নয়া–ঔপনিবেশক পাশ্চাত্যের প্রচারযন্ত্রের নির্মাণ আনিয়েস গোনজে বোইয়াজিয়ু ওরফে মা টেরিজা
পুষ্কর দাশগুপ্ত
বালিগঞ্জ রেল স্টেশনের সামনে স্টেশন রোড দিয়ে হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ল প্রবেশপথের পাশে সারা দেয়াল জুড়ে কলকাতার গৌরবজনক স্মারক হিসেবে বিরাট পাথরে মোজাইক করা কয়েকটা ছবি, ঐ ছবির একটা হল অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখি–এর। নাম শুনে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে? উনি আসলে পশ্চিমি প্রচারযন্ত্র আর তার প্রতিধ্বনি দিশি গণমাধ্যমের ঢক্কানিনাদে এই ছদ্ম নামে পরিচিত। শুধু বালিগঞ্জ রেল স্টেশনের প্রবেশপথে নয় কলকাতার রাস্তাঘাটে সর্বত্র এই মহিলার ছবি বা প্রতিমূর্তি। এমন কী কলকাতার সবচেয়ে পুরনো রাস্তার একটা পার্ক স্ট্রিটের নাম পলটে নতুন নাম দেওয়া হয়েছে মাদার টেরিজা সরণি ।
চারদিকের এই ডামাডোলের মধ্যে অনেক কথাই মনে পড়ল, মনে পড়ল অনেকদিন আগে ইন্টারনেট সংস্করণে ‘আমাদের কথা’ শীর্ষক আত্মপরিচয় অনুসারে যে দৈনিকপত্রিকা ‘কলকাতা থেকে নিয়মিত বিমানে ভ্রমণকারী প্রতি দু’জনের একজন, পশ্চিমবঙ্গে নামকরা গাড়ির মালিকদের ৪০%, রাজ্যের ওয়াশিং মেশিন আছে, এমন মানুষদের অর্ধেকেরও বেশি, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক মাইক্রোওয়েভ মালিক, রাজ্যের সমস্ত এয়ার কন্ডিশন মালিকের ৪০%’ তার মানে ‘ শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালি …..কলকাতার উচ্চ সমাজের বেশির ভাগ মানুষ’ নিয়মিত পড়ে সেই আনন্দবাজার পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে প্রকাশিত একটি চিঠির প্রতিবাদে বিদেশ থেকে স্পিড পোস্টে একটা চিঠি পাঠিয়ছিলাম। চিঠির বিষয় ছিল পূর্বোক্ত মহিলা অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন। না, আনন্দবাজার সে চিঠি ছাপায় নি, আমাকে তার কারণ দেখিয়ে কোনো চিঠি পাঠানো তো দূরের কথা।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর মোহান্ত বা পোপের অধীন বিদেশে ধর্মপ্রচারকদের শিক্ষাকেন্দ্র ২০০৪ সাল থেকে এশিয়াননিউজ.ইট (AsianNews.it) নামে একটি ইন্টারনেট পত্রিকা প্রকাশ করে। এই পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণের শিরোনামের নিচে থাকে ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর ভূতপূর্ব মোহান্ত কারল ভোইতিলা–র (এই পোলিশ পাদ্রির পোপ হিসেবে ছদ্মনামের ইংরেজি রূপ: দ্বিতীয় জন–পল) শেষ গ্রন্থ ‘ওঠ,এগিয়ে চল!’ (Alzatevi, andiamo! ইংরেজি অনুবাদে: Rise, Let us be on our way) থেকে উদ্ধৃতি ‘তৃতীয় সহস্রাব্দে আমাদের সবার মিলিত কর্মক্ষেত্র হল এশিয়া’ (Asia, our common task for the Third Millennium) ৷ মনে পড়ে ১৯৯৫ সালে ম্যানিলায় এশিয়ার ক্যাথলিক বিশপদের সমাবেশে ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর পূর্বোক্ত ভূতপূর্ব মোহান্ত বলেছিলেন:
পৃথিবীব্যাপী খ্রিস্টমণ্ডলীর সঙ্গে এসিয়ায় খ্রিস্টমণ্ডলী তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রবেশপথ পার হবে, আশ্চর্য হয়ে প্রত্যক্ষ করবে শুরু থেকে আজ অব্দি ঈশ্বর যা করেছেন এবং এই প্রত্যয়ে অবিচল থাকবে যে ‘প্রথম সহস্রাব্দে যেরকম ইয়োরোপের মাটিতে ক্রস রোপিত হয়েছে, আর দ্বিতীয় সহস্রাব্দে হয়েছে দুই আমেরিকা আর আফ্রিকায়, আমরা প্রার্থনা করতে পারি তৃতীয় খ্রিস্টীয় সহস্রাব্দে এই বিশাল আর গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশে বিশ্বাসের বিপুল এক ফসল আহৃত হবে’ ৷
– দ্বিতীয় জন–পল: এশিয়ার খিস্টীয় ধর্মমণ্ডলী ৷ ১
এবার তৃতীয় সহস্রাব্দে খ্রিস্টমণ্ডলীর অভিযান ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রসারের ঘোষিত লক্ষ্য হল এশিয়া ৷ ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রধান কারল ভোইতিলার ওপরে উদ্ধৃত ঘোষণা, কৈশোরে নাৎসি স্বেচ্ছাসেবক, পূর্বতন গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর কার্ডিনাল থেকে পদোন্নত ক্যাথলিক মোহান্ত জোজেফ রাৎসিঙ্গের–এর ( পোপ হিসেবে ছদ্মনাম ষোড়শ বেনেডিক্ট) বাচন, ইভাঞ্জেলিস্ট, সাদার্ন ব্যাপটিস্ট, গসপেল ফর এশিয়া ইত্যাদি অসংখ্য প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রচার, এমনকি গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টমণ্ডলীর কর্মসূচিতেও এই ঘোষিত লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য নিরন্তর বিভিন্ন সক্রিয় প্রয়াস ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায় ৷ কারল ভোইতিলার বাচনের ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণ করে বলা যায় আসলে গত চারশ বছর ধরে নানা কৌশল অবলম্বন করেও খ্রিস্টমণ্ডলীর বিভিন্ন শাখা অন্য মহাদেশগুলির তুলনায় এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে ততটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি ৷ যেখানে ইয়োরোপ, দুই আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় তাবৎ প্রাচীন ধর্মকে ধ্বংস করে খ্রিস্টমণ্ডলীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, আফ্রিকায়ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্মরণাতীত কালের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে ইসলামের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খ্রিস্টমণ্ডলীর আধিপত্য কায়েম সেখানে এশিয়া মহাদেশে আজো (হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ইত্যাদি) অন্য ধর্মের তুলনায় খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য অপ্রতিষ্ঠিত ৷ তাই আহত আত্মগৌরব পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর উদ্দেশ্য যে করেই হোক এশিয়া মহাদেশ জয় করতে হবে ৷
আবার এশিয়ায় কম্যুনিস্ট চিন, অর্থোডক্স খ্রিস্টান রাষ্ট্র আর্মেনিয়া, কম্যুনিস্ট ভিয়েৎনাম এবং তাবৎ ঐস্লামিক রাষ্ট্রে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তর বেআইনি অপরাধ ৷ ফলে কারল ভোইতিলা কথিত খ্রিস্টীয় ‘ঈশ্বরের’ ঘাড়ে চাপানো ‘অত্যাশ্চর্য পরিকল্পনা’ অনুযায়ী এশিয়াকে ধর্মান্তরিত করার ধান্ধায় ভারত আর ঐস্লামিক রাষ্ট্র হলেও তুলনামূলকভাবে উন্মুক্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের হরেক খ্রিস্টমণ্ডলীর সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতার প্রধান লক্ষ্যভূমি ৷
ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের রণকৌশলের অঙ্গ হিসেবে কয়েক বছর আগে ভ্যাটিকানের ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলী কর্তৃক সদ্য পরলোকগত আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু ওরফে টেরিজা মা–কে সন্ত খেতাব দেওয়ার প্রশ্নে দেশে বিদেশে আবেগোচ্ছ্বাসের চুনামি আর প্রশস্তির ধ্বনিত–প্রতিধ্বনিত করতালির মধ্যে প্রায় হারিয়ে যাওয়া কিছু বিরল কণ্ঠের প্রতিবাদ আমাকে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে চিন্তিত করে ৷ তার ওপর আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু তথা ক্যাথলিক গণমাধ্যম, দমিনিক লাপিয়ের ইত্যাদির অবদানে আজ পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্র, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসু, সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা আন্তর্জাতিকভাবে টেরিজা মার কলকাতা, নর্দমার কলকাতা, কুষ্ঠরোগের কলকাতায় পরিণত হয়েছে ৷ পশ্চিমি প্রচারমাধ্যমে টেরিজা মার কলকাতা, নর্দমার কলকাতা, কুষ্ঠরোগের কলকাতা শুনতে শুনতে কলকাতার আমি বিষণ্ণ হয়ে উঠি ৷ খ্রিস্টধর্ম প্রচার তথা পশ্চিমি প্রভাব ও স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার প্রয়েজনে নানা কৌশলে গড়ে তোলা টেরিজা মা নামক নাটকের নেপথ্যের কথাগুলি কেন বলা হয় না তা ভেবে বিরক্ত আর ক্রুদ্ধ হই ৷ বস্তুত পূর্বোল্লিখিত রণকৌশলের অঙ্গ হিসেবে ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে ভ্যাটিকানের কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলী কর্তৃক গোনখে বোইয়াখিনকে ‘পরমানন্দায়ন’ (বিআটিফিকেশন) মঞ্জুর করেন অর্থাৎ তিনি ‘ভগবদ্ করুণাপ্রাপ্ত’ (ব্লেসেড) অভিধা লাভ করে ‘সাধ্বী’ বা ‘সন্তের’ পদবী পাওয়ার প্রথম ধাপ টপকান ৷ এই উপলক্ষে ২৩–এ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকায় শর্মিলা বসু ‘মাদার টেরিজা–র কাজ ভাল, খারাপ, দুই–ই’ নামে একটি নিবন্ধ লেখেন ৷ উক্ত নিবন্ধে লেখিকা পাশ্চাত্যের মুখোমুখি ঔপনিবেশিতের দ্বিধা নিয়ে আমতা আমতা করে টেরিজা–র প্রশস্তির সঙ্গে কিছুটা সমালোচনা করেন ৷ এই সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেনস–এর টেরিজা সম্পর্কে গ্রন্থের উল্লেখ করেন ৷ কিন্তু তিনি পাশ্চাত্যে মহানায়িকার কদর পাওয়া সাদা চামড়ার টেরিজা–র সমালোচক হিসেবে ডাক্তার অরূপ চট্টোপাধ্যায়ের নাম হয়ত বাঙালি বলে উল্লেখ করেন নি ৷ যাই হোক শর্মিলা বসুর প্রবন্ধের প্রতিবাদে ৯–ই ডিসেম্বর ২০০৩ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় নিচে উদ্ধৃত চিঠিটি প্রকাশিত হয়:
আর্তের ত্রাতা
অবশেষে শর্মিলা বসুকে (মাদার টেরিজা–র কাজ ভাল, খারাপ দুই–ই, ২৩/১০) কয়েকটি কথা বলতেই হয় ৷ মাদার টেরিজা সন্ত হবেন কি না, কী ভাবে হবেন, খ্রিস্টমণ্ডলীতে তার প্রয়োজন আছে কি না, মণিকা বেসরা সুস্থ হল কি না, সন্ত হওয়ার পদ্ধতি কারও দৃষ্টিতে ভুল বা ঠিক ইত্যাদি বিষয়টি খ্রিস্টমণ্ডলীর অত্যন্ত নিজস্ব ব্যাপার ৷ অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষদের মাথাব্যথার কারণ নেই ৷ আমরা খ্রিস্টানরা যেমন কোনও দেবদেবী, পূজা–অর্চনা, সংস্কার নিয়ে উৎসাহী নই, তেমনই আমরাও আশা করব, আমাদের ধর্মীয় আচার–অনুছ্ঠান, রীতিনীতি, সংস্কার, ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মবিশ্বাসকে সমালোচনা করে কেউ আঘাত করুক। এটা অনধিকার চর্চা।
ভারতবর্ষ সাধু–সন্ন্যাসীদের পুণ্যভূমি, অলৌকিকতার ছড়াছড়ি। চোখের সামনে দেখি, সমাজের শিক্ষিত মানুষেরা ডান হাতের কব্জিতে অমুক বাবার সরু–মোটা সুতো জড়িয়ে রাখেন। এটা যদি সংস্কার হয়, তবে মাদারের লকেট দেওয়াটা কি কুসংস্কার হবে?
খ্রিস্টধর্ম চিরকাল গর্ভপাতের বিরোধিতা করেছে এবং করবে। সন্তান নষ্ট তো জীবন হত্যার শামিল — মহাপাপ কেউ শুনুক বা না শুনুক, গর্ভপাত অন্যায়। আপনার ধর্ম কি জীবন হত্যার পক্ষে না বিপক্ষে ?
মাদারের কুখ্যাত বন্ধু থাকতেই পারে। মাদার তাদের টাকার সদ্ব্যবহার করেছেন। হয়তো তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাদের সৎপথে ফিরিয়ে আনার। যিশু এসেছিলেন সমাজের যত পাপী মানুষদের বাঁচাতে। তিনি এখজন পতিতা নারীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলেন। একজন কুখ্যাত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে যদি সমাজের সুস্থ জীবনের পথে অনুপ্রাণিত করা যায়, তাতে মাদারের দোষটা কোথায় ? তিনি তাঁর গুরুর কাজ সম্পন্ন করেছেন মাত্র।
হিচেনস–এর প্রশ্ন, মাদারের টাকার হিসাব কোথায়? এটা তো সকলেরই জানা যে, কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব রক্ষার জন্য একটি নির্দিষ্ট দফতর আছে। তাঁরা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে উদাসীন নন। কোনও সংস্থার টাকার হিসাব কি কোনও সাধারণ মানুষের চাওয়ার অধিকার আছে ?
সমীরস্টিফেন লাহিড়ী। কৃষ্ণনগর, নদিয়া
আনন্দবাজারের ইন্টারনেট সংস্করণে আমি শর্মিলা বসুর প্রবন্ধ ও তারপর সমীরস্টিফেন লাহিড়ী–র চিঠিটি পড়ি ৷ শ্রীযুক্ত লাহিড়ীর চিঠির উত্তরে আমি একটা দীর্ঘ চিঠি লিখি আর চিঠিটি গ্রিস থেকে স্পিড পোস্টে আনন্দবাজারে পাঠায় ৷ আনন্দবাজার আমার চিঠি ছাপায় নি ৷ উক্ত চিঠির খসরাটি আমি এখানে উপস্থাপিত করছি:
সবিনয় নিবেদন,
মাদার টেরিজা সম্পর্কে শর্মিলা বসুর প্রবন্ধ (২৩–১০–২০০৩) প্রসঙ্গে সমীরস্টিফেন লাহিড়ীর পত্র (০৯–১২–২০০৩) পড়ে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি ৷
সমীরস্টিফেনবাবু লিখেছেন, ‘মাদার টেরিজা সন্ত হবেন কি না, কী ভাবে হবেন, খ্রিস্টমণ্ডলীতে তার প্রয়োজন আছে কিনা, মণিকা বেসরা সুস্থ হল কিনা, সন্ত হওয়ার পদ্ধতির কারও কারও দৃষ্টিতে ভুল বা ঠিক ইত্যাদি বিষয়টি খ্রিস্টমণ্ডলীর অত্যন্ত নিজস্ব ব্যাপার ৷ অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষদের মাথাব্যথার কারণ নেই ৷’ প্রথমেই বলে নিই আমি নাস্তিক আর বিভিন্ন ধর্মের রক্তাক্ত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে তাবৎ ধর্মের বিরোধী ৷ তবু সমীরস্টিফেনবাবুর সারমন মেনে বহু মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী, ইনকুইজিশনের রক্তমাখা তথা বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের দায়ভাগীকে বেয়াটিফিকেশন বা সন্তকরণের (ক্যাননাইজেশনের) ব্যাপারে নীরব থাকছি ৷ এমনকী মানবিকতার প্রশ্নও তুলছি না ৷ চুপ করে থাকছি এমিলিও বনাভেন্তুরো আলতিয়েরি (ওরফে পোপ দশম ক্লেমেন্ট ( Pope Clement X, ১৫৯০ – ১৬৭৬ ), কর্তৃক স্পেন থেকে মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়ন এবং অসংখ্য মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরের নায়ক ক্যাস্টিল–এর রাজা তৃতীয় ফার্ডিন্যান্ডকে ও ভূতপূর্ব কারল জোজেফ ভোইতিলা (ওরফে পোপ দ্বিতীয় জন–পল) কর্তৃক চিনে হত্যা, বলপূর্বক খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতকারী, নানা অপরাধ ও ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত মিশনারি ফ্রান্সিস্কুস দে কাপিয়াস, ওগ্যুস্ত শাপদলেন, আলবেরিকুস ক্রেসচিতেল্লি এবং স্পেনের ডিক্টেটর জেনারেল ফ্রাংকো–র সমর্থক–সুহৃদ, চিলির কুখ্যাত ডিক্টেটর পিনোচেৎ–এর ধর্মোপদেষ্টা ও ক্যাথলিক মৌলবাদী সংস্থা ওপুস দেই–এর প্রতিষ্ঠাতা হেজেমারিয়া এস্ক্রিভা দে বালাগুয়ের সন্তকরণ ব্যাপারে ৷ সমীরস্টিফেনবাবুর সারমন শিরোধার্য করে পূর্বোক্ত ভোইতিলা কর্তৃক ইহুদিদের ‘কুকুর’ বলে অভিহিত করা ইহুদি–বিদ্বেষী, তাবৎ নতুন চিন্তার বিরোধী জোভান্নি মারিয়া মাস্তাই–ফেরেত্তি (ওরফে নবম পাইয়াস), হাজার হাজার ইহুদি, জিপসি ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানের হত্যাকাণ্ডের সমর্থক ও সহায়ক ক্রোয়াসিয়ার জাগ্রেব–এর রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপ আলোইজিয়ে স্তেপিনাচ অথবা ‘হিটলারের পোপ’ বলে আখ্যাত এউজেনিও মারিয়া গিসেপ্পে পাচেল্লিকে (ওরফে দ্বাদশ পাইয়াসকে) বেয়াটিফিকেশন বা আরো অনেক ধর্মীয় কাণ্ড সম্পর্কে এতটুকু মুখ খুলছি না ৷
স্কোপিয়ে–য় (ম্যাসিডোনিয়ায়) জন্মানো আলবেনীয় (মতান্তরে ব্লাহস) মহিলা অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন–এর (ওরফে মাদার টেরিজা–র) বেয়াটিফিকেশন নিয়ে আমি নীরব থাকতে পারতাম যদি মহিলাকে ব্লেসেড টেরিজা অভ ক্যালকাটা বলা না হত, যদি খ্রিস্টান পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে ঐ মহিলার নয়া–ঔপনিবেশিক খ্রিস্টীয় খয়রাতির শো–বিজ–এর বিরামহীন প্রচারের ফলে আমাদের শহর পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্র, রামমোহন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসু, নজরুল, সত্যজিৎ রায়ের শহরের বদলে বস্তি, ভিখিরি, ফুটপাতবাসী, কুষ্ঠরোগী আর মৃত্যুমুখী মানুষের করুণ বাসস্থান খ্রিস্টীয় খয়রাতি–নির্ভর মা টেরিজা–র কলকাতায় পরিণত না হত ৷ যদি পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে ঐ আলবেনীয় মহিলাকে কলকাতার মা টেরিজা বলে অভিহিত করার সঙ্গে নর্দমার সন্ত বলে অভিহিত করে কলকাতাকে নর্দমার সমার্থক করে তোলা না হত ৷
সমীরস্টিফেনবাবু জানিয়েছেন ‘খ্রিস্টধর্ম চিরকাল গর্ভপাতের বিরোধিতা করেছে এবং করবে ৷’ অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন গর্ভপাত, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও বিবাহবিচ্ছেদের চরম বিরোধী ছিলেন ৷ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বক্তৃতায় তিনি বলেন যে পৃথিবীর শান্তির সবচেয়ে বড় শত্রু হল গর্ভপাত, না, রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধ কোনোটাই শান্তির শত্রু নয় ৷ এছাড়া একদিকে লোকসংখ্যা–স্ফীতির তাবৎ কুফল আর অন্যদিকে এইডস্–এর মহামারীর সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে এই মহিলা জন্মনিয়ন্ত্রণের সমস্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিরোধিতা করেন ৷ তবে সুবিধাবাদী অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন ইন্দিরা গান্ধির মানবাধিকার–বিরোধী জরুরি অবস্থার সমর্থক ছিলেন আর ঐ জরুরি অবস্থার অংশ হিসেবে সঞ্জয় গান্ধির বলপ্রয়োগে নির্বীজকরণের মাধ্যমে উগ্রপন্থী জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কোনো বিরোধিতা করেন নি ৷ এই মহিলা আয়ারল্যান্ডে গিয়ে বিবাহ–বিচ্ছেদ সম্পর্কে আইনের প্রস্তাব সম্পর্কে গণভোটে (রেফারেন্ডামে) প্রস্তাবের বিপক্ষে প্রচার করলেও প্রিন্সেস ডায়ানার বিবাহ–বিচ্ছেদ অনুমোদন করেন ৷ অবশ্য প্রিন্সেস বলে কথা! সমীরস্টিফেনবাবুর প্রশ্ন ‘আপনার ধর্ম কি জীবন হত্যার পক্ষে না বিপক্ষে?’ ক্রুসেড, ক্যাথার ও অন্যান্য তথাকথিত হেরেটিকস্ বা ‘ধর্মবিরোধীদের’ হত্যা, ইনকুইজিশন, (পাদ্রি বার্তোলেমি দে লাস কাসাস–এর বিবরণ অনুসারে) ‘ইন্ডিয়ান’ বলে অভিহিত কয়েক কোটি আমেরিকার প্রকৃত অধিবাসীদের নিধন, ফ্রান্সে স্যাঁ–বার্তেলেমি–র হত্যাকাণ্ড, উইচ বা ডাইনি বলে চিহ্নিত জোয়ান অভ আর্ক সহ হাজার হাজার মহিলাকে পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি সম্পর্কে সমীরস্টিফেনবাবুর ধর্ম কী বলে? এই ব্যাপারগুলি মনে হয় রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর বিচারে ‘জীবন হত্যা’ নয় ৷ এছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধের পর পাক সেনাদের হাতে যেসব শিশুর মা–বাবা নিহত হয়েছিলেন অথবা ঐ সেনাদলের দ্বারা ধর্ষিত অসংখ্য নারীর সন্তানদের অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন–এর খয়রাতি সংস্থা প্রবল উদ্যোগে গ্রহণ করে ৷ অবশ্য ইতিপূর্বে ভিয়েৎনাম যুদ্ধে আমেরিকার সেনাবাহিনির হত্যাকাণ্ডে ব্লেসেড টেরিজা যেমন নীরব ছিলেন পাক সৈন্যদের বর্বরতা ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তেমনি মুখ বুজে থাকেন ৷ অনাথ ও পরিত্যক্ত শিশুদের তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন ৷ এরকম কয়েক হাজার শিশু ইয়োরোপ ও আমেরিকার খ্রিস্টান পরিবারে দত্তক হিসেবে দান করা হয় ৷ প্রসঙ্গত বলা দরকার যেসব দরিদ্র পিতামাতা নিজস্ব ধর্ম অনুসারে সন্তানের ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে সন্তানকে মিশনারীজ অব চ্যারিটি–র অনাথ আশ্রমে সমর্পন করে তাদের বাদ দিয়ে পিতামাতার ধর্মীয়পরিচয়হীন তাবৎ অনাথকে (সাবালক হয়ে সচেতন ভাবে বিশেষ ধর্ম বা ধর্মহীনতা বেছে নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে) ব্যাপ্টাইজ বা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয় ৷ অবশ্য ভারতে তথাকথিত সেবাব্রতী ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট বা গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টমণ্ডলীর তাবৎ মিশন এই পদ্ধতিতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে ৷ তাছাড়া সমীরবাবু লিখেছেন ‘মাদারের কুখ্যাত বন্ধু থাকতেই পারে ৷… হয়তো তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাদের সৎপথে ফিরিয়ে আনার ৷’ অ্যাগনেস সি আই এ সমর্থিত চরম অত্যাচারী শোষক হাইতির ডিক্টেটর ফ্রঁসোয়া দ্যুভালিয়ে–র পুত্র একই চরিত্রের ডিক্টেটর জঁ–ক্লোদ দ্যুভালিয়ে–র কাছ থেকে লেজিওঁ দন্যর খেতার নেন আর দুভালিয়ে–র পরিবারকে দরিদ্রের বন্ধু ও দরিদ্রের প্রিয় বলে ঘোষণা করেন ৷ অসংখ্য মধ্যবিত্ত আমেরিকানকে প্রতারণার মাধ্যমে পঁচিশ কোটি কুড়ি লক্ষ ডলার আত্মসাৎকারী চার্লস্ কিটিংকে মামলা থেকে বাঁচানোর জন্য আলোচ্য অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন (ওরফে মাদার টেরিজা) কিটিংকে দরিদ্রের সাহায্যকারী বলে সার্টিফিকেট দিয়ে মার্কিন বিচারককে চিঠি দেন ৷ কিটিং–এর দশ বছর কারাদণ্ড হয় ৷ কিটিং মিশননারিজ অভ চ্যারিটিকে বারো লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার ও টেরিজাকে ব্যাক্তিগত বিমান ব্যবহার করার অধিবার দিয়েছিলেন ৷ লস অ্যাঞ্জেলস–এর ডেপুটি অ্যাটর্নি পল টার্লি অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিনকে উপর্যুক্ত অর্থ তার প্রকৃত মালিকদের ফেরৎ দেওয়ার নৈতিক কর্তব্য পালন করার আবেদন জানান ৷ অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন ওরফে ব্লেসেড টেরিজা ঐ পত্রের কোনো উত্তর দেন নি ৷ প্রতারক ব্রিটিশ প্রকাশক রবার্ট ম্যাক্সওয়েল–এর দানও তিনি অনায়াসে গ্রহণ করেছিলেন ৷ মানতে হয় এ সমস্তই ‘কুখ্যাত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে… সমাজের সুস্হ জীবনের পথে অনুপ্রাণিত করা’ ৷
এছাড়া আরো দুটি প্রশ্ন ৷ প্রথমত অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন বলতেন আর তাঁর দলবল (নির্মলা যোশি এন্ড কোম্পানি) বলে থাকে ‘দারিদ্র্য সুন্দর, দারিদ্র্য ঈশ্বরের দান’ ৷ অতি উত্তম! তবে অ্যাগনেস ও তাঁর দলবল কেন খ্রিস্টধর্মীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসী পাশ্চাত্যকে ধনদৌলত ধ্বংস করে সুন্দর, ঈশ্বরের অবদান দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়ে খ্রিস্টের প্যাশন বা জীবন–যন্ত্রণায় অংশ নিতে আবেদন বা প্রচার করেন করেন নি বা করেন না ৷ দ্বিতীয়ত গর্ভপাতের প্রচন্ড বিরোধী অ্যাগনেস ও তাঁর দলবল কখনো পাশ্চাত্যের যেসব খ্রিস্টধর্মাবলম্বী দেশে গর্ভপাত আইনানুগ (যেমন ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি) সেখানে গিয়ে সরকারকে আইন পালটে গর্ভপাত বন্ধ করতে বলেন নি ৷
অবশেষে সমীরস্টিফেনবাবুর উক্তি ‘মাদারের টাকার হিসেব কোথায়?’ ইত্যাদি ৷ প্রশ্নটা শুধু ক্রিস্টোফার হিচেনস–এর নয় ৷ হিচেনস, মিশনারিজ অব চ্যারিটির সন্ন্যসিনী–ভগ্নী হিসেবে এক দশক কাজ করে মোহভঙ্গ হওয়া মার্কিন মহিলা সুজান শিলডস্, জার্মান পত্রিকা ‘স্টের্ন’–এর সাংবাদিক ভালেতের ভোয়েলনভেরেব, লণ্ডনবাসী বাঙালি ডাক্তার অরূপ চট্টোপাধ্যায় এবং আরো অনেকের ৷ বলা দরকার ঐ মিশনের টাকা শুধু ভারতে আসে না বা জমা পড়ে না ৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জমা হয়, এর সিংহভাগ সরাসরি জমা পড়ে এবং থাকে পোপের শাসনাধীন খ্রিস্টমণ্ডলী পরিচালিত ভ্যাটিকানের ব্যাংকে ৷ ইয়োরোপে লোকে ঠাট্টা করে বলে ভ্যাটিকানের ব্যাংকের হিসেব স্বয়ং ভগবানেরও অজানা ৷ যেমন মার্কিন অর্থদপ্তরের সন্দেহ অনুসারে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ক্রোয়সিয়ায় নাৎসিদের বসানো আন্তে পাভেলিচ সরকারের লুঠ করা কুড়ি কোটি সুইস ফ্রঁ মূল্যের সোনা ভ্যাটিকানের ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল এবং তার একটা অংশ ভ্যাটিকান ব্যয় করে আদলফ্ আইখমান, ক্লাউস বার্বি, আন্তে পাভেলিচ এবং আরো বেশ কয়েকজন হত্যাকারী নাৎসি যুদ্ধাপরাধীর ভুয়ো রেড ক্রসের পাসপোর্ট জোগাড় ও কখনো কখনো রোমান ক্যাথলিক পাদ্রির বেশে ইয়োরোপ থেকে (প্রধানত ল্যাটিন আমেরেকায়) পালানোর ব্যবস্থা করতে ৷ নিঃসন্দেহে এসব ‘খ্রিস্টমণ্ডলীর অত্যন্ত নিজস্ব ব্যাপার’, আর খ্রিস্টমণ্ডলীর ‘নিজস্ব ব্যাপার’ ‘ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান, ধর্মতত্ত্ব, ধর্মবিশ্বাসকে সমালোচনা করা’ সমীরস্টিফেনবাবুর সারমন অনুসারে ভারতীয় হিন্দুদের কি আমার মতো ভারতীয় নাস্তিকের ‘অনধিকার চর্চা’ ৷ এখানে শুধু একটা প্রশ্ন থেকে যায়, গত পাঁচশ বছর ধরে পশ্চিমি খ্রিস্টমণ্ডলী কোন অষিকারে ভারতীয়দের ‘ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান, ধর্মতত্ত্ব, ধর্মবিশ্বাস’ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আসছে: ভারতীয়রা বর্বর, ভুয়ো দেবতা অথবা শয়তানের উপাসক, প্রতারক স্বভাবের.এসব বলে আসছে ৷
এমনকী অ্যাগনেস গোনখে বোইয়াখিন–এর তথাকথিত অলৌকিক কর্ম মনিকা বেসরা–র সুস্থ হওয়ার ব্যাপারে ভ্যাটিকানের তথাকথিত তদস্ত কমিশন বাঙালি ডাক্তারদের বক্তব্য কোনো যুক্তি না দেখিয়ে অগ্রাহ্য করে ৷ এর মধ্যেও পশ্চিমি খ্রিস্টমণ্ডলীর ঐতিহ্যানুসারী অন্যের সম্পর্কে এবং বিশেষভাবে ভারতীয়দের সম্পর্কে অবমাননাকর উদ্ধত মনোভাবের পরিচায়ক ৷
স্মরণীয়, ১৫৪৩ সালে ইস্পনি বাস্ক পাদ্রি ফ্রানচিস্কো দে হাবিয়ের (ওরফে সন্ত জাভিয়ের) রোমে জিশুসংঘকে একটি চিঠিতে জানান, ‘যেহেতু ভারতীয়রা কালো ওরা ওদের নিজেদের রঙকে সবচেয়ে সুন্দর বলে ভাবে, ওরা বিশ্বাস করে ওদের দেবতারা কালো ৷ কারণে ওদের বেশির ভাগ দেবমূর্তিগুলি যতটা কালো হওয়া সম্ভব ততটা কালো, আর তার ওপর সাধারণত মূর্তিগুলি এমনই তেলমাখা যে তার থেকে দুর্গন্ধ নির্গত হয়, আর আর সেগুলি যতটা কুৎসিৎ যতটা বীভৎস দেখতে ঠিক ততটাই নোংরা বলে মনে হয় ৷’ আবার ১৫৪৯ সালে রোমে ঐ জেজুইট পাদ্রি তাঁর গুরু ইনিগো লোপেথ দে লোইয়েলা–কে ভারত থেকে চিঠিতে জানাচ্ছেন ‘যতটা আমি লক্ষ্য করতে পেরেছি তদনুসারে ভারতীয়দের পুরো জাতিটাই নিতান্ত বর্বর; নিজেদের প্রথা ও দেশাচারের সঙ্গে মেলে না এমন কোনো কথাই তারা শুনতে আগ্রহী নয়, আর আমার মতে ঐ রীতিনীতি বা আচার–বিচার হল বর্বরোচিত ৷… বেশির ভাগ ভারতীয় দুষ্ট চরিত্রের ও পুণ্যকর্মের বিরোধী, তাদের পাপ ও প্রতারণার অভ্যাস এমন বন্ধমূল যে তাদের স্থৈর্যের অভার, চাপল্য এবং চিত্তবিকার অবিশ্বাস্য ৷’ উক্ত ধর্মান্ধ পাদ্রি ভারতীয়দের ‘শিক্ষাদীক্ষাহীন বর্বর’ বলে অভিহিত করেছেন এবং পর্তুগালের রাজাকে ১৫৪৮ সালে কোচিন থেকে লেখা এক চিঠিতে ভারতীয়দের জোর করে খ্রিস্টধর্মান্তরিত করার প্রস্তাব করেছেন ৷ আর এই কুৎসিৎ কাদা ছোঁড়া আজও অব্যাহত ৷ যেমন একটি রোমান ক্যাথলিক ইন্টারনেট সাইটে পাদ্রি জাভিয়ের–এর জীবনী উপস্থাপিত: করতে গিয়ে ভারত সম্পর্কে মন্তব্য রয়েছে: ‘আজ এই বিরাট দেশ এখনো একই অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে ৷ এই দেশ সার্বিকভাবে মূর্তি উপাসনার আরো বেশি গভীর দুরবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে ৷’ কিংবা ক্যাথলিক ফ্যামিলি নিউজ পত্রিকার সম্পাদক জন ভেনারির মন্তব্য ‘হিন্দুধর্ম যেসব ভুয়ো দেবতার পুজো করে তারা শয়তান ৷’ ভারতীয় অন্যের সম্পর্কে ক্যাথলিকদের এই মৌলবাদী বিদ্বেষ ও ঘৃণার প্রচার (অধিকার–চর্চা?) বিষয়ে সমীরস্টিফেনবাবু কী বলেন?
বিনীত
পুষ্কর দাশগুপ্ত
না, আনন্দবাজার পত্রিকা এই চিঠি ছাপেনি ৷ স্বাভাবিক ! বহুকাল ধরে পশ্চিমের নয়া–ঔপনিবেশিকতার (সুগারকোটেড গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের, আনন্দবাজারের মোলায়েম ভাষায় ‘ভুবনায়নের’) কম্প্রাদর, মার্কিন মুল্লুকের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল ফাকস নিউজ চ্যানেল (Fox News Channel) ও ইংল্যান্ডের রেসিস্ট, কুরুচিপূর্ণ ও কুৎসাপ্রিয় দৈনিক দ্য সান পত্রিকার মালিক রুপার্ট ম্যাড্রকের স্টার ইন্ডিয়া টেলিভিশন চ্যানেলের তল্পিবাহক আনন্দবাজারের পক্ষে এই চিঠি ছাপানো সম্ভব ছিল না ৷
প্রসঙ্গত একটা কথা বলা দরকার। আমি যুক্তিবাদী নাস্তিক, কোনো ধর্মের প্রতিই আমার আলাদা কোনো পক্ষপাত বা আক্রোশ নেই। সমস্ত ধর্মেরই ভিত্তি হল যুক্তিহীন বিশ্বাস আর একগাদা (কু)সংস্কার। এই নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে আমি একদিকে যেমন সব রকমের ধর্মীয় হানাহানির বিরোধী অন্যদিকে তেমনি পৃথিবীর সাংস্কৃতিক উদ্বর্তন ও বৈচিত্র্য ধ্বংসকারী তাবৎ ধর্মান্তরের বিপক্ষে।
টীকা
১.With the Church throughout the world, the Church in Asia will cross the threshold of the Third Christian Millennium marvelling at all that God has worked from those beginnings until now, and strong in the knowledge that “just as in the first millennium the Cross was planted on the soil of Europe, and in the second on that of the Americas and Africa, we can pray that in the Third Christian Millennium a great harvest of faith will be reaped in this vast and vital continent”.
─The Marvel of God’s Plan in Asia [1]
Ecclesia in Asia – John Paul II – Post-Synodal Apostolic …
1) John Paul II, Address to the Sixth Plenary Assembly of the Federation of Asian Bishops’ Conferences (FABC), Manila (15 January 1995), 11: Insegnamenti …]
‘