বাংলাভাষী বাঙালিদের কাছে আমার প্রশ্ন পুষ্কর দাশগুপ্ত

বাংলাভাষী বাঙালিদের কাছে আমার প্রশ্ন

পুষ্কর দাশগুপ্ত

প্রশ্ন ১.

বাঙালি কে বা কারা ? অল্পবিদ্য, স্বল্পবুদ্ধি আমি আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায় যা বুঝি তা হল ভাষাপরিচয়ে অর্থাৎ মাতৃভাষা বা প্রথম শেখা ভাষার পরিচয়ে বাঙালি বাঙালি, ইংরেজ ইংরেজ। ভৌগোলিক পরিচয়টা গৌণ, যেমন, আসামে অনেক বাঙালি রয়েছেন অথবা কলকাতায় বহু অবাঙালি বাস করেন। প্রশ্ন হল, ইংরেজি জানে না এমন কাউকে কি ইংরেজ বলা যায় ? বাংলা জানে না অথচ বাঙালি হতে পারে কি?

প্রশ্ন ২.

শিক্ষিত বাঙালি কে বা কারা ? ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় দুএকটা পাশ দেওয়া বাঙালি হল শিক্ষিত বাঙালি। অথচ ধ্রুপদী আরবি আর ফারসি অথবা সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অধিকার রয়েছে এরকম দুজন বাঙালিকে শিক্ষিত বলা হয় না। শিক্ষিত বাঙালিরা অবজ্ঞার বাঁকা হাসি মিশিয়ে প্রথম জনকে বলবে মৌলবি সাহেব, দ্বিতীয় জনকে পণ্ডিতমশাই। এর কারণ বা যুক্তিটা কী?

প্রশ্ন ৩.

আনন্দবাজার পত্রিকার বৈদ্যুতিন সংস্করণে ‘আমাদের কথা’ নামে আত্মপরিচিতিতে এই দৈনিক পত্রিকার পাঠকদের সামাজিকসাংস্কৃতিক মর্যাদার উচ্চস্তর বোঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে, এঁরা হলেন কলকাতা থেকে নিয়মিত বিমানে ভ্রমণকারী প্রতি দুজনের একজন, পশ্চিমবঙ্গে নামকরা গাড়ির মালিকদের ৪০%, রাজ্যের ওয়াশিং মেশিন আছে, এমন মানুষদের অর্ধেকেরও বেশি, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক মাইক্রোওয়েভ মালিক, রাজ্যের সমস্ত এয়ার কন্ডিশন মালিকের ৪০%। এতে যোগ করা হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা সংবাদপত্র নয়, এক বৃহৎ বাজার’। এই বড়া বাজার আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলাভাষার পত্রিকা হয়েও বাংলাভাষার ব্যবহারের বিস্তারের চরম বিরোধী আর মাতৃভাষা বাংলার পক্ষপাতীদের বাংলাবাজ বলে নির্দেশ করে।

যে ভাষার পত্রিকা সেই ভাষারই চূড়ান্ত বিরোধী বাংলাভাষার আনন্দবাজার পত্রিকা ছাড়া এরকম আর কোনো একটি পত্রিকা পৃথিবীতে আছে কী? যদি না থাকে তাহলে বাংলা ভাষার সংবাদপত্র ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’ পৃথিবীর একমাত্র দৈনিক পত্রিকা যা যে ভাষায় প্রকাশিত হয় ব্যবসাবাণিজ্য কি কর্মক্ষেত্রে সে ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহারের বিস্তার আর সে ভাষা সর্ব স্তরে শিক্ষা, বিদ্যা এবং জ্ঞানচর্চার ভাষা হয়ে উঠুক তার একান্ত বিরোধী । গিনেস বুকে এই ব্যাপারটা এখনো স্থান পায়নি। ‘শিক্ষিত’ বাঙালিদের কী গিনেস বুকের অপদার্থ কর্মী আর কর্তৃপক্ষকে এই অনন্যসাধারণ ব্যাপার সম্পর্কে অবহিত করানো উচিত নয়?

প্রশ্ন ৪.

দেশের শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞনের চর্চা — সর্ব স্তরে, সর্ব ক্ষেত্রে মাতৃভাষার বদলে বিদেশি কোনো ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে অথচ সে দেশের তথা দেশের সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষের সামগ্রিক, স্থিতিশীল ও সর্বঙ্গীন উন্নতি হয়েছে — সারা পৃথিবীতে এরকম কোনো দেশ আছে কি? থাকলে সেই দেশ বা দেশগুলির নাম কী?

.প্রশ্ন ৫.

ইংরেজি শিক্ষার গত দুশ বছরের ইতিহাসে প্রকৃতিবিজ্ঞান, মানবিকবিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় শিক্ষিত ভারতীয়দের অবদান কী যদি সেরকম কোনো অবদান না থাকে তার কারণ কী?

প্রশ্ন ৬.

সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থে অনড় এই ঔপনিবেশিক শিক্ষা দেশে ইংরেজি জানা না জানার মাপকাঠিতে পুরনো জাতিভেদের চেয়ে আরো দৃঢ়মূল নতুন জাতিভেদ গড়ে তুলেছে । টমাস ব্যাবিংটন মেকলের জারজ ( মেকলের ভাষায়, ‘a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect’/রক্তের পরিচয়ে ভারতীয়, অথচ রুচি, মতামত, নৈতিকতা আর বুদ্ধিবিবেচনায় ইংরেজ এরকম এক শ্রেণীর লোক) বড়বাবুবড়বিবিদের পোস্টকলোনিয়াল যুগের (? নিওকলোনিয়াল বললে রাবিশ, রিডিক্যুলাস ইত্যাদি বলে সমাজের ক্রেম দ লা ক্রেম বাঙালিরা আমার মতো সিলি অ্যাস, নিটউইট, ইল্লিটারেটকে ইংরেজিতে তাড়া করবে !) এ দেশে ইংরেজি না জানলে তো বটেই, গটমট করে ইংরেজি না বললে কোনো অফিসআদালতে, এমন কী বড়সড় দোকানপাট কি রেস্টোরেন্টে খদ্দের হিসেবেও পাত্তা পায় না। অবশ্য কলকাতা শহরও এখন আর বাঙালির – রামমোহন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের কলকাতা নয়, এই পোস্টকলোনিয়াল (?) শহর এখন ‘নর্দমার সাধ্বী’ আলবেনীয় আনিয়েজ গইনজে বোজাজিয়ু ওরফে খ্রিস্টানদের ওপরওয়ালার আশীর্বাদধন্যা টেরিজার ‘নর্দমা’ কলকাতায় পরিণত। যাই হোক, পোস্টকলোনিয়াল (?) নতুন জাতবিচারে এদেশে বা কলকাতা শহরে এখন যারা একমাত্র ‘ছোটলোকদের’ অর্থাৎ ঝিচাকর, ড্রাইভার, দারওয়ান, ছোটখাট দোকানদার আর বাজারের ওয়ালাদের বাদ দিয়ে সবার সঙ্গে সারাক্ষণ ইন্ডিয়ান ইংলিশে (তুলনীয়: বিলিতি আমড়া, দিশি হুইস্কি) কথা বলে (ইংরেজিতে অকথ্য বলে নটে ইত্যাদি শাক, সজনে ডাঁটা, পটলের দোলমা, ইলিশ মাছের পাতুরি, এঁচড়ের ডালনা বা কৈতেল খায় না) তারা হল বামুন, (আবার এদের মধ্যে যারা প্রচুর স্বরক্ষেপ সহ ইংরেজি বলে, ব্রিনজল না বলে এগপ্লান্ট বা obErZinবলে, রুইকাৎলার বদলে ইল্ডিয়ান কার্প্স্ বলে, প্লেজার, মেজার না বলে বলে pleZ:@r, meZ:@r, তারা হল কুলীন বামুন, – এর পরের স্তরে ইংরেজি বলাকওয়ার কায়দা আর কেরামতির কমবেশিতে ওই বামুনদের মধ্যে আবার ভঙ্গ, অকুলীন যজমেনে, অগ্রদানী ইত্যাদি পর্যায় স্থির হয়।) ইংরেজি অল্পস্বল্প জানে, ঘষে ঘষে কোনোরকমে মাছিমারা কেরানির কাজ চালিয়ে যেতে পারে, ইংরেজি বলতে গেলে ঢোক গিলতে হয়, বুক ধরফর করে : এরা হল গিয়ে বদ্যি, কায়েত; তারপর জলচল নবশাখ: ইংরেজিতে নামঠিকানা, সনতারিখ, পণ্যদ্রব্যের কৌটোর ওপর ছাপানো নাম, ইংরেজি সাইনবোর্ড, পথনির্দেশ ইত্যাদি মোটামুটি পড়তে পারে। সব মিলিয়ে খুব বেশি হলেও দেশের মানুষের শতকরা পাঁচ জন। বাকি শতকরা পঁচানব্বই জন দেশের নাগরিক ইংরেজি জানে না, ইংরেজি বুঝতে, বলতে বা লিখতে পারে না, পোস্টকলোনিয়াল (?) নতুন জাতবিচারে এরা জলঅচল নিচু জাত, অচ্ছুৎ। এই জাতিভেদ সম্পর্কে প্রগতিশীল ‘শিক্ষিত’ বাঙালিরা কী বলেন?

প্রশ্ন ৯.

ইংরেজি নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের জের্মানিকটিউটনিক অ্যাংলোস্যাক্সন ভাষাগোষ্ঠীর একটি ভাষা। এই ভাষা গ্রেকোরোমান সভ্যতা আর জুডিওখ্রিস্টান সংস্কৃতির ধ্যানধারণায় পরিপোষিত। গ্রীষ্মমণ্ডলের ভিন্নতর ভৌগোলিক পরিবেশ আর সামাজিকসাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাস করা ভারতীয়দের/বাঙালির জীবনের বহু অপরিহার্য উপাদান বা ধ্যানধারণাকে (গাছপালা, শাকসব্জি, রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মবিশ্বাস, পারিবারিকসামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি) এ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তাই ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বাঙালি/ভারতীয় শিশুকে/ব্যক্তিকে তার সমাজ তথা সামাজিকসাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই শিক্ষাব্যবস্থা কিছু মাঝারি মানের অনুকরণ, অনুসরণ ও পুনরাবৃত্তিক্ষম ‘শিক্ষিত’ উত্পাদনেই শেষ হতে বাধ্য। ইংরেজি শিক্ষার গত দুশ বছরের ইতিহাসে প্রকৃতিবিজ্ঞান, মানবিকবিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা/এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় ‘শিক্ষিত’ ভারতীয়দের অবদান কী বা কতখানি তা চিন্তা করলেই ব্যপারটা বোঝা যায় (দ্র. প্রশ্ন ৪.)। আমাদের প্রযুক্তিবিদরা ইংরেজি বইয়ে পড়া আর দেখা ছবি অনুসারে শীতের দেশের বাড়ির আদলে এদেশে এমন সব বাড়ি তৈরি করেন যেগুলিতে গ্রীষ্মমণ্ডলের মৌসুমী অঞ্চলে বাস করা যণ্ত্রণাদায়ক। আমাদের সহস্রমারী চিকিত্সকদের বেশির ভাগ ইংরেজি বইপড়া হাতু়ড়ে। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বেশির ভাগ কারিগর, বিদেশিদের নির্দেশ আর ছক মেনে অর্ডারি সফ্টওয়ার বানিয়েই সন্তুষ্ট। আমাদের অধ্যাপকরা অমুক সাহেব আর তমুক সাহেবের মতামত মুখস্ত বলাটাই অধ্যাপনা বলে মনে করেন। এই অস্বাভাবিক অবস্থা কী কখনো কাটবে না?

প্রশ্ন ১০.

চারদিকের জগৎ ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন বিদেশি ভাষায় অধীত বিষয় শিক্ষার্থীর বোঝার স্তর পেরিয়ে বড় জোর মানসিকতার আপাত সংস্থানে পৌঁছোতে পারে, কিন্তু তা তার পরের স্তরে নিহিত সংস্থানে আত্তীকৃত হয়ে চিন্তাপদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সৃজনশীল বা উদ্ভাবক সঞ্জননী ক্ষমতায় পরিণত হয় না। আমাদের এই উপলব্ধিটা কি আমাদের দেশ তথা ঔপনিবেশিত আরো কিছু দেশের তথাকথিত শিক্ষিতদের সম্পর্কে প্রযোজ্য বা যথার্থ নয় ?

প্রশ্ন ১১.

বিদেশি ভাষায় এই শিক্ষাব্যবস্থা কি শিক্ষিতদের এক ধরনের ভারসাম্যহীন দ্বৈত জীবন যাপনে (স্কিৎজোফ্রোনিয়ায় ভুগতে) বাধ্য করে না ? বটঅশ্বত্থ আর নিম গাছে ঘেরা বাস্তবের ঘর আর ওকএল্মঅ্যাশএর ছায়ার স্বপ্ন দেখা বাইরের, জীবনযাপন আর বাচনের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত অসুস্থ জীবন কি ব্যক্তি আর সমাজজীবনকে পঙ্গু, পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তোলে না ? এই পক্ষাঘাতের লক্ষণ আর উপসর্গ কি দেশের তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা আর কথাবার্তায় স্পষ্ট নয়?

প্রশ্ন ১২.

যে ভাষা জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ হয় না, যে ভাষা আধুনিক নাগরিক জীবন আর তথ্যপ্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন আর তার ফলে নতুন শব্দের, নতুন বাগধারার উদ্ভাবন দ্বারা আধুনিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রেতভাবে যুক্ত হয় নি , যে ভাষায় কিছু গল্পকবিতা ছাড়া আর কিছুই লেখা হয় না সে ভাষার ভবিষ্যৎ কী ? সে ভাষার আয়ু কতদিন? আর সে ভাষার সাহিত্যও কি গতিহীন গেঁজিয়ে ওঠা বদ্ধ জলায়, গল্পকবিতা একঘেয়ে বিলাপ আর প্রলাপে পরিণত হয়ে ওঠে না ? বাংলা ভাষার অপুষ্টি আর রক্তশূন্যতার ভবিষ্যৎ পরিণাম কী?

প্রশ্ন ১৩.

আমরা অনুবাদের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষার বিদেশি সাহিত্য পড়ি, পড়ে হৈচৈ করি: বোদলের, রিলকে, নেরুদা, মার্কেসকিন্তু ইংরেজিতে অনূদিত হলেও বাংলা ভাষার লেখকদের (রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ , সামসুর রহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়…) লেখা বিদেশিদের কেউ পড়ে না বা তা নিয়ে আলোচনা করে না। এর কারণ কী?

প্রশ্ন ১৪.

বাংলা ভাষা আজও যথার্থ অর্থে কম্প্যুটারিয়িত হয় নি । তথ্যপ্রযুক্তির পরিভাষা নিয়ে কখনো মাথা ঘামানো হয়নি। বাংলায় কোনো পরিচালনা তন্ত্র (যেমন উইনডৌজ, ম্যাক ও এস, অ্যান্ড্রইড ) নেই, কোনো পরিপূর্ণ সফ্টওয়ার সমষ্টি (যেমন মাইক্রোসফ্ট অফিস, ওপেন অফিস…) নেই , জোড়াতালি দিয়ে বাংলায় টাইপ করতে হয়রান হতে হয়। আরেক পদ্ধতি হল রোমান হরফে বাংলা — অদ্ভুত, অনেক ক্ষেত্রে তার পাঠোদ্ধার প্রায় অসম্ভব। কম্প্যুটারে প্রকাশনার জন্য পেজ মেকার বা ইন ডিজাইনে সরাসরি বাংলা ব্যবহার করা যায় না, কারিগরি পদ্ধতিতে তৈরি নিম্নমানের কিছু সফ্টওয়ারের সাহায্য নিতে হয়। প্রায়কুটিরশিল্পের উত্পাদন ওই সফ্টওয়ারগুলির প্রযুক্তি সীমাবদ্ধ, তাতে আলাদা ইউনিকোডে টাইপ করা রচনা ব্যবহার করা যায় না, আবার এই সফ্টওয়ারের সাহায্যে টাইপ করা রচনা আলাদাভাবে বাইরে ব্যবহার করাও কঠিন। স্বয়ংক্রিয় বানান আর ব্যকরণসংশোধক না থাকায় ছাপার ভুল ছাড়া বাংলা বই দেখা যায় না। এসব নিয়ে সাধারণভাবে বাঙালি আর বিশেষভাবে বাংলাভাষার লেখকসাংবাদিকরা কেন কখনো কিছু বলেন না, ভাবেন বলেও মনে হয় না। তাঁরা কি অন্যন্য অনেক ব্যাপারের মতো এ ব্যাপারেও অদৃষ্টবাদী?

প্রশ্ন ১৫.

বাংলাভাষায় যথার্থ অর্থে কোনো অভিধান নেই। কোনো ভাষার সাধারণ অভিধানে (বিপ. বিশেষ অভিধান: দ্বিভাষিক, বৈজ্ঞানিক, আঞ্চলিক অভিধান ইত্যাদি) যা থাকে তা হল উপস্থাপিত শব্দগুলির:

. আন্তর্জাতিক ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালায় প্রতিবর্ণীকৃত (বৈদ্যুতিন সংস্করণে শোনার জন্য উচ্চারণের রেকর্ড সহ ) মান উচ্চারণ;

. পদপ্রকরণ (বিশেষ্য, বিশেষণ ইত্যাদি) ;

. .ইতিহাস. শব্দটির উত্স ও ব্যুত্পত্তি ;

. ভাষায় কোন সময় থেকে শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে ;

. সংখ্যা (, , ৩ ইত্যাদি) বা অন্য কোনো চিহ্ন দ্বারা নির্দেশিত শব্দটির ক্রমানুসারী বিভিন্ন (প্রচলিত বর্তমান থেকে অতীত, সাধারণ থেকে বিশেষ পারিভাষিক…) অর্থ বা সংজ্ঞার্থ — উক্ত সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী শব্দটির প্রয়োগের (যথাসম্ভব সাহিত্য, সংবাদপত্র ইত্যাদি থেকে) দৃষ্টান্ত;

. সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সাহিত্য বা/এবং প্রবচনে বা বাগধারায় শব্দটির বিশেষ বা রূপকার্থে ব্যবহারের উদাহরণ সহ সংজ্ঞার্থ ;

. ক্ষেত্র বিশেষে শব্দটির সমার্থক বা/এবং বিপরীতার্থক শব্দের নির্দেশ।

ঢাকার বাংলা একাডেমি কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত গোলাম মুরশিদএর বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কীভাবে আরো এগিয়ে যাওয়া যায় এই ব্যাপারে (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও সারা পৃথিবীর) বাংলাভাষী বাঙালিদের কি কিছুই করার নেই?

প্রশ্ন ১৬.

বাংলাভাষার শব্দের বানানের ক্ষেত্রেও নৈরাজ্য। ঢাকার বাংলা একাডেমি আর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বানান ব্যাপারে একমত নয়। একাডেমি, আকাদেমি এই দুই বানানেই বোঝা যায় মতভেদের কারণ খুব গভীর নয়। এছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকা বা আরও কিছু প্রকাশনসংস্থা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের নিজের বানানবিধি মেনে চলে। দুদেশের একাডেমি, ত্রিপুরা, আসাম ও সারা পৃথিবীর বাঙালিদের যোগাযোগ, আলোচনা ও সম্মতির মাধ্যমে বাংলাভাষার শব্দের বানানে একটি অদ্বিতীয় বিধান রচনা করুক এটা কী দাবি করা যায় না ?

প্রশ্ন ১৭.

কিছুদিন আগে প্রদীপ বসু নামে খ্যাতনামা ইতিহাসসমাজতত্ত্বের গবেষকঅধ্যাপকের লেখা দুটো প্রবন্ধ চোখে পড়ল। তাঁর মতে বাংলাভাষায় জ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তার প্রধান কারণ হল ভাষিক উপাদানের অর্থাৎ পরিভাষার অভাব। বার বার গুরুগম্ভীর জ্ঞানীদের মুখে এই যুক্তি শুনে বাঙালিরা ভয়েভক্তিতে নতমস্তকে তা মেনে নিয়েছি। কিন্তু সৎশিক্ষার অনটনে পূজ্যপাদ তত্ত্বজ্ঞানীদের প্রতি সনাতন ভক্তি আর বিশ্বাসের অভাবে দুর্বিনীত আমার কুতর্ক করার নিন্দনীয় স্বভাব থেকে আমার মনে হল, আসলে কোনো ভাষায় জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে পরিভাষা তৈরি হয়। দৃষ্টান্ত দেখা যাক Algebra (আরবি আলজাবর থেকে চতুর্দশ শতকে ল্যাটিনে তারপর ইংরেজি সহ আধুনিক ইয়োরোপীয় ভাষাগুলিতে রূপান্তরিত), television (বিশ শতকের শুরুতে গ্রিকমূল তিলে (τῆλε দূরে) ও ল্যাটিনমূল vision (দৃশ্য), ১৯২০র পর ইংরেজি সহ আধুনিক ইয়োরোপীয় ভাষাগুলিতে রূপান্তরিতভাবে আধুনিক দূরদর্শন । দুটি শব্দই আদিতে নতুন পারিভাষিক শব্দ। প্রয়োজনে গঠিত আর গৃহীত হয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রাত্যহিক শব্দে পরিণত হয়েছে। বাংলাভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় একই ভাবে গ্রিক ও ল্যাটিনের মতো সংস্কৃত বা/এবং বিদেশি আরবিফার্সি থেকে গঠিত আর রূপান্তরিত শব্দ পারিভাষিক শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় প্রাত্যহিক শব্দে পরিণত হতে পারত। ধরা যাক email , বিভিন্ন আকার আর নামে বৈদ্যুতিন চিঠি বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে চালু হলেও বর্তমান নাম ও পদ্ধতিতে email বা e-mail চালু হয় বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে। নামটির গঠন দেখে (Electronic + Mail) অল্পশিক্ষিত আমার মনে হল বাংলায় আমরা বৈচিঠি বা বৈচিঠি (বৈদ্যুতিন চিঠি ) চালু করতে পারি, কিন্তু আমার ‘শিক্ষিত’ বন্ধুরা হাসল, একজন আমাকে উদ্দেশ করে বাংলায় ছিটিয়াল, আরেকজন ইংরেজিতে ক্র্যাকপট, তৃতীয় জন অবোধ্য কোনো ভাষায় ‘কোঁপ্লেৎমঁ দ্যাঁগ’ বলে অন্য কথা পাড়ল । তবু আমার মনে হয়, খোদ ইংল্যান্ডে বা ইয়োরোপে ষোড়শসপ্তদশ শতকে যদি বেশ কিছু প্রদীপ বসু আর আমার বন্ধুদের মতো ‘শিক্ষিত’ থাকত তাহলে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় সাধারণ মানুষের অবোধ্য ল্যাটিন আজও বেঁচে থাকত, জীবনচর্যার সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানের কোনো সংযোগ স্থাপিত হত না। ইয়োরোপে চিন্তার মধ্যযুগ কাটত না। আমার প্রশ্ন বাংলা ভাষায় কি জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা সম্ভব নয়? জাপানিতে, কোরিয়ানে, চিনে, (ইন্দোনেশীয়) ভাষায়, থাই, আরবি, রুমানিয়ান, পোলিশ, হাঙ্গেরিয়ান, চেক ইত্যাদি ভাষায় যদি তা সম্ভব হয় তাহলে বাংলায় কেন সম্ভব নয়? প্রদীপ বসুর মতো বিদগ্ধ বাঙালিরা কী বলেন?

প্রশ্ন ১৮.

১৮৬৫ সালের ২৬এ জানুয়ারি ফ্রান্সের ভের্সাই থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বন্ধু গৌরদাস বসাককে একটা চিঠিতে লিখছেন:

…European scholarship is good…but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let those, who feel that they have spring of fresh thought in them, fly to their mother-tongue…I should scorn the pretensions of that man to be called “educated” who is not master of his own language.

[ইয়োরোপ বিষয়ে পাণ্ডিত্য প্রশংসনীয় ব্যাপার, … কিন্তু আমরা যখন পৃথিবীকে কিছু বলব তখন তা যেন আমরা আমাদের নিজের ভাষায় বলি। নিজেদের ভেতরে নতুন চিন্তার উত্সার রয়েছে বলে যারা বোধ করে তারা যেন অবিলম্বে নিজেদের মাতৃভাষার ছুটে যায়নিজের ভাষায় দক্ষতা নেই এমন কোনো মানুষের ‘শিক্ষিত’ বলে পরিচিত হতে চাওয়ার ভড়ংকে আমি ঘৃণা করি।]

ব্রিটিশ যুগে ভারতীয় প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ১৮৯১ সালের সমাবর্তন অভিভাষণে বলেন:

I firmly believe that we cannot have any thorough and extensive culture as a nation, unless knowledge is disseminated through our own vernaculars. Consider the lesson that the past teaches. The darkness of the Middle Ages of Europe was not completely dispelled until the light of Knowledge shone through the medium of the numerous modern languages. So in India… the dark depth of ignorance all round will never be illumined until the light of knowledge reaches the masses through the medium of their own vernaculars.

( Convocation Address 1891)

[আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের মাতৃভাষাগুলির মাধ্যমে জ্ঞান প্রচারিত না হলে জাতি হিসেবে আমাদের কোনো সর্বব্যাপ্ত আর পরিপূর্ণ বিকাশতে পারে না। অতীত আমাদের যে শিক্ষা দেয় তার কথা ভেবে দেখুন। অসংখ্য আধুনিক ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো দীপ্তিময় হয়ে ওঠার আগে অব্দি ইয়োরোপে মধ্যযুগের অন্ধকার সম্পূর্ণ বিদূরিত হয় নি। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্যতাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো জনসাধারণের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত চারপাশের অজ্ঞানের গভীর অন্ধকার কখনোই আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে না।

(সমাবর্তন অভিভাষণ,১৮৯১)]

১৯১২ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রাসায়াণিক পরিভাষা পুস্তিকার ভূমিকায় লিখেছিলেন,

বাঙ্গালা ভাষায় বহুল পরিমাণে বৈজ্ঞানিক পুস্তক লিখিত ও প্রকাশিত না হইলে পরিভাষার দোষগুণ সম্যকরূপে বিচার করা যাইতে পারে না। গ্রন্থকারগণ কতক শব্দ গ্রহণ করিবেন, কতক বাদ দিবেন, কতক বা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া সামঞ্জস্য করিয়া লইবেন। এক কথায়, বাঙ্গালী মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রচার না করিলে কখনই ভাষার ও বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের পুষ্টিসাধন হইবে না।

১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন:

আমি জানি তর্ক এই উঠিবে তুমি বাংলা ভাষার যোগে উচ্চশিক্ষা দিতে চাও কিন্তু বাংলাভাষায় উঁচুদরের শিক্ষাগ্রন্থ কই ? নাই সে কথা মানি কিন্তু শিক্ষা না চলিলে শিক্ষাগ্রন্থ হয় কী উপায়ে ? শিক্ষাগ্রস্থ বাগানের গাছ নয় যে , শৌখিন লোকে শখ করিয়া তার কেয়ারি করিবে ,— কিংবা সে আগাছাও নয় যে , মাঠে বাটে নিজের পুলকে নিজেই কণ্টকিত হইয়া উঠিবে! শিক্ষাকে যদি শিক্ষাগ্রন্থের জন্য বসিয়া থাকিতে হয় তবে পাতার জোগাড় আগে হাওয়া চাই তার পরে গাছের পালা এবং কুলের পথ চাহিয়া নদীকে মাথায় হাত দিয়া পড়িতে হইবে।

(রবীন্দ্রনাথ: শিক্ষার বাহন)

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতে যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চ্চা সম্ভব নয় তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।

মধুসূদন, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এঁরা কী তাহলে সত্যিকারের শিক্ষাদীক্ষার ঘাটতি থেকে উলটোপালটা বকেছেন, অথবা ওঁদের উক্তি নিতান্তই পাগলে কী না বলে! রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রিয় ‘শিক্ষিত’ বাঙালিরা কী বলেন? এছাড়া বাঙালি বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু আরো অনেকে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্মন্ধে যা ভেবেছিলেন তা নিয়ে বাঙালিরা আর মাথা ঘামাল না কেন ?

প্রশ্ন ১৯.

১৮৩৫ সাধারণ অব্দে টমাস ব্যাবিংটন মেকলের ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে প্রস্তাবের ষাট বছর পর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ‘ইংরাজী শিক্ষার পরিণাম’ (সাহিত্য, শ্রাবণ ১৩০২/ জুলাইঅগাস্ট ১৮৯৫ সাধারণ অব্দ) নামক প্রবন্ধে লেখেন:

ষাটি বত্সর পূর্বে এ দেশে সাব্যস্ত হইয়াছিল, ইংরাজী বিদ্যা না শিখিলে আমাদের মনুষ্যত্ব জন্মিবে না

আমরা জানিয়াছি অনেক ও শিখিয়াছি অনেক; কিন্তু কিরূপে জানিতে হয় ও কিরূপে শিখিতে হয় তাহা শেখা আবশ্যক বোধ করি নাই। মনুষ্যজাতির জ্ঞানের রাজ্য আমাদের কর্ত্তৃক এক কাঠা, কি এক ছটাক পরিমানেও বিস্তার লাভ করে নাই।

আমরা ইংরাজের প্রসাদে শিখিয়াছি যথেষ্টকিন্তু হায়! আমাদের গড়িবার শক্তি কই, আমাদের উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় কোথায়! আমরা শোনা কথা ও শেখা কথা ভিন্ন জগতে নূতন কথা কি বলিলাম!…

ষাটি বত্সরের ইংরাজী শিক্ষার ফলে আমরা ভাঙ্গিতে শিখিয়াছি, গড়িতে শিখি নাই, আমাদের আহারের দ্রব্য বাডিয়াছে, কিন্তু পরিপাকের শক্তি বাড়ে নাই: আমরা পরের কথার আবৃত্তি করিতে পারি, কিন্তু স্বয়ং বাক্য রচনা করিতে জানি না। আমাদের রাজনৈতিক পরাধীনতা হীন, আমাদের জ্ঞানজীবনে পরাধীনতা শোকাবহ।

মেকলের প্রস্তাবের ষাট বছর পর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী যা বলেছিলেন তা রামেন্দ্রসুন্দরের বলার একশ ন বছর পর আজ পড়ে আজকের ‘শিক্ষিত’ বাঙালির কী মনে হয়? আজও কি কথাগুলো একই ভাবে সত্যি?

dasgupta391@gmail.com )

Deux poèmes de René Char, traduits en bengali par Pushkar Dasgupta / René Char: Two poems, translated into Bengali by Pushkar Dasgupta /রনে শার  :দুটি কবিতা:অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত।

রনে শার (René Char, ১৯০৭১৯৮৮)এর দুটি কবিতা

অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত

গ্রন্থাগারে আগুন

ওই কামানের মুখ থেকে তুষারপাত। আমাদের মাথার ভেতরে ছিল নরক। ঠিক ওই একই মুহূর্তে আমাদের আঙুলের ডগায় বসন্তকাল । আবার অনুমতি পাওয়া পদচিহ্ন, প্রেমে পড়া পৃথিবী, প্রাণোচ্ছল তৃণদল।

সব কিছুরই মতো অস্তরাত্মাও কেঁপে উঠল।

ঈগল ভবিষ্যতের গর্তে।

অন্তরাত্মার অজ্ঞাতেই যে তাকে প্রবর্তনা দেয় এমন প্রতিটি কর্মের উপসংহার হিসেবে থাকবে কোনো একটা অনুতাপ কি বেদনা। তাকে মেনে নিতে হবে।

কীভাবে আমার কাছে লেখা এলো? শীতে, আমার জানলার শার্সির কাচে একটা পালকের মতো। অমনি ঘরের অগ্নিকুণ্ডে বেধে গেল জলন্ত কাঠের টুকরোগুলোর লড়াই, যা এখন অব্দি সাঙ্গ হয় নি।

আরো সব শহরের মধ্যে বসিয়ে দেওয়া, শুধু আমাদেরই পায়ে পায়ে চিহ্নিত পথ ওয়ালা আমাদের মনোযোগে সাড়া দেওয়া বিদ্যুচ্চমকের ডানার তলায়, রেশমের মতো মোলায়েম আটপৌরে চাউনির সহরগুলি।

যা আমরা আগে থেকে কখনো ভাবি নি, যা আমরা পরিস্ফুট করি না, যা কেবল তার নিজস্ব উপায়ে আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চলেছে এমন একটা কিছু যখন ঘটবে আমাদের ভেতরে সবকিছুকেই তখন শুধু একটা উল্লসিত উৎসবের পরিণতি লাভ করতে হবে।

এসো গভীরতা মাপার তার ফেলে যাই, গুচ্ছ গুচ্ছ শব্দের ব্যবহারে কথা বলে যাই একই পর্দায়, শেষ অব্দি আমরা স্তব্ধ করে দেবো ঐ কুকুরগুলোকে, যাতে করে ধোঁয়াটে একটা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে ওরা মাঠের ঘাসের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, যখন হাওয়া মুছে দেবে ওদের পিঠ।

বিদ্যুচ্চমক আমার মধ্যে অব্যাহত ।

শুধু রয়েছে আমার সমধর্মী, সঙ্গিনী বা সঙ্গী যে আমাকে জড়তা থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে, করতে পারে কবিতার উদ্বোধন, আমায় ছুঁড়ে দিতে পারে পুরনো মরুভূমির সীমানার পাঁচিলগুলোর গায়ে , যাতে করে আমি তাদের পরাস্ত করতে পারি। আর কেউ নয়। না স্বর্গ, না বিশেষ সুবিধেভোগী মর্ত্য, না আতঙ্কে শিউরে তোলা কিছু — এর কোনোটাই নয়।

মশাল, আমার সমধর্মী ছাড়া আর কারো সঙ্গে আমি নাচি না।

জগৎ আর নিজের সম্পর্কে সামান্য একটু ভ্রান্তি ছাড়া, প্রথম শব্দগুলি সম্পর্কে একটুকরো অজ্ঞতা ছাড়া কোনো একটা কবিতা শুরু করা যায় না।

কবিতায় প্রত্যেকটি বা প্রায় সবগুলো শব্দকে তার আদি অর্থে ব্যবহৃত হতে হবে। বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু শব্দ হয়ে ওঠে বহুযোজী। কোনো কোনোটি স্মৃতিভ্রষ্ট। প্রসারিত অনন্য হীরকখণ্ডের মণ্ডলী।

আমার কাছ থেকে কবিতা আমার মৃত্যুকে ছিনিয়ে নেবে।

কেনইবা বিচূর্ণ কবিতা? কারণ দেশের অভিমুখে যাত্রার শেষে জন্মের আগের অন্ধকার আর পার্থিব কঠোরতার পর, কবিতার সমাপ্তিই আলোক, জীবনের কাছে জীবের অবদা

কবি যা আবিষ্কার করে তাকে সে নিজের অধিকারে রেখে দেয় না; লিপিবদ্ধ করে অবিলম্বে তাকে হারিয়ে ফেলে। ওরই মধ্যে নিহিত থাকে তার নতুনত্ব, তার অন্তহীনতা আর তার ধ্বংস।

আমার পেশা হল যথার্থ দক্ষতার।

জন্ম হয় মানুষের সঙ্গে, দেবতাদের মধ্যে ঘটে সান্ত্বনাহীন মৃত্যু।

যে মাটি বীজ ধারণ করে সে বিমর্ষ। এত যার বিপদের সম্ভাবনা সেই বীজ আনন্দিত।

আর কোনো অভিশাপের মতো নয় এমনই এক অভিশাপ । এক ধরনের আলস্যে সে চোখ পিটপিট করে, মন ভোলানো তার স্বভাব, মুখের ভঙ্গি আশাপ্রদ। অথচ ভানটা কেটে গেলে, সে কী উদ্দীপনা, অবিলম্বে লক্ষ্যের অভিমুখে সে কী গতি। যে ছায়ায় সে ভারা বাঁধে তা অশুভ, একেবারে গোপন অঞ্চল, হয়ত কোনো এক আহবান থেকে সে অব্যাহতি পাবে, চিরকাল সময় মতো ঠিক সরে পড়বে । কয়েকজন দ্রষ্টার আকাশের ঘোমটার মধ্যে সে বেশ ভয়াবহ কিছু অধিবৃত্ত এঁকে ফেলে।

গতিহীন বইগুলো। অথচ যেসব বই আমাদের জীবনের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে, সেখানে আর্তনাদ করে ওঠে, শুরু করে যুগল নৃত্য।

কেমন করে বলা যায় আমার স্বাধীনতার কথা, আমার বিস্ময়, হাজার বাঁকের শেষেঃ সেখানে কোন ভিৎ নেই, নেই কোন চাল।

বারবার একটি অশ্বশাবকের, দূরবর্তী কোন এক শিশুর ছায়ামূর্তি গুপ্তচরের মতো আমার কপালের দিকে এগিয়ে আসে আর লাফিয়ে ডিঙিয়ে যায় আমার দুশ্চিন্তার বেড়া। তখন গাছের তলায় ঝর্ণা আবার কথা বলতে থাকে।

যে নারীরা আমাদের ভালোবাসে তাদের ঔৎসুক্যের কাছে আমরা অপরিচিত থাকতে চাই। আমরা তাদের ভালোবাসি।

আলোর একটা বয়স আছে। অন্ধকারের তা নেই। তবে কখন ছিল এই সম্পূর্ণ প্রস্রবণের লগ্ন ?

ঝুলন্ত আর যেনবা তুষারে ঢাকা কয়েকটা মৃত্যুর দরকার নেই। মজবুত একটি হলেই হোল। আর তা পুনরুত্থানহীন।

পিছু হটার উপায় এতটুকু বা একেবারেই না থাকা সত্ত্বেও যারা নিজেদের সঙ্গতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, এসো আমরা সেই সব প্রাণীর কাছে দাঁডাই। প্রতীক্ষা ওদের জন্য মাথাঘোরানো এক অনিদ্রা খুঁড়তে থাকে। সৌন্দর্য্য ওদের পরিয়ে দেয় ফুলের একটা টুপি।

পাখিরা, তোমরা যারা তোমাদের তণিমা, তোমাদের বিপজ্জনক ঘুম অর্পণ কর এক শরবনে, শীত এলে আমরা কেমন তোমাদের মতোই হয়ে যাই।

আমি ভালোবাসি যেসব হাত ভরে দেয়, আর, যুক্ত হওয়ার জন্য, মিলিত হওয়ার জন্য যে আঙুল পাশার অক্ষকে প্রত্যাখ্যান করে।

বারবার আমার মনে হয় যে, আমাদের অস্তিত্বেপ্রবাহকে ধরে ফেলাটা দুঃসাধ্য, যেহেতু আমরা শুধুমাত্র তার খেয়ালি ক্ষমতার ফল ভোগ করি তা নয়, তবু যেখানে গেলে আমরা খুসি হব হাত আর পায়ের অনায়াস গতি আমাদের নিয়ে যাবে সেখানে সেই আকাঙ্ক্ষিত তটভূমিতে, বহুতর ভালোবাসার সন্নিধানে, যার বৈচিত্র্য আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলবে; ঐ গতি অসমাপ্ত থেকে যায়, দ্রুত ছবির আকার পেয়ে শেষ হয়ে যায়, আমাদের চিন্তার ওপর সুগন্ধির একটি বড়ির মত।

আকাঙ্ক্ষা, কী যে আকাঙ্ক্ষা , পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসে যারা আমাদের দীপ্তিময় করে তোলে সেই সব অদৃশ্য শৃঙ্খল, অদৃশ্য অগ্নিশিখার যথার্থ সংমিশ্রণ কিছু স্বাধিকার ছাড়া আমাদের অন্ধকার থেকে আর কিছুই আমরা পাই না।

সৌন্দর্য একাকী তার মহিমাময় শয্যা রচনা করে, অদ্ভুতভাবে তার খ্যাতি গড়ে তোলে মানুষের মধ্যে, তাদেরই পাশে অথচ একান্তে।

এসো আমাদের অন্তরের ক্ষতগুলির ধারে, পাহাড়ে পাহাড়ে বপন করি শরবন, গড়ে তুলি আঙুর খেত। নিষ্টুর আঙুল, সতর্ক হাত, এই রঙ্গভূমিটাই হলো উপযুক্ত।

যে আবিষ্কার করে তারই বিপরীতে যে উদ্ভাবন করে, একটা লৌহমণ্ড, মাঝামাঝি কিছু জিনিশ, কয়েকটা মুখোস ছাড়া আর কিছুই সে বস্তুতালিকায় যোগ করে না, আর কিছুই সে এনে দেয় না প্রাণীদের কাছে।

অবশেষে সারাটা জীবন, যখন তোমার গভীরে ভালোবাসার সত্য থেকে ছিনিয়ে নিই মাধুর্য।

মেঘের কাছাকাছি থাকো। সজাগ থাকো হাতিয়ারের পাশে। প্রতিটি বীজ ঘৃণিত।

মানুষের হিতৈষিতা কোনো কোনো তীব্র ভোরবেলা। প্রলাপী হাওয়ার জটলায়, আমি ওপরে উঠে যাই, বন্দী করি নিজেকে, ভুক্ত কীট, অনুসৃত এবং অনুসারী।

কঠিন আকার, ঐ জলরাশির মুখোমুখি, যে পথ ধরে চলে যায় ছড়িয়ে পড়া তোড়ায় সবুজ পর্বতের তাবৎ ফুল, প্রহরগুলি দেবতাদের সঙ্গে পরিণয়বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

সতেজ সুর্য, আমি তার বল্লরী।

উদভাবকেরা

এরা এল, আরেক উৎরাই থেকে বনরক্ষীরা, আমাদের অচেনা, আমাদের

আচারআচরণের বিরোধী।

ওরা এল অগণন।

এরই মধ্যে জলে ভেজা আর সবুজ পুরনো ফসলের খেত

আর দেবদারু গাছগুলির সীমারেখায় ওদের দলকে দেখা গেল।

দীর্ঘ পদযাত্রা ওদের উত্তপ্ত করে তুলেছিল।

ওদের টুপিগুলো চোখের ওপর এলিয়ে পড়েছিল আর ওদের শ্রান্ত পা

পড়ছিল এলোপাথাড়ি।

আমাদের দেখতে পেয়ে ওরা থামল।

বোঝা যায় ওরা ভাবতে পারে নি যে ওখানে আমাদের দেখতে পাবে,

অনায়াস ভূমি আর লাঙলের ঘনসংবদ্ধ রেখার ওপর,

দর্শকদের প্রতি একেবারে ভ্রূক্ষেপহীন।

আমরা মাথা তুলে ওদের উত্সাহ দিলাম।

সবচেয়ে বাকপটু লোকটা কাছে এগিয়ে এল, তারপর দ্বিতীয় একজন ঠিক তেমনই ছিন্নমূল

আর মন্থরগতি

তোমাদের চিরশত্রু, ঘুর্ণিঝড়ের আসন্ন আবির্ভাবের খবর তোমাদের জানাতে

আমরা এসেছি, বলল ওরা।

পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া বর্ণণা আর নানান বিবরণ ছাড়া আর কোনভাবেই তাকে

তোমাদের চেয়ে ভালোভাবে আমরা চিনি না।

তবু তোমাদের সামনে কেন যে আমরা অবোধ্যভাবে উল্লসিত আর হঠাৎ

শিশুদের মতো?

ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা ওদের বিদায় দিলাম।

তবে তার আগে, ওরা মদ খেল, আর ওদের হাত কাঁপতে লাগল, আর ওদের

চোখ গেলাসের কানায় হাসতে থাকল।

কুঠার আর গাছের মানুষগুলি, কোনো একটা আতংকের মুখোমুখি হতে ওরা

সক্ষম, কিন্তু জলস্রোতকে বইয়ে নিয়ে যেতে, ঘরবাড়ির সারি গড়ে

তুলতে কি তাতে মনভোলানো রঙের আস্তর লাগাতে অপারগ।

শীতের বাগান আর আনন্দের সঞ্চয় ওদের অজ্ঞাত।

অব্শ্যই আমরা ওদের বুঝিয়ে বশ করতে পারতাম।

কেননা ঘুর্ণিঝড়ের আশঙ্কা মর্মম্পর্শী।

হ্যাঁ, অবিলম্বে ঘুর্ণিঝড় আসছে ;

তবে তার কথা বলে ভবিষ্যতের শান্তি নষ্ট করার কি তেমন কোনো দরকার ছিল?

যেখানে আমাদের বসতি সেখানে কোনো জরুরি ভয় নেই।

গিয়োম আপলিনের কবিতা অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত Guillaume Apollinaire Poèmes Traduction en bengali : Pushkar Dasgupta Guillaume Apollinaire Poems Translated into Bengali: Pushkar Dasgupta

Guillaume Apollinaire Poèmes Traduction en bengali : Pushkar Dasgupta গিয়োম আপলিনের কবিতা অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত Guillaume Apollinaire Poems Translated into Bengali: Pushkar Dasgupta.

Deux poèmes de René Char, traduits en bengali par Pushkar Dasgupta / René Char: Two poems, translated into Bengali by Pushkar Dasgupta /রনে শার  :দুটি কবিতা:অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত।

রনে শার (René Char, ১৯০৭১৯৮৮)এর দুটি কবিতা

অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত

গ্রন্থাগারে আগুন

ওই কামানের মুখ থেকে তুষারপাত। আমাদের মাথার ভেতরে ছিল নরক। ঠিক ওই একই মুহূর্তে আমাদের আঙুলের ডগায় বসন্তকাল । আবার অনুমতি পাওয়া পদচিহ্ন, প্রেমে পড়া পৃথিবী, প্রাণোচ্ছল তৃণদল।

সব কিছুরই মতো অস্তরাত্মাও কেঁপে উঠল।

ঈগল ভবিষ্যতের গর্তে।

অন্তরাত্মার অজ্ঞাতেই যে তাকে প্রবর্তনা দেয় এমন প্রতিটি কর্মের উপসংহার হিসেবে থাকবে কোনো একটা অনুতাপ কি বেদনা। তাকে মেনে নিতে হবে।

কীভাবে আমার কাছে লেখা এলো? শীতে, আমার জানলার শার্সির কাচে একটা পালকের মতো। অমনি ঘরের অগ্নিকুণ্ডে বেধে গেল জলন্ত কাঠের টুকরোগুলোর লড়াই, যা এখন অব্দি সাঙ্গ হয় নি।

আরো সব শহরের মধ্যে বসিয়ে দেওয়া, শুধু আমাদেরই পায়ে পায়ে চিহ্নিত পথ ওয়ালা আমাদের মনোযোগে সাড়া দেওয়া বিদ্যুচ্চমকের ডানার তলায়, রেশমের মতো মোলায়েম আটপৌরে চাউনির সহরগুলি।

যা আমরা আগে থেকে কখনো ভাবি নি, যা আমরা পরিস্ফুট করি না, যা কেবল তার নিজস্ব উপায়ে আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চলেছে এমন একটা কিছু যখন ঘটবে আমাদের ভেতরে সবকিছুকেই তখন শুধু একটা উল্লসিত উৎসবের পরিণতি লাভ করতে হবে।

এসো গভীরতা মাপার তার ফেলে যাই, গুচ্ছ গুচ্ছ শব্দের ব্যবহারে কথা বলে যাই একই পর্দায়, শেষ অব্দি আমরা স্তব্ধ করে দেবো ঐ কুকুরগুলোকে, যাতে করে ধোঁয়াটে একটা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে ওরা মাঠের ঘাসের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, যখন হাওয়া মুছে দেবে ওদের পিঠ।

বিদ্যুচ্চমক আমার মধ্যে অব্যাহত ।

শুধু রয়েছে আমার সমধর্মী, সঙ্গিনী বা সঙ্গী যে আমাকে জড়তা থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে, করতে পারে কবিতার উদ্বোধন, আমায় ছুঁড়ে দিতে পারে পুরনো মরুভূমির সীমানার পাঁচিলগুলোর গায়ে , যাতে করে আমি তাদের পরাস্ত করতে পারি। আর কেউ নয়। না স্বর্গ, না বিশেষ সুবিধেভোগী মর্ত্য, না আতঙ্কে শিউরে তোলা কিছু — এর কোনোটাই নয়।

মশাল, আমার সমধর্মী ছাড়া আর কারো সঙ্গে আমি নাচি না।

জগৎ আর নিজের সম্পর্কে সামান্য একটু ভ্রান্তি ছাড়া, প্রথম শব্দগুলি সম্পর্কে একটুকরো অজ্ঞতা ছাড়া কোনো একটা কবিতা শুরু করা যায় না।

কবিতায় প্রত্যেকটি বা প্রায় সবগুলো শব্দকে তার আদি অর্থে ব্যবহৃত হতে হবে। বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু শব্দ হয়ে ওঠে বহুযোজী। কোনো কোনোটি স্মৃতিভ্রষ্ট। প্রসারিত অনন্য হীরকখণ্ডের মণ্ডলী।

আমার কাছ থেকে কবিতা আমার মৃত্যুকে ছিনিয়ে নেবে।

কেনইবা বিচূর্ণ কবিতা? কারণ দেশের অভিমুখে যাত্রার শেষে জন্মের আগের অন্ধকার আর পার্থিব কঠোরতার পর, কবিতার সমাপ্তিই আলোক, জীবনের কাছে জীবের অবদান।

কবি যা আবিষ্কার করে তাকে সে নিজের অধিকারে রেখে দেয় না; লিপিবদ্ধ করে অবিলম্বে তাকে হারিয়ে ফেলে। ওরই মধ্যে নিহিত থাকে তার নতুনত্ব, তার অন্তহীনতা আর তার ধ্বংস।

আমার পেশা হল যথার্থ দক্ষতার।

জন্ম হয় মানুষের সঙ্গে, দেবতাদের মধ্যে ঘটে সান্ত্বনাহীন মৃত্যু।

যে মাটি বীজ ধারণ করে সে বিমর্ষ। এত যার বিপদের সম্ভাবনা সেই বীজ আনন্দিত।

আর কোনো অভিশাপের মতো নয় এমনই এক অভিশাপ । এক ধরনের আলস্যে সে চোখ পিটপিট করে, মন ভোলানো তার স্বভাব, মুখের ভঙ্গি আশাপ্রদ। অথচ ভানটা কেটে গেলে, সে কী উদ্দীপনা, অবিলম্বে লক্ষ্যের অভিমুখে সে কী গতি। যে ছায়ায় সে ভারা বাঁধে তা অশুভ, একেবারে গোপন অঞ্চল, হয়ত কোনো এক আহবান থেকে সে অব্যাহতি পাবে, চিরকাল সময় মতো ঠিক সরে পড়বে । কয়েকজন দ্রষ্টার আকাশের ঘোমটার মধ্যে সে বেশ ভয়াবহ কিছু অধিবৃত্ত এঁকে ফেলে।

গতিহীন বইগুলো। অথচ যেসব বই আমাদের জীবনের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে, সেখানে আর্তনাদ করে ওঠে, শুরু করে যুগল নৃত্য।

কেমন করে বলা যায় আমার স্বাধীনতার কথা, আমার বিস্ময়, হাজার বাঁকের শেষেঃ সেখানে কোন ভিৎ নেই, নেই কোন চাল।

বারবার একটি অশ্বশাবকের, দূরবর্তী কোন এক শিশুর ছায়ামূর্তি গুপ্তচরের মতো আমার কপালের দিকে এগিয়ে আসে আর লাফিয়ে ডিঙিয়ে যায় আমার দুশ্চিন্তার বেড়া। তখন গাছের তলায় ঝর্ণা আবার কথা বলতে থাকে।

যে নারীরা আমাদের ভালোবাসে তাদের ঔৎসুক্যের কাছে আমরা অপরিচিত থাকতে চাই। আমরা তাদের ভালোবাসি।

আলোর একটা বয়স আছে। অন্ধকারের তা নেই। তবে কখন ছিল এই সম্পূর্ণ প্রস্রবণের লগ্ন ?

ঝুলন্ত আর যেনবা তুষারে ঢাকা কয়েকটা মৃত্যুর দরকার নেই। মজবুত একটি হলেই হোল। আর তা পুনরুত্থানহীন।

পিছু হটার উপায় এতটুকু বা একেবারেই না থাকা সত্ত্বেও যারা নিজেদের সঙ্গতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, এসো আমরা সেই সব প্রাণীর কাছে দাঁডাই। প্রতীক্ষা ওদের জন্য মাথাঘোরানো এক অনিদ্রা খুঁড়তে থাকে। সৌন্দর্য্য ওদের পরিয়ে দেয় ফুলের একটা টুপি।

পাখিরা, তোমরা যারা তোমাদের তণিমা, তোমাদের বিপজ্জনক ঘুম অর্পণ কর এক শরবনে, শীত এলে আমরা কেমন তোমাদের মতোই হয়ে যাই।

আমি ভালোবাসি যেসব হাত ভরে দেয়, আর, যুক্ত হওয়ার জন্য, মিলিত হওয়ার জন্য যে আঙুল পাশার অক্ষকে প্রত্যাখ্যান করে।

বারবার আমার মনে হয় যে, আমাদের অস্তিত্বেপ্রবাহকে ধরে ফেলাটা দুঃসাধ্য, যেহেতু আমরা শুধুমাত্র তার খেয়ালি ক্ষমতার ফল ভোগ করি তা নয়, তবু যেখানে গেলে আমরা খুসি হব হাত আর পায়ের অনায়াস গতি আমাদের নিয়ে যাবে সেখানে সেই আকাঙ্ক্ষিত তটভূমিতে, বহুতর ভালোবাসার সন্নিধানে, যার বৈচিত্র্য আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলবে; ঐ গতি অসমাপ্ত থেকে যায়, দ্রুত ছবির আকার পেয়ে শেষ হয়ে যায়, আমাদের চিন্তার ওপর সুগন্ধির একটি বড়ির মত।

আকাঙ্ক্ষা, কী যে আকাঙ্ক্ষা , পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসে যারা আমাদের দীপ্তিময় করে তোলে সেই সব অদৃশ্য শৃঙ্খল, অদৃশ্য অগ্নিশিখার যথার্থ সংমিশ্রণ কিছু স্বাধিকার ছাড়া আমাদের অন্ধকার থেকে আর কিছুই আমরা পাই না।

সৌন্দর্য একাকী তার মহিমাময় শয্যা রচনা করে, অদ্ভুতভাবে তার খ্যাতি গড়ে তোলে মানুষের মধ্যে, তাদেরই পাশে অথচ একান্তে।

এসো আমাদের অন্তরের ক্ষতগুলির ধারে, পাহাড়ে পাহাড়ে বপন করি শরবন, গড়ে তুলি আঙুর খেত। নিষ্টুর আঙুল, সতর্ক হাত, এই রঙ্গভূমিটাই হলো উপযুক্ত।

যে আবিষ্কার করে তারই বিপরীতে যে উদ্ভাবন করে, একটা লৌহমণ্ড, মাঝামাঝি কিছু জিনিশ, কয়েকটা মুখোস ছাড়া আর কিছুই সে বস্তুতালিকায় যোগ করে না, আর কিছুই সে এনে দেয় না প্রাণীদের কাছে।

অবশেষে সারাটা জীবন, যখন তোমার গভীরে ভালোবাসার সত্য থেকে ছিনিয়ে নিই মাধুর্য।

মেঘের কাছাকাছি থাকো। সজাগ থাকো হাতিয়ারের পাশে। প্রতিটি বীজ ঘৃণিত।

মানুষের হিতৈষিতা কোনো কোনো তীব্র ভোরবেলা। প্রলাপী হাওয়ার জটলায়, আমি ওপরে উঠে যাই, বন্দী করি নিজেকে, ভুক্ত কীট, অনুসৃত এবং অনুসারী।

কঠিন আকার, ঐ জলরাশির মুখোমুখি, যে পথ ধরে চলে যায় ছড়িয়ে পড়া তোড়ায় সবুজ পর্বতের তাবৎ ফুল, প্রহরগুলি দেবতাদের সঙ্গে পরিণয়বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

সতেজ সুর্য, আমি তার বল্লরী।

উদ্ভাবকেরা

এরা এল, আরেক উৎরাই থেকে বনরক্ষীরা, আমাদের         অচেনা, আমাদের  আচারআচরণের বিরোধী।

ওরা এল অগণন।

এরই মধ্যে জলে ভেজা আর সবুজ পুরনো ফসলের খেত

আর দেবদারু গাছগুলির সীমারেখায় ওদের দলকে দেখা গেল।

দীর্ঘ পদযাত্রা ওদের উত্তপ্ত করে তুলেছিল।

ওদের টুপিগুলো চোখের ওপর এলিয়ে পড়েছিল আর ওদের শ্রান্ত পা

পড়ছিল এলোপাথাড়ি।

আমাদের দেখতে পেয়ে ওরা থামল।

বোঝা যায় ওরা ভাবতে পারে নি যে ওখানে আমাদের দেখতে পাবে,

অনায়াস ভূমি আর লাঙলের ঘনসংবদ্ধ রেখার ওপর,

দর্শকদের প্রতি একেবারে ভ্রূক্ষেপহীন।

আমরা মাথা তুলে ওদের উত্সাহ দিলাম।

সবচেয়ে বাকপটু লোকটা কাছে এগিয়ে এল, তারপর দ্বিতীয় একজন ঠিক তেমনই ছিন্নমূল

আর মন্থরগতি

তোমাদের চিরশত্রু, ঘুর্ণিঝড়ের আসন্ন আবির্ভাবের খবর তোমাদের জানাতে

আমরা এসেছি, বলল ওরা।

পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া বর্ণণা আর নানান বিবরণ ছাড়া আর কোনভাবেই তাকে

তোমাদের চেয়ে ভালোভাবে আমরা চিনি না।

তবু তোমাদের সামনে কেন যে আমরা অবোধ্যভাবে উল্লসিত আর হঠা

শিশুদের মতো?

ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা ওদের বিদায় দিলাম।

তবে তার আগে, ওরা মদ খেল, আর ওদের হাত কাঁপতে লাগল, আর ওদের

চোখ গেলাসের কানায় হাসতে থাকল।

কুঠার আর গাছের মানুষগুলি, কোনো একটা আতংকের মুখোমুখি হতে ওরা

সক্ষম, কিন্তু জলস্রোতকে বইয়ে নিয়ে যেতে, ঘরবাড়ির সারি গড়ে

তুলতে কি তাতে মনভোলানো রঙের আস্তর লাগাতে অপারগ।

শীতের বাগান আর আনন্দের সঞ্চয় ওদের অজ্ঞাত।

অব্শ্যই আমরা ওদের বুঝিয়ে বশ করতে পারতাম।

কেননা ঘুর্ণিঝড়ের আশঙ্কা মর্মম্পর্শী।

হ্যাঁ, অবিলম্বে ঘুর্ণিঝড় আসছে ;

তবে তার কথা বলে ভবিষ্যতের শান্তি নষ্ট করার কি তেমন কোনো দরকার ছিল?

যেখানে আমাদের বসতি সেখানে কোনো জরুরি ভয় নেই।

Guillaume Apollinaire Poèmes Traduction en bengali : Pushkar Dasgupta গিয়োম আপলিনের কবিতা অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত Guillaume Apollinaire Poems Translated into Bengali: Pushkar Dasgupta

APOLLINAIRE

গিয়োম আপলিনের (১৮৮০১৯১৮)

[এখানে টীকাসহ আপলিনেরএর যে কবিতাগুলির অনুবাদ উপস্থাপিত হয়েছে সেগুলি পুষ্কর দাশগুপ্তের আপলিনেরএর কবিতা(দ্বিতীয় সংস্করণ) বই থেকে নেওয়া।]

বিশ শতকের প্রথম থেকে ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ আর তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত চিন্তা ও ভাবাদর্শের জগতে দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই নতুন পরিস্থিতির সামাজিকঐতিহাসিক প্রথম মহাযুদ্ধ, রুশবিপ্লব, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ইত্যাদি। ইয়োরোপীয় শিল্পকলার জগতে এই ক্রান্তির প্রথম প্রকাশ ঘটে চিত্রকলার জগতে ফোভিসম্ (. Fauvisme, ইং. Fauvism), ক্যুবিজম্ (. Cubisme, ইং. Cubism ), সাহিত্যের জগতে নাত্যুরিসম (. Naturisme, ইং. Naturism), য়্যুনানিমজম (. Unanimisme, ইং. Unanimism ), দ্রামাতিসম্ (. Dramatisme, ইং. Dramatism), র্তিসিজম (ইং. Vorticism) ইত্যাদি আন্দোলনের অস্থির সন্ধানের মধ্যে। এর পর পরিবর্তনের প্রবণতার চরমপন্থী বিস্ফোরক প্রকাশ ঘটে ফিউচারিজম (ইং. Futurism, ইতা.ফুতুরিস্মো/Futurismo, . ফ্যুতিরিরসম/Futurisme) ও দাদা (Dada) আন্দোলনে।

ফরাসি কবিতায় বিশ শতকের পরিবতর্নের চরিত্র ও বিভিন্ন প্রবণতা প্রথম স্পষ্টভাবে অঙ্গীকৃত হয়েছে গিয়োম আপলিনের ও ব্লেজ সঁদ্রারের কবিতায়। এ দুজনের মধ্যে আমাদের বিচারে কবি হিসেবে ব্লেজ সঁদ্রার বিপ্লবী চরিত্রের, কবিতার জগতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রথাবিরোধী। সাহিত্যগোষ্ঠী, আন্দোলন ইত্যাদি চিহ্নিতকরণের তাবৎ সীমানার বাইরে থেকে সত্যিকারের নতুন কিছু কবিতা লিখে কবিতার জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। অন্যদিকে আপলিনেরএর কাব্যকৃতিতে বিবতর্নের চরিত্র স্পষ্ট । শেষ অব্দি আপলিনের তাঁর কবিতায় পুরনোকে নতুনের আধারে মিশিয়ে দিয়েছেন আর নতুনকে পুরনোর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন । বস্তুত আধুনিক ফরাসি কবিতার ইতিহাসে আপলিনেরএর কাব্যসৃষ্টি সেই সংযোগক্ষেত্র যেখানে অনেক পুরনো রাস্তা শেষ হয়েছে আর যেখান থেকে শুরু হয়েছে অনেক নতুন পথ।

আপলিনের সম্পর্কে:

On peut dire que le grand poète que fut Apollinaire a mis fin à l’ère des « poètes maudits ». Avec lui commence celle de « la poésie conquérante ». Tout est conquête dans ce vaste domaine où la poésie est constante invention, comme désormais il ne s’agira plus vivre sa vie, mais de l’inventer à chaque instant. ―Tristan Tzara

[ বলা যায় বিরাট কবি হিসেবে আপলিনের ‘অভিশপ্ত কবিদের’ যুগের অবসান ঘটিয়েছেন। তাঁর রচনাতেই শুরু হয়েছে ‘বিজয়ী কবিতার’ যুগ। বিশাল এই ক্ষেত্রে সব কিছুই হল বিজয় যেখানে কবিতা হল নিরন্তর উদ্ভাবন। যেন এর পর থেকে জীবন যাপন করা বলা যাবে না, বরং বলতে হবে প্রতি মুহূর্তে জীবনকে আবিস্কার করা। — ―ত্রিস্তঁ জারা।]

আপলিনের থেকে:

তাঁর কাব্যগ্রন্থ সুরাসার(Alcools) সম্পর্কে আপলিনের একটি চিঠিতে (৩০ এপ্রিল ১৯১৪) যেকথা লিখেছিলেন তা তাঁর সমস্ত কাব্যসৃষ্টি সম্পর্কে প্রযোজ্য:

vous le classerez dans l’école poétique qui vous plaira, je ne prétends faire partie d’aucune, mais il n’en est également aucune à laquelle je ne sente pas un peu attaché.

[বইটাকে তোমরা তোমাদের খুশিমতো কবিতার যেকোনো একটা প্রস্থানে স্থান দিতে পার, আমি নিজেকে কোনো একটা বিশেষ প্রস্থানের অন্তর্ভুক্ত বলে ভাবি না, আবার এমন কোনো প্রস্থান নেই যার সঙ্গে আমি কিছুটা সম্পর্ক বোধ করি না।]

গিয়োম আপলিনেরএর ‘নতুন মানসিকতা আর কবিরা’ (Guillaume Apollinaire : L’esprit nouveau et les poètes) থেকে:

Les artifices typographiques poussés très loin avec une grande audace ont l’avantage de faire naître un lyrisme visuel qui était presque inconnu avant notre époque. Ces artifices peuvent aller très loin encore et consommer la synthèse des arts, de la musique, de la peinture et de la littérature.

[দারুণ সাহসে বহুদূর অব্দি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মুদ্রণলিপির তাবৎ কৌশলের মধ্যে রয়েছে আমাদের আগে প্রায় অজ্ঞাত দৃষ্টিগ্রাহ্য একটা গীতিময়তার জন্ম দেওয়ার সুযোগ ৷ এসব কৌশল আরো অনেক দূরে এগিয়ে গিয়ে বিভিন্ন শিল্পকলা, সঙ্গীত, চিত্রকলা আর সাহিত্যের সংশ্লেষণ ঘটাতে পারে ৷]

L’esprit nouveau est… dans la surprise. C’est ce qu’il y a en lui de plus vivant, de plus neuf. La surprise est le grand ressort nouveau. C’est par la surprise, par la place importante qu’il fait à la surprise que l’esprit nouveau se distingue de tous les mouvements artistiques et littéraires qui l’ont precedé.

[নতুন মানিসকতা রয়েছেবিস্ময়ের মধ্যে ৷ নতুন মানিসকতার মধ্যে এটাই হল গিয়ে সবচেয়ে জীবন্ত, সবচেয়ে আনকোরা নতুন ৷ বিস্ময় হল নতুন এক বিরাট প্রেরণা ৷ বিস্ময়ের জন্যই, বিস্ময়কে যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান সে দেয় তার জন্যই নতুন মানিসকতা তার আগের তাবৎ শিল্প আর সাহিত্যের আন্দোলন থেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত ৷]

L’esprit nouveau est avant tout ennemi de l’esthétisme, des formules et de tout snobisme. Il ne lutte point contre quelque école que ce soit, car il ne veut pas être une école, mais un des grands courants de la littérature englobant toutes les écoles, depuis le symbolisme et le naturisme.

[নতুন মানসিকতা সবকিছুর আগে নান্দনিকতা,বাঁধা গতের ফর্মুলা আর তাবৎ উন্নাসিকতার শত্রু । এই নতুন মানসিকতা বিশেষ কোনো প্রস্থানের বিরুদ্ধে লড়াই করে না, কেননা তা নিজে কোনো প্রস্থান হতে চায় না, প্রতীকিবাদ থেকে প্রকৃতিবাদ সমস্ত প্রস্থানকে আত্মস্থ করে নতুন মানসিকতা হয়ে উঠতে চায় সাহিত্যের বিরাট একটা ধারা ৷]

গিয়োম আপলিনের তাঁর ‘তিরেজিয়াসএর স্তন’ (Guillaume Apollinaire: Les Mamelles de Tirésias) নাটকের ভূমিকায় তাঁর উদ্ভাবিত পরাবাস্তবতা(surréalisme) ও ‘পরাবাস্তব’ (surréaliste) শব্দদুটি প্রথম ব্যবহার করেন :

Pour caractériser mon drame je me suis servi d’un néologisme qu’on me pardonnera car cela m’arrive rarement et j’ai forgé l’adjectif surréaliste qui ne signifie pas du tout symbolique…Quand l’homme a voulu imiter la marche, il a créé la roue qui ne ressemble 

pas à une jambe. Il a fait ainsi du surréalisme sans le savoir.

[আমার নাটকটির চরিত্র নিদের্শ করার জন্য আমি একটা নতুন শব্দ ব্যবহার করেছি, এর জন্য লোকে আমাকে ক্ষমা করবেন কেননা আমি তা প্রায় করি না বললেই হয় আর আমি পরাবাস্তব (স্যুররেআলিস্ত/surréaliste) এই বিশেষণটা তৈরি করেছি যার মানে কোনোক্রমেই প্রতীকি নয়মানুষ যখন হাঁটার ব্যপারটাকে অনুকরণ করতে চাইল তখন সে সৃষ্টি করল চাকা যা দেখতে একটা পায়ের মতো নয় ৷ এভাবে সে না জেনে যা করেছে তাই হল পরাবাস্তবতা।]

গিয়োম আপলিনের

এলাকা (Zone)

অবশেষে সেকেলে এই জগত্টা ক্লান্ত করছে তোমাকে

মেষপালক হে আইফেল টাওয়ার আজ ভোরে সেতুর পাল ব্যা ব্যা করে ডাকে

গ্রিস আর রোমের প্রাচীন সভ্যতায় বেঁচে থাকতে থাকতে তুমি ক্লান্ত

এখানে মোটরগাড়িগুলোর চোহারা অব্দি কেমন যেন সেকেলে হয়ে গেছে

শুধু ধর্মই একমাত্র আনকোরা নতুন থেকে গেছে শুধু একমাত্র ধর্মই

সাদাসিধে থেকে গেছে বিমানবন্দরের হ্যাঙারের মতোই

খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপে তুমিই কেবল পুরনো হয়ে যাওনি

পোপ দশম পাইয়াস সবচেয়ে আধুনিক ইয়োরোপীয় হলেন আপনিই

আর জানলাগুলো সব তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বলে লজ্জার পিছুটানে তুমি কিছুতেই

আজ সকালে পাপ স্বীকার করতে পারছ না ঢুকে পড়ে কোনো একটা গির্জেয়

তুমি পড়ে যাচ্ছ দরাজ গলায় যারা গান করে সেই প্রসপেকটাস ক্যাটালগ আর পোস্টার

আজ সকালে এই হল কবিতা আর খবরের কাগজে রয়েছে গদ্যের সম্ভার

আছে ২৫ পয়সার বেসাতি গোয়েন্দাগল্পে ঠাসা

বড় বড় মানুষের জীবনী আর হাজার শিরোনাম খাসা

আজ সকালে সুন্দর একটা রাস্তা আমি দেখেছি তার নামটা আমার মনে নেই

যেন একটা তূর্য সূর্যের আলোয় ঝকঝকে আর নতুন একেবারেই

বড়সাহেব মজুর আর সুন্দরী স্টেনোটাইপিস্টরা সবাই

সোমবার সকাল থেকে শনিবার সন্ধে অব্দি দিনে চারবার করে ঐ পথ দিয়ে আসে যায়

সকালে তিন তিনবার ওখানে সাইরেন ওঠে গুমরে

দুপুরে বারোটা নাগাদ গির্জের খেপে যাওয়া একটা ঘন্টা ঘেউ ঘেউ করে

সাইনবোর্ড আর পাঁচিলের গায়ে লেখা যত ফলক আর বিজ্ঞাপন

চেঁচাতে থাকে একপাল টিয়ে পাখির মতন

.ব্যু ওমঁতিয়েভিল আর আভন্যু দে তের্নএর মাঝামাঝি প্যারিসের

কলকারখানায় ভরা ঐ রাস্তাটাকে আমার বড় ভালো লাগে

ঐ তো কমবয়সি একটি রাস্তা আর তুমি তো কেবল একটা শিশু তখনো

তোমার মা তোমাকে নীল আর সাদা রঙের জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই পরান না কখনো

ধর্মে তোমার খুবই ভক্তি আর তোমার সঙ্গে তোমার সবচেয়ে পুরনো বন্ধু রনে দালিজের

গির্জের জাঁকজমকের মতো আর কিছুই অতটা ভালো লাগে না তোমাদের

নটা বাজে কমিয়ে দেওয়া গ্যাসের আলোটা একেবারে নীল তোমরা চুপি চুপি বেরিয়ে পড়

শোয়ার ঘর ছেড়ে

রাতভর তোমরা প্রার্থনা কর স্কুলের উপাসনাঘরে

অপরূপ এক গভীরতা নীলকান্তমণির আভা আর চিরন্তন

খ্রিস্টের দীপ্ত মহিমা ঘুরতে থাকে অনুক্ষণ

এই তো সেই স্থলপদ্ম যাকে ফুটিয়ে তুলি আমরা সবাই

এই তো সেই লালচুল মশাল যা কখনো নিভে যায় না হাওয়ায়

এই তো সেই যান্ত্রণাকাতর মায়ের সিঁদুরেরঙ ছেলে

এই তো সেই গাছ প্রার্থনার ভারে যা চিরতরে পড়েছে হেলে

এই তো সেই গৌরব আর অমরতার যুগল ফাঁসিকাঠ

এই তো সেই ছটি জ্যোতির তারা আর

এই তো সেই ঈশ্বর যিনি শুক্রবার মারা গিয়ে পুনর্জীবন পান রবিবার

এই তো সেই খ্রিস্ট যিনি বিমানচালকদের চেয়েও নিপুণভাবে আকাশে ওড়েন

উচ্চতার এক তুলনাহীন বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেন

চোখের খ্রিস্টমণি

শতাব্দীর বিংশতি মণি তার জানা রয়েছে কী করতে হয় কী করে

আর এই শতাব্দী জিশুর মত শূন্যে উঠে যায় পাখির রূপ ধরে

পাতালের শয়তানেরা ওকে দেখবে বলে মাথা তোলে

ও জুডিয়ার সাইমন গুণিনের নকল করছে তারা সবাই বলে

তারা চেঁচাতে থাকে ও যদি উড়তে পারে তবে চোর বলে ডাকা হোক ওকে

দেবদূতেরা সব উড়ে বেড়ায় সুন্দর ঐ উডুক্কু ভবঘুরের চারদিকে

ইকারুস, ইনক, ইলাইজা, আপলোনিয়ুস দ তিয়ান

প্রথম উড়োজাহাজকে ঘিরে সবাই তাঁরা ভেসে বেড়ান

পবিত্র রূপান্তরের উত্সব যাঁদের বয়ে নিয়ে যায় তাঁদের ওঁরা মাঝে পথ ছেড়ে দেন

সেই সব পুরোহিতদের যাঁরা চিরতরে পবিত্র অর্ঘ্য তুলে ধরেন

অবশেষে বিমানপোত ডানা না গুটিয়েই বসে পড়ে স্থির হয়ে

আকাশ তখন লক্ষ লক্ষ বাবুই পাখিতে যায় ছেয়ে

অবিরত ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে আসে যত বাজ পেঁচা কাক

আফ্রিকা থেকে এসে পড়ে সারস ফ্ল্যামিংগো আর মারাবুর ঝাঁক

কথাকার আর কবিরা যার গুণগান করেছেন সেই রক পাখি ভেসে বেড়ায়

আদি মানব আদমের করোটি ধরে থাকে থাবায়

তীব্র আর্তনাদে দিগন্ত থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঈগল

আমেরিকা থেকে হাজির হয় খুদে হামিংবার্ডের দল

লম্বা আর তুলতুলে যত পিহিপাখি চিনদেশ থেকে এসে যায়

একটিমাত্র তাদের ডানা তারা উড়ে বেড়ায় জোড়ায় জোড়ায়

তারপর ঐ তো নিষ্পাপহৃদয় কপোতকে পথ দেখিয়ে

লায়ার পাখি আর চাকা চাকা দাগওয়ালা ময়ুর সঙ্গে এল নিয়ে

ঐ তো জ্বলন্ত চিতা ফিনিক্স নিজে নিজেই সে জন্ম নেয়

মুহূর্তের জন্য তার ছাইয়ে সব কিছু ঢেকে দেয়

ভয়ংকর প্রণালী থেকে মত্স্যকন্যারা

গান গাইতে গাইতে উঠে আসে তিন তিনজনে তারা

আর ঈগল ফিনিক্স চিনের পিহিরা সবাই

উড়ন্ত যন্ত্রটার সঙ্গে ভাব করে গলায় গলায়

একা একা তুমি হাঁটছ প্যারিসের ভিড়ে

তোমার পাশ দিয়ে পালে পালে বাস বেরিয়ে যাচ্ছে ডাক ছেড়ে

ভালোবাসার যন্ত্রণা কণ্ঠনালীকে চেপে ধরেছে তোমার

যেনবা কখনোই তুমি যোগ্য ছিলে না ভালোবাসার

সেকালে বেঁচে থাকলে তুমি বরণ করে নিতে কোনো একটা মঠের জীবন

প্রার্থনার স্তব উচ্চারণ করতে করতে ধরা পড়ে গেলে তোমাদের কিযে লজ্জা হয় এখন

নিজেকে নিয়ে তুমি মজা কর আর তোমার হাসি নরকের আগুনের মত চনমন করতে থাকে

তোমার হাসির ফুলকিগুলো সোনালি করে দেয় তোমার জীবনের গভীরতাকে

অন্ধকার যাদুঘরের দেয়ালে একটি ছবি টাঙানো আছে

আর সেটা দেখার জন্যে মাঝে মাঝে তুমি এগিয়ে যাও তার খুব কাছে

আজ তুমি প্যারিসে হেঁটে চলেছ মেয়েমানুষেরা সব রক্তে রক্তময়

তখন ছিল অথচ আমি কিছুতেই মনে করতে চাইছিলাম না যে তখন ছিল সৌন্দর্যের

বিদায়ের সময়

শার্ত্রএর মেরীমাতা আমার দিকে তাকালেন আগুনের দীপ্ত শিখার ভেতর থেকে

মোঁমার্ত্রএর পবিত্রহৃদয়ের রক্ত ভাসিয়ে দিল আমাকে

পরম সুখের বাণী শুনে শুনে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে আমার

যে ভালোবাসায় আমি ভুগছি সেটা একটা অসুখ নিতান্তই লজ্জার

আর যে ছবিটা তোমার ওপর ভর করেছে তোমাকে তা অনিদ্রা আর উদ্বেগের মধ্যে

রাখে জিইয়ে

আর সব সময় সে ছবিটা চলে যায় তোমার পাশ দিয়ে

এইতো এখন তুমি ভূমধ্যসাগরের কূলে

সেই নেবুগাছের তলায় যে নেবুগাছগুলো সারা বছর ছেয়ে থাকে ফুলে ফুলে

বন্ধুদের সঙ্গে নৌকোয় করে তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছ

একজন হল নিসার, একজনের বাড়ি মঁতোতে আর বাকি দুজন তুরবিয়াস্ক

ভয়ে ভয়ে আমরা অনেক তলার অক্টোপাসগুলোর দিকে তাকাই

আর জলের শ্যাওলার ফাঁকে ফাঁকে ত্রাণকর্তার প্রতিমূর্তি মাছগুলি ঘুরে বেড়ায়

তুমি প্রাগের শহরতলিতে একটা বাগানের ভেতর

নিজেকে তোমার বেজায় সুখী বলে বোধ হচ্ছে একটা গোলাপ তোমার টেবিলের ওপর

গদ্যে তোমার গল্পটা না লিখে

তুমি তাকিয়ে রয়েছে গোলাপের বুকে ঘুমন্ত পোকাটির দিকে

সন্ত ভিৎ গির্জের কষ্টিপাথরে নিজের ছবি আঁকা দেখে ভয়ে তুমি আঁতকে উঠলে

ওখানে নিজেকে দেখতে পেয়ে সত্যি তুমি ভেঙে পড়লে

অনেকটা দিনের আলোয় ভ্যাবাচাকা খাওয়া ল্যাজারাসের মত দেখাচ্ছিল তোমাকে

ইহুদিপাড়ার ঘড়ির কাঁটাগুলো উল্টোদিকে ছুটতে থাকে

হ্রাদচিন প্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সন্ধেবেলায়

তোমার কানে আসে চেকভাষায় গান হচ্ছে সরাইখানায়

সে গান শুনতে শুনতে নিজের জীবনের পথে তুমি পিছিয়ে যেতে থাক ধীরে ধীরে

এইতো তুমি মার্সেইএ চারপাশে গাদা করা যত তরমুজ তোমাকে ঘিরে

এইতো তুমি কোব্লঁসএ দানবনিবাসে

এইতো তুমি রোমে জাপানি চেরিগাছের ছায়ায় বসে

এইতো কমবয়সি একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তুমি আমস্টারডামে তাকে তোমার সুন্দরী

বলে মনে হলেও আসলে সে কদাকার

লেইডের এক ছাত্রের সঙ্গে বিয়ে হবে তার

সেখানে ভাড়া পাওয়া যায় ল্যাটিন সাইনবোর্ড ওয়ালা যত ভাড়ার ঘর

মনা পড়ছে আমি কাটিয়েছিলাম তিন দিন করে সেখানে আর গুডা শহরে পরপর

প্যারিসে তুমি দায়রা জজের আদালতে

আসামির মতন তোমায় ওরা পুরে রেখেছিল হাজতে

বেদনা আর আনন্দের মধ্যে তুমি ঘুরে বেড়িয়েছ দেশদেশান্তরে

মিথ্যে আর বয়সের ভারের উপলব্ধি হয়েছে তোমার আরো পরে

বিশ আর তিরিশ বছর বয়সে তুমি ভোগ করেছ ভালোবাসার দুর্বহ কষ্ট

আমি পাগলের মত জীবন কাটিয়েছি আর বৃথাই সময় করেছি নষ্ট

নিজের হাতের দিকে তাকাতেও তোমার আর ভরসা হয় না আর প্রতি মুহুর্তে যেন

ইচ্ছে করে

তোমার জন্য যে মেয়েটিকে আমি ভালোবাসি ওর জন্য যা কিছু তোমায় আতঙ্কিত করে

তার জন্য কেঁদে উঠি গুমরে গুমরে

জলভরা চোখে তুমি তাকাও ঐ ছন্নছাড়়া দেশত্যাগীদের দিকে

ঈশ্বরে ওদের আস্থা রয়েছে ওরা প্রার্থনা করে মেয়েছেলেরা বাচ্চাদের দুধ দিতে থাকে

নিজেদের গায়ের গন্ধে ওরা ভরে রেখেছে স্যাঁলাজার স্টেশনের হলঘর

বাইবেলের জ্ঞানী রাজাদের মতোই ওদের বিশ্বাস রয়েছে নিজের নিজের নক্ষত্রের ওপর

ওদের আশা আর্জেন্টিনায় গিয়ে ওরা পয়সা রোজগার করবে

তারপর বড়লোক হয়ে নিজের দেশে ফিরে আসবে

একটি পরিবার লাল একটা লেপ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে যেমন তোমরা বয়ে বেড়াও

তোমাদের হৃদয়

ঐ লেপ আর আমাদের স্বপ্ন একইরকম অবাস্তব

ঐ দেশছাড়াদের কেউ কেউ এখানেই থেকে যায়

আর বাসা বাঁধে .ব্যু দে রোজিয়ে আর .ব্যু দেজেকুফএর খুপরিগুলোয়

প্রায় সন্ধেবেলা ওদের আমি দেখি ওরা হাওয়া খেতে বেরোয় রাস্তায়

আর ঠিক যেন সব দাবার ঘুঁটি কখনো সখনো জায়গা পাল্টায়

বিশেষ করে ঐ ইহুদিরা ওদের বাড়ির মেয়েরা পরচুলাপরা মাথায়

ওরা ফ্যাকাশে মতন বসে থাকে দোকানের এক কোণায়

হতচ্ছাড়া একটা শুঁড়িখানায় কাউন্টারের সামনে

তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছে সন্তার কফি গিলছ অভাগাদের মাঝখানে

রাত্রিবেলা তুমি বিরাট একটা রেস্তোরাঁয়

ঐ মেয়েগুলো সবাই বদ নয় তবু অনেক দুশ্চিন্তা ওদের মাথায়

ওরা প্রত্যেকে এমনকী ওদের মধ্যে সবচেয়ে যে কুচ্ছিৎ দেখতে সেও তার প্রেমিককে

ভুগিয়েছে অনেক যন্ত্রণায়

জার্সি দ্বীপের এক দারোগা ওর বাবা

ওর যে হাতগুলো আমি দেখিনি সেগুলো শক্ত আর ফুটিফাটা

ওর পেটের কাটা কাটা দাগগুলোর জন্য ওর ওপর আমার খুবই করুণা হয়

বীভত্স হি হি হাসির হতভাগা একটা মেয়ের দিকে আমি এখন আমার মুখ নামাই

তুমি একা ভোর হয়ে এল বলে

রাস্তায় রাস্তায় দুধওয়ালারা তাদের দুধের পাত্রের টুংটাং আওয়াজ তোলে

দোআঁশলা রূপসী মেয়েটির মতোই রাত্রি দূরে মিলিয়ে যায়

সে যেন ঠিক জালি ফের্দিন কি যত্নআত্তি করা লেয়া

আর তুমি খেয়ে চলেছ ঐ মদ যা জ্বালাধরানো তোমার জীবনের মতন

তোমার জীবন যা তুমি খেয়ে চলেছ মদের মতন

ওত্যইএর দিকে তুমি হেঁটে যাচ্ছ পায়ে হেঁটে তুমি বাড়ি পৌঁছবে

ওসেয়ানা আর গিনির দেবদেবীদের মাঝখানে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে

ওরা সব অন্য এক চেহারার অন্য এক বিশ্বাসের খ্রিস্ট

ওরা হল অন্ধকার আশার নিকৃষ্ট খ্রিষ্ট

বিদায় বিদায়

কাটামুণ্ড সূর্য

মিরাবো সেতু

(Le Pont Mirabeau)

মিরাবো সেতুর তলা দিয়ে সেন বয়ে চলে অনিবার

আর আমাদের যত প্রেম

স্মৃতি হবে কি জাগাতে তার

সুখ দেখা দিত দুঃখের জ্বালা জুড়োলে বারংবার

রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন

যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন

হাতে হাত রেখে এসো মুখোমুখি থাকি শুধু দুজনায়

আর আমাদের বাহুর

সেতুর তলা দিয়ে বয়ে যায়

নিরবধি যত দৃষ্টির ঢেউ অবসিত জড়িমায়

রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন

যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন

প্রেম চলে যায় যেন জলধারা ছুটে যায় তরতর

প্রেম চলে যায় এ জীবন

যেন কিরকম মন্থর

দুরাশার মায়া যেন কিরকম তীব্র ভয়ংকর

রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন

যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন

পার হয়ে যায় দিনগুলি আর সপ্তাহ হয় পার

গতকাল আর গত যত

প্রেম ফিরে আসেনা তো আর

মিরাবো সেতুর তলা গিয়ে সেন বয়ে চলে অনিবার

রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন

যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন

La_muse_inspirant_le_poète

অঁরি রুসো (Henri Rousseau) আঁকা ছবি ‘মিউজ কবিকে অনুপ্রাণিত করছেন’’

 (La Muse inspirant le poète)

বন্ধন (Liens)

চিত্কারে বোনা দড়িগুলো

ইয়োরোপ জুড়ে গির্জের ঘন্টার ধ্বনি

ফাঁসিতে লটকানো যত শতাব্দী

যত রেলের লাইন ওগুলিই তো সমস্ত জাতির হাতেপায়ে বেড়ি

পরিয়ে দিয়েছে

আমরাই শুধু দুতিন জন মানুষ

সবরকমের বাঁধন থেকে মুক্ত

এসো আমরা হাতে হাত মেলাই

ঝমঝম বৃষ্টি ধোঁয়াকে চিরুনি দেয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে

দড়ি

পাকানো যত দড়ি

জলের তলার ডুবো তার

সেতু হয়ে যাওয়া ব্যাবেলের মিনার

মাকড়সামোহান্ত

একসূত্রে বাঁধা তাবৎ প্রেমিকপ্রেমিকা

সূক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর আরো সব বাঁধন

আলোর সাদা রশ্মি

সূত্র আর যোগসূত্র

আমার লেখালেখি তো শুধু তোমাদেরই জয়গান করার জন্য

আমার ইন্দ্রিয়গুলি প্রিয় ইন্দ্রিয়গুলি

স্মৃতির শত্রু

কামনার শত্রু

অনুতাপের শত্রু

চোখের জলের শত্রু

যা কিছু আমি এখনো ভালোবাসি তার শত্রু

জানলা (Les fenêtres)

লাল থেকে সবুজের মধ্যে সবটা হলুদ মরে যায়

যখন বনের জন্মভুমিতে গান গাইতে থাকে কাকাতুয়ারা

পিহি পাখিদের নাড়িভুড়ি

একটিমাত্র ডানাওয়ালা ঐ পাখিটিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে হবে

আমরা তা টেলিফোনবার্তায় পাঠিয়া দেব

বিশাল আকারের আতঙ্ক

চোখ থেকে যা জল বের করে দেয়

কমবয়েসি তুরিনিজদের মধ্যে ঐতো সুন্দরী একটি মেয়ে

বেচারা ছেলেটা নিজের সাদা টাই দিয়ে নাক মুছছে

পর্দাটা তুলে দেবে

আর ঐতো এবার জানলাটা খুলে যাচ্ছে

মাকড়সারা যখন হাতগুলি সব আলো বুনছিল

সৌন্দর্য পাণ্ডুরতা অপরিমেয় বেগুনি

অনর্থক আমরা বিশ্রাম করার চেষ্টা করব

মাঝরাতে শুরু করা হবে

যখন সময় থাকে স্বাধীনতা থাকে

ঝিনুক অ্যাঙলার মাছ অনেক অনেক সূর্য আর অস্তবেলার সমুদ্রসজারু

জানলার সামনে একজোড়া হলুদ জুতো

মিনার

মিনার হল রাস্তা

কুয়ো

কুয়ো হল চক

কুয়ো

ফাঁপা গাছগুলো উড়নচণ্ডী কাপ্রেসদের আশ্রয় দেয়

শাব্যাঁরা প্রাণান্তকর কিছু সুর শোনায়

উধাও হওয়া শাবিনদের

আর রাজহাঁস ক্রেংকার উত্তরে তুর্যধ্বনি

সেখানে ভোঁদড়শিকারীরা

চামড়ায় ব়্যাঁদা ধার দেয়

ঝলমল হীরে

ভ্যাংকুভার

যেখানে রাতের আগুন আর তুষারে হয়ে যাওয়া রেলগাড়ি শীতের নাগাল ছেড়ে

পালিয়ে যায়

আহারে প্যারিস

লাল থেকে সবুজের মধ্যে সবটা হলুদ মরে যায়

প্যারিস ভ্যাংকুভার ইয়ের ম্যাঁৎনোঁ নিউ ইয়র্ক আর পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ

জানলাটা খুলে যায় যেন একটা কমলালেবুর মতো

আলোর সুন্দর ফল

স্যাঁমেরির বাঁশিবাজিয়ে (Le Musicien de Saint-Merry)

যেসব জীবকে আমি চিনি না অবশেষে তাদের সম্ভাষণ করার অধিকার আমি পেয়েছি

আমার সামনে দিয়ে চলে গিয়ে দূরে ওরা জমায়েৎ হয়

তখন ওদের যা কিছু আমার চোখে পড়ে সবই আমার অজানা

আর ওদের আশা আমার নিজের আশার চেয়ে কম জোরদার নয়

এই জগৎ কি অন্য সব জ্যোতিষ্ক নিয়ে আমি গান গাই না

আমি গান গাই এই জগৎ আর জ্যোতিষ্কগুলির সীমানার বাইরে আমার নিজের তাবৎ

সম্ভাবনা নিয়ে

আমি গান গাই ঘুরে বেড়ানো আর এভাবে ঘুরতে ঘুরতে মরে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে

১৯১৩ সালের মে মাসের ২১ তারিখ

মৃতদের সীমান্ত পারাপারের কাণ্ডারী আর মৃত্যুদাতা দুপুরের ঘুম

লক্ষ লক্ষ মাছি আশ্চর্য একটা ঘটনাকে ভনভন করে হাওয়া করে যাচ্ছিল

যখন যার চোখ নেই কান নেই নাক নেই এরকম একটা লোক

সেবাস্তো থেকে বেরিয়ে এসে ওব্রিবুশে রাস্তায় ঢুকল

কমবয়সি ঐ লোকটির গায়ের রঙ ছিল বাদামি আর তার গালে স্ট্রবেরির সেই রঙ

লোকটি আহারে! আরিয়ান

ও বাঁশি বাজাচ্ছিল আর সুরের মুর্ছনা ওর পাদুটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল

স্যাঁমার্ত্যাঁ রাস্তার মোড়ে এসে ও দাঁড়িয়ে পড়ল

যে সুরে আমি গান গাই আর যে সুর আমি আবিস্কার করেছি সেই সুর ও বাজাতে লাগল

পথচলতি মেয়েরা ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছিল

চারদিক থেকে তারা আসছিল

যখন আচমকা স্যাঁমেরি গির্জের ঘন্টাগুলো বাজতে শুরু করল

তখন বাঁশিবাজিয়ে বাজনা থামিয়ে ফোয়ারায় জল খেল

ফোয়ারাটা হল সিমোঁফোর রাস্তার মোড়ে

তারপর স্যাঁমেরি নীরব হল

অজানা লোকটি আবার ওর বাঁশি বাজাতে শুরু করল

আর যে পথে গিয়েছিল সে পথ ধরেই .ব্যু দ লা ভেররি অব্দি হেঁটে এল

পেছন পেছন আসা ঐ মেয়ের দঙ্গল নিয়ে ও ঐ রাস্তায় ঢুকল

ঐ মেয়েগুলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল

ঐ মেয়েগুলি উল্টোদিকের তাবৎ রাস্তা ধরে আসছিল উন্মাদ তাদের দৃষ্টি

সুরেলা ঐ মনের মানুষটির দিকে দুহাত বাড়ানো

বাঁশিতে ওর নিজস্ব সুর তুলে ও নির্বিকার চলে যাচ্ছিল

ও চলে যাচ্ছিল ভয়ংকরভাবে

তাছাড়া

প্যারিসে যাওয়ার ট্রেন কটায় ছাড়বে

ঐ মুহুর্তে

মালুক দ্বীপের পায়রাদের বিষ্ঠায় জায়ফল বেরুচ্ছে

একই সঙ্গে

বোমার ক্যাথলিক মিশন ঐ ভাস্করটিকে নিয়ে তুমি কী করেছ

অন্য কোথাও

মেয়েটি বন আর ব্যোয়েলএর মাঝখানের সেতু পেরিয়ে প্যুত্জেশনএর মধ্যে

হারিয়ে যায়

একই মুহূর্তে

মেয়রের প্রেমে পড়া এক যুবতী

অন্য এক পাড়ায়

কবি তখন আতরওয়ালার লেবেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে

মোট কথা তোমরা রঙ্গরসিকের দল তোমরা মানুষের কাছ থেকে খুব একটা কিছু

আদায় করে উঠতে পার নি

আর ওদের দুঃখদুর্দশা থেকে বলতে গেলে তোমরা শুধু একটুখানি চর্বি বের করে

নিতে পেরেছ

অথচ আমরা যারা একে অন্যের কাছ থেকে অনেক দূরে বাঁচতে গিয়ে মরে যাই

আমরা হাত বাড়িয়ে দিই আর এই রেললাইনগুলোর ওপর দিয়ে লম্বা একটা মালগাড়ি

গড়িয়ে যায়

একটা ঘোড়ার গাড়ির ভেতর আমার পাশে বসে তুমি কাঁদছিলে

আর এখন

তোমাকে আমার মতন দেখাচ্ছে দুঃখের কথা তোমাকে আমার মতন দেখাচ্ছে

আমরা একে অন্যের মতো দেখতে যেরকম গত শতকের শ্থাপত্যে

ঐ উঁচু উঁচু চিমনিগুলো দেখতে অবিকল মিনারের মতো

আমরা এখন আরো উঁচুতে উঠে যাচ্ছি আর মাটি ছুঁচ্ছি না

আর যখন জগৎসংসার বেঁচেবর্তে থাকত আর পাল্টে যেত

একটাও রুটি জোগাড় করতে না পারা দিনের মতোই দীর্ঘ মেয়েদের শোভাযাত্রাটা

.ব্যু দ লা ভেররি ধরে খোসমেজাজ বাঁশিবাজিয়েটার পেছন পেছন যাচ্ছিল

শোভাযাত্রা আহারে শোভাযাত্রা

সেকালে যখন রাজা ভ্যাঁসেনএ যাত্রা করতেন

যখন রাষ্ট্রদূতরা এসে পৌঁছতেন প্যারিসে

যখন রোগাপটকা স্যুজের ছুটে যেতেন সেনএর দিকে

যখন স্যাঁমেরির আশেপাশে দাঙ্গাহাঙ্গামা থিতিয়ে আসত

শোভাযাত্রা আহারে শোভাযাত্রা

মেয়েদের সংখ্যাটা এমনই বিরাট ছিল যে আশেপাশের সবগুলি রাস্তায়

তারা উপছে পড়ছিল

আর টানটান কামানের গোলার মতন ছুটে যাচ্ছিল

বাঁশিবাজিয়ের পেছন পেছন যাওয়ার জন্য

আহা ! আরিয়ান আর তুমি পাকেৎ আর তুমি আমিন

আর তুমি মিয়া আর তুমি সিমন আর তুমি মাভিজ

আর তুমি কোলেৎ আর তুমি রূপসী জনভিয়েভ

অবয়বহীন তারা চলে গেল কাঁপতে কাঁপতে

আর তাদের উদগ্র কানকে পথ দেখাচ্ছিল সেই রাখালিয়া সুর

যে সুরের তালে তালে

তাদের হালকা আর চঞ্চল পা গতিময় হয়ে উঠছিল

অচেনা লোকটি একটা বাড়ির সামনে এসে মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল

বিক্রির জন্য রাখা ছাড়া বাড়ি

তার কাচের জানলাগুলো ভাঙা

ষোড়শ শতকের একটা বসতবাটি

উঠোনটা মালবওয়া গাড়ি রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়

সেই বাড়িটাতেই বাঁশিবাজিয়েটা ঢুকে পড়ল

দূরে মিলিয়ে যাওয়া তাঁর বাঁশির সুর স্তিমিত হয়ে উঠল

মেয়েরা তার পেছন পেছন ছাড়া বাড়িটার মধ্যে ঢুকে গেল

আর তারা সবাই একসঙ্গে দঙ্গল বেঁধে সেখানে ঢুকে পড়ল

পেছনে এতটুকু না তাকিয়ে সবাই সেখানে ঢুকে পড়ল সবাই

যা তারা ছেড়ে এসেছে যা তারা ফেলে এসেছে

তার জন্য এতটুকু আফশোস না করে

দিনের আলো জীবন আর স্মৃতির জন্য একটুকু আফশোস না করে

অবিলম্বে এক আমি আর স্যাঁমেরির একজন পাদ্রি ছাড়া

.ব্যু দ লা ভেররিতে আর কেউই রইল না

পুরনো বাড়িটার ভেতর আমরা ঢুকে পড়লাম

কিন্তু কাউকে আমরা সেখানে দেখতে পেলাম না

এখন সন্ধে নেমে এসেছে

স্যাঁমেরিতে বেজে ওঠে সন্ধের প্রার্থনার সুর

শোভাযাত্রা আহারে শোভাযাত্রা

এই সময়েই আগেকার দিনে রাজা ভ্যাঁসেন থেকে ফিরে আসতেন

একদল টুপিওয়ালা এল

এল কলাওয়ালারা

এল প্রজাতন্ত্রবাহিনীর সিপাইরা

আহারে রাত্রি

মেয়েদের অবসন্ন চাউনির পাল

আহারে রাত্রি

তুমি আমার বেদনা আর আমার নিস্ফল প্রতীক্ষা

আর আমি শুনতে পাচ্ছি অনেক দূর থেকে আসা একটা বাঁশির সুর মিলিয়ে যাচ্ছে

মেঘের এক ছায়ামূর্তি (Un fantôme de nuées)

যেহেতু দিনটা ছিল ১৪ই জুলাইয়ের আগের দিন

তাই বিকেল চারটে নাগাদ

মাদারিদের দেখার জন্যে আমি বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়

ঐ যে লোকগুলো খোলা জায়গায় খেলা দেখিয়ে বেড়ায়

আজকাল প্যারিসে ওদের বড় একটা চোখে পড়ে না

আমার ছেলেবেলায় আজকের তুলনায় অনেক বেশি ওদের দেখা যেত

ওরা প্রায় সবাই চলে গেছে গ্রামগঞ্জের দিকে

বুলভার স্যাঁজের্ম্যাঁ ধরে আমি হাঁটতে লাগলাম

আর স্যাঁজের্ম্যাঁ দে প্রে আর দঁতোঁর মূর্তির মাঝামাঝি ছোট্ট একটা চকে

মাদারিদের দেখা পেলাম

কী হয় দেখার অপেক্ষায় এক দঙ্গল লোক ওদের ঘিরে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল

সব কিছু দেখব বলে আমিও ঐ বৃত্তের মধ্যে জায়গা করে নিলাম

ভার তোলার দারুণ খেলা

লোঁউইর একটা রুশ মজুরের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ওপরে উঠে পড়েছে

বেলজিয়ামের শহরগুলো

কালো কালো ফাঁপা বারবেলের মাঝখানের ডাণ্ডাটা জমাট এক একটা নদী

আঙুলগুলো পাকিয়ে চলেছে জীবনের মতো তেতো আর উপাদেয় একটা সিগারেট

অসংখ্য নোংরা সতরঞ্চি মাটির ওপর পাতা সতরঞ্চিগুলো ভাঁজপড়া সে ভাঁজ

আর কখনো খোলা হবে না

সতরঞ্চিগুলো প্রায় পুরোপুরি ধুলোর রঙের

আর কয়েকটা হলুদ নয়তো সবুজ দাগ তাতে সেঁটে আছে

কোনো একটা সুর যেমন তোমাদের পেছনে লেগে থাকে

রোগা ঐ জংলি লোকটাকে দেখতে পাচ্ছো তো

ওর কাঁচাপাকা দাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ওর পূর্বপুরুষের ছাই

ও যেন এভাবেই বংশের সমস্ত ধারাটা ওর চেহারার মধ্যে ধরে রেখেছে

যন্ত্রের মতো একটা ব্যারেলঅর্গানের হাতল ঘোরাতে ঘোরাতে

ও যেন আগামী দিনের স্বপ্ন দেখছে

আর ঐ অর্গানের একটানা আওয়াজ গুমরে গুমরে অদ্ভুত কেঁদে চলেছিল

গুব্ গুব্ ক্যাঁ ক্যাঁ আর চাপা একটা গোঙানি

মাদারিরা নড়াচড়া করছিল না

সবচেয়ে বুড়ো মাদারিটার গায়ে বেগনে গোলাপি রঙের একটা গেঞ্জি যে রঙটা দেখা

যায় তরতাজা অথচ মৃত্যুমুখী কিছু অল্পবয়সি মেয়ের গালে

ঐ গোলাপি রঙটা বিশেষ করে বাসা বাঁধে তাদের মুখের চারপাশে হামেশা দেখাদেওয়া

ভাঁজগুলোর মধ্যে

কিংবা নাকের ফুটোর আশেপাশে

ঐ গোলাপি রঙটাকে এতটুকু ভরসা করা যায় না

তাই বলা যায় লোকটির গায়ে ছিল

তার কদাকার ফুসফুসের ছাপ

হাতদুটো ব জায়গায় পাহারা দিচ্ছিল হাতদুটো

দ্বিতীয় মাদারিটা

তার পরনে কেবল তার ছায়া

তার দিকে অনেকক্ষণ আমি তাকিয়ে ছিলাম

তার মুখটা আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না

ঐ লোকটির কোনো চেহারাই ছিল না

শেষের আরেক জনকে দেখতে অনেকটা মাস্তানের মতো

একই সঙ্গে ভোলাভালা আর বদমাস একটা ডাকাতের মতো

ঢোলা পাৎলুন আর মোজা বাঁধার ফিতে সুদ্ধু

ওর হাবভাব দেখে মনে হতে পারে যেন একটা বেশ্যার দালাল সাজগোজ করছে

বাজনা থেমে গেল আর শুরু হল দর্শকদের সঙ্গে দরকষাকষি

এক এক পসা করে তারা মোট দুটাকা পঞ্চাশ পয়সা সতরঞ্চির ওপর ছুঁড়ে দিল

বুড়োর ঠিক করা খেলার মজুরি তিনটি টাকাও পুরো হল না

কিন্তু যখন পরিষ্কার বোঝা গেল কেউ আর কিছুই দেবে না

তখন ঠিক হল এবার খেল শুরু হবে

অর্গানের তলা থেকে ফুসফুসের রঙের গোলাপি জামাপরা খুদে একটি মাদারি

বেরিয়ে এল

র হাতের কব্জি আর পায়ের গাঁটে পশম জড়ানো

থেকে থেকে ও চিত্কার করে উঠছিল

আর হাত দুটো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিয়ে

খোলা মুঠোয় সবাইকে অভিবাদন করছিল

একটা পা পেছনে নিয়ে অনেকটা নতজানু হওয়ার ভঙ্গিতে

প্রধান চারটি দিককে ও প্রণাম জানাল

আর যখন ও একটা বলের ওপর উঠে হাঁটতে শুরু করল

তখন তার ক্ষীণ শরীরটা এমন এক কমনীয় সঙ্গীত হয়ে উঠল যে দর্শকদের

কেউই তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারল না

প্রত্যেকেরই মনে হল

এইটুকু একটা অশরীরী আত্মা যার মধ্যে কিছুমাত্র মানবিক ব্যাপার নেই

আর নানান ভঙ্গির ঐ সুরমূর্ছনা

পূর্বপুরুষে মুখ ঢাকা লোকটির যান্ত্রিক অর্গানের জাঁতাকলে পেষাই করা

সঙ্গীতকে ভেঙে চুরমার করে দিল

খুদে মাদারিটা এমন তালে তালে ডিগবাজি খেতে লাগল যে

অর্গানের বাজনা স্তব্ধ হয়ে গেল

আর অর্গানবাজিয়ে দুহাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে ফেলল

তার হাতের আঙুলগুলো দেখতে তারই ভাগ্যের বংশধরদের মতন

তার দাড়ি থেকে বেরিয়েআসা একরত্তি সব ভ্রূণ

রেড়ইণ্ডিয়ানদের নতুন নতুন সব চিত্কার

গাছের কিন্নরকষ্ঠ গান

বাচ্চা ছেলেটির অদৃশ্য হওয়া

মাদারিরা হাতের নাগাল অব্দি বিরাট বিরাট সব বারবেল তুলতে লাগল

নানান ওজনের জিনিষ নিয়ে

ওরা লোফালুফির খেলা দেখাচ্ছিল 

কিন্তু প্রতিটি দর্শক তখন নিজের ভেতর খুঁজে বেড়াচ্ছিল অলৌকিক

ঐ শিশুটিকে

শতাব্দী হে মেঘের শতাব্দী

হৃদয় রাজমুকুট আর আয়না (Cœur couronne et miroir)

CALI 4A

APOLLINAIRE PAR PICASSO

পিকাসোর আঁকা .যুদ্ধে আহত গিয়োম আপলিনের

বিজয় (Victoire)

একটা মোরগ ডেকে ওঠে আমি স্বপ্ন দেখছি আর পাতায় ভরা ডাল

দেখতে হতচ্ছাড়া জাহাজিদের মতন পাতাগুলো দোলাতে থাকে

জাল ইকারুসএর মতো ডানাওয়ালা আর ঘুরে পাক খেতে থাকা

অন্ধেরা পিঁপড়ের মতো হাতপা ছুঁড়তে ছুঁড়তে

বৃষ্টির ভেতর ফুটপাতের আলোর প্রতিফলনে নিজেদের দিকে তাকিয়ে ছিল

তাদের হাসি আঙুরের থোকার মতো টাল করা

মণি আমার তুমি তো কথা বলে যাচ্ছিলে আমার ঘর ছেড়ে তুমি আর বেরিয়ো না

শান্ত হয়ে ঘুমোও তোমার নিজের ঘরেই তুমি রয়েছো সবকিছুই তোমার

আমার বিছানা আমার বাতি আর আমার ফুটো হয়ে যাওয়া লোহার টুপি

চোখের চাউনি স্যাঁক্লোদএর আশেপাশে কাটা দামি নীলা আর দিনগুলি ছিল

নিখুঁত এক একটা পান্না

তোমাকে আমার মনে পড়ছে উল্কার শহর

কিছুই যখন ঘুমোয় না সেই সব রাতে শূন্যে ওরা ফুটে উঠত

আলোর সব বাগান যেখান থেকে আমি তুলে এনেছি ফুলের তোড়া

ঐ আকাশটাকে ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে তোমার তো বিরক্ত হয়ে পড়ার কথা

নিজের হেঁচকি সে সামলে রাখুক

সাফল্য মানুষকে কতটা নির্বোধ আর নির্জীব করে দেয়

তা কল্পনা করা কঠিন

তরুণ অন্ধদের শিক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন করা হল

আপনাদের হাতে কি কোনো ডানাওয়ালা তরুণ অন্ধ নেই

মুখের দল মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে নতুন একটা বাগভঙ্গি

যার সম্পর্কে কোনো ভাষার ব্যাকরণবিদের কিছুই বলার থাকবে না

আর এই পুরনো ভাষাগুলো এমনই মরোমরো যে

সত্যি বলতে কি শুধু অভ্যাসবশে আর সাহসের অভাবে

আজও ওদের কবিতায় ব্যবহার করা হচ্ছে

অথচ ওরা অরুচিধরা রোগীর মতন

আমার ধারণা লোকে অবিলম্বে চুপ করে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে

চলচ্চিত্রে মূকাভিনয়ই তো যথেষ্ট

তবু এসো কথা বলার জন্যে গোঁ ধরে থাকি

এসো জিব নাড়াই

এসো থুতু ছেটাই

আমাদের চাই নতুন ধ্বনি নতুন ধ্বনি নতুন ধ্বনি

আমাদের চাই স্বরধ্বনিহীন ব্যঞ্জন

যে ব্যঞ্জন অঘোষ ফটফট আওযাজ করে

লাট্টুর ধ্বনির নকল কর

অনুনাসিক একটা ধ্বনিকে একনাগাড়ে টিকটিক করে যেতে দাও

জিব দিয়ে চক চক শব্দ করে যাও

যে লোকটা অসভ্যের মতো খায় তার চাপা গপগপ আওয়াজকে ব্যবহার কর

থুথু ফেলার মহাপ্রাণ ঘর্ষণও সুন্দর একটা ব্যঞ্জনধ্বনি তৈরি করতে পারে

নানান ধরনের ওষ্ঠ্য বায়ুনিঃসরণও তোমার বাচনকে ধ্বনিময় করে তুলতে পারে

খুশিমত ঢেকুর তোলার অভ্যেস কর

আর আমাদের স্মৃতির ভেতর

কোন অক্ষরটাই বা গির্জের ঘণ্টাধ্বনির মতো গম্ভীর

নতুন নতুন সুন্দর জিনিস দেখার আনন্দ

আমাদের খুব একটা ভালো লাগে না

বান্ধবী আমার তাড়া করো

ভুলে যোয়ো না একদিন একটা রেলগাড়ি তোমাকে আর নাও মুগ্ধ

করতে পারে

যতটা পারো চটপট করে তার দিকে তাকাও

চলন্ত রেললাইনগুলো অবিলম্বে জীবনের বাইরে চলে যাবে

হয়ে যাবে সুন্দর আর হাস্যকর

দুটো বাতি আমার সামনে জ্বলছে

দুটি নারী যেন হি হি করে হাসছে

দীপ্ত তামাসার সামনে

আমি বিষন্নভাবে মাথা নোয়াই

ঐ হাসি ছড়িয়ে পড়ছে

সর্বত্র

হাত দিয়ে কথা বল আঙুল দিয়ে তুড়ি দাও

ঢোল বাজানোর ভঙ্গিতে গালের ওপর চাঁটি মারো

আহারে কথাগুলো

ওরা মার্টেলের বনে

অশ্রুসজল কাম ও নিষ্কামের পিছু নেয়

আমি মহানগরীর আকাশ

সমুদ্রের দিকে কান পাতো

সমুদ্র অনেক দূরে গোঙাচ্ছে আর একা একা চিত্কার করে উঠছে

ছায়ার মতো বিশ্বস্ত আমার কণ্ঠস্বর

শেষ অব্দি আমার জীবনের ছায়া হতে চায়

হতে চায় হে প্রাণচঞ্চল সমুদ্র তোমারই মতন অবিশ্বস্ত

যে সমুদ্র অগুনতি মাঝিমাল্লার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বারে বারে

আমার প্রচণ্ড আর্তনাদকে সে ডুবে যাওয়া দেবতাদের মতো গিলে ফেলে

আর রৌদ্রোজ্জ্বল সমুদ্র একমাত্র সইতে পারে

সেই সব পাখিদের ছায়া যারা উড়ে যায় ডানা মেলে

বচন আকস্মিক আর ঐতো কাঁপতে থাকা এক ঈশ্বর

এগিয়ে এসো আর আমায় ধরে থাক তাদের ঐ হাতগুলি নেই বলে আমি কষ্ট পাই

যারা আমায় একসঙ্গে হাত বাড়িয়ে করত আদর

আগামীকাল বাহুর কোন মরুদ্যান অভ্যর্থনা জানাবে আমায়

নতুন নতুন জিনিস দেখার আনন্দের সঙ্গে তোমার কি পরিচয় হয়েছে

হে কণ্ঠস্বর আমি সমুদ্রের ভাষায় কথা বলছি

আর বন্দরে শেষ সরাইখানাগুলোর রাত

লের্নএর হায়ড্রা যতটা একরোখা হতে পারে তার চেয়েও আমি বেশি একরোখা

শহরময় তল্লাশি করা নিপুণ আঙুল নিয়ে

আমার হাতদুটো সাঁতার কাটে যেখানে

সেই রাস্তাটা বিদায় নেয় আজকের দিনটা পেরোলে

রাস্তাটা অনড় হয়ে যাবে কিনা কে জানে

কে জানে আমার গতি হবে কোন দিকে

মনে রেখো রেলরাস্তা

কিছুদিনের মধ্যেই সেকেলে আর বাতিল হয়ে পড়বে

তাকিয়ে থাকো

সবার আগে জয় হবে

অনেক দূরে ভালো করে দেখার

কাছ থেকে

সব কিছু দেখার

আর সব কিছুরই হোক নতুন এক একটা নাম

টীকা

এলাকা (Zone)

আপলিনেরএর ‘সুরাসার’ (Alcools) কাব্যগ্রন্থের প্রথম রচনাএলাকা’ (Zone) কালানুক্রমিক দিক থেকে এ কাব্যের সবচেয়ে শেষে লেখা কবিতা। আসলে সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি কালানুক্রমিকভাবে সাজানো নয়। হয়ত একঘেঁয়েমির ভয়ে, বিষয় ও প্রকাশের বৈচিত্র্যের কথা মনে রেখে কবি কালানুক্রমিকতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন। কিংবা এও হতে পারে যে বিচিত্র সুরের স্তরবিন্যস্ত পর্যায় ও বিভিন্নতা একটা সাংগীতিক ঐকতান সৃষ্টি করবে — এটাই ছিল কবির উদ্দেশ্য।

বর্তমান কবিতাটির রচনাকাল সম্ভবত ১৯১২র মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসের মধ্যে। ‘সুরাসার’ কবিতার বইয়ের প্রথম প্রুফ আসার পর আপলিনের কবিতাটিকে বইয়ে স্থান দেন । বই বের হওয়ার আগে ‘লে সোয়ারে দ পারি’ (Les soirées de Paris) পত্রিকার ডিসেম্বর সংখ্যায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কাগজের একটা প্রুফকপি বইয়ের প্রথম প্রুফে যোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এই কপিতে দেখা যায়, কবি কবিতাটির প্রথম দেওয়া নাম চিত্কার’ (Cri) পাল্টে এলাকা’ (Zone) করে দিয়েছেন। বইয়ের প্রুফে কবিতাটির মধ্যে আরো কিছু পরিবর্তন করা হয়।

এই কবিতাটি নিয়ে যে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হয়েছে তার পরিমাণ সত্যি বিপুল। এ কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন হল কবিতাটি কি ব্লেজ সঁদ্রারএর (Blaise Cendrars) নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ (পাক আ ন্যু ইয়র্ক /Pâques à New York) দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত, নিদেনপক্ষে অনুপ্রাণিত? সঁদ্রারএর কবিতাটি ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল, আর একথা সত্যি যে দুটি কবিতার মধ্যে সাদৃশ্য খুবই স্পষ্ট। যাঁরা মনে করেন আপলিনেরএর কবিতাটি সঁদ্রারএর পূর্বোক্ত কবিতার দ্বারা প্রভাবিত, তাঁরা বলেন, সঁদ্রার নিউ ইয়র্কে ১৯১২র এপ্রিল মাসে কবিতাটি লেখেন, তারপর আমেরিকা থেকে ফিরে তিনি নাকি আপলিনেরকে কবিতাটি পড়ে শোনান। আপলিনের বুঝতে পারেন, সঁদ্রার যা লিখেছেন তার তুলনীয় কিছুই তিনি লিথে উঠতে পারেন নি আর তখনই তিনি ‘এলাকা’ কবিতাটি লেথেন। অন্য দিকে আপলিনেরএর এক বন্ধুর সাক্ষ্য অনুসারে, সঁদ্রারএর কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর আপলিনের তাঁকে কবিতাটি দেখান, কেননা তাঁর নিজের কবিতার সঙ্গে সঁদ্রারএর কবিতার সাদৃশ্য তাঁকে বিস্মিত করেছিল। এসব কাহিনি থেকে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় নি; স্ঁদ্রার ১৯১২ সালে আমেরিকা থেকে ফিরলেও ঠিক কোন সময়ে ফিরেছিলেন জানা যায় নি। আর তাছাড়া এসব বিতর্কের সময় বেঁচে থাকলেও সঁদ্রার কখনো এ নিয়ে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেন নি।

আবার ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ব্লেজ সঁদ্রারএর জীবনীতে গ্রন্থের লেখিকা সঁদ্রারএর কন্যা মিরিয়াম (Miriam Cendrars) জানিয়েছেন যে সঁদ্রাম ১৯১২ সালের ৬ থেকে ৮ই এপ্রিল লেখা ‘নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ কবিতাটি আমেরিকা থেকে আপলিনারকে পাঠান। সঁদ্রার চেয়েছিলেন আপলিনের কবিতাটি ‘মের্ক্যুর দ ফ্রঁস’ (Mercure de France) পত্রিকায় ছাপতে দিন। আপলিনের সঁদ্রারকে কোনো উত্তর দেন নি। প্যারিসে এসে ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সঁদ্রার একটি বইয়ের দোকান থেকে আপলিনেরএর সদ্যপ্রকাশিত ‘লেরেজিয়ার্ক’ (l’Hérésiarque) বইটি চুরি করে হাজতে যান। ১৭ই সেপ্টেম্বর হাজত থেকে তিনি বইটি পড়ে মুগ্ধ হওয়ার কথা আপলিনেরকে চিঠি লিখে জানান। এই চিঠিতেও তিনি ‘নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করেন। এর পর সঁদ্রার ও তাঁর দুই বন্ধু পরিচালিত একটা বইয়ের সিরিজে প্রথম পুস্তিকা হিসেবে যখন কবিতাটি প্রকাশিত হয় তখনও সেই পুস্তিকা আপলিনেরকে পাঠানো হয়েছিল। শিল্পীদম্পতি সবের এবং সোনিয়া দলোনেরর বাড়িতে সঁদ্রার যেদিন কবিতাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন সেখানেও আপনিনের উপস্থিত ছিলেন।

এ সম্পর্কে আমরা বলতে পারি, আপলিনেরএর কবিতাটির সঙ্গে সঁদ্রারএর উল্লিখিত কবিতাটির সাদৃশ্য রয়েছে, তাছাড়া আপলিনেরবিশেষজ্ঞ মিশেল দেকোদ্যাঁ (Michel Décaudin) তাঁর ‘সুরাসারএর দলিল(ল দোসিয়ে দালকল/Le dossier d’Alcools) গ্রন্থে ‘এলাকা’ কবিতাটির যে আদি খসড়া উপস্থাপিত করেছেন তাতে এই সাদৃশ্য আরো স্পস্ট, কবিতাটির পরিমার্জনা সেই সাদৃশ্য অনেকটা মুছে দিয়েছে। আবার আপলিনেরএর কবিতার বিবর্তনের ইতিহাসে ‘এলাকা’ কবিতাটি সত্যি আকস্মিক — তার প্রস্ত্ততি এর আগে তাঁর কবিতায় চোখে পড়ে না। তবু সঁদ্রারএর কবিতার সঙ্গে সাদুশ্য সত্ত্বেও বর্তমান কবিতাটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বস্ত্তত দুটি কবিতাই ফরাসি সাহিত্যে অনন্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বোঝা যায়, আপলিনের সঁদ্রারএর কবিতা শুনেছিলেন বা পড়েছিলেন আর তা তাঁর মনের মধ্যে ধীরে ধীরে জমতে থাকা বারুদে প্রেরণার অগ্নিসংযোগ করে — তারই বিস্ফোরণ ‘এলাকা’ কবিতাটি । বলা যায়, যে কোনো যথার্থ নতুন কাব্যসৃস্টিই সাধারণত বিবর্তনের পথ ধরে পরিণতি বা কখনো কখনো কয়েকটি পর্যায় পার হওয়া বিস্ফোরণ। ‘নিউইয়র্কে ইস্টার’ আর ‘এলাকা’ কবিতার বিস্ফোরণের পেছনে তত্কালীন ফরাসি কবিতার কিছু প্রবণতা কাজ করেছে। বস্ত্তত এ সময়ে ফরাসি কবিতায় প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনের আবির্ভাব, গদ্যময়তা, মুক্তছন্দ ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। আবার বিদেশি কবিকৃতির অনুবাদ, বিশেষ করে হুইটম্যানএর অনুবাদ কবিতায় নতুন উচ্চারণ সম্পর্কে সচেতনতার প্রেরণা যোগায়। এই সমস্ত উপাদানের পরিণতি সঁদ্রার এবং আপলিনেরএর কবিতা। হয়তবা সঁদ্রারএর রচনা আপলিনেরকে নতুন উচ্চারণের অন্বেষণে পথের নির্দেশ দিয়েছিল — তারপর আপলিনের এগিয়ে গেছেন নিজের পথে, সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব কবিতা। তবে অনস্বীকার্যভাবে আপলিনেরএর ‘এলাকা’ আন্তঃরাচনিক সূত্রে সঁদ্রারএর ‘নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ কবিতাটির সঙ্গে সম্পর্কিত।

আলোচনার অন্য এক স্তরে বলা যায় যে আপলিনের ও সঁদ্রারএর কবিতা দুটির সাদৃশ্য তাদের আপাতসংস্থানে। নিহিত সংস্থানে রচনা দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, অনন্য। সঁদ্রারএর কবিতার ভ্রমণপথের স্থানব্যাপ্তি নিউ ইয়র্কে সীমাবদ্ধ আর কালব্যাপ্তি বর্তমান কালে সীমিত; আপলিনেরএর কবিতার স্থানব্যাপ্তি প্যারিসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানান্তরে গতিশীল, আর কালব্যাপ্তি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে অবাধ গতিময়। আবার আপলিনেরএর কোলাজধর্মিতাও তাঁর নিজস্ব। এদিক থেকে সঁদ্রারএর কবিতায় রয়েছে একটা প্রবহমানতা, আর আপলিনেরএর কবিতায় উল্লম্ফনধর্মিতা।

এলাকা’ কবিতাটিকে ‘সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা হিসেবে উপস্থাপনার মধ্যে আপলিনের কবিতাটিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন তা বোঝা যায়। আমরা বলতে পারি এই রচনাটি আপলিনেরএর ১৮৯৪ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত কাব্যসৃস্টির পরিণতির স্বাক্ষর আর একই সঙ্গে নতুন কবিতা সম্পর্কে তাঁর ঘোষণাপত্র।

কবিতাটির নাম Zone, আমরা বাংলা অনুবাদে নাম দিয়েছি ‘এলাকা’। কিন্ত্ত এই Zone নামের তাত্পর্য কী? স্মরণীয়, প্রথম প্রকাশের সময় কবিতাটির নাম ছিল ‘চিত্কার’ (ক্রি/Cri )। সেই নাম পাল্টে অনির্দিষ্ট Zone নাম রাখার কারণ কী? সঁদ্রারকন্যা মিরিয়ামএর আভিমতে Zones (বহুবচনে) সঁদ্রার ও আপলিনেরএর পরিকল্পিত পত্রিকার নাম; পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় নি, কিন্ত্ত আপলিনের zone শব্দটি একবচনে তাঁর বর্তমান ‘সঁদ্রারপ্রভাবিত’ কবিতাটির শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেন। তাছাড়া জানা যায়, শ্রীমতী গাব্রিয়েল ব্যুফে (Gabrielle Buffet) ও তাঁর স্বামী ফ্রঁসিস পিকাবিয়া (Francis Picabia) ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে জ্যুরাতে (Jura) এতিভাল গ্রামে গাব্রিয়েলএর মাবাবার গাঁয়ের বাড়িতে আপলিনেরকে আমন্ত্রণ করেন। সেখানে তিনি অসমাপ্ত ‘এলাকা’ কবিতাটি পড়ে শোনান। গাব্রিয়েলএর মা কবিতাটির নাম জানতে চাইলে আপলিনের জবাব দেন, Zone।জোন অনেকের ধারণা ফরাসিসুইস সীমান্তের ‘মুক্ত এলাকা’ বা Zone francheএর কাছাকাছি এতিভাল গ্রামের অবস্থান থেকে এই নামের কথাটি আপলিনেরএর মনে আসে। আবার প্যারিস শহরের চারদিকে শহরতলির বসতি শুরু হওয়ার আগে কিছুটা থালি জায়গা রাখা ছিল। সেখানে ধীরে গরিব, গৃহহীন আর ভবঘুরেদের বসতি গড়ে ওঠে; এই অঞ্চলকেও বলা হত Zone, আবার Zone (গ্রিক ζόνη, লাতিন zona, ফরাসি zone) বলতে বোঝায় বেল্ট বা বলয়। বৃত্তাকারভাবে ঘুরে এসে আরম্ভের জায়গায় শেষ হওয়া কবিতাটি তাই zone বা বলয়ের মতোই।

আমাদের মনে হয়েছে, এই কবিতায় কবি প্রাচীন বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশিয়ে খণ্ড, ছিন্ন, প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনকে স্থান দিতে চেয়েছেন — কবিতার প্রথানির্দিষ্ট নগরপরিখার বাইরের এক এলাকায় এই মিলন সন্ভব। একই সঙ্গে এই কবিতায় একাকার হয়ে গেছে কাব্য আর অকাব্য, বাস্তব আর কল্পনা, অতীত আর বর্তমান — কবি কবিতার রাজ্যের আইনকানুনের সীমান্ত পেরিয়ে কবিতার এক ‘মুক্ত এলাকা’ তৈরি করতে চেয়েছেন। এই কবিতা তাই দুঃখের, যন্ত্রণার বা প্রতিবাদের ‘চিত্কার’ নয়, কবিতার নতুন ‘এলাকা’র সৃস্টি।

ঐ কবিতার ছন্দের প্রসঙ্গে দুএকটি কথা বলা দরকার। ফরাসি কবিতায় অক্ষর বা দলমাত্রিক ছন্দের প্রথাকে ভাঙার চেষ্টা হয় টানা গদ্যে কবিতা লেখার মাধ্যমে। পরিণতির পথ ধরে তা বিশ শতকের প্রথমে ক্লোদেল এবং পের্সএর গদ্যকবিতায় বিশিস্ট একটা রূপ লাভ করে। অন্যদিকে উনিশ শতকের শেষ থেকে মুক্তছন্দ (vers libres) নিয়ে পরীক্ষা শুরু হল। মুক্তছন্দ মানে মোটামুটিভাবে অসম পর্বের বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের পঙক্তির সমাবেশ — বাংলায় যে ধরনের রচনাকে আমরা গদ্যছন্দে বা (সিঁড়ি) ভাঙা গদ্যে লেখা কবিতা বলি। ফরাসি মুক্তছন্দ সমিল বা অমিল দুই হতে পারে। প্রাথমিক প্রচেস্টায় আমরা তাতে গদ্যের চাল লক্ষ করলেও তা কাব্যময়, সুক্ষ্ম ছন্দোস্পন্দনময়। সঁদ্রার আর আপলিনের এই মুক্তছন্দের ব্যবহারেও বিপ্লব ঘটালেন। তাঁরা কোনো ছক মানলেন না, একই কবিতায় কখনো মিলওয়ালা, কখনো অমিল পঙক্তি ব্যবহার করলেন, মিলের পাশাপাশি ব্যবহার করলেন মিলাভাস বা স্বরসাম্য (assonance) যা ফরাসিকবিতায় মধ্যযুগে ব্যবহৃত হত। মুক্তছন্দের এ সমস্ত চরিত্রবৈশিস্ট্য আমরা ‘এলাকা’ কবিতায় লক্ষ করি।

এ কবিতা এবং আপলিনেরএর আরো কিছু কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কবিতাঅনুবাদের সাধারণ সমস্যাগুলি ছাড়াও আমরা যে বিশেষ সমস্যার সম্মুথীন হয়েছি তা হল:

. বাচনের গদ্যধর্মিতার সঙ্গে মিল আর স্বরসাম্য রক্ষা করা। স্বরসাম্য ব্যাপারটা বাংলা কবিতার ঐতিহ্যস্বীকৃত নয়, বাংলা কবিতার প্রথাগত বিচারে চরণান্ত স্বরসাম্য দুর্বল বা অক্ষম মিল হেসেবে বিবেচিত হতে পারে।

. খিস্টধর্মীয় তথা জুডোহেলেনিক অনুষঙ্গময় শব্দ আর তার পাশাপাশি নাগরিক তথা যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দগুলির অনুবাদ ও সামঞ্জস্য রাখা সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

. আপলিনের বিভিন্ন স্তরের শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যভাষার প্রথানির্দিস্ট ছাঁচের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শব্দের মিশ্রণ দুঃসাধ্য।

কবিতার প্রথম পক্তির ‘তোমাকে’ (তুমি) আসলে কবির নিজেকে উদ্দেশ করে বলা। কবিতাটিতে নিজেকে নির্দেশ করতে কবি ‘আমি’ আর ‘তুমি’ দুই ব্যবহার করেছেন। বস্ত্তত উত্তম ও মধ্যম পুরুষের মধ্যে অবাধ সঞ্চরণের ফলে কবিতায় একই সঙ্গে মন্ময় ও তন্ময় ভঙ্গিতে নিজেকে দেখা আর নিজের সম্পর্কে কথা বলার রীতিতে একটা নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে।

মেষপলক হে আইফেল টাওয়ার : মুলে রয়েছে ‘মেষপালিকা’, কেননা ব্যাকরণগত বিচারে টাওয়ারএর ফরাসি প্রতিশব্দ ‘তুর’ (tour = মিনার) স্ত্রীলিঙ্গ। তাই ফরাসিতে আইফেল টাওয়ার হল লা তুর এফেল’ (la tour Eiffel) ১৮৮৯ সালের বিশ্বমেলা’ (Exposition universelle) উপলক্ষে ফরাসি প্রযুক্তিবিদ্ গুস্তাভ এফেল (Gustave Eiffel) ধাতুনির্মিত এই মিনার তৈরি করেন (১৮৮৭১৮৮৯) কালক্রমে এই মিনার প্যারিস নগরীর অনুষঙ্গময় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বর্তমান এই টাওয়ার ভ্রমণকারীদের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া দীর্ঘকাল ধরে মিনারটিকে রিডিও এবং টেলিভিশনের সম্প্রচারটাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পূর্বতন পক্তির সেকেলে জগৎ আর বিশ শতকের প্রথম পর্বের শিল্পীদের প্রিয় ব্যবহারিক কারিগরিস্থাপত্যের নিদর্শন আইফেল টাওয়ারএর মধ্যে প্রাথমিক সম্পর্কে বিরোধ আর বৈপরীত্যের। অন্যদিকে আইফেল টাওয়ারকে মেষপালক এবং সেন নদীর ওপরের সেতুগুলিকে ভেড়ার পাল বলে কল্পনা করে — আর তারই অনুষঙ্গে সেতুর পালের ভেড়ার ডাকের কল্পনা (হয়ত সেতুর তলা দিয়ে যাওয়া গাধাবোটের ভোঁ) অবাধে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা থেকে শ্রুতিগ্রাহ্যতায় সঞ্চলনের নিদর্শন। বস্তুত এই অবাধ গতি আর এক পঙক্তি থেকে পরবর্তী পঙক্তির চিন্তার উল্লম্ফনের দ্বারা যে আপাত যুক্তিবিরোধী সংস্থান গড়ে উঠেছে তাই হল (বিশ শতকের) আধুনিক শিল্প আর কবিতার ভিত্তি । অন্যদিকে মেষপালক আর ভেড়ার পালের কল্পনার মধ্যে খ্রিস্টধর্মীয় অনুষঙ্গও বর্তমান। খ্রিস্টীয় মেষপালক (= জিশুপোপ) এবং নতুন যন্ত্রযুগের প্রতীক আইফেল টাওয়ার কবির উপলব্ধিতে এক হয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে তা কবিতায় খ্রিস্টধর্ম তথা পোপের প্রসঙ্গের অবতারণার ভূমিকা রচনা পরেছে।

মোটর গাড়িগুলোর চেহারা … সেকেলে : ঘোড়ার গাড়ির আকারের অনুকরণে কিছু কিছু মোটরগাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। আপলিনের হয়ত বিশেষ করে সেই গাড়িগুলির কথা স্মরণ করছেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি, আধুনিক পৃথিবীর তাবৎ আবিষ্কার আপলিনেরকে মুগ্ধ করত। বিমানপোত ও বিমানভ্রমণ সম্পর্কে তাঁর উত্সাহ ছিল সীমাহীন। তাঁর মনে হত পুরাকাহিনি ও লোকবৃত্তের কল্পনার মধ্যে প্রকাশিত মানুষের ওড়ার স্বপ্নের সার্থক বাস্তব রূপায়ণ বিমানের আবিষ্কার। বিমানভ্রমণকে খ্রিস্টের উত্থানপর্বের সঙ্গে তুলনা করে আপলিনের বর্তমান কবিতায় মানুষের বৈমানিক প্রয়াসকে আধ্যাত্মিক তাত্পর্য দিতে চেয়েছেন। খ্রিস্টধর্ম আপলিনেরএর ধারণায় চিরন্তন এবং বর্তমান তাই তা প্রাচীন হয়ে যায় নি। অন্যদিকে আপলিনের পোপ দশম পাইয়াসকে সবচেয়ে আধুনিক ইয়োরোপীয়’ বলে অভিহিত করেছেন। পোপ দশম পাইয়াস ছিলেন অতান্ত রক্ষণশীল চরিত্রের আর সমস্ত রকমের আধুনিকতার’ বিরোধী। তিনি ট্যাঙ্গো নাচকে কামুক নৃত্য বলে নিযিদ্ধ করে ফর্মান জারি করেছিলেন। পরবর্তীকালে মাদলেনকে লেখা আপলিনেরএর একটা চিঠি থেকে বোঝা যায় যে আপলিনের সবই জানতেন। তবু ঐ পোপকে তিনি কেন আধুনিক বলে অভিহিত করলেন? এর কারণ বোধ হয়, পোপ দশম পাইয়াস একবার খ্রিস্টধর্মকে আধুনিক মানসিকতার উপযোগী হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। এছাড়া ১৯১১ সালের মে মাসে প্যারিসরোমতুরিন বিমান চালনার প্রতিযোগিতা হয়। পোপ তাঁর ভ্যাটিকানের প্রাসাদের ঝুলবারান্দা থেকে ঐ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী বৈমানিক বোমোঁকে (Beaumont) আশীর্বাদ করেন। আশীর্বচনে পোপ বিমানচালনার প্রসঙ্গে খ্রিস্টের উত্থানপর্বের (Ascension) কথা উল্লেখ করেন। মনে হয় পোপের এই উক্তি আপলিনেরকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে ভবিষ্যদবাদী ইতালীয় কবি মারিনেত্তি ‘পোপের মনোপ্লেন’ নামক একটি কবিতা লিখেছিলেন। ভবিষ্যবাদ সম্পর্কে উত্সাহী আপলিনের নিশ্চয় ঐ রচনাটির কথা জানতেন। প্যারিসরোম বিমানঅভিযান প্রতিযোগিতা নিয়ে এদমঁ রস্তঁ (Edmond Rostand), জঁ একার (Jean Aicard) এবং আরো অনেক কবি কবিতা লেখেন। বিমানভ্রমণ কবিদের মধ্যে এমন উত্সাহ জাগায় যে ১৯১০ থেকে আকাদেমি ফ্রঁসেজ ‘আকাশবিজয়’ নামে এক কবিতাপ্রতিযোগিতা শুরু করে।

প্রসপেকটাস ক্যাটালগ আর পোস্টার : ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসের ‘লে সোয়ারে দ পারি’ পত্রিকায় প্রকাশিত অঁদ্রে বিলি(André Billy) লেখা ‘আমি কী করে কবি হলাম’ (Comment je suis devenu poète) রচনা খেকে জানা যায় যে ক্যাটালগ, পোস্টার আর নানান ধরনের বিজ্ঞাপনের মধ্যেই নতুন যুগের কবিতা রয়েছে বলে আপলিনের মনে করতেন।

গোয়েন্দা গল্পে ঠাসা : এর মধ্যে কোন কটাক্ষ বা বিদ্রূপ নেই, কেননা জনপ্রিয় গোয়েন্দাগল্পে আপলিনেরএর বিশেষ অনুরাগ ছিন।

রনে দালিজ (René Dalize) : আপলিনেরএর স্কুলের বন্ধু। তাঁর আসল নাম রনে দ্যুপ্যুই (René Dupuis) মোনাকোর স্যাঁশার্লে ১৮৯২ সালে আপলিনেরএর সঙ্গে রনে দ্যুপ্যুইএর পরিচয় হয়। তাঁরা একই ক্লাসে পড়তেন। পরে প্যারিসে এসে ১৯০৩ সালে আবার তাঁদের দেখা হয়। দুজনেই সাহিত্যজগতে পরিচিত হয় ওঠেন। দ্যুপ্যুইএর বাবার একটা খবরের কাগজ ছিল। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জগতে রনে দ্যুপ্যুই রনে দালিজ ছদ্মনামে পরিচিত হন। ‘লে সোয়ারে দ পারি’ পত্রিকার তিনি ছিলেন অন্যতম সহযোগী। ১৯১৭ সালে তিনি যুদ্ধে মারা যান। আপলিনের তাঁর ‘কালিগ্রাম’ (Calligrammes) বইটি রনে দালিজকে উত্সর্গ করেন।

খ্রিস্টের দীপ্ত মহিমা … : খ্রিস্টের যে রূপ এখানে বর্ণিত হয়েছে তা দেখা যায় নৎর্দাম (Notre-Dame) ও অন্যান্য প্রাচীন গির্জের স্ফটিকচিত্রে। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, কবির মার সাক্ষ্য অনুসারে শৈশবে আপলিনের খুবই ধার্মিক ছিলেন।

এই সেই স্থলপদ্ম … : এখানে জিশুর বর্ণনায় প্রাচীন ও প্রথাগত বাইবেলঅনুপ্রাণিত শব্দব্যবহারে একটি স্তোত্রের অনুষঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। ‘যন্ত্রণাকাতর মায়ের সিঁদুরে রঙ ছেলে’ একদিকে মধ্যযুগীয় চিত্রে জিশুর ছবির রঙের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যদিকে তা ক্যাথলিক গির্জেয় উচ্চারিত ল্যাটিন স্তব Stabat Mater dolorosa… মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপলিনের ধর্মীয় স্তোত্র লিখতে চান নি; ‘এই সেই খ্রিস্ট যিনি বিমানচালকদের চেয়েও…’ ইত্যাদি দুই পক্তি নাটকীয়ভাবে সমস্ত রচনাকে অন্য এক তাত্পর্যের অভিমুখী করেছে। তাছাড়া কবিতার পরের অংশে খ্রিস্টের উত্থান আধুনিক মানুষের বৈমানিক প্রয়াসের উপমেয় হিসেবে তার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে।

জুডিয়ার সাইমন গুণিন : সাইমন ছিলেন সামারিয়ার বাসিন্দা, জুডিয়ার নয়। জিশুশিষ্য সন্ত পিটারের কাছ থেকে জাদুকর সাইমন অলৌকিক ঘটনাসংঘটনের ক্ষমতা কিনতে চেয়েছিলেন। সাইমন গুণিনের কাহিনি আপলিনেরকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি ‘সাইমন গুণিন’ (সিমোঁ মাজ/Simon mage) নামে একটি গল্পও লিখেছিলেন।

চোর : ফরাসিতে যে শব্দশ্লেষ রয়েছে বাংলায় তা রাখা যায় নি। ফরাসি voler ক্রিয়ার অর্থ হল : . ওড়া, . চুরি করা — তার থেকে আসা voleur শব্দের স্বভাবত দুটি অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে : . চোর, . উড়ন্ত (ব্যক্তি)। বাংলা অনুবাদে প্রথম অর্থ গ্রহণ করে মূলের অর্থপরিধিকে খণ্ডিত করা হয়েছে।

জিশুর উত্থানপর্বের প্রসঙ্গে আপলিনেরএর বর্ণনা কোলনের ম্যুজিয়ামে রাখা প্রাচীন জার্মান ছবির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সে ছবি আপলিনের দেখেছিলেন। ছবিতে আছে ডানাওয়ালা ক্রুশে ভর করে যিশু আকাশে উড়ছেন — চারদিকে ঘিরে আছে বিমানকে।

ইকারুস … : পৌরাণিক যুগ থেকে মানুষের ওড়ার স্বপ্ন আর চেষ্টার কথা আপলিনেরএর বারবার মনে পড়ে যায়। গ্রিক পুরাণের চরিত্র ইকারুস (Icarus, গ্রি. ইকারস/ Ίκαρος, . ইকার/Icare) পিতা দিদালুসের সঙ্গে মিনস কর্তৃক গোলকধাঁধায় বন্দী হন। মিনসএর স্ত্রী তাঁদের মুক্ত করে দেন। তখন পালানোর জন্য ইকারুস পিতার সঙ্গে মোম দিয়ে লাগানো ডানার সাহায্যে আকাশে উঠে যান —পিতার উপদেশ ভুলে গিয়ে, ওড়ার আনন্দে তিনি সূর্যের দিকে এগিয়ে গেলেন। তখন উত্তাপে মোম গলে গিয়ে ডানা খসে পড়ল আর ইকারুস সমুদ্রে পড়ে গেলেন।

ইহুদিপুরাণ অনুসারে ইনক (Enoch) হলেন কাইনএর পুত্র। আর ইহুদি সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষদের একজন ছিলেন ইলাইজা (Elijah, . এলি/Elie)। ইহুদি পুরাণের মতে, ঈশ্বর ইনক আর ইলাইজাকে আগুনের রথে করে আকাশে (স্বর্গে) তুলে নিয়েছিলেন।

আপলোনিয়স দ তিয়ান (Apollonios de Thyane, . Apollonius of Tyana) : খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের পিথাগোরাসঅনুগামী গ্রিক দার্শনিক। এই প্রাজ্ঞ দার্শনিককে জাদুকর বলে ভাবা হত আর খ্রিস্টের প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করা হত।

অর্ফিয়ুস, ইকারুস, মার্লিনএর মতো আপলোনিয়স দ তিয়ানও তাঁর অলৌকিক, মায়াবী ‘ক্ষমতার’ জন্য আপলিনেরএর কাছে কবির প্রতীক বলে গণ্য হতেন।

রক (Roc): ‘আরব্যরজনী’র কাল্পনিক পাখি।

মারাবু (Marabout): আফ্রিকার দীর্ঘচঞ্চু পাখি। মারাবু শব্দের অন্য অর্থ ভবিষ্যৎদ্রস্টা আফ্রিকান দৈবজ্ঞ বা পির। মারাবু পাখিকে ইংরেজিতে বলা হয় ibis।আইবিস।

পিহি : আপলিনেরবিশেষজ্ঞ দেকোদ্যাঁর মতে এই চৈনিক পাথির কল্পনার সূত্র হল ১৮৯৬ সালের জানুয়ারিফেব্রুয়ারি মাসের ‘এশিয়াবিষয়ক পত্রিকা’য় (Journal asiatique) প্রকাশিত প্রাচীন চিন সম্পর্কে একটি রচনা। সে রচনায় জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ানো এক চোখওয়ালা পিমু মাছ আর একটি ডানাওয়ালা পিই পাখির কথা দেখা যায়। এই পাখির উল্লেখ আপলিনেরএর ‘জানলা’ (Les fenêtres) কবিতাটিতেও লক্ষ্য করা যায়। পিমু মাছের উল্লেখ রয়েছে ‘দরজা’ (La porte, অনুবাদে নেই) কবিতায়। চিন সম্পর্কিত রচনাটিতে ঐ কাল্পনিক পাখিটির নামের ফরাসি বানান ছিল pi-i, আপলিনের তাকে একটু পাল্টে নিয়ে লিখেছেন pihi, বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে হওয়া উচিত ছিল পি, কিন্তু আমরা উচ্চারণের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেছি পিহি।

ভালোবাসার যন্ত্রণা : ১৯১২ সালের গ্রীষ্মে মারি লোরস্যাঁর সঙ্গে কবির সম্পর্কের ছেদ হয়। ‘এলাকা’ কবিতা বস্তুতপক্ষে একদিকে আপলিনেরএর সেই প্রণয়াবসানের কবিতা আর অন্যদিকে তার মধ্যে রয়েছে বেদনাময় স্মৃতির যন্ত্রণা। প্রসঙ্গত পরবর্তী ‘মিরাবো সেতু’ কবিতাটির টীকা দ্রষ্টব্য।

শার্ত্র্এর মেরি মাতা : প্যারিস থেকে ৯৬ কিলোমিটার দূরে শার্ত্র্ (Chartes) শহর তার ক্যাথিড্রালের জন্য বিখ্যাত। দ্বাদশত্রয়োদশ শতকে নির্মিত এই গির্জে প্যারিসের নৎর্ দামএর মতো খ্রিস্টের কুমারী মাতাকে নিবেদিত। মধ্যযুগ থেকে এই গির্জে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মীদের বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র।

মোঁমার্ত্র্ (Montmartre) : প্যারিস শহরের উত্তর অংশে একটি ছোট পাহাড় বা টিলা। উনিশ শতকের শেষ দিকে এই টিলার চূড়ায় একটি বড় গির্জে বানানোর পরিকল্পনা হয় (১৮৭৩)। ১৯১০ সালে গিজেটির নির্মণ শেষ হয়। এই বিপুলাকার গির্জে বা বাজিলিকটির নাম ‘পবিত্র হৃদয়’ বা সাক্রে ক্যর (Sacré-cœur) মোঁমার্ত্র্এর টিলার গায়ে যে পুরনো পাড়া রয়েছে তার নাম মোঁমার্ত্র্ পাড়া। এই পাড়া ছিল এককালে, বিশেষ করে বিশ শতকের প্রথম দিকে, শিল্পীদের পাড়া। শিল্পীদের বন্ধু আপলিনের, সঁদ্রার প্রভৃতি কবিসাহিত্যিকরা এখানা নিত্য যাতায়াত করতেন।

চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ শহরে রয়েছে সন্ত ভিৎ (Saint Vit) ক্যাথিড্রাল আর হ্রাদচিন (Hredchin = Hradschin) রাজপ্রসাদ।

কোব্লঁস (Coblence, জর্মন, কোব্লেনত্স/Koblenz) জার্মানির, লেইদ (Leyde) বেলজিয়ামের আর গুডা (Gouda) হল্যান্ডের শহর।

প্যারিসে তুমি দায়রা জজের আদালতে : ১৯১১ সালে লুভ্র্ ম্যুজিয়াম থেকে মূর্তি চুরির ব্যাপারে গ্রেপ্তার হওয়ার স্মৃতি।

বিশ আর তিরিশ বছরে : কবি যখন এ কবিতা লিখেছেন তখন তাঁর বয়স বত্রিশ — বিশ আর তিরিশ বছর বয়সের যে ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি তাঁর মনে পড়ছে তী হল আনি প্লেডেন (Annie Playden) ও মারি লোরঁস্যাঁ(Marie Laurencin) কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ইতিহাস।

স্যাঁলাজার স্টেশন : আপলিনের কিছুদিন তাঁর মার সঙ্গে প্যারিসের শহরতলিতে থাকতেন। প্যারিসের অন্যতম রেলস্টেশন স্যাঁলাজার দিয়ে তাঁকে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হত।

বাইবেলের জ্ঞানী রাজা : নক্ষত্রের অবস্থান লক্ষ করে প্রাচ্যের জ্ঞানী রাজারা ত্রাণকর্তা জিশুর জন্মসংবাদ অবগত হন এবং নবজাত ঈশ্বরপুত্রকে দেখার জন্য নক্ষত্রকে অনুসরণ ফরে সুদীর্য পথপরিক্রমান্তে বেখলেহেমএ পৌঁছান।

লাল একটা লেপ : পোলাণ্ডের লোকদের কাছে লাল লেপ করিবারের প্রতীক। আপলিনেরএর মা ছেলেকে পরিবারের প্রতীক একটা লাল লেপ দিয়েছিলেন।

ওত্যই : ১৯০৯ থেকে আপলিনের ওত্যই পাড়ায় থাকতেন ।

ওসেয়ানা আর গিনির দেবদেবী : বিশ শতকের প্রথম দিকে ইয়োরোপীয় শিল্পীরা কালো মানুষদের আদিম শিল্পকলাকে আবিষ্কার করেন। শিল্পীদের বন্ধু তথা শিল্পরসিক আপলিনেরও এই আদিম শিল্পকলা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

নিকৃষ্ট খ্রিস্ট : আজকের পাঠকের কাছে ‘নিকৃষ্ট’ বিশেযণটি বর্ণবিদ্বেষের পরিচায়ক বলে মনে হবে — কিন্তু আপলিনের এ ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই সচেতন ছিলেন না। বিশেষণটি তত্কালীন ইয়োরোপীয় মানসিকতার প্রকাশ।

মিরাবো সেতু ( Le Pont Mirabeau)

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় লে সোয়ারে দ পারি’ (Les Soirées de Paris) পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় অর্থাৎ ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই প্রথম প্রকাশের খুব বেশিদিন আগে কবিতাটি লেখা হয়েছিল বলে মনে হয় না । ১৯১১ সালে লেখা একটি অপ্রকাশিত কবিতার খসড়ার মধ্যে বর্তমান কবিতার ধ্রুবপদ দুটি পাওয়া যায়।

১৯১৫ সালে একটি চিঠিতে আপলিনের তাঁর বান্ধবী মাদলেনকে জানিয়েছিলেন যে মিরাবো সেতু’ কবিতাটিসেই নারীর সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কের অবসানের বিষন্ন সঙ্গীত ‘এলাকা’ (Zone) কবিতাকে অনুপ্রাণীত করেছিলেন আর পরে ঐ কবিতার জার্মান অনুবাদের প্রচ্ছদের জন্য ঘোড়ার পিঠে আমার ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। এই নারী মারি লোরঁস্যাঁ (Marie Laurencin, ১৮৮৫১৯৫৬) ১৯০৭ সালে পিকাসোর মাধ্যমে এই মহিলাশিল্পীর সঙ্গে আপলিনেরএর পরিচয় হয়। আপলিনেরএর বয়স তখন ২৭, মারির ২২। ১৯১২ সাল পর্যন্ত নানা ঘাতপ্রতিঘাত সত্ত্বেও তাঁদের সম্পর্কে বজায় ছিল। কিন্তু ক্রমশ তা চিড় থেতে শুরু করল, বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। ১৯১২ সালে লেখা মিরাবো সেতু,’ ‘মারি’ (Marie) এবং এলাকা’ কবিতার মধ্যে এই বিচ্ছোদের অনুভূতি কবিতার বিষয়গত উপাদানে মিশে রয়েছে। পরবর্তীকালে আপলিনের এই বিচ্ছেদের স্মৃতিকে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক স্মৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন।

১৯১৪ সালে আপলিনেরএর নিজের কণ্ঠে পড়া তিনটি কবিতা রেকর্ড করা হয়। এই তিনটি কবিতার একটি ছিল ‘মিরাবো সেতু’।

এলাকা’ যেরকম ‘সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে আলোচিত কবিতা, ‘মিরাবো সেতু’ ও ‘মারি’ তেমনি এই বইয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা । এই কবিতায় গীতিময় ধ্বনি, ছন্দোম্পন্দন, ঐতিহ্যানুসারী রোমান্টিক কাব্যভাষা সব ধরনের পাঠকেরই প্রিয়। ফরাসি গীতিকবিতার চিরায়ত ঐতিহ্যের আধারে রচিত এ কবিতার ছন্দের সঙ্গে সমালোচক মারিও রক (Mario Roques) ত্রয়োদশ শতকের ফরাসি গীতিকবিতা একটি শঁসোঁ দ তোয়াল’এর (Chanson de Toile) ছন্দের সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। আবার বিখ্যাত আপলিনেরবিশেষজ্ঞ মিশেল দেকোদ্যাঁ (Michel Décaudin) কবিতাটির ধ্রুবপদের দ্বিতীয় চরণের সঙ্গে চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত কবি ফ্রঁসোয়া ভিইয়োঁ(François Villon) শেষ ইচ্ছা’ (Testament) কবিতার একটি পক্তির মিল খুঁজে পেয়েছেন। বলা যায়, মধ্যযুগীয় শঁসোঁ দ তোয়াল’ বা ফ্রঁসোয়া ভিইয়োঁ থেকে ভের্লেন পর্যন্ত ফরাসি গীতিকবিতার ঐতিহ্যের ধারা আপলিনেরএর কবিতায় এসে মিশেছে আর তারপর সেই ধারা তাঁরই কবিতার মধ্যে বিশ শতকের আধুনিকতার নৈচিত্র্যের অন্তরালে অন্তঃসালিলা হয়েছে ।

লে সোয়ারে দ পারি’ পত্রিকায় যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন কবিতাটিতে ছেদচিহ্ন এবং প্রতিটি স্তবকে তিনটে সমান (দশ) অক্ষরের পক্তি ছিল। পরে বইয়ের প্রথম প্রুফে কবি ছেদচিহ্ন তুলে দেন এবং প্রতিটি স্তবকের দ্বিতীয় পঙক্তিকে দুভাগে ভাগ করে সাজান। এতে ছন্দের একটা নাটকীয় দোলা আর সুরবৈচিত্র্য স়ৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া, ছেদচিহ্নের লোপ কবিতাটিতে এক ধরনের প্রবহমান গতিময়তার সৃষ্টি করেছে।

বর্তমান কবিতাটির আরো চারটি বাংলা অনুবাদ আমরা পড়েছি। প্রথম অনুবাদটি বিষ্ণ দে, যা তাঁর বিদেশি কবিতার অনুবাদসংকলনে রয়েছে। অনুবাদটি সুপরিচিত। দ্বিতীয় অনুবাদটি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের, এটি একটি সাহিত্যপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান অনুবাদের (সম্ভবত) পরে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত একটি সাহিত্যপত্রিকায় আর বাংলাদেশে শিশির ভট্টাচার্য তাঁর ‘আপলিন্যাখ্’ গ্রন্থে বর্তমান কবিতাটির অনুবাদ করেন। পাঠক বিষ্ণু দে, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, শিশির ভট্টাচার্য আর আমাদের অনুবাদ পড়ে মূলের সাংগীতিক ধ্বনিমূর্ছনাকে পরোক্ষভাবে কিছুটা অনুভব করতে পারবেন। বিষয় বা প্রকাশের দিক থেকে বর্তমান কবিতাটি কোনো অর্থেই নতুন নয়। একটা প্রবহমান বিধুরতার বোধ আর ব্যঞ্জক ধ্বনিময়তাই কবিতাটিকে অনন্য করে তুলেছে । কবিতার ধ্বনিময় সংস্থান অনুবাদে রূপান্তরিত করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমরা তার কিছুটা আভাস দিতে চেষ্টা করেছি।

মিরাবো সেতু’ প্যারিস শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সেন নদীর ওপরের অনেকগুলি সেতুর একটি। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৭ সালে এই সেতুটি তৈরি হয় । ফরাসি বিপ্নবের অন্যতম নেতা মিরাবো (Honoré Gabriel Riqueti, comte de Mirabeau, ১৭৪৯১৭৯১) নামে এই সেতুর নামকরণ করা হয় আপলিনের ১৯০৯ সালের শেষ দিক থেকে ১৯১২র অক্টোবর পর্য়ন্ত প্যারিসের ওত্যই (Auteuil) পাড়ায় থাকতেন। যাতায়াতের পথে তাঁকেমিরাবো সেতু’ পার হতে হত।

সুখ’ দুঃখের জ্বালা’ র চেয়ে ‘আনন্দ’ (la joie) আরবেদনা’ (la peine) হয়ত মূলের নিকটতর শব্দার্থবহ বা প্রাতিশাব্দিক হত। মূল পঙক্তির শব্দার্থ:আনন্দ আসত চিরকাল বেদনার পরে’।

সেন নদীকে অবলম্বন করে এই কবিতার সমধর্মী অনুভব পাওয়া যায় ‘মারি’ (Marie) কবিতার একটি পক্তিতে। সেখানেও কবির মনে হয়েছে: le fleuve est pareil à ma peine।নদী আমার বেদনার অনুরূপ।

প্রহরের ঘণ্টা বাজুক (sonne l’heure): এর ইয়োরোপীয় অনুষঙ্গ প্রহর গড়াক’ তর্জমায় কিছুটা রূপান্তরিত হয়েছে।

ধ্রুবপদের দ্বিতীয় পক্তির দিন [গুলি] (les jours)কে প্রথম পক্তিতে নিয়ে আসা হয়েছে।

গতিহীন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কিছুটা অন্ত্যমিলের খাতিরে, কিছুটা কালের বহমান গতির বৈপরীত্য নির্দেশের জন্য ।

অবসিত জড়িমায় : মূলের শব্দার্থ হল ‘এমন অবসন্ন’ (si lasse)

দুরাশার মায়া : বাংলা কবিতার প্রথাগত ভাষায় মূলের আশা’ (L’espérance) শব্দটিকে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

যেন কিরকম তীব্র ভয়ংকর : মূলে রয়েছে comme… violente।কিযেভয়ংকর।

বন্ধন ( Liens)

কবিতাটি ‘মোঁজোয়া’ (Montjoie) পত্রিকায় ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

বন্ধন’ ‘কালিগ্রাম’ বইয়ের ‘ঢেউ’ অংশের তথা ‘কালিগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা। কবিতাটি আলাদা হরফে (ইটালিক্স্ টাইপে) ছাপা হয়েছিল। মনে হয়, কবি রচনাটিকে ‘ঢেউ’ অংশ তখা ‘কালিগ্রাম’ বইয়ের মুখবন্ধকবিতা হিসেবে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন।

বন্ধন’ কবিতার মধ্যে আপলিনের যেন এক নতুন কাব্যতত্ত্বের প্রস্তাবনা রচনা করেছেন। এখন থেকে ইন্দ্রিয়ানুভূতি অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বর্তমানের মধ্যে বেঁচে থাকাটাই হবে তাঁর কবিতার অবলম্বন, সেই কবিতায় প্রতিবেশ রচনা করবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনে ভরা আধুনিক পৃথিবী। আর এই বর্তমান অতীতের প্রতিপক্ষ — ইন্দ্রিয়ানুভূতি হল স্মৃতি, কামনা, অনুতাপ আর চোখের জলের শত্রু ।

কিন্তু কবিতার শেষ পঙক্তিতে আপলিনের অতীতের আবেগময় অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেন নি। তাই ‘বন্ধন’ কবিতাটি শেষ পর্যন্ত একই সঙ্গে বিচ্ছেদ ও যোগসূত্রের কবিতা। অতীতের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা বলেও কবি ‘এখানে যা কিছু ভালোবাসেন’ তার কথা বলেছেন। ‘এখনো ভালোবাসা’র কথা বলার অর্থ হল অতীতের সঙ্গে যোগসূত্রের স্বীকৃতি। বলা যায়, ‘সবরকমের বাঁধনছাড়া’ মানুষ হওয়া শেষ পর্যন্ত কবির সম্ভব হয় নি।

আমরা বাংলায় ‘বন্ধন’ কবিতাটির ইটালিক্স্ হরফে ছাপা রূপ রাখি নি, কেননা ইটালিক্স্ হরফ বাংলায় আমাদের দৃষ্টিকে কিছুটা পীড়িত করে।

জানলা (Les Fenêtres)

এ কবিতাটি শিল্পী রবের দলোনে(Robert Delaunay, ১৮৮৫১৯৪১) জার্মানিতে চিত্রপ্রদর্শনীর আলব্যামক্যাটালগে প্রথম প্রকাশিত হয়, তারপর প্রকাশিত হয় পোএম এ দ্রাম’ (Poème et Drame) পত্রিকার দ্ধিতীয় সংকলনে (জানুয়ারি ১৯১৩)

আপলিনেরএর বন্ধু অঁদ্রে বিলি(André Billy) স্মৃতি অনুসারে, আপলিনের, দ্যুপুই (রনে দালিজ) আর বিলি একদিন ক্রুসিফিক্স্ (Crucifix) কাফেতে বসে ছিলেন। হঠাৎ আপলিনের হো হো করে হেসে উঠে বললেন যে শিল্পী দলোনের প্রদর্শনীতে ক্যাটালগের মুখবন্ধ হিসেবে তাঁর একটা কবিতা লেখার কথা, কিন্তু ব্যাপারটা তিনি একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। তত্ক্ষণাৎ তিনি বেয়ারার কাছ থেকে কাগজকলম চেয়ে নেন আর তিনজনে মিলে একটি কবিতা লিখবেন স্থির করেন। তাঁরা প্রত্যেকে এক একটি করে পঙক্তি বলতে থাকেন, এবং এভাবে কবিতাটি রচিত হয়। বিলির এই স্মৃতিচারণার পর দলোনে জানান, আপলিনের তাঁর স্টুডিয়োতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী সোনিয়ার সামনে বসে কবিতাটি লিখেছিলেন। কবিতায় ব্যবহৃত উপাদান জানলা, জানলার সামনে হলুদ জুতো ইত্যাদি স্টুডিওতেই ছিল। বিতর্কে বিলি আবার প্রমাণ হিসেবে জানান যে ইতালিয়ান বারে বসে তাঁরা তুরিনএর (Turin) মদ খাচ্ছিলেন, তাই তুরিনিজ তরুণীর প্রসঙ্গ এসেছে ; এছাড়া তাঁরা সময়’ (Le Temps) আর স্বধীনতা’ (La Liberté) নামে দুটি সান্ধ্য পত্রিকা কিনেছিলেন, তারই অনুযঙ্গে রচিত হয়েছে যখন সময় থাকে স্বাধীনতা থাকে’।

বোঝা যাচ্ছে কবিতাটির রচনা সম্পর্কে বিতর্কের মূল প্রশ্ন হল, কবিতাটি একটি ‘সংলাপকবিতা’ না দলোনের স্টুডিয়োতে ‘লেখা’ কবিতা। বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে কাফেতে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আপলিনের একটা ‘সংলাপকবিতা’ রচনা করেন, তারপর দলোনের বাড়িতে ঐ ‘সংলাপকবিতাটিকে’ খসড়া হিসেবে ব্যবহার করে তাকে একটা সুনির্দিস্ট রূপ দেন। এছাড়া এই ইতিহাসের মধ্যে আমরা আরো দুটি জিনিস লক্ষ করি। প্রথমত, আপলিনের নতুন রচনারীতির সন্ধান করছিলেন, তাতে তিনি সংলাপ, তাৎক্ষণিক দেখা বস্তু (জানলা, জুতো ইত্যাদি) ব্যবহারকে পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া কবিতার রচনা সম্পর্কে এক ধরনের ‘ইতিহাস’ তৈরি করতে তিনি ভালোবাসতেন। তাই বন্ধুদের কারো কাছেই তিনি কবিতা রচনার পুরো ইতিবৃত্ত জানান নি, ‘অঁদ্রে সালমোঁর বিয়েতে পড়া কবিতা’র ক্ষেত্রেও আমরা এই কবিতা রচনার ‘ইতিহাস’ তৈরির প্রবণতা লক্ষ করি।

পিহি : ‘এলাকা’ কবিতার টীকা দ্রস্টব্য ।

সমুদ্রসজারু : মূলে আছে oursin (উর্স্যাঁ) যাকে ইংরেজিতে বলে sea-urchin বা sea-hedgehog.

কাপ্রেস : আমরা মূলের Capresse শব্দটিই ব্যবহার করেছি। কাপ্রেস বলা হয় ফরাসি পশ্চিম ভারতীয় দ্ধীপপুঞ্জে আফ্রিকান ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত দোআঁশলা মেয়েদের।

শাব্যাঁ (পুং.), শাবিন (স্ত্রী.) (Chabin, Chabine): এক ধরনের লম্বা, কর্কশ লোমওয়ালা ভেড়া। এদের ছাগল আর ভেড়ার সংকর বলে ভাবা হত।

ভোঁদরশিকারি : মূলে রয়েছে আমেরিকার এক ধরনের লোমশ প্রাণীর নাম যাকে ফরাসিতে বলে raton (রাতোঁ ই. Racoon)

ভ্যাংকুভার (Vancouver) : ক্যানাডার বন্দরনগর। ইয়ের (Hyères) ম্যাঁৎনোঁ (Maintenon) ফ্রান্সের দুটি ছোট শহর।

স্যাঁমেরির বাঁশিবাজিয়ে (Le musicien de Saint-Merry)

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি, লে সোয়ারে দ পারি’ (Les soirées de Paris) পত্রিকায় । অঁদ্রে সালমোঁ (André Salmon) তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:

১৯০৯ সালের ১৩ই জুলাই, … গিয়োম প্রথমবার স্যাঁমেরি গির্জেয় প্রবেশ করল। গির্জেটি তার খুব ভালো লাগল আর পুরনো ঐ পাড়ার অনন্য চরিত্রটাও তাকে মুগ্ধ করল। একদিন গিয়োম আপলিনের একা একা স্যাঁমেরিতে ফিরে এল, গির্জের ভেতর ঢুকে দেখল আর পাড়ার পুরনো অলিগলিতে ঘুড়ে বেড়াল, আর এই অভিজ্ঞতা থেকেই তার মনে রচিত হল স্যাঁমেরির বাঁশিবাজিয়ে’। কিছুই কখনো চূড়ান্তভাবে স্পষ্ট হয় নিমহাফেজখানার সর্বভূক পোকা, বিস্ময়বিহ্বল প্রত্নবিশারদ, এক ধরনের মজাদার পাণ্ডিত্যের অধিকারী গিয়োম আপলিনের কি কোথাও পড়েছিল যে কোনো এক দুষ্ট পাদ্রি, অনেকদিন আগে, স্যাঁমেরি গির্জেটাকে শয়তানের কাছে নিবেদন করতে চেয়েছিল ?

অন্যদিকে জঁ মোলে (Jean Mollet) ১৯৪৮ সালের ১১ই নভেম্বর লে লেৎর্ ফ্রঁসেজ’ (Les Lettres françaises) পত্রিকায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কাহিনি উপস্থাপিত করেন। আপলিনেরএর সঙ্গে একবার প্যারিসএর পুরনো মারে’ (Marais) অঞ্চলে ভ্রমণের স্মৃতিতে তিনি লেখেন :

রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা, কাকপক্ষী নেই, গাড়িঘোড়ার চিহৃ নেই। ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য আমরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছিলাম, রেলিঙের সৌন্দর্য দেখার উদ্দেশ্যে বাড়ির বিভিন্ন তলায় উঠছিলাম। ঐ বাড়িগুলোর কোনো একটার ভেতরে সিঁড়ি ধরে নামার পথে, আমাদের চোখে পড়ল বাড়ির উঠোনে একজন বাজিয়ে আর একজন গায়ককে ঘিরে এক দঙ্গল লোক, ওরা গলা মিলিয়ে বারবার একটা গানের ধুয়ো ধরছিল। কারো মনে হতে পারত যেন সবগুলো রাস্তা এই উঠোনে এসে লোকজন সব উজাড় করে ঢেলে দিয়ে গেছে। ব্যাপারটা দেখে আমরা দুজনেই খুব অবাক হয়ে গেলাম। কয়েক দিন পর আপলিনের আমায় একটা কবিতা পড়ে শোনাল। কবিতার নাম বলল : ‘স্যাঁমেরির বাঁশিবাজিয়ে’।

১৯১৬ সালে, এই কবিতার বিষয় অবলম্বন করে আপলিনের একটি ব্যালের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ‘চোখ, নাক, কান ছাড়া মানুষটি’ (লম সঁজিয়ো, সঁ নে, সঁজরেই/ L’homme sans yeux, sans nez, sans oreilles)

মেঘের এক ছায়ামূর্তি (Un Fantôme de nuées)

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়লেজেক্রি ফ্রঁসে’ (Les Ecrits français) পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (ডিসেম্ভর, ১৯১৩) । এ কবিতাটি লেখার ইতিহাস সম্পর্কে কবির বন্ধু অঁদ্রে বিলি (André Billy) লিখেছেন, আপলিনের একটা গল্প লিখবেন বলে লেখাটি শুরু করেন, দশ লাইন লেখার পর কী লিখবেন তাঁর আর মাথায় আসে না, তখন তিনি ঐ দশ লাইনকে প্রথম দশ পঙক্তি (তিনটি স্তবক) হিসেবে রেখে একটি কবিতা লিখে ফেলেন।

এই কবিতাটি আপলিনেরএর কাব্যচিন্তা, কাব্যভাষা আর চিত্রকলার সঙ্গে কবিতার যোগাযোগ রচনার প্রয়াস হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন স্তরে কবিতাটির পাঠ সন্ভব। কবিতাটির নামের পেছনে হয়ত পুরাণপ্রিয় আপলিনেরএর চিন্তায় একটি পুরাণকাহিনির অনুষঙ্গ কাজ করেছে : রাজা ইক্সিয়নকে মায়াগ্রস্ত করার জন্য জিউস তাঁর স্ত্রীর চেহারার এক মেঘের মূর্তি তৈরি করেন। অন্যদিকে বাস্তব জগতের সৃষ্টিশীল শৈল্পিক রূপান্তর ঐ মেঘের ছায়ামূর্তি। অতান্ত বাস্তব দিনক্ষণ, রাস্তার নাম, মূর্তির নাম থেকে অবাস্তবে পৌছে গেছে কবির যাত্রা — সহজে, অনায়াসে। আবার কবির ঐ সময়কার কবিতা ‘জানলা’ (Les Fenêtres) যেমন শিল্পী দলোনে(Delaunay) ছবির সঙ্গে সম্পর্কেত তেমনি বর্তমান কবিতার সমান্তরালে রয়েছে পিকাসো(Picasso) ছবি বিশেষ করে ১৯০৪ সালে আঁকা বল নিয়ে বাজিকর’ (আক্রোবাৎ আ লা বুল/Acrobate à la boule) ছবিটি। আপলিনের কিউবিস্ট চিত্রকরদের সম্পর্কে তাঁর আলোচনায় পিকাসোর ছবির প্রসঙ্গে যেসব কাব্যিক বর্ণনাত্মক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় কবিতাটির মধ্যে।

১৪ই জুলাই : ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাতে ১৪ই জুলাই বিদ্রাহী জনতা রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারের প্রতীক বাস্তিই (Bastille) দুর্গ অধিকার করে। এই দিনটি তাই ফরাসি সাধারণতন্ত্রে জাতীয় দিবস’ হিসেবে পরিগণিত ও পালিত হয়।

স্যাঁজের্ম্যাঁদেপ্রে (Saint-Germain-des-Prés) : প্যারিস শহরের সেন নদীর বাম তীরবর্তী অংশে ৬ষ্ঠ শতকে প্রতিষ্ঠিত একটি মঠ যার মধ্যে যুক্ত হয়েছিল দশমএকাদশ শতকে নির্মিত একটি গির্জে। ধর্মবিরোধী বিপ্লবীদের হাতে মঠটি ধ্বংস হলেও গির্জেটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রক্ষা পায়। উনিশ শতকে গির্জেটির সংস্কার করা হয়। বর্তমান স্যাঁজের্ম্যাঁদেপ্রে বললে বুলভার স্যাঁজের্ম্যাঁর ওপর এ গির্জেটিকেই বোঝায়। ১৯১২ সালের অক্টাবর মাসে আপলিনের ২০২, বুলভার স্যাঁজের্ম্যাতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। ১৯১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এখানেই তিনি থাকতেন। তাঁর এই বাসাটি ছিল স্যাঁজের্ম্যাঁদেপ্রে গির্জের কাছেই।

দঁতোঁ (জর্জজাক দঁতোঁ/ Georges-Jacques Danton, ১৭৫৯১৭৯৪): ফরাসি বিপ্লবের এই নেতার মূর্তি রয়েছে স্যাঁজার্ম্যাঁদেপ্রে গির্জে থেকে বুলভার স্যাঁজের্ম্যাঁ ধরে বুলভার স্যাঁমিশেলের দিকে এগিয়ে গেলে একটু পরেই ডানদিকে, মেট্রো স্টেশন ওদেঁও’ (Odéon) প্রবেশ পথে।

প্রথম দশ পঙক্তির বাস্তব পরিবেশের পটভূমিতে কবি পিকাসোর ছবির জগতের সহধর্মী এক জগৎ রচনা করতে শুরু করেন, যেখানে বাস্তব ধীরে রূপান্তরিত হয়। তখন বাস্তব বর্ণনার অংশও অন্য এক অর্থ লাভ করে ; ১৪ই জুলাইয়ের আগের দিন — বিপ্লবের আগের মুহূর্ত, দঁতোর মূর্তি — বিপ্লবের প্রতীক, — কালের সাক্ষী স্যাঁজের্ম্যাঁদেপ্রের গির্জে — এসব অনুষঙ্গের মধ্যে যেন কবিতা তথা শিল্পের বিপ্লব ঘোষিত হচ্ছে। তখন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখা বুড়ো মাদারি এক ঐতিহ্যানুসারী কবি হয়ে গিয়ে ব্যারেলঅর্গানের যান্ত্রিক সঙ্গীত শোনায় আর তার অর্গানের তলা দিয়ে বেরিয়ে আসে নতুন করিতার স্রষ্টা — সমস্ত মানবিক ব্যাপার যে পেরিয়ে যায় — বাস্তব থেকে অনায়াসে, অকৃত্রিমভাবে অবাস্তবে, অলৌকিকে পৌছে যায়।

প্রসঙ্গত স্মরণীয়, রিল্কে(Rilke)ডুইনো এলিজি (Duino Elegy) পঞ্চম এলিজির অবলম্বনও প্যারিসের রাস্তার মাদারি। ১৯২২ সালে এই কবিতা লেখার আগে রিল্কে আপলিনেরএর কবিতাটি পড়েছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। মনে হয়, আপলিনেরএর কবিতাটির মতোই রিল্কের কবিতারও প্রাথমিক সূত্র ছিল তাঁর প্যারিসের জীবন ও পিকাসোর ছবি।

হৃদয় রাজমুকুট আর আয়না (Cœur couronne et miroir)

এই চিত্রকবিতাটি আরো দুটি চিত্রকবিতার সঙ্গে ১৯১৪ সালের জুলাইঅগাস্ট মাসের লে সোয়ারে দ পারি’ (Les soirées de Paris) পত্রিকার যুগ্ম ২৬/২৭ সংথ্যায় প্রকাশিত হয়।

১৯১৪ সালের লে সোয়ারে দ পারি’ (Les soirées de Paris) পত্রিকার ২৪ সংখ্যায় (জুন) সমুদ্রপত্র’ (Lettre-Océan) নামে আপলিনেরএর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি মেক্সিকোতে পাড়ি দেওয়া কবির ছোট ভাই আলবেরকে (Albert) উদ্দেশ করে লেখা। কবিতাটির শব্দগুলি প্রথমে কয়েকটি পঙক্তির আকারে থাকলেও তার পরেই জ্যামিত্যিক বিন্যাসে চারদিকে ছড়ানো আর একটা বিশেষ আকারে সাজানো যেন শব্দ দিয়ে একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য ছবি তৈরি করা হয়েছে। এ কি কবিতা ? আপলিনের এর নাম দিলেন ইদেওগ্রাম লিরিক’ (Idéogramme lyrique)। চারদিকে আলোড়ন উঠল। লে সোয়ারে দ পারি’ পত্রিকার পরের সংখ্যায় গাব্রিয়েল আর্বুয়্যাঁ (Gabriel Arbouin) আপলিনেরএর প্রয়াসকে সমর্থন করে এক প্রবন্ধ লিখলেন। পত্রিকার ২৬/২৭ যুগ্ন সংখ্যায় আপলিনেরএর আরো তিনটি চিত্রকবিতা প্রকাশিত হল। ঘোষণা করা হল, আপলিনেরএর এই চিত্রকবিতাগুলি বর্ণময় মুদ্রণে একটি এক ফর্মার পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হবে। তার যে ডামি তৈরি করা হয় তাতে আপলিনের নিজের নামের নিচে লিখেছিলেন আর আমিও চিত্রকর’ (এ মোয়া ওসি জ স্যুই প্যাঁৎর্ /Et moi aussi je suis peintre) ঠিক ছিল কবির একটা ছবির নিচে তাঁর নামের তলায় ব্যক্যটি ছাপা হবে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এই পরিকল্পনা আর বাস্তবে রূপায়িত হতে পারল না। পরে আপলিনের এ জাতীয় চিত্রকবিতাকে ইদেওগ্রাম’এর পরিবর্তে ‘কালিগ্রাম’ (Caligramme) নামে অভিহিত করলেন। Idéogramme শব্দের ব্যুত্পত্তিগত অর্থদৃশ্যলিপি’। ভাষাতাত্ত্বিক অর্থে idéogramme বলতে বোঝায় সেই লিপি যাতে ধারণাকে ন্যূনতম রেখাচিত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, এই লিপিতে ন্যূনতম রেখাচিত্র ধ্বনিমূল (ফোনিম) বা ধ্বনির পরিবর্তে শব্দমূল (মর্ফিম) বা শব্দকে সংকেতিত করে। চিনা ভাষার লিপির মৌলিক রূপ এই চিত্রিলিপি। আর আপলিনের calligramme শব্দটি উদ্ভাবন করেনcalligraphie (. Calligraphy) শব্দ থেকে। শব্দটির মূল হল গ্রিক শব্দ কালিগ্রাফিয়া’। গ্রিক কালোস’ শব্দের অর্থ: সুন্দর, সু, ভালো, আর ‘গ্রাফিয়া’ মানে হল: লিখন, অক্ষর, হস্তক্ষর। এভাবে ‘কালিগ্রাফি’ বা ‘কালিগ্রাম’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় সুলিখন বা সুন্দর হস্তাক্ষর। আপলিনের calligramme শব্দটির যে অর্থ দিলেন তা হল: চিত্রলিখন। তাঁর চিত্রকবিতাগুলি কালিগ্রাম’ (Calligrammes) কাব্যগ্রন্থে স্থান পেল। এই চিত্রকবিতা কবির কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা কাব্যগ্রন্থটির নাম থেকে বোঝা যায়। কালিগ্রাম’ বইয়ের প্রথম অংশ ‘ঢেউ’ (Ondes) আপলিনেরএর যুদ্ধের আগে লেখা পাঁচটি চিত্রকবিতা স্থান পেয়েছে। এখানে ঢেউ’ অংশের ‘হৃদয় রাজমুকুট আর আয়না’ (Cœur couronne et miroir) চিত্রকবিতাটির অনুবাদ আমরা উপস্থাপিত করছি।

শিল্পের জগতে নতুন নতুন প্রবণতার সমর্থক ও ব্যাখ্যাতা আপলিনের কবিতার প্রকাশপ্রকরণের ক্ষেত্রে নতুনতর পথের সন্ধানে, শব্দ দিয়ে চিত্রকল্প তৈরির প্রথা পার হয়ে শব্দকে চিত্রবিন্যাসে সাজিয়ে কবিতায় দৃস্টিগ্রাহ্যতার এক নতুন মাত্রা যোগ করতে চেয়েছিলেন। চিত্রকর’ আপলিনেরএর এই কালিগ্রাম নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক মাথা ঘামানো হয়েছে। প্রথমে কালিগ্রামকে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা যায়। প্রাচীন গ্রিক, লাতিন, মধ্য যুগ ও তার পরবর্তীকালের ইয়োরোপীয় সাহিত্যে কাব্যিক বাচনের চিত্ররূপায়িত উপস্থাপনার নিদর্শন রয়েছে। ল্যাটিনে একে বলা হত carmina figurataফরাসিতে একে বলা হত ‘মুদ্গর পদ্য’ (ভের রোপালিক/ Vers rhopaliques) বা vers figurésঅর্থাৎ আকৃতিপ্রাপ্ত পদ্য। আমরা তার কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করছি :

HACHE

পরশুর (মাথার) আকারের প্রাচীন গ্রিক চিত্রকবিতা ।

AUTEL LATIN

মন্দিরের বেদীর আকারের প্রাচীন ল্যটিন চিত্রকবিতা ।

O Bouteille

Pleine toute

De mistères

D’une aureille

Je t’escoute :

Ne diffères,

Et le mot profères

Auquel pend mon cœur.

En la tant divine liqueur,

Baccus, qui fut d’Inde vainqueur

T i e n t t o u te v é r i t é e n c l o s e.

Vin tant divin, loin de toy est forclose

T o u t e m e n s o n g e et t o u t e t r o m p e r i e.

En joye soit l’aire de Noach close,

Lequel de toy nous fist la tempérie

Sonne le beau mot, je t’en prie,

Qui me doibt oster de misères.

Ainsi ne se perde une goutte.

De toy, soit blanche, ou soit vermeille.

O Bouteille

Pleine toute

De mistères,

D’une aureille

Je t’escoute :

Ne diffères.

ফ্রঁসোয়া রাবলে(François Rabelais, ১৪৮৩১৫৫৩) রচনায় মদের বোতলের আকারে এই চিত্রকবিতাটি রয়েছে।

Nous ne pouvons rien trouver sur la terre

Qui soit si bon, ni si beau que le verre.

Du tendre amour, berceau charmant,

C’est toi, champêtre fougère,

C’est toi qui sers à faire

L’heureux instrument

Où souvent pétille

Mousse et brille

Le jus qui rend

Gai, riant,

Content

Quelle Douceur

Il porte au cœur !

Tôt

Tôt

Tôt

Qu’on m’en donne !

Qu’on l’entonne !

Tôt

Tôt

Tôt

Qu’on m’en donne

Vite et comme il faut.

L’on y voit sur ses flots chéris

Nager l’allégresse et les ris.

অষ্টাদশ শতকের শার্ল ফ্রঁসোয়া পানারএর (Charles François Panard, ১৬৯৪১৭৬৫) পানপাত্রের আকারে বিন্যস্ত একটি চিত্রকবিতা।

LEWIS CARROL

লুইস ক্যারলএর (Lewis Carroll, ১৮৩২১৮৯৮) ‘আশ্চর্যের দেশে অ্যালিসএর অভিজ্ঞতা’ (Alice’s Adventures in Wonderland, ১৮৬৫) বইয়ের একটি চিত্রকবিতা

ভারতীয় ঐতিহ্যে, সংস্কৃত কাব্যালংকারবিধি অনুসারে কবিতার শব্দসমবায়ের বর্ণগুলির পদ্ম, খড়্গ , চক্র, গোমূত্রিকা প্রভৃতি আকারে বিন্যাসকে চিত্রালংকার বলে। (পদ্মাদ্যাকারহেতুত্বে ব্ণানাং চিত্রমুচ্যতে। — সাহিত্যদর্পণঃ। দশমঃ পরিচ্ছদঃ।)। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ তাঁর সম্পাদিত ‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থের টীকায় চিত্রালংকোরের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আমরা এখানে তার থেকে দুটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করেছি:

cAL 2

cal 1

লালমোহন বিদ্যানিধি তাঁর ‘কাব্যনির্ণয়’ (প্রথম সংস্করণ, ১৮৬২) গ্রন্থে শব্দালংকার বিভাগে চিত্রালংকারের যে সংজ্ঞার্থ দিয়েছিলেন তা হল: ‘শব্দ দ্বারা কোনরূপ চিত্র অঙ্কিত করার নাম নাম চিত্রালংকার’। চিত্রালংকারের দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি একটি পদ্মবন্ধ উপস্তাপিত করেছেন :

CAL 3

হায়!

হায়!

বসন্ত ফুরায়!

মুগ্ধ মধু মাধবের গান।

ফল্গু সম লুপ্ত আজি মুহ্যমান প্রাণ।

অশোক নির্মাল্যশেষ, চম্পা আজি পাণ্ডু হাসি হাসে,

ক্লান্ত কণ্ঠে কোকিলের যেন মুহুর্মুহু কুহুধ্বনি নিবে নিবে আসে!

দিবসের হৈমজ্বালা দীপ্ত দিকে দিকে, উজ্জ্বলজাজ্জ্বলঅনিমিখ্ ,

নিঃশ্বসিছে নিঃস্ব হাওয়া, হুতাশে মূর্ছিত দশদিক্!

রৌদ্র আজ রুদ্র ছবি আকাশ পিঙ্গল,

ফুকারিছে চাতক বিহ্বল —

খিন্ন পিপাসায়;

হায়!

বসন্ত ফুরায়!

মুগ্ধ মধু মাধবের গান।

ফল্গু সম লুপ্ত আজি মুহ্যমান প্রাণ।

অশোক নির্মাল্যশেষ, চম্পা আজি পাণ্ডু হাসি হাসে,

ক্লান্ত কণ্ঠে কোকিলের যেন মুহুর্মুহু কুহুধ্বনি নিবে নিবে আসে!

দিবসের হৈমজ্বালা দীপ্ত দিকে দিকে, উজ্জ্বলজাজ্জ্বলঅনিমিখ্,

নিঃশ্বসিছে নিঃস্ব হাওয়া, হুতাশে মূর্ছিত দশদিক্!

রৌদ্র আজ রুদ্র ছবি আকাশ পিঙ্গল,

ফুকারিছে চাতক বিহ্বল —

খিন্ন পিপাসায়;

হায়!

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কুহু ও কেকা (১৯১২) কাব্যগ্রন্থের গ্রীষ্মের সুর কবিতার প্রথম স্তবক। এই কবিতাটির স্তবকসংগঠনে এক ধরনের দৃষ্টিগ্রাহ্যতা তৈরির প্রয়াস রয়েছে।

উনিশ শতক থেকে আধুনিক কবিতার মুদ্রণবিন্যাস সম্পর্কে অনেকদিন ধরে চিন্তা করা হচ্ছল; মালার্মে (Mallarmé) তাঁর ‘পাশার চাল…’ (Un coup de dés...) কবিতার মুদ্রণবিন্যাসে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপকে ব্যঞ্জনাময় করে তুলতে চেয়েছিলেন। আবার আপলিনের অল্পবয়স থেকে (প্রধানত চিনা) লিখনরীতির চিত্রধর্মিতা সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের ইতালীয় ভবিয্যদবাদী বা ফিউচারিস্টদের কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তাঁরা তাঁদের ঘোষিত ‘মুক্ত শব্দের’ (Parole in liberta) মধ্যে একদিকে যেমন অন্বয় থেকে শব্দকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনি শব্দের মুদ্রিত বিন্যাসকে প্রথামুক্ত করেতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। বিশেষ করে ইতালীয় ফিউচারিস্ট কবি ফ্রান্চেসকো কানজ্যুল্লো (Francesco Cangiullo) ১৯১৩ সালে বেশ কিছু চিত্রকবিতা সমন্বিত এক দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কবিতাটি যদিও ১৯১৬ সালে মুদ্রিত হয় তবু তা ১৯১৩ থেকে ইতালি আর প্যারিসের বিভিন্ন ভবিয্যদবাদী কবিতাসন্ধ্যায় প্রদর্শিত ও পঠিত হয়ে আলোড়ন তুলেছিল। এছাড়া আপলিনেরএর ‘সমুদ্রপত্র’ প্রকাশিত হওয়ার সাড়ে পাঁচ মাস আগে ১৯১৪ সালের ১লা জানুয়ারি ‘লাচের্বা’ (Lacerba) পত্রিকায় কানজুল্লোর Fumatori II নামক একটি (প্রায়) চিত্রকবিতা প্রকাশিত হয়। মারিনেত্তি (Marinetti) এই জাতীয় কবিতার নামকরণ করেন ‘মুক্তশব্দচ্ছবি’ (Tavole parolibere) এর পর মারিনেত্তি ও অন্যান্য ইতালীয় ভবিষ্যদবাদীরা ‘লাচের্বা’ পত্রিকায় মুদ্রণবিন্যাসের বৈচিত্র্যময় ‘মুক্ত শব্দ’ প্রকাশ করতে থাকেন।

ভবিষ্যদবাদী পাপিনি (Papini) ১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভবিষ্যদবাদীদের মুখপত্র এই ‘লাচের্বা’ (Lacerba) পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকা প্রকাশে তাঁর সহযোগী ছিলেন সোফিচি (Soffici) সোফিচি ১৯০৩ থেকে ১৯০৭ সাল অব্দি প্যারিসে ছিলেন এবং পিকাসো, আপলিনের ও মাক্ম জাকবএর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। স্বভাবতই মনে হয়, প্রথম সংখ্যা থেকেই ‘লাচের্বা’ আপলিনের সহ ফরাসি তরুণ শিল্পীসাহিত্যিকদের হাতে আসে। তাছাড়া ‘লাচের্বা’ যখন প্রকাশিত হয় তখন ভবিষ্যদবাদী শিল্পী বোচ্চোনি (Boccioni) তাঁর ভাস্কর্যের প্রদর্শনীর আয়োজন করার জন্য প্যারিসে ছিলেন। তাঁর সঙ্গেও ফরাসি শিল্পী ও লেখকদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তিনি নিশ্চয় ভবিষ্যদবাদীদের মুখপত্র ‘লাচের্বা’ সবাইকে সবাইকে দেখিয়েছিলেন। পরে ‘লাচের্বা’ পত্রিকায় আপলিনের লিখেও ছিলেন।

এছাড়া ১৯১৩ সালে আপলিনের ‘ভবিষ্যদবাদী ঐতিহ্যবিরোধিতা’ (L’Antitradition futuriste) নামে একটি ভবিষ্যদবাদী ইস্তাহার রচনা করেন। এই ইস্তাহার মিলান থেকে মারিনেত্তি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এই ইস্তাহারে আপলিনের ‘মুক্তি পাওয়া শব্দ’এর (Mots en liberté) কথা ঘোষণা করেন, ঘোষণা করেন অনেক কিছুর সঙ্গে ‘টাইপোগ্রাফি বা হরফ বিন্যাসের সঙ্গতির বিলোপ’এর (Supression de l’harmonie typographique) কথা। ‘কালিগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় এই ভবিষ্যদবাদী প্রবণতার স্বাক্ষর দেখা যায়। এসব সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে অনুমান করা যায় ভবিষ্যদবাদী ‘মুক্তি পাওয়া শব্দ’এর ভাবনা এবং কানজ্যুল্লোর চিত্রকবিতা আপলিনেরকে ‘কালিগ্রাম’ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। তাছাড়া পিয়ের আলবেরবিরো(Pierre Albert-Birot) সম্পাদিত SIC পত্রিকায় ‘বৃষ্টি পড়ে’ কবিতাটি ছাপা হয়। এই পত্রিকাটি ছিল ইতালীয় ও ফরাসি ভবিষ্যদবাদীদের মিলনক্ষেত্র।

সঙ্গে সঙ্গে একথা মনে রাখা দরকার, আপলিনেরএর ভবিষ্যদবাদী ইস্তাহারের শিরোনামের তলায় যে কথাটি লেখা ছিল তা হল ‘ইস্তাহার = সমন্বয়’। (Manifeste = Synthèse)। তাই ভবিষ্যদবাদীদের বিধ্বংসী উগ্রপন্থা তাঁর কবিতায় অনুপস্থিত। তাঁর কবিতায় যা রয়েছে তা হল বিবর্তিত আধুনিকতার সমন্বয়। আপলিনেরএর চিত্রকবিতার কাব্যগুণ এই সমন্বয়ের নিদর্শন।

MANIFESTE 1

MANIFESTE 2

অনেক সমালোচক আপলিনেরএর কালিগ্রাম’কে বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেন নি। তাঁদের বিচারে এই চিত্রকবিতাগুলি একধরনের তাত্ক্ষণিক খেয়ালি কল্পনার ফসল, কবিতা হিসেবে সে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘কালিগ্রাম’ গ্রন্থ প্রকাশের পর কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম অঁদ্রে বিলি (André Billy) এই গ্রন্থের একটি সমালোচনা লেখেন। বিলি চিত্রকবিতার উদ্ভাবনকে সমর্থন করতে পারেন নি। সমালোচনা পড়ে আপলিনের বিলিকে একটি চিঠি লেখেন, কালিগ্রাম’ সম্পর্কে তিনি জানান :

কালিগ্রামএর কথায় বলতে হয় এগুলো হল মুক্তছন্দনির্ভর কবিতার আদর্শ রূপায়ণ, আর চলচ্চিত্র আর গ্রামোফোনের মতো উপস্থাপনার নতুন মাধ্যমের আবির্ভাবের ঊষায়, মুদ্রণলিপির উজ্জ্বল জীবনসায়াহ্নে এই কবিতাগুলি মুদ্রণের এক ধরনের সূক্ষ্ম ব্যবহার।

এ চিঠিতে আপলিনের তাঁর চিত্রকবিতাকে উদ্ভাবন বা সৃষ্টি বলেন নি, বলেছেন ‘সন্ধান’ (recherches) । আমাদের কাছে আপলিনেরএর এই সন্ধানী মানসিকতাই সবচেয়ে গুরুত্বপর্ণ বলে মনে হয়েছে। অন্যদিকে কালিগ্রামের সন্ধান আমাদের কাছে একাধিক কারণে তাত্পর্যময় বলে বোধ হয়েছে। প্রথমত, এ কবিতা প্রথাগত উপস্থাপনাকে ভেঙে কবিতাপাঠকের অভ্যস্ত চিন্তাহীন পঠনরীতিকে আঘাত করে, তাঁকে চিন্তিত আর সচেতন করে তোলে। দ্বিতীয়ত, এ জাতীয় মুদ্রণবিন্যাস কবিতায় শ্রুতিগ্রাহ্যতার সঙ্গে অন্য একটি মাত্রা যোগ করে (অন্ততপক্ষে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়) আর তা হল দৃষ্টিগ্রাহ্যতা। এছাড়া লিখন বা মুদ্রণের এতাবৎ প্রচলিত দু দিকের সাদা সীমানায় আবদ্ধ অনুভূমিক শৃঙ্খলিত পঠনরীতিকে ভেঙে পঠনের অন্যতর সম্ভাবনাকে আবিষ্কার ও ব্যবহার করা মুদ্রিত সাহিত্যের লিখনের/পঠনের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে আমাদের মনে হয় কেননা তা রচনার বাগর্থের সীমানাকে প্রসারিত করতে পারে। আপলিনেরপরবর্তী বিশ শতকের সৃষ্টিশীল গদ্য আর কবিতায় মুদ্রণবিন্যাসের সম্ভাবনার ব্যবহার আপলিনেরএর প্রয়াসের গুরুত্ব এবং সার্থকতার নির্দেশক।

বৃষ্টি পড়ে ( Il pleut)

বৃষ্টি পড়েচিত্রকবিতাটি ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু কবিতাটি অনেক আগের লেখা। ১৯১৪ সালের ২৯এ জুলাই সের্জ ফেরাকে ( Serge Férat) লেখা একটি চিঠিতে আপলিনের লিখেছিলেন, তার আগের দিন বৃষ্টি পড়ছিল আর তিনি শোন বৃষ্টিপড়ছে কিনা নামে একটা কবিতা লিখেছেন, চিঠিতে রেখার সাহায্যে তিনি কবিতাটির একটা ছক এঁকে দিয়েছিলেন

বৃষ্টি পড়েকবিতাটিতে বৃষ্টির ধারার অনুকরণে সাজানো পঙক্তিগুলির দৃষ্টিগ্রাহ্য আর ব্যঞ্জনাময় বিন্যাসসৌন্দর্য বাদ দিলেও কবিতাটির মুদ্রণ্যবিন্যাস অন্য একটি কারণেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে রাখা দরকার, ফরাসি (ইয়োরোপীয় ইন্দোইয়োরোপীয় বেশির ভাগ) ভাষার লিখনমুদ্রণ হচ্ছে অনুভূমিক , তার গতি বাম থেকে দক্ষিণ অভিমুখী বর্তমান কবিতায় চিরাচরিত ঐ রীতি সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, এখানে পঙক্তিগুলির গতি বৃষ্টিধারার অনুকরণে নিম্নাভিমুখী, কিছুটা তির্যক, উল্লম্বক। আপাতদৃষ্টিতে তা চিনে বা জাপানি লিখনরীতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়

বিজয় (La Victoire)

এ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে নরস্যুদ’ (Nord-Sud) পত্রিকায়। কবিতাটির যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় তাতে রচনাকাল রয়েছে ১১ আর ১২ই মার্চ, ১৯১৭।কালিগ্রাম’ বইয়ের ষষ্ঠ অংশে কবিতাটি স্থান পেয়েছে। এ বইয়ের শেষ কবিতা ‘লালচুল সু্ন্দরী’ (La jolie Rousse)

রচনাকালের দিক থেকে সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থের প্রথমে উপস্থাপিত কিন্তু কালানুক্রমিকভাবে শেষ কবিতা ‘এলাকা’র সময় থেকে আপলিনের উত্কণ্ঠ সচেতনতা নিয়ে আধুনিক পৃথিবীতে কবিতার স্থান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেছেন, — ‘আধুনিক’ পৃথিবীর উপযুক্ত ‘আধুনিক’ কবিতার নতুন ভাষা, নতুন প্রকাশপ্রকরণ সন্ধান করেছেন। যুদ্ধের উত্তেজনার তীব্র অভিজ্ঞতার মধ্যেও আপলিনেরএর উপলব্ধির জগৎ অধিকার করে ছিল কাব্যচিন্তা ; তাই ‘কালিগ্রাম’ গ্রন্থের কবিতায় যে বিষয় ফিরে ফিরে এসেছে তা হল কবিতা, কাব্যসৃষ্টি, কবিতার লক্ষ্য, কবিতার ভাষা — এক কথায় কাব্যতত্ত্ব। আর কাব্যগ্রন্থের শেষে এই উপলব্ধির চূড়ান্ত, বিস্ফোরিত, স্বতোত্সার প্রকাশ ঘটেছে ‘বিজয়’ কবিতাটিতে । এর পাশাপাশি এই বইয়ের পুনরাবৃত্ত আরেক উপলব্ধি হল প্রেম। অবশেষে কবি প্রেমের শান্তস্নিগ্ধ পরিণতি থুঁজে পেলেন ‘লালচুল’ এক সুন্দরীর মধ্যে — সে হয়ে উঠল তাঁর জীবনের আশ্রয় । আর এই পরিণতির গভীর উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘লালচুল সুন্দরী’ কবিতায়। সে দিক থেকে ‘কালিগ্রাম’ গ্রন্থের দুই স্রোতের পরিণাম যেন তার শেষ দুটি কবিতা।

বিজয়’ কবিতাটি পড়ে আজকের পাঠকের মনে হতে পারে, এ যেন কবিতার ভাষার মুক্তি সম্পর্কে এক অনন্য ঘোষণা ; স্মরণ হতে পারে, ফিউচারিস্টদের সঙ্গে আপলিনেরএর সম্পর্কের ইতিহাস তথা ধ্বন্যাত্মক মুক্ত শব্দের প্রতি ফিউচারিস্টদের আগ্রহের কথা ; মনে পড়তে পারে, কবিতার ভাষা নিয়ে দাদাবদীদের ধ্বংসাত্মক প্রয়াস আর দাদাবাদীদের সঙ্গে আপলিনেরএর যোগাযোগের প্রসঙ্গ, এমন কি পরবর্তী স্যুররিয়ালিস্টদের কাব্যভাবনার কথাও মাথায় আসতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর সমকালীন আর পরবর্তী কাব্যচিন্তার অনেক বীজই আপলিনেরএর উপলব্ধি ও কাব্যকৃতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, আপলিনেরএর ‘নিহত কবি’(পোত্রৎ আসাসিনে/Poète assassiné : যুদ্ধের আগে রচিত ও ১৯১৬ সালে প্রকাশিত) উক্তি:সমস্ত বাঁধন থেকে, এমন কি ভাষার বাঁধন থেকেও মুক্ত এক কবিতা আমি লিখব’ । বস্তুত ‘এলাকা’ কবিতার পরবর্তী কাব্যসৃষ্টিতে আপলিনেরএর ‘মুক্ত কবিতা’র সন্ধান অব্যাহত। এই ‘মুক্ত কবিতা’র জন্য — যন্ত্র আর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের এই নতুন যুগের কবিতার জন্য প্রয়োজন নতুন ভাষার সন্ধান।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে আপলিনেরএর ব্যক্তিগত গ্রন্থসংগ্রহে ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন বইয়ের প্রাচুর্য থেকে অনুমান করা যায়, কবি কবিতার ভাষার সূত্রেই ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে কৌতূহলী ছিলেন।

ভাষা (লঁগ্ /langue) বচন (পারোল/parole) : আপলিনেরএর এই কবিতায় ভাষা’ ও ‘বচন’এর উল্লেখে আজকের ভাষাবিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক পাঠক চমকে উঠে ভাবতে পারেন, আপলিনের হয়ত ভাষাবিজ্ঞানের জগতে ফের্দিনঁ দ সোস্যুরএর (Ferdinand de Saussure, ১৮৫৭১৯১৩) যুগান্তকারী চিন্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু মনোযোগ দিলে বোঝা যায় যে, আপলিনের সাধারণ অর্থে শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন তার সঙ্গে সোস্যুরীয় চিন্তার কোন সম্পর্কে নেই।

লের্নএর হায়ড্রা : হায়ড্রা (. Hydra, . দ্র্ /Hydre) বলতে জলের সাপকে বোঝায়। লের্নএর হায়ড্রা গ্রিক পুরাণঅনুসারে লের্নএর জলাভূমিতে বসবাসকারী এক ভয়ষ্কর বহুমুণ্ডধারী সর্পাকৃতি দানব। তার নিঃশ্বাস ছিল কালান্তক। য়োরিস্থিউস কর্তৃক প্রেরিত হয়ে হেরাক্লেস শেষে তার ভাগনের সাহায্য নিয়ে এই দানবকে হত্যা করেন।