Blaise Cendrars: Poèmes, Traduction en bengali: Pushkar Dasgupta (Première série) ব্লেজ সঁদ্রার : কবিতা , অনুবাদ : পুষ্কর দাশগুপ্ত ( প্রথম পর্ব) Blaise Cendrars: Poems Translated into Bengali by Pushkar Dasgupta (First series)

ব্লেজ সঁদ্রার: কবিতা / Blaise Cendrars : Poèmes
(
প্রথম পর্ব / Première série)



অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত / Traduits par Pushkar Dasgupta /Translated by Pushkar Dasgupta

Toute vie n’est qu’un poème, un mouvement. Je ne suis qu’un mot, un verbe, une profondeur dans le sens le plus sauvage, le plus mystique, le plus vivant.

Blaise Cendrar

[প্রত্যেকটি জীবন একটা কবিতা, একটা গতি ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ সবচেয়ে আদিম, সবচেয়ে মরমি, সবচেয়ে জীবন্ত অর্থে আমি হলাম একটা শব্দ, একটা ক্রিয়াপদ, একটা গভীরতা ৷

ব্লেজ সঁদ্রার]

উনিশ শতকের ইয়োরোপীয় আধুনিক কবিতার প্রথম উদ্গাতা হলেন শার্ল বোদলের (Charles Baudelaire, ১৮২১-১৮৬৭) ৷ রোমান্টিক কাব্যান্দোলনের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বোদলের যাত্রা শুরু করেছিলেন কাব্যিক অন্বেষণের নতুন এক দিগন্তের রোমান্টিক কাব্যান্দোলনের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বোদলের যাত্রা শুরু করেছিলেন কাব্যিক
অন্বেষণের নতুন এক দিগন্তের অভিমুখে ৷ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকেরর শুরু অব্দি ‘প্রতিকীবাদী’ বলে চিহ্নিত কবিদের রচনায় এই আধুনিক কবিতার বিবর্তন অব্যাহত থাকে ৷ এর পর বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত আগে দুজন কবির কাব্যসৃষ্টির মধ্যে বিশ শতকের আধুনিক ফরাসি তথা ইয়োরোপীয় কবিতার অবিসংবাদী সূচনা ঘোষিত হয় ৷ এই দুজন কবি হলেন গিয়োম আপলিনের (
Guillaume Apollinaire, ১৮৮০-১৯১৮) এবং ব্লেজ সঁদ্রার (Blaise Cendrars,১৮৮৭-১৯৬১) ৷ ভবিষ্যদবাদ (Futurism), দাদা ( Dada), পরাবাস্তববাদ (Surrealism), বর্ণবাদ (Lettrism) ইত্যাদি কোনো বিশেষ আন্দোলন দ্বারা চিহ্নিত বা কোনো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না হলেও এই দুই কবির রচনায় বিশ শতকের তাবৎ শিল্প-আন্দোলনের পূ্র্বাভাস তথা সূচনা উপলব্ধি করা যায় ।

সঁদ্রারের কাব্যসৃষ্টির মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা সঁদ্রারের বন্ধু এবং অন্যতম ইংরেজি অনুবাদক বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক জন ডস পাসোস-এর(John Dos Passos, ১৮৯৬-১৯৭০) ভাষায়:

The poetry of Blaise Cendrars was part of the creative tidal wave that spread over the world from the Paris of before the last European war. Under various tags: futurism, vorticism, modernism, most of the best work in the arts in our time has been the direct product of this explosion, that had an influence in it sphere comparable with that of the October revolution in social organization and politics and the Einstein formula in physics. Cendrars and Apollinaire, poets, were on the first cubist barricades with the group that included Picasso Modigliani, Marinetti, Chagall; that profoundly influenced Maiakovsky, Meyerhold, Eisenstein; whose ideas carom through Joyce, Gertrude Stein, T.S. Eliot (…). The music of Stravinsky and Prokofieff and Diageleffs Ballet hail from this same Paris already in the disintegration of victory, as do the windows of Saks Fifth Avenue, skyscraper furniture, the Lenin Memorial in Moscow, the painting of Diego Rivera in Mexico City and the newritz styles of advertizing in American magazines.

[ব্লেজ সঁদ্রারের কবিতা গত ইয়োরোপীয় যুদ্ধের আগে যে সৃজনশীল জোয়ারের ঢেউ প্যারিস থেকে এসে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল তারই একটা ভাগ। ভবিষ্যদবাদ, ঘুর্ণণবাদ, আধুনিকতা – এসব বিভিন্ন লেবেল আঁটা আমাদের সময়ের বেশির ভাগ শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম এই বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষ উত্পাদন । তার নিজস্ব ক্ষেত্রে এই বিস্ফোরণের প্রভাব সমাজসংগঠন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অক্টোবর বিপ্লব আর পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের সূত্রের সঙ্গে তুলনীয়। সঁদ্রার আর আপলিনের কবি, এঁরা প্রথম ক্যুবিস্ট ব্যারিকেডের ওপর সেই দলের সঙ্গে ছিলেন যে দলের মধ্যে ছিলেন পিকাসো, মোদিলিয়ানি, মারিনেত্তি , শাগাল; যা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে মায়াকভস্কি, মেয়েরহোল্ড, আইজেনস্টাইনকে , এঁদের ধ্যানধারণা জয়স, গেরট্রুড স্টেইন, টি. এস. এলিয়টের (…) লেখায় ক্যারামের গুটির মতো এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অব্দি ঘুরে বেড়িয়েছে । ইতিমধ্যেই বিজয়ে সংহতি হারানো সেই একই প্যারিস থেকে এসেছে স্ত্রাভিনস্কি আর প্রকোফিয়েফের সঙ্গীত আর দিয়াজেলেফের ব্যালে যেমন এসেছেফ ফিফথ অ্যাভেন্যুর স্যক্সেল শোকেস. গগনতচুম্বী আসবাব,মস্কোয় লেনিনের স্মৃতিসৌধ, মেক্সিকো শহরে দিয়েগো রিভেরার ছবি আর অ্যামেরিকান ম্যগাজিনে নতুন স্টাইলের বিজ্ঞাপন।]

ট্রান্সসাইবেরিয়ান আর ফ্রান্সের ছোট্ট জানএর গদ্য
(Prose du Transsibérien et de la petite Jeanne de France)
                                                                                                                                                      সঙ্গীতশিল্পীদের উৎসর্গিত

আমি তখন কিশোর
সবে ষোলো বছর আমার বয়েস আর এরই মধ্যে ছেলেবেলার কথা আমার আর মনে পড়ে না
আমি তখন আমার জন্মস্থান থেকে ৫৬০০০ মাইল দূরে
আমি ছিলাম মস্কোতে, হাজার তিনটে গির্জের চুড়ো আর সাতটা স্টেশনের শহরে
আর সাতটা স্টেশন আর হাজার তিনটে মিনার তখনো আমার কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে নি
কেননা আমার কৈশোর ছিল এমনই গনগনে আর এমনই পাগলামিতে ভরা
যে আমার হৃদয়, সূর্যাস্তের সময়
কখনো ইফিজাসের মন্দিরের মতন অথবা কখনো মস্কোয় রেড স্কোয়ারের মতন জ্বলতে থাকত ।
আর আমার চোখদুটি পুরনো দিনের রাস্তাগুলোকে আলোকিত করে দিত ৷
আর এরই মধ্যে আমি এমন এক অপদার্থ কবি হয়ে উঠেছিলাম
যে কোনো কিছুরই শেষ অব্দি আমি পৌঁছতে পারতাম না ৷

ক্রেমলিনটা যেন একটা প্রকাণ্ড তাতার কেক
মচমচে সোনার,
তার মধ্যে সাদা ক্যাথিড্রালগুলির বাদাম বসানো
আর গির্জের ঘন্টার মধু ভরা সোনা
বুড়ো এক সন্ন্যাসী আমায় নভগরোদএর ইতিকথা পড়ে শোনাত
আমার গলা শুকিয়ে আসত
আর আমি কৌণিক হরফগুলির পাঠোদ্ধার করতাম
তারপর, আচমকা, পবিত্রআত্মার পায়রাগুলো চকের ওপর দিয়ে উড়ে যেত
আর অ্যালবাট্রসের ডানার শব্দে উড়ে যেত আমার হাতদুটিও
আর এটাই, এটাই ছিল আমার শেষ দিনের
একেবারে শেষ ভ্রমণের
আর সমুদ্রের শেষ অস্পষ্ট স্মৃতি।

তবুও আমি হয়ে উঠেছিলাম নিতান্ত অপদার্থ এক কবি
কোনো কিছুরই শেষ অব্দি গিয়ে আমি পৌঁছতে পারতাম না
আমার খিদে পেত
আর সবকটা দিন আর সবকটা কাফের মধ্যে সবকটা মেয়েমানুষ আর সবকটা মদের গেলাস
পারলে আমি ওদের খেয়ে ফেলতাম আর ভেঙে চুরমার করে দিতাম
আর সবকটা শোকেস আর সবকটি রাস্তা
আর সবকটা বাড়িঘর আর সবকটা জীবন
আর রাস্তার এবড়োথেবড়ো শানের ওপর ঘুর্ণিবেগে ঘুরতে থাকা ছ্যাকড়া গাড়ির সবকটা চাকা
পারলে আমি ওদের তরোয়ালের হাপরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতাম
আর সবকটা হাড় গুঁড়ো করে দিতাম
আর সবকটা জিব টেনে বেব করে আনতাম
আর আমার মাথা খারাপ করে দেওয়া পোশাকে ঢাকা সবকটা উদোম আর উদ্ভট শরীরকে গলিয়ে জল করে দিতাম
রুশ বিপ্লবের বিরাট লাল খ্রিস্টের আবির্ভাবের পূর্বাভাস আমি অনুভব করছিলাম
আর সূর্যটা ছিল একটা দুষ্ট ক্ষত
জ্বলন্ত একটা অঙ্গারের মতো যার মুখ খুলে যেত ৷

তখন আমি কিশোর
সবে ষোলো বছর আমার বয়েস আর এরই মধ্যে ছেলেবেলার কথা আমার আর মনে পড়ত না
আমি ছিলাম মস্কোতে, সেখানে নিজেকে আমি আগুনের শিখায় পরিপুষ্ট করে তুলতে চেয়েছিলাম
আর আমার দুচোখ যতগুলি মিনার আর স্টেশনের নক্ষত্র জমা করছিল তা আমার কাছে যথেষ্ট ছিল না
সাইবেরিয়ায় কামান গর্জাচ্ছিল, যুদ্ধ চলছিল
খিদে ঠাণ্ডা মহামারী কলেরা
আমুরএর ঘোলা জল লক্ষ লক্ষ মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল
সবকটা স্টেশনে সবকটা শেষ ট্রেনকে আমি ছেড়ে যেতে দেখছিলাম
কেউ কোথাও আর যেতে পারছিল না কেননা আর কোনো টিকিটই দেওয়া হচ্ছিল না
যে সৈনিকেরা বিদায় নিচ্ছিল পারলে ওরা থেকে যেত
বুড়ো এক সন্ন্যাসী আমায় নভগরোদএর ইতিকথা গেয়ে শোনাচ্ছিল।

আমি, আমি এক অপদার্থ কবি, কোথাও আমার যেতে ইচ্ছে না করলেও যেকোনো জায়গায় আমি যেতে পারতাম
আর তাছাড়া পয়সা কামানোর ধান্ধায় বেরিয়ে পড়ার জন্য
ব্যবসায়ীদের হাতে তখনো যথেষ্ট টাকাকড়ি ছিল ৷
প্রতি শুক্রবার ভোরবেলা ওদের ট্রেন ছাড়ছিল ৷
লোকে বলাবলি করছিল যে প্রচুর লোক মারা পড়েছে ৷
একজন নিয়ে যাচ্ছিল এলার্ম ঘড়ি আর ব্ল্যাক ফরেস্টের কোকিলডাকা ঘড়ির একশটা পেটি
আরেক জন টুপির বাক্স, কলের গানের রেকর্ড আর হরেক রকমের শেফিল্ডে তৈরি বোতলের ছিপি খোলার যন্ত্র
আরেক জন মালমোএর কিছু কফিনে ভরে কৌটোর খাবার আর তেলে ডোবানো সার্ডিন
এছাড়া ছিল অনেক অনেক মেয়েমানুষ
দু পায়ের মাঝখানের ফাঁক ভাড়া দেওয়ার জন্য মেয়েমানুষ যাদের দিয়ে কফিনেরও
কাজ চলে যায়
মেয়েমানুষগুলো সব লাইসেন্স করা
লোকে বলাবলি করছিল ওখানে প্রচুর লোক মারা পড়েছে
মেয়েমানুষগুলো ছাড় দেওয়া কম দামের টিকিটে যাতায়াত করছিল
আর ওদের সবারই ব্যাংকে একটা করে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল৷

তারপর, শুক্রবারের এক সকালে, অবশেষে আমার পালা এল
তখন ডিসেম্বর মাস
আর একজন গয়নার পসারি হারবিনে যাচ্ছিল আমি ও বেরিয়ে পড়লাম তার সঙ্গে
এক্সপ্রেস ট্রেনে আমাদের ছিল দুটো খুপরি আর সঙ্গে ফরত্জাইমেব গয়নার ৩৪টা পেটি
মেড ইন জার্মানি’ মার্কা মারা জার্মান মাল
লোকটি আমায় নতুন একটা পোশাক পরতে দিয়েছিল, আর ট্রেনে উঠতে গিয়ে তার একটা বোতাম আমি খুইয়েছিলাম
কথাটা আমি ভুলি নি, কথাটা আমি ভুলি নি, তারপর থেকে হামেশাই কথাটা আমার মনে পড়েছে
পেটিগুলির ওপর আমি শুয়ে থাকতাম আর লোকটা আমায় যে নিকেল করা একটা ব্রাউনিং পিস্তল দিয়েছিল ঐ পিস্তলটা নিয়ে খেলা করতে আমার খুবই মজা লাগছিল

আমি বেশ বেপরোয়া খোশমেজাজে ছিলাম
আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন ডাকাত ডাকাত খেলছি
গোলকুণ্ডার ধনভাণ্ডার আমরা লুঠ করেছি
আর ট্রান্সসাইবেরিয়ান এক্সপ্রেসের দৌলতে, আমরা তাকে পৃথিবীর অপর প্রান্তে লুকিয়ে রেখে আসতে চলেছি
ঐ সম্পদ আমাকে রক্ষা করতে হবে যারা জ্যুল ভের্নএর মাদারিদের আক্রমণ করেছিল উরালের সেই লুঠেরাদের হাত থেকে
খুঙ্গুজদের হাত থেকে চিনের সন্ত্রাসবাদী ইহে কানদের কাছ থেকে
আর দালাই লামার খ্যাপা বেঁটে মোঙ্গলদের হাত থেকে
আলি বাবা আর চল্লিশ চোরের হাত থেকে
আর পাহাড়ের সেই ভয়ংকর বুড়োর স্যাঙাৎদের কাছ থেকে
আর বিশেষ করে, সবচেয়ে আধুনিক
হোটেলের বাটপাড়
আর আন্তর্জাতিক এক্সপ্রেস ট্রেনের ওস্তাদদের হাত থেকে ।

আর তবুও, আর তবুও
একটা বাচ্চা ছেলের মতো আমার মন খারাপ করছিল
ট্রেনের দোলা
মার্কিন মনোরোগচিকিত্সকদের ‘রেলপথ মজ্জা’
আওয়াজ দরজার গলার স্বরের ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া লাইনের ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করা চাকার ধুরার
আমার ভবিষ্যতের সোনার পাত
আমার ব্রাউনিং পিস্তল পিয়ানো আর পাশের কামরায় তাসখেলোয়াড়দের দিব্যিগালা
জানএর মনমাতানো উপস্থিতি
নীল চশমা পরা লোকটি অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল আর যেতে যেতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল
মেয়েমানুষদের ঘষাঘষির শব্দ
আর বাষ্পের হুইসল
আর আকাশের দাগকাটা পথে খেপে যাওয়া চাকার অন্তহীন ঘর্ঘর
তুষারকণায় ঢাকা শার্সি কাচ
প্রকৃতি বলতে কিছুই আর নেই !
আর পেছনে, সাইবেরিয়ার প্রান্তর নিচু আকাশ আর নীরব সব অস্তিত্বের বিরাট বিরাট ছায়া একবার ওপরে উঠছে আবার নিচে নেমে পড়ছে
একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে আমি শুয়ে রয়েছি
কম্বলটা রঙবেরঙের
আমার জীবনের মতো
আর আমার জীবন স্কটল্যাণ্ডের এই আলোয়ানটার চেয়ে
আমাকে বেশি গরম করে রাখে না
আর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকা এক্সপ্রেস ট্রেনের হাওয়াকাটা নাক থেকে এক ঝলকে দেখা গোটা ইয়োরোপ
আমার জীবনের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ নয়
আমার হতচ্ছাড়া জীবন
এই আলোয়ানটা
সোনায় ঠাসা পেটিগুলির ওপর পাতা
যে পেটিগুলি নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি
স্বপ্ন দেখা যাক
খাওয়া যাক একটা সিগারেট
আর মহাবিশ্বের একমাত্র অগ্নিশিখা হল
নগণ্য একটা ভাবনা

ভালোবাসা, আমার প্রেমিকার কথা ভাবলে
হৃদয়ের গভীর থেকে আমার চোখে জল বেরিয়ে আসে;
ওতো বাচ্চা একটি মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নয়, একটা বেশ্যাবাড়ির ভেতরে
ওকে আমি এমনই ফ্যাকাসে, নিষ্কলঙ্ক অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিলাম ।

ওতো বাচ্চা একটি মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নয়, সোনালি চুল, হাসিখুশি আর মনমরা
ওর মুখে হাসি দেখা যায়না আর ও কখনো কাঁদে না;
অথচ ওর চোখের গভীরে, যখন ও তোমাকে সেখানে চুমুক দিতে দেয়
থরথর করে কাঁপে কবির ফুল, একটা নরম রুপোর লিলি ৷

মেয়েটি চুপচাপ আর মিষ্টি, ওর কোনো দোষ নেই,
তোমার কাছে আসতে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ও কেঁপে কেঁপে ওঠে;
অথচ যখন এখান থেকে, সেখান থেকে, হৈহুল্লোড় থেকে আমি ওর কাছে আসি
ও তখন এক পা এগোয়, তারপর চোখ বোজে — তারপর আবার এক পা এগোয়।

কেননা ও আমার প্রেমিকা, আর অন্য সব মেয়েদের
আগুনের শিখার লম্বা লম্বা শরীরের ওপর সোনার পোশাকই শুধু রয়েছে,
আমার বান্ধবীটি এমনই নিঃসঙ্গ,
ও একেবারেই নগ্ন, ওর কোনো শরীরই নেই — ও যে একান্ত নিঃস্ব।

ও যে শুধু খোলামেলা, লিকলিকে একটা ফুল,
কবির ফুল, নগণ্য একটা রুপোর লিলি,
একেবারে ঠাণ্ডা, একেবারে একা, আর এরই মধ্যে এমনই শুকিয়ে যাওয়া
যে তার হৃদয়ের কথা ভাবলে আমার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে।

আর একটা ট্রেন যখন রাতের অন্ধকারে ছুটে চলছে তখন এই রাতটা আরো একলক্ষ রাতের মতো
ধূমকেতুগুলি খসে পড়ছে —
আর বয়স কম হলেও, পুরুষ আর নারী সঙ্গম করে মজা পায়৷

ফ্ল্যাণ্ডার্সে আকাশটা
জেলেদের ছোট্ট একটা গ্রামে সংগতিহীন কোনো সার্কাসের ছেঁড়া তাবুর মতো
সূর্য হোল ধোঁয়াওগরানো একটা লন্ঠন
আর ট্র্যাপিজের সবচেয়ে ওপরে একটি মেয়ে চাঁদ তৈরি করে।
ক্যারিওনেট ট্র্যাম্পেট তীক্ষ্ণ একটা বাঁশি আর রদ্দি একটা ঢাক
আর এইযে আমার ছোটবেলাকার দোলনা
আমার ছোটবেলাকার দোলনা
আমার মা যখন মাদাম বোভারির মতন বেটোফেনএর সোনাটা বাজাতেন তখন ওটা সারাক্ষণ পিয়ানোর কাছাকাছি থাকত
আমি আমার শৈশব কাটিয়েছি ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানে
আর স্কুল পালিয়ে, স্টেশনে স্টেশনে ছেড়ে দিতে যাওয়া ট্রেনগুলির সামনে
এখন, সবকটা ট্রেনকে আমি আমার পেছনে ছুটিয়েছি
বাজেলটিম্বাকটু
ওতঈ আর লোশঁর ঘোড়ার মাঠে আমি বাজি ধরেছি
প্যারিসনিউইয়র্ক
এখন, সবকটা ট্রেনকে আমি আমার সারা জীবনের পথ ধরে ছুটিয়েছি
মাদ্রিদস্টকহোম
আর আমার সবকটা বাজি আমি হেরেছি
শুধু রয়েছে প্যাটাগোনিয়া, প্যাটাগোনিয়া, যা আমার বিপুল বিষণ্ণতার সঙ্গে খাপ খায়, প্যাটাগোনিয়া,আর একবার দক্ষিণ সমুদ্রে পাড়ি
আমি পথে বেরিয়ে পড়েছি
আমি চিরটা কাল পথেই কাটিয়েছি
আমি ফ্রান্সের ছোট্ট জেআনকে নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছি
ট্রেনটা মারাত্মক একটা লাফ দিয়ে তার সবকটা চাকার ওপর বসে পড়ে
ট্রেনটা তার চাকার ওপর বসে পড়ে
ট্রেনটা চিরকাল তার সবকটা চাকার ওপর বসে পড়ে

বলনা, ব্লেজ, আমরা কি মোঁমার্ত্র্ থেকে অনেকটা দূরে?’

আমরা দূরে, জান, সাত দিন ধরে তুমি ট্রেনে করে চলেছ
তুমি মোঁমার্ত্র্ থেকে দূরে, তোমাকে যে মানুষ করেছে সেই মোঁমার্ত্র্ পাহাড় থেকে যাকে আঁকড়ে ধরে তুমি মুখ গুঁজে ছিল সেই সাক্রেক্যর থেকে দূরে
প্যারিস আর তার বিশাল আগুনের শিখা অদৃশ্য হয়ে গেছে
অবিরত ছাই ছাড়া আর কিছুই নেই
ঝরে পড়া বৃষ্টিধারা
ফুলে ফেঁপে ওঠা জলে ভেজা পচা গাছপালায় ঢাকা মাটি
পাক থেতে থাকা সাইবেরিয়া
আরো পুরু হয়ে ওঠা তুষারের ভারি চাদর
আর নীল শূন্যে অন্তিম বাসনার মতো কাঁপতে থাকা পাগলামির ঘন্টা
সিসেয় ঢাকা দিগন্ত থেকে দিগন্তের বুকে ট্রেনটা ধুক ধুক করে চলেছে
আর তোমার বেদনা মুখ বিকৃত করে

বল না, ব্লেজ, আমরা কি মোঁমার্ত্র্ থেকে অনেকটা দূরে ?’

উদ্বেগ
তাবৎ উদ্বেগ ভুলে যাও
যাত্রাপথে সবকটা ফাটলধরা আঁকাবাঁকা রেল স্টেশন
টেলিগ্রাফের তার যাতে ঐ স্টেশনগুলি সব ঝুলে রয়েছে
দাঁতখিঁচোনো খাম্বাগুলো হাতপা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ওদের গলা টিপে ধরে
জগত্সংসার ধর্ষকামী কোনো হাতে নিপীড়িত অ্যাকর্ডিয়ানের মতো হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে আর সেঁধিয়ে যায়
আকাশের ফাটলগুলির মধ্যে, উন্মাদ ইঞ্জিনগুলি
উধাও
আর গর্তের ভেতর,
মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া যত চাকা যত মুখ যত গলার স্বর
আর আমাদের পেছন পেছন ঘেউ ঘেউ করতে থাকা দুর্ভাগ্যের কুকুরগুলি
তাবৎ দানবদের শেকল খুলে দেওয়া হয়েছে
লোহালক্কড়
সবকিছুই বেসুরো
চাকার ‘ঝিক ঝিক ঝিক’
ধাক্কার পর ধাক্কা
আবার লাফের পর লাফ
আমরা একজন বধিরের মাথার মধ্যে ঝড়

বল না, ব্লেজ, আমরা কি মোঁমার্ত্র্ থেকে অনেকটা দূরে ?’

বলছি তো হ্যাঁ, আমার মাথাটা তুমি খারাপ করে দিচ্ছ, তুমি তা ভালো করেই জানো, আমরা অনেক দূরে
টগবগ করা উন্মাদনা ইঞ্জিনের ভেতর ডেকে ওঠে
মহামারী কলেরা আমাদের চলার পথে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো হাজির হচ্ছে
একটা সুড়ঙ্গের একেবারে মাঝখানে যুদ্ধের মধ্যে আমরা হারিয়ে যাই
খানকি খিদে ছত্রখান মেঘগুলোকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে
আর মৃতদেহের দুর্গন্ধ গাদায় লড়াইয়ের বিষ্ঠা
খানকি খিদের মতো হও, নিজের কাজ করে যাও

বল না, ব্লেজ, আমরা কি মোঁমার্ত্র্ থেকে অনেকটা দূরে ?’

হ্যাঁ তাই, আমরা দূরে, আমরা অনেক দূরে
সবগুলি বলির পাঁঠা এই মরুভূমিতে টেসে গিয়েছে
ঐ ঘেয়ো জানোয়ারের পালের ঘন্টার আওয়াজ শোনো
তোমস্ক চেলিয়াবিনস্ক কেইনস্ক ওবি তাইশেৎ ভের্কনে উদিনস্ক কুর্গান সামারা পেনসাতুলুন
মাঞ্চুরিয়ায় মৃত্যুই হল গিয়ে
আমাদের ঘাট আমাদের শেষ নিশানা
ভয়ংকর এই যাত্রা
গতকাল সকালে
ইভান উলিচের চুল সাদা হয়ে গেল
আর কোলিয়া নিকোলাই ইভানোভিচ পনেরো দিন ধরে আঙুল কামড়ে চলেছে
মৃত্যু দুর্ভিক্ষ তুমি নিজের কাজ করে যাও তুমি মৃত্যুর মতো হও দুর্ভিক্ষের মতো হও
এর দাম একশ পয়সা, ট্রান্সসাইবেরিয়ান এক্সপ্রেসে এর দাম একশ রুবল
গদি আটা বেঞ্চির গায়ে জ্বর আর টেবিলের তলায় হাম
শয়তান পিয়ানো বাজাচ্ছে
তার গাঁটওয়ালা আঙুল সবকটি মেয়েকে কামার্ত করে তোলে
প্রকৃতি
যত ছেনাল
নিজের কাজ করে যাও
হারবিন অব্দি

বলনা, ব্লেজ, আমরা কি মোঁমার্ত্র্ থেকে অনেকটা দূরে?’

না তবেআমায় আর জ্বালিয়ো নাআমায় শান্তিতে থাকতে দাও
তোমার পাছাদুটো ছুঁচলো
তোমার পেট টকো আর তোমায় গনোরিয়ায় ধরেছে
প্যারিস তোমার কোলে এটাই শুধু উপহার দিয়েছে
আর একটুখানি অন্তরওকেননা তুমি কষ্ট পাচ্ছ
আমার করুণা হচ্ছে আমার করুণা হচ্ছে আমার কাছে এসো আমার বুকের ওপর
চাকাগুলি সবপেয়েছির দেশের হাওয়াকল
আর হাওয়াকলগুলি কোনো একটা ভিখিরির ঘোরাতে থাকা লাঠি
আমরা মহাশূন্যের পাকাটা আতুর
আমাদের চারটে ক্ষতের ওপর আমরা গড়িয়ে চলেছি
ওরা আমাদের ডানাগুলি কামড়ে থেয়ে ফেলেছে
আমাদের সাতটি পাপের ডানা
আর সবকটা ট্রেন হোল শয়তানের লাটিম
খামারবাড়ির উঠোন
আধুনিক জগৎ
গতি ওখানে কিছুই করতে পারে না
আধুনিক জগৎ
যাকিছু দূরবতী তা খুবই দূরে
আর যাত্রাপথের শেষে মেয়েমানুষ সঙ্গে নিয়ে একজন পুরুষ হওয়াটা ভয়ংকর

বলনা, ব্লেজ, আমরা কি মোঁমার্ত্র্ থেকে অনেকটা দূরে?’

আমার করুণা হচ্ছে আমার করুণা হচ্ছে আমার কাছে এসো আমি তোমায় একটা গল্প বলব
আমার বিছানায় এসো
আমার বুকের ওপর
আমি তোমায় একটা গল্প বলব
বলছি এসো! এসো!

ফিজি দীপপুঞ্জে বিরাজ করে অন্তহীন বসন্ত
আলস্য
লম্বা ঘাসের মধ্যে ভালোবাসা জোড়ায় জোড়ায় নারীপুরুষকে অবশ করে দেয় আর তপ্ত সিফিলিস কলাগাছের ঝাড়ের ছায়ায় ঘুরে বেড়ায়
চলো প্রশান্ত মহাসাগরের হারিয়ে যাওয়া দ্বীপগুলিতে যাই
ফিনিক্স আর মার্কিজ ওদের নাম
বোর্নিও আর জাভা
আর বেড়ালের মতন দেখতে সুলাবেশি দ্বীপ।

জাপানে আমরা যেতে পারব না
চলো যাই মেক্সিকোতে!
উঁচু উঁচু মালভূমির ওপর ট্যুলিপ গাছগুলি ফুলে ভরা
বাড়ন্ত লতাগুল্মগুলো সূর্যের গোছা গোছা চুল
বলা যায় চিত্রকরের রঙদানি আর তাবৎ তুলি
ঘন্টার আওয়াজের মতন কানে তালা লাগানো রঙ
রুসো ওখানেই ছিলেন
ওখানেই তিনি জীবনটাকে ঝলসে দিয়েছিলেন
পাখিদের ঐ দেশ
স্বর্গের পাখি, লায়ারপাখি
টুকান, মকিং বার্ড
আর মধুচুষ কালো লাইলাকের বুকে বাসা বাঁধে
চলে এসো!
কোনো একটা আজটেক মন্দিরের বিশাল ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আমরা প্রেম করব
তুমিই হবে আমার প্রতিমা
বেরঙরঙ ছেলেমানুষি একটুখানি বাজে দেখতে আর উদভটভাবে অদ্ভুত একটা প্রতিমা
হ্যাঁ চলে এসো!

তুমি চাইলে আমরা এরোপ্লেনে করে চলে যাবো আর হাজার হাজার হ্রদের দেশের ওপর দিয়ে উড়ে যাবো
রাত সেখানে মাত্রারিক্ত ভাবে দীর্ঘ
আমার মোটরের শব্দে প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ ভয় পেয়ে যাবে
আমি মাটিতে নামব
আর আমি আমার এরোপ্লেনের জন্য ম্যামথের ফসিল হাড় দিয়ে একটা ছাউনি তৈরি করব
আদিম আগুন আমাদের করুণ ভালোবাসাকে আবার উত্তপ্ত করে তুলবে
সামোভার
মেরুর কাছাকাছি বেশ বড়লোকি চালে আমরা ভালোবাসব
হ্যাঁ চলে এসো!

জান জানসোনা সোনামণি মণি মেনি মেনা
বেড়ালছানা চাঁদের কণা খুকুরানি সোনার খনি
ঘুমঘুম ঝুমঝুমি
চুষিকাঠি আমার লেবেঞ্চুষ
টুনটুনি প্রাণ আমার
দুষ্টু মেয়ে
পাগল আমার ছাগলছানা
টুকটুকে আমার পাপ
ধন ধন এইটুকু
টুকি
ও ঘুমোচ্ছে৷

ও ঘুমোচ্ছে;
আর পৃথিবীর সবকটা সময়ের একটাকেও ও গিলে খায় নি
স্টেশনে স্টেশনে একটুখানি চোখে পড়া সবকটা মুখ
সবকটিা ঘড়ি
প্যারিসের সময় বার্লিনের সময় সেন্ট পিটার্সবুর্গের সময় আর সবকটা রেলস্টেশনের সময়
আর উফায়, গোলন্দাজের রক্তমাখা মুখ
আর গ্রদনোয় অকারণে আলোকোজ্জ্বল ডায়াল
আর ট্রেনের নিরন্তর এগিয়ে চলা
লোকে প্রতি দিন ভোরবেলা হাতঘড়ি মিলিয়ে নেয়
ট্রেন এগিয়ে চলে আর সূর্য পিছিয়ে পড়ে
তাতে কিছুই ঘটে না, আমি গির্জের সুরেলা ঘন্টাধ্বনি শুনতে পাই
নৎর্দামের গম্ভীর বিশাল ঘন্টা
লুভরএর তীক্ষ্ণ সেই ঘন্টা যা সন্ত বার্তেলেমির উৎসবের দিন বেজে উঠেছিল
ব্র্যুজলামর্তএর মরচে পড়া ঘন্টা
নিউ ইয়র্ক গ্রন্থাগারের বৈদ্যুতিক ঘন্টা
ভেনিসের গির্জের পাশে মিনারের ঘন্টা
আর মস্কোর গির্জের ঘন্টাগুলি, যখন আমি একটা দপ্তরে কাজ করতাম তখন আমাকে যে সময়ের
হিসেব দিত সেই মস্কোর লালফটকের ঘড়ি
আর আমার যত স্মৃতি ।
বাঁকগুলির ওপর দিয়ে ট্রেন গুমগুম গর্জন করে উঠছে
ট্রেন ছুটছে
একটা গ্রামোফোনে জিপসি তাল গরগর করছে
আর জগত্সংসার প্রাগের ইহুদিপাড়ার ঘড়ির মতো প্রাণপনে পেছনের দেকে ছুটে চলেছে

ছিঁড়ে ফেল বাতাসের গোলাপের পাপড়ি
এই যে শেকলছেঁড়া ঝড় সোঁ সোঁ আওয়াজ করে ওঠে
পথের জটপাকানো জালের ওপর দিয়ে ট্রেনগুলি ছুটে চলেছে
শয়তানের লাটিম
কিছু কিছু ট্রেন রয়েছে যারা কখনো একে অন্যের দেখা পায় না
আর কতগুলি পথ চলতে চলতে হারিয়ে যায়
স্টেশনমাস্টাররা দাবা খেলছে
পাশা
বিলিয়ার্ড
ক্যারামবোর্ড
অধিবৃত্ত
রেলের লাইন নতুন এক জ্যামিতি
সাইরাকিউজ
আর্কিমেডিস
আর যারা তাঁর মুণ্ডু কেটেছিল সেই সব সৈনিক
আর ক্রীতদাসদের দাঁড়টানা জাহাজ
আর যত জলপোত
আর তাঁর উদভাবিত বিস্ময়কর সব যন্ত্র
আর সবগুলি হত্যাকাণ্ড
প্রাচীন যুগের ইতিহাস
আধুনিক যুগের ইতিহাস
যত ঘূর্ণিঝড়
যত জাহাজডুবি
এমনকি আমার খবরের কাগজে পড়া টাইটানিকের ডুবে যাওয়াটাও
এত সব চিত্রানুষঙ্গ আমি যা নিজের পদ্যে ঠিকমত ফুটিয়ে তুলতে পারি না
কেননা আমি এখনো নিতান্ত অপদার্থ কবি
কেননা মহাবিশ্ব আমাকে ডুবিয়ে দিয়ে যায়
কেননা ট্রেনদুর্ঘটনার জন্য ইনসিওরেন্স করার কথাটা আমার মাথায় আসে নি
কেননা আমি কোনো কিছুরই শেষ অব্দি পৌঁছতে জানি না
আর আমার ভয় করে৷

আমার ভয় করে
আমি কোনো কিছুরই শেষ অব্দি পৌঁছতে পারি না
আমার বন্ধু শাগালের মতো আমি একটা অদ্ভুত চিত্রমালা আঁকতে পারি
তবে ঘোরাঘুরির পথে আমি কিছুই টুকে রাখি নি
গিয়োম আপোলিনের যেমন বলে
আমার অজ্ঞতার জন্য আমায় ক্ষমা করবেন
পদ্যের পুরনো খেলাটা আমি আর খেলতে পারি না বলে আমায় ক্ষমা করবেন’
যুদ্ধের সব খবরই লোকে কুরোপাৎকিনএর স্মৃতিকথায় পড়ে নিতে পারে
অথবা পড়তে পারে জাপানি খবরের কাগজে যেগুলি আবার নিষ্ঠুরভাবে সচিত্রও
স্মৃতির অতর্কিত চমকের হাতে
আমি আত্মসমর্পণ করি

ইর্কুত্সক থেকে যাত্রা খুবই মন্থর হয়ে উঠল
একটানা
প্রথম যে ট্রেনটি বৈকাল হ্রদের চারপাশ ঘুরে যাচ্ছিল আমরা তাতে করেই চলেছিলাম
পতাকা আর চিনে লন্ঠনে ইঞ্জিনটাকে সাজানো হয়েছিল
জারের বন্দনাগীতির বিষণ্ণ সুরের মধ্যে আমরা স্টেশন ছেড়েছিলাম
চিত্রকর হলে এই যাত্রার সমাপ্তির ওপর আমি অনেকটা লাল রঙ অনেকটা হলুদ রঙ ঢেলে দিতাম
কেননা আমরা দৃঢ় ধারণা আমরা সবাই ছিলাম কমবেশি পাগল
আর বিপুল এক প্রলাপ আমাদের সহযাত্রীদের রাগত মুখকে রক্তিম করে তুলেছিল
যখন আমরা অগ্নিকাণ্ডের মতো গোঁ গোঁ করা
মঙ্গোলিয়ার কাছে এসে পৌঁছাচ্ছিলাম ৷
তখন ট্রেন তার গতি শ্লথ করে দিয়েছিল
আর চাকার অবিরত ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ আওয়াজের মধ্যে আমি উপলব্ধি করছিলাম
চিরন্তন এক প্রার্থনাগীতির
ফুঁপিয়ে কান্না আর উন্মাদ ব্যাকুল এক সুর ৷

আমি দেখেছি
আমি দেখেছি নিঃশব্দ ট্রেনগুলি কালো কালো ট্রেনগুলি দূরপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসছে আর অপচ্ছায়ার মতো চলে যাচ্ছে
আর আমার চোখ, পেছনে ঝোলানো লন্ঠনের মতো, ঐ ট্রেনগুলির পেছনে এখনো ছুটে চলেছে
তালগায় ১০০০০০ আহত মানুষ চিকিত্সার অভাবে মরতে বসেছে
আমরা ক্রাসনোইআর্স্ক্এর হাসপাতগুলি ঘুরে ঘুরে দেখেছি
আর খিলোকএ আমরা পাগল হয়ে যাওয়া সৈনিকদের দীর্ঘ একটা সারির পাশ দিয়ে গিয়েছি
আর চিকিত্সাকেন্দ্রে আমি দেখেছি হাঁকরা ক্ষতমুখ থেকে অর্গানের চড়া সুরে রক্ত ঝরে পড়ছিল
আর কেটে বাদ দেওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি চারপাশে নাচছিল বা দমকা হাওযায় উড়ে যাচ্ছিল
সবকটি মুখে সবকটি হৃদয়ে অগ্নিকাণ্ড
নির্বোধ আঙুলগুলি সবকটি কাচের শার্সিতে তাল ঠুকে যাচ্ছিল
আর ভয়ের চাপে চোখের দৃষ্টিগুলি ফোঁড়ার
সবকটি রেলস্টেশনে সবগুলি গাড়ির কামরা পোড়ানো হচ্ছিল
আর আমি দেখেছি
আমি দেখেছি কামার্ত দিগন্তগুলোর তাড়া খাওয়া ৬০ ইঞ্জিনের যত ট্রেন আর তার পেছনে পেছনে উড়ে যাওয়া পালে পালে কাক
পোর্টআর্থারের পথে
অদৃশ্য হয়ে গেল৷

চিতায় পৌঁছে আমরা কয়েক দিনের জন্য হাঁফ ছাড়ার অবকাশ পেলাম
রেল লাইনের গোলমালের জন্য পাঁচ দিনের বিরতি
আমরা ঐ বিরতি কাটালাম সেই ইয়ানকেলেভিচএর বাড়িতে যিনি তাঁর একমাত্র মেয়েকে আমার
সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছিলেন
তারপর আবার ট্রেন ছেড়ে দিল ৷
আমিই এবার পিয়ানোয় বসেছিলাম আর আমার দাঁত কনকন করছিল
যখনই আমার ইচ্ছে হয় আমি দেখতে পাই এমন স্তব্ধ সেই ভেতরের বাড়ি বাবার দোকান আর যে
মেয়েটি রাতে আমার বিছানায় চলে আসত তার চোখদুটি
মুসোরগস্কি
আর য়ূগো ভোলফএর লোকগীতি
আর গোবিমরুভূমির বালি
আর খাইলারএ মালপত্র নিয়ে সাদা উটের একটা দল
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ৫০০ কিলোমিটারের ওপর পথ ধরে আমি ছিলাম মদের ঘোরে
তবে আমি পিয়ানো বাজাচ্ছিলাম আর এটাই শুধু আমার চোখে পড়েছিল
যাত্রাপথে উচিত চোখ দুটি বুজে থাকা
ঘুমনো
ঘুমোতে পারলে কীযে ভালো হত
গন্ধ শুকেই চোখ বুজে আমি সবকটি দেশ চিনে নিতে পারি
আওয়াজ শুনেই আমি সবকটি ট্রেন চিনে নিতে পারি
ইয়োরোপের ট্রেনগুলি চলে চার তালে যেখানে এশিয়ার ট্রেনগুলি চলে পাঁচ বা সাত তালে
আর অন্য ট্রেনগুলি হল চুপিসাড়ে চলে যাওয়া ঘুমপাড়ানি গান
আবার এমন কিছু ট্রেন আছে যারা তাদের চাকার একঘেয়ে আওয়াজ আমাকে মেতেরল্যাঁকএর অনড় গদ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়
চাকার তাবৎ জগাখিচুড়ি রচনারই আমি পাঠোদ্ধার করেছি আর হিংস্র সৌন্দর্যের ছড়ানোছিটানো
উপাদানগুলি একজায়গায় জড়ো করেছি
সেগুলি রয়েছে আমার কাছে
আর সেগুলি আমার ওপর ভর করেছে ৷

চিচিকা আর হারবিন
এর থেকে বেশি দূরে আমি আর যাচ্ছি না
এটাই হল গিয়ে শেষ স্টেশন
আমি হারবিনএ নেমে পড়লাম কেউ যেন রেডক্রশের অফিসগুলিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল ৷

প্যারিস
বিশাল এক উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ড যাতে আড়াআড়ি ভাবে রাখা তোমার রাস্তাগুলির জলন্ত যত চেলাকাঠ আর তার ওপর নুয়ে পড়া তোমার যত পুরনো বাড়ি যারা ঠাকুরমাদিদিমাদের মতো
তাদের গা গরম করছে
আর এই যে পোস্টারগুলি, আমার সংক্ষিপ্ত হলুদ অতীতের মতন লাল সবুজ রঙবেরঙ
হলুদ হল বিদেশে ফরাসি দেশের উপন্যাসের গর্বিত রঙ
বড় বড় শহরে বাসে গা ঘষতে আমার ভালো লাগে
স্যাঁজের্ম্যাঁমোঁমার্ত্র্ রুটের বাসগুলি আমাকে মোঁমার্ত্র্ পাহাড়ের সামনে পৌঁছে দেয়
মোটরগুলি সোনার ষাঁড়ের মতো ডেকে ওঠে
গোধূলির গোরুগুলি সাক্রেক্যর চিবিয়ে খায়
প্যারিস
মূল স্টেশন বাসনার ঘাট দুর্ভাবনার মোড়
শুধুমাত্র ওষুধের দোকানের দরজার তলায় এখানো একটুখানি আলো রয়েছে
ট্রেনের শয়নকামরা আর ইয়োরোপের বিখ্যাত যত দ্রুতগামী ট্রেনের আন্তর্জতিক বাণিজ্যসংস্থা আমাকে তার প্রসপেক্টাস পাঠিয়েছে
এটাই হল গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গির্জে
আমার কিছু বন্ধু রয়েছে যারা আমায় পাঁচিলের মত ঘিরে থাকে
ওদের ভয় কখন আমি আবার বেরিয়ে পড়ি হয়ত আমি আর ফিরে আসব না
আমি যেসব নারীর দেখা পেয়েছি তারা সবাই দিগন্তে দিগন্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে
করুণ ওদের অঙ্গভঙ্গি আর ওদের চাউনি বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার ট্র্যাফিক সিগনালের মতো বিষণ্ণ
বেলা, অ্যাগনেস, ক্যাথরিন আর ইতালিতে আমার ছেলের মা
আর ঐযে উনি, আমেরিকায় আমার প্রেমিকার মা
সাইরেনের কিছু আর্তনাদ রয়েছে যা আমার অন্তরকে বিদীর্ণ করে
ওখানে মাঞ্চুরিয়ায় একটা পেট এখানো থরথর করে কেঁপে উঠছে প্রসবের সময় যেমনটি হয়
ভালো হোত
ভালো হোত আমি যদি কখনো আমার এই ভ্রমণগুলি না করতাম
আজ রাতে দারুণ এক ভালোবাসা আমায় যন্ত্রণা দিচ্ছে
আর না চাইলেও আমি ফ্রান্সের ছোট্ট জেআনএর কথা ভাবছি
বিষাদে ভরপুর এক সন্ধ্যায় তার সম্মানে এই কবিতা আমি লিখছি
জান
বেঁটেখাটো বারবনিতা
আমার মন খারাপ আমার মন খারাপ
আমার হারানো যৌবনকে ফের স্মরণ করার জন্য আমি যাবো ‘দুরন্ত খরগোশ’ রেস্তোরাঁয়
আর ছোট্ট কয়েক গেলাস মদ খাবো
তারপর একা একা আমি বাড়ি ফিরব

প্যারিস

নির্যাতনচক্র বিরাট ফাঁসিকাঠ আর অনন্য টাওয়ারের নগরী ফন্ত্রণা দেওয়ার চাকা

                                                                                                                                      প্যারিস ১৯১

                             

                                                                         

পানামা অথবা আমার সাত মামার কীর্তিকলাপ
(Le panama ou les aventures de mes sept oncles)
                              মাতাচিনএর বারম্যান এদমোঁ বেরত্রঁকে


বই
পানামা খালের ওপর কিছু বই রয়েছে
গ্রন্থাগারের পুস্তকতালিকায় কী বলা হয়েছে তা আমার জানা নেই
আর রেডিয়োর আর্থিক সমাচার আমি শুনি না
যদিও শেয়ারবাজারের বুলেটিন হল আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক প্রার্থনা

পানামা খালের সঙ্গে আমার ছেলেবেলার সম্পর্কটা ছিল নিবিড়
টৈবিলের তলায় বসে আমি খেলতাম
মাছির শরীর নিয়ে কাঁটাছেড়া করতাম
আমার মা তার সাত ভাইয়ের
আমার সাত মামার কীর্তিকলাপের গল্প বলত
আর আমার মা যখন চিঠি পেত
সে এক অবাক কাণ্ড !
অজানা দূর দেশের টিকিট লাগানো ব়্যাঁবোর কবিতার লাইন ছাপানো ঐ চিঠিগুলি
সেদিন মা আমায় আর কোনো গল্প বলত না
আর আমি টেবিলের তলায় মনমরা হয়ে বসে থাকতাম

আর ঐ সময়েই আমি লিসবনের ভূমিকম্পের ইতিহাস পড়েছিলাম
অথচ আমার মনে হয়
পানামা খালের দেউলিয়া হওয়াটা সারা পৃথিবীতে আরো গুরুতর ঘটনা
কেননা আমার শৈশবকে তা ওলটপালট করে দিয়েছিল ৷

আমার একটা সুন্দর ছবির বই ছিল
আর প্রথমবার আমি দেখছিলাম তিমিমাছ
তিমিমাছ
বিশাল মেঘ
সিন্ধুঘোটক
সূর্য
প্রকাণ্ড সিন্ধুঘোটক
ভালুক সিংহ শিম্পাঞ্জি ঘন্টাওয়ালা সাপ আর মাছি
মাছি
ভয়ংকর মাছি
মা, মাছি, মাছি! আর গাছের গুঁড়ি!
সোনা আমার, ঘুমো, ঘুমো ৷
আহাজুয়েরুস একটা গবেট

আমার সূন্দর একটা ছবির বই ছিল
দিল দ্যুরাক নামে প্রকাণ্ড একটা শিকারি কুকুর
একটা ইংরেজ ঝি
ব্যাংকার
আমার বাবা তাঁর সম্পত্তির ৩/৪ অংশ খোয়ালেন
যাঁরা এই দেউলিয়া হওয়ার ঘটনায় তাঁদের টাকা খুইয়েছিলেন এরকম কিছু ভদ্রলোকের মতো,
তবে তুলনায় তাঁদের চেয়ে কম বোকা
আমার বাবা
হারাচ্ছিলেন অন্য লোকদের টাকা
পিস্তলের গুলি।
আমার মা কাঁদছিল;
সেদিন রাতে আমাকে ইংরেজ ঝির সঙ্গে ঘুমোতে পাঠানো হল

তারপর খুবই লম্বা কয়েকটা দিন কেটে যাওয়ার পর
আমাদের বাড়ি পাল্টাতে হল
আর আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটের কয়েকটি ঘর ছিল আসবাবে ঠাসা
আমাদের সমুদ্রের ধারের ভিলায় আমরা আর রইলাম না
গাদা করা আসবাবের মধ্যে
দিনের পর দিন আমি একা একা কাটাতাম
এমন কি ইচ্ছে করলে আমি বাসনপত্র টুকরো টুকরো করতে পারতাম
সোফার গদি ফাঁসিয়ে দিতে পারতাম
গিয়ানোটা ভেঙে চুরমার করতে পারতাম
এর বেশ কিছু দিন বাদে
আমার এক মামার চিঠি এল

পানামার দেউলিয়া হওয়ার ঘটনাটাই আমাকে কবি করে দিল
ব্যাপারটা মজার
আমার সমবয়সীরা সবাই এরকমই
কম বয়সীরা
যারা অদ্ভুত ওঠানামা ভোগ করেছে
আমরা আর আসবাব নিয়ে খেলি না
আমরা আর পুরনো দিনের জিনিসপত্র নিয়ে খেলিনা
সারাক্ষণ আর সর্বত্র আমরা বাসনপত্র ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করি
আমরা জাহাজে চড়ে দেশান্তরে পাড়ি দিই
আমরা তিমিমাছ শিকার করি
আমরা সিন্ধুঘোটক মারি
আমরা চিরকাল চে চে মাহিকে ভয় করি
কেননা ঘুমোতে আমাদের ভালো লাগে না ৷

ভালুক সিংহ শিম্পাঞ্জি ঘন্টাওয়ালা সাপ আমাকে পড়তে শিখিয়েছিল
আহারে ! তাবৎ সৃষ্টির চেয়ে বেশি পিল পিল করা আহা সেই প্রথম চিঠিটা
আমি নিজে নিজে তার পাঠোদ্ধার করেছিলাম
আমার মামা লিখছে
আমি গালভেস্টোনে মাংসের দোকানদার
জবাইথানাগুলো শহর থেকে ১৮ মাইল দূরে
সন্ধেবেলা সমুদ্রের ধার দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়া জানোয়ারগুলো আমি নিজেই বয়ে নিয়ে আসি
আর আসার সময় বিরাট বিরাট অক্টোপাসগুলি শূন্যে লাফিয়ে ওঠে
অস্তমিত সূর্য়
আর এছাড়া আরো কিছু একটা ছিল
বিষণ্ণতা
আর বাড়ির জন্য মন কেমন করা।

মামা তুমি ১৮৯৫এর ঘূর্ণিঝেড়ে হারিয়ে গেলে
তারপর নতুন করে তৈরি করা শহরটা আমি দেখেছি আর যে পথ ধরে রক্ত ঝরে পড়া
জানোয়ারগুলো তুমি বয়ে নিয়ে আসতে সেই সমুদ্রের ধার ধরে আমি হেঁটেছি
বেড়া দেওয়া একটা মণ্ডপে স্যালভেশন আর্মির একটা ব্যাণ্ডপার্টি ব্যাণ্ড বাজাচ্ছিল
ওরা আমায় এক পেয়ালা চা খাওয়াল
তোমার মৃতদেহ কখনোই আব ধুঁজে পাওয়া যায় নি
আর কুড়ি বছর বয়সে উত্তরাধিকারী হিসেবে আমি পেলাম তোমার জমানো ৪০০ ডলার
যে বিস্কুটের কৌটোয় তুমি স্মৃতিচিহ্ন জমাতে ওটাও আমার হাতে রয়েছে
ওটা টিনের
তোমার জমানো টুকিটাকি সব জিনিস
ইউনিফর্মের একটা বোতাম
একটা কাবিল পাইপ
কয়েকটা কোকোর দানা
তোমার নিজের হাতে আঁকা খান দশেক জলরঙের ছবি
পুরস্কার পাওয়া যত জানোয়ারের ফটো, প্রকাণ্ড সব ষাঁড় তুমি তাদের দড়ি ধরে রয়েছে
তোমার পরনে হাফশার্ট আর সাদা অ্যাপ্রন ৷

জন্তুজানোয়ার আমারও ভালো লাগে
টেবিলের তলায়
একা
এরই মধ্যে চেয়ার নিয়ে আমি থেলি
আলমারি দরজা
জানলা
আধুনিক স্টাইলের আসবাবপত্র
কল্পনা করে নেওয়া জীবজন্তু
বাড়ির মধ্যে যাদের রাজত্ব
জাদুঘরে প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারগুলির পুনর্নিমাণের মতো
প্রথম টুলটা হল গিয়ে একটা বাইসন:
দ্রুত কাচের আলমারির মধ্যে আমি ঢুকে পড়ি
আর সব কিছু আমি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি
শহরটা আমার কুকুরের খাবার
ছবি
বই
ঝি
দেখাসাক্ষাৎ
কীযে হাসাহাসি!

কি করে যে তোমরা চাও আমি পরীক্ষার জন্য তৈরি হই?
আমায় তোমরা ইয়োরোপের তাবৎ বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিলে
উচ্চমাধ্যমিক
মাধ্যমিক
বিশ্ববিদ্যালয়
কী করে তোমরা চাও আমি পরীক্ষার জন্য তৈরি হই?
যখন দরজার তলায় রয়েছে একটা চিঠি
ওটা আমার চোথে পড়ল
সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা!
চিঠিটা যে পথ পেরিয়ে এসেছে তা আমি সিনেমায় দেখেছি
আমার কাছে পৌঁছতে চিঠিটার আটষট্টি দিন সময় লেগেছে
বানান ভুলে ভর্তি
আমার দ্বিতীয় মামা:
যে মেয়েটিকে আমি বিয়ে করেছি সে জেলার সবচেয়ে ভালো রুটি বানায়
আমার বাড়ি আমার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে তিন দিনের পথ
আমি এখন আলাস্কায় সোনা থুঁজছি
আমার বেলচায় আজ অব্দি কখনো ৫০০ ফ্রঁর বেশি দামের সোনা ওঠে নি
এমনকী জীবনটারও ঠিক দাম পাওয়া না!
আমার তিনটে আঙুল ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে গেছে
শীত পড়েছে
আর এছাড়া আরো কিছু একটা ছিল
বিষণ্ণতা
আর বাড়ির জন্য মন কেমন করা।

হায়রে মামা আমার, মা আমায় সবকিছুই বলেছে
তোমার ভাইদের সঙ্গে পালাবার জন্য তুমি ঘোড়া চুরি করেছিল
মালবওয়া জাহাজে তুমি কেবিন বয়ের কাজ নিয়েছিল
চলন্ত ট্রেন থেকে লাফাতে গিয়ে তুমি পা ভেঙে ফেললে
আর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সরকারি ডাকগাড়ি থামানোর অপরাধে তুমি জেলে গেলে
আর ম্যুসের অনুপ্রেরণায় তুমি কবিতা লিখতে
সান ফ্রান্সিসকো
ওখানেই তুমি পড়েছিলে জেনারেল স্যুতেরএর কাহিনি যেই জেনারেল স্যুতের কালিফোর্নিয়া জয় করে যেই যুক্তরাস্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন
আর ঐ কোটিপতি স্যুতের তাঁর জমিতে সোনার খনি আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে সর্বস্বান্ত হলেন
আমি যেখানে জমির গাছ কাটার কাজ করেছি সেই সাক্রামেন্তো উপত্যকায় তুমি বহুকাল ধরে
শিকার করেছ
কিন্তু কী হল
আামি তোমার অহংকারের মানে বুঝি

জেলার সবচেয়ে ভালো রুটি খাওয়া আর প্রতিবেশীদের শত্রুতা যেখানে ১০০০ বর্গ কিলোমিটারে ১২ জন মেয়ের বাস
তোমাকে খুঁজে পাওয়া গেল
বন্দুকের গুলিতে মাথার খুলি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে
তোমার স্ত্রী সেখানে ছিল না
তোমার স্ত্রী তারপর একজন পয়সাওয়ালা জ্যাম তৈরির কারখানার মালিককে আবার বিয়ে করল

আমার তেষ্টা পেয়েছে
গোল্লায় যাক
গোল্লায় যাক সব
গোল্লায় যাক সব
ন্যোশতালএর খবরের কাগজ’ বা ‘পঁপল্যুনএর পত্র’ পড়তে পারলে ভালো হত
অ্যাটলান্টিকের মাঝখানে আমরা সম্পাদকীয় দপ্তরের মধ্যে থাকার চেয়ে খুব একটা বেশি স্বস্তিতে নেই
নিজের খাঁচায় ফিরে যাওয়া কাঠবিড়ালির মতো আমি আমার ওপরের খাঁচায় ফিরে যাই
ঐ তো ঐ তো একজন রুশ যাকে দেখলে বেশ ভালোমানুষ বলেই মনে হয়
কোথায় যাওয়া য়ায়
ও নিজেও জানে না কোথায় ওর মাল রাখবে
লেওপল্দভিলে বা নাজারেথের কাছে সেজারায়, মিস্টার জ্যুনোর বাড়িতে অথবা আমার পুরনো বন্ধু পের্লএর ওখানে
কঙ্গোতে বাসারাবিয়ায় সামোয়ায়
তাবৎ টাইমটেবিল আমার জানা আছে
তাবৎ ট্রেন আর তাবৎ বদল করার ট্রেন
পোঁছানোর সময় ছাড়ার সময়
তাবৎ যাত্রীবাহী জাহাজ তাবৎ ভাড়া তাবৎ মাশুল
কিছুতেই কিছু আমার এসে যায় না
আমার কাছে রয়েছে ঠিকানা
উঞ্ছবৃত্তি করে বেঁচে থাকা
ভোলত্যুর্নো জাহাজে করে আমি অ্যামেরিকা থেকে ফিরে আসছি ৩৫ ফ্রঁতে নিউইয়র্ক থেকে
রটেরডাম

সেটা ছিল জাহাজকোম্পানীর মহরৎ
পরপর ইঞ্জিনগুলি একে অপরকে জোর থাপ্পড় মেরে চলেছে
নিগ্রো চাকররা
ঝপাস
বালতি বালতি জল
আঙুলে কালির দাগওয়ালা একজন অ্যামেরিকান তাল দিয়ে চলেছে
বেতারবার্তা
কমলালেবুর খোসা আর খালি খাবারের কৌটোর মধ্যে হাঁটু ঢুকিয়ে আমরা নেচে চলেছি
ক্যাপ্টেনের কাছে একটা প্রতিনিধিদল
রুশ বিপ্লবী যৌন অভিজ্ঞতা
গাউপা
সবচেয়ে অশ্লীল হাঙ্গেরিয়ান শব্দ
৮ মাসের গর্ভবতী এক নাপলিতান মার্কিজকে আমি সঙ্গে নিয়ে আসছি
আমিই কিশিনেভএর শরনার্থীদের হামবুর্গে নিয়ে চলেছি
সেটা ১৯০১ সাল যখন আমি প্রথম মোটরগাড়ি দেখলাম
বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে,
ঐ ছোট্ট ট্রেন সোল্যরএর লোকেরা যার নাম দিয়েছে ইস্ত্রি
আমার কনসালকে আমি ফোন করব
অবিলম্বে আমাকে একটা থার্ড ক্লাসের টিকিট দিন
দ য়ুরিনিয়াম স্টিমশিপ কোম্পানি
আমি চাই আমার টাকার উপযুক্ত মূল্য দেওয়া হোক
জাহাজটা ঘাটে বাঁধা
যন্ত্রপাতি সব খুলে ফেলা হয়েছে
মাল তোলার ফটকগুলি হাট করা
লোকে যেরকম একটা নোংরা বেশ্যাকে ফেলে চলে যায় আমি জাহাজটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম
যাত্রাপথে
আমার পোঁদ মোছার কাগজ ফুরিয়ে গেছে
আমি বেরিয়ে পড়লাম
জগতটাকে জল থেকে বড়শিতে গেঁথে যিনি টেনে তুলেছিলেন সেই দেবতা তাঙ্গালোয়ার মতো
আমার তৃতীয় মামার শেষ চিঠি:
পাপেৎ , ১লা সেপ্টেম্বর ১৮৮৭
বোন আমার, আমার খুবই আদরের বোন
আমি বৌদ্ধ একটা রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের সদস্য
ডিনামাইট কেনার জন্য আমি এখানে এসেছি
তোদের ওখানে য়েমন চিকোরি বিক্রি হয় এখানে সেভাাবো ছোট ছোট প্যাকেটে মুদির দোকান
ডিনামাইট বিক্রি হয়
এরপর আমি ইংরেজদের উড়িয়ে দেওয়ার জন্য বোম্বাইয়ে ফিরে যাবো
সব কিছু বেশ তেতে উঠছে
তোর সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না
আর এছাড়া আরো কিছু একটা ছিল
বিষাদ
আর বাড়ির জন্য মন কেমন করা

এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো
আমি মার্সেইএ জেল খাটলাম আর আমাকে আবার স্কুলে নিয়ে যাওয়া হল
সবগুলি গলা একসঙ্গে চিত্কার করতে থাকে
জীবজন্তু আর পাথর
বোবার কথাই সবচেয়ে সুন্দর
উচ্ছৃঙ্খল আমি জগত্টাকে নিয়ে যা খুশি করেছি

তোমরা যারা ইশ্বরে বিশ্বাস কর তোমরা কেন সময়মত এসে হাজির হলে না
তোমাদের বয়সকালে
মামা আমার
তুমি ছিলে সুপুরুষ আর খুবই ভালো ক্লারিওনেট বাজাতে
রেখে ঢেকে না বললে বলতেই হয় সেটাই তোমার সর্বনাশের কারণ হল
গানবাজনা তুমি এতটা ভালোবাসতে যে কালো পোসাকের
ঐকতানের চেয়ে বোমার নাক ডাকা তোমার বেশি ভালো লেগে গেল
ভগবাপুরের চারপাশে রেললাইন তৈরির কাজে আমুদে ইতালিয়ানদের সঙ্গে তুমি কাজ করেছ
মজা করার নাটের গুরু
তুমিই ছিলে তোমার সঙ্গীসাথীদের সর্দার
তোমার রগুড়েস্বভাব আর তোমার ব্যাণ্ডবাদকের দারুণ ক্ষমতা
তুমিই ছিলে ব্যারাকের মেয়েদের পিরীতের নাগর
দলের সর্দারকে তুমি মুসার মতো আচমকা আঘাতে অজ্ঞান করে পালিয়ে গেলে
১২ বছর ধরে আমরা তোমার কোনো খবর পাই নি
আকস্মিক এক আলোর ঝলক লুথারের মত তোমাকে ঈশ্বরে বিশ্বাসী করে তুলল
বোমা বানানোর জন্য তুমি বাংলা আর উর্দু শিখলে
লণ্ডনের গুপ্ত সমিতিগুলির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ছিল
আমি তোমার গতিবিধির হদিশ পেয়েছিলাম হোয়াইট চ্যাপেলে
তুমি জেলখানায় কয়েদি
তোমার জীবন কেটে বাদ দেওয়া হল
এমনই ব্যাপার যে
তোমাকে একবার চোথে দেখার সুযোগের জন্য আমার সসেজ বা কেক খাইয়ে কাউকে একটা খুন
করতে ইচ্ছে হচ্ছে
কেননা আমি তোমায় কখনো দেখি নি
তোমার কপালে লম্বা একটা কাটা দাগ থাকার কথা

আমার চতুর্থ মামার কথা বলতে গেলে বলতে হয় ও ছিল জেনারেল রবার্টসনের খানসামা যে রবার্টসন বুযরদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন
ক্বচিৎ কদাচিৎ ধরা যাক ও এ ধরনের চিঠি লিখত
হুজুর বাহাদুর আমার বেতন ৫০ পাউণ্ড বাড়িয়ে দিতে রাজি হয়েছেন
অথবা
হুজুর বাহাদুর ৪৮ জোড়া মোজা নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছেন
অথবা
প্রতিদিন ভোরবেলা আমি হুজুর বাহাদুরের নখ কেটে দিই
কিন্তু আমি জানি
ওর মধ্যে আরো কিছু একটা ছিল
বিষাদ
আর বাড়ির জন্য মন কেমন করা।

আমার জঁমামা, আমার সাত মামার মধ্যে একমাত্র তোমাকেই আমি আগে কখনো দেখি নি
তুমি দেশে ফিরে এলে আর তুমি অসুস্থ বোধ করছিলে
হিপোপটামাসের চামড়ায় তৈরি তোমার একটা বিরাট সিন্ধুক
ছিল আর সিন্ধুকটাতে সারাক্ষণ তালা লাগানো থাকত
চিকিত্সার জন্য তুমি ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে ছিলে
আমি যখন প্রথমবার তোমাকে দেখলাম তুমি তখন ঘুমোচ্ছিলে
তোমার মুখে ভয়ংকর যন্ত্রণা ফুটে উঠেছিল
লম্বা দাড়ি
১৫ দিন ধরে তুমি ঘুমোচ্ছিলে
আর আমি তোমার ওপর ঝুঁকে পড়তেই
তোমার ঘুম ভেঙে গেল
তুমি পাগল হয়ে গিয়েছিল
তুমি দিদিমাকে মেরে ফেলতে গেলে
তোমাকে গারদে বেঁধে রাখা হয়েছিল
আর সেখানেই আমি তোমাকে দ্বিতীয় বার দেখেছিলাম
খাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা
বেশি নড়াচড়া করতে না পারার জন্য খাটো পোশাক পরা
তোমাকে মেঝে নামতে দেওয়া হচ্ছিল না
তুমি করুণভাবে হাতদুটি নাড়িয়ে চলেছিলে
যেন তুমি দাঁড় টেনে চলেছ
ট্র্যানসভাল
তোমাদের জাহাজকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল আর ঘোড়সওয়ার রক্ষীরা তোমাদের জাহাজের
দিকে একটা কামান তাক করে রেখেছিল
প্রিটোরিয়া
আরেকটু হলে একজন চিনে তোমায় গলা টিপে মারত
তুগাইলা
লর্ড রবার্টসন মারা গেলেন
লণ্ডনে ফিরে আসা
হুজুর বাহাদুরের পোশাকের আলমারিটা জলে পড়ে গেল আর এ ব্যাপারটা তোমার বুকে শেল হয়ে বিঁধেছিল
সুইজারল্যাণ্ড স্যাঁতোব্যাঁর পাগলা গারদে তুমি মারা গেলে
তোমার বোধবুদ্ধি,
তোমার শেষকৃত্য
আর সেখানেই আমি তোমায় তৃতীয়বার দেখেছিলাম
বরফ পড়ছিল
আমি তোমার কফিনের গাড়ির পেছনে, কবর খুঁড়িয়েদের সঙ্গে বখশিস নিয়ে আমি ঝগড়া করছিলাম
পৃথিবীতে শুধু দুটি জিনিস তুমি ভালোবেসেছিলে
একটা কাকাতুয়া
আর হুজুর বাহাদুরের গোলাপি নখ

কোনো আশা নেই
আর কিছু না কিছু করতেই হবে
বদ্ধ জীবনই হল সবচেয়ে গাঢ়
ঝিল্লিঢাকা কাপড়
রেমি দ গুর্মোঁ থাকেন ৭১ নম্বর ব়্যু দে স্যাঁপের
ডিনামাইটের তার বা বাঁধাছাদার দড়ি
সঙ্গীহারানো একজন মানুষ আরেকজন মানুষের দেখা পায় কিন্তু একটা পর্বত কখনোই
আরেকটা পর্বতের দেখা পায় না’
এটা হল গিয়ে একটা হিব্রু প্রবাদ
খাদগুলি পরস্পরকে আড়াআড়ি পার হয়ে যায়
আমি তখন নেপলস্
১৮৯৬
আমি হাতে পেলাম ল পতি জুর্নাল ইল্যুস্ত্রে
সামরিক বাহিনীর সামনেই ক্যাপ্টেন দ্রেফ্যুসএর পদবনতি
আমার পঞ্চম মামা:
আমি শিকাগোর ক্লাবহোটেলের শেফ
আমার হুকুম মানার জন্য রয়েছে ৪০০ আনাড়ি রাঁধুনি
তবে ইয়াংকিদের রান্না আমার ভালো লাগে না

আমার নতুন ঠিকানাটা মনে রেখো
ত্যুনিস ইত্যাদি
মামীমা আদেলের ভালোবাসা জেনো
আমার নতুন ঠিকানাটা
বিয়ারিত্জ ইত্যাদি

আহারে মামা আমার একমাত্র তোমারই কখনো বাড়ির জন্য মন কেমন করে নি
নিস লণ্ডন বুদাপেস্ট বারমুডা সিন্টপিটার্সবুর্গ টোকিও মেমফিস
তাবৎ বড় বড় হোটেল তোমাকে কাজ দেওয়ার জন্য মারামারি করে
তুমি হলে গিয়ে ওস্তাদ
বেশ কিছু মিষ্টি স্বাদের খাবার তুমি আবিষ্কার করেছ আর সেগুলির নাম হয়েছে তোমার নামে
তোমার কারিগরি
তুমি তোমাকে পরিবেশন কর তুমি তোমাকে বিক্রি কর লোকে তোমাকে থেয়ে নেয়
কেউ কখনো জানতে পারে না তুমি কোথায় রয়েছ
এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে তোমার ভালো লাগে না
তোমার কাছে নাকি রয়েছে সমস্ত যুগে সমস্ত জাতির রান্নার ইতিহাস
অক্টাভো ১২ খণ্ড
ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত রাঁধুনিদের ছবি ওয়ালা
সমস্ত ঘটনা তোমার জানা
যেখানেই কিছু একটা ঘটছে তুমি চিরকাল সেখানে
হয়তো তুমি এখন প্যারিসে
তোমার তাবৎ মেনু
নতুন কবিতা

এ সমস্তই আমি ছেড়ে চলে এসেছি
আমি অপেক্ষা করছি
গিয়োতিন হল মহৎ শিল্পসৃষ্টি
চকিতে তার নেমে আসা
অবিরাম গতি
বদমাইসদের রক্ত
আলোর গান মিনারগুলিকে কাঁপিয়ে দেয়
রঙ গড়িয়ে পড়ে শহরের বুকে
তোমার আর আমার চেয়ে বড় পোস্টার
চিত্কার করতে থাকা হাঁ করা মুখ
তার মধ্যে আমরা পুড়িয়ে ফেলি
তিনজন উদ্দীপ্ত যুবককে
হানানিয়া মিজায়েল আজারিয়া
অ্যাডামনস্ এক্সপ্রেস কোং
মাদি ঘোড়াটা য়ে চড়ে বেড়াচ্ছে তার সঙ্গে
অপেরার পেছনে
ঘোড়া ঘোড়া খেলতে হবে
বিজ্ঞাপনের সুন্দর খেলনা
এবার পথে!
সিমেয়োঁ , সিমেয়োঁ
প্যারিসবিদায়

ব্যাপারটা মজার
কেদর্সেস্যাঁনাজের!
আমরা আইফেল টাওয়ারের তলা দিয়ে চলেছি — বৃত্তটাকে শেষ করা — জগতের অন্য পেঠে
আবার ছিটকে পড়ার জন্য
তারপর ফের চলতে থাকে
সূর্যের ক্ষেপণযন্ত্র বদমেজাজি নিরক্ষীয় অঞ্চলকে চারদিক থেকে আক্রমণ করে
গোয়ানো দাঙ্গামোসএর ক্ষেতের ধনী পেরুভিয়ান মালিক
আকারাগোয়ান কলা বাজারে ছাড়া হয়
ছায়ায়
অতিথিপরায়ণ দোআঁশলা মানুষগুলো
এই পয়মন্ত দ্বীপগুলিতে পুরো একটা শীতকালেরও বেশি সময় আমি কাটিয়েছি
সেক্রেটারিপাখি একটা আলোর ঝলক
লম্বাচওড়া সুন্দরী মহিলারা
বাইরে উঠোনে বসে আমরা বরফঠাণ্ডা পানীয় খাই
একটা টর্পেডো বোট একটা চুরুটের মতো জ্বলছে
আনারসের ক্ষেতে পোলো ম্যাচ
আর গরান গাছগুলি কমবয়সী পড়ুয়া মেয়েদের হাওয়া দেয়
My gun
গুলি
আগ্নেয়গিরির গায়ে একটা মানমন্দির
শুকিয়ে যাওয়া নদীর মধ্যে মোটা মোটা সাপ
ক্যাকটাসের বেড়া
একটা গাধা শূন্যে লেজ তুলে ডেকে ওঠে
বেঁটেখাটো ট্যারা রেডইণ্ডিয়ান মেয়েটি বুয়েনস আইরেসএ যেতে চায়
জার্মান সঙ্গীতশিল্পীটি রুপোর গোল মাথাওয়ালা আমার ঘোড়ার চাবুক আর একজোড়া সুইডিশ দস্তানা আমার কাছ থেকে ধার নেয়
ঐ মোটাসোটা ওলন্দাজটা একজন ভূগোলবিদ্
ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমরা তাস খেলতে থাকি
মালয়ের মেয়েটির জন্মদিন
নিজের নামে আমি একটা প্যাকেট, ২০০০০০ পেজেতাস আর আমার ষষ্ঠ মামার একটা চিঠি পাই:
আগামী বসন্ত অব্দি আমার জন্য কুঠিতে অপেক্ষা করিস
প্রাণ ভরে ফুর্তি কর ঢক ঢক করে মদ গেল আর মেয়েদের ছাড়াছড়ি নেই
সবচেয়ে ভালো মৃতসঞ্জিবনী
ভাগ্নে আমার
আর এছাড়া আরো একটা কিছু ছিল
বিষাদ
আর বাড়ির জন্য মন কেমন করা

মামা আমার, তোমার জন্য আমি এক বছর ধরে অপেক্ষা করেছিলাম আর তুমি এলে না
একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সঙ্গে তুমি চলে গিয়েছিলে ওরা প্যাটাগোনিয়ার পশ্চিম উপকূলের ওপর
আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে যাচ্ছিল

তুমি ছিলে ওদের দোভাষি আর গাইড
তোমার পরামর্শ
তোমার অভিজ্ঞতা
সেক্সট্যান্ট যন্ত্র দিয়ে দিগন্ত তাক করায় তুমি ছিলে অদ্বিতীয়
ইলেকট্রোম্যাগনেটিক
স্থিতিস্থাপক যন্ত্রপাতি
জগতের সেষ সীমায়
আগুনের দেশের ফিয়র্ডগুলির মধ্যে
বৈদ্যুতিক মাছের আভায় দুই স্রোতের মাঝখানে তোমরা জালে প্রোটোজোয়িক শ্যাওলা ধরছিলে
তোমরা লোহার পারঅক্সাইডের আয়েরোলিথ জমাচ্ছিলে
একদিন রোববার সকালে:
তুমি দেখলে মুকুট মাথায় একজন বিশপ জন থেকে উঠে এল
তার মাছের লেজ আর সে তোমাকে ক্রুশচিহ্ন করে
জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল
তুমি আহত লেমুরের মতো ছুটে পাহাড়ের মধ্যে পালিয়ে গেলে
সে দিন রাতেই
একটা ঘুর্ণিঝড় ক্যাম্প ধ্বংস করে দিল
তোমার সঙ্গীরা তোমাকে জ্যান্ত খুঁজে পাওয়ার আশা ত্যাগ করল
ওরা যত্নসহকারে বৈজ্ঞানিক নথিপত্র নিয়ে গেল
আর তিন মাস বাদে,
ঐ হতভাগ্য বুদ্ধিজীবিরা,
একদিন সন্ধ্যেবেলায় ওরা গোশোর এক তাঁবুতে হাজির হল যেখানে তোমার কথাই

আলোচনা হচ্ছিল
আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম
তুপা
সুন্দর প্রকৃতি
ঘোড়ারা পাল খাচ্ছে
২০০ কোলো যাঁড় ডেকে উঠছে
আর্জেন্টাইনার ট্যাঙ্গো

কী আর করা যায়
তাহলে সুন্দর গল্প বলতে আর কিছুই নেই
সন্তদের জীবন
Das Nechtbuechlein von Schuman
Cymbalum Mundi
La Tariffa delle Puttane di Venegia
জঁ স্ত্যুইসএর সমুদ্রযাত্রা , আমস্তেরদাম ১৫২৮
Shalom Aleïchem
স্যাঁ মার্ত্যাঁর কুমির
স্ট্রিণ্ডবের্গ দেখিয়েছেন পৃথিবীটা পুরোপুরি গোল নয়
ইতিপূর্বে পাভার্নি জ্যামিতিকে লোপ করে দিয়েছিলেন
পাম্পাস
গ্রোমোফোনের রেকর্ড
হাওয়ার ইরোকোয়াজরা
সালামাগুণ্ডি
জহরতের পপলার
ম্যাগি
বিররহ্
Daily Chronicle
ঢেউ হলো গিয়ে পাথরের আকর সেখানে তুফান ভাস্কর হয়ে পাথরের চাই ধ্বসিয়ে দেয়
দাঁতে লাগাম কামড়ে ফেনার রথের ঘোড়া চারটি
অনন্তকাল ধরে
জগতের শুরু থেকে
আমি শিস দিই
ভেঙে যাওয়ার শব্দ

আমার সপ্তম মামা
তার যে কী হল কেউ কখনো জানতে পারে নি
লোকে বলে আমি দেখতে তোমার মতো

মসিয়্যো বেরত্রঁ
এই কবিতাটি আমি আপনাকে উত্সর্গ করছি
খালের জ্বর যাতে প্রতিরোধ করতে পারি তার জন্য আমাকে আপনি বেশ কিছু কড়া মদ খাইয়েছিলেন
আমার সম্পর্কে তাবৎ প্রেস কাটিং পাওয়ার জন্য আপনি প্রেস ডাইরেক্টরির গ্রাহক হয়েছিলেন
পানামার শেষ ফরাসি (সংখ্যায় ওরা ২০ জনও নয়)
আমি আপনাকে এই কবিতাটি উত্সর্গ করছি
মাতাচিনএর বারম্যান
এখন যেখানে ঐ জ্বলজ্বল করা বার দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে হাজার হাজার চিনে মারা গেছে
আপনি মদ তৈরি করেন
কলেরায় যারা মারা যাচ্ছিল তাদের কবর দিয়ে আপনি পয়সা করেছেন
ফরাসি কোম্পানির ফেলে যাওয়া ৪০০ রেল ইঞ্জিনের ওপর যে ওকশোলার জঙ্গল গজিয়েছে তার ছবি আপনি আমায় পাঠিয়ে দেবেন
জ্যান্তমৃতদেহগুলি
অর্কিডে ঠাসা একটি ক্রেনএর হাতায় একটা পামগাছ খোদাই করা
তুকান পাখিদের ঠোকরানোতে ফুটো হওয়া জলসেচের কামানগুলি
কচ্ছপে ভরা ড্রেজার
চুরমার হয়ে যাওয়া গ্যাসের মিটারে পুমারা বাসা বেঁধেছে
করাত মাছের ফুটো করা জল আটকানোর ফটক
ইগুয়ানের বসতিতে মুখ বুজে যাওয়া পাম্পের নল
শুয়াপোকার আভিযানে আটকে থাকা যত রেলগাড়ি
আর পঞ্চদশ লুইয়ের বর্ম ওয়ালা প্রকাণ্ড নোঙরটা কেন যে জঙ্গলের মধ্যে হাজির হয়েছে
তার কোনো কারণ আপনি আমাকে বলতে পারেন নি
ফি বছর আপনি আপনার দোকানের সই খোদাই করা দরজা পালটান
যারা আপনার ওখানে এসেছিল তারা সবাই
ঐ ৩২টি দরজা কী যে সাক্ষ্য
আপনার এমন আদরের ঐ সর্বনাশা খালের জীবন্ত ভাষা

আজকের ভোর হল পৃথিবীর প্রথম সকাল
ইসথমুস
যেখান থেকে যুগপৎ আকাশের সমস্ত জ্যোতিষ্ক আর উদ্ভিদের সমস্ত আকার দেখা যায়
নিরক্ষবৃত্তের পর্বতগুলোর অপূর্ব সৌন্দর্য
অনন্য অঞ্চল
প্যাটারসন মাড়এর স্টিমার এখনো চলছে
রঙ দিয়ে লেখা অ্যাটলান্টিকপ্যাসিফিক টি ট্রাস্টএর নামের প্রথম অক্ষর
লস অ্যাঞ্জেলস লিমিটেড ১০টা ২এ ছেড়ে তিন দিনের দিন পৌঁছয় আর পৃথিবীতে ঐ একমাত্র ট্রেন যাতে রয়েছে চুলকাটার সেলুনকামরা
গ্র্যাণ্ড ট্রাংক গ্রহণ আর বাচ্চাদের জন্য খুদে গাড়ি
বিদায়ের সাইরেনএর ফেরুলের তলায় তোমাদের সবাইকে জীবনের অ আ ক খ বানান করে
শেখানোর জন্য
তোমাইয়ো কিজেন কাইশা
আমার কাছে রুটি আর চিজ আছে
একটা ধবধবে জামার কলার
কবিতা শুরু হল আজ থেকে

গলার চারদিকে ছায়াপথ
চোখের ওপর দুটি গোলার্ধ
খুবই দ্রুতবেগে
আর কোনো বিকল হওয়ার ব্যাপার নেই
কিছুটা পয়সা জমানোর সময় যদি আমার থাকত তাহলে আমি উড়োজাহাজের ব়্যালিতে যোগ দিতাম
ইংলিশ চ্যানেলের তলার সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রথম যে ট্রেন যাবে তাতে আমি আসন সংরক্ষণ করে রেখেছি
এক আসনের প্লেনে যে অাটলান্টিক পার হচ্ছে আমিই সেই বৈমানিক
৯০ কোটি

পৃথিবী পৃথিবী জল সাগর আকাশ
বাড়ির জন্য আমার মন খারাপ করছে
সবগুলি মুখই আমি লক্ষ্য করি আর লেটার বক্স দেখলে আমার ভয় করে
শহরগুলি হোল পেট
আমি আর পথ ধরে চলি না
জাহাজলাইন
টেলিগ্রাফের তার
খাল
ঝুলন্ত সেতুগুলিও নয় !

সূর্য সূর্য চাঁদ চাঁদ তারা তারা
ধ্বংসের মুখোমুখি যত জগৎ
তোমাদের সবারই জন্য এখনো এক একটা সুন্দর ভূমিকা রয়েছে
জলের কলের একটা নল হেঁচে ওঠে
সাহিত্যিক কেচ্ছাকাহিনির তালে তালে ওদের গতি
খুবই নিচুগলায়
গোলঘরে
যেন গেলাসের তলায়
আমি অপেক্ষা করছি

আমি হতে চাই রথের পঞ্চম চাকা
ঝড়
চোদ্দটায় দুপুর
কিছুই না আর সর্বত্র

                                            প্যারিস আর তার শহরতলি: স্যাঁ-ক্লু, সেভর্, মোমোরঁসি, কুর্বভোয়া, বুজিভাল,  ব়্যুএইল, মোঁরুজ, স্যাঁদনি, ভ্যাঁসেন, এতঁপ    স্যাঁমার্ত্যাঁ, মেরেভিল, বার্বিজোঁ, ফর্জঅঁবিয়ের ৷

                                                                       জুন ১৯১৩ — জুন ১৯১৪

 

    

                                                                             

মার্ক শাগাল  
(Marc Chagall)

. প্র তি কৃ তি (I. Portrait)

সে ঘুমোচ্ছে
তার ঘুম ভেঙে যায়
হঠাৎ, সে ছবি আঁকতে শুরু করে
সে একটা গির্জে তুলে নেয় তারপর গির্জে দিয়ে ছবি আঁকতে থাকে
সে একটা গোরু তুলে নেয় তারপর গোরু দিয়ে ছবি আঁকতে থাকে
একটা সার্ডিন মাছ দিয়ে
কয়েকটা মাথা, কয়েকটা হাত, কয়েকটা ছুরি দিয়ে
একটা চাবুক দিয়েও সে ছবি আঁকতে থাকে
সে ছবি আঁকতে থাকে ছোট্ট একটা ইহুদি শহরের তাবৎ নোংরা কামনা দিয়ে
রাশিয়ার গ্রামগঞ্জের তাবৎ রগরগে যৌনতা দিয়ে
ফ্রান্সের জন্য
নিরাসক্ত
সে তার উরু দিয়ে ছবি আঁকে
তার চোখদুটি পাছায়
আর সহসা তা তোমাদেরই ছবি
পাঠক ওটা তুমি
ওটা আমি
ওটা সে
ওটা তার হবু বৌ
ওটা পাড়ার মুদি
গয়লানী
ধাই
ওখানে গামলা গামলা রক্ত
তাতে সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের চান করানো হবে
পাগলামির যত সামিয়ানা
আধুনিকতার মুখগুলো
পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠা মিনার
কয়েকটা হাত
খ্রিস্ট
খ্রিস্ট সে নিজেই
সে তার ছেলেবেলা কাটিয়েছে ক্রুশের ওপর
প্রতিদিন সে আত্মহত্যা করে
হঠাৎ, সে আর ছবি আঁকে না
তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল
এখন সে ঘুমোচ্ছে
নিজের টাই দিয়ে সে গলায় ফাঁস দেয়
এখনো বেঁচে আছে বলে শাগাল অবাক হয়ে যায়

মার্ক শাগালের আঁকা ব্লেজ সঁদ্রার

                                                                                                                                                                                                                                        

. স্টু ডি ও (II. Atelier)

মৌচাক
সিঁড়ি, দরজা, সিঁড়ি
আর তার দরজাটা একটা খবরের কাগজের মতো খুলে যায়
ভিজিটিং কার্ডে মোড়া
তারপর ওটা বন্ধ হয়ে যায়।
বিশৃঙ্খলা, আমরা চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে
লেজের ফোটোগ্রাফি, তোবেনএর ফোটোগ্রাফি, দেখা যায় না
আর তার উলটো পিঠে
উন্মাদ শিল্পকর্ম
স্কেচ, ড্রয়িং, উন্মাদ শিল্পকর্ম
বড় বড় ছবি
যত খালি বোতল
আমাদের টোম্যাটো সসের সম্পূর্ণ বিশুদ্ধতা সম্পর্কে আমরা গ্যারান্টি দিচ্ছি’
একটা লেবেলের ঘোষণা
জানলাটি একটা পঞ্জিকা
বিদ্যুতচমকের প্রকাণ্ড সব ক্রেন কড় কড় শব্দে আকাশের গদিনৌকার মাল খালাস করে দেয় আর বাজে ঠাসা যত ঠেলাগাড়ি উলটে দেয়
সে তখন পড়ে যায়

ছত্রখান

কশাকরা খ্রিস্ট একটা সূর্য পচেগলে ছড়িয়ে পড়ছে
বাড়ির চাল
ঘুমের ঘোরে ঘুরে বেড়ানো কিছু লোক কিছু ছাগল
নিজেকে নেকড়ে বলে ভেবে নেওয়া একটা বাতুল
পেত্র্যুস বরেল
পাগলামি শীত
পিচফলের মতো গলে যাওয়া একটা কিন্নর
লোক্রেয়ামোঁ
শাগাল
আমার স্ত্রীর কাছে বেচারা ছেলেটি
মাথায় ভর করা পাপের আনন্দ
জুতোর গোড়ালি ক্ষয়ে গেছে
চকোলেট ভর্তি পুরনো একটা কেৎলি
দুগুণ জোরে জ্বলে ওঠা একটা বাতি
আর আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন আমার নেশার ঘোর
খালি বোতল
বোতল
জিনা
(
মেয়েটির সম্পর্কে আমরা অনেক কথাই বলেছি)
শাগাল
শাগাল
আলোর সিঁড়ির ভেতর

                                          অক্টোবর ১৯১৩                                                                                                       

স্টি ল লা ই ফ (Natures mortes)
রজে দ লা ফ্রেসনেইএর জন্য

সবুজ’
জ্যামিতির ওপর দিয়ে গোলন্দাজদদের ভারি কদম চলে যায়
আমি আমার পোশাক আসাক ছুঁড়ে ফেলে দিই
আলোর টি স্কোয়ার বাদ দিলে
অবিলম্বে আমি হয়ে যাব একেবারে ইস্পাত
হলুদ’
আধুনিকতার তূর্য
নর্মাণ্ডি
প্রথম গ্রামগুলি যতটা সবুজ
আমেরিকার ফাইলকভারগুলো ততটাই
শুকনো আর
তরতাজা
আর স্থপতির টেবিল
তাই পাকাপোক্ত ভাবে সুন্দর
কালো’
সঙ্গে একবোতল চাইনিজ ইংক
আর নীল শার্টগুলি
নীল’
লাল’
তাছাড়া রয়েছে এক লিটার, এক লিটার ইন্দ্রিয়ানুভূতি
আর ঐ উঁচুস্তরের নতুনত্ব
সাদা’
কাগজের কয়েকটা সাদা পাতা

                                       এপ্রিল ১৯১৪                                                                                                             

নি র্মা  ণ (Construction)

রঙ, রঙ আর অনেক রঙ
এইতো লেজে — তৃতীয়ক যুগের সূর্য়ের মতো সে বেড়ে ওঠে
আর শক্ত হয়
আর সেঁটে দেয়
স্টিল লাইফ
পার্থিব গুঁড়ো
তরল
কুয়াশা কুয়াশা
যা কিছু ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে ওঠে
মেঘলা জ্যামিতি
সিসের তার মিশে যায়
হাড়ের গড়া ওঠা ৷
ইঞ্জিনের গতি ৷
সব কিছু পিল পিল করতে থাকে
হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে মন আর নিজের পালায় প্রাণী আর উদ্ভিদের মতো সাজগোজ করে নেয়
জবরজঙভাবে
আর এইতো এবার
ছবিটা বিরাট এক বস্তুতে পরিণত হয়ে নড়ে ওঠে
চাকা
জীবন
যন্ত্র
মানুষের অত্মরাত্মা
রাইফেল ৭৫এর একটা নল
আমার প্রতিকৃতি

                                                          ফেব্রুয়ারি ১৯১৯                                                                                       

জ্যো ৎ স্না (Clair de lune)

জাহাজের দোলায় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে দুলছি আমরা দুলছি
চাঁদ ঐ যে চাঁদটা জলের বুকে বৃত্ত তৈরি করেছে
আকাশে বৃত্ত তৈরি করেছে মাস্তুল
আর আঙুল দিয়ে তাবৎ তারাকে দেখিয়ে দিচ্ছে

জাহাজের রেলিঙে কনুইয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনার একটি মেয়ে
ফ্রান্সের উপকূলের রেখা এঁকে দেওয়া বতিঘরগুলির দিকে তাকিয়ে প্যারিসের স্বপ্ন দেখছে
যে প্যারিসকে ও চেনে না বললেই হয় সেই প্যারিসের স্বপ্ন দেখতে দেখতে
তার জন্য মন খারাপ করছে
সেঁটে আটকানো একদিকে কালো রঙকরা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরতে থাকা ঐ বাতিগুলো তাকে বুলভারের ওপর হোটেলের জানলা থেকে দেখা রাস্তার আলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অবিলম্বে ফিরে আসার 

মেয়েটি স্বপ্ন দেখছে অচিরে ও ফ্রান্সে ফিরে আসবে প্যারিসে জীবন কাটাবে                                                                                            আমার টাইপ মেশিনের আওয়াজ ওর নিজের স্বপ্নটাকে শেষ অব্দি নিয়ে যেতে ওকে বাধা দেয় না                                                                    আমার সুন্দর টাইপ মেশিনটা প্রতিটি  লাইনের শেষে বেজে ওঠে আর জ্যাজএর   মতো তা দ্রুতগতি                                                          আমার সুন্দর টাইপ মেশিনটা আমাকে জাহাজের ডান কি বাঁ পাশে গিয়ে স্বপ্ন দেখতে বাধা দেয় না                                                                   আর আমাকে কোনো একটা ধারণার আমারই ধারণার পেছন পেছন  শেষ অব্দি ধাওয়া করায়

 

কে ন আ মি লি খি (Pourquoi j’écris)

কেননা..