Blaise Cendrars: Poèmes,
Traduction en bengali: Pushkar Dasgupta
(Deuxième série)
Blaise Cendrars: Poems
Translated into Bengali by Pushkar Dasgupta
(Second series)
ডাইরি(Journal)
খ্রিস্ট
আমার আগের আগের কবিতা ‘ইস্টার’ লেখার পর থেকে
এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল তোমার কথা আমি আর ভাবি
নি
ইতিমধ্যে আমার জীবনটা অনেকটাই পালটে গেছে
অথচ আমি চিরকাল সেই একই রয়ে গেছি
এমন কী আমি চিত্রশিল্পী হব বলে ভেবেছিলাম
আজ সন্ধ্যায় ঐ যে আমার আঁকা ছবিগুলো দেয়ালে ঝুলছে
ঐ ছবিগুলো আমার কাছে আমার নিজের সম্পর্কে এমন সব
ধারণা
উদ্ঘাটিত করে যা আমাকে
তোমার কথা ভাবায় ৷
খ্রিস্ট
জীবন
সেটাই তো আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছি
নিজের আঁকা ছবিগুলি আমাকে কষ্ট দেয়
আমার কামনাটা খুবই বেশি
সব কিছুই কমলা রঙের ৷
আমার বন্ধুদের কথা ভাবতে ভাবতে আর খবরের কাগজ
পড়ে বিষণ্ণ পুরো
একটা দিন আমি কাটিয়েছি
খ্রিস্ট
দুহাত ছড়িয়ে পুরো খোলা যে খবরের কাগজটা আমি ধরে
রয়েছি তার
মধ্যে ক্রুশবিদ্ধ জীবন
ছড়িয়ে দেওয়া ডানা
হাউই
টগবগ করে ফুটতে থাকা
চিৎকার ৷
মনে হবে যেন এরোপ্লেন ভেঙে পড়ছে ৷
আমিই ৷
আগুন
ধারাবাহিক উপন্যাস
ডাইরি
নিজের কথা বলতে না চাইলেও
বারবার চিৎকার করে উঠতে হবে
আমি অন্য কেউ
অতিরিক্ত স্পর্শকাতর
অগাস্ট ১৯১৩
টাউয়ার(Tour)
১৯১০
কাস্তেলমার
কমলালেবুর গাছের ছায়ায় একটা কমলালেবু দিয়ে আমি
রাতের খাবার
সারছিলাম
যখন, আচমকা…
না তা ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত ছিল না
না তা মিশরের দশটি ক্ষতের অন্যতম পঙ্গপালের মেঘ ছিল
না
কিংবা পম্পেইও না
না তা অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক হাতির পুনরুজ্জীবন পাওয়া
চিৎকার নয়
না তা ঘোষিত তূর্যধ্বনি নয়
কিংবা তা পিয়ের ব্রিসে–র ব্যাঙও নয়
যখন, আচমকা,
আগুন
আঘাত
লাফিয়ে ওঠা
সমান্তরাল দিগন্তগুলির স্ফুলিঙ্গ
আমার লিঙ্গ
আইফেল টাউয়ার !
আমি তোমার পায়ে সোনার জুতো পরিয়ে দিই নি
আমি তোমায় স্ফটিকের শানের ওপর নাচাই নি
আমি তোমায় কার্থেজের কোনো কুমারীর মতো অনন্তনাগের
কাছে মানত
করি নি
আমি তোমায় গ্রিসের প্রাচীন জোব্বা পরিয়ে দিই নি
আমি তোমায় কখনো মেনহিরের সীমানার মধ্যে প্রলাপ বকাই
নি
আমি তোমায় ডেভিডের বংশলতিকা বা ক্রুশের কাঠ বলে
অভিহিত করি নি
Lignum Crucis
আইফেল টাউয়ার !
বিশ্ব–প্রদর্শনীর বিরাট তুবড়ি
গঙ্গার তীরে
বারাণসীতে
হিন্দুমন্দিরের আত্মমৈথুনকারী লাট্টুগুলির মধ্যে
আর প্রাচ্যের জনসমুদ্রে রঙবেরঙ চিৎকারের মধ্যে
তুমি নুয়ে পড়ছ, অনবদ্য তালগাছ!
তুমিই তো ইহুদি জনগোষ্ঠীর পুরাকাহিনির যুগে
মানুষের ভাষাকে তালগোল পাকিয়ে দিলে
ব্যাবেল!
আর হাজার খানেক বছর পরে তুমি তোমার গির্জের মধ্যে
সমবেত
খ্রিস্টপার্ষদ প্রেরিতদের মাথার ওপর আগুনের লেলিহ শিখার
আকারে
ভেঙে পড়লে
অপার সমুদ্রে তুমি একটা মাস্তুল
আর উত্তর মেরুতে
তোমার বেতার বার্তায় তুমি মেরুজ্যোতির সমস্ত দীপ্তি নিয়ে
জ্বলে উঠলে
লতাগুলি ইউক্যালিপ্টাসের গায়ে জড়িয়ে যায়
আর তুমি মিসিসিপির বুকে ভাসতে থাক, পুরনো গুঁড়ি,
যখন
তোমার মুখ হাঁ করে
আর একটা কুমির একটা নিগ্রোর উরু কামড়ে ধরে
ইয়োরোপে তুমি একটা ফাঁসিকাঠের মতো
(আমার ইচ্ছে ছিল টাউয়ার হওয়ার, আইফেল টাউয়ারে
ফাঁসিতে ঝোলার)
আর যখন তোমার পেছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে
বনোর দলেরমাথা গিয়োতিনের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে
তুমিই ছুটছ আফ্রিকার বুকে
জিরাফ
উটপাখি
অজগর
নিরক্ষরেখা
মৌসুমীবায়ু
অস্ট্রেলিয়ায় তুমি ছিলে চিরকাল নিষিদ্ধ
তুমিই সেই আকশি যা ক্যাপ্টেন কুক তাঁর অভিযানের জাহাজ
চালানোর
জন্য ব্যবহার করত
দিব্যওলনদড়ি !
যাকে আমি এ কবিতাটি উৎসর্গ করছি সেই সমান্তরাল
দলোনে–র কাছে
তুমি হলে সেই তুলি যা সে আলোয় ভিজিয়ে নেয়
ঝাঁঝর দামামা তিনপাশার খেলা জঙ্গলের জানোয়ার এক্স্–রে
এক্সপ্রেস
অফ্রিকান ছুরি ঐকতান
সব কিছুই তুমি
টাউয়ার
প্রাচীন দেবতা
আধুনিক জানোয়ার
সৌর ছায়ামূর্তি
আমার কবিতার বিষয়
টাউয়ার
পৃথিবীর টাউয়ার
চলন্ত টাউয়ার
অগাস্ট ১৯১৩
বিরোধ(Contrastes)
আমার কবিতার জানলাগুলি বুলভারের দিকে হাট করে খোলা
আর তার
শোকেসগুলির ভেতর
জ্বলজ্বল করছে
আলোর মণিমুক্তো
কান পেতে শোনো বিরাটা গড়িগুলোর বেহালা আর
লাইনোটাইপের
জলতরঙ্গ
বিরাট হাতাটা আকাশের হাতমোছার গামছায় হাত মুখ ধুয়ে
নেয়
সব কিছুই রঙের ছোপ
যে সব মেয়েরা চলে যাচ্ছে তাদের মাথার টুপিগুলি
সন্ধ্যেবেলার
অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ধূমকেতুর মতো
মিল
আর কোনো মিল নেই
দশ মিনিট পিছিয়ে দেওয়ার পর সমস্ত ঘড়িতেই এখন ২৪টা
বাজে
আর কোনো সময় নেই
আর কোনো টাকাপয়সা নেই ৷
চেম্বার অব কমার্সে
কাঁচা মালের আশ্চর্য উপাদানগুলি আমরা নষ্ট করি
শুঁড়ির দোকানে নীল জ্যাকেট পরা শ্রমিকবা লাল মদ খায়
প্রতি শনিবার মজুররা তাস খেলে
ওরা জুয়ো খেলে
ওরা বাজি ধরে
মাঝে মধ্যে একটা এক আধটা ডাকাত মোটর গাড়ি করে
চলে যায়
অথবা একটা বাচ্চা লার্ক দ ত্রিয়োঁফ নিয়ে খেলা করে…
মসিয়ো কোশঁকে পরামর্শ দিই তিনি যেন তাঁর প্রিয়পাত্রদের
আইফেল
টাউয়ারে আশ্রয় দেন
আজ
মালিক পালটানো
সবচেয়ে ছোট দোকানদারদের দোকানে দোকানে পবিত্র
আত্মা খুচরোতে
বিক্রি হচ্ছে
আমি মুগ্ধ হয়ে ক্যালিকো কাপড় আর
লাল ককলিকোর ব্যানার পড়ি
একমাত্র সরবনের আগ্নেয়গিরির পাথরে কখনো ফুল ফোটে
না
ডিপার্টমেন্টাল স্টোর সামারিটেনের সাইনবোর্ড সেন নদীর
গায়ে নদীর
গায়ে
আর স্যাঁ–সেভব়্যাঁ–র দিকে লাঙল চালাচ্ছে
আমি শুনতে পাই
আমি ট্র্যামওয়ের ঘন্টা এক নাগাড়ে বেজে চলেছে
বিদ্যুৎ–গোলকের বৃষ্টি
মোঁরুজ গার দ লেস্ত মেট্রো উত্তর–দক্ষিণ বাতো মুশ লোকজন
সব কিছুই আলোর প্রভা
গভীরতা
.ব্যু দ ব্যুসি চিৎকার শোনা যায় ‘ল্যাঁত্রঁসিজঁ’ আর
‘পারি–স্পর’
আকাশের বিমানঘাটি এখন গনগন করছে একটা সিমাব্যু–র
ছবি
যখন সামনে
লোকগুলি
লম্বা
কালো কালো
বিষণ্ণ
আর ধোঁয়া ওগড়াচ্ছে, কারখানার চিমনিগুলি
অক্টোবর ১৯১৩
শেষ প্রহর (Dernière heure)
‘ওক্লাহামা, ২০–এ জানুয়ারি ১৯১৪’
তিনজন কয়েদি রিভলভার জোগাড় করে
ওরা জেলারকে খতম করে জেলের চাবি হস্তগত করে
সেলের থেকে বেরিয়ে ওরা ছুটতে থাকে আর উঠোনে চারজন
রক্ষীকে
খতম করে
এর পর ওরা জেলের তরুণী স্টেনো–টাইপিস্টকে জোর করে
সঙ্গে নেয়
দরজার পাশে একটা গাড়ি ওদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল ওরা
তাতে উঠে পড়ে
রক্ষীরা যখন পলাতকদের তাক করে তাদের দিকে
রিভলভারের গুলি
ছুঁড়তে থাকে
তখন ওরা টগবগিয়ে চম্পট দেয়
কয়েকজন রক্ষী লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে কয়েদিদের
পেছনে ধাওয়া
করে
দুপক্ষের গুলি বিনিময় হয়
রক্ষীদের একজনের ছোড়া একটা গুলিতে তরুণীটি আহত হয়
যে ঘোড়াটি গাড়ি টানছিল গুলির আঘাতে সেটা মারা য়ায়
রক্ষীরা কাছাকাছি এগিয়ে যেতে পারে
তারা দেখতে পায় কয়েদিরা মারা পড়েছে ওদের সর্বাঙ্গ
গুলিতে ঝাঁঝরা
হয়ে গেছে
আমেরিকান কংগ্রেসের ভূতপূর্ব সদস্য মিস্টার টমাস যিনি
জেলখানা
পরিদর্শন করতেন
তরুণীটিকে অভিনন্দন জানান
‘পারি–মিদি ’ পত্রিকা থেকে টোকা টেলিগ্রাম–কবিতা
জানুয়ারি ১৯১৪
বোম্বে এক্সপ্রেস(Bombay -Express)
যে জীবন আমি কাটিয়েছি
তা আমাকে আত্মহত্যা করতে বাধা দেয়
সব কিছুই লাফিয়ে ওঠে
প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে
মেয়েছেলেরা চাকার তলায় গড়াতে থাকে
স্টেশনের দরজায় এক্কাগাড়িগুলি এখানে ওখানে ছড়িয়ে
রয়েছে
গানবাজনা আমার নখদর্পণে ৷
মাসকাগনি আমার কখনোই ভালো লাগে নি
না শিল্প না শিল্পীদের
না বাঁধগুলো না সেতু
না ট্রম্বোন না পিস্টন
আমি আর কিছুই জানি না
আমি আর কিছুই বুঝে উঠতে পারি না…
এই আদরের স্পর্শ
ভৌগোলিক মানচিত্রটা যাতে শিউরে ওঠে
এ বছর কি আসছে বছর
এস্পেরেন্তোর মতোই শিল্প–সমালোচনার কোনো মানে হয়
না
বৃন্দিসি
আবার দেখা হবে আবার দেখা হবে
এই শহরেই আমি জন্মেছি
আর আমার ছেলেটাও
আমার ছেলে যার কপালটা দেখতে তার মার যেনির মতো
এমন কিছু চিন্তা রয়েছে যা বাসগুলিকে চমকে দেয়
যে বইগুলি শুধু গ্রন্থাগারেই রয়েছে তা আমি আর পড়ি না
পৃথিবীর সুন্দর বণর্পরিচয়
শুভ যাত্রা!
যে তুমি সিঁদুরে হাসি হাসছ
তোমাকে আমার নিয়ে যেতে হবে
এপ্রিল ১৯১৪
মাথা(La tête)
গিয়োতিন হল অসামান্য শিল্পকর্ম
টিক করে তার পড়ার আওয়াজ
সৃষ্টি করে চিরন্তন গতি
খ্রিস্টোফার কলম্বাসের ডিমের কথা সবাই জানে
ডিমটা ছিল চ্যাপ্টা, স্থির , উদ্ভাবকের ডিম,
আর্কিপেংকো–র ভাস্কর্য হল প্রথম উপবৃত্তাকার ডিম
দারুণ ভারসাম্যে ধরে রাখা
তার প্রাণবন্ত মাথার ওপর
স্থির একটা লাট্টুর মতো
গতি
সে খুলে ফেলে
হরেক রঙের ঢেউ
রঙের কোমরবন্ধগুলি
আর তার গভীরতায় ঘুরতে থাকে
নগ্ন ৷
নতুন ৷
পুরোটা ৷
জুলাই ১৯১৪ ৷
১৯টা ৪০–এর সুপার একস্প্রেসে(Dans le rapide de
19h. 40)
বেশ কয়েক বছর হল আমি কোনো ট্রেনে চাপি নি
আমি ঘুরে বেড়িয়েছি মোটরগাড়িতে
এরোপ্লেনে
একবার সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছি আর আবার আমি আরো লম্বা
আরেকটা
পাড়ি দিচ্ছি
আজ রাতে হঠাৎ আমি ফের আমার এককালের খুবই
জানাশোনা ট্রেনের
সেই আওয়াজের মধ্যে চলেছি
আর আমার মনে হচ্ছে আওয়াজটাকে আমি আগেকার চেয়ে
আরো ভালো
করে বুঝতে পারছি
রেস্টোরেন্ট–ওয়াগন
বাইরে কিছুই স্পষ্ট চেনা যায় না
রাতের নিকষ অন্ধকার
তাকালে চোখে পড়ে চারভাগের একভাগ চাঁদ এতটুকু
নড়াচড়া করছে না
তবে সে কখনো ট্রেনের বাঁপাশে, কখনো ডানপাশে
এক্সপ্রেস ট্রেন ঘন্টায় পঁচাত্তর মাইল বেগে ছুটে চলেছে
আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না
তীক্ষ্ণ গমগম একটা আওয়াজে আমার কানের পর্দা ঝাঁ ঝাঁ
করছে —
বাঁদিকের পর্দাটা ব্যথায় টনটন করছে — পাথরে গাঁথা
সুড়ঙ্গপথ তারপর
একটা লোহার সেতুর জলপ্রপাত হাঁতুড়ি পেটানো দুমুখি
রেললাইনের হার্প
একটা স্টেশনের থাপ্পড় খেপে যাওয়া সুড়ঙ্গের একটা জোড়া
ঘুসি চোয়ালে
বন্যার জন্য ট্রেনের গতি যখন কমে যায় তখন শোনা যায়
জলীয় বাষ্পের
হিসহিস এবং বাসনপত্র আর ব্রেকের আওয়াজের মাঝখানে
গরম হয়ে
ওঠা একশ টনের যত পিস্টনের শব্দ
আভ্র্ বন্দর বাস লিফ্ট্
হোটেলের ঘরের শাসির্লাগানো জানলাগুলি আমি খুলে দিই
বন্দরের জাহাজঘাটা আর তারাভরা একটা রাতের ঠান্ডা
বিশাল আলোর
ছটার ওপর ঝুঁকে পড়ি
সমুদ্রের ধারের রাস্তায় কাতুকুতু খাওয়া একটি মেয়ে খুকখুক
করে হাসছে
অন্তহীন একটা শেকল কাশছে গোঙাচ্ছে কাজ করছে
দেশ–গাঁয়ের মতো
হাঁসমুর্গি রাখার পেছনের উঠোনের ঐ গণ্ডগোলের দিকে
জানলা খোলা
রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়ি
জেগে ওঠা (Réveil)
আমি চিরকাল জানলা খোলা রেখে ঘুমোই
একজন নিঃসঙ্গ মানুষের মতো আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
বাতাস ঠাসা বা বাষ্পীয় সাইরেনগুলি খুব একটা আমার ঘুম
ভাঙাতে
পারে নি
আজ ভোরবেলা আমি জানলা দিয়ে ঝুঁকে পড়ি
দেখতে পাই
আকাশ
সমুদ্র
এই জাহাজঘাটা দিয়ে ১৯১১ সালে আমি নিউইয়র্ক থেকে
আসছিলাম
জাহাজকে পথ দেখানোর জন্য ছোট্ট একটি কুটুরি
আর
বাঁদিকে
চিমনির ধোঁয়া ক্রেন পেছন থেকে আসা বৃত্তাকার আলো
হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ভোরের প্রথম ট্রাম ঠকঠক করে কাঁপতে
কাঁপতে
চলে যাচ্ছে
আমার অবশ্য খুবই গরম লাগছে
বিদায় প্যারিস
স্বাগত সূ্র্যালোক
আকাশ আর সমুদ্রের চেয়ে তুমি সুন্দর (Tu es plus
belle que le ciel et la mer)
তুমি যখন ভালোবাসো তখন তোমায় বেড়িয়ে পড়তে হবে
ফেলে রেখে যাও তোমার স্ত্রীকে রেখে যাও তোমার সন্তানকে
ফেলে রেখে যাও তোমার বন্ধুকে রেখে যাও তোমার
বান্ধবীকে
ফেলে রেখে যাও তোমার প্রেমিকাকে রেখে যাও তোমার
প্রেমিককে
তুমি যখন ভালোবাসো তখন তোমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে
জগৎসংসার নিগ্রো পুরুষ আর নিগ্রো নারীতে ভরা
নারী পুরুষ পুরুষ নারী
তাকিয়ে দেখ সুন্দর দোকানপাট
ঐ ঘোড়ার গাড়ি ঐ পুরুষটি ঐ নারী ঐ ঘোড়ার গাড়ি
আর তাবৎ সুন্দর পসরা
রয়েছে আকাশ রয়েছে বাতাস
পর্বত জল আকাশ পৃথিবী
ছেলেমেয়েরা জীবজন্তু
গাছপালা আর মাটির নিচের কয়লা
বেচতে কিনতে আবার নতুন করে বেচতে শেখ
দাও নাও দাও নাও,
তুমি যখন ভালোবাসো তখন তোমায়
গান গাইতে ছুটতে খেতে মদ খেতে
শিস দিতে
আর কাজ করার তালিম নিতে জানতে হবে
তুমি যখন ভালোবাসো তখন তোমাকে বেড়িয়ে পড়তে হবে
মুখে হাসি নিয়ে নাকি কান্না কেঁদো না
বাসা বেঁধো না দুটি স্তনের মাঝখানে
নিঃশ্বাস নাও হাঁটতে থাক বেরিয়ে পড় চলে যাও
স্নান করে নিয়ে আমি তাকিয়ে থাকি
আমি দেখতে পাই আমার চেনা মুখ
হাত পা চোখ
স্নান করে নিয়ে আমি তাকিয়ে থাকি
গোটা জগৎসংসার চিরকালই এখানে রয়েছে
জীবনটা অবাক করা মালমশলায় ভরপুর
ওষুধের দোকান থেকে আমি বেরিয়ে পড়ি
ওজনের যন্ত্রটার ওপর থেকে সবে নেমে আসি
আমার ৮০ কিলো ওজনটা দেথে নিই
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিঠি (Lettre)
তুমি আমায় বলেছ যদি তুমি আমায় চিঠি লেখ
তবে সবটা যেন টাইপ মেশিনে টাইপ কোর না
তোমার নিজের হাতে লেখা একটা লাইন যোগ করে দিও
একটা শব্দ কিছুই না আহা এমন কিছুই নয়
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ
অথচ আমার রেমিংটনটা চমৎকার
ওটাকে আমি দারুণ ভালোবাসি আর খুবই ব্যবহার করি
আমার লেখা গোটা গোটা আর পরিচ্ছন্ন
দেখে বেশ বোঝা যায় আমিই তা টাইপ করেছি
কিছু ফাঁকা জায়গা থেকে যায় শুধু আমিই তা রাখতে জানি
তাহলে আমার পৃষ্ঠার মধ্যে যে একটা চোখ রয়েছে তার দিকে
তাকাও
তবু তোমায় খুশি করার জন্য আমি কালিতে যোগ করে দিই
দু তিনটে শব্দ
আর মোটা একটা কালির দাগ
যাতে করে তুমি শব্দগুলি পড়তে না পারো
বিলবাও (Bilbao)
ভোর হওয়ার অনেকটা আগেই আমরা বিলবাও–এর
পোতাশ্রয়ে পৌঁছে যাই
শহরের আলোয় ফুটকি কাটা মখমলের কালো ছায়ার মধ্যে
নিচু নিচু
পর্বত আর পাহাড়ের খাঁড়ি
এই সরল আর সুন্দর ভাবে সাজানো পটভূমি আমাকে স্মরণ
করিয়ে দেয়
স্পেনে রয়েছি বলে আকাট বলে গণ্য হওয়ার বিপদ থাকা
সত্ত্বেও
আবার বলছি যে আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় পিকাসোর ছবির
একটা
পটভূমি
দুজন মাত্র লোক নিয়ে খুদে তিনকোণা একটা পাল তোলা
ছোট ছোট
নৌকা
ইতিমধ্যেই সমুদ্রের মধ্যে এগিয়ে গেছে
দুটি শিশুমার ডিগবাজি খায়
পর্বতগুলির পেছন থেকে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে
এমন সরল এই পটভূমি
রঙের বন্যায়
প্লাবিত হয়
গাঢ় নীল থেকে বেগুনি
আর তা পিকাসোকে জার্মান একসপ্রেশনিস্টে পরিণত করে
দুটি বিপরীত বিন্দু একজায়গায় এসে মিশে যায়
দাকার–এর পথে (En route pour Dakar)
বাতাস ঠাণ্ডা
সমুদ্র ইস্পাতের
আকাশ ঠাণ্ডা
আমার শরীরটা ইস্পাতের
বিদায় ইয়োরোপ ১৯১৪ সালের পর এই প্রথম তোমায় আমি
ছেড়ে চলেছি তোমার বুকে কিছুই আমার আর ভালো লাগছে
না দুই ডেকের মাঝখানে
ঘরছাড়া ইহুদি রুশ বাস্ক ইস্পানি পর্তুগিজ আর প্যারিসের
জন্য মন
খারাপ করা জার্মান মাদারিরাও নয়
আমার ইচ্ছে করে সব কিছুই ভুলে যেতে তোমার ভাষাগুলিও
আর না
বলতে আর নিগ্রো পুরুষ আর নিগ্রো নারী রেড ইণ্ডিয়ান পুরুষ
আর
রেড ইণ্ডিয়ান নারী জন্তুজানোয়ার আর উদ্ভিদের সঙ্গে শুয়ে
থাকতে
আর স্নান করে জলের মধ্যে বেঁচে থাকতে
আর স্নান করে মোটাসোটা একটা কলাগাছের সঙ্গে রোদের
মধ্যে
জীবন কাটাতে
আর ঐ গাছের পরিপুষ্ট মোচাটাকে ভালবাসতে
নিজেই নিজেকে টুকরো টুকরো করতে
আর পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠতে
সটান পড়ে যেতে
অতলে তলিয়ে যেতে
৩৫০৫৭΄উত্তর অক্ষাংশ ১৫০১৬΄দক্ষিণ দ্রাঘিমাংশ
(35° 87′ Latitude nord 15° 16′ Longitude ouest)
ঘটনাটা আজই ঘটল
সমুদ্রযাত্রার শুরু থেকে ব্যাপারটা আমার চোখে পড়েছিল
সমুদ্রটাকে দারুণ দেখাচ্ছিল তার ভেতর থেকে ফেঁপে ওঠা
তরঙ্গ আমাদের
গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল
সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা
তখন বিকেল চারটে
আমি তাস খেলছিলাম
হঠাৎ আমি চিৎকার করে পাটাতনের ওপর ছুটে গেলাম
হ্যাঁ এ ব্যাপারটাই এ ব্যাপারটাই
সমুদ্রের গাঢ় নীল
আকাশের টিয়াপাখির নীল
গরম আবহাওয়া
কেউ বলতে পারে না কী করে এটা ঘটল আর কীভাবে
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা
করা যায়
অথচ সবকিছুর পরিমাপ মাত্রায় মাত্রায় বাড়তে থাকে
সন্ধ্যেবেলা এর চারদফা প্রমাণ পেলাম
আকাশ এবার পরিষ্কার
ডুবন্ত সূর্য যেন একটা চাকা
পূর্ণিমার চাঁদ যেন আরেকটা চাকা
আর নক্ষত্রগুলি বড় থেকে আরো বড়
জায়গাটা হল মাদেরা বন্দরকে জাহাজের ডান দিকে রেখে
কাজাব্লাঙ্কা
বন্দরের পথে
এরই মধ্যে
ব্লেজ সঁদ্রার
বুবু (Les boubous)
আহারে নিগ্রো গ্রামের আশেপাশে ছাপা কাপড়ের
ব্যাপারিদের দোকানে
যাদের দেখা যায় সেই নিগ্রো নারীরা
এমন মর্যাদা এমন আভিজাত্য এমন ভাবভঙ্গী এমন চলার ঢঙ
এমন গড়ন
এমন নির্বিকার ভাব এমন পরিশীলন এমন পরিচ্ছন্নতা এমন
শুদ্ধতা এমন
স্বাস্থ্য এমন আশাবাদ এমন স্বাভাবিকতা এমন যৌবন এমন
রুচি পৃথিবীর
আর কোনো নারীরই নেই
না ভোরবেলায় হাইড পার্কে সম্ভ্রান্ত ইংরেজ মহিলার
না রোববারের সন্ধ্যায় ঘুরে বেড়ানো ইস্পানি মহিলার
না পিঞ্চিয়োর সুন্দরী রোমান মহিলার
না হাঙ্গেরি বা আর্মেনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের মেয়েদের
না নেভা নদীর তীর ধরে পুরনো আমলে স্লেজে করে যাওয়া
রুশ
রাজপরিবারের নারীদের
না ফুলের নৌকোর চিনে মহিলার
না নিউইয়র্কের সুন্দরী টাইপিস্টদের
না প্যারিজিয়ান মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি
প্যারিজিয়ানেরও
ভগবান করুন সারা জীবন ধরে চকিতে দেখা চেহারা আর
গড়ন ঐ
কয়েকটা আকার আমার মাথার মধ্যে যেন ঘুরে বেড়ায়
ওদের চুলের প্রতিটি গোছা হল তেল মাখা রঙীন চকচক করা
সমান
মাপের বিনুনি
মাথার চুড়োয় ওরা রঙিন রেশমের সুতো বা ঝকঝকে মুক্তোর
ছোট ছোট
শেকলে আটকানো এইটুকু একটা চামড়া বা হাতির দাঁতের
অলংকার
পরে
এই চুল বাঁধার কায়দা বেশ কয়েক মাসের পরিশ্রমের স্বাক্ষর
আর ওদের
সারাটা জীবন কাটে বারবার নতুন করে চুল বাঁধতে
সোনার ছোট ছোট পাতের কয়েকটা সারি ওদের কানের লতি
এফোঁড়
ওফোঁড় করে রয়েছে
কারো কারো মুখে চোখের তলায় আর গলায় রঙিন কাটা দাগ
আর দারুণ
শিল্পনৈপুণ্যে ওরা সবাই সাজগোজ করে
আংটি আর কাঁকনে ঢাকা ওদের হাত আর প্রত্যেকের হাতের
তালু আর
নখে
রঙ লাগানো
রূপোর ভারি মল ওদের পায়ের গোছায় বাজতে থাকে আর
ওদের পায়ের
আঙুলে আংটি পরানো
পায়ের গোড়ালিতে নীল নীল রঙ লাগানো
ওদের পরনে লম্বায় নানা মাপের বুবু ওরা ঐ বুবুগুলো
একটার ওপর
আরেকটা চাপিয়ে দেয় আর ওদের বুবুগুলোর ওপর ছাপা
হরেক রঙ
আর হরেক ধরনের ফুলকারির কাজ ঐ মেয়েগুলো একান্ত
অনড়
রুচিতে অপুর্ব এক পোশাকের সমন্বয় রচনা করে যার মধ্যে
প্রাধান্য
পায় কমলা নীল সোনালি বা শাদা রঙ
তার ওপরে ঐ মেয়েগুলির কোমরে রয়েছে কোমরবন্ধ আর
হাতে ভারি
তাবিজ
অন্যদের মাথায় থাকে অপার্থিব পাগড়ি
ওদের সবচেয়ে দামি সম্পদ হল ওঁদের নিষ্কলঙ্ক দাঁতের সারি
আর লোকে
যেমন বিলাসবহল ইয়ৎ–এর পেতলের সজ্জা ঘষেমেজে রাখে
তেমনি ওরা ওদের দাঁতগুলিকে ঝকঝক করে রাখে
ওদের চলার ভঙ্গীটাও ঠিক যেন সরু একটা পালের নৌকোর
মতো
অথচ কিছুই ওদের শরীরের নমনীয় পরিমাপ ব্যাখ্যা করতে
পারে না
অথবা ঐ গতির পরিকল্পিত নির্লিপ্ততাকে প্রকাশ করতে পারে
না ৷
সূর্যাস্ত(Couchers de soleil)
সবাই সূর্যাস্তের কথা বলাবলি করে
এ তল্লাটে সূর্যাস্ত নিয়ে সমস্ত ভ্রমণকারীই কথা বলতে রাজি
শুধুমাত্র সূর্যাস্তের বর্ণনা দিয়ে প্রচুর বই লেখা হয়েছে
নিরক্ষীয় অঞ্চলের সূর্যাস্ত
অবশ্য এটা সত্যি যে ব্যাপারটা দারুণ
তবে কিনা আমার অনেক বেশি ভালো লাগে সূর্যোদয়
ঊষা
একটি ঊষাও আমি ছেড়ে দিই না
সারাক্ষণ আমি জাহাজের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকি
উদোম
আর তারিফ করার জন্যে চিরকাল আমি একা
তবে আমি সেসব ঊষার বর্ণনা দিতে যাচ্ছি না
শুধু নিজের জন্য আমি ওদের জমিয়ে রাখব
মৃগশিরা নক্ষত্র (Orion)
এটাই হল আমার নক্ষত্র
হাতের মত তার আকার
ওটা আকাশে স্থান পাওয়া আমার হাত
পুরোটা যুদ্ধের সময় আমি ট্রেঞ্চের ওপর ঘুলঘুলি দিয়ে আমি
মৃগশিরা
নক্ষত্রকে দেখেছি
আজ মৃগশিরা রয়েছে আমার মাথার ঠিক ওপরে
বড় মাস্তুলটা হাতের ঐ তালুটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করছে
আর হাতটা
নিশ্চয় যন্ত্রণা পাচ্ছে
যেরকম একটা বল্লমে এক নাগাড়ে এফোঁড় ওফোঁড় আমার
কাটা হাত
আমাকে যন্ত্রণা দেয়
বিষুবরেখা পার হওয়া (Le passage de la ligne)
স্বভাবতই আমার নাম দেওয়া হল
এটা আমার নিষুবরেখার এগারো বারের নামকরণ
আমি মেয়ে সেজেছিলাম আর দারুণ মজা করা হল
তারপর আমরা মদ খেলাম
আমি সাঁতার কাটছি (Je nage)
বিষুবরেখা অব্দি ছিল শীতকাল
এখন গ্রীষ্ম
ক্যাপ্টেন ওপরের ডেকে একটা সুইমিং পুল বসিয়ে দিয়েছে
আমি ঝাঁপ দিচ্ছি সাঁতার কাটছি চিৎহয়ে ভাসছি
আমি আর কিছুই লিখছি না
বেঁচে থাকাটা যে কী সুখের
রোববার (Dimanche)
সমুদ্রের বুকে রোববার
গরম পড়েছে
আমি আমার কেবিনে ঠিক যেন গলতে থাকা মাখনের ভেতর
প্রজাপতি (Papillon)
অদ্ভুত কাণ্ড
গত দুদিন ধরে আমরা মাটি দেখতে পেলেও এর মধ্যে একটি
পাখিও
আমাদের চোখে পড়ে নি বা আমাদের পিছু নেয় নি
অথচ
আজ
খুব ভোরবেলা
আমরা যখন রিও উপসাগরে ঢুকছি
তখন হাতের থাবার মতো একটা প্রজাপতি এসে জাহাজের
পুরো চারপাশে
পাক খেতে লাগল
প্রজাপতিটা ছিল কালো আর হলুদের ওপর আবছা নীল
ডোরাকাটা
দ্বীপ (Iles)
দ্বীপ
দ্বীপ
দ্বীপ যেখানে কেউ কোনোদিন নৌকো ভেড়াবে না
দ্বীপ যেখানে কেউ কোনোদিন পা ফেলবে না
দ্বীপ গাছপালায় ঢাকা
দ্বীপ বাঘের মত ওঁৎ পেতে থাকা
দ্বীপ নীরব
দ্বীপ নিস্পন্দ
দ্বীপ অবিস্মরণীয় আর নামহীন
জাহাজ থেকে আমি আমার জুতোগুলি ছুঁড়ে দিই
কেননা আমি তোমাদের কাছে যেতে চাই
প্রাণের অস্তিত্ব (Vie)
আমাদের জাহাজ ‘ফর্মোজা’ তার নোঙরটা টপকে যায় আর
আমরা
অলক্ষ্যে
জাহাজের ওপর ঘুরতে থাকি
নৌকোর মতন কিছু একটা তীর ছেড়ে বেরিয়ে আসে
গাছের গুঁড়িতে খোদাই করা একটা লম্বা সালতি
তার মধ্যে রয়েছে দুজন বেঁটেখাটো কালো লোক
ওদের একজন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে
অন্য জন গলুইয়ের ওপর উবু হয়ে নিশ্চিন্তে দাঁড় টেনে
চলেছে
সূর্য তার দাঁড়ের দুপাশে খেলা করে
ধীর গতিতে জাহাজের চারদিকে একটা চক্কর দিয়ে ওরা
ফিরে যায়
সাঁও পাওলো (São-Paulo)
অবশেষে এই তো সব কারখানা শহরতলি শান্তশিষ্ট ছোট্ট
একটা ট্র্যাম
ট্র্যামের ওপরের তারগুলি
লোকজনে গিজগিজ করা একটা রাস্তা আর ওরা সবাই
সন্ধ্যের কেনাকাটা
করতে বেরিয়েছে
একটা গ্যাসের ট্যাঙ্ক
অবশেষ আমরা স্টেশনে ঢুকছি
সন্ত–পল
আমার মনে হচ্ছে আমি যেন নিস স্টেশনে
অথবা লণ্ডনের চারিং–ক্রসে নামছি
আমি আমার তাবৎ বন্ধুদের দেখতে পাই
কী খবর
আমি এসে গেছি
ল আভ্র্–স্যাঁ–পল, ফেব্রুয়ারি ১৯২৪
ঘুম থেকে ওঠা (Réveil)
আমি উদোম
এরই মধ্যে আমি স্নান সেরে নিয়ে
গায়ে ওডি কোলন ঘষছি
আমার কেবিনের ঘুলঘুলি দিয়ে টালমাটাল একটা পালের
নৌকা
বয়ে চলে যায়
আজ সকালে শীত পড়েছে
কুয়াশা
আমি আমার তাবৎ কাগজপত্র গুছিয়ে রাখি
একটা রুটিন তৈরি করে নিই
আমার দিনগুলি হবে কাজে ঠাসা
একটা মিনিটও নষ্ট করলে চলবে না
আমি লিখছি
লেখা (écrire)
আমার টাইপ–মেশিনটা তালে তালে ধুক ধুক করে চলেছে
প্রতিটি পংক্তির শেষে ওটা বেজে ওঠে
রোলারের মাথায় দাঁতওয়ালা চাকতিগুলি ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে
ওঠে
মাঝে মাঝে আমি আমার বেতের আরাম কেদারায় এলিয়ে
পড়ে
একরাশ ধোঁয়া ছাড়ি
আমার সিগারেট সারাক্ষণ জ্বলতে থাকে
আমি তখন ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাই
বেসিনের পাইপে গলা টেপা জলের গরগর আওয়াজ
আমি উঠে দাঁড়াই আর ঠাণ্ডা জলে আমার হাত ভিজিয়ে নিই
কিংবা গায়ে আতর লাগাই
লেখার সময় নিজেকে না দেখার জন্য আর্শি লাগানো
আলমারির আয়নাটা
আমি ঢেকে দিয়েছি
জাহাজের গোল ফোকরটা একটা রোদের চাকতি
আমি যখন চিন্তা করি তখন ওটা ঢোলের চামড়ার মতো
প্রতিধ্বনি করে ওঠে
আর জোরে জোরে কথা বলে
হাঙর(Requins)
ওরা আমায় ডাকছে
কয়েকটা হাঙর আমাদের পিছু নিয়েছে
ওদের মুর্গি ছুঁড়ে দিলে দু তিনটে বিকট জানোয়ার সাদা
ফেনায় পাক খেয়ে
লাফিয়ে ওঠে
একটা ভেড়া কিনে আমি জাহাজের ওপর থেকে ছুঁড়ে দিলাম
ভেড়াটা সাঁতার কাটতে লাগল হাঙরগুলো ভয় পেয়ে গেল
আমার পয়সাটা
গায়েব হল
কথাটা তো আমি বলেইছিলাম (Je l’avais bien dit)
কথাটা আমি বলেছিলাম
বানর কিনতে গেলে
যেগুলি বেশ ছটফটে আর তোমাদের প্রায় ভয় পাইয়ে দেয়
সেগুলিই
নিতে হয়
আর তোমাদের বুকের ভেতর লেপ্টে ঘুমিয়ে পড়া শান্তশিষ্ট
বানর
কখনো বাছতে নেই
কেননা ওগুলো হল গিয়ে আফিং খাওয়ানো বানর পরদিন
ওরা ভয়ংকর
হিংস্র হয়ে ওঠে
এ ঘটনাটাই ঘটেছিল অল্পবয়সী একটি মেয়ের ও কামড়
খেয়েছিল
নাকে
হাসা (Rire)
আমি হাসছি
আমি হাসছি
তুমি হাসছ
আমরা হাসছি
এই যে হাসি যা আমরা ভালোবাসি
এছাড় আর কিছুরই কোনো মূল্য নেই
নির্বোধ আর খুশি হতে জানা চাই
নীল পাখি (L’oiseau bleu)
আমার নীল পাখিটির পেটটা পুরো নীল
তার মাথাটা ব্রোঞ্জের মতো ঝকঝকে সবুজ
তার গলার তলায় রয়েছে একটা কালো দাগ
সোনালি হলুদ থোকা থোকা পালকওয়ালা নীল তার ডানা
তার লেজের ডগায় সিঁদুরে রঙের দাগ
তার পিঠের ওপর কালো আর সবুজ ডোরা কাটা
তার ঠোঁট কালো পাগুলো গোলাপি আর চোখদুটো
কষ্টিপাথরের
সে ঝপাৎ করে জলে ডুব দিতে ভালোবাসে তার খাবার হল
কলা আর সে
খুব ছোট্ট একটা জলীয় বাষ্পের স্টিম এঞ্জিনের শিস দেওয়ার
মতো
ডেকে ওঠে
আমরা তার নাম দিয়েছি সাতরঙা
কেন(Pourquoi)
পাখিটা শিস দেয়
বানরগুলো ওর দিকে তাকিয়ে থাকে
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা
মুখে মৃদু হাসি নিয়ে আমি লিখে যাচ্ছি
যাই আমার হোক না কেন তাতে আমার কিছুই এসে যায় না
যাই আমি করি না কেন তা আমার মাথা খারাপ করে দেয় না
আমার দৃষ্টি এখানে যে নেই এমন কারো একটা পিছু নেয়
জাহাজের গতির উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে আমি লিখতে থাকি
কুয়াশার ভেতর সূর্য
আগে আগে
দেরিতে
হ্যাঁ