ফরাসি সাহিত্যের বাঙালি পরিগ্রহণ : রবীন্দ্রনাথ
পুষ্কর দাশগুপ্ত
১. প্রস্তাবনা
রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ না টেনে বাংলাসাহিত্যে কোনো দিক সম্পর্কে আলোচনাই সম্পূর্ণ করা যায় না। বাংলাভাষায় ফরাসি সাহিত্যে চর্চার ইতিবৃত্তে আরো বৃহত্তর পরিধিতে বাঙালির ফরাসি সংস্কৃতির পরিগ্রহণে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাকে বাদ দেওয়া যায় না।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘হিং টিং ছট’ (১৮৯২) কবিতায় ইয়োরোপীয় (ইংরেজ) যবন পণ্ডিতের পাশাপাশি মধ্যে কৌতুকপ্রিয়, ভদ্র, শ্লেষ ও যমক সৃস্টিতে চতুর ফরাসি পণ্ডিতের যে বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে শিক্ষিত বাঙালির কল্পনায় ইয়োরোপীয় চরিত্রের উগ্রমূর্তি সাধারণকল্পরূপের পাশে তুলনামূলকভাবে ফরাসি চরিত্রের কল্পরূপ বা ভাবমূর্তি উপস্থাপিত হয়েছে :
ফরাসি পণ্ডিত ছিল, হাস্যোজ্জ্বলমুখে
কহিল নোয়ায়ে মাথা, হস্ত রাখি বুকে,
“স্বপ্ন যাহা শুনিলাম রাজযোগ্য বটে;
হেন স্বপ্ন সকলের অদৃষ্টে না ঘটে।
কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান
যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান।
অর্থ চাই, রাজকোষে আছে ভূরি ভূরি
রাজস্বপ্নে অর্থ নাই, যত মাথা খুঁড়ি।
নাই অর্থ কিন্তু তবু কহি অকপট,
শুনিতে কী মিষ্ট আহা, হিং টিং ছট্।‘
২.আমাদের উদ্দেশ্য
এখানে আমাদের উদ্দেশ্য কয়েকটি প্রশ্নের আলোচনার পর ফরাসি সাহিত্য থেকে রবীন্দ্রনাথের বিরল অনুবাদের উপস্থাপনার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের ফরাসি সাহিত্যের (বৃহত্তর পরিধিতে ফরাসি সংস্কৃতির) পরিগ্রহণ ও তার চরিত্র এবং স্বরূপ নির্ধারণ। প্রথমে আলোচ্য হল:
১. রবীন্দ্রনাথ কি ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন বা জানতেন? অর্থাৎ তাঁর ফরাসি সাহিত্যের পরিগ্রহণকে (Reception) প্রত্যক্ষ (ফরাসি ভাষায়) বা পরোক্ষ (ইংরেজি অনুবাদ–মাধ্যম) কোন শ্রেণীতে ফেলা যায়?
২.তাঁর চিঠিপত্র তথা বিভিন্ন রচনা থেকে রবীন্দ্রনাথ কোন কোন ফরাসি সাহিত্যকার বা/এবং কোন কোন ফরাসি সাহিত্যকৃতি পড়েছিলেন তা নির্ধারণ করা। তবে স্পষ্ট নাম উল্লেখ না থাকলেও পারিপার্শ্বিক উপাদান (নিদর্শন, স্বাক্ষ্য, প্রমাণ) থেকে কোনো ফরাসি সাহিত্যকার বা ফরাসি সাহিত্যকৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচিতির উপপ্রমেয় তৈরি করা যায় কিনা তা দেখা।
৩. আন্তঃরাচনিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনা কোনো ফরাসি সাহিত্যকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা তা পরীক্ষা করা। ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনায় তথাকথিত ‘ফরাসি প্রভাবের’ কথা কেউ কেউ বলেছেন, কট্টর রবীন্দ্র–ভক্তরা তা উড়িয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হল: ক.) শিল্পসৃষ্টিতে দৃষ্টবাদী (positivist) সাবেকি ‘প্রভাবতত্ত্ব’ আমাদের কাছে গ্রহণীয় বলে মনে হয় নি। ‘প্রভাবতত্ত্বে’ ভাবা হয় তন্ত্র (system) ‘খ’ ও তন্ত্র ‘ক’–এর মধ্যে যোগাযোগের পরিণামে তন্ত্র ‘খ’ তন্ত্র ‘ক’–এর ওপর কিছু উপাদান চাপিয়ে দেয় অর্থাৎ ‘খ’ ‘ক’–কে প্রভাবিত করে। খ.) সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যা ঘটে তা হল ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক কারণে তন্ত্র ‘খ’ ও তন্ত্র ‘ক’–এর মধ্যে যোগাযোগের পরিণামে তন্ত্র ‘ক’ তার সংস্থান (structure) আর ঐতিহাসিক প্রয়োজন অনুসারে তন্ত্র ‘খ’–এর কাছ থেকে নির্বাচিত কিছু উপাদান গ্রহণ করে তার রূপান্তর তথা আত্তীকরণ করে। বস্তুত প্রতিটি সংস্কৃতির মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে একদিকে অতিসাংস্কৃতিকতা (দ্বিতীয় কোনো সংস্কৃতিতে সাংস্কৃতিক উপাদানের সংপ্রেষণের ক্ষমতা) অন্যদিকে আন্তঃসাংস্কৃতিকতা (তার সংস্থান আর ঐতিহাসিক প্রয়োজন অনুসারে দ্বিতীয় কোনো সংস্কৃতি থেকে নির্বাচিত কিছু সাংস্কৃতিক উপাদানের পরিগ্রহণ করে তার রূপান্তর তথা আত্তীকরণের ক্ষমতা) এই প্রক্রিয়ার পরিণামে প্রতিটি সংস্কৃতিতে অন্তর্নিহিত রয়েছে সাংস্কৃতিক বহুস্বর। আর একই ভাবে প্রতিটি রচনায় রয়েছে একদিকে অতিরাচনিকতা (দ্বিতীয় কোনো রচনাতে রাচনিক উপাদানের সংপ্রেষণের ক্ষমতা) অন্যদিকে আন্তঃরাচনিকতা (তার সংস্থান আর প্রয়োজন অনুসারে দ্বিতীয় কোনো রচনা থেকে নির্বাচিত কিছু রাচনিক উপাদানের পরিগ্রহণ তথা তার রূপান্তর তথা আত্তীকরণের ক্ষমতা) এর ফলে প্রতিটি রচনার মধ্যে অন্তর্নিহিত একাধিক রচনার কণ্ঠস্বর বা রাচনিক বহুস্বর। তাই রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো রচনায় তথাকথিত ‘ফরাসি প্রভাবের’ পরিবর্তে কোনো ফরাসি রচনার আন্তঃরাচনিক সম্ভাব্য উপস্থিতিও আমাদের আলোচ্য।
২.১.. রবীন্দ্রননাথ কি ফরাসি ভাষা জানতেন ?
বহুকাল আগে ‘দেশ’ (২০ জুন, ১৯৭০) পত্রিকায় অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরি রবীন্দ্রনাথের ফরাসি–চর্চা বিষয়ক একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ফরাসি ভাযা জানতেন কি না এনিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল রবীন্দ্রননাথ ফরাসি ভাযা জানতেন তবে আমাদের কাছে বিতর্কটা অবান্তর। ১৯০০ সালে (৯ অক্টোবর) শিলাইদহ থেকে ফরাসি–বিদ্ বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন:
ব্যাকরণ ঘেঁটে ফরাসী শেখা আমার কর্ম্ম নয় — একটা বই দিয়ো। আমার লাইব্রেরীতে যে যে ফরাসী গ্রন্থের তর্জ্জমা আছে তারই কোন একটার original পেলে সুবিধা হয় ৷
বোঝা যাচ্ছে ফরাসি ভাষা শেখার অস্পষ্ট ইচ্ছা থাকলেও বিধিবদ্ধ কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করে ঐ ভাযা আয়ত্ত করার কোনো তাগিদ রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেন নি। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের রচনাতে তাঁর সে অর্থে ফরাসি ভাষায় জ্ঞান বা ব্যুৎপত্তির কোনো পরিচয় নেই। তবে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্বে, তাঁর প্রথম যৌবনে, রবীন্দ্রনাথের চারপাশে তাঁর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন যাঁরা ফরাসি ভাষা জানতেন আর যাঁরা ছিলেন ফরাসি সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক। এঁরা হলেন তাঁর অগ্রজ ভাই (মেজদা) সত্যেন্দ্রনাথ, (সেজদা) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বন্ধু আশুতোষ চৌধুরি, প্রিয়নাথ সেন, লোকেন্দ্রনাথ পালিত। রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে (৬ মে ১৯০০) প্রিয়নাথ সেন লিখছেন:
ভারতীতে কি চমৎকার গল্পই আরম্ভ করেচ…গল্পটি বলার ধরণ সমস্ত হাব ভাব Gautierএর উপযুক্ত। তোমার ফরাসীভাষা জানা থাকলে অনেক মহাত্মা তোমার মৌলিকতায় সন্দেহ কর্ত্ত। আমাদের বাঙ্গালী মহাশয়েরা এসব বিষয়ে বড়ই উদার।
এ চিঠিও প্রমাণ করে যে রবীন্দ্রনাথ ফরাসি ভাযা জানতেন না। আবার ১৯২২ সালে মোলিয়ের–এর জন্মের তিন শ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের উক্তি এই বক্তব্যের সমর্থক:
আমি মোলিয়্যারের বিষয়ে অনভিজ্ঞ, তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জানি, তা জ্যোতিদাদার বাংলা অনুবাদ ও সমালোচনার ভিতর দিয়ে হয়েছে ; আর বোধ হয় মোলিয়্যারের ইংরাজা অনুবাদও কিছু কিছু পড়েচি।…
এছাড়া প্রমথ চৌধুরীকে লেখা একাধিক চিঠির সাক্ষ্য একই কথা প্রমাণ করে। ১৯১৭ সালে প্রমথ চৌধুরীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :
তোমাকে একখানি ফরাসী বই পাঠাচ্চি। এখানি একজন ইংরেজ অধ্পক খুব প্রসংশা করে আমাকে পাঠিয়েছিলেন — বলেছিলেন এ বই আমার পড়া উচিত। কিন্তু এই কর্ত্তব্যটি পালন করা কেন আমার পক্ষে কঠিন সে কথা তোমার কাছে গোপন নেই।…
প্রমথ চৌধুরীকে আরেকটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন:
ফরাসী চিঠি গুলি আমাকে তর্জ্জমা করে পাঠাতে পারবে কি জবাব দিতে হবে।
১৯৩০ সালে লেখা একটা চিঠিতে রয়েছে:
বিবিকে একটা ফরাসী কাগজ থেকে আমার সম্বন্ধীয় একটা আলোচনা তর্জ্জমা করতে পাঠিয়েছি… [বিবি রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রমথ চৌধুরীর স্ত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর ডাক নাম] ৷
এসব প্রমাণ থেকে আমাদের দ্বিধাহীন সিদ্ধান্ত হল রবীন্দ্রনাথ ফরাসি ভাষা জানতেন না।বস্তুত বেশির ভাগ ইয়োরোপীয় সাহিত্যের বাঙালি পাঠক–পরিগ্রাহকের মতো রবীন্দ্রনাথেরও ফরাসি সাহিত্য পাঠের মাধ্যম ছিল (প্রধানত ইংরেজি) অনুবাদ অর্থাৎ তাঁর ফরাসি সাহিত্যের পরিগ্রহণের প্রণালী ছিল পরোক্ষ।
২,২. রবীন্দ্রনাথ যেসব ফরাসি লেখক বা/এবং রচনার উল্লেখ করেছেন
২.২.১. বের্নাদ্যাঁ দ স্যাঁ–পিয়ের
অবোধবন্ধু পত্রিকায় (১৮৬৮–১৮৬৯ সালে) ধারাবাহিকভাবে বের্নাদ্যাঁ দ স্যাঁ–পিয়ের–এর (Jacques-Henri Bernardin de Saint-Pierre, ১৭৩৭–১৮১৪) উপন্যাস ‘পল ও ভির্জিনি’ (Paul et Virginie, ১৭৮৭) ‘পৌলবর্জ্জিনী’ শিরোনামে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য কৃত বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়।বালক রবীন্দ্রনাথ ঐ রচনা পড়ে মুগ্ধ হন। ‘আধুনিক সাহিত্য’ গ্রন্থে সংকলিত ‘বিহারীলাল’ (১৮৯৪) প্রবন্ধে তিনি লিখছেন:
এখনো মনে আছে ইস্কুল ফাঁকি দিয়া একটি দক্ষিণদ্বারী ঘরে সুদীর্ঘ নির্জন মধ্যাহ্নে অবোধবন্ধু হইতে পৌল–বর্জিনীর বাংলা অনুবাদ পাঠ করিতে করিতে প্রবল বেদনায় হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। তখন কলিকাতার বহির্বর্তী প্রকৃতি আমার নিকট অপরিচিত ছিল এবং পৌল–বর্জিনীতে সমুদ্রতটের অরণ্যদৃশ্যবর্ণনা আমার নিকট অনির্বচনীয় সুখস্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাত হইত, এবং সেই তরঙ্গঘাতধ্বনিত বনচ্ছায়াস্নিগ্ধ সমুদ্রবেলায় পৌল–বর্জিনীর মিলন এবং বিচ্ছেদবেদনা হৃদয়ের মধ্যে যেন মূর্ছনাসহকারে অপূর্ব সংগীতের মতো বাজিয়া উঠিত।
পরে ‘জীবনস্মৃতিতেও’ (১৯১২) রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছেন:
বাল্যকালে আর–একটি ছোটো কাগজের পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম। তাহার নাম অবোধবন্ধু।… এই অবোধবন্ধু কাগজেই বিলাতি পৌলবর্জিনী গল্পের সরস বাংলা অনুবাদপড়িয়া কত চোখের জল ফেলিয়াছি তাহার ঠিকানা নাই ।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ফরাসি সাহিত্যের এই প্রথম পরিচয় ।
২.২.২ মোলিয়ের .
তারপর রবীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনে, তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্বেপ্রধানত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে ঠাকুরবাড়ি থেকে ভারতী পত্রিকা প্রকাশিত হয় (১৮৭৭)। প্রথম থেকেই ঐ পত্রিকায় ইয়োরোপীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতীর চতুর্থ বর্ষে ( ১৮৮০–১৮৮১) পাঁচটি সংখ্যায় ‘দোকানদার বড়লোক বা হঠাৎ নবাব’ শিরোনামে (পরবর্তীকালে পুস্তকাকারে শিরোনাম ‘হঠাৎ নবাব’, ১৮৮৪) মোলিয়ের–এর ‘ল বুর্জোয়া জঁতিইঅম’ (Le Bourgeois gentilhomme) নাটকের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯০২ সালে ঐ ভারতী পত্রিকায় ‘দায়ে পড়ে দারগ্রহ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কৃত মোলিয়ের–এর ‘ল মারিয়াজ ফোর্সে’(Le Mariage forcé) নাটকের অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথ যে মোলিয়ের–এর নাটকের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮৮২ সালের ‘ভারতী’ পত্রিকার গ্রন্থসমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন:
প্রিয়নাথ সেনকে শিলাইদহ থেকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একাধিক চিঠিতে মোলিয়ের–এর প্রসঙ্গ এসেছে:
সুরেন ইতিমধ্যে Newmanদের ওখানে মোলিয়ের অর্ডর দিয়ে এসেছে তারা পাঁচ ছ দিনের মধ্যে পাঠাবে এমন আশ্বাস দিয়েছে।… (৮ অগাস্ট ১৯০০)
তুমি ত কাল বৃহস্পতিবারে এলে না…তখন মোলিয়েরের যশস্বী জুর্দ্যাঁর মহাবাক্য স্মরণ করে বলবে প্রায় ৪০ বছর লোকটাকে দেখে আসছি কিন্তু জানতাম না ইনি এত বড় ইনি।…(১০ অগাস্ট ১৯০০)
যেটা পছন্দ হয় ঠিক কোরো। Molière ? (তারিখ নেই)
Molière রচিত L’Avare নামক একটি নাটক Fasnach দ্বারা edited বেলার পড়ার জন্য চাই — এর ওখানে আমার হয়ে অর্ডর দিয়ে দেবে।…(১৭ অগাস্ট ১৯০০)
এছাড়া শান্তিনিকতনে ছাত্রদের সংস্থা বিশ্বভারতী সম্মিলন ১৯২২ সালে মোলিয়ের–এর জন্মের তিন শ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তার সভাপতি হিসেবে তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথ মোলিয়ের–এর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেন :
আমি মোলিয়্যারের বিষয়ে অনভিজ্ঞ, তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জানি, তা জ্যোতিদাদার বাংলা অনুবাদ ও সমালোচনার ভিতর দিয়ে হয়েছে ; আর বোধ হয় মোলিয়্যারের ইংরাজা অনুবাদও কিছু কিছু পড়েচি।…
উল্লিখিত বিভিন্ন উপাদান মোলিয়ের–এর রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের নিদর্শন।
২.২.৩ পাস্কাল
১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধসংকলন ‘ববিধ প্রসঙ্গ’ প্রকাশিত হয়, এই রচনাগুলির একটি বাদ দিয়ে সবগুলিই ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যখন ভারতীতে রচনাগুলি প্রকাশিত হতে শুরু করে (১৮৮১) তখন একটা মুখবন্ধ ছিল (যা বইতে পরিত্যক্ত হয়েছিল), ঐ মুখবন্ধে তিনি লেখেন:
স্মরণ হইতেছে ফরাসীস পণ্ডিত প্যাস্কাল এক দীর্ঘ পত্র লিখিয়া অবশেষে উপসংহারে লিখিয়াছেন,— “মার্জ্জনা করিবেন, সময় অল্প থাকাতে বড় চিঠি লিখিতে হইল, ছোট চিঠি লিখিবার সময় নাই।” আমাদের হাতে যখন বিশেষ সময় থাকিবে তখন মাঝেমাঝে সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ পাঠকদের উপহার দিব।
এই মন্তব্য ও ‘বিবিধ প্রসঙ্গের’ নাতিদীর্ঘ রচনাগুলির রচনাভঙ্গী থেকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ পাস্কাল–এর ( Blaise Pascal, ১৬২৩– ১৬৬২ ) রচনা ‘চিন্তা’–র সঙ্গে অপরিচিত ছিল না।
২.২.৪. গোতিয়ে
বিভিন্ন রচনা আর চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তেয়োফিল গোতিয়ে–র (Théophile Gautier, ১৮১১–১৮৭২) উল্লেখ দেখা যায়। ১৮৮৩ সালে প্রিয়নাথ সেনকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন:
মেজদাদার Mademoiselle de Maupinখুবই ভালো লাগচে। কাল এসে সব শুনবেন।
এর কিছুদিন পরে তিনি আবার লেখেন:
Mademoiselle de Maupinমেজদার পড়া হয়ে গেছে। তাঁর খুব ভালো লেগেছে। …তিনি… বলেচেন, আপনার যদি আপত্তি না থাকে ত কোন সুপাঠ্য ফরাসী গ্রন্থ তাঁকে পাঠিয়ে দিলে তিনি বাধিত হন।
রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ফরসি ভাষা জানতেন, তাই মনে হয় এ বইটি ছিল ফরাসিতে। মনে হয় প্রিয়নাথ সেন আর মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের প্রশংসা শুনে রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ পড়েন। প্রিয়নাথ সেনকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন:
… Mademoiselle সম্বন্ধে দেখা হলে জানাব।
‘সাহিত্য’ (১৯০৭) গ্রন্থে লোকন্দ্রনাথ পালিতকে লেখা চারটি পত্র (ফাল্গুন ১২৯৮ ১৮৮২) স্থান পেয়েছে। এই পত্রগুলি এবং লোকেন্দ্রনাথের উত্তর সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের পত্রগুলি ‘সাহিত্য’ গ্রন্থে ‘আলোচনা’ ‘সাহিত্য’ ‘সাহিত্যের প্রাণ’ ও ‘মানবপ্রকাশ’ শিরোনামে সংকলিত হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রে রবীন্দ্রনাথ ফরাসি কবি তেওফিল গোতিয়ে–র (Théophile Gautier১৮১১–১৮৭২) ‘মাদমোয়াজেল দ মোপ্যাঁ’ (Mademoiselle Maupin, ১৮৩৫) উপন্যাসের সমালোচনা করেছেন।সাহিত্যের সত্য কী — এই প্রশ্নের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যসের প্রসঙ্গ এনেছেন। উপন্যাসটি তিনি পড়েছিলেন ইংরেজি অনুবাদে ৷
…ফরাসি কবি গোতিয়ে রচিত “মাদ্মোয়াজেল দ্য মোপ্যাঁ‘ প‘ড়ে (বলা উচিত আমি ইংরাজি অনুবাদ পড়েছিলুম) আমার মনে হয়েছিল, গ্রন্থটির রচনা যেমনই হোক তার মূলতত্ত্বটি জগতের যে অংশকে সীমাবদ্ধ করেছে সেইটুকুর মধ্যে আমরা বাঁচতে পারি নে। গ্রন্থের মূল–ভাবটা হচ্ছে, একজন যুবক হৃদয়কে দূরে রেখে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেশদেশান্তরে সৌন্দর্যের সন্ধান করে ফিরছে। …এই বিশ্বব্যাপী সত্যকে সংকীর্ণ করে আনাতে পূর্বোক্ত ফরাসী গ্রন্থে সাহিত্যশিল্পের প্রাচুর্য–সত্ত্বেও সাহিত্যসত্যের স্বল্পতা হয়েছে বলা যেতে পারে।
এ সম্পর্কে বলা দরকার ‘মাদমোয়াজেল দ মোপ্যাঁ’–র মুখবন্ধে গোতিয়ে তাঁর ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ (লার পুর লার/L’art pour l’art) তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। তাই সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের স্বভাবতই এই উপন্যাসটির প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। আর গোতিয়ে–র ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ ভিত্তিক রচনাতত্ত্বের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পাবে না এটাই স্বাভাবিক।
২.২.৫ জোলা
প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ এমিল জোলা (émile Zola, ১৮৪০–১৯০২ ) তথা প্রকৃতিবাদী সাহিত্যতত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন।
... সুবৃহৎ অনাবরণের মধ্যে অশ্লীলতা নেই। এইজন্যে শেক্স্পীয়র অশ্লীল নয়, রামায়ণ মহাভারত অশ্লীল নয়। কিন্তু ভারতচন্দ্র অশ্লীল, জোলা অশ্লীল; কেননা তা কেবল আংশিক অনাবরণ।…
২.২.৬ আনাতোল ফ্রঁস
আরো কিছু রচনায় আরো কয়েকজন ফরাসি লেখকের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন। ১৯০০ সালে (৫ অক্টোবর) শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রিয়নাথ সেনকে লিখছেন:
ভেবে চিন্তে দুচার রকমের পড়বার বই থাকলে নিয়ে এস। Le crime de Sylvestre Bonard নামক Anatole Franceএর ফরাসী বই যদি তোমার কাছে বা কোনো দোকানে থাকে আমাকে পাঠাতে পার?
পরবর্তীকালে ‘কালান্তর’ (১৯৩৭) প্রবন্ধ–সংকলনে ‘বাতায়নিকের পত্র’ (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ মে–জুন ১৯১৯) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি অনুবাদে চিন ও চিনাদের সম্বন্ধে আনাতোল ফ্রঁস–এর (Anatole France, ১৮৪৪–১৯২৪) মতামত উপস্থাপিত করেছেন:
জগদবিখ্যাত ফরাসী–লেখক আনাতোল ফ্রাঁস লিখছেন….
২.২.৭ রেনঁ
একাধিক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ফরাসী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এর্নেস্ত রেনঁ–র (Ernest Renan, ১৮২৩–১৮৯২)উল্লেখ করেছেন:
নেশন ব্যাপারটা কী, সুপ্রসিদ্ধ ফরাসী ভাবুক রেনাঁ এই প্রশ্নের আলোচনা করিয়াছেন।…এক্ষণে রেনাঁর সারগর্ভ বাক্যগুলি আমাদের দেশের প্রতি প্রয়োগ করিয়া আলোচনার জন্য প্রস্তুত হওয়া যাক। (নেশন কী, শ্রাবণ ১৩০৮, কালান্তর)
২.২.৮ ভিক্তর য়ুগো
‘সাহিত্যের গৌরব’ (১৮৯৪) প্রবগ্ধটি সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত এবং ‘সাহিত্য’ (১৯০৭) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। হাঙ্গেরির লেখক ‘মৌরস য়োকাই’–এর সাহিত্য–চর্চার পঞ্চাশ বার্ষিক উত্সব–বিবরণের উল্লেখ করে তিনি বঙ্গ সাহিত্যের গৌরবের অভাবের জন্য আক্ষেপ করেছেন।এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে :
‘সেই উত্সব বিবরণ পাঠ করিলে তাহার সহিত আমাদের দেশে বঙ্কিমচন্দ্রের বিয়োগ–জনিত শোকপ্রকাশের তুলনা স্বতই মনে উদয় হয় ৷
ভিক্টর হ্যুগোর মৃত্যুর পর সমস্ত ফ্রান্স কিরূপ শোকাকুল হইয়াছিল বর্তমান প্রসঙ্গে সে কথা উত্থাপন করিতে লজ্জা বোধ হয়; কারণ ফ্রান্স ইয়োরোপের শীর্ষস্থানীয়। বীরপ্রসবিনী হাঙ্গেরির সাহিতও নির্জীব বঙ্গদেশের তুলনা হইতে পারে না; তথাপি অপেক্ষাকৃত অসংকোচে তাহার নামোল্লেখ করিতে পারি ৷’
ভিক্তর য়ুগোর (Victor Hugo, ১৮০২–১৮৮৫) মৃত্যুর (১৮৮৫) মৃত্যুর ন বছর পরে বঞ্চিমচন্দ্রের মৃত্যুর বছর (১৮৯৪) ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত এ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশে সাহিত্যে গৌরবের অভাবের জন্য আক্ষেপের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ফ্রান্সের সাহিত্য–মনস্কতার প্রতি শ্রদ্ধ্য প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘সাহিত্যের পথে’ প্রন্থে সংকলিত ‘সাহিত্যরূপ’ (১৯২৮) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের য়ুগো সম্পর্কিত মন্তব্য তাঁর শ্রদ্ধার পরিচায়ক।দান্তে ও গ্যেটের সঙ্গে এখানে য়ুগোর নাম উচ্চারিত হয়েছে : ‘…দান্তে, গ্যটে, ভিক্টর হ্যুগো আপন রূপের জগৎ সৃষ্টি করে করে গেছেন ৷…সাহিত্যে এই নব নব রূপস্রষ্টার সংখ্যা বেশি নয়।’
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি প্রিয়নাথ সেন তথা রবীন্দ্রনাথের পরিচিত ফরাসি সাহিত্যে মনোযোগীদের মধ্যে য়ুগো আর তাঁর ‘অনুধ্যান’ (লে কোঁতঁপ্লাসিওঁ/Les Contemplations) কাব্যগ্রন্থের পরিচিতি নির্দেশ করে। রবীন্দ্রনাথ (যৌবনে) যে ছটি ফরাসি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন, জ্যেতিরিন্দ্রনাথও একই কাব্যগ্রন্থ থেকে কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন।
২.২.৮. অজ্ঞাতনামা ফরাসি ভ্রমণকারী
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ‘ছিন্নপত্রাবলী’–তে সংকলিত ১৬৫ সংখ্যক পত্রে (বোলপুর থেকে লিখিত, ২৯ অক্টোবর ১৮৯৪) রবীন্দ্রনাথের ফরাসি চরিত্রের প্রতি বিশেষ মনোযোগী অভিমত রয়েছে :
‘কাল কেবল বিছানায় উপুড় হয়ে একখানি ছোটো কবিতা লিখেছি এবং একটি তিব্বত–ভ্রমণের বই পড়েছি। …ভ্রমণকারী একটি ফরাসি, সেই জন্যে সে ভ্রমণ করতেও জানে এবং লিখতেও জানে।…কোনো ইংরাজ ভ্রমণকারী এই sensation of the desert-কে ঠিক সুখকর বলে মনে করত কিনা আমি সন্দেহ করি।ইংরাজ ভ্রমণকারীদের যতগুলো বই পড়েছি প্রায় সবগুলোতেই তাদের উদ্ধত পাশব প্রকৃতির এবং আত্মাভিমানের পরিচয় পাওয়া যায়। তারা অন্য জাতের প্রতি সুবিচার করতে এবং ভালোবাসা দিতে পারে না ৷’
অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ভ্রমণকাহিনির লেখকের নাম উল্লেখ করেন নি।
২.২,৯/১০. আমিয়েল ও জুবের
এছাড়া দুজন ফরাসি ভাযার লেখকের রচনা রবীন্দ্রনাথকে বিশেযভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এঁরা হলেন: উনিশ শতকের ফরাসিভাষী সুইস দার্শনিক ফ্রেদেরিক আমিয়েল (Frédéric Amiel, ১৮–২১–১৮৮১) ও অষ্টাদশ শতকের ফরাসি চিন্তাবিদ জোজেফ জুবের (Joseph Joubert, ১৭৫৪–১৮২৪) ।
২.২,৯ আমিয়েল
ফরাসিভাষী সুইস কবি ও লেখক আমিয়েল–এর ‘অন্তরঙ্গ ডাইরি’ (জুর্নাল অ্যাঁতিম/Journal intime) বিখ্যাত রচনা। আর এ গ্রন্থটি ছিল রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় গ্রন্থ। ‘ছিন্নপত্রাবলীর’ একটি চিঠিতে (পত্র সংখ্যা ১০১, পতিসর বুধবার ২২ মার্চ, ১৮৯৪) রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :
‘…আমার একটি নির্জনের প্রিয়বন্ধু জুটেছে — আমি লো [কেনে]র ওখেন থেকে তার এখানা Amiel’s Journal ধার করে এনেছি — যখনি সময় পাই বইটা উল্টপাল্টে দেখি।ঠিক মনে হয় তার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে কথা কাচ্ছি — এমন অনতরঙ্গ বন্ধু আর খুব অল্প ছাপার বইয়ে পেয়েছি। অনেক বই এর চেয়ে ভালো লেখা আছে এবং এ বইয়ের অনেক দোষ থাকতে পারে, কিন্তু এ বই আমার মনের মতো বই। অনেক সময় আসে যখন সব বই ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফেলে দিতে হয়, কোন বই ঠিক আরামের বোধ হয় না — যেমন রোগের সময় অনেক সময় বিছানায় ঠিক আরামের অবস্থাটি পাওয়া যায় না, নানা রকমে পাশ ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে, কখনো বালিশের ঔপর বালিশ চাপাই, কখনো বালিশ ফেলে দিই — সেই রকম মানসিক অবস্থায় আমিয়েলের যেখানেই খুলি সেখানেই মাথাটি ঠিক গিয়ে পড়ে, শরীরটা ঠিক বিশ্রাম পায়।আমার সেই অস্তরঙ্গ বন্ধু আমিয়েল পশুদের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে একজায়গায় লিখেছে — [বলুর] লেখায় আমি সেইটে সমস্তটা নোট বসিয়ে দিয়েছি ৷’
এই জাতীয় উচ্ছ্বাসপূর্ণ অভিমত আ র কোনো ফরাসি লেখক সম্পর্কেই রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেন নি ৷
‘
২.২,১০. জুবের
আধুনিক সাহিত্য’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত (১৩০৮ বৈশাখ/১৯০১) ‘জুবেয়ার’ শীর্ষক রচনাটি আছে। নিবন্ধের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ জুবের–এর পরিচয় দিয়েছেন :
রসজ্ঞ ম্যাথ্যু আর্নলড্ ফরাসি ভাবুক জুবেয়ারের সহিত ইংরাজি–পাঠকদের পরিচয় করাইয়া দেন।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন ফরাসি চিন্তাবিদ জুবের–এর মৃত্যুর পর ১৮৪২ সালে তাঁর রচনা সংকলন ‘চিন্তা, নিবন্ধ ও সুভাষিত’ (পঁসে, এসে, মাক্সিম/ Pensées, essais, maximes) প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:
যখন যাহা মনে আসিত জুবেয়ার তাহা লিখিতেন কিন্তু প্রকাশ করিতেন না। তাঁহার রচনা প্রবন্ধরচনা নহে, এক–একটি ভাবকে স্বতন্ত্ররূপে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা। পদ্যে যেমন সনেট, যেমন শ্লোক, গদ্যে এই লেখাগুলি তেমনি।
এই জাতীয় রচনার ধারা ফরাসি সাহিত্যে সপ্তদশ শতক থেকে চলে আসছে।সপ্তদশ শতকে পাস্কাল–এর (Blaise Pascal, ১৬২৩– ১৬৬২) ‘চিন্তা’ (পঁসে Pensées) এবং লা রশফুকো–র (François de La Rochefoucauld, ১৬১৩–১৬৮০) ‘সুভাষিতাবলী’ (মাক্সিম/Maximes) এবং অস্টাদশ শতকে ভোভনার্গ–এর ( Luc de Clapiers, marquis de Vauvenargues, ১৭১৫–১৭৪৭) সুভাষিতগুলি এই জাতীয় রচনার বিখ্যাত নিদর্শন। জুবের–এর রচনার প্রকাশ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
জুবেয়ারের বাক্সে দেরাজে এই লেখা কাগজসকল স্তূপাকার হইয়া ছিল; তাঁহার মৃত্যুর চোদ্দ বৎসর পরে এগুলি ছাপা হয়; তাহাও পাঠকসাধারণের জন্য নহে, কেবল বাছা বাছা অল্প গুটিকয়েক সমজদারের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ জুবের–এর সাহিত্য ও রচনাকলা সম্পর্কিত উক্তির ‘এক অঞ্জলি সংগ্রহ কবিয়া পাঠককে উপহার’ দিয়েছেন। এই উক্তিগুলির সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য, ব্যাখ্যা বা মতামত। উক্তিসমূহ ইংরেজি অনুবাদ থেকে অনূদিত। ইংরেজি শব্দের ও একটি বাক্যের ব্যবহার তারপ্রমাণ : ‘সংগতি শব্দের পাশে বন্ধনীর মধ্যে দেওয়া হয়েছে harmonyশব্দ, আর অন্যত্র রয়েছে ‘স্টাইলের চালাকিতে ভুলিয়ো না, beware of tricks of style’ ‘মূলে যে কথা আছে তাহার ইংরেজী প্রতিশব্দ soul ৷’ এই বাক্য থেকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ হয়ত মূল সম্পর্কে ফরাসিবিদ কোনো ব্ন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
২.২,১১. আধুনিক ফরাসি সাহিত্য
ফরাসি আধুনিক সাহিত্য–আন্দোলন বা আধুনিক কবিতার প্রতি আকর্ষণ বোধ করা মানসিকতার কারণে রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর্জেন্টাইন বিদূষী ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো (Victoria Ocampo,১৮৯০–১৯৭৯) তাঁকে বোদলের–এর (CharlesBaudelaire, ১৮২১–১৮৬৫) বিখ্যাত কবিতা ‘ভ্রমণের ডাক’ (Invitation au voyage) ফরাসিতে পড়ে ইংরেজি অনুবাদ করে শোনান। বোদলের–এর ঐ কবিতা রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগে নি, বোদলের তাঁর কাছে ‘আসবাবপত্রের কবি’ বলে মনে হয়। আসলে যে বৌদ্ধিক পরিবেশ ও সাহিত্য পাঠের শিক্ষা তথা ইতিহাস রবীন্দ্রনাথের মানসিকতা আর প্রত্যাশার দিগন্ত গড়ে উঠেছিল তাতে তাঁর পক্ষে আধুনিক কবিতার পরিগ্রহণ সম্ভব ছিল না। এই একই কারণে ইয়োরোপের ফ্রান্সের আধুনিক সাহিত্য বা/এবং কাব্য–আন্দোলন তিনি কোনো কৌতুহল বোধ করেন নি । ‘সাহিত্যের পথে’ গ্রন্থে (১৯৩৫) সংকলিত ১৯২৭ সালে লেখা ‘সাহিত্যে নবত্ব’( প্লান্সিউজ জাহাজ, ২৩ অগষ্ট ১৯২৭ ) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ‘দাদা’ Dadaআন্দোলনকেআক্রমণ করেছেন। ভারতীয়/বাঙালি রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এই ধ্বংসাত্মক ও নেতিবাচক বিদ্রোহ বা আন্দোলনকে সমর্থন করা অথবা যে জাতীয় ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বা মনোভাব এই জাতীয় আন্দোলনের উৎস তা উপলব্ধি করা স্বভাবতই অসম্ভব ছিল। তাছাড়া রূপকাত্মক কাব্যিক ভাষায় দাদার যে চরিত্র রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন তা দাদার বাইরের চেহারার অস্পষ্ট আভাস দিলে দাদার ইস্তাহার বা দাদাবাদীদের লেখার সঙ্গে সে অর্থে কোনো পরিচয় ছিল বলে মনে হয় না :
আলো যখন ক্ষীণ হয়ে আসে তখনি অদ্ভূতের প্রাদুর্ভাব হয়। ….বস্তুত সাহিত্যের সায়াহ্নে কল্পনা ক্লান্ত হয়ে আসে ব‘লেই তাকে বিকৃতিতে পেয়ে বসে… ভাষাটাকে বেঁকিয়ে–চুরিয়ে, অর্থের বিপর্যয় ঘটিয়ে, ভাবগুলোকে স্থানে অস্থানে ডিগবাজি খেলিয়ে, পাঠকের মনকে পদে পদে ঠেলা মেরে, চমক লাগিয়ে দেওয়াই সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ।…সেই চরমের নমুনা য়ুরোপীয় সাহিত্যের ডাডায়িজ্ম্। … আলাপের সহজ শক্তি যখন চলে যায় সেই বিকারের দশায় প্রলাপের শক্তি বেড়ে ওঠে। …য়ুরোপের সাহিত্যে চিত্রকলায় এই–যে বিহ্বলতা ক্ষণে ক্ষণে ও স্থানে স্থানে বীভৎস হয়ে উঠছে এটা হয়তো একদিন কেটে যাবে, যেমন ক‘রে বলিষ্ঠ লোক মারাত্মক ব্যামোকেও কাটিয়ে ওঠে।
তাছাড়া এখানে উল্লেখ করা দরকার যে রবীন্দ্রনাথ যখন এই প্রব্ন্ধ লিখেছেন (১৯২৭) তখন দাদা–র প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ অবসিত । দাদার চমকের পর ১৯২৪ থেকে ১৯৩৭ সাল স্যুররেআলিসম্–এর আত্মস্থ সন্ধানের কাল। দাদার বিশেষ কোনো প্রভাব ফরাসি সাহিত্যে স্থায়ী হয় নি। যদি কিছু প্রান্তিক প্রভাব আবার দেখা দিয়ে থাকে তা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে, লেত্রিস্ত আন্দলন বা যাটের দশকের স্পাসিয়ালিস্ত (কংক্রীট) কবিতায় ৷
৩. রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনা কি কোনো ফরাসি সাহিত্যকৃতির সঙ্গে আন্তঃরাচনিক সূত্রে সম্পর্কিত ?
রবীন্দ্রনাথের কোনো (এক বা একাধিক) রচনা আন্তঃরাচনিক সূত্রে ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা তা পরীক্ষা করতে গিয়ে কয়েকটা কথা আমাদের মনে হয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা বলেছি প্রথাগত প্রভাবতত্ত্ব আমাদের কাছে গ্রহণীয় বলে মনে হয় নি। অন্যদিকে উনিশ শতকের আগে অব্দি বাংলা সাহিত্যের আন্তঃরাচনিকতার পরিধি ছিল সংস্কৃত, আরবি–ফারসি, ও আধুনিক ভারতীয় হিন্দুস্থানি, অহমিয়া ও ওড়িয়া ভাষার সাহিত্য। উনিশ শতকের আরম্ভ থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে বাঙালির সাহিত্য–সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার পরিধি গ্রেটব্রিটেন–ইংরেজির আর প্রধানত ইংরেজির মধ্যস্থতায় সাধারণভাবে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সাহিত্য–সংস্কৃতি অব্দি বিস্তৃত হল। ঔপনিবেশিক শিক্ষার কারণে ইংরেজের পরিগ্রহণের দ্বারা নির্ধারিত–নিয়ন্ত্রিত বাঙালির এই পরিগ্রহণে ক্রমানুসারে ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় সাহিত্য–সংস্কৃতি স্থান পেল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের রচনার কোনো আন্তঃরাচনিক সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা দেখা যাক।
৩.১. সৈয়দ মুজতবা আলী–র অনুমান
সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ফরাসী–বাংলা নামক নিবন্ধে (দেশ, ২২বর্ষ, সংখ্যা ৩৭, জুলাই ১৯৫৫) লিখেছিলেন :
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ছোট–গল্প লেখক রবীন্দ্রনাথ যবে থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরে মারফতে মপাসাঁকে চিনতে শিখলেন তবে থেকে তাঁর গল্প ঋজু কাঠামো নিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে আত্মপ্রকাশ পেল।… রবীন্দ্রনাথের উপর মপাসাঁর ছায়া পড়েছিল সেকথা পূর্বেই বলেছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহকর্মীরূপে তিনি ফরাসী কবিতানাট্য এমন কি ‘শারাদ’ও পড়েছিলেন। তারই ফলে
Celui qui me lira, dans les siècles, un soir,
Troublant mes vers
ইত্যাদি (ইংরাজীতে শব্দে শব্দে অনুবাদ):
One who would read me, after centuries, one evening, turning over my verses
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ হয়ে বেরল। কিন্তু প্রথম কয়েক ছত্রের পরে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে গিয়েছেন। ঠিক সেইরকম মেটারলিঙ্কের ‘নীল–পাখি’ যে কাঠামোতে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ‘অরূপ রতন’ সেই কাঠামো নিয়ে, কিন্তু উভয় নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচনে এবং রসনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ মেটারলিঙ্ককে অনেক পেছনে ফেলে গিয়েছেন।
৩.১. ১.
মুজতবা আলীর রচনায় রবীন্দ্রনাথের ফরাসি সাহিত্যচর্চার প্রসঙ্গে তিনটি অনুমান উপস্থাপিত করেছেন: ক) রবীন্দ্রনাথ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মারফতে মোপাসঁকে চিনেছলেন, রবীন্দ্রনাথের উপর মোপাসঁর ছায়া পড়েছিল, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ছোট–গল্পে মোঁপাস–র রচনার আন্তঃরাচনিক উপস্থিতি রয়েছে, খ) রবীন্দ্রনাথের ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ অর্থাৎ ‘১৪০০ সাল’ শীর্ষক কবিতাটির মধ্যে একটি ফরাসি কবিতার আর গ) রবীন্দ্রনাথের নাটক ‘ডাকঘর’, ‘অরূপ রতন’ মেতেরলিঙ্ক–এর ‘নীল–পাখি’ নাটকের আন্তঃরাচনিক সম্পর্ক স্পষ্ট।
আমরা এক এক করে এই তিনটি প্রশ্ন পরীক্ষা করতে পারি:
৩.১. ১.ক. রবীন্দ্রনাথ সে অর্থে কখনো মোপাসঁ (গি দ মোপাসঁ/ Guy de Maupassant, ১৮৫০–১৮৯৩) সম্পর্কে কিছু বলেন নি। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ট বন্ধু প্রিয়নাথ সেন ছিলেন মোপাসঁ–র মনোযোগী পাঠক, মোপাসঁ–র মৃত্যুর অনতিকাল পরে তিনি ‘গী দে মোপাসঁ’ নামক প্রবন্ধে মোপাসঁ–র সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। আমরা অনুমান করতে পারি প্রিয়নাথ সেন রবীন্দ্রনাথকে মোপাসঁ–র রচনা সম্পর্কে কৌতুহলী করেছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় একটা চিঠিতে (১৯ জুলাই, ১৮৮৬) প্রিয়নাথ রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন,
…আমার মনটা নিতান্তই বেফুর্ত্তি হয়ে পড়েচে তার ভিতরকার স্বভাব যেন বিগড়ে গেচে…আমার মত কেতাবী লোকের আর চেয়ে কি দুর্দ্দশা হতে পারে যে, কোন বইই আর আমার ভাল লাগে না। Guy de Maupassantর একখানা নূতন বই পেয়েচি কিন্তু কই তার সেই সুন্দর জীবন্ত উদার তরঙ্গময়ী ভাষা আগেকার মত ত প্রাণে একটা উৎসাহের স্রোত — একটা জীবনের তরঙ্গ এনে দিতে পারেনা !
তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুরবাড়ির অনেকের উৎসাহ আর সক্রিয় সহযোগিতায় প্রকাশিত ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকায় মোপাসঁ–র জীবৎকালেই ১৮৯২ সালে ‘চ্ন্দ্রালোক’ শিরোনামে মোপাসঁ–র একটি গল্পের (Claire de lune) অনুবাদ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী তখন পত্রিকাটির সম্পাদিকা আর গল্পটির অনুবাদিকা ছিলেন তাঁরই কন্যা (অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ভাগনি) হিরণ্ময়ী দেবী। ঐ একই সংখ্যায় উক্ত অনুবাদের ঠিক আগের মুদ্রিত রচনাটি ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গান’ নামে একটি কবিতা (আমার পরাণ লয়ে/ কি খেলা খেলিবে...)। ১৮৯৬ সালে পূর্বোক্ত পত্রিকায় ‘কণ্ঠমালা’ শিরোনামে মোপাসঁ–র আরকটি গল্পের (La parure) অনুবাদ প্রকাশিত হয়, এতে অনুবাদকের কোনো নাম ছিল না। এতে মনে হয় অনুবাদটি পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ঠাকুরবাড়ির কারো করা। এছাড়া ইতিপূর্বে উল্লিখিত ফরাসি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে চিঠিতে (অক্টোবর ১৯০০) রবীন্দ্রনাথ তাঁর লাইব্রেরীর যেসব বইয়ের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে মোপাসঁ–র দুটি বইয়ের ইংরেজি তর্জমার নাম রয়েছে, প্রথমটি একটি উপন্যাস, দ্বিতীয়টি মনে হয় গল্প–সংকলন। এ সমস্ত পারিপার্শ্বিক উপাদান থেকে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ মোপাসঁ–র সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে কখনো কিছু না বললেও তিনি মোপাসঁ–র রচনার সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন না। ‘রবীন্দ্রনাথের উপর মপাসাঁর ছায়া পড়েছিল’– এ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হল আমরা মোপাসঁ–র কোনো গল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো গল্পের আন্তঃরাচনিক সম্পর্কের চিহ্ন এখনো অব্দি আমাদের চোখে পড়ে নি।
৩.১. ১.খ. মুজতবা আলী ইংরেজি অনুবাদ সহ যে পংক্তিটি উপস্থাপিত করেছেন তা এমিল ভেরআরেন–এর (Emile Verhaeren, ১৮৫৫–১৮১৬) ‘একটি সন্ধ্যা’ (Un Soir) নামে কবিতার শুরু, আর কবিতাটি যে কাব্যসংকলনের অন্তর্গত সেই সংকলন ‘কলকোলাহলময় শক্তি’ (Les Forces tumultueuses) প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে, আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘১৪০০ সাল’ ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত, ‘চিত্রার’ প্রকাশকাল ১৮৯৬ সাল।
৩.১.১.গ. রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি নাটকের সঙ্গে মেতেরলিঙ্ক–এর(Maurice Maeterlinck, ১৮৬২–১৯৪৯) নাটকের আন্তঃরাচনিক সম্পর্কের (বাংলা সমালোচনার ভাষায় ছায়াপাত বা তথাকথিত প্রভাবের) কথা অনেকে বলেছেন, রবীন্দ্রভক্ত অনেকে আবার তার বিরোধিতা করেছেন এ সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি । কেননা রবীন্দ্রনাথ মেতেরলিঙ্ক–এর নাটক পড়েছিলেন তার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে মেতেরলিঙ্ক রবীন্দ্রনাথের দুবছর আগে ১৯১১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯১৭ সালে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীকে লিখছেন:
তুমি কিছুকাল যদি ইবসেন মেটারলিঙ্ক ডসটেভস্কি বার্ণাডশ কোট করে এবং ব্যাখ্যা করে ইস্কুলমাষ্টারি করতে পার তাহলে তার মূল্য যতই তুচ্ছ হোক্ তার কাটতি এবং খ্যাতি হবে প্রচুর।
তাছাড়া ১৯১৭ সালে লেখা ‘পয়লা নম্বর’নামক গল্পে রয়েছে:
‘এমন–কি ইবসেন–মেটারলিঙ্কের নামের নৌকা ধরে আমাদের মাসিক সাহিত্যে সস্তা খ্যাতির বাঁধা কারবার চালাতে আমার সংকোচ বোধ হয়।’
বোঝাযায় যে রবীন্দ্রনাথ মেতেরলিঙ্ক–এর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন না, আর ইবসেন–এর সঙ্গে নামের উল্লেখে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ মেতেরলিঙ্ক–এর নাট্যসৃষ্টি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে সচেতন ছিলেন। এখানে বলা দরকার, প্রভাবতত্ত্ব থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যদি কোনো রচনার কথা ভাবি তখন আমরা উপলব্ধি করি রচনার বুননে থথা উৎপাদনে পূর্ববর্তী এক বা একাধিক রচনার পাঠের অভিজ্ঞতা/স্মৃতি ক্রিয়াশীল হয়, তাকে কিছুটা নিন্দার্থক ওপর থেকে চাপানো ‘প্রভাব’ শব্দের দ্বারা বোঝানো যায় না। সেদিক থেকে ডাকঘর (১৯১২) রবীন্দ্রনাথের নাটকে থেকে রবীন্দ্রনাথের নাটকের যে চারিত্রিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে মেতেরলিঙ্ক–এর নাটক পড়ার অভিজ্ঞতা/স্মৃতি ক্রিয়াশীল হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
৩.১. ২ বের্গ্সন
রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ (১৯১৬) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর বারাণসী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক শিশিরকুমার মৈত্র ‘বলাকার’ বিবিন্ন কবিতার মধ্যে ফরাসি দার্শনিক বের্গসন–এর (Henri-Louis Bergson, ১৮৫৯–১৯৪১) ‘সৃজনশীল অভিব্যক্তি–র’ (L’évolution créatrice, ১৯০৭) আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিক উপস্থিতি অনুভব করেন মে। এর পর থেকে অনেকেই তার পুনারাবৃত্তি করেছেন। পূর্বোক্ত ‘পয়লা নম্বর’গল্পে আছে: ‘আমি… বের্গ্সঁর তত্ত্বজ্ঞান ও ইব্সেনের মনস্তত্ত্ব আলোচনা করছি...’; আমরা জানি যে বের্গসন–এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখাও হয়েছিল।
৩.২. আমাদের অনুমান : “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ও “নিরুদ্দেশ যাত্রা
রবীন্দ্রনাথের ‘প্রভাতসঙ্গীত’ (১৮৮৩) কাব্যগ্রন্থের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ‘সোনার তরী (১৮৯৪)’ কাব্যগ্রন্থের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ এইদুটি কবিতা আমাদের গোতিয়ে–র ‘ঝর্ণা’ (লা সুর্স/La source) ও ‘বার্কারোল’ (Barcarolle, La Comédie de la Mort,১৮৩৮) এই দুটি কবিতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় ৷ আমাদের মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা দুটি আন্তঃরাচনিক সূত্রে গোতিয়ে–র কবিতা দুটির সঙ্গে সম্পর্কিত ৷ স্বভাবতই আমাদের এই অনুমিতি বা প্রাগ–প্রকল্পের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে রবীন্দ্রনাথ কি গোতিয়ে–র কবিতা দুটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন? আমাদের ধারণা ছিলেন ৷ তরুণ রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে দাদা ফরাসিবিদ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন গোতিয়ে–র পাঠক ও একাধিক রচনার অনুবাদক, আশুতোষ চৌধুরি এবং প্রিয়নাথ সেনও ছিলেন গোতিয়ে–র রচনার সঙ্গে অনুরাগী ৷ ১২৯৮ বঙ্গাব্দে (১৮৯১ সাধারণ অব্দে) সালে ফরাসিবিদ বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘ফরাসি কবি গোতিয়ে রচিত ‘মাদ্মোয়াজেল দ্য মোপ্যাঁ’ প‘ড়ে…আমার মনে হয়েছিল…’ — গোতিয়ে–র উপন্যাসের আলোচনায় ‘ফরাসি কবি’ বিশেষণ লক্ষ্যনীয় ৷ এছাড়া পূর্বোল্লিখিত আশুতোষ চৌধুরী ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ (ভারতী ও বালক) পত্রিকায় (বঙ্গাব্দ ১২৯৩ আষাঢ় থেকে ফাল্গুন, সা.অ. ১৮৮৬, জুন–জুলাই– ১৮৮৭, ফেব্রুয়ারি–মার্চ) তাঁর ‘কাব্যজগৎ’ প্রবন্ধে ফরাসি কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে গোতিয়ে–র ‘বার্কারোল’ কবিতাটির অনুবাদ করেছিলেন। স্মরণীয় সেবছর পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।তাছাড়া আশুতোষ চৌধুরি যাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতিতে’ লিখেছিলেন ‘ফরাসি কাব্যসাহিত্যের রসে তাঁহার বিশেষ বিলাস ছিল’ ঐ একই বছরে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থের সম্পাদনা করেছিলেন। স্বভাবতই আমরা ভাবতে পারি যে রবীন্দ্রনাথ আশুতোষ চৌধুরির সঙ্গে গোতিয়ে–র কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক বসন্ত কুমার রায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আলোচনায় লিখছেন:
He interprets love in all its multiform expressions…Each and every one of these he portrays with his characteristic softness of touch that recalls the lyrics of Theophile Gautier, and with the exquisite felicity of Shelley and Keats. [― Basanta Kumar Roy: Rabindranath Tagore, The Man and His Poetry, New York, Dodd, Mead & Company, 1915, p59].
এই তুলনা রবীন্দ্রনাথের সমকালে গোতিয়ে–র কবিতার পরিচিতির কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ আন্তঃরাচনিক সূত্রে গোতিয়ে–র কবিতার কথা মনে করিয়ে দিলেও আমরা অনুভব করি রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত কবিতা দুটি কবিতা হিসেবে গোতিয়ে–র কবিতাকে পার হয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে ৷ আমরা এখানে ক.) আশুতোষ চৌধুরির উল্লিখিত প্রবন্ধের একটি অংশ আর খ.) গোতিয়ে–র ‘ঝর্ণা’ কবিতাটির একটা খসড়া অনুবাদ উপস্থাপিত করছি ৷
ক.) একটি পুরাতন ফরাসী গ্রাম্য গীতি দেখ—
দেখবি, কাহারে ভাল যে বাসি
(অঘুম চোখে) হৃদয় চলরে দেখিয়া আসি।
প্রভাত আলোকে কনক তরী, দ্বিরদরদের মাস্তুল তারি
রেশমের পাল, কনকের হাল
কতই সুন্দর আহা মরি মরি ।…
দেখ অই দূরে চেয়ে — কে সে যে আসিছে বেয়ে
ছোটখাট ডিঙাখানি, আমারি সেত হৃদয় রাণী !
ইহার সহিত ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি ফরাসী কবিতার তুলনা দিতে ইচ্ছা হয়:
বলরে যুবতী বালা কোথা যাবি তুই?
পাল উড়িতেছে, বায়ু বহিতেছে,চল কোথা যাবি তুই।
সোনার ডিঙার সোনার হাল, পরীর পাখার উড়িছে পাল
হাতির দাঁতের দাঁড়টি লয়ে, দেবতার ছেলে যাইবে বেয়ে, বালা কোথা যাবি তুই?
পাল উড়িতেছে, বায়ু বহিতেছে. চল্ কোথা যাবি তুই?
বালটিক সাগর ধারে, কিম্বা পাসিফিক পারে
দুলাতে হিমানি দুল, পরিতে অশোক ফুল
যথা সাধ যাহা চাই চল আনিবারে যাই
পরীর পাখার উড়িছে পাল, সোনার ডিঙার সোনার হাল, বালা কোথা যাবি তুই?
আগ্রহে বলিল বালা—‘‘জুড়াতে হৃদয় জ্বালা
চির প্রেম যেথা পাব চল সেই দেশে যাব’’
‘‘কোথা সেই দেশ প্রেমের রাজার, জানেনাক কেহ বালিকা আমার।’’
আশুতোষ চৌধুরি উনিশ শতকের যে ফরসি কবিতাটির অনুবাদ করেছেন আমরা তার উত্স কবিতাটি উপস্থাপিত করছি :
Théophile Gautier
Barcarolle
Dites, la jeune belle !
Où vouleś-vous aller ?
La voile ouvre son aile,
La brise va souffler !
L’aviron est d’ivoire,
Le pavillon de moire,
Le gouvernail d’or fin ;
ñ’ai pour lest une orange,
Pour voile une aile d’ange,
Pour mousse un séraphin.
Dite, la jeune belle !
Où vouleś-vous aller ?
La voile ouvre son aile,
La brise va souffler !
Est-ce dans la Baltique,
ṣur la mer Pacifique,
ḍans l’île de ñava ?
Ou bien dans la ṇorwége,
Cueillir la fleur de neige,
Ou la fleur d’āngsoka ?
Dite, la jeune belle !
Où vouleś-vous aller ?
La voile ouvre son aile,
La brise va souffler !
— ṁeneś-moi, dit la belle,
À la rive fidèle
Où l’on aime toujours.
— Cette rive, ma chère,
On ne la connaît guère
āu pays des amours.
— La Comédie de la ṁort
La ṣource
Tout près du lac filtre une source,
Entre deux pierres, dans un coin ;
Allègrement l’eau prend sa course
Comme pour s’en aller bien loin.
Elle murmure : « Oh ! quelle joie !
Sous la terre il faisait si noir !
Maintenant ma rive verdoie,
Le ciel se mire à mon miroir.
« Les myosotis aux fleurs bleues
Me disent : ‹ ṇe m’oublieś pas ! ›
Les libellules de leurs queues
M’égratignent dans leurs ébats ;
« À ma coupe l’oiseau s’abreuve…
Qui sait ? après quelques détours
Peut-être deviendrai-je un fleuve
Baignant vallons, rochers et tours.
« Je broderai de mon écume
Ponts de pierre, quais de granit,
Emportant le steamer qui fume
À l’Océan où tout finit. »
Ainsi la jeune source jase,
Formant cent projets d’avenir ;
Comme l’eau qui bout dans un vase,
Son flot ne peut se contenir ;
Mais le berceau touche à la tombe,
Le géant futur meurt petit ;
Née à peine, la source tombe
Dans le grand lac qui l’engloutit !
— Émaux et Camées
ঝরনা
দুইটি শিলার মাঝখানে, একপাশে
ক্ষরিত ঝরনা, কাছে তার সরোবর ;
পথ করে নেয় জলধারা উচ্ছাসে
দূরে যেতে চায় যেন তার অন্তর ৷
বলে গুঞ্জনে ! “আহা ! কীযে এই সুখ !
মাটির তলায় কী ছিল অন্ধকার !
সবুজ হয়েছে এখন আমার পার,
আমার মুকুরে আকাশ দেখছে মুখ ׀
‘ভুলো না আমায়’ – আমায় যে এসে বলে
ছোট কাঁটা গাছ, ফুলে ফুলে ভরা তারা ৷
আমার বুকেতে দাগ কেটে যায় চলে
পতঙ্গ–দল খেলায় আত্মহারা ;
জল খায় পাখি আমার পাত্র থেকে ;
কে জানে ? হয়ত বিরাট নদীর রূপ
পেয়ে যাবো আমি কয়েকটি বাক বেঁকে
ভাসিয়ে দুকূল, মিনার, শিলার স্তূপ ?
ফেনায় ফেনায় চিত্রিত করে দেবো
পাথরের সেতু, গ্র্যানিটের পথ যত,
ধোঁয়া–ওগরানো জাহাজকে বয়ে নেবো
সাগরে যেখানে সব কিছু অপগত ৷”
বালিকা ঝর্ণা বয়ে চলে কলকল,
বুনছে শতেক আগামী স্বপ্ন তার ৷
ছোট্ট আধারে যেন ফুটন্ত জল,
স্রোত তার স্থির থাকতে পারে না আর ৷
অথচ দোলনা সমাধিতে গিয়ে মেশে,
যে হবে বিরাট সে শিশুটি যায় মরে ৷
জন্ম হতেই ঝরনা পড়ল এসে
সুবিশাল হ্রদ্রে, – হ্রদ তাকে গ্রাস করে ৷
অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত
রবীন্দ্রনাথের ফরাসি সাহিত্যচর্চার আর একটি দিক তাঁর অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথ কবিতার অনুবাদতত্ত্ব নিয়ে আলাদা কিছু না লিখলেও আমরা তাঁর বিভিন্ন আলোচনা থেকে এসম্পর্কে তাঁর চিন্তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে পারি।
‘ভারতী’ (বৈশাখ ১২৯০/১৮৮৩) পত্রিকায় ‘সঙ্গীতসংগ্রহ: বাউলের গাথা ১ম খণ্ড’ গ্রন্থের ‘বাউলের গান’ শীর্ষক সমালোচনায়
রবীন্দ্রনাথ বলেন:
ভাবের ভাষার অনুবাদ চলে না। ছাঁচে ঢালিয়া শুষ্ক জ্ঞানের ভাষায় প্রতিরূপ নির্ম্মাণ করা যায়। কিন্তু ভাবের ভাষা হৃদয়ের স্তন্য পান করিয়া, হৃদয়ের সুখদুঃখের দোলায় দুলিয়া মানুষ হইতে থাকে।
ঐ একই পত্রিকায় (আষাঢ়, ১৩০৫/১৮৯৮) সাময়িক সাহিত্য সমালোচনায় নব্যভারত (জৈষ্ঠ্য ও আষাঢ়, ১৩০৫) পত্রিকার সমালোনায় লেখেন:
শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার বড়াল ইংরাজি কবি হুড্ রচিত ‘এ প্যেরেন্টাল ওড্ টু মাই সন্’ নামক কবিতার মর্ম গ্রহণ করিয়া ‘আদর‘ নামক যে কবিতা রচনা করিয়াছেন তাহা সুন্দর হইয়াছে— তাহাতে মূল কবিতার হাস্যমিশ্রিত স্নেহরসটুকু আছে অথচ তাহাতে অনুবাদের সংকীর্ণতা দূর হইয়া কবির স্বকীয় ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে।
আবার ওমর খৈয়ামের রোবাইয়েৎ–এর বাংলা অনুবাদ সম্পর্কে কান্তিচন্দ্র ঘোষকে লেখা একটি চিঠিতে (২৯ শ্রানণ, ১৩২৬/১৯১৯) রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
…ভাল কবিতা মাত্রকেই তর্জ্জমাই নূতন করে সৃষ্টি করা দরকার। …কবিতা লাজুক বধূর মতো এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙেচ, তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে।
শান্তিনিকেতনে মোলিয়ের–এর তৃতীয় জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন:
আমি মোলিয়্যারের …সম্পর্কে যতটুকু জানি, তা জ্যোতিদাদার বাংলা অনুবাদ ও সমালোচনার ভিতর দিয়ে হয়েছে ; আর বোধ হয় মোলিয়্যারের ইংরাজী অনুবাদও কিছু কিছু পড়েচি। সাহিত্যের কোনো ভাল রচনা ভাষান্তরিত হলে তা বিকলাঙ্গ হয়ে যায়, সেই অনুবাদে সৌন্দর্য্য রক্ষিত হয় না, এবিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে। অনুবাদের ভিতরে দিয়ে লেখকের সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিচয় হয়না এবং সে পরিচয়কে অবলম্বন করে সমালোচনা করাও কঠিন।
রবীন্দ্রনাথ যৌবনে ভিক্তর য়ুগো–র ছটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ–পদ্ধতি বোঝার জন্য দুটি অনুবাদ পরীক্ষা করে দেখতে পারি। প্রথম অনুবাদ য়ুগোর ‘ঐক্য’ (য়্যুনিতে Unité) কবিতাটির।
Unité
Par-dessus l’horizon aux collines brunies,
Le soleil, cette fleur des splendeurs infinies,
Il penchait sur la terre à l’heure du couchant;
Une humble marguerite, éclose au bord d’un champ,
Sur le mur gris, croulant parmi l’avoine folle,
Blanche, épanouissait sa candide auréole;
Et la petite fleur, par-dessus le vieux mur,
Regardait fixement, dans l’étérnel azur,
Le grand astre épanchant sa lumière immortelle.
«Et, moi, j’ai des rayons aussi!» lui disait-elle.
এর গদ্যার্থ :
বাদামি হয়ে–ওঠা পাহাড়ে ভরা দিগন্ত পেরিয়ে / সূর্য, অন্তহীন দীপ্তির ঐ ফুল, / অস্ত যাওয়ার সময় পৃথিবীর ওপর আনত হয়েছিল / প্রান্তরের সীমায় প্রস্ফুটিত একটি অবজ্ঞাত মার্গেরিৎ / উন্মাদ যবের ক্ষেতের মধ্যে প্রায় হারিয়ে যাওয়া, একটা ধূসর প্রাচীরের ওপর, / শুভ্র, উন্মীলিত করে রেখেছিল তার অবারিত জ্যেতির্বলয়; / আর ছোট্ট ফুলটি, পুরানো প্রাচীর পেরিয়ে, / অবিচল তাকিয়ে ছিল, অনপ্ত নীলিমায়, / তার মৃত্যুহীন আলো ঢেলে দেওয়া বিরাট জ্যোতিষ্কটির দিকে।/ ‘আর, আমি, আমারও রয়েছে কিরণ’ তাকে ও বলছিল ৷
য়ুগোর এ কবিতাটি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাণ্ডুলিপিতে ‘সাম্য’ এই শিরোনাম ব্যবহার করেছিলেন। পরে নামকরণ করা হয় ‘সূর্য ও ফুল’। অনুবাদটি সস্পূর্ণ উদ্ধৃত করা যেতে পারে :
পরিপূর্ণ মহিমার আগ্নেয় কুসুম
সূর্য ধায় লভিবারে বিশ্রামের ঘুম ৷
ভাঙা এক ভিত্তি পরে ফুল শুভ্রবাস
চারিদিকে শুভ্র দল করিয়া বিকাশ
মাথা তুলে চেয়ে দেখে সুনীল বিমানে
অমর আলোকময় তপনের পানে ৷
ছোট মাথা দুলাইয়া কহে ফুল গাছে,
‘লাবণ্যকিরণছটা আমারো তো আছে ৷’
আমরা এখানে দেখতে পাই ‘তর্জ্জমায় নূতন করে সৃষ্টি করার প্রয়োজনে’ ‘এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে’ নিয়ে আসতে গেলে যে আড়ষ্টতা আর ‘অনুবাদের সংকীর্ণতা’ দেখা দেয় তা দূর করার জন্য কী পদ্ধতি বা রচনাকৌশল অবলম্বন করেছেন:
ক.) উৎসকবিতার উপরচনা শিরোনাম বিমূর্ত ধারণামূলক বিশেয্য ‘ঐক্য/Unité–র’ করে রবীন্দ্রনাথ মূর্ত বস্তুনির্দেশক ‘সূর্য ও ফুল’ শিরোনাম ব্যবহার করেন।এই শিরোনাম বাংলা কবিতার, বিশেষ করে নীতিকবিতার সংযোগক অব্যয় ও যু্ক্ত ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেয়।খ.) উৎসকবিতার দশ পংক্তি রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে আট পংক্তিতে পরিণত হয়েছে। মূলের প্রথম পংক্তি এবং পরিবেশ–বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ বাদ দিয়েছেন। গ.) বস্তুত ‘কবিতার মর্ম গ্রহণ করিয়া’ শিরোনাম পরিবর্তন এবং মূলের প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা ছেটে দেওয়াই অনুবাদ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’র নীতিমূলক কবিতার একটা সমগোত্রীয় ভংগী এসে গেছে —যা ঠিক মূল কবিতার চরিত্র নয়। ঘ.) মূল কবিতা বা তার আক্ষরিক গদ্যানুবাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ ‘অনুবাদের সংকীর্ণতা দূর’ করার জন্য অনুবাদে যথেষ্ট স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন। ঘ.) সচ্ছন্দ প্রকাশে অনুবাদটি কোথাও অনুবাদগন্ধী বা আড়ষ্ট হয়ে পড়েনি, বাংলা কবিতায় পরিণত হয়েছে ৷ আমরা ‘কণিকা’–র একটি কবিতা উদ্ধৃত করছি, এই কবিতাটি আমাদের আন্তঃরাচনিক পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক রূপান্তরিত য়ুগো–র কথা মনে করিয়ে দেয়:
প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন
ফুটিয়াছে ছোট ফুল অতিশয় দীন।
ধিক্ ধিক্ করে তারে কাননে সবাই —
সূর্য্য উঠি বলে তারে — ভাল আছে ভাই
— (উদার–চরিতানাম্)
রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনার জন্য আরো একটি কবিতা নেওয়া যাক। মূল কবিতাটি :
15 Février 1843
Aime celui qui t’aime, et sois heureuse en lui.
— Adieu! — sois son trésor, ô toi qui fus le nôtre !
Va, mon enfant béni, d’une famille à l’autre.
Emporte le bonheur et laisse nous l’ennui !
Ici, l’on te retient ; là-bas, on te désire.
Fille, épouse, ange, enfant, fais ton double devoir.
Donne-nous un regret, donne-leur un espoir,
Sors avec une larme ! Entre avec un sourire !
এর গদ্যানুবাদ :
যে তোকে ভালোবাসে তাকে ভালোবাসিস, আর তাকে নিয়ে সুখী হোস।/ —বিদায়! তার সম্পদ্ হোস, ওরে যে তুই ছিলি আমাদের (সম্পদ)! / যা, আশীর্বাদ আমার সন্তান, এক পরিবার থেকে আরেক (পরিবারে)।/ বয়ে নিয়ে যা সৌভাগ্য আর আমাদের জন্য রেখে যা সমস্যা!//
এখানে, তোকে আটকে রাখা হচ্ছে ; ওখানে তুই আকাঙ্ক্ষিত ৷/ কন্যা, বর্ধূ, দেবদূত, সন্তান, তোর উভয় কর্তব্যই তুই কর।আমাদের দিস্ একটু অনুতাপ, ওদের দিস একটু আশা, / একফোঁটী চোখের জল নিয়ে বেরিয়ে পড়! একটা স্মিতহাসি নিয়ে প্রবেশ কর!
রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ:
বিসর্জন
যে তোরে বাসে রে ভালো, তারে ভালোবেসে বাছা
চিরকাল সুখে তুই রোস ৷
বিদায়! মোদের ঘরে রতন আছিলি তুই,
এখন তাহারি তুই হোস ৷
আমাদের আশীর্বাদ নিয়ে তুই যা রে
এক পরিবার হতে অন্য পরিবারে ৷
সুখশান্তি নিয়ে যাস তোর পাছে পাছে,
দুঃখজ্বালা রেখে যাস আমাদের কাছে।৷
হেথা রাখিতেছি ধরে, সেথা চাহিতেছে তোরে
দেরি হল, যা তাদের কাছে ৷
প্রাণের বাছাটি মোর, লক্ষ্মীর প্রতিমা তুই,
দুইটি কর্তব্য তোর আছে —
একটু বিলাপ যাস আমদের দিয়ে
তাহাদের তরে আশা যাস সাথে নিয়ে;
একবিন্দু অশ্রু দিস আমাদের তরে,
হাসিটি লইয়া যাস তাহাদের ঘরে।৷
য়ুগো–র কবিতাটি তাঁর অনুধ্যান (Les Contemplations, ১৮৫৬) কাব্যগ্রন্থের Pauca meae শীর্ষক চতুর্থ অংশের দ্বিতীয় কবিতা। উক্ত ল্যাটিন শিরোনাম ভার্জিলের ‘দশম গোষ্ঠকবিতা’–রদ্বিতীয় চরণের শুরু pauca meo Gallo থেকে নেওয়া ও রূপান্তরিত, যার অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘তার জন্য (আমার মেয়ের জন্য) সামান্য কিছু (কয়েকটা কবিতা)’। য়ুগো–র এই কন্যা লেয়োপল্দিন (Léopoldine Hugo, ১৮২৪–১৮৪৩)।কবিতাটির নাম ‘১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৩’ ।ঐ তারিখে শার্ল ভাকরি–র সঙ্গে বিয়ে হয়, কবিতাটি গির্জের ভেতর লেখা।লেয়োপল্দিন আর তার স্বামী কয়েক মাস পরে ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৪৩ দুর্ঘটনায় সেন নদীতে ডুবে মারা ষায়, বস্তুত অনুধ্যান কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ অংশ য়ুগেো–র শোকগাথা।
রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে কবিতাটির শিরোনাম হয়েছে ‘বিসর্জন’। অনুবাদে পাঠ–নিয়ন্ত্রক উপরচনা শিরোনামের এই পরিবর্তনের দ্বারা অনূদিত কবিতাটি (বাঙালি পাঠকের অজানা) উৎসকবিতার কবিজীবন সম্পৃক্ত বিশেষ প্রসঙ্গ পরিবর্তিত হয়ে সাধারণীকৃত ‘বিসর্জন’ শব্দ দ্বারা স্থানীয়কৃত হয়েছে। এছাড়া আবার স্থানীয়করণের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ মূলে অনুপস্থিত এমন অনেক কথাই যোগ করেছেন। প্রথমেই পরিলক্ষিত হয় যে মূল কবিতায় আছে চার পংক্তির দুটি স্তবক মোট আট পংক্তি, মিলবিন্যাস ক খ খ ক)।এর অনুবাদ হয়েছে ৮ পংক্তির দুই স্তবকে (মোট ষোলো পংক্তি, মিলবিন্যাম: ক খ ক খ গগ ঘঘ)।কবির কন্যার পরিণয় উপলক্ষে এই কবিতা রচিত। আমরা আবার রবীন্দ্রনাথের উক্তির পুনরাবৃত্তি করে বলতে পারি যে তিনি উৎসকবিতার ‘মর্ম গ্রহণ করে… যে কবিতা রচনা করেছেন… তাতে কবির স্বকীয় ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে…’, ‘…তর্জ্জমা নতুন করে সৃষ্টি করা’ সার্থক একটি বাংলা কবিতায় পরিণত হয়েছ।
রবীন্দ্রনাথের য়ুগো–র যে কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন সে ছটি কবিতাই য়ুগো–র অনুধ্যান (Contemplations) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া । রবীন্দ্রনাথের ফরাসিবিদ বন্ধু প্রিয়নাথ সেন বিভিন্ন রচনায় য়ুগো–র এই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথও এ কাব্যগ্রন্থ থেকে একাধিক কবিতার অনুবাদ করেছেন। মনে হয় এই বইটি রবীন্দ্রনাথের পরিমণ্ডলের বিশেষ পরিচিত ছিল। কেউ কেউ এই মত প্রকাশ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহায্য নিয়ে য়ুগো–র কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন। আমরা দেখতে পাই পরবর্তীকালে জ্যেতিরিন্দ্রনাথ য়ুগো–র যেসব কবিতার অনুবাদ করেছিলেন তার মধ্যে একটি কবিতা রয়েছে যা রবীন্দ্রনাথ ইতিপূর্বেই অনুবাদ করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যদি রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদে সাহায্য করতেন তাহলে তিনি আবার একই কবিতার অনুবাদ করতেন না। আমাদের মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ এই অনুবাদে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহায্য গ্রহণ করেন নি, তিনি সাহায্য পেয়েছিলেন প্রিয়নাথ সেন বা/এবং আশুতোষ চৌধুরির।
এবার পূর্বোল্লিখিত ফরাসি সাহিত্য চর্চার নিদর্শনগুলি থেকে আমরা রবীন্দ্রনাথের ফরাসী সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে কিছু সাধারণ ধারণায় আসতে পারি ৷
১) ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল সীমাবদ্ধ আর তা প্রধানত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ফরাসি জানতেন না তা ইতিপূর্বেই আমরা বলেছি। রবীন্দ্রনাথের ফরাসি জানার কোনো প্রমাণ নেই আর ভাষাশিক্ষার প্রবণতা তাঁর মধ্যে ছিল না। জার্মান তিনি কিছুটা শিখেছিলেন। তার প্রমাণ ছিন্নপত্রে গ্যটের জর্মন উদ্ধৃতি বা শব্দতত্ত্বে জর্মন শব্দের দৃষ্টান্তদানের মধ্যে। অথবা ১৮৯০ সালে প্রমথ চৌধুরীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন:
জর্ম্মান Faust অল্প অল্প করে পড়তে চেষ্টা করচি। পড়ার মাঝে মাঝে মৌলবীর বক্তৃতা নায়েবের কৈফিয়ৎ প্রজাদের দরখাস্ত এসে পড়লে জর্ম্মান ভাষা বুঝে ওঠা কি রকম ব্যাপার হয়…
কিন্তু ফরাসি জানার এরকম কোনো নিদর্শন কোথাও নেই।দেখা যায় তিনি দু একবার সচেষ্ট হলেও ব্যকরণের বাধা ঠেলে শেষ পর্যন্ত এগোন নি ৷
২) সংস্কৃত বা ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যে বিস্তৃত ও ধারাবাছিক চর্চার পরিচয় পাওয়া যায়।ফরাসি সাহিত্য সম্পর্কে তদনুরূপ ধারণার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না।অবশ্য তিনি কি কি বই পড়েছিলেন — তার কোন অনুমানে আমরা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি না।দেখা যাচ্ছে ফরাসি কথাসাহিত্যের দুটি গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন।প্রথমটি কৈশোরকালে পড়া কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য কর্তৃক বাংলায় অনূদিত পৌল ভর্জিনী (পল ও ভির্জিনি Paul et Virginie) দ্বিতীয় গ্রন্থটি তেওফিল গোতিয়ে–র উপন্যাস ‘মাদমোয়াজেল দ্য মোপ্যাঁ’(Mademoiselle de Maupin)।কিন্তু ফরাসি কথাসাহিত্যের দিকপালদের রচনাপাঠের কোন উল্লেখ তাঁর রচনায় কোথাও পাওয়া যায় না।কবিতার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তিনি অষ্টাদশ শতকের জঁ ফ্লোরিঅঁ এবং উনিশ শতকের ভিক্তর য়ুগোর ছটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন।ফ্লোঁরিঅঁ–র দুই পংক্তির অনুবাদ খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। ভিক্তরয়ুগোর যে কবিতাগুলি রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছিলেন তা য়ুগোর একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ (লে কোঁতাঁপ্লাসিঅঁLes Contemplations) থেকে।মহ্য কবি হিসেবে ভিকতর য়ুগোর নাম উল্লেখ করলেও, তাঁর অন্যকোন রচনা পাঠের কোন পরিচয় রবিন্দ্রনাথের রচনায় পাওয়া যায় না।রোলঁ–র সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে তিনি দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কত য়ুগোর কবিতা পড়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন।আবার য়ুগো ছাড়া অন্য কোন ফরাসি রোমান্টিক কবি বা তাঁদের কোন কিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কোথাও উল্লেখ করেন নি। শেষজীবনে বোদল্যের পড়ে তিনি নাকি এই কবিকে ‘ফানির্চার পোএট’ বলে অভিহিত করেছিলেন। অবশ্য বোদল্যের বা পরবর্তী আধুনিক কবিদের সঙ্গে রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের মানসিকতা ও কাব্যাদর্শের দুস্তর ব্যবধান।রবীন্দ্রনাথের পক্ষে আধুনিক কবিতাকে গ্রহণ করা স্বাভাবিক ভাবেই সম্ভব ছিলেন। কিন্তু ইংরে জ রোমা ন্টিক কবিদের প্রসঙ্গ যেভাবে তাঁর রচনায় এসেছে কিন্তু ফরাসি রোমান্টিকদের (য়ুগো বাদ দিয়ে) উল্লেখ সেখানে নেই। কিন্তু বিশ শতকের কোনো ফরাসি কবির উল্লেখ তিনি কথনো করেন নি। ‘দাদা’ আন্দলন সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য বিক্ষিপ্ত উল্লেখমাত্র ৷
এছাড়া ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের ফরাসি ধ্রুপদী সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের কোনো নিদর্শন তাঁর রচনা থেকে পাওয়া যায় না। উনিশ শতকের দুজন ফরাসি চিন্তাশীলের জুবের–এর রচনা তাঁর মৃত্যুর (১৮২৪) পর ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রচনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।ম্যাথু আর্নলডের রচনা থেকে জুবের–এর সঙ্গে তাঁর পরিচয়।আমিয়েলের–এর জার্নাল (জুর্নাল অ্যাঁতিম/Journal intime) গ্রন্থটি তিনি পেয়েছিলেন লোকেন পালিতের কাছ থেকে।বোঝা যায় জুবের ও আমিয়েলের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় বিক্ষিপ্ত ঘটনামাত্র ৷
ফরাসি সাহিত্যের প্রতি মনোযোগ বা নিয়মিত যারাসী সাহিত্য পাঠের ফল নয়।তাছাড়া জুবের বা আমিয়েলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাশীল ফরাসি গদ্যকারদের সঙ্গে তাঁর কোন পরিচয়ের নিদর্শন পাওয়া যায় না ৷
৩) ওপরের নিদর্শনগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি, শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ফরাসি সাহিত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোযোগকে আমরা প্রান্তিক বলে বিশেষিত করতে পারি । তাঁর ফরাসি সাহিত্য চর্চা বিক্ষিপ্ত কয়েকটি গ্রন্থ পাঠ, এবং য়ুগোর বিচ্ছিন্ন অনুবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা কখোনো ধারাবাহিক ফরাসি সাহিত্য পাঠ বা গভীর মনোযোগে পরিণত হয় নি। এটা দোষ বা গুণের কোন ব্যাপার নয়, ঘটনা মাত্র। কোনো অর্থেই নিয়ম–নির্ধারিত ভাবে ফরাসি সহিত্য সম্পর্কে তাঁর আলাদা কোনো আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় না ৷ ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্য তিনি যতটা বিধিবদ্ধভাবে পড়েছিলেন ফরাসি সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। কোনো অর্থেই নিয়ম–নির্ধারিত ভাবে ফরাসি সহিত্য সম্পর্কে তাঁর আলাদা কোনো আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় না ৷
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কর্তৃক
ফরাসি রচনার অনুবাদ
রবীন্দ্রনাথের অনূদিত কবিতাগুলি সবই য়ুগো–র একটি কাব্যগ্রন্থ ‘অনুধ্যান’/Les contemplations থেকে নেওয়া, একথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। এর মধ্যে ‘কবি’ , ‘বিসর্জন’, ‘তারা ও আঁখি’, ‘সূর্য্য ও ফুল’ ‘ভারতী’ (আষাঢ় ১২৮৮ বঙ্গাব্দ/ ১৮৮১ জুন–জুলাই) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তারপর ‘প্রভাতসঙ্গীত’(১৮৮৩) কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছিল, কবিতার শিরোনামের নিচে বন্ধনীর মধ্যে অনুবাদ আর কবিতার শেযে রোমান অক্ষরে VICTOR HUGO নাম ছিল। ‘বেঁচেছিল, হেসে হেসে…’ কবিতাটি ‘ভারতী’ (শ্রাবণ ১২৯১ বঙ্গাব্দ/ ১৮৮৪ জুলাই–অগাস্ট) পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬) ‘বিদেশী ফুলের গুচ্ছ’ শিরোনামে উপস্থাপিত কবিতাগুচ্ছের মধ্যে স্থান পেয়েছিল, কবিতাটির কোনো শিরোনাম ছিল না, বন্ধনীর মধ্যে ছিল VICTOR HUGO ‘জীবন মরণ’ কবিতাটি ‘আলোচনা’ (১৮৮৩) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, কবিতার শেষে ছিল ‘Victor Hugo হইতে অনুবাদিত’। পরবর্তী কালে এই অনূদিত কবিতাগুলি আলাদা করে ‘বিদেশী ফুলের গুচ্ছ’ শিরোনামে কাব্যগ্রন্থ থেকে আলাদা করে রচনাবলিতে স্থান দেওয়া হয়েছে । য়ুগো–র অনুধ্যান কাব্যগ্রন্থে রচনাকাল অনুসারে কবিতাগুলির ক্রম নিম্নরূপ:
কবি (Le poëte s’en va dans les champs)
তারা ও আঁখি (Hier au soir)
সূর্য ও ফুল (Unité)
জীবন মরণ (Quia pulvis es)
বেঁচেছিল, হেসে হেসে… (Épitaphe)
বিসর্জন (15 février 1843)
Le poète s’en va dans les champs ; il admire.
Il adore ; il écoute en lui-même une lyre ;
Et le voyant venir, les fleurs, toutes les fleurs.
Celles qui des rubis font pâlir les couleurs.
Celles qui des paons même éclipseraient les queues.
Les petites fleurs d’or, les petites fleurs bleues.
Prennent, pour l’accueillir agitant leurs bouquets.
De petits airs penchés ou de grands airs coquets,
Et, familièrement, car cela sied aux belles :
— Tiens ! c’est notre amoureux qui passe ! disent-elles.
Et, pleins de jour et d’ombre et de confuses voix.
Les grands arbres profonds qui vivent dans les bois,
Tous ces vieillards, les ifs, les tilleuls, les érables.
Les saules tout ridés, les chênes vénérables,
L’orme au branchage noir, de mousse appesanti.
Comme les ulémas quand paraît le muphti ;
Lui font de grands saints et courbent jusqu’à terre
Leurs têtes de feuillée et leurs barbes de lierre.
Contemplent de son front la sereine lueur.
Et murmurent tout bas : C’est lui ! c’est le rêveur !
Les Roches, juin 1831.
কবি
ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া,
কভু বা অবাক, কভু ভকতি–বিহ্বল হিয়া।
নিজের প্রাণের মাঝে
একটি যে বীণা বাজে,
সে বাণী শুনিতেছেন হৃদয় মাঝারে গিয়া।
বনে যতগুলি ফুল আলো করি ছিল শাখা,
কারো কচি তনুখানি নীল বসনেতে ঢাকা,
কারো বা সোনার মুখ,
কেহ রাঙা টুকটুক,
কারো বা শতেক রঙ যেন ময়ূরের পাখা,
কবিরে আসিতে দেখি হরষেতে হেলি দুলি
হাব ভাব করে কত রূপসী সে মেয়েগুলি।
বলাবলি করে, আর ফিরিয়া ফিরিয়া চায়,
“প্রণয়ী মোদের ওই দেখ লো চলিয়া যায়।”
সে অরণ্যে বনস্পতি মহান্ বিশাল–কায়া
হেথায় জাগিছে আলো, হোথায় ঘুমায় ছায়া।
কোথাও বা বৃদ্ধবট —
মাথায় নিবিড় জট;
ত্রিবলী অঙ্কিত দেহ প্রকাণ্ড তমাল শাল;
কোথাও বা ঋষির মতো
অশথের গাছ যত
দাঁড়ায়ে রয়েছে মৌন ছড়ায়ে আঁধার ডাল।
মহর্ষি গুরুরে হেরি অমনি ভকতিভরে
সসম্ভ্রমে শিষ্যগণ যেমন প্রণাম করে,
তেমনি করিবে দেখি গাছেরা দাঁড়াল নুয়ে,
লতা–শ্মশ্রুময় মাথা ঝুলিয়া পড়িল ভুঁয়ে।
একদৃষ্টে চেয়ে দেখি প্রশান্ত সে মুখচ্ছবি,
চুপি চুপি কহে তারা “ওই সেই। ওই কবি।”
15 Février 1843
Aime celui qui t’aime, et sois heureuse en lui.
— Adieu ! — sois son trésor, ô toi qui fus le nôtre !
Va, mon enfant béni, d’une famille à l’autre.
Emporte le bonheur et laisse-nous l’ennui !
Ici, l’on te retient ; là-bas, on te désire.
Fille, épouse, ange, enfant, fais ton double devoir.
Donne-nous un regret, donne-leur un espoir,
Sors avec une larme ! entre avec un sourire !
বিসর্জন
যে তোরে বাসেরে ভালো, তারে ভালোবেসে বাছা,
চিরকাল সুখে তুই রোস্।
বিদায়! মোদের ঘরে রতন আছিলি তুই,
এখন তাহারি তুই হোস্।
আমাদের আশীর্বাদ নিয়ে তুই যা রে
এক পরিবার হতে অন্য পরিবারে।
সুখ শান্তি নিয়ে যাস্ তোর পাছে পাছে,
দুঃখ জ্বালা রেখে যাস্ আমাদের কাছে।
হেথা রাখিতেছি ধরে, সেথা চাহিতেছে তোরে,
দেরী হ‘ল, যা‘ তাদের কাছে।
প্রাণের বাছাটি মোর, লক্ষ্মীর প্রতিমা তুই,
দুইটি কর্তব্য তোর আছে।
একটু বিলাপ যাস আমাদের দিয়ে,
তাহাদের তরে আশা যাস সাথে নিয়ে;
এক বিন্দু অশ্রু দিস আমাদের তরে,
হাসিটি লইয়া যাস তাহাদের ঘরে।
Hier au soir
Hier, le vent du soir, dont le souffle caresse,
Nous apportait l’odeur des fleurs qui s’ouvrent tard;
La nuit tombait; l’oiseau dormait dans l’ombre épaisse.
Le printemps embaumait, moins que votre jeunesse;
Les astres rayonnaient, moins que votre regard.
Moi, je parlais tout bas. C’est l’heure solennelle
Où l’âme aime à chanter son hymne le plus doux.
Voyant la nuit si pure, et vous voyant si belle,
J’ai dit aux astres d’or: Versez le ciel sur elle!
Et j’ai dit à vos yeux: Versez l’amour sur nous!
তারা ও আঁখি
কাল সন্ধ্যাকালে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস,
বহিয়া আনিতেছিল ফুলের সুবাস।
রাত্রি হ‘ল, আঁধারের ঘনীভূত ছায়ে
পাখিগুলি একে একে পড়িল ঘুমায়ে।
প্রফুল্ল বসন্ত ছিল ঘেরি চারি ধার
আছিল প্রফুল্লতর যৌবন তোমার,
তারকা হাসিতেছিল আকাশের মেয়ে,
ও আঁখি হাসিতেছিল তাহাদের চেয়ে।
দুজনে কহিতেছিনু কথা কানে কানে,
হৃদয় গাহিতেছিল মিষ্টতম তানে।
রজনী দেখিনু অতি পবিত্র বিমল,
ও মুখ দেখিনু অতি সুন্দর উজ্জ্বল।
সোনার তারকাদের ডেকে ধীরে ধীরে,
কহিনু, “সমস্ত স্বর্গ ঢালো এর শিরে!”
বলিনু আঁখিরে তব “ওগো আঁখি–তারা,
ঢালো গো আমার ‘পরে প্রণয়ের ধারা।”
Unité
Par-dessus l’horizon aux collines brunies,
Le soleil, cette fleur des splendeurs infinies,
Se penchait sur la terre à l’heure du couchant;
Une humble marguerite, éclose au bord d’un champ,
Sur un mur gris, croulant parmi l’avoine folle,
Blanche épanouissait sa candide auréole;
Et la petite fleur, par-dessus le vieux mur,
Regardait fixement, dans l’éternel azur,
Le grand astre épanchant sa lumière immortelle.
Et, moi, j’ai des rayons aussi!- lui disait-elle
Granville, juillet 1836.