নয়া-ঔপনিবেশক পাশ্চাত্যের প্রচারযন্ত্রের নির্মাণ আনিয়েস গোনজে বোইয়াজিয়ু ওরফে মা টেরিজা: পুষ্কর দাশগুপ্ত Agnes Gonxha Bojaxhiu alias Mother Teresa : An icon fabricated by the Neo-colonialist West’s media-machine: Pushkar DASGUPTA

নয়াঔপনিবেশক পাশ্চাত্যের প্রচারযন্ত্রের নির্মাণ আনিয়েস গোনজে বোইয়াজিয়ু ওরফে মা টেরিজা

পুষ্কর দাশগুপ্ত

Ballygunj Station

বালিগঞ্জ রেল স্টেশনের সামনে স্টেশন রোড দিয়ে হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ল প্রবেশপথের পাশে সারা দেয়াল জুড়ে কলকাতার গৌরবজনক স্মারক হিসেবে বিরাট পাথরে মোজাইক করা কয়েকটা ছবি, ঐ ছবির একটা হল অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিএর। নাম শুনে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে? উনি আসলে পশ্চিমি প্রচারযন্ত্র আর তার প্রতিধ্বনি দিশি গণমাধ্যমের ঢক্কানিনাদে এই ছদ্ম নামে পরিচিত। শুধু বালিগঞ্জ রেল স্টেশনের প্রবেশপথে নয় কলকাতার রাস্তাঘাটে সর্বত্র এই মহিলার ছবি বা প্রতিমূর্তি। এমন কী কলকাতার সবচেয়ে পুরনো রাস্তার একটা পার্ক স্ট্রিটের নাম পলটে নতুন নাম দেওয়া হয়েছে মাদার টেরিজা সরণি ।

চারদিকের এই ডামাডোলের মধ্যে অনেক কথাই মনে পড়ল, মনে পড়ল অনেকদিন আগে ইন্টারনেট সংস্করণে আমাদের কথা শীর্ষক আত্মপরিচয় অনুসারে যে দৈনিকপত্রিকা কলকাতা থেকে নিয়মিত বিমানে ভ্রমণকারী প্রতি দু’জনের একজন, পশ্চিমবঙ্গে নামকরা গাড়ির মালিকদের ৪০%, রাজ্যের ওয়াশিং মেশিন আছে, এমন মানুষদের অর্ধেকেরও বেশি, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক মাইক্রোওয়েভ মালিক, রাজ্যের সমস্ত এয়ার কন্ডিশন মালিকের ৪০% তার মানে ‘ শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালি …..কলকাতার উচ্চ সমাজের বেশির ভাগ মানুষ’ নিয়মিত পড়ে সেই আনন্দবাজার পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে প্রকাশিত একটি চিঠির প্রতিবাদে বিদেশ থেকে স্পিড পোস্টে একটা চিঠি পাঠিয়ছিলাম। চিঠির বিষয় ছিল পূর্বোক্ত মহিলা অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন। না, আনন্দবাজার সে চিঠি ছাপায় নি, আমাকে তার কারণ দেখিয়ে কোনো চিঠি পাঠানো তো দূরের কথা।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর মোহান্ত বা পোপের অধীন বিদেশে ধর্মপ্রচারকদের শিক্ষাকেন্দ্র ২০০৪ সাল থেকে এশিয়াননিউজ.ইট (AsianNews.it) নামে একটি ইন্টারনেট পত্রিকা প্রকাশ করে। এই পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণের শিরোনামের নিচে থাকে ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর ভূতপূর্ব মোহান্ত কারল ভোইতিলা(এই পোলিশ পাদ্রির পোপ হিসেবে ছদ্মনামের ইংরেজি রূপ: দ্বিতীয় জনপল) শেষ গ্রন্থ ‘ওঠ,এগিয়ে চল! (Alzatevi, andiamo! ইংরেজি অনুবাদে: Rise, Let us be on our way) থেকে উদ্ধৃতি ‘তৃতীয় সহস্রাব্দে আমাদের সবার মিলিত কর্মক্ষেত্র হল এশিয়া’ (Asia, our common task for the Third Millennium) ৷ মনে পড়ে ১৯৯৫ সালে ম্যানিলায় এশিয়ার ক্যাথলিক বিশপদের সমাবেশে ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর পূর্বোক্ত ভূতপূর্ব মোহান্ত বলেছিলেন:

পৃথিবীব্যাপী খ্রিস্টমণ্ডলীর সঙ্গে এসিয়ায় খ্রিস্টমণ্ডলী তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রবেশপথ পার হবে, আশ্চর্য হয়ে প্রত্যক্ষ করবে শুরু থেকে আজ অব্দি ঈশ্বর যা করেছেন এবং এই প্রত্যয়ে অবিচল থাকবে যে ‘প্রথম সহস্রাব্দে যেরকম ইয়োরোপের মাটিতে ক্রস রোপিত হয়েছে, আর দ্বিতীয় সহস্রাব্দে হয়েছে দুই আমেরিকা আর আফ্রিকায়, আমরা প্রার্থনা করতে পারি তৃতীয় খ্রিস্টীয় সহস্রাব্দে এই বিশাল আর গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশে বিশ্বাসের বিপুল এক ফসল আহৃত হবে’ ৷

দ্বিতীয় জনপল: এশিয়ার খিস্টীয় ধর্মমণ্ডলী

এবার তৃতীয় সহস্রাব্দে খ্রিস্টমণ্ডলীর অভিযান ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রসারের ঘোষিত লক্ষ্য হল এশিয়া ৷ ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রধান কারল ভোইতিলার ওপরে উদ্ধৃত ঘোষণা, কৈশোরে নাৎসি স্বেচ্ছাসেবক, পূর্বতন গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর কার্ডিনাল থেকে পদোন্নত ক্যাথলিক মোহান্ত জোজেফ রাৎসিঙ্গেরএর ( পোপ হিসেবে ছদ্মনাম ষোড়শ বেনেডিক্ট) বাচন, ইভাঞ্জেলিস্ট, সাদার্ন ব্যাপটিস্ট, গসপেল ফর এশিয়া ইত্যাদি অসংখ্য প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রচার, এমনকি গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টমণ্ডলীর কর্মসূচিতেও এই ঘোষিত লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য নিরন্তর বিভিন্ন সক্রিয় প্রয়াস ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায় ৷ কারল ভোইতিলার বাচনের ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণ করে বলা যায় আসলে গত চারশ বছর ধরে নানা কৌশল অবলম্বন করেও খ্রিস্টমণ্ডলীর বিভিন্ন শাখা অন্য মহাদেশগুলির তুলনায় এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে ততটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি ৷ যেখানে ইয়োরোপ, দুই আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় তাবৎ প্রাচীন ধর্মকে ধ্বংস করে খ্রিস্টমণ্ডলীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, আফ্রিকায়ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্মরণাতীত কালের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে ইসলামের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খ্রিস্টমণ্ডলীর আধিপত্য কায়েম সেখানে এশিয়া মহাদেশে আজো (হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ইত্যাদি) অন্য ধর্মের তুলনায় খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য অপ্রতিষ্ঠিত ৷ তাই আহত আত্মগৌরব পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর উদ্দেশ্য যে করেই হোক এশিয়া মহাদেশ জয় করতে হবে

আবার এশিয়ায় কম্যুনিস্ট চিন, অর্থোডক্স খ্রিস্টান রাষ্ট্র আর্মেনিয়া, কম্যুনিস্ট ভিয়েৎনাম এবং তাবৎ ঐস্লামিক রাষ্ট্রে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তর বেআইনি অপরাধ ৷ ফলে কারল ভোইতিলা কথিত খ্রিস্টীয় ‘ঈশ্বরের’ ঘাড়ে চাপানো ‘অত্যাশ্চর্য পরিকল্পনা’ অনুযায়ী এশিয়াকে ধর্মান্তরিত করার ধান্ধায় ভারত আর ঐস্লামিক রাষ্ট্র হলেও তুলনামূলকভাবে উন্মুক্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের হরেক খ্রিস্টমণ্ডলীর সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতার প্রধান লক্ষ্যভূমি ৷

ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের রণকৌশলের অঙ্গ হিসেবে কয়েক বছর আগে ভ্যাটিকানের ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলী কর্তৃক সদ্য পরলোকগত আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু ওরফে টেরিজা মাকে সন্ত খেতাব দেওয়ার প্রশ্নে দেশে বিদেশে আবেগোচ্ছ্বাসের চুনামি আর প্রশস্তির ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত করতালির মধ্যে প্রায় হারিয়ে যাওয়া কিছু বিরল কণ্ঠের প্রতিবাদ আমাকে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে চিন্তিত করে ৷ তার ওপর আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু তথা ক্যাথলিক গণমাধ্যম, দমিনিক লাপিয়ের ইত্যাদির অবদানে আজ পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্র, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসু, সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা আন্তর্জাতিকভাবে টেরিজা মার কলকাতা, নর্দমার কলকাতা, কুষ্ঠরোগের কলকাতায় পরিণত হয়েছে ৷ পশ্চিমি প্রচারমাধ্যমে টেরিজা মার কলকাতা, নর্দমার কলকাতা, কুষ্ঠরোগের কলকাতা শুনতে শুনতে কলকাতার আমি বিষণ্ণ হয়ে উঠি ৷ খ্রিস্টধর্ম প্রচার তথা পশ্চিমি প্রভাব ও স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার প্রয়েজনে নানা কৌশলে গড়ে তোলা টেরিজা মা নামক নাটকের নেপথ্যের কথাগুলি কেন বলা হয় না তা ভেবে বিরক্ত আর ক্রুদ্ধ হই ৷ বস্তুত পূর্বোল্লিখিত রণকৌশলের অঙ্গ হিসেবে ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে ভ্যাটিকানের কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলী কর্তৃক গোনখে বোইয়াখিনকে ‘পরমানন্দায়ন’ (বিআটিফিকেশন) মঞ্জুর করেন অর্থাৎ তিনি ‘ভগবদ্ করুণাপ্রাপ্ত’ (ব্লেসেড) অভিধা লাভ করে সাধ্বী বা সন্তের পদবী পাওয়ার প্রথম ধাপ টপকান এই উপলক্ষে ২৩এ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকায় শর্মিলা বসু মাদার টেরিজার কাজ ভাল, খারাপ, দুই নামে একটি নিবন্ধ লেখেন উক্ত নিবন্ধে লেখিকা পাশ্চাত্যের মুখোমুখি ঔপনিবেশিতের দ্বিধা নিয়ে আমতা আমতা করে টেরিজার প্রশস্তির সঙ্গে কিছুটা সমালোচনা করেন এই সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেনসএর টেরিজা সম্পর্কে গ্রন্থের উল্লেখ করেন কিন্তু তিনি পাশ্চাত্যে মহানায়িকার কদর পাওয়া সাদা চামড়ার টেরিজার সমালোচক হিসেবে ডাক্তার অরূপ চট্টোপাধ্যায়ের নাম হয়ত বাঙালি বলে উল্লেখ করেন নি যাই হোক শর্মিলা বসুর প্রবন্ধের প্রতিবাদে ৯ই ডিসেম্বর ২০০৩ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় নিচে উদ্ধৃত চিঠিটি প্রকাশিত হয়:

আর্তের ত্রাতা

অবশেষে শর্মিলা বসুকে (মাদার টেরিজার কাজ ভাল, খারাপ দুই, ২৩/১০) কয়েকটি কথা বলতেই হয় ৷ মাদার টেরিজা সন্ত হবেন কি না, কী ভাবে হবেন, খ্রিস্টমণ্ডলীতে তার প্রয়োজন আছে কি না, মণিকা বেসরা সুস্থ হল কি না, সন্ত হওয়ার পদ্ধতি কারও দৃষ্টিতে ভুল বা ঠিক ইত্যাদি বিষয়টি খ্রিস্টমণ্ডলীর অত্যন্ত নিজস্ব ব্যাপার ৷ অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষদের মাথাব্যথার কারণ নেই ৷ আমরা খ্রিস্টানরা যেমন কোনও দেবদেবী, পূজাঅর্চনা, সংস্কার নিয়ে উৎসাহী নই, তেমনই আমরাও আশা করব, আমাদের ধর্মীয় আচারঅনুছ্ঠান, রীতিনীতি, সংস্কার, ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মবিশ্বাসকে সমালোচনা করে কেউ আঘাত করুক। এটা অনধিকার চর্চা।

ভারতবর্ষ সাধুসন্ন্যাসীদের পুণ্যভূমি, অলৌকিকতার ছড়াছড়ি। চোখের সামনে দেখি, সমাজের শিক্ষিত মানুষেরা ডান হাতের কব্জিতে অমুক বাবার সরুমোটা সুতো জড়িয়ে রাখেন। এটা যদি সংস্কার হয়, তবে মাদারের লকেট দেওয়াটা কি কুসংস্কার হবে?

খ্রিস্টধর্ম চিরকাল গর্ভপাতের বিরোধিতা করেছে এবং করবে। সন্তান নষ্ট তো জীবন হত্যার শামিল মহাপাপ কেউ শুনুক বা না শুনুক, গর্ভপাত অন্যায়। আপনার ধর্ম কি জীবন হত্যার পক্ষে না বিপক্ষে ?

মাদারের কুখ্যাত বন্ধু থাকতেই পারে। মাদার তাদের টাকার সদ্ব্যবহার করেছেন। হয়তো তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাদের সৎপথে ফিরিয়ে আনার। যিশু এসেছিলেন সমাজের যত পাপী মানুষদের বাঁচাতে। তিনি এখজন পতিতা নারীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলেন। একজন কুখ্যাত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে যদি সমাজের সুস্থ জীবনের পথে অনুপ্রাণিত করা যায়, তাতে মাদারের দোষটা কোথায় ? তিনি তাঁর গুরুর কাজ সম্পন্ন করেছেন মাত্র।

হিচেনসএর প্রশ্ন, মাদারের টাকার হিসাব কোথায়? এটা তো সকলেরই জানা যে, কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব রক্ষার জন্য একটি নির্দিষ্ট দফতর আছে। তাঁরা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে উদাসীন নন। কোনও সংস্থার টাকার হিসাব কি কোনও সাধারণ মানুষের চাওয়ার অধিকার আছে ?

সমীরস্টিফেন লাহিড়ী। কৃষ্ণনগর, নদিয়া

আনন্দবাজারের ইন্টারনেট সংস্করণে আমি শর্মিলা বসুর প্রবন্ধ ও তারপর সমীরস্টিফেন লাহিড়ীর চিঠিটি পড়ি ৷ শ্রীযুক্ত লাহিড়ীর চিঠির উত্তরে আমি একটা দীর্ঘ চিঠি লিখি আর চিঠিটি গ্রিস থেকে স্পিড পোস্টে আনন্দবাজারে পাঠায় ৷ আনন্দবাজার আমার চিঠি ছাপায় নি ৷ উক্ত চিঠির খসরাটি আমি এখানে উপস্থাপিত করছি:

সবিনয় নিবেদন,

মাদার টেরিজা সম্পর্কে শর্মিলা বসুর প্রবন্ধ (২৩১০২০০৩) প্রসঙ্গে সমীরস্টিফেন লাহিড়ীর পত্র (০৯১২২০০৩) পড়ে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি ৷

সমীরস্টিফেনবাবু লিখেছেন, ‘মাদার টেরিজা সন্ত হবেন কি না, কী ভাবে হবেন, খ্রিস্টমণ্ডলীতে তার প্রয়োজন আছে কিনা, মণিকা বেসরা সুস্থ হল কিনা, সন্ত হওয়ার পদ্ধতির কারও কারও দৃষ্টিতে ভুল বা ঠিক ইত্যাদি বিষয়টি খ্রিস্টমণ্ডলীর অত্যন্ত নিজস্ব ব্যাপার ৷ অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষদের মাথাব্যথার কারণ নেই ৷’ প্রথমেই বলে নিই আমি নাস্তিক আর বিভিন্ন ধর্মের রক্তাক্ত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে তাবৎ ধর্মের বিরোধী ৷ তবু সমীরস্টিফেনবাবুর সারমন মেনে বহু মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী, ইনকুইজিশনের রক্তমাখা তথা বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের দায়ভাগীকে বেয়াটিফিকেশন বা সন্তকরণের (ক্যাননাইজেশনের) ব্যাপারে নীরব থাকছি ৷ এমনকী মানবিকতার প্রশ্নও তুলছি না ৷ চুপ করে থাকছি এমিলিও বনাভেন্তুরো আলতিয়েরি (ওরফে পোপ দশম ক্লেমেন্ট ( Pope Clement X, ১৫৯০ – ১৬৭৬ ), কর্তৃক স্পেন থেকে মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়ন এবং অসংখ্য মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরের নায়ক ক্যাস্টিলএর রাজা তৃতীয় ফার্ডিন্যান্ডকে ও ভূতপূর্ব কারল জোজেফ ভোইতিলা (ওরফে পোপ দ্বিতীয় জনপল) কর্তৃক চিনে হত্যা, বলপূর্বক খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতকারী, নানা অপরাধ ও ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত মিশনারি ফ্রান্সিস্কুস দে কাপিয়াস, ওগ্যুস্ত শাপদলেন, আলবেরিকুস ক্রেসচিতেল্লি এবং স্পেনের ডিক্টেটর জেনারেল ফ্রাংকোর সমর্থকসুহৃদ, চিলির কুখ্যাত ডিক্টেটর পিনোচেৎএর ধর্মোপদেষ্টা ও ক্যাথলিক মৌলবাদী সংস্থা ওপুস দেইএর প্রতিষ্ঠাতা হেজেমারিয়া এস্ক্রিভা দে বালাগুয়ের সন্তকরণ ব্যাপারে ৷ সমীরস্টিফেনবাবুর সারমন শিরোধার্য করে পূর্বোক্ত ভোইতিলা কর্তৃক ইহুদিদের ‘কুকুর’ বলে অভিহিত করা ইহুদিবিদ্বেষী, তাবৎ নতুন চিন্তার বিরোধী জোভান্নি মারিয়া মাস্তাইফেরেত্তি (ওরফে নবম পাইয়াস), হাজার হাজার ইহুদি, জিপসি ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানের হত্যাকাণ্ডের সমর্থক ও সহায়ক ক্রোয়াসিয়ার জাগ্রেবএর রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপ আলোইজিয়ে স্তেপিনাচ অথবা ‘হিটলারের পোপ’ বলে আখ্যাত এউজেনিও মারিয়া গিসেপ্পে পাচেল্লিকে (ওরফে দ্বাদশ পাইয়াসকে) বেয়াটিফিকেশন বা আরো অনেক ধর্মীয় কাণ্ড সম্পর্কে এতটুকু মুখ খুলছি না ৷

স্কোপিয়ে(ম্যাসিডোনিয়ায়) জন্মানো আলবেনীয় (মতান্তরে ব্লাহস) মহিলা অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিনএর (ওরফে মাদার টেরিজা) বেয়াটিফিকেশন নিয়ে আমি নীরব থাকতে পারতাম যদি মহিলাকে ব্লেসেড টেরিজা অভ ক্যালকাটা বলা না হত, যদি খ্রিস্টান পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে ঐ মহিলার নয়াঔপনিবেশিক খ্রিস্টীয় খয়রাতির শোবিজএর বিরামহীন প্রচারের ফলে আমাদের শহর পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্র, রামমোহন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসু, নজরুল, সত্যজিৎ রায়ের শহরের বদলে বস্তি, ভিখিরি, ফুটপাতবাসী, কুষ্ঠরোগী আর মৃত্যুমুখী মানুষের করুণ বাসস্থান খ্রিস্টীয় খয়রাতিনির্ভর মা টেরিজার কলকাতায় পরিণত না হত ৷ যদি পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে ঐ আলবেনীয় মহিলাকে কলকাতার মা টেরিজা বলে অভিহিত করার সঙ্গে নর্দমার সন্ত বলে অভিহিত করে কলকাতাকে নর্দমার সমার্থক করে তোলা না হত ৷

সমীরস্টিফেনবাবু জানিয়েছেন ‘খ্রিস্টধর্ম চিরকাল গর্ভপাতের বিরোধিতা করেছে এবং করবে ৷’ অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন গর্ভপাত, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও বিবাহবিচ্ছেদের চরম বিরোধী ছিলেন ৷ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বক্তৃতায় তিনি বলেন যে পৃথিবীর শান্তির সবচেয়ে বড় শত্রু হল গর্ভপাত, না, রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধ কোনোটাই শান্তির শত্রু নয় ৷ এছাড়া একদিকে লোকসংখ্যাস্ফীতির তাবৎ কুফল আর অন্যদিকে এইডস্এর মহামারীর সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে এই মহিলা জন্মনিয়ন্ত্রণের সমস্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিরোধিতা করেন ৷ তবে সুবিধাবাদী অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন ইন্দিরা গান্ধির মানবাধিকারবিরোধী জরুরি অবস্থার সমর্থক ছিলেন আর ঐ জরুরি অবস্থার অংশ হিসেবে সঞ্জয় গান্ধির বলপ্রয়োগে নির্বীজকরণের মাধ্যমে উগ্রপন্থী জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কোনো বিরোধিতা করেন নি ৷ এই মহিলা আয়ারল্যান্ডে গিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে আইনের প্রস্তাব সম্পর্কে গণভোটে (রেফারেন্ডামে) প্রস্তাবের বিপক্ষে প্রচার করলেও প্রিন্সেস ডায়ানার বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদন করেন ৷ অবশ্য প্রিন্সেস বলে কথা! সমীরস্টিফেনবাবুর প্রশ্ন ‘আপনার ধর্ম কি জীবন হত্যার পক্ষে না বিপক্ষে?’ ক্রুসেড, ক্যাথার ও অন্যান্য তথাকথিত হেরেটিকস্ বা ‘ধর্মবিরোধীদের’ হত্যা, ইনকুইজিশন, (পাদ্রি বার্তোলেমি দে লাস কাসাসএর বিবরণ অনুসারে) ‘ইন্ডিয়ান’ বলে অভিহিত কয়েক কোটি আমেরিকার প্রকৃত অধিবাসীদের নিধন, ফ্রান্সে স্যাঁবার্তেলেমির হত্যাকাণ্ড, উইচ বা ডাইনি বলে চিহ্নিত জোয়ান অভ আর্ক সহ হাজার হাজার মহিলাকে পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি সম্পর্কে সমীরস্টিফেনবাবুর ধর্ম কী বলে? এই ব্যাপারগুলি মনে হয় রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর বিচারে ‘জীবন হত্যা’ নয় ৷ এছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধের পর পাক সেনাদের হাতে যেসব শিশুর মাবাবা নিহত হয়েছিলেন অথবা ঐ সেনাদলের দ্বারা ধর্ষিত অসংখ্য নারীর সন্তানদের অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিনএর খয়রাতি সংস্থা প্রবল উদ্যোগে গ্রহণ করে ৷ অবশ্য ইতিপূর্বে ভিয়েৎনাম যুদ্ধে আমেরিকার সেনাবাহিনির হত্যাকাণ্ডে ব্লেসেড টেরিজা যেমন নীরব ছিলেন পাক সৈন্যদের বর্বরতা ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তেমনি মুখ বুজে থাকেন ৷ অনাথ ও পরিত্যক্ত শিশুদের তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন ৷ এরকম কয়েক হাজার শিশু ইয়োরোপ ও আমেরিকার খ্রিস্টান পরিবারে দত্তক হিসেবে দান করা হয় ৷ প্রসঙ্গত বলা দরকার যেসব দরিদ্র পিতামাতা নিজস্ব ধর্ম অনুসারে সন্তানের ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে সন্তানকে মিশনারীজ অব চ্যারিটির অনাথ আশ্রমে সমর্পন করে তাদের বাদ দিয়ে পিতামাতার ধর্মীয়পরিচয়হীন তাবৎ অনাথকে (সাবালক হয়ে সচেতন ভাবে বিশেষ ধর্ম বা ধর্মহীনতা বেছে নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে) ব্যাপ্টাইজ বা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয় ৷ অবশ্য ভারতে তথাকথিত সেবাব্রতী ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট বা গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টমণ্ডলীর তাবৎ মিশন এই পদ্ধতিতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে ৷ তাছাড়া সমীরবাবু লিখেছেন ‘মাদারের কুখ্যাত বন্ধু থাকতেই পারে ৷হয়তো তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাদের সৎপথে ফিরিয়ে আনার ৷’ অ্যাগনেস সি আই এ সমর্থিত চরম অত্যাচারী শোষক হাইতির ডিক্টেটর ফ্রঁসোয়া দ্যুভালিয়ের পুত্র একই চরিত্রের ডিক্টেটর জঁক্লোদ দ্যুভালিয়ের কাছ থেকে লেজিওঁ দন্যর খেতার নেন আর দুভালিয়ের পরিবারকে দরিদ্রের বন্ধু ও দরিদ্রের প্রিয় বলে ঘোষণা করেন ৷ অসংখ্য মধ্যবিত্ত আমেরিকানকে প্রতারণার মাধ্যমে পঁচিশ কোটি কুড়ি লক্ষ ডলার আত্মসাৎকারী চার্লস্ কিটিংকে মামলা থেকে বাঁচানোর জন্য আলোচ্য অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন (ওরফে মাদার টেরিজা) কিটিংকে দরিদ্রের সাহায্যকারী বলে সার্টিফিকেট দিয়ে মার্কিন বিচারককে চিঠি দেন ৷ কিটিংএর দশ বছর কারাদণ্ড হয় ৷ কিটিং মিশননারিজ অভ চ্যারিটিকে বারো লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার ও টেরিজাকে ব্যাক্তিগত বিমান ব্যবহার করার অধিবার দিয়েছিলেন ৷ লস অ্যাঞ্জেলসএর ডেপুটি অ্যাটর্নি পল টার্লি অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিনকে উপর্যুক্ত অর্থ তার প্রকৃত মালিকদের ফেরৎ দেওয়ার নৈতিক কর্তব্য পালন করার আবেদন জানান ৷ অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন ওরফে ব্লেসেড টেরিজা ঐ পত্রের কোনো উত্তর দেন নি ৷ প্রতারক ব্রিটিশ প্রকাশক রবার্ট ম্যাক্সওয়েলএর দানও তিনি অনায়াসে গ্রহণ করেছিলেন ৷ মানতে হয় এ সমস্তই ‘কুখ্যাত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকেসমাজের সুস্হ জীবনের পথে অনুপ্রাণিত করা’ ৷

এছাড়া আরো দুটি প্রশ্ন ৷ প্রথমত অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন বলতেন আর তাঁর দলবল (নির্মলা যোশি এন্ড কোম্পানি) বলে থাকে ‘দারিদ্র্য সুন্দর, দারিদ্র্য ঈশ্বরের দান’ ৷ অতি উত্তম! তবে অ্যাগনেস ও তাঁর দলবল কেন খ্রিস্টধর্মীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসী পাশ্চাত্যকে ধনদৌলত ধ্বংস করে সুন্দর, ঈশ্বরের অবদান দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়ে খ্রিস্টের প্যাশন বা জীবনযন্ত্রণায় অংশ নিতে আবেদন বা প্রচার করেন করেন নি বা করেন না ৷ দ্বিতীয়ত গর্ভপাতের প্রচন্ড বিরোধী অ্যাগনেস ও তাঁর দলবল কখনো পাশ্চাত্যের যেসব খ্রিস্টধর্মাবলম্বী দেশে গর্ভপাত আইনানুগ (যেমন ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি) সেখানে গিয়ে সরকারকে আইন পালটে গর্ভপাত বন্ধ করতে বলেন নি

অবশেষে সমীরস্টিফেনবাবুর উক্তি ‘মাদারের টাকার হিসেব কোথায়?’ ইত্যাদি প্রশ্নটা শুধু ক্রিস্টোফার হিচেনসএর নয় ৷ হিচেনস, মিশনারিজ অব চ্যারিটির সন্ন্যসিনীভগ্নী হিসেবে এক দশক কাজ করে মোহভঙ্গ হওয়া মার্কিন মহিলা সুজান শিলডস্, জার্মান পত্রিকা ‘স্টের্ন’এর সাংবাদিক ভালেতের ভোয়েলনভেরেব, লণ্ডনবাসী বাঙালি ডাক্তার অরূপ চট্টোপাধ্যায় এবং আরো অনেকের ৷ বলা দরকার ঐ মিশনের টাকা শুধু ভারতে আসে না বা জমা পড়ে না ৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জমা হয়, এর সিংহভাগ সরাসরি জমা পড়ে এবং থাকে পোপের শাসনাধীন খ্রিস্টমণ্ডলী পরিচালিত ভ্যাটিকানের ব্যাংকে ৷ ইয়োরোপে লোকে ঠাট্টা করে বলে ভ্যাটিকানের ব্যাংকের হিসেব স্বয়ং ভগবানেরও অজানা ৷ যেমন মার্কিন অর্থদপ্তরের সন্দেহ অনুসারে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ক্রোয়সিয়ায় নাৎসিদের বসানো আন্তে পাভেলিচ সরকারের লুঠ করা কুড়ি কোটি সুইস ফ্রঁ মূল্যের সোনা ভ্যাটিকানের ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল এবং তার একটা অংশ ভ্যাটিকান ব্যয় করে আদলফ্ আইখমান, ক্লাউস বার্বি, আন্তে পাভেলিচ এবং আরো বেশ কয়েকজন হত্যাকারী নাৎসি যুদ্ধাপরাধীর ভুয়ো রেড ক্রসের পাসপোর্ট জোগাড় ও কখনো কখনো রোমান ক্যাথলিক পাদ্রির বেশে ইয়োরোপ থেকে (প্রধানত ল্যাটিন আমেরেকায়) পালানোর ব্যবস্থা করতে ৷ নিঃসন্দেহে এসব ‘খ্রিস্টমণ্ডলীর অত্যন্ত নিজস্ব ব্যাপার’, আর খ্রিস্টমণ্ডলীর ‘নিজস্ব ব্যাপার’ ‘ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান, ধর্মতত্ত্ব, ধর্মবিশ্বাসকে সমালোচনা করা’ সমীরস্টিফেনবাবুর সারমন অনুসারে ভারতীয় হিন্দুদের কি আমার মতো ভারতীয় নাস্তিকের ‘অনধিকার চর্চা’ ৷ এখানে শুধু একটা প্রশ্ন থেকে যায়, গত পাঁচশ বছর ধরে পশ্চিমি খ্রিস্টমণ্ডলী কোন অষিকারে ভারতীয়দের ‘ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান, ধর্মতত্ত্ব, ধর্মবিশ্বাস’ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আসছে: ভারতীয়রা বর্বর, ভুয়ো দেবতা অথবা শয়তানের উপাসক, প্রতারক স্বভাবের.এসব বলে আসছে ৷

এমনকী অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিনর তথাকথিত অলৌকিক কর্ম মনিকা বেসরার সুস্থ হওয়ার ব্যাপারে ভ্যাটিকানের তথাকথিত তদস্ত কমিশন বাঙালি ডাক্তারদের বক্তব্য কোনো যুক্তি না দেখিয়ে অগ্রাহ্য করে ৷ এর মধ্যেও পশ্চিমি খ্রিস্টমণ্ডলীর ঐতিহ্যানুসারী অন্যের সম্পর্কে এবং বিশেষভাবে ভারতীয়দের সম্পর্কে অবমাননাকর উদ্ধত মনোভাবের পরিচায়ক ৷

স্মরণীয়, ১৫৪৩ সালে ইস্পনি বাস্ক পাদ্রি ফ্রানচিস্কো দে হাবিয়ের (ওরফে সন্ত জাভিয়ের) রোমে জিশুসংঘকে একটি চিঠিতে জানান, যেহেতু ভারতীয়রা কালো ওরা ওদের নিজেদের রঙকে সবচেয়ে সুন্দর বলে ভাবে, ওরা বিশ্বাস করে ওদের দেবতারা কালো ৷ কারণে ওদের বেশির ভাগ দেবমূর্তিগুলি যতটা কালো হওয়া সম্ভব ততটা কালো, আর তার ওপর সাধারণত মূর্তিগুলি এমনই তেলমাখা যে তার থেকে দুর্গন্ধ নির্গত হয়, আর আর সেগুলি যতটা কুৎসিৎ যতটা বীভৎস দেখতে ঠিক ততটাই নোংরা বলে মনে হয় ৷’ আবার ১৫৪৯ সালে রোমে ঐ জেজুইট পাদ্রি তাঁর গুরু ইনিগো লোপেথ দে লোইয়েলাকে ভারত থেকে চিঠিতে জানাচ্ছেন যতটা আমি লক্ষ্য করতে পেরেছি তদনুসারে ভারতীয়দের পুরো জাতিটাই নিতান্ত বর্বর; নিজেদের প্রথা ও দেশাচারের সঙ্গে মেলে না এমন কোনো কথাই তারা শুনতে আগ্রহী নয়, আর আমার মতে ঐ রীতিনীতি বা আচারবিচার হল বর্বরোচিত ৷বেশির ভাগ ভারতীয় দুষ্ট চরিত্রের ও পুণ্যকর্মের বিরোধী, তাদের পাপ ও প্রতারণার অভ্যাস এমন বন্ধমূল যে তাদের স্থৈর্যের অভার, চাপল্য এবং চিত্তবিকার অবিশ্বাস্য ৷’ উক্ত ধর্মান্ধ পাদ্রি ভারতীয়দের ‘শিক্ষাদীক্ষাহীন বর্বর’ বলে অভিহিত করেছেন এবং পর্তুগালের রাজাকে ১৫৪৮ সালে কোচিন থেকে লেখা এক চিঠিতে ভারতীয়দের জোর করে খ্রিস্টধর্মান্তরিত করার প্রস্তাব করেছেন ৷ আর এই কুৎসি কাদা ছোঁড়া আজও অব্যাহত যেমন একটি রোমান ক্যাথলিক ইন্টারনেট সাইটে পাদ্রি জাভিয়েরএর জীবনী উপস্থাপিত: করতে গিয়ে ভারত সম্পর্কে মন্তব্য রয়েছে: আজ এই বিরাট দেশ এখনো একই অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে এই দেশ সার্বিকভাবে মূর্তি উপাসনার আরো বেশি গভীর দুরবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে ৷’ কিংবা ক্যাথলিক ফ্যামিলি নিউজ পত্রিকার সম্পাদক জন ভেনারির মন্তব্য ‘হিন্দুধর্ম যেসব ভুয়ো দেবতার পুজো করে তারা শয়তান ৷’ ভারতীয় অন্যের সম্পর্কে ক্যাথলিকদের এই মৌলবাদী বিদ্বেষ ও ঘৃণার প্রচার (অধিকারচর্চা?) বিষয়ে সমীরস্টিফেনবাবু কী বলেন?

বিনীত

পুষ্কর দাশগুপ্ত

না, আনন্দবাজার পত্রিকা এই চিঠি ছাপেনি ৷ স্বাভাবিক ! বহুকাল ধরে পশ্চিমের নয়াঔপনিবেশিকতার (সুগারকোটেড গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের, আনন্দবাজারের মোলায়েম ভাষায় ‘ভুবনায়নের’) কম্প্রাদর, মার্কিন মুল্লুকের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল ফাকস নিউজ চ্যানেল (Fox News Channel) ও ইংল্যান্ডের রেসিস্ট, কুরুচিপূর্ণ ও কুৎসাপ্রিয় দৈনিক দ্য সান পত্রিকার মালিক রুপার্ট ম্যাড্রকের স্টার ইন্ডিয়া টেলিভিশন চ্যানেলের তল্পিবাহক আনন্দবাজারের পক্ষে এই চিঠি ছাপানো সম্ভব ছিল না ৷

প্রসঙ্গত একটা কথা বলা দরকার। আমি যুক্তিবাদী নাস্তিক, কোনো ধর্মের প্রতিই আমার আলাদা কোনো পক্ষপাত বা আক্রোশ নেই। সমস্ত ধর্মেরই ভিত্তি হল যুক্তিহীন বিশ্বাস আর একগাদা (কু)সংস্কার। এই নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে আমি একদিকে যেমন সব রকমের ধর্মীয় হানাহানির বিরোধী অন্যদিকে তেমনি পৃথিবীর সাংস্কৃতিক উদ্বর্তন ও বৈচিত্র্য ধ্বংসকারী তাবৎ ধর্মান্তরের বিপক্ষে।

টীকা

.With the Church throughout the world, the Church in Asia will cross the threshold of the Third Christian Millennium marvelling at all that God has worked from those beginnings until now, and strong in the knowledge that “just as in the first millennium the Cross was planted on the soil of Europe, and in the second on that of the Americas and Africa, we can pray that in the Third Christian Millennium a great harvest of faith will be reaped in this vast and vital continent”.

The Marvel of God’s Plan in Asia [1] 

Ecclesia in Asia – John Paul II – Post-Synodal Apostolic …

http://www.vatican.va/…/john_paul_ii/apost_exhortations/documents/hf_jp-ii_exh_06111999_ecclesia-in-asia_en.html

1) John Paul II, Address to the Sixth Plenary Assembly of the Federation of Asian Bishops’ Conferences (FABC), Manila (15 January 1995), 11: Insegnamenti …]

মহাত্মার মুখোসের আড়ালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি পুস্কর দাশগুপ্ত Mohandas Karamchand Gandhi Under the mask of Mahatma Pushkar DASGUPTA

Bahuswar | বহুস্বর

 

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি :মুখ আর মুখোস

পুষ্কর দাশগুপ্ত

GANDHI 3

গান্ধি ভারতের স্বাধীনতার স্থপতি? ভারতীয় জাতির জনক ?

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি নাকি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করেছেন। আবার তিনি নাকি ভারতীয় জাতির জনক, সরকারিভাবে এটা স্বীকৃত তথা প্রচারিত। এছাড়া তাঁর অবদান হল অহিংসা, অসহযোগ, সত্যাগ্রহ। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ব্যক্তি গান্ধির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেছেন। গান্ধি আন্তর্জাতিকভাবে ভারতীয় ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা এক কথায় ভারতীয়ত্বের প্রতিভূপ্রতীক। তাঁর জন্মদিন সারা ভারতে ছুটির দিন, সরকারিভাবে উদযাপিত গান্ধিজয়ন্তী, সারা পৃথিবীতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক অহিংসাদিবস। গ্রাম, আড়ম্বরহীন আর কুটিরশিল্পভিত্তিক (চরকা, খাদি) অর্থনীতি আর অন্যদিকে অহিংসা, সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, আত্মশুদ্ধি (অনশন, ব্রহ্মচর্য, মৌনব্রত, নিরামিষ) ইত্যাদি ধারণার ভিত্তিতে ধর্ম (সত্য, ঈশ্বর) ও রাজনীতির মিশ্রণ — এসব উপাদানে গড়ে উঠেছে গান্ধির ভারতীয়ত্বের কল্পরূপ বা…

View original post 10,123 more words

পুষ্কর দাশগুপ্ত : দিব্য ভ্রমণ: ৪৫ সংখ্যাচিহ্নিত বাস অভিধেয় কলিকাতার গণযানে অর্ধ প্রহর

পুষ্কর দাশগুপ্ত

দিব্য ভ্রমণ

৪৫ সংখ্যক বাসে অর্ধ প্রহর

bus 45

বারবেলা, দিকশূল, নিষিদ্ধ যোগ ইত্যাদির গণনা বিচারবিবেচনা ও বর্জন করত শুভলগ্নে দিকপতিকে ভক্তিপূর্ণ নতমস্তকে প্রণাম করিয়া হস্তস্থিত মর্দিত শুষ্ক বিল্বপত্রের দিব্য ঘ্রাণ গ্রহণ করিতে করিতে গৃহ হইতে নির্গত হইবার সময় ধেনুবত্সপ্রযুক্তা বৃষগজতুরগা দক্ষিণাবর্তো বহ্ণিঃ, দিব্যস্ত্রী পূর্ণকুম্ভাইত্যাদি আবৃত্তি করিতে করিতে ধীরস্থির পদক্ষেপে নরেন্দ্রমার্গে আসিয়া কেবলমাত্র প্রহরার্ধযাবৎ একান্ত একাগ্র একনিষ্ঠ অনন্যচিত্ত সুকঠোর তন্ময় প্রতীক্ষারূপ তপস্যার অবসানে অবশেষে সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম শ্রীল শ্রীশ্রীগুরুদেবের শ্যামলদুর্বাদলকোমল রাতুল চরণকমলের মন্দাকিনীপ্রবাহবৎ পরম কৃপাপ্রভাবে আপুনি প্রাকৃত ভাষায় ফট্টিফাইভ অর্থা পঞ্চচত্বারিংশৎ সংখ্যার দ্বারা চিহ্নিত বংশ পদ অর্থ ক্ষমতা মর্যাদা চাতুর্য সাফল্য খ্যাতি কীর্তি গৌরব বৈভব প্রতিভা প্রতিপত্তি ইত্যাদিতে উন হীন দীন অপাংক্তেয় অসহায় অকিঞ্চন সর্বসাধারণের নিমিত্ত তথা একমাত্র তস্মদদিগেরই উপযুক্ত রবারবলয়বেষ্টিত চক্রসংযুক্ত স্বয়ংচালিত কটিবস্ত্রপরিধান দণ্ডধারী জাতির জনকের আরাম হারাম হ্যায় বাণীর বাস্তব রূপায়ণে যাবতীয় বিলাসবিবর্জিত প্রাণান্তকর বিপুলসংখ্যক আরোহীবহনে সক্ষম বাস অভিধেয় অত্যাশ্চর্য একখানি উত্তরআধুনিক শকটের নিরতিশয় সংকীর্ণ জানকীর্ণ প্রবশপথের স্বল্পায়ত কাষ্ঠসোপানের সংকীর্ণ কাষ্ঠখণ্ডে উপানহাবৃত দক্ষিণ পদের অগ্রার্ধভাগ সংস্থাপন করত মনুষ্যবুদ্ধির অগম্য মুনিজনমানসতামসহর দুর্মর ভগবদমহিমায় চর্মচটিকাবৎ অত্যাশ্চর্যভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় আপুনি শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী পরমকারুণিক বিষ্ণুর প্রতি ভক্তি এবং কৃতজ্ঞতায় পরিপ্লাবিত হৃদয়ে উপলব্ধি করিতে লাগিলেন যে প্রজাপতির সৃষ্ট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অসামান্য, অতুলনীয়, অনন্য, দেবলোকের প্রযুক্তিবিদ বিশ্বকর্মারও অকল্পনীয় যে যানে সিংহ, ব্যাঘ্র, গণ্ডার, ভল্লুক, বন্য মহিষ, বন্য বরাহ ইত্যাদি হিংস্র আরণ্যক জন্তু কিম্বা গবাদি পশু,অশ্ব, গর্ধভ, ছাগল, মেষ, মার্জার, সারমেয়, ইত্যাদি গৃহপালিত প্রাণীকে স্বেচ্ছায় সাধারণভাবে দূরে থাকুক যথাসাধ্য বলপ্রয়োগেও পরিবহন করিবার চেষ্টা করিলে যেক্ষেত্রে ওই সকল জন্তু অসহ্য বোধে যন্ত্রণার্ত তথা শ্বাস রুদ্ধ হইবার আতঙ্কে কয়েক মুহুর্তের মধ্যে যেনতেন প্রকারেণ উক্ত যান হইতে লম্ফ প্রদানপূর্বক অবতরণ করতঃ ঊর্ধ্বশ্বাসে নিরুদ্দেশ যাত্রা করিবে অথচ সেক্ষেত্রেই করুণার মহাসিন্ধু পরমেশ্বরের সীমাহীন কৃপায় মনুর নশ্বর দ্বিপদ বংশধরেরা এই যানে ভ্রমণ করিবার অদ্ভুত, অনস্বীকার্য, অচিন্ত্যনীয় ক্ষমতা, সাহস এবং সহনশক্তি লাভ করিয়াছে অহো! দৈবমহিমা যে কী! মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তেগিরিং

বস্তুত আপুনি ইতঃপূর্বে ভিন্ন ভিন্ন বহুবিধ সংখ্যাচিহ্নিত রক্তিম নীল পাণ্ডু ধূসর পাটল ধূমল ইত্যাদি বর্ণময় সমুজ্জ্বল, উজ্জ্বল, অনতিউজ্জ্বল, মলিন, ধূলিধূসর ক্ষুদ্র বৃহৎ নাতিক্ষুদ্র নাতিবৃহৎ একতল বা দ্বিতলবিশিষ্ট নির্বিশেষ বিশেষ সবিশেষ অসংখ্য গণযানে সূচ্যগ্রপরিমাণ তিলার্ধধারণক্ষম স্থানের অসঙ্কুলানে আরোহণে অকৃতকার্য হইবার পর বর্তমানে অবিচল প্রতীক্ষার পরীক্ষান্তে বাসে আরোহণকর্মের সাফল্যের মনোরথসিদ্ধির মাধ্যমে পরমপুরুষের অপার অপরিমেয় অপরিসীম অপরিব্যক্ত করুণা প্রকট হইয়া ভাবাবেগে আপনকার অন্তরকে পরিপ্লাবিত করিয়া তাঁহার বিভূতি বুঝিবারে পারে নশ্বর স্বল্পবুদ্ধি কীটাণুকীট মনুষ্যের কিবা সাধ্য এই অনুভব অন্তরের অন্তস্থলকে

সাধ্যবস্তুসার গোপীজনবল্লভ বন্দারুজনমন্দার যদুনম্দনের জয়ধ্বনিতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল

যদ্কালে যাত্রাপথে স্থানে অস্থানে আপন আপন গল্তব্যস্থলের আবির্ভাবে করালবদনা মুক্তকেশী মুণ্ডমালা বিভূষিতা দক্ষিণাকালী ঘোরদংষ্ট্রা করালিনী ব্যাঘ্রচর্মাবৃতকটি তারা স্বীয় বামকরে স্বমস্তকধারিণী নিজকণ্ঠবিনির্গত রুধিরপায়িনী দিগম্বরী ছিন্নমস্তা গর্ধভারূঢ়া দক্ষিণকরে সমার্জনী ও বামে পূর্ণকুম্ভধারিণী শীতলা সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী দশভূজা ত্রিনয়না সঙ্কটাদি ইত্যকার কোনো না কোনো বিপন্নাশিনী ত্রিতাপদুঃখহারিণী মনস্কামনাপূর্ণকারিণী মাতৃকাদেবীর নাম পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করতঃ তত্সহ মা মা বহ্মময়ী মা আমার আবৃত্তি করিতে করিতে কতিপয় যাত্রী অভাবনীয় অকল্পনীয় অচিন্তনীয় অতুলনীয় অবর্ণনীয় প্রযত্নে তথা যত্পরোনাস্তি শারীরিক এবং মানসিক কৌশলে অনর্গল দাদা নাবব দাদা একটু রাস্তা করে দিন মেশোমশায় একটু কাৎ হয়ে দাঁড়ান দাদা একটু পেছনে ঠেলে থাকুন একটু রাস্তা দিন স্লা যত ভিড় দরজায় পকেট সামলে ওসব কায়দা জানা আছে আমি স্লা দমদমের মাল পকেটে নস্যির কৌটো ছাড়া কিচ্ছু রাখিনা দাদা নাবতে দিন একটু নেবে দাঁড়ান কলকোলাহলের মধ্যে পূর্বোক্ত কতিপয় ভ্রমণকারী তাহাদিগের পূর্বপুরুষের এবং তত্সহ স্বীয় পূর্বজন্মজন্মান্তরের আহৃত সঞ্চিত পুঞ্জিভূত সুকৃতিরাশির অমোঘ অনিবার্য অলৌকিক অনুকূল প্রভাবে প্রাণান্তকর অবতরণাভিপ্রায়ে সফল হইবামাত্র তন্মুহূর্তে অবতীর্ণ ব্যক্তিদিগের চতুর্গুণ কিম্বা পঞ্চগুণ নূতন যাত্রী রথে আরোহণ করিলে সহসা আপুনি সম্মুখে পশ্চাতে দক্ষিণে বামে ঊর্ধ্বে তথা অধোভাগে চকিত অতর্কিত অভাবনীয় অপ্রত্যাশিত আকস্মিক আধিভৌতিক অসহ্য অকথ্য প্রকট বিকট উত্কট নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের কারণে পিতৃপিতামহসহ সঙ্কটত্রাণ মধুসূদনের নাম পুনঃপুনঃ স্মরণ উচ্চারণ এবং কীর্তন করতঃ আপনকার অজ্ঞাতসারে অগোচরে শূন্যমার্গে ঊর্ধ্বগতি উত্তোলিত উক্ষিপ্ত হইয়া প্রবেশপথের দারুখণ্ডের সোপান হইতে উক্ত সার্বজনীন যানের উদরের গভীর অভ্যন্তরে সংস্থাপিত হইলে

আপনকার পৃষ্ঠদেশে বিস্ফারিত বিকটাকার বিশালকায় অলিঞ্জরোপম এক ভয়ংকর উদর অবিরত অনিবার্য অব্যাহত অচিন্তিতপূর্ব প্রবল পেষণে আপনাকে ক্রমশ অবিরত সম্মুখবতী করিতে থাকায় আপুনি আপনকার পুরোভাগে দণ্ডায়মান অবিচল চৈনিক মহাপ্রাচীরসদৃশ ষণ্ডোপম সহযাত্রীর পশ্চাদ্দেশে লিপ্ত লুপ্তপ্রায় হইয়া আপনকার গত্যন্তরবিরহিত স্থাণু অচঞ্চল নাসিকা উক্ত ভীমকায় বৃষভপ্রতিমের শ্রাবণের অবিশ্রাম ধারাপাতের তুল্য নিরন্তরনিঃস্রাবী ঘর্মোদকপরিপ্লুত বাহুমূলের পশ্চাতে আতত কামিজাংশে আসঞ্জিত হওনে স্বেদস্রাবের সুতীব্র লবণাক্ত পূতিগন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রকট প্রবিষ্ট ও প্রবাহিত হইতে থাকিলে আপনকার জঠরস্থ সংবৎসরের তাবৎ অন্নব্যঞ্জনাদি দ্রুত উদ্গত হইবারে উদ্যত হইলে

মঙ্গলময়ের অভিপ্রায়ই পূর্ণ হউক তাঁহার উদ্দেশ্য অনুমান করিবারে দেবগণও অক্ষম তথায় মনুষ্য কি ছার

আপনকার

দক্ষিণ পার্শ্বে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিহিত এক ব্যক্তির ভগবদ্কৃপায় সাতিশয় পুষ্ট ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রোমশ পুরুষোচিত সম্প্রসারিত বাম বাহু আপনার ক্ষীণ দীন দুর্বল স্কন্ধদেশে আশ্লিষ্ট হইয়া থাকায় বস্তুতঃ ঐ দরদরধারায় ঘর্মশ্রাবী বাহু হইতে নিঃসৃত বিগলিত স্রোতস্বিনীবৎ ঘর্মপ্রবাহ আপনকার স্কন্ধে পতিত তথা আপনকার স্বীয় স্বেদজলে মিশ্রিত হইয়া যমুনোত্রী উৎসারিত যমুনাপুলিন ও গঙ্গোত্রীনিঃসৃত পাপতাপহর পূত গঙ্গোদকের সম্মিলিত যুগলপ্রবাহের ন্যায় ক্রমেক্রমে আপনার স্কন্ধ হইতে বক্ষ উদর কটিদেশ অতিক্রম করতঃ জঘন শিশ্ন ও জানুপ্রদেশ প্লাবিত করিলেক

তদুপরি বিধাতার অবশ্যম্ভাবী বিধানে

আপনকার বামপার্শ্বে অবস্থিত দুইজন মনুষ্যের সূক্ষমূখ তীক্ষ্ণ বর্শাফলকসদৃশ কফোণি আপনকার পঞ্জরাস্থিতে নিবিষ্ট হইয়া ব্রণে সূচিকা বিদ্ধ হইবার অনুরূপ তীব্র বেদনার সৃষ্টি করিবার কারণে আপনকার দাদা কনুইটা একটু ইত্যাকার ক্ষীণকষ্ঠ অসমাপ্ত অবিন্যস্ত বাক্য উচ্চারণ করিবামাত্র ধ্বন্ন্যুৎপন্ন প্রতিধ্বনিসদৃশ তাৎক্ষণিক উদ্দিষ্ট প্রথম ব্যক্তির যথোপযুক্ত তির্যক প্রত্যুত্তর কনুই কি কেটে বাড়িতে রেখে আসব অত আরামে যেতে হলে ট্যাক্সিতে যান এবং অবিলম্বে দ্বিতীয়জনের সদাশয় সুমার্জিত মন্তব্য জ্যাঠামশায় গোরুর গাড়িটা বের করলেই পারতেন দিদিমাকে নিয়ে আরামসে হাওয়া খেতে খেতে যেতেন শ্রবণে সকলি ভক্তবৎসল করুণাময়ের লীলা উপলব্ধি করতঃ আপুনি গঙ্গার হ্রদের ন্যায় অক্ষুব্ধ এবং স্থিতধী, তৃণাপেক্ষা বিনীত এবং তরুর ন্যায় সহিষ্ণু হইয়া ঈশ্বরের নাম কীর্তনকে প্রেয় তথা শ্রেয় বিবেচনায় তূষ্ণীভাব অবলম্বন করিলেন

অচিরাৎ অলঙ্ঘ্য ললাটলিখন অনুযায়ী আপনাকার দর্শন ও

শ্রবণেন্দ্রিয় অবলা মাতৃজাতির উপবেশনের নিমিত্ত সংরক্ষিত দীর্ঘ আসনের অভিমুখী হইলে আপুনি অবলোকন করিলেন তত্রস্থ আসন পরিপূর্ণ ও তাহার সম্মুখে নাবালিকা বালিকা কিশোরী যুবতী প্রৌড়া প্রাচীনা অতিপ্রাচীনা বামাবৃন্দের জটলায় নাবালক বালক কিশোর যুবক প্রৌঢ় প্রাচীন অতিপ্রাচীন পুরুষোত্তমগণ অশ্রুতপূর্ব অদৃষ্টপূর্ব অভূতপূর্ব অজ্ঞাতপূর্ব অভাবনীয় পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় কামিনীদিগের সম্মুখে পশ্চাতে পার্শ্বদেশে স্থান লাভ করতঃ অত্যুৎসাহে তথা অদ্ভুত অত্যুৎকট রঙ্গে ষোষিদবৃন্দের অঙ্গের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের সঙ্গে নিজ নিজ দেহের ভিন্ন ভিন্ন অংশের সংম্পর্শ ঘটাইয়া অকলুষ অপার্থিব সনাতন ব্রক্ষস্বাদসহোদর দিব্য পরমানন্দানুভূতি লাভ করিতেছে

এই দৃশ্য দর্শনে আপুনি উপলব্ধি করিলেন কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম অহো জগদীশ্বরের মহিমা অপার অতএব তাঁহার নামজপযজ্ঞ কলিতে বদ্ধজীবের মুক্তির একমাত্র ঊপায়

ইতোমধ্যে ঘোর বচসার সূত্রপাত ঘটিল

পুস্তকাদি পঠনপাঠনের

ঊপকরণহস্তে জনৈকা নবযুবতী তদ্পশ্চতস্থিত সূর্যকরনিবারক শোভাবর্ধক বর্ণময় সানগ্লাস নামক অনুপম আধুনিক নেত্রালংকার পরিহিত জনৈক বিদ্বান বুদ্ধিমান ধর্মজ্ঞ সমুদাচারাভিজ্ঞ অভিজাতদর্শন যুবাপুরুষের উদ্দেশ্যে এই অসহ্য গরমে ভীড়ের চাপে দাঁড়াতে পারছিনা তার মধ্যে অসভ্যতা করে চলেছে এবম্বিধ প্রগলভ নীতিবিরহিত রীতিবর্জিত সদাচারবিরোধী ব্রীড়াবিবর্জিত উক্তি করিলে উত্তরে যুবকের যুগোপযোগী বীরত্বব্যঞ্জক আত্মমর্যাদা তথা আভিজাত্যসূচক সংযত প্রত্যুত্তর অত সভ্য হলে ঘরে বসে থাকলেই হয় তত্সহ সংবেদী মার্জিতরুচি সচ্চরিত্র সজ্জন এক নবযুবক সহযাত্রীর শিষ্টাচারসম্মত স্বগতোক্তি, সব সতীপনা জানা আছে, ঘোমটার নীচে খ্যামটা নাচে শ্রবণে শকটস্থিত পুরুষ যাত্রীদিগের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক তথা মহান জাতীয়তাভাবোদ্দীপিত মনোবৃত্তিতে নবযুবকদ্বয়ের বাক্যের সোচ্চার উচ্চকণ্ঠ সমর্থনসহ প্রাতঃস্নরণীয়া পঞ্চকন্যার সহিত তুলনাত্মক বিবেচনায় অধুনাতন কালের অঙ্গনাদিগের চরিত্র ধর্মভাব সতীত্ব শিক্ষা নম্রতা আদর্শ ঐতিহ্য গৃহকর্মনৈপুণ্য সূচিকর্মকুশলতা ইত্যাদি বিষয়ে যুক্তিবাদী শাস্ত্রসম্মত ও সত্যব্রত সুকঠোর সমালোচনায় মুখর হইলে উপর্যুক্তা নবীনা অনতিবিলম্বে বুঝিবা এবম্বিধ নির্মল সত্যবাক্যের সম্মুখীন হইবার অক্ষমতায় অথবা আপনকার ক্ষমার অযোগ্য অপরাধবিষয়ে চৈতন্যসঞ্জাত অনুশোচনার বৃশ্চিকদংশনে অস্থির হইয়া গন্তব্যস্থানের আর্বির্ভাবের পূর্বেই অবতরণ করিবারে বাধ্য হইলে তাহার অবতরণের অসাধ্যসাধনের প্রাণপণ প্রয়াসের মুহূর্তে সমালোচক শাস্ত্রবেত্তা নীতিবেত্তা ন্যায়মার্গাশ্রয়ী সমবেত অবিচল ধর্মপথাবলম্বী পুরুষসিংহকুল উক্ত যুবতীর দেহযষ্টির ভিন্ন ভিন্ন অংশকে মিথ্যা মায়া মোহাবেশং বিচার করিয়া ঐ সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যথাসাধ্য আলিপ্ত স্পর্শানুভূতির মাধ্যমে নিষ্পাপ নির্বিকার নিষ্কাম নিগুঢ় ভাবসমাধির তুল্য মায়াবাদী দর্শনের ব্যবহারিক উপলব্ধি লাভের মহত উদ্দেশ্যে যথোপযুক্ত পরিশ্রমের বিন্দুমাত্র ত্রুটি করলেন না

প্রভু কহে এহো বাহ্য আগে কহ আর

সহসা শকটের

সম্মুখভাগে বামপার্শ্বে দেশমাতৃকার পরম সেবক সর্বত্যাগী নগ্নগাত্র কেবলমাত্র লজ্জানিবারণের কারণে কটিবস্ত্রপরিহিত দণ্ডধারী অহিংসা পরমোধর্মের প্রতিমূর্তি জাতির জনক গান্ধি মহারাজ মধ্যে শবরূপী শিবোপরি দণ্ডায়মানা করালবদনা নৃমুণ্ডমালিনী জগন্মাতা কালিকা দক্ষিণ পার্শ্বে কদম্বতরুচ্ছায়ায় মুরলিবাদনরত সহস্রগোপকন্যাপরিবেষ্টিত সকলবাঞ্ছাপূর্ণকারী যমুনাকূলবিহারী কংসধ্বংসকারী ভক্তজনমানসহংস শ্রীকৃষ্ঞের পবিত্র বহুবর্ণ চিত্র এবং মাল্যবিভূষিত এই তিন চিত্রের পাদমূলে সত্যমেব জয়তে এই সনাতন আপ্তবাক্যের প্রতি আপনকার দৃষ্টি নিবদ্ধ হইলে

অহো কি দেখিলাম প্রভো কি দেখাইলে

এই দিব্য অনির্বচনীয় মহাভাব আপনকার হৃদয়কন্দরে তমসার ঘন অন্ধকার বিদীর্ণ করিল

ইতোমধ্যে রুদ্রের ভৈরব তুল্য ধর্মরাজ যমের দূতের

ন্যায় নরকের দৌবারিকের সদৃশ শকটস্বামীর অনুচর কণ্ডাক্টর অভিধেয় ভয়ংকর দ্বাররক্ষকের বাক্য ও বাহুবলে শকটের নিশ্ছিদ্র অভ্যন্তরে প্রেরিত যাত্রীসাধারণের মধ্যে অন্যতমের হস্তে ধৃত ম্লেচ্ছজাতিদিগের নব্য জড়বিজ্ঞানের মহৎ উদ্ভাবন তাররহিত ক্ষুদ্র পেটিকাসদৃশ যন্ত্র হইতে উৎসারিত অম্ফুট অবোধ্য অনর্গল বিজাতীয় বাক্যপ্রবাহ কর্ণে প্রবিষ্ট হইবামাত্র পুঞ্জীভূত সমবেত জনকুল সমুচ্চ দেশাত্মবোধে উত্তেজিত অনুপ্রাণিত উৎসর্গিতপ্রাণ হইয়া দাদা ইণ্ডিয়া কত রান করল কে ব্যাট করছে কপিল শালা ক্রিকেট কাকে বলে দেখিয়ে দেবে ইত্যাকার উত্সাহ ও উদ্দীপনাপূর্ণ কলকোলাহল করিতে লাগিলে আপনকার চিত্ত দেশপ্রেমের প্লাবনে পরিপ্লাবিত হইয়া উঠিল

হে পরম বরণীয়া চিরস্মরণীয়া স্বর্গাদপি গরিয়সী আদরণীয়া দেশমাতৃকা তুমি সনাতন ধর্মের ধারয়ত্রী পালয়ত্রী প্রভু হে সেই পুণ্য আনন্দময় দিন কি আগতপ্রায় যখন পৃথিবীর সপ্তদ্বীপের প্রতিটি জনপদে শ্রীহরির নামগানের সঙ্গে দেশমাতৃকার বিজয়গীতি ধ্বনিত হইবে

অকস্মাৎ যাত্রীসাধারণের প্রণাম তথা নাসিকা ও কর্ণমর্দনের ভঙ্গীসহ মা মা তারা ব্রক্ষময়ী মা রব ও তাহার কিয়ৎকাল পরে একই ভঙ্গীর পুনরাবৃত্তি সদযোগে বাবা বাবা জয় বাবা ভোলানাথ ধ্বনিতে আপুনি উপলব্ধি করিলেন প্রথমে বরাভয়দায়িনী পাপতাপবিনাশিনী জগন্মাতা কালিকার মন্দির এবং তদনন্তর যোগীশ্রেষ্ঠ বৃষবাহন

দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দির অতিক্রান্ত হইল

এদিকে বুদ্ধির অগম্য চিন্তার

অতীত জ্ঞানের সীমাতিক্রান্ত দৈবপ্রভাবে আপনকার মস্তক বিঘূর্ণিত হইতে লাগিল আপনকার পশ্চাদবস্থিত স্ফীতোদরের তীব্র হইতে ক্রমশ তীব্রতর অসহনীয় ঘর্ষণ ও পেষণে নাসারন্ধ্র সম্মুখস্থ বৃষস্কন্ধ মনুষ্যের স্বেদবারিনিষিক্ত বাহুমূলে অধিক হইতে অধিকতরভাবে সংলিপ্ত অবস্থায় আপনকার বমনেচ্ছা প্রবল হইতে প্রবলতর হইয়া উঠিল আপনকার বোধ হইতে লাগিল এই অনাদি অনন্ত ভ্রমণ বুঝিবা শত সহস্র অযুত বৎসর যাবৎ অব্যাহত আদি অন্তহীন বমি করছে বমি করছে মুখটা জানলা দিয়ে বের করতে দিন কলরবে সংজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া আপুনি দেখিতে পাইলেন আপুনি নহেন ভয়ংকর পেষণ ও অগ্নিময় উত্তাপে অস্থির অপরিণতমতি তথা আদর্শ সার্বজনীন গণযানে ভ্রমণে অযোগ্য অনভ্যস্ত অকিঞ্চন ক্কচিৎ নাবালক বাসের বাতায়নপথে মস্তকের কিয়দংশ বহির্গত করিবার প্রযত্ন করতঃ বারে বারে বমন করিতেছে এবং উক্ত উদগীর্ণ বমনের অংশবিশেষ গণযানের অভ্যন্তরভাগে নিপতিত হইতেছে এবং ধাবমান বহির্ভাগে যে অংশ পতিত হইতেছে তাহা বহুলপরিমাণ বাতাহত হইয়া বিন্দু বিন্দু শীকরকণার আকারে গণতান্ত্রিক রথের অভ্যন্তরে সবেগে প্রবিষ্ট হইয়া পবিত্র দুর্গোৎসবান্তে শান্তিবারিনিষেকের ন্যায় যাত্রীসাধারণের শরীরের অনাবৃতভাগকে সিঞ্চিত করিতেছে

সকলই প্রভুর ইচ্ছা

সাধারণতন্ত্রী

শকট দক্ষিণাভিমুখে আবর্তন করিলে আপুনি জ্ঞাত হইলেন আপনকার গন্তব্যস্থল আসন্ন আগতপ্রায় এবং তৎকালে ক্রমে ক্রমে তমিস্রা, অন্ধতমিস্রা, রৌরব, মহারৌরব, কুম্ভীপাক, কালসূত্র, শূকরমুখ, ক্রিমিভোজন, সূচিমুখ ইত্যাদি ভাগবতপুরাণোক্ত অষ্টবিংশ নরকের পূতিগন্ধ হইতে সহস্রগুণ দেহ ও আত্মার উদ্বেজক বীভৎস গন্ধের আবির্ভাব শিয়ালদহ নামধেয় বিখ্যাত পল্লীর অবস্থান ঘোষণা করিলে অবতরণ করিতে হইবে এইরূপ অনুধাবন করতঃ গুরুকৃপাহি কেবলম্ ভরসায় শ্রীমন্মহাপ্রভুর শ্রীচরণকমলযুগল স্মরণ মনন ও কীর্তন করিতে করিতে তাঁহারই পাপতাপহর নামোচ্চারণ পূর্বক বারংবার সমবেত ও বিচ্ছিন্ন ভাবে অঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যঙ্গের আন্দোলন আঘুর্ণন আকর্ষণ বিকর্ষণ সংকর্ষণাদি ঐকান্তিক ও অবিরত কায়িক বিক্ষেপণের কারণে

দাদা নামবো দাদা দয়া করে

একটু যেতে দিন আপনি আমার জায়গায় চলে আসুন আপনি কি নামবেন দাদা দাদা ইত্যাকার বাচিক প্রক্ষেপণের দ্বারা

গুরু ইষ্টদেবতা কূলদেবতা

তথা বৈদিক অবৈদিক শৈব শাক্ত বৈষ্ণব গাণপত্য বার্হস্পত্য ইত্যাদি যাবতীয় দেবকূলের নামকীর্তন ধ্যান ও অনুধ্যানের মানসিক সাধনাপ্রসূত শক্তিতে

ওভাবে চিতিয়ে বাস থেকে নামা যায় না কাঁৎ হয়ে যান চোখটা কি ট্যাঁকে গুজে নিয়েছেন পা মাড়াচ্ছেন দেখতে পাচ্ছেন না পায়ে খুর আছে নাকি বুড়োর রস আছে মেয়েদের দিকে ব্যাট করতে যাচ্ছে বয়সটা কি ঘাস খেয়ে হয়েছে ষাঁড়ের মত গুঁতোচ্ছেন কেন কি চাঁদু চকচকে টাকটাতো বেশ বানিয়েছ বেড়ু করতে বেড়িয়েছ হাঁটি হাঁটি করতে জানো না ইত্যাদি সুমধুর সুশ্রাব্য সদুক্তিবর্ষণের লক্ষ্য হইয়া আপনি অবশেষে কতিপয় সদাশয় সমাজসেবী বলবান যাত্রীর পশ্চদবর্তী অবস্থায় এক প্রবল প্রকৃষ্ট প্রকট পেষণে পিষ্ঠ মথিত পরিহিত বস্ত্রের অনেকাংশ ছিন্ন ঊর্ধ্বগামী অধিকাংশ কালিমালিপ্ত কণ্ঠাগতপ্রাণ অবস্থায় জ্ঞানবুদ্ধিহীন জড়পিণ্ডবৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাস হইতে ভূমিতলে অবতীর্ণ হইয়া দশদিকে একযোগে অন্ধকার ও খদ্যোৎপ্রতিম আলোকের স্ফুলিঙ্গ এবং সরিষাপুষ্প অবলোকন করিতে লাগিলেন

এমতাবস্থায় বাসের

দ্বারপালের সুযোগ্য ও সুকৌশলী সহকারী দাদু টিকিটটা শব্দে দাবি জানাইয়া ঐ অঘটনীয় অভাবনীয় অকল্পনীয় অতুলনীয় দিব্য এবং সমাজতান্ত্রিক ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত অর্থমূল্য গ্রহণ করিয়া সবাস অন্তর্হিত হইলে আপুনি কথঞ্চিৎ আচ্ছন্নতা কাটাইয়া জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ অহো প্রভুর কি কৃপা তাঁহারই করুণায় দরিদ্রের সেবাকল্পে বর্তমান এতদ সকল সার্বজনীন যানারোহনে গন্তব্যস্থলে পৌছানো সম্ভব হইল কেননা প্রকাণ্ড বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের তাব কাণ্ড তাঁহারই ইচ্ছায় নির্ধারিত ইত্যাদি পরম সত্য চরম বাস্তব ও সাতিশয় যুক্তিযুক্ত ভাবনায় নিমগ্ন হইলেন

পুষ্কর দাশগুপ্ত: আমার ভাট বকা , দ্বিতীয় পর্ব

পুষ্কর দাশগুপ্ত

আমার ভাট বকা

দ্বিতীয় পর্ব

AMAR BHAT BAKA 3

. আবার কলকাতায় (১৯১৩)

ঘুরে ফিরে আবার কলকাতায় !

দুকোটি পঞ্চান্ন লক্ষ সাঁইত্রিশ হাজার ছশ বাহাত্তরটি জাতীয় পাখি কাক, বিভিন্ন মাপের পঁচিশ কোটি সাতচল্লিশ লক্ষ ষোলো হাজার নশ বত্রিশটি সর্বংসহ পোকা আরশোলা, ঋতুভেদে কমবেশি হলেও ঠিক এই মুহূর্তে অ্যানোফিলিস, কিঊলেক্স্ ইত্যাদি প্রজাতিতে বিভক্ত সতেরো কোটি আটান্ন লক্ষ বারো হাজার তিনশ ছাপান্নটি মশা, ধেড়ে আর নেংটি মিলিয়ে সাঁইত্রিশ লক্ষ সত্তর হাজার তিনশ সাতটা লম্বোদর গজানলের বাহন ইঁদুর, মাত্র নব্বই হাজার ছশ সাতাশটা বিশ্বকর্মার বহু যত্নের সন্তান ছুঁচো, গৃহপালিত বাদ দিয়ে বাহাত্তর হাজার পঁয়তাল্লিশটি দেবকুক্কুরী সরমার বংশধর অনাথ সারমেয় বা ঘেয়ো নেড়ি কুত্তা, হাজার পঞ্চাশেক মা ষষ্ঠীর অনুচর বেড়াল, বিরামহীন ইলেক্ট্রিক হর্নের আওয়াজে কানে তালা লাগানো আর চোখমুখ জ্বলা করা ধোঁয়াওগরানো নতুন, পুরনো, মান্ধাতার ঠাকুর্দা, বাবা আর তার নিজের আমলের এবং গ্লোবালাইজড্ একুশ শতকের ক্যাটকেটে, ম্যাটমেটে, চকচকে, রঙচটা, ঝকঝকে হরেক কিসিমেব দুচাকা (স্কুটার ও বাইক সহ), তিনচাকা, চারচাকা তিরিশ লক্ষ গাড়ি, হাতে টানা আর পায়ে (সাইকেলে) চালানো দুলক্ষ রিক্সা ও সাইকেল ভ্যানের শহর কলকাতা। হাজার হাজার হকারের ঝুপড়ি আর পসরায় উধাও ফুটপাথ কলকাতা, গাদাগাদি ঠাসাঠাসি ধাক্কাধাক্কি কামড়াকামড়ি করা এক কোটি চল্লিশ লক্ষ মনুর অপোগণ্ড বংশধরের শহর কলকাতা। কালী কলকাত্তাওয়ালির শহর সনাতন কলকাতা।

সিটি, মেগাসিটি, নগরী, মহানগরী যে নামেই ডাক না কেন কলকাতা কলকাতা। কলকাতা পাল্টায় না, পাল্টাতে পারে না। কয়েক পরত ধুলো, কাদা আর ধোঁয়ায় আস্তরণে ধূসর রাস্তার পাশে অসংখ্য বিবর্ণ পুরনো বা পড়োপড়ো বাড়ি, বস্তি বা ঝুপড়ির মাঝখানে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু চকচকে বহুতল বাড়ি আর বিতিকিচ্ছিরি উড়ালপুলের কনট্র্যাস্ট কলকাতার দাদা‘ (Dada) চেহারাটকে আরো খোলসা করে দিয়েছে । খোলা ভ্যাট, চারদিকে ছড়ানো ডাঁই করা আবর্জনার মধ্যে মানুষ, কুকুর আর কাক পঞ্চশীলের মটো মেনে সহাবস্থান মেনে নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় জীবন ধারণের রসদ খুঁজছে দেখাচ্ছে আশাবাদী জীবনযুদ্ধের উজ্জ্বল উদাহরণ। নাড়িভূঁড়িতে মোচড় লাগানো বর্জ্য পদার্থের সৌরভ আর মূত্রস্রোতের মধ্যে মাথা তুলছে ঝিংচ্যাকচ্যাক মল, বাংলা মল নয়, খোদ ইয়াংকি মল । চমৎকার! আর কী চাই ? কলকাতায় পিৎসাহাট, দোমিঙ্গো, জোভান্নি, কেন্টাকি চিকেন, ম্যাকডোনাল্ড, মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা আরো কত কী এসে গেছে , আরো কত কী আসছে । ক্যা বাৎ! রাসবিহারী এভেন্যুতে রেস্টোরেন্টের নাম রিস্তোরান্তে পুঞ্জাবইতালিয়া — পঞ্চনদীর তীরের সঙ্গে টাইবারআডিজেইপৌএর রন্ধন সংস্কৃতির পরিণয়! ক্রেডিট কার্ডের তাড়ায় পেটমোটা ওয়ালেট নিয়ে শহরের বাবুদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা লেটেস্ট মডেলের কার থেকে নেমে লাইন লাগাচ্ছে কোকে সিপ করতে করতে খাচ্ছে বিগ ম্যাক, চিকেন নাগেট, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফ্রাইড চিকেন, পিৎসা, স্পাগেত্তি, রিজতো ; পরস্পরকে হাই, হাই (হায় হায় নয়) শব্দে সম্ভাষণ করছে , নাইটক্লাব, ডিস্কোতে নাচানাচি করছে — গ্লোবালাইজেশন, ‘মেরিকান ড্রিমস্(নিওকলোনিয়ালিজম্ , নিওকম্প্রাদর, বিশ্বায়নের ভুয়ো লেবেলে কর্পোরেট কলোনাইজেশন, ইয়াংকি নাইটমেয়ার — যত সব ফালতু কথা ! — বুলশিট!)

চৈত্র মাস । তারকশ্বরে মানত দিতে যাবে বলে মেয়েমদ্দরা গলির মোড়ে ভিক্ষে করছে, মানত দিতে যাওয়ার পথে রাস্তায় বাংলা মাল, কিচাইন, বাওয়াল, রথ দেখা আর কলা বেচা— বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগি, বাবা ম — হা — দে — ব, ভোলে বাবা পার করেগা ।

চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক কলকাতায় এই পাঁচটা ইন্দ্রিয়কে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়, তা না হলে প্রাণ রাখতে প্রাণান্ত হয়। মরা ইঁদুর, গাড়িতে চাপা পড়া কুকুর, রাস্তায় যেখানে সেখানে , বিশেষত যেখানে লেখা আছে প্রস্রাব করা নিষেধ’ বা প্রস্রাব করিবেন না ’ সেখানে পেচ্ছাবের বন্যা, জঞ্জালের পাহাড়, গন্ধে নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে আসার উপায়। নোংরা, নোংরা বলে কিছু হয় না, হতে পারে না হতে পারে শুচি বা অশুচি, ব্যাপারটা ছোঁয়াছুঁয়ির, চোখ বা নাকের ব্যাপার নয়, ব্যাপারটা স্পর্শের। পাশের মাড়ওয়ারিদের বাড়িতে সকাল পাঁচটা থেকে করতাল আর মৃদঙ্গ সহ রামনাম, গলির ভেতর রাম ঠাকুরের আশ্রমে অষ্টপ্রহর অবিরাম নামসংকীর্তন, কলিতে নামই ভরসা, রাস্তায় অবিরত ইলেক্ট্রিক হর্ন, চায়ের দোকান, সিডির দোকানে ফিল্মি গান, বারমাসে বারোয়ারি তের পর্বণে মাইকে সঙ্গীতবিতরণ, গলির মধ্যে পাড়ার শচীনদের ক্রিকেটের হুল্লোড়! কান ঝালাপালা ! জীবন মানেই হৈ চৈ, গন্ডগোল, নীরবতা মানে নাকি মৃত্যু, চুপ করে ভাবার কী আছে? বাসেট্রামে, রাস্তায়, দোকানবাজারে গাদাগাদি, ঠেলাঠেলি। চামড়াকে সহনশীল করতে হবে !

শুনলাম বাঙালিদের প্রিয় দিদি নাকি বলেছেন কলকাতাকে লন্ডন বানিয়ে দেবেন। বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা বাপের নাম খগেন করে দেওয়ার মতো কিছু কিনা। তবে কলকাতাকে কেউ সুন্দর, পরিষ্কার, দূষণমুক্ত, শব্দদূষণহীন কলকাতা করার কথা বলে নি বা বলে না কেন? এক পশলা বৃষ্টির পর রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেল, নোংরা জল ভেঙে এগোতে গিয়ে চোখে পড়ল নানা বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে দুটো মরা ইঁদুর ভাসছে। পেছন থেকে ছিটিয়াল মন্টুদার গলা শুনলাম, দেশের হালচাল কিছুই আর তোমার মাথায় ঢুকছে না। হ্যাঁ, কলকাতা এখনো লন্ডন হয়নি, তবে টেমস্এর জল ঢুকে পড়েছে।

যতবার কলকাতায় আসি তার আগে থেকেই মনের মধ্যে সুবর্ণরেখা ছবিতে বিজন ভট্টাচার্যের অভিনীত চরিত্রের উক্তির প্রতিধ্বনি অবসেশনের মতো পাক খেতে থাকে, চলো পুষ্কর কোইলকাতায় যাই, কোইলকাতায় বীভৎস আনন্দ!

. শম্ভুর চায়ের ঠেকে

প্রতিদিন অন্তত একবার শম্ভুর চায়ের ঠেকে গিয়ে রঙচটা বেঞ্চিতে কিছুক্ষণ পোঁদ না ঘষলে ঠিক কলকাতায় এসেছি বলে বোধ হয় না। তাই ভোরে উঠে আটটা নাগাদ শম্ভুর ঠেকে হাজির হলাম। শম্ভু   বলল, কবে এলেন? অমলদা, পার্থদা সবাই জিজ্ঞেস করে । খেয়াল করিনি শম্ভুর পেছনের বেঞ্চে ঝন্টু বসে ছিল। উঠে এসে বলল , বস এসে গেছ ? শম্ভুর ঝামেলি না করে বসকে আগে বসতে দে। শম্ভুর ঠেকে আর জায়গা নেই, কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। ঝন্টু পেছনের বেঞ্চে নিজের জায়গায় আমাকে বসিয়ে শম্ভুর টুলটা এনে নিজে গ্যাঁট হয়ে বসে শম্ভুকে অর্ডার দিল, জম্পেশ করে বড় গেলাসে দুটো ডবল লেবু চা, দুটো জোড়া মাখম টোস্ট আর ডবল ডিমের দুটো ঝিং চ্যাক চ্যাক মামলেট ।

ঝন্টু জানাল মাইরি বলছি বস সকালে তোমাকে নিয়ে শান্তিতে বসে চা খেতে খেতে সুখদুঃখের কথা বলব তার আর উপায় নেই। পুরনো চায়ের ঠেকগুলো সব এক এক করে ভোগে গেছে । বিনোদবাবু আর মুন্নার দোকান বিক্রমপুর হয়ে ঝকমকে চাইনিজের দোকান বনে গেছে, বাবুয়া গোবরা থেকে একটা মুসলমান ছোকরাকে ধরে এনে চাফা বন্ধ করে রোল আর টিকিয়া বিক্রি করছে, মন্টুদার দোকান গেছে , বাড়ি ভেঙে ওখানে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে, নিচের তলায় নাকি বাবুদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য একদিকে ফাস্ট ফুড আর অন্যদিকে সাহেবি রেস্টোরেন্ট হবে, কী যেন বলে শালা, পেটে আসছে ত মুখে আসছে না। হ্যাঁ, মনে পড়ছে, ফিউশন রান্নার রেস্টোরেন্টগুষ্টির পিন্ডিমালটা কী হবে জানিনা। ফুটের কিছুটা জুড়ে শম্ভুর চায়ের ঠেকই আমাদের শেষ সম্বল। তবে শম্ভুর ঠেকে সক্কাল বেলা হাড়হাভাতে বুড়োগুলো পাড়ার লোকের হাঁড়ির খবর নিয়ে চটকায়, অমুক আর তমুকের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে। ওরা ঢেউ তুললেই আমাদের কেউ না কেউ থাকে অর্থা আমি, হিরু, পটলা কি খোকন । বুড়োগুলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ কানের পোকা বের করে দেয়। তের নম্বর বাড়ির নতুন ভাড়াটের মেয়ে উনিশ নম্বরের বিধবা বাড়িউলির ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে, তাতে বাঞ্চো তোর কী?

ঝন্টু বলল, বস আমি কাটছি , একটা ধান্ধা আছে। তুমিত এখন আছ? কাল দেখা হবে।

আমি শম্ভুর দোকানে বসে চারদিকের আজব শহর কলকাতার লোকজন, জীবনযাপন দেখতে থাকলাম। বেঞ্চে চারটে ছোকরা বসে ছিল। এদের আমি চিনি না। তবে বুঝতে পারলাম এরা শম্ভুর ঠেকের নিয়মিত খদ্দের, কাজকম্ম নেই, পকেট ফাঁকা। দুটো চা আর দুটো ফল্স, তার সঙ্গে দুটো লেড়ে বিস্কুট নিয়ে চারজনের হেভি ঘ্যানর ঘ্যানর । নেই কাজ তো খই ভাজ! এদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এরা বাংলাভাষায় লেখালেখি করে। দুজন কবিয়াল আর দুজন গপ্পো বানিয়ে। কেউ তাদের পাত্তা দেয় না, তবু ওরা সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে ঘোট পাকাচ্ছে। পয়লা নম্বর কবিয়াল বলছে: কবিতা? সুবোধদা দারুণ লিখেছে আন্ন্দবাজারে: কবিতা হাতে নিলে হাত পুড়ে যাবে!

মাথায় গোবর ডেলিপাষণ্ড উটকো একটা লোক এক কোণায় বসে ছিল, হাতে নিলে হাত পুড়ে যাবে শুনে বলে উঠল গরম তেলেভাজার কথা বলছেন? দোকান কাছাকাছি? বাঞ্চতের ট্রেন সোনারপুরে আটকে আছে, আধঘন্টা বন্ধ, শুনশান। গরম তেলেভাজা খেলে কিছুটা সময় কাটবে।

মহাগেঁড়ে ঐ ফালতু লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে কবতে আর গপ্পো নিয়ে চারজনের বকরবকর চলতে থাকল। দুনম্বর কবি একনম্বর গপ্পোওয়ালাকে বলল, তোর গপ্পটা পড়লাম, দারুন লিখেছিস, গপ্পের শেষটাও খুব ভাবায়।

এক নম্বর কবিওয়ালা বলল, আঁতেলদের আঁতলামির কথা আর বলিস না। শনিবার কফি হাউসে বোদলেয়ার বোদলেয়ার করে এক আঁতেল আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। পাপবোধ আর দ্রষ্টা, মাথা আর মু্ন্ডু! গত কাল আবার আরেক ম্যাস্টার পাকড়াও করেছিল। রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করে কানে তালা লগিয়ে দিল। রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথের কবিতা অপাঠ্য। গান? হ্যাঁ, গান অসাধারণ, তার কোনো তুলনা নেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তাই বলতেন।

আমি শালা গবেট। রবি ঠাকুরের কবিতা অপাঠ্য, গানের কোনো তুলনা হয়না! আমার কাছে ব্যাপারটা উদ্ভট। রবি ঠাকুরের কবিতা রোমান্টিক গীতিকবিতা, তাঁর গানও তাই, সে গান কথায় ভর্তি কবিতা, সুর কিছুটা একঘেঁয়ে । গানের বাণী রোমান্টিক কখনোকখনো ছদ্মমরমিয়া। রবি ঠাকুরের পদ্য যদি ভালো না লাগে গান কি করে অতটা প্রিয় হতে আমার মাথায় ঢুকল না।

ইতিমধ্যে কর্পোরেশনের জঞ্জালের গাড়ি খোলা ভ্যাট নিয়ে চারদিকে হরিলুটের বাতাসার মতো জঞ্জাল আর নাড়িভুঁড়ি বের করা দুর্গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে চলেছে। শুনলাম রবীন্দ্রসঙ্গীত-প্রিয় কবি গুনগুন করে গাইছে ‘জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে…’

গিয়োম আপলিনের কবিতা অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত Guillaume Apollinaire Poèmes Traduction en bengali : Pushkar Dasgupta Guillaume Apollinaire Poems Translated into Bengali: Pushkar Dasgupta

Bahuswar | বহুস্বর

APOLLINAIRE

গিয়োম আপলিনের (১৮৮০১৯১৮)

[এখানে টীকাসহ আপলিনেরএর যে কবিতাগুলির অনুবাদ উপস্থাপিত হয়েছে সেগুলি পুষ্কর দাশগুপ্তের আপলিনেরএর কবিতা(দ্বিতীয় সংস্করণ) বই থেকে নেওয়া।]

বিশ শতকের প্রথম থেকে ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ আর তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত চিন্তা ও ভাবাদর্শের জগতে দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই নতুন পরিস্থিতির সামাজিকঐতিহাসিক প্রথম মহাযুদ্ধ, রুশবিপ্লব, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ইত্যাদি। ইয়োরোপীয় শিল্পকলার জগতেএই ক্রান্তির প্রথম প্রকাশ ঘটে চিত্রকলার জগতে ফোভিসম্ (.Fauvisme, ইং.Fauvism), ক্যুবিজম্ (.Cubisme, ইং.Cubism), সাহিত্যের জগতে নাত্যুরিসম (.Naturisme,ইং. Naturism), য়্যুনানিমজম (.Unanimisme, ইং.Unanimism), দ্রামাতিসম্ (.Dramatisme,ইং.Dramatism), র্তিসিজম (ইং.Vorticism) ইত্যাদি আন্দোলনের অস্থির সন্ধানের মধ্যে। এর পর পরিবর্তনের প্রবণতার চরমপন্থী বিস্ফোরক প্রকাশ…

View original post 13,361 more words