Scattered thoughts on the Bengali language 3 Pushkar Dasgupta বাংলা ভাষা নিয়ে বিক্ষিপ্ত চিন্তা ৩ নয়া-ঔপনিবেশিকতার জমানায় বাংলা ভাষার কোণঠাসা হওয়ার ইতিহাস পুষ্কর দাশগুপ্ত

 

নয়াঔপনিবেশিকতার জমানায় বাংলা ভাষার কোণঠাসা হওয়ার ইতিহাসের একটি পর্ব

পুষ্কর দাশগুপ্ত

ঔপনিবেশিকতার যুগের পুরনো ইতিহাস: মেকলের জারজরা

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় শিকড় গেড়ে বসার পর থেকে তাদের সরকার, মুত্সুদ্দি, দালালের কাজ করে কিছু দিশি লোক জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। তারপর কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাবকে পরাজিত করে ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ ও ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠা করে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দখলদারি পাওয়ার পর এই উপনিবেশের পরিধি দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে । কলকাতা হয় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। দলে দলে ভাগ্যান্বেষী ‘কলিকাতা কমলালয়ে’ এসে হাজির হল। ঔপনিবেশক সাহেবদের অধীনে কাজ করতে গেলে এক আধটু সাহেবদের বুলি বোঝা দরকার, উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা দু চারটে ইংরেজি বুকনি আউড়াতে শিখে সাহেবদের নেক নজরে পড়ল আর বেশ দু পয়সা কামিয়ে দিশি সমাজে কেউকেটা বনে গেল । হেস্টিংসের ব্যক্তিগত ব্যবসার মুন্সি শোভাবাজারের নব মুন্সি মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবে পরিণত হল। কোম্পানির আফিঙের চোরাই চালানে সহায়ক চিপুরের পিরালি ব্রাহ্মণ দ্বারকানাথ ঠাকুর হয়ে গেলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। দিশি সমাজে ইংরেজি শেখার চাহিদা দেখা দিল। সেই চাহিদা মেটানোর জন্য প্রথমে কিছু বিদেশি, ফিরিঙ্গি, অল্পস্বল্প ইংরেজি জানা লোক ইংরেজি পাঠশালা খুলল। তারপর ১৮১৭ সালে দিশি সমাজের কেউকেটা নবকৃষ্ণের দত্তক পুত্র রাজা রাধাকান্ত দেব এবং আরও কয়েকজনের মদতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি ও ইয়োরোপীয় বিদ্যা শেখার জন্য হিন্দু কলেজ স্থাপিত হল। ১৮৩০ সালের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার বিবরণ অবস্থাটা স্পষ্ঠ করে:

হিন্দুকালেজাদি নানা পাঠশালাদ্বারা অনেক বিষয়ি লোকের সন্তানেরা ইঙ্গরেজী বিদ্যায় পারগ হইয়াছে হইতেছে ও হইবেক। ইহারা কেহ দেওয়ানের পুত্র কেহ কেরাণির ভাই কেহ খাজাঞ্চির ভাতৃপুত্র কেহ গুদাম সরকারের পৌত্র কেহ নীলামের সেলসরকারের সম্বন্ধী ইত্যাদি প্রায় বিষয়ি লোকের আত্মীয় তাহারদিগকে কর্ম্মে উক্ত ব্যক্তিরা অবশ্যই নিযুক্ত করিয়া দিবেন এবং এই প্রথমতঃ কর্ম্ম হইয়া থাকে

(সমাচার চন্দ্রিকা, ১৫ চৈত্র ১২৩৬)

এই অবস্থায় ১৮৩৪ সালে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ঔপনিবেশিত ভারতে আসেন। ভারতবর্ষের বিশাল উপনিবেশের শাসনশোষণের প্রয়োজনে দিশি কম্প্রাদরকর্মচারি তৈরি করার জন্য ঔপনিবেশকদের ভাষায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। মনে পড়ে, ১৪৯২ সালে ইস্পানি পণ্ডিত আন্তোনিয়ো দে নেব্রিহা (Antonio de Nebrija, ১৪৪১১৫২২) স্প্যানিশ ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশ করেন।এই ব্যকরণ তিনি রানি ইজাবেলাকে উৎসর্গ করেছিলেন। ওই বই দিয়ে তিনি কী করবেন রানির এই প্রশ্নের উত্তরে নেব্রিহা বলেন, শ্রদ্ধেয় রানি, ভাষা হল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র।’ সে বছরই স্প্যানিশ রানি ইজাবেলার পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার ও ইস্পানি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য সমুদ্রপথে যাত্রা করেন।

মেকলে ১৮৩৫ সালে তাঁর ঔপনিবেশিত ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে স্মারকলিপিতে স্বল্পসংখ্যক ভারতীয়দের ইংরেজিমাধ্যম যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব করেন তার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ছিল::

এই মুহূর্তে আমরা অবশ্যই এমন একটা শ্রেণী গড়ে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব যারা হবে যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আমরা শাসন করি তাদের আর আমাদের মধ্যে দোভাষি, এমন একটা শ্রেণীর মানুষ যারা হবে রক্তে আর গায়ের রঙে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মতামত, নৈতিকতা আর বিচারবুদ্ধিতে ইংরেজ।

[We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect.]

ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মেকলের অভিপ্রেত কিছু ‘রুচি, মতামত, নৈতিকতা আর বিচারবুদ্ধিতে ইংরেজ’ আর ‘গায়ের রঙে ভারতীয়’ তৈরি হল। কোটি কোটি ভারতীয়দের মধ্যে এরা সংখ্যয় নগণ্য। এদেরই বড় একটা অংশ ইংরেজের বশংবদ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিশ্বস্ত কম্প্রাদরের ভূমিকা নেয়, আাবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যখন ভারতীয় উপমহাদেশে তথাকথিত ‘স্বাধীনতার’ নামে মার্কিনি নেতৃত্বে দলবদ্ধ পশ্চিমের নয়াঔপনিবেশিকতা কায়েম হল তখন থেকে সুবিধাভোগী পূর্বোক্ত কম্প্রাদরদের বংশধররা নয়াকম্প্রাদরের ভূমিকা নিয়ে দেশের শাসনশোষণ ব্যবস্থার কর্ণধার হয়ে বসল। ‘মেকলের জারজ’ এই সামান্য সংখ্যক সুবিধাভোগী দেশের সংখ্যাগুরু বিপুলসংখ্যক মানুষকে মানবিক তথা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ইংরেজি ভাষাকে শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, উচ্চশিক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা করে রাখল। এই অবস্থায় ইংরেজি না জানা বা/এবং কম জানা বিপুলসংখ্যায় সংখ্যাগুরু বাংলাভাষীর অবস্থাটা করুণ। সরকারি কাগজপত্র, চিঠি, আইনকানুন, পড়া, বোঝা, জানার, কোনো সমস্যায় আবেদন করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, ভোগ্যপণ্য বা ওষুধ কিনে তার নাম অথবা ব্যবহারের নিয়ম বোঝার অধিকার তাদের নেই, বৈদ্যুতিন জগৎ তাদের আয়ত্তের বাইরে। অন্যদিকে মেকলের জারজ বা ইংরেজিনবিশ বাঙালিদের অবস্থাটা কী? এরা তোতাবৃত্তিতে বিভিন্ন বিদ্যায় পাশ্চাত্যবাচন আউড়ায়। এদের অবদান, মৌলিক মনন, বিশ্লেষণ, সৃষ্টি, আবিষ্কার অতি নগণ্য। গত দুশ বছরের ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। সাম্প্রতিককালে যেসব ইংরেজিনবিশ ভারতীয় বা/এবং বাঙালি তোতাবৃত্তিতে নৈপুণ্য দেখিয়ে খ্যাতি লাভ করেন বা/এবং ইংরেজিতে (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে) আবোলতাবোল লেখেন পশ্চিমের নয়াঔপনিবেশক শক্তি বিদেশে চাকরি বা/এবং পুরস্কার দিয়ে তাদের পিঠ চাপড়ে দেয়। এটা হল গিয়ে নয়াঔপনিবেশিকতার প্রোথিতমূল প্রতিষ্ঠার কৌশলের অঙ্গ। স্মরণীয়, ১৯৪৩ সালে হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিক ডিগ্রি নেওয়ার অভিভাষণে উইনস্টন চার্চিল ইংরেজি ভাষার প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে ভাষার নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের সাম্রাজ্যের (অর্থা নয়াঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের) প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্টের সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা বলেন। এই পরিকল্পনার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তিনি যা বলেন তাই হল নয়াঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশের ভিত্তি:

ভাষার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা লোকের দেশ বা জমিজমা কেড়ে নিয়ে তাদের শোষণের মাধ্যমে পিষে ফেলার চেয়ে অধিকতর মূল্যবান লভ্যাংশ এনে দেয়। ভবিষ্যতের সাম্রাজ্য হবে মানসিকতার সাম্রাজ্য।

[The power to control language offers far better prizes than taking away people’s provinces or lands or grinding them down in exploitation. The empires of the future are the empires of the mind.

Winston Churchill, 1943]

যাঁরা মেকলের জারজের দলে ঢোকেন নি

অবশ্য উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষা সামান্য সংখ্যক বাঙালিকে মেকলের জারজদের শ্রেণীভুক্ত করতে পারে নি, তার পরিবর্তে ঐ শিক্ষা তাদের চেতনাকে জাগ্রত এবং প্রসারিত করে। এঁরা দেশ, জাতি আর বাঙালি সংস্কৃতির ধারকবাহক বাংলা ভাষার ব্যবহারের পরিধির বিস্তার এবং সমৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা করতে লাগল।

যে মধুসূদন দত্ত প্রথম যৌবনে ইংরেজি ভাষার কবি হবার স্বপ্ন দেখতেন, যিনি ইংরেজি বাদ দিয়েও সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি ও ইতালিয়ান ভাষা জানতেন, তিনি ১৮৬৫ সালে ফ্রান্সের ভের্সাই শহর থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন:

তুমি জান, গৌর আমার, গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটা ইয়োরোপীয় ভাষায় জ্ঞান হল বিরাট আর আবাদ করা একটা ভূখণ্ড অধিকার করার মতো — ঐ ভূখণ্ড অবশ্যই বৌদ্ধিক ।ইয়োরোপ সম্পর্কে পাণ্ডিত্য প্রশংসনীয় ব্যাপার, … কিন্তু আমরা যখন পৃথিবীকে কিছু বলব তখন তা যেন আমরা আমাদের নিজের ভাষায় বলি। নিজেদের ভেতরে নতুন চিন্তার উত্সার রয়েছে বলে যারা বোধ করে তারা যেন অবিলম্বে নিজেদের মাতৃভাষার দিকে যাত্রা করে।নিজের ভাষায় দক্ষতা নেই এমন কোনো ব্যক্তির ‘শিক্ষিত’ বলে পরিচিত হতে চাওয়ার আত্মম্ভরিতাকে আমি ঘৃণা করি।

[European scholarship is good…but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let those, who feel that they have springs of fresh thought in them, fly to their mother-tongue…I should scorn the pretensions of that man to be called “educated” who is not master of his own language.]

শেষ পর্যন্ত, আমাদের নিজেদের ভাষার চর্চা আর তার সমৃদ্দ্ধিসাধনের তুলনীয় আর কিছুই হতে পারে না। তুমি কি ভাব যে ইংল্যাণ্ড কি ফ্রান্স অথবা জার্মানি কি ইতালির কবি আর প্রবন্ধকারের দরকার আছে ? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি মিল্টনের নিজের মাতৃভাষা আর জন্মভূমির জন্য কিছু করার মহৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে তাবৎ প্রতিভাধর মানুষকে উদ্বুদ্ধ করুক।

[After all, there is nothing like cultivating and enriching our own tongue. Do you think England, or France or Germany or Italy wants Poets and Essayists? I pray God, the noble ambition of Milton to do something for his mother-tongue and his native land may animate all men of talent among us.]

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অভিভাষণে বলেন:

আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের মাতৃভাষাগুলির মাধ্যমে জ্ঞান প্রচারিত না হলে জাতি হিসেবে আমরা কোনো সর্বব্যাপ্ত আর বিস্তৃত কৃষ্টির অধিকারী হতে পারব না। অতীত আমাদের যে শিক্ষা দেয় তার কথা ভেবে দেখুন। অসংখ্য আধুনিক ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো দীপ্তিময় হয়ে ওঠার আগে অব্দি ইয়োরোপে মধ্যযুগের অন্ধকার সম্পূর্ণ বিদূরিত হয় নি। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, ― তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো জনসাধারণের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত চারপাশের অজ্ঞানের গভীর অন্ধকার কখনোই আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে না ।

[I firmly believe that we cannot have any thorough and extentsive culture as a nation, unless the knowledge is disseminated through our own vernaculars. Consider the lesson the past teaches. The darkness of Middle Ages of Europe was not completely dispelled until the light of knowledge shone through the medium of the numerous modern languages. So in India, ― the dark depth of ignorance all round will never be illuminated until the light of knowledge reaches the masses through the medium of their own vernaculars.

Gurudas Bandyopadhay: Convocation Address , 1891]

গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে উদ্বুদ্ধ তরুণ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে মাতৃভাষা বাংলা, হিন্দি বা উর্দুকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন, বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু ইত্যাদি কয়েকজন সমর্থন করলেও মেকলের জারজ বাঙালিদের দলবদ্ধ বিরোধিতায় সে প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়।

১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতী পত্রিকায় লেখেন:

বঙ্গ বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক। ইংরাজিতে শিক্ষা কখনোই দেশের সর্বত্র ছড়াইতে পারিবে না। তোমরা দুটিচারটি লোক ভয়ে ভয়ে ও কী কথা কহিতেছ, সমস্ত জাতিকে একবার দাবি করিতে শিখাও কিন্তু সে কেবল বিদ্যালয় স্থাপনের দ্বারা হইবে, Political agitationএর দ্বারা হইবে না।

(ন্যাশনল ফন্ড , ভারতী, কার্তিক, ১২৯০)

তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ২২ বছর। এর পর সারা জীবন তিনি সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন:

আমাদের ভীরুতা কি চিরদিনই থাকিয়া যাইবে? ভরসা করিয়া এটুকু কোনোদিন বলিতে পারিব না যে, উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের ভাষায় দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে? পশ্চিম হইতে যা কিছু শিখিবার আছে জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল, তার প্রধান কারণ, এই শিক্ষাকে তারা দেশী ভাষার আধারে বাঁধাই করিতে পারিয়াছে। আমরা ভরসা করিয়া এ পর্যন্ত বলিতেই পারিলাম না যে, বাংলাভাষাতেই আমরা উচ্চশিক্ষা দিব এবং দেওয়া যায়, এবং দিলে তবেই বিদ্যার ফসল দেশ জুড়িয়া ফলিবে।আমি জানি তর্ক এই উঠিবে তুমি বাংলা ভাষার যোগে উচ্চশিক্ষা দিতে চাও কিন্তু বাংলাভাষায় উঁচুদরের শিক্ষাগ্রস্থ কই? নাই সে কথা মানি কিন্তু শিক্ষা না চলিলে শিক্ষাগ্রস্থ হয় কী উপায়ে? শিক্ষাগ্রস্থ বাগানের গাছ নয় যে, শৌখিন লোকে শখ করিয়া তার কেয়ারি করিবে,–কিংবা সে আগাছাও নয় যে, মাঠে বাটে নিজের পুলকে নিজেই কণ্টকিত হইয়া উঠিবে!…. বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষাগ্রন্থ বাহির হইতেছে না এটা যদি আক্ষেপের বিষয় হয় তবে তার প্রতিকারের একমাত্র উপায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষা প্রচলন করা।

(শিক্ষার বাহন, ১৩২২)

ছিয়াত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেন:

আজ কোনো ভগীরথ বাংলাভাষায় শিক্ষাস্রোতকে বিশ্ববিদ্যার সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে চলুন, দেশের সহস্র সহস্র মন মূর্খতার অভিশাপে প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে, এই সঞ্জীবনী ধারার স্পর্শে বেঁচে উঠুক, পৃথিবীর কাছে আমাদের উপেক্ষিত মাতৃভাষার লজ্জা দূর হোক, বিদ্যাবিতরণের অন্নসত্র স্বদেশের নিত্যসম্পদ হয়ে আমাদের আতিথ্যের গৌরব রক্ষা করুক।

(শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ, ভাষণ : ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬)

না, রবীন্দ্রনাথের কামনা পূর্ণ হয় নি। বহুকাল কেটে গেল, বাংলা ভাষা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল, তার সঙ্গে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে রইল সংখ্যাগুরু কোটি কোটি বাঙালি। তারপর বিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকে ষষ্ঠ দশক অব্দি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার ব্যবহার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক পা এগোল; শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৩৪১৯৩৮) তখন তাঁর প্রয়াসে ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মাধ্যমিক ম্যাট্রিকুলেশন পর্যায়ে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা বাদ দিয়ে আর যেকোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা আর পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বাংলাক স্বীকৃতি দেওয়া হল। বিভিন্ন বিষয়ে বই আর পরিভাষার অভাব নিয়ে যথারীতি প্রচুর হৈচৈ হল। শ্যামাপ্রসাদের চেষ্টায় বিশেজ্ঞদের নিয়ে গঠিত পরিভাষাসমিতি আর বাংলাবানান সংস্কার সমিতি বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেন আর বাংলা শব্দের বানানের নৈরাজ্য দূর করার জন্য কিছু সংস্কারের প্রস্তাব উপস্থাপিত করে। বানান সংস্কার সমিতির নির্ধারিত বানানবিধি মেনে নেওয়ার লিখিত স্বীকৃতি জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্র তাকে মর্যাদা দেন। ১৯৩৭ সালে শ্যামাপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে অভিভাষণ দিতে আমন্ত্রণ জানান, রবীন্দ্রনাথ বাংলায় অভিভাষণ দেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথা ভেঙে এই প্রথম বাংলা অভিভাষণ। ছিয়াত্তর বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথ এই অভিভাষণে তাঁর বাইশ বছর বয়স থেকে বারবার মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে যেকথা বলে এসেছেন সেকথা আরো একবার বললেন। তাঁর ভাষায়:

ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেই শিক্ষার ভাষা আর শিক্ষার্থীর ভাষার মধ্যে আত্মীয়তাবিচ্ছেদের অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না।

ওই একই সালে অর্থাৎ ১৯৩৭ সাধারণ অব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রথম পিএইচ.ডির জন্য বাংলায় লেখা গবেষণাগ্রন্থক স্বীকৃতি দিয়ে গবেষক বিমানবিহারী মজুমদারকে পিএইচ.ডি ডিগ্রিতে ভূষিত করে। ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার্থীরা প্রথম ইংরেজি ব্যতীত অন্য সব বিষয়ে বাংলাভাষায় উত্তর লিখতে পারে। তারপর ১৯৪৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক স্তর (অনার্স ছাড়া বি. ., বি.এসসি ও বি. কম্ ) পর্যন্ত বাংলাভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে। বই আর পারিভাষিক শব্দ নিয়ে যথারীতি সোরগোল উঠল, ব্যঙ্গবিদ্রুপ হল। ক্রমশ নির্ভরযোগ্য, মান পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হতে লাগল আর পরিভাষার স্থিতিশীলতা দেখা দিল। স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে স্থির করা হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক ধানাই পানাই হলেও তা কখনোই কার্যকরী করা হয় নি।

বাংলা ভাষার সূর্যাস্ত

তার পর সত্তরের দশক থেকে নতুন করে সর্ব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অঘোষিত বিদায় সূচিত হল। তারপর চার দশক পরে এখন বাংলা ভাযার করুণ অবস্থা। বাংলা ভাযা প্রশাসনে ব্যবহৃত হয় না, পাড়ার মুদি, বেঞ্চিওয়ালা চায়ের দোকান, রাস্তার হকার, বাজারের সব্জি, ফল কি মাছবিক্রেতার বাইরে ব্যবসাবাণিজ্যে এই ভাষার ব্যবহার নেই, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রাকৃতিক বা মানবিক বিজ্ঞান, উচ্চশিক্ষা, গবেযণা কোথাও বাংলা ব্যবহৃত হয় না, এ ভাষা আজও মোটামুটিভাবে কম্প্যুটারায়িত হয়নি, ২৪ কোটি ভাষাভাষীর এই ভাষা আজো বৈদ্যুতিন জগতের খুদে একটা টুকরো দখল করে নিজের ন্যূনতম আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি । ক্রমশ বাংলা ভাযা ‘নিম্নবর্গীয়’ বাঙালির পারস্পরিক সংজ্ঞাপনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড় ছে, কলকাতা আর ঢাকায় বড় দোকান কি রেস্তোরাঁয় ঢুকে ইংরেজি না বলে বাংলা বললে খুব একটা ইজ্জত পাওয়া যায় না। মোটামুটি সঙ্গতি থাকলেই লোকে শিশুবয়স থেকে ছেলেমেয়েকে ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পাঠায়, ইংরেজি না বললে চলনসই চাকরি বাকরিও পাওয়া ষাবে না। বাংলায় শুধু কিছু গপ্পোকবিতা লেখা হয়, তবে যে ভাষায় সর্ববিদ্যার চর্চা হয় না সে ভাষার স্রোত মজে যায়, জলে পচন ধরে, তার সৃজনশীলতা হ্রাস পায়, সাহিত্যের মান ক্রমশ নিম্নমুখী হতে থাকে, চর্বিতচর্বণে পরিণত হয়, তার পাঠকের মানও নিম্নগামী হয়, পাঠকের প্রত্যাশার দিগন্তের পরিধির বিস্তারও ক্রমশ কমে যায়। বাংলা সাহিত্যের অবস্থা আজ দীপ্তিহীন, মেধাহীন — করুণ থেকে করুণতর হয়ে উঠছে ।

গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষা নিয়ে কী ভেবেছিলেন বা কী বলেছিলেন তা নিয়ে কেউ আর আজ মাথা ঘামায় না। সব কিছুর মাথায় বসে রয়েছে মেকলের জারজরা আর ইংরেজি ভাষা যা শতকরা ৯ জন বাঙালি জানে না, বুঝতে পারে না।

বাংলা ভাষার পক্ষ নিয়ে রা কাড়ার উপায় নেই, মেকলের জারজরা তো বটেই, ‘কলকাতা থেকে নিয়মিত বিমানে ভ্রমণকারী প্রতি দু’জনের একজন, পশ্চিমবঙ্গে নামকরা গাড়ির মালিকদের ৪০%, রাজ্যের ওয়াশিং মেশিন আছে, এমন মানুষদের অর্ধেকেরও বেশি, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক মাইক্রোওয়েভ মালিক, রাজ্যের সমস্ত এয়ার কন্ডিশন মালিকের ৪০%’ এইসব সংস্কৃতির কমলবনে বিএনডব্ল্যুতে করে মত্ত মাতঙ্গের মতো বিহারকারী পাঠকরা যে খবরের কাগজ নিয়মিত পড়েন বাংলা ভাষার সেই দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ‘বাংলাবাজ’ বলে গালি দেবে।

২৪ কোটি ভাষাভাষীর ভাষা বাংলার এই দুরবস্থা, অবক্ষয়ের ইতিহাস নিয়ে আজকাল কেউ আর মাথা ঘামায় না। কোনো আলোচনা হয় না এ ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের কথা কেন জানিনা কেউ কেন কখনোই বলেন না। এই পর্বটা হল ষাটের দশকের শেষে আর সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গে নক্সাল আন্দোলন নামে পরিচিত মাওবাদী কম্যুনিস্ট আন্দোলন। বস্তুত এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমরা নয়াঔপনিবেশিকতার পরিবর্তিত রণকৌশল বাজারঅর্থনীতি আর তার বিবর্তিত পরিণত রূপ বিশ্বায়নের পরিপোষক ভাষিক আর সাংস্কৃতিক নীতির আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা ও বিতর্কে কেন জানি না এই দুই বিষয় সম্পর্কে নীরবতা পালন করা হয়।

১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীনহয় তখন কলকাতা শহর তথা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মাধ্যমিক স্কুল ছিল বাংলামাধ্যম। ১৯৫১ সালে কলকাতা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল দুশ বিয়াল্লিশটি (স্থায়ী অনুমোদনপ্রাপ্ত ছেলেদের স্কুল ৭৩ + মেয়েদের স্কুল ৬৩ + অস্থায়ী অনুমোদনপ্রাপ্ত স্কুল ১০৬) । এর মধ্যে ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দুমাধ্যম স্কুল ছিল সব মিলিয়ে পনেরোষোলোটি, বাকি সবই বাংলামাধ্যম। ইংরেজিমাধ্যম স্কুল ছিল সাতআটটি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ক্যাথলিক বা প্রটেস্ট্যান্ট (খ্রিস্ট) ধর্মীয় মিশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত মিশনারি স্কুল নামে পরিচিত এই স্কুলগুলিতে যাঁরা ছেলেমেয়েদের পাঠাতেন তাঁরা হলেন : . অ্যাংলোইন্ডয়ান সম্প্রদায়; . বাঙালি খ্রিস্টানদের একটি অংশ, করণ এসব মিশনারি স্কুলে খ্রিস্টান ছাত্ররা নানান ধরনের সুবিধা পেত, এছাড়া খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে ইংরেজি ভাষার একটা ভাবানুষঙ্গ গড়ে উঠেছিল ; . গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলির চাকরি করা ভারতীয়রা — যাঁরা ঘনঘন স্থান পরিবর্তনের বাস্তব কারণে সস্তানদের ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হতেন ; . ছেলেকে ইংল্যাণ্ডে ইটন বা হ্যারোর পাবলিক স্কুল, মেয়েকে সুইজারল্যাণ্ডের ফিনিশিং স্কুল তো দূরের কথা, সিমলা, নৈনিতাল কি দার্জিলিংএর ইংরেজি স্কুলে পাঠানোও যাঁদের সাধ্যে কুলোত না অথচ যাঁরা ছেলেমেয়েকে ব্রাউন ছোটসাহেব কি ছোটিমেমসাহেব বানানোর স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা পিটুলিগোলা জলে দুধের সাধ মেটানোর জন্য ছেলেমেয়েদের কলকাতার অ্যাংলোইন্ডিয়ান স্কুলে পাঠেতেন। এসব স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এদেশে বসে ইয়র্কশায়ারের মিস্টার ও মিসিস মার্টিনের ছেলে ক্রিসমাসে কী করে তার বিবরণ পড়ত। সাধারণত এরা দেশের অবস্থা, সমাজ বা রাজনীতির সমস্যা বা পরিবর্তন নিয়ে মাথা ঘামাত না, কর্মজীবনে বিলিতি সওদাগরী হৌসে সাদা চামড়ার বড় সাহেবদের বশংবদ মেজ, সেজ কি ছোট সাহেব হওয়াটাই ছিল এদের জীবনের চরম লক্ষ্য। বস্তুত এসব ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের বাঙালি ছাত্ররা পরবর্তী জীবনে সাধারণত বিলিতি সওদাগরি অফিস, চাবাগান, সওদাগরি জাহাজ ইত্যাদির ছোট সাহেব হতেন। শিক্ষা আর ভাষার নিয়ন্ত্রণে এরা দেশের মানুষ, সংস্কৃতি এবং জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় স্যুটকোটটাইগাউন, লাঞ্চডিনার, ড্রয়িং রুম, ডাইনিং টেবল ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকত। অন্যদিকে যেসব ছেলেমেয়ে শিক্ষা, প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রাকৃতিক বা মানবিক বিজ্ঞানের গবেষণা, প্রশাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতেন তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন বাংলামাধ্যম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উত্পাদন।

বিশ শতকের প্রথম থেকে, বিশেষ করে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জোয়ারের পর বাঙালি স্কুলগুলিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এই চেতনা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার পর প্রগতিশীল বামপন্থী চিন্তা ও মানসেকতার পরিণতি লাভ করে, এই মানসিকতা কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ক্রমশ কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সহমর্মী করে তুলতে থাকে। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বামপন্থী প্রবণতা পঞ্চাশের মাঝামাঝি থেকে অনুমোদিত, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানিক পরিণতি লাভ করল। এর পর বাইেরর ঘটনাক্রমে দেখা যায়, যাটের দশকের গোড়ায় চিনভারত বিরোধ ও সংঘর্ষের ফলস্বরূপ ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। এরপর আবার আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনের (রুশ ও চিনে পন্থার) বিভাগের ঢেউ ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টিকে আরো বিভক্ত করে, দেখা দেয় সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী মাওবাদী নকশালপন্থীরা (১৯৬৭) । তবে ভেতরের দিক থেকে বলা যায়, নিম্নমধ্যবিত্ত দ্বিধা, বাঙালি/ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণীর সামাজিক স্কিজোফ্রেনিয়া, ক্ষমতালোভী সুবিধাবাদ, প্রতিষ্ঠানিক বামপন্থার নাস্ত্যর্থক পরিণতির মধ্যে ক্রমশ স্পষ্ঠ হয়ে উঠছিল। তাই প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থার মধ্যে পথের সন্ধান না পেয়ে ষাটের দশকের শেষে বাঙালি মধ্যিবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর আদর্শবাদী নতুন প্রজন্মের আশাভঙ্গ এবং অন্বেষণের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটল। অপরিকল্পিত, স্বতঃস্ফুর্ত এই অতর্কিত বিস্ফোরণই হল নকশালআন্দোলন। এই আন্দোলনের সময় তথাকথিত বুর্জোয়া শিক্ষার বিরুদ্ধে পরিকল্পনাহীন, বিকল্পের চিন্তাহীন বিক্ষিপ্ত আক্রমণের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন শক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে যে পরিকল্পিত ধ্বংসাত্মক অরাজকতার সৃষ্টি করল তার প্রথম শিকার হল বাঙলামাধ্যম মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলো। এই নকশালপন্থী বিদ্রোহের আক্রমাণের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে ওঠে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা। শুরু হয় শিক্ষায়তন, পরীক্ষা ভণ্ডুল ইত্যাদির মাধামে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের কার্যক্রম। নকশালপন্থীরা শহরাঞ্চলে লুম্পেনপ্রলেতারিয়েৎদের বিপ্লবের সঙ্গী করে তথাকথিত আর্বান গেরিলাবাহিনী গড়ে তুলতে চাইলেন। নকশালপন্থীদের যথার্থ সংগঠন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বা পরিকল্পনা বলে প্রায় কিছুই ছিল না। এছাড়া কর্মীদের আদর্শে দীক্ষিত এবং তাত্ত্বিক দিক থেকে শিক্ষিত করে তোলার কর্মসূচিও ছিল না বললেই হয়। একথা আজ যেকোনো পর্যবেক্ষকের কাছে স্পষ্ট যে এঁদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও হঠকারিতার সুযোগ নিয়ে দলের তথাকথিত লুম্পেনপ্রলেতারিয়েৎদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক লুম্পেনপ্ররোচক বেনোজলের মতো ঢুকে পড়ে। এদের কাজ হয় একদিকে আতঙ্ক সৃষ্টি করে নকশালপন্থী আন্দোলনকে জনসাধারণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা, অন্যদিকে বামপন্থী ধ্যানধারণার বীজতলা বাংলামাধাম স্কুলগুলির প্রতিষ্ঠানিক মূর্তি ধ্বংস করা। আর এই অবস্থাকে নানা উপায়ে রাজনীতিবিমুখীনতার বিস্তারের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হল। বাংলা মাধ্যম, দীর্ঘকালের ঐতিহ্যপূর্ণ স্কুলগুলোর আর্থিক অবস্থা, শিক্ষার মান এবং পরিবেশের দ্রুত চূড়ান্ত অধোগতি হল, আর পাশাপাশি গজিয়ে উঠল, ফুলে ফেঁপে উঠল অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। এসব স্কুল আক্রান্ত হল না, এসব স্কুলে পরীক্ষা ভন্ডুল হল না, শিক্ষকশিক্ষিতরা নিগৃহীত হল না। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার বাংলা স্কুলের অরাজকতা ও নিম্নমান এড়িয়ে যে কোন মূল্যে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুলে পাঠাতে শুরু করলেন। এই পরিস্থিতিটা ক্রমশ স্বাভাবিক হিসেবে স্থিতি লাভ করল। উচ্চতর শিক্ষা, পেশাদারী শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র এমন কি সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রেও রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামানো, বহিমুর্খী (extravert) চটপটে ইংরেজি বুলিআউড়ানো ছেলেমেয়েদের অগ্রাধিকার স্বীকৃত হল। গত বিশ বছরে ইংরেজি স্কুলের উত্পাদন নতুন প্রজন্ম চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ক্ষমতাসীন সুবিধাভোগী শাসকশোষক শ্রেণীর পক্ষে নিরাপদ, দেশের রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক অবস্থা, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহহীন, স্বার্থপর এবং সুযোগসন্ধানী এই প্রজন্ম ক্রমশ পরিপুষ্ট হচ্ছে, শাসকশোষক শ্রেণীর কাছে মদত পাচ্ছে। অনগ্রসরবাংলাভাষা নিয়ে এদের কোনো মাথা ব্যথা নেই, নিজেদের স্বার্থ এবং প্রতিষ্ঠা বজায় রাখার জন্য কর্মের জগতে ইংরাজির আধিপত্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে এরা বাধ্য। সুতরাং বাংলাভাষার সর্বন্তরে ব্যবহারের সম্ভাবনা সুদুরপরাহত। এই ব্যাপারটা যে পরিকল্পিত ও সংগঠিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই; এর পেছনে ছিল শাসন কর্তৃপক্ষের গুপ্ত আরক্ষা কৃত্যকের মদত ও পরিচালনা এবং অনুমান করা যায়, বিদেশি (নয়াঔপনিবেশিক ধনতান্ত্রিক বা/এবং তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক) গুপ্ত আরক্ষা চক্রের যোগসাজশ, পরামর্শ ও পরিকল্পনা। কলকাতা তথা সারা পশ্চিমবঙ্গে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের নামে দীর্ঘ ঐতিহ্যযুক্ত বাংলামাধ্যম স্কুলগুলি আক্রান্ত হল; গণটোকাটুকি, পরীক্ষা ভণ্ডুল, পরীক্ষককে অপমান ও আক্রমণ ইত্যাদির মাধ্যমে পরীক্ষাব্যবস্থায় চূড়ান্ত অরাজকতা সৃষ্টি করা হল, বিশৃঙ্খলা ও ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে তৈরি হওয়া নিরাপত্তাহীন অবিদ্যায়তনিক পরিস্থিতিতে সাধারণভাবে এই স্কুলগুলির শিক্ষণব্যবস্থা শিকেয় উঠল। একই সময়ে ছাত্রদের কাছ থেকে সামান্য আর্থিক পাওনার আদায় প্রায় বন্ধ হওয়া এবং সরকারি সাহায্যের অপর্যাপ্তি ও অনিয়মিততার ফলে বেশিরভাগ বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক দুরবস্থাও চরমে ওঠে। ফলে এই নৈরাজ্যের মধ্যে মানসিকভাবে নির্যাতিত বাংলামাধ্যম স্কুলের শিক্ষকদের নিয়মিত মাসমাইনে পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসম্মানের কারণে যাঁর অন্য কোনোভাবে জীবিকাঅর্জনের এতটুকু উপায় আছে, নিদেনপক্ষে সরকারি বা বেসরকারি অফিসে অবরবর্গীয় কেরানির পদ পাওয়ার সন্ভাবনা রয়েছে তিনি বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করতে আর রাজি ছিলেন না। পড়ানোর যোগ্যতা, ক্ষমতা এবং ইচ্ছে রয়েছে এমন কেউ আর বাংলামাধ্যম স্কুলের পথে পা বাড়াতে চাইলেন না। পাশাপাশি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলগুলির দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকল। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, বলা যায়, দোকান হিসেবে কলকাতা ও শহরতলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য নতুন ইংরেজিমাধ্যম স্কুল গজিয়ে উঠল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই ইংরেজিমাধ্যম স্কুলগুলির একটিও নকশাল অরাজকতার শিকার হল না, স্কুল আক্রান্ত হল না, পরীক্ষা ভণ্ডুল হল না। অ্যাসবেসটসের ছাউনিওয়ালা বালিগঞ্জের সাউথ পয়েন্ট স্কুলের কয়েকটি নতুন বাড়ি হল — ছাত্রসংখ্যা বাড়তে বাড়তে বারো হাজার ছুঁল, স্কুলের নাম ছাত্রসংখ্যার রেকর্ডের জন্য গিনিজ বুকে স্থান পেল। দুতিনটি সরকারি স্কুল বাদ দিয়ে বাকি বাংলা স্কুলগুলি বাত, পিত্ত, কফে ভোগা রোগীর মতো কোনোরকমে খুঁকতে থাকল। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালিরা — যাঁদের বাড়িতে একাধিক প্রজম্মের পড়াশোনার চল ছিল তাঁরা অন্যান্য খরচ যতটা পারেন কমিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ছেলেমেয়েদের ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পাঠাতে লাগলেন। বর্ধিষ্ঞু মফস্বল শহরগুলিতেও কিছু কিছু ইংরেজিমাধ্যম স্কুল গড়ে উঠতে লাগল। শহরে নিতান্ত গরিব বা/এবং পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কহীন লোকেরা আর গ্রামবাসীরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিম্লমানের বাংলামাধ্যম স্কুলে পাঠাতে লাগলেন। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার সম্পর্কে যে চিন্তা উনিশ থেকে বিশ শতকের ষাটের দশক অবধি বিবর্তিত হচ্ছিল, যা নিয়ে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক চলছিল, তা হঠাৎ পুরোপুরি থেমে গেল। আজকের শহুরে বাঙালি উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের জন্য নির্বাচিত প্রথম ভাষা হল ইংরেজি। দ্বিতীয় ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দি (সর্বভারতীয় সরকারি ভাষা ! হিন্দিতে বলে রাষ্ট্রভাষা!) এসব ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগের বাংলা অক্ষরপরিচয় নেই। চিনে, জাপানি, জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ান, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষা পরিচয়ে কেউ চিনে, কেউ জাপানি, কেউ জার্মান, কেউ ফরাসি, কেউ ইতালিয়ান, কেউ ইংরেজ, ভাষার আত্মপরিচয় হারানো বঙ্গবাসী শেষ পর্যন্ত সুকুমার রায়ের “কিম্ভূত”এ পরিণত হতে চলেছে :

কোথাকার তুই কেরে, নাম নেই ধাম নেই ?

জবাব কি দেবে ছাই, আছে কিছু বলবার ?

কাঁচুমাচু বসে তাই, মনে শুধু তোল্‌পাড়

নই ঘোড়া, নই হাতি, নই সাপ বিচ্ছু,

মৌমাছি প্রজাপতি নই আমি কিচ্ছু ।

মাছ ব্যাং গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই,

নই জুতা নই ছাতা, আমি তবে কেউ নই !

Pushkar Dasgupta: Scattered Thoughts on the Bengali Language ( 2) পুষ্কর দাশগুপ্ত বাংলা ভাষা নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবনা (দ্বিতীয় কিস্তি)

Pushkar Dasgupta: Scattered Thoughts on the Bengali Language 

(Part II)

পুষ্কর দাশগুপ্ত

 বাংলা ভাষা নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবনা

(দ্বিতীয় কিস্তি)

. বাংলায় বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ

আমার হাতের কাছে রয়েছে ‘আকাদেমি বানান অভিধান’ (পঞ্চম সংস্করণ, আগস্ট ২০০৫)।  পাতা ওলটাতে ওলটাতে চোখে পড়ল ‘প্যারি [রী নয়](পৃষ্ঠা ২৮৪)।  অনুমান করলাম এই শব্দটি ফ্রান্সের রাজধানীর নাম Parisএর প্রতিবর্ণীকরণ । মনে পড়ল বেশ কিছু বিদগ্ধ বাঙালি ফ্রান্সের রাজধানীর নাম লেখেন ‘পারী’। অতৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈকার বর্জনীয় — এই বিধি মেনে বানানঅভিধানে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে নির্দেশ করা হয়েছে ‘রী’ নয়। প্রসঙ্গত একাধিক কথা বলার থাকে। ফ্রান্সের রাজধানী উনিশ শতক থেকে ইংরেজি উচ্চারণের অনুসরণে বাঙালিদের কাছে বাংলা ভাষায় ‘প্যারিস’ নামে পরিচিত। তাকে পালটানোর প্রয়োজন বা/এবং যুক্তিটা কী ? যদি বলা হয় ‘প্যারি’ বা ‘পারী’ ‘মূল’ ভাষার ‘শুদ্ধ’ বা ‘সঠিক’ উচ্চারণ তাহলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রথমত এক ভাষার কিছু কিছু ধ্বনিমূল (ফোনিম/phoneme) অন্য একটি ভাষায় অনুপস্থিত থাকতে পারে আর তখন উক্ত অনুপস্থিত ধ্বনিমূলকে লিখিতভাবে প্রকাশ করার জন্য কোনো বর্ণপ্রতীক ও (বর্ণমূল = গ্রাফিম/grapheme) ঐ দ্বিতীয় ভাষায় থাকে না ৷ বানান অভিধানের ‘প্যারি’র অ্যা/æ (বাংলায় দেখা, ইংরেজি cat) ফরাসি ভাষায় নেই। Paris নামের ɑআ’ (ɑ :) অ্যা’ নয়। আবার প্যারিসীয় ফরাসি rএর উচ্চারণ বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতিতে নেই। তাই বাংলা বর্ণ ‘র’ দিয়ে তার যথাযথ প্রকাশ সম্ভব নয়, যেমন বাংলা ‘ড়’, ‘ঢ়’ বা ‘ঢ’ দ্বারা প্রকাশিত ধ্বনিমূলকে ইয়োরোপীয় (গ্রিক, ল্যাটিন) বর্ণমালার কোনো বর্ণমূল দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। ফরাসি iএর দীর্ঘত্ব প্রকাশ করার জন্য যদি দীর্ঘ ঈকার ব্যবহার করা হয় তাহলেও বাঙালির উচ্চারণে তা হ্রস্ব রূপ লাভ করবে। কেননা বাংলা উচ্চারণপদ্ধতিতে ‘ই’ আর ‘ঈ’এর কোনো তফাত নেই — একাক্ষর শব্দে (যেমন চি, ধী) দুটোই দীর্ঘ, অন্যত্র দুটোই হ্রস্ব (যেমন প্রতিবাদী, টীকাটিপ্পনী। দ্বিতীয়ত ‘প্যারিস’ জাতীয় বিভিন্ন বিদেশি ভৌগোলিক বা ব্যক্তির নামের তথাকথিত ‘মূলানুগ’, ‘শুদ্ধ’ বা ‘সঠিক’ উচ্চারণের প্রতিবর্ণীকরণের শুদ্ধিয়জ্ঞ যদি একবার শুরু হয় তাহলে আমরা যে গোলকধাঁধায় প্রবেশ করব তার মধ্যে পথ হারিয়ে ঘোরা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। ইতালি, রোম, মিলান, লিসবন, গ্রিস, অ্যাথেন্স, ইজিপ্ট/মিশর, কাইরো, মেক্সিকো ইত্যাদি আর বলা বা লেখা যাবে না, বলতে বা/এবং লিখতে হবে ইতালিয়া, রমা (ইতালীয়r-এর উচ্চারণ বাংলা ভাষার ‘র’এর উচ্চারণ এক নয়), মিলানো, লিসবোআ, এলাস বা এলাদা, আথিনা (গ্রিক θ থিতা বাংলা ‘থ’ দিয়ে প্রতিবর্ণীকরণ করা যায় না), কেমেৎ/মিস্র্ বা গুমহুরিয়াৎ মিস্র্ আল আরাবিয়া, আলকাহিরা, মেহিকো (আরবি ‘হ’ আর ইস্পানি x ঠিক বাংলা হ’ নয়, আবার তা মহাপ্রাণ ‘খ’ ও নয়)

আকাদেমি বানান অভিধানের ৪৫৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘শ্যাম্পেন’। ‘শ্যাম্পেন’ ফ্রান্সের উক্ত নামের প্রদেশে উৎপাদিত ফেনাওঠা সাদা মদবিশেষ। champagneএর ইংরেজি উচ্চারণের অনুসরণে বাংলা ভাষায় বহু কাল ধরে উক্ত বিশেষ ধরনের মদের নাম হিসেবে ‘শ্যাম্পেন’ শব্দটি প্রচলিত আর এই প্রচলিত রূপটি রক্ষা করাই আমাদের মতে যুক্তিযুক্ত। তবে প্রশ্ন হল ‘শঁপাইন’ (ফরাসিতে gn-এর তরল ‘ɲধ্বনি বাংলায় নেই) যদি তার প্রচলিত রূপ ‘শ্যাম্পেন’ নামে স্বীকৃত হয় তাহলে ‘প্যারিস’এর বদলে বাংলায় ‘প্যারি’ বা ‘পারী’ বলা বা/এবং লেখার লেখার যুক্তিটা কী ?

বানান অভিধানের ২৮৪ পৃষ্ঠায় দেখলাম ‘প্যাস্কাল’। এতদিন শুনে আসা সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞানীদার্শনিক ‘পাস্কাল’এর নাম অভিধানকর্তাদের ইচ্ছায় ‘প্যাস্কাল’এ পরিণত হল কেন তা বোঝা গেল না।

পূর্বোক্ত প্রসঙ্গের জের টেনে বলা যায় যে বেশ কিছুকাল ধরে বাংলা ভাষায় বিদেশি আখ্যাবাচক বিশেষ্যের, বিশেষ ভৌগোলিক ও ব্যাক্তিনামের প্রতিবর্ণীকরণে একটা নৈরাজ্য লক্ষ করা যায়। এখানে ঐ অরাজকতা সম্বন্ধে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। আমার মনে হয়েছে উক্ত নৈরাজ্যের মূলে রয়েছে দু ধরনের অপ্রকৃস্থ মানসিক প্রবণতা। প্রথমত এক ধরনের প্রদর্শক (একজিবিশনিস্ট), পণ্ডিতম্মন্যআত্মস্ভরিতা (ওরা/অন্যেরা যা বলে বা লেখে তা ভুল, আমিই হলাম জ্ঞানের জিম্মাদার আমি যা বলব/লিখব তাই ধ্রুবসতা, তাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য)। দ্বিতীয়ত ঔপনিবেশিতের উপসর্গে (কলোনাইজড সিনড্রমস/ colonized syndromes) ভোগা বাঙালি/ভারতীয় বুদ্ধিজীবিশ্রেণীর পাশ্চাত্যের মুখোমুখি হীনমন্যতা; তাই জাপানি, চিনে, থাই, ভিয়েতনামীয়, ইন্দোনেশীয়, আরবি ইত্যাদি ভাষার নাম সম্পর্কে বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু পশ্চিমি নামের ‘মূল’, ‘সঠিক’ উচ্চারণ দিতে না পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ! —এই প্যারানোইয়ায় তারা মুহ্যমান। কী কাণ্ড ! লোকে ভাববে ও জানে না !

ঘটনাচক্রে বেশ কিছু বছর ধরে আমি ইয়োরোপপ্রবাসী । তাছাড়া অন্নসংস্থানের জন্য তার বহু আগে থেকেই আমাকে অইংরেজি একটি ইয়োরোপীয় ভাষা পড়াতে হত, ঐ ভাষার সূত্রে বারবার ইয়োরোপেও আসতে হত। ফলে কলকাতায় দেখা হলে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, অমুক নামের সঠিক উচ্চারণটা কী হবে? নামটা বাংলায় কীভাবে লেখা যাবে?আমি জবাব দিই, সাহেবরা আমাদের নামধাম ওদের উচ্চারণপদ্ধতিতে, ওদের মতো করে উচ্চারণ করে। আমাদেরও উচিত বাংলা ভাষায় ওদের নামধামের প্রচলিত উচ্চারণ আর বানানগুলি রাখা আর নতুন নামধামের ক্ষেত্রে তথাকথিত শুদ্ধ বা আসল উচ্চারণ নিয়ে মাথা খারাপ না করে বাঙালির উচ্চারণঅভ্যাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, বাঙালির ধাতে সয় এরকম বানানে প্রতিবর্ণীকরণ করা।’ প্রশ্নকর্তা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন — আমার জ্ঞানের বহর সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে বলে বোধ হয়।

ইয়োরোপ আমেরিকার নাম করলে এ দেশের বুদ্ধিজীবিরা কিছুটা নড়েচড়ে বসেন, বেশ খানিকটা স্বস্তি পান। তাই ইয়োরোপীয় পরিপ্রেক্ষিতে যাওয়া যাক, ঐ পশ্চিমি পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে আমাদের হীনমন্যতা আর মানসিক দৈন্যের ছবিটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের রাজধানীর নামের বাংলা ভাষায় উচ্চারণপ্রতিবণীকরণ নিয়ে প্যারিসপ্যারিপারীর টানাহ্যাঁচড়ার কথা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। ঐ নগরীকে ফরাসি বাদ দিয়ে অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষায় বলা বা/এবং লেখা হয়ে থেকে প্যারিস, পারিস, পারিয়িস, পারিসি, ইত্যাদি। ঐ সব ভাষা বলা বা লেখার সময় কেউ উক্ত নগরীর নামের তথাকথিত ‘শুদ্ধ’, ‘মূলানুগ’ উচ্চারণ — প্রতিবর্ণীকরণের চেষ্টা করে না। বস্তুত এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তথাকথিত শুদ্ধ করার চেষ্টা করলে ভাষাব্যবহারের উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হবে অর্থাৎ তখন ভাষা আর তার উদ্দিষ্ট পরিগ্রাহকের (রিসিভারের) কাছে বক্তব্যের সংজ্ঞাপন (কম্যুনিকেশন) করতে পারবে না। ইয়োরোপে সরু এক চিলতে ইংলিশ চ্যানেলের দুপাশে রয়েছে দুটি দেশ — গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স — ভাষা ইংরেজি আর ফরাসি। ফরাসিতে গ্রেট ব্রিটেনকে বলা হয় গ্রঁদ ব্রতাইন, ইংল্যান্ডকে অঁগলতের, ওয়েলসকে গাল, শেকসপিয়ারকে শেকসপির, লন্ডনকে লোঁদর্। আর ইংরেজিতে ফ্রঁসকে বলা হয় ফ্রান্স, পারিকে প্যারিস, ব্রতাইনকে ব্রিট্যানি, মঁশকে ইংলিশ চ্যানেল, তুর এফেলকে আইফেল টাওয়ার, জান দার্ককে জোয়ান অব আর্ক ৷ ফরাসি বলতে পারে এরকম একজন ইংরেজকে ফরাসিতে সংজ্ঞাপন করতে গিয়ে বলতে হয় গ্রঁদ ব্রতাইন, অঁগলতের, গাল, শেকসপির, লোঁদর্ আর ঠিক একই ভাবে একজন ফরাসিকে ইংরেজিতে বলতে হয় ফ্রান্স, প্যারিস, ব্রিটানি, ইংলিশ চ্যানেল, আইফেল টাওয়ার, জান দার্ক ৷ অথচ বাংলায় বহুকাল ধরে প্রচলিত জার্মান মহাকবি গেটের নাম ‘শুদ্ধভাবে’ উপস্থাপিত করতে গিয়ে গ্যেটে, গয়টে, গ্যোয়টে, গ্যোটে, ইত্যাদি কত কিছুই না বলা বা/এবং লেখা হয়। ‘ইডিপাস’ নামে পরিচিত গ্রিক ধ্রুপদী নাটক তথা তার নায়কের নাম ইডিপাস, ঈডিপাস, অয়দিপুস, অয়দিপাউস, ইত্যাদির মধ্যে কোনটা ‘সাঠিক’ তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ তর্ক হয়। উনিশ শতকের এক বিখ্যাত ফরাসি কবির নাম ব়্যাঁবো, হ্র্যাম্বো, হ্র্যাঁবো, খ্যাম্বো ইত্যাদির মধ্যে কোনটা ‘মূলানুগ’ তা নিয়ে লড়াই বেধে যায়। অথচ ফরাসিতে সংজ্ঞাপন করতে গেলে তথাকথিতসঠিক’, ‘মূলানাগ’ উচ্চারণ ভুলে গিয়ে একজন জার্মান, একজন গ্রিক, একজন ইতালিয়ান, এমন কী একজন বাঙালিকেও বলতে হয় ‘গ্যোৎ ’ (গেটে), ‘য়্যদিপ’ (ইডিপাস), দঁত (দান্তে)

ইদানীং কালের বাংলা ভাষার তাবৎ লিখিত উৎপাদনে (সংবাদপত্র, সামায়িক পত্র, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনায়) পশ্চিমি আখ্যাবাচক নামপদের উচ্চারণপ্রতিবর্ণীকরণের অরাজকতার অজস্র দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। আমার সামনে রয়েছে সুবল সামন্ত সম্পাদিত সাম্প্রতিক কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যপত্রিকা ‘এবং মুশেয়ারা’র একটি সংখ্যা। এই বিশেষ সংখ্যাটির বিষয়বস্তু হল ষোড়শ শতকের বিখ্যাত ইস্পানি উপন্যাস Don Quixote। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং সাহিত্যস্রষ্টা উপন্যাসটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন ৷ এসব আলোচনার বিচার বা মূল্যায়ন এখানে আমার আলোচ্য নয় আর তা আমার ক্ষমতারও বাইরে। তবে পাত্রিকাটিতে প্রকাশিত বিভিন্ন রচনায় উক্ত উপন্যাসের শিরোনাম তথা প্রধান চরিত্র, প্রধান চরিত্রের সঙ্গী ও উপন্যাসের রচয়িতার নামের যে উচ্চারণপ্রতিবর্ণীকরণগুলি চোখে পড়ল তা হতবুদ্ধি করার মতো:

. উপন্যাস ও তার প্রধান চরিত্রের নাম Don Quixote : ডন কুইকসোট, ডন কুইক্ সোট, ডন কুইকজোট, ডন কুইক্ জোট, ডন কিহ্বোতে (বাংলায় ‘হ্বো’র উচ্চারণটা কী ?), ডন কিহোতে, দন কিহোতে, দোন কিখোতে, ডন কিওটি, ডন কুইক্সোট, দোন কিহোতি, ডন কুইজোট, ডন কিহোটে, দন কিশোটে, দন কিহোটে।

. প্রধান চরিত্রের পদবির অংশ de la Mancha: দি লা মাঞ্চা, দ্য লা মাংকা, দ্য লা মাঞ্চা, ডি লা মাঞ্চা, দে লা মানচা, দে লা মাঞ্চা।

. প্রধান চরিত্রের সঙ্গীর নাম Sancho Panza : সাঙ্কো, স্যাঙ্কো, সাঙ্কো পাঞ্জা, সাংকো পাঞ্জা, সানচো পানসা, সাঞ্চো পাঞ্জা, সাঙ্কো পানসা, সাঁকো পাঁজা।

. উপন্যাসের রচয়িতার নাম Miguel de Cervantes Saavedra: মিগুয়েল দি থেরভান্তেস, সার্ভান্টিস, সের্ভান্তেস, সার্ভেন্তেজ, সেরভান্তেস, সের্ভান্তেস, মিগেল দে সেরভানতেস সাভেদ্রা, সারভেন্তিস, সারভেন্তেস, সারভ্যানটিস, মিগুয়েল সারভানতিস, দোন মিহুয়েল দে সের্ভান্তেস সাভেদ্রা, সেরভেন্তেস, সার্ভান্তিস, মিগেল দে সেরভান্তেস সাবেদ্রা, মিগেল দ থেরভান্টে সাআভেদ্রা, মিগেল দ্য সেরবানতেস, মিখুয়েল দে সেরভানতেস সাভেদ্রা।

ওপরের তালিকা থেকে সাধারণভাবে বাংলা ভাষার অস্থির নৈরাজ্যের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই অস্থিরতা তার পরিপুষ্টি ও পরিণতির অভাবকে সূচিত করে। আমি ‘ভারতীয়’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘গান্ধি’র দেশের লোক, ‘কলকাতা’ থেকে এসেছি। একথা বোঝানোর জন্য আমাকে ইংরেজিতে বলতে হয়, আমি ‘ইন্ডিয়া’ থেকে আসা ‘ইন্ডিয়ান’ (আমেরিকার ‘ইন্ডিয়ান’ নই), ‘টেগোর’ আর ‘গ্যান্ডি’র দেশের লোক, ‘ক্যালকাটা’ (‘কোলক্যাটা’এখনো পরিচিত নয়) থেকে এসেছি ; ফরাসিতে পরিচয় দিতে হয়, আমি ‘অ্যাঁদ’ (ল্যাঁদ) থেকে আসা ‘অ্যাঁদিয়্যাঁ’, ‘তাগোর’ আর ‘গঁদি’র দেশের লোক, ‘কালক্যুতা’ খেকে এসেছি ; গ্রিকে বলতে হয়, আমি ‘ইন্দিয়া’ থেকে আসা ‘ইন্দস’ (আমেরিকার ‘ইন্দিয়ানস’ নই), ‘তাগোর’ আর ‘গান্দি’র দেশের লোক, ‘কালকুতা’ (‘কলকাতা’ এখানো কেউ জানে না) থেকে এসেছি। আমাকে ব্রিটিশ ইংরেজিতে বলতে হয় ডন কুইকজোট, (টেক্সমেক্সএর দেশ আমেরিকার) মার্কিন ইংরেজিতে ডন (বা দন) কিহোতে। অর্থাৎ সংজ্ঞাপনের সর্বস্তরে ব্যবহৃত যেকোনো পরিণত ভাষায় আখ্যাবাচক বিদেশি নামপদের (ভৌগোলিক বা ব্যত্তির নামের) অনন্য একটি সর্বজনগ্রাহ্য মান উচ্চারণপ্রতিবর্ণীকরণের রূপ রয়েছে। ঐ রূপ উক্ত ভাষার ধ্বনিউৎপাদনপদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে উঠেছে। সেখানে ঔপনিবেশিতের উপসর্গের প্রকাশক হীনমন্যতা থেকে ‘আসল’, ‘সঠিক’, ‘মূলানুগ’ উচ্চারণের অর্থহীন অনুকরণের প্রয়াস দেখা যায় না। বহু ভাষায় সংজ্ঞাপনে সক্ষম বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা তাঁরা কি এ জাতীয় প্রয়াস কোনো পরিণত ভাষায় লক্ষ করেছেন?

এমনকী বাঙালির হীনমন্যতার প্রকাশ ভারতীয় ভাষার আখ্যাবাচক নামপদের প্রতিবর্ণীকরণেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। হিন্দিতে বংগাল, কলকাত্তা, হাবড়া ইত্যাদি বলা বা লেখা হত এবং এখানো হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় সম্প্রতি গাঁধি, পটনা, গ্বার্লিয়র (শব্দের আদি অক্ষরে বাংলায় বযুক্ত ব্যঞ্জনে ‘ব’ বা ‘বফলার’ কোনো উচ্চারণ নেই যেমন ‘স্বাধীনতা’, তাহলে ‘গ্বা’এর উচ্চারণ কী ?) ইত্যাদি লেখা শুরু হয়েছে।

 প্রসঙ্গত আরেকটি প্রশ্ন : আখ্যাবাচক নামপদের উচ্চারণ—প্রতিবর্ণীকরণের মান, সর্বজনগ্রাহ্য রূপ স্থির করা — যা চলে আসছে (প্যারিস, অ্যাথেন্স, ইডিপাস, গেটে, ডন কুইকজোট ইত্যাদি) তাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া আর বাংলা ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক সংস্থান (স্ট্রাকচার) মেনে নতুন বিদেশি নামের উচ্চারণ — প্রতিবর্ণীকরণের একটা নিয়মপ্রণালী তৈরি করা কি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আর ঢাকার বাংলা একাডেমির যৌথ কর্তব্য হয়ে উঠতে পারে না ? তবে এ প্রয়াসেও বিদেশি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বে জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে যা দরকার তা হল বাংলা ভাষার উচ্চারণরীতির কাঠামোয় বিদেশি শব্দ তথা ধ্বনিকে (প্রয়োজন অনুসারে রূপান্তরিত করে) স্থান দেওয়া — বাঙালির ধ্বনিউৎপাদন স্বভাবের সঙ্গে তাকে খাপ খাওয়ানো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানসংস্কার সমিতি ১৯৩৬ সালে তাঁদের প্রস্তাবে Z-র প্রতিবর্ণীকরণের নিম্নরেখাযুক্ত অথবা দুটি বিন্দু বা ফুটকিযুক্ত জ* ব্যবহারের কথা বলেছিলেন, তারপর বুদ্ধদেব বসু pleasure-এর S বা ফরাসিj আর g(+e/ i)এর জন্য একটা বিন্দু বা ফুটকিওয়ালা ‘জ’*-এর প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু বিদেশি ভাষার উচ্চারণে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত নয় এরকম বাঙালির উচ্চারণে ফুটকি ছাড়া ‘জ’ বা/এবং নিম্নরেখাযুক্ত তথা দুটি বা একটি ফুটকিওয়ালা *এক আর অনন্য বাংলা ‘জ’* পরিণত হতে বাধ্য ৷

আমার শেষ জিজ্ঞাসা : বাংলা ভাষা কি কখনো সাবালক হবে না ? আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের সহজাত নিয়ম মেনে বিদেশি শব্দকে নিজস্ব ধ্বনিসংস্থানের মধ্যে রূশান্তরিত তথা আত্মীকৃত করে নিতে পারবে না ? বাংলা ভাষা কি চিরকাল শৈশবের অস্ফুট, অপটু অনুকরণে সাহেবদের নামধাম আউড়াতে থাকবে ? বাংলা ভাষার চিরশৈশব কি কাটবে না ?


 

. বাংলা ভাষা নিয়ে ভ্যানতাড়া

সাদা চামড়ার সায়েবরা যদ্দিন এদেশের মাথায় বসেছিল তদ্দিন বাপ বলে ইংরিজি বুলিটা রপ্ত করতে হত ৷ নইলে লোকজনের ভিড়ে ভদ্দরলোক বলে কল্কে মিলত না, বাপের ঠাকুর লালমুখোদের তোয়াজ করে নানান ধান্দা করার উপায় থাকত না, আঙুলে থুতু লাগিয়ে নোট গোণা যেত না ৷হেয়ার কলিন পামরশ্চ কেরী মার্শমেনস্তথা ৷ পঞ্চগোরা স্মরেনিত্যং মহাপাতকনাশনম্ ৷৷ — তার মানে ঘুম থেকে ধরমর করে উঠে চোদ্দপুরুষের আউড়ানো পঞ্চকন্যার নাম খেয়ে ফেলে তার বদলে পঞ্চগোরার নাম আউড়েও দিনভর গোরাদের হাতে কেলানি খাওয়ার ভয়ে চিমসে মেরে থাকতে হত ৷ অবশ্যি ওরই ফাঁকফোকরে, ঝোপ বুঝে কোপ মেরে, হরেক কিসিমের ফন্দিফিকির করে ফায়দা লোটার চেষ্টাচরিত্তির চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো রাস্তা ছিল না ৷ আর ইংরিজিতে বুকনি ঝাড়তে পারলে হেভি সুবিদে হত — সায়েব ফাদার সায়েব মাদার বলে লালমুখোদের এঁড়ে তেল মাখানো যেত, মজাসে দিশি ছোটলোকদের চমকানো কি টুপি পরানো যেত ৷ তবু ইংরেজিওয়ালা টপ্ টপ্ ভদ্দরলোকদের মনটা চুপসে থাকত৷ চব্বিশ ঘন্টা গটমট ইংরিজি বলেও গোরা সায়েবগুলোর মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা দায়, দিনে পাঁচশবার ঝাড় খেতে হয়, বিলিতি খিস্তিখাস্তা মুক বুজে হজম করতে হয়, মায় চুনোগলির বেজম্মা ফিরিঙ্গিগুলো অব্দি ব্লাডি নিগার বলে মামাসি তোলে ৷ তাই মানইজ্জতে পয়জার খাওয়া ইংরিজিতে এগ্গাদা পাশ দেওয়া ভদ্দরলোকদের অনেকে মায়ের মুকের ভাষায় গপ্পোকবতে কি বইপত্তর লিখে বা পড়ে একটুখানি সোয়াস্তি পেতেন ৷ ঐ বাঙালিপনাটা ছিল বাবুদের বুকের বেথার মলম, ওটা ছিল সায়েবদের হুকুমদারির বাইরে ৷ খিদিরপুরের মদুসুদন দত্ত থেকে হাটখোলার সুদিন দত্ত পজ্জন্ত কোটপ্যান্টুলুন পরা বহুত তাবড় তাবড় দিশি ইংরিজিোয়ালাদের বাংলা বাজারটাই ছিল মাতা গোঁজার ঠেক ৷

তারপর বাপঠাকুদ্দার আমলের সেসব সখের প্রাণ গড়ের মাঠের দিন ভোগে গেল ৷ দুদুটো লড়াইয়ের হেভি কিচাইন, তিরিশের টাইমে দুনিয়া জুড়ে মালগন্ডার মন্দা — সায়েবদের জান কয়লা — বলা যায়, ও দুটো রগে উঠে গেল! দেখা গেল শেষমেশ সায়েবের বাচ্চারা  ফুটল ৷ তবে ওটা শুধু চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য, আসলে গোরারা রামু শামুর মতো ভোট পবলিককে ঢপের চপ গেলাল ৷ ব্রিটিশ লালমুখোগুলো নামকা ওয়াস্তে সটকে পড়ল, আসল ব্যাপারটা হল, একা শুধু ব্রিটিশ গোরারা নয় তাবৎ লালমুখোরা যেসব দেশ জবরদখল করে তার মাথায় গেঁড়ে বসেছিল সেগুলো একটার পর একটা লোক দেখানো কায়দায় ছেড়ে দিয়ে সবাই মিলেঝুলে একাট্টা হয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াবে বলে ঠিক করল ৷ মারদাঙ্গা করে, তার ওপর আবার বন্দে মাতাগরম বন্দে পেটগরমের ঝক্কি সামলে সায়েবদের আর পোষাচ্ছিল না, লাভের গুড় মাছিতে খাচ্ছিল ৷ ওদের মাথায় বাওয়া জিলিবির প্যাঁচ — ওরা দেশটাকে ভেঙে দুটুকরো করে রামওয়ালা আর আল্লাহোআকবরওয়ালাদের মধ্যে বেঁটে দিল, যাতে দুদলের কামড়াকামড়ি লেগে থাকে, তাঅলে ঘোলা জলে নির্ঝঞ্ঝাটে মাছ ধরা যাবে, হরবকত পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানোর সুবিদে  হবে ৷ বলতে কী সব সায়েবে মিলেঝুলে পেছন থেকে সুতো টানতে পারলে আর কোনো ঝক্কি পোয়াতে হবে না, মস্তিসে রস নিঙড়ে চুক চুক করে খাওয়া যাবে — হারামির বাচ্চা দিশি কেলে ভূতগুলো জাতির বাপের মতো নেংটি পরে আঁটি চুষবে ৷ এদ্দিন যারা সায়েবদের কাগজে পোছা হেগো পোঁদ চেটে এসেছে, গোরারা সেই দিশি ইংরিজিওয়ালাদের অত্থাৎ কিনা মেকলে সায়েবের বেজম্মা নাতিপুতিদের তখতে বসিয়ে দিয়ে গেল ৷ ঐ কেলে ইংরিজিওয়ালারা সায়েবদের ফেলে যাওয়া চেয়ারে সব গ্যাঁট হয়ে বসল, হয়ে উঠল গোরাদের নতুন ফিকিরের আড়কাঠি ৷ লালমুখোদের সুতো টানার মন্তর হয়ে থাকল ইংরিজি বুলি ৷ আর মেকলে সায়েবের ঐ বেজম্মা নাতিপুতিদের ছকে ইংরিজি বুলিটা দেশে আরো জবরদস্তভাবে মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসল ৷ নয়া জমানায় ঐ কেলে ইংরিজিওয়ালাদের আর মাতা গোঁজার ঠেকের দরকার রইল না, ওরাই হয়ে উঠল দেশের মাতা — কথায় বলে, ছাতুবাবু লাটুবাবু হয়ে গেল গায়েব ৷ এবার সায়েব তো সায়েব কেলে সায়েব ৷৷ কিম্বা, রাধাকান্ত নবকেস্ট একে একে গেল সবাই অক্কা ৷ এখন শুধু কেলে সায়েবরা মেরে যাচ্ছে দানে দানে ছক্কা ৷৷ ওদের সবাই — মেজ সায়েব, সেজ সায়েব, ছোট সায়েব আর ন সায়েবরা সবাই সুটবুট চাপিয়ে ভাসন দিতে লাগল — ইংরিজি হল আমাদের দিশি ভাষা নিজের ভাযা ৷ ও ভাষা ছাড়লে চলবে না ৷ আর বিলিতি ধলা সায়েবরা হল গিয়ে আমাদের দাদা ৷ (না না, মায়ের পেটের ভাই নয়, তুতো দাদা ৷ কোন তুতো? খুড়তুতো? মাসতুতো? পিসতুতো? নারে বাঞ্চোত না, ওসব দিশি তুতো নয়, খাঁটি বিলিতি সম্পক্ক — গাঁড়তুতো)

সায়েবি জমানায় মদুসুদন দত্ত থেকে ভবানী ভটচায্, সরোজিনী নাইডু অব্দি নেটিভদের বেশ দুচারজন ইংরিজিতে বই ছাপাত ৷ সায়েবদেরতো কথা বাদই দাও, এমন কী দিশি ভদ্দরলোকরাও তাদের বড় একটা পাত্তা দিত না ৷ লোকজন বলাবলি করত, ওসব হল গিয়ে ফিরিঙ্গি লেখা — অ্যাংলোইণ্ডিয়ান রাইটিং । এবার লালমুখোরা দেখল, ইংরিজি বুলিটা দেশের ঘাড়ে যত চেপে বসছে ওদের আঁখ মাড়াইয়ের কল গরগর ঘরঘর করে ততই বেড়ে চলছে, তেল দিতে হচ্ছে না। তাই ফায়দা তোলার আঁক কষে সায়েবরা কেলোদের মাথায় হাত বোলানোর জন্যে ফতোয়া দিল, কেলে সায়েবদের ইংরিজি মালগুলো মন্দ নয়। গোরা সায়েবের থুতু গেলা কেলো সায়েবদের বিশ ইঞ্চি ছাতি ফুলে ফেঁপে ছত্তিশ ইঞ্চি হয়ে উঠল। ওরা বুকনি ঝাড়তে লাগল, আমাদের ইংরিজি মাল আর অ্যাংলোইণ্ডিয়ান নয়, ইন্দোঅ্যাংগ্লিকান । গোরারা এসব কেলেদের দুচারবার কালাপানি পার করে বিলেতআমেরিকা মুল্লুকে চক্কর দিইয়ে আনল। কেলেরা হেভি লেজ নাড়াতে লাগল। আনকোরা বিলিতি কোটপ্যান্টুলুনে ঘেমে নেয়ে ওরা লেকচারে লেকচারে অন্ধকার করে দিল। যোদো মোধোরও হুঁশ হল। ইংরিজি বুলি রপ্ত না থাকলে টু পাইস কামানো যাবে না, পাড়ায় ইজ্জত থাকবে না, মায় মেয়েকে কোনো একটা মন্দের ভালো পাওরের গলায়ও ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে না। ফটাফট ইংরিজি বকতে না পারলে ছেলেপিলেকে লাফাঙ্গা হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হবে, বাপের হোটেলে খেয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করতে হবে। যোদো তার ছেলেকে বাপের ইংরিজি বকা লালু ছেলে বানাবার জন্যে ঘটিবাটি বন্দক দিয়ে ইংরিজি গোয়ালে ঢুকিয়ে দিল। মোধো পেটে গামছা বেঁদে এগ্গাদা নোট খসিয়ে মেয়েটাকে ধুমসো কেলে মেমসায়েব আন্টিদের জিম্মায় পৌঁছে দিয়ে এল। এবার বাড়ির মধ্যে ইঞ্জিরি বকা শুরু হয়ে গেল। আন্ডাবাচ্চা আর বাড়ির কুত্তার সঙ্গে ইয়েসনোকামগো সিটইট বলে ইঞ্জিরি না ফাটালে আর চলে না। যোদোর লেড়েকুত্তা ভুলোর নতুন নাম দেয়া হল টমি। মোধোর বাড়ির মেনি বেড়ালটা হয়ে গেল পুসি। পাড়ার কাকা, জেঠা আর কাকা, জেঠা রইল না, হয়ে গেল আংকল ; জেঠিমা, খুড়িমা, মাসিমা, পিসিমা, গুষ্টিশুদ্দু সব ঝেঁটিয়ে আন্টি।

বাপঠাকুদ্দার আমলে দেশে জাতফাত নিয়ে হরবকত হেভি ঝামেলা লেগে থাকত: বামুন, বোদ্যি, কায়েত, শুদ্দুর, নম শুদ্দুর, বড়জাত, ছোটজাত, জলচল. জলঅচল, নবশাখ, হেলে কৈবত্ত, জেলে কৈবত্ত আরো কতো যে ঘোট! ওসব ভোগে গেছে, নম শুদ্দুরের হোটেলে কুলীন রাঢ়ী বামুনের ছেলে বাসন মাজছে, বারিন্দির বামুনের মেয়ে জাতে জেলে কৈবত্ত ছেলেকে লভ মেরেজ করে দিব্যি ঘর করছে ৷ দিনকাল পালটে গ্যাছে, আজকাল কেউ ওসব নিয়ে মাতা ঘামায় না, ধোপা নাপিত বন্দ করে একঘরে করার দিন চলে গ্যাছে, ৷ এখন জাতপাতের নতুন ছক ৷ এই নতুন ছকের মাপকাঠি হল গিয়ে কে কতটা ইংরিজিতে সরগর তার ওপর ৷ তুমি গুরু গটমট করে ইংরিজি বল আর ঘ্যাচঘ্যাচ করে ইংরিজি লেখ ৷ তুমি হলে বামুন, তাতে যদি আবার সায়েবি ইস্কুল থেকে বেরুনো হও, ইংরিজি বলার সময় কথার আদ্দেকটা চিবিয়ে খেয়ে ফেল, বাড়িতে চাকরবাকর আর ডেরাইভার ছাড়া সবার সঙ্গে ইংরিজি বল তাহলে তুমি হলে গিয়ে নৈকষ্য কুলীন ৷ এর পর যারা দিশি কায়দায় কোনোরকমে ইংরেজি বলে আর লেখে তারা হল যজমেনে বামুন ৷ আর যারা কানার মধ্যে ঝাপসা দ্যাখে অত্থাৎ ইংরেজি বলতে গেলে ঘন ঘন ঢোক গেলে, আর লিখতে গেলে মাথা চুলকিয়ে মাথায় প্রায় টাক ফেলে দেয় তারা হল গিয়ে বোদ্দি কি কায়েত, তারপর রয়েছে যারা কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ইংরেজি দুচার লাইন পড়তে পারে তবে বলতে গেলে সব গুলিয়ে যায়, বুকের ভেতর ধপাস ধপাস করে এরা জলচল — বলা যায় নবশাখ ৷ এর পরের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লোক হল জলঅচল আর অচ্ছুৎ ৷

লোকে বলে, গোরারা নাকি কেটে পডেছে ৷ তার মানে দেশ নাকি স্বাধীন হয়ে গেছে ৷ এখন সবার নাকি সমান অধিকার ৷ কী বললে? ঢপ? ঢপ হতে যাবে কেন? তোমার কি চোখ বলতে কিছুই নেই? দেখতে পাচ্ছনা সবাই স্বাধীন দেশের নাগরিক, মাথাপিছু সবার একটা করে ভোট ৷ তবে একথাটাও মিথ্যে নয় যে ঐ ভোটেই শুরু আর ঐ ভোটেই শেষ ৷ তোমরা হলে গিয়ে ছোটলোক পবলিক, তোমরা যে ভোট দিতে পারছ ওটাই তোমাদের চোদ্দপুরুযের ভাগ্যি, ভোটের কাগজটা বাক্সে গুঁজে দিয়েমুখ বুজে শুনসান ফুটে যাও ৷ দেশের আইনকানুন, সরকারি চিঠিপত্তর, দলিলদস্তাবেজ, কাজকম্ম সবই ইংরিজিতে, তোমার হুদ্দোর বাইরে ৷ তুমি ইংরিজিতে পোক্ত নও, তুমি শালা জলঅচল ছোটজাত! ইংরিজির শাসন যুগ যুগ জিয়ো! মেকলে সায়েবের বেজম্মা নাতিপুতিদের রাজত্ব চলছে চলবে!

ঐ যা বলছিলাম, সায়েবরা দুঁদে মাল, ওরা বুঝতে পারল ওদের ছক দুয়ে দুয়ে চার হতে শুরু করেছে। রস চাখতে চাখতে লালমুখোদের মালুম হল, খেলটা হেভি জমে উঠেছে, আর গোটাকয়েক দানেই কিস্তি মাৎ । তারা দিশি ইংরিজিয়ালাদের বেশ করে পিঠ চাপড়ে দিল, কেলেদের ইংরিজি বইপত্তরের তারিফ করতে লাগল মায় দুচারটে প্রাইজ ফাইজও ঠেকিয়ে দিল। তোল্লাই খেয়ে ফুলে ওঠা দিশি কেলে সায়েবরা বাওয়াল শুরু করে দিল। বুঝলে, আমাদের মাল হচ্ছে দিশি ইংরিজি। বিলিতি ইংরিজিতে বেশ কিছু খাদ ঢুকে পড়েছে — আমাদের মালটা যোল আনার ওপর বত্তিশ আনা খাঁটি ; আমাদের হল গিয়ে ইন্ডিয়ান ইংলিশ। (মা শেৎলার নামে কিরে খেয়ে বলছি, পেছন থেকে হারামির গাছ কেউ একটা ফুট কাটল, জাঙিয়ার বুকপকেট আর কি !) বাজারে বাংলা কাগজগুলোর বাঙালি বাবুরা ঐ সায়েবি ইংরেজি বুলিতে খুব একটা রপ্ত নয়। ওদের মধ্যে দুচাজ্জন — যারা কানার মধ্যে ঝাপসা দেখে — ওদেরও বুলিটা পেটে আসে তো মুখে আসে না। ওরা তো তুলকালাম ধুমধাড়াক্কা লাগিয়ে দিল। অমুক দিশি সায়ের আর তমুক কেলে মেমসায়েব ইংরিজিতে বই ছাপিয়েছে। সে বই বেরিয়েছে খোদ বিলেত মুল্লুক থেকে। তার ওপর তিন তিনটে বিলিতি কাগজে কেলে মেমসায়েবের বগলকাটা মেনা দেখানো ফোটো উঠেছে। যাই বলো বস্, কেলি আছে ! আর শালা, কথায় বলে, মাগির মাগি লেউইনস্কি, নেশার নেশা হুইস্কি ; পেশার পেশা দালালগিরি, বুলির বুলি ইঞ্জিরি। ওর সঙ্গে বাংলা বুলির কোনো কমপারিজন চলে ? — কোথায় গালের তিল আর কোথায় হাইড্রোসিল ! চাঁদে আর পোঁদে ? বাংলা কাগজয়ালাদের বুকের ভেতরটা সারাক্ষণ ঢিপ ঢিপ করে, পাছে পাবলিক ওদের পট্টিটা ধরে ফেলে — বুঝে ফেলে ওদের ইংরিজি বুলির দখলদারি তেমন পাকাপোক্ত নয়। তাই ঐ বাংলা কাগজয়ালারাই সারাক্ষণ ইংরিজির ঢাক পিটিয়ে কানে তালা লাগিয়ে দেয়।

তাঅলে বল এখন বাংলা বুলির হালটা কী ? বাংলা মাল আর বাংলা বুলি চলছে চলবে। তবে বস্, চাদ্দিকের ইংরিজির ধামাকায় বাংলাটা আর গিয়ার খাচ্ছে না। ওদিকে হিন্দিয়ালারাও তড়পাচ্ছে, আরে রাষ্ট্রভাষা বোল। তা যা বলছিলাম, বাংলা বুলির হাল। বাংলা এখন পুরোপুরি গরিবগুর্বো, ছোটলোকদের বুলি। ফেকলু চাকরবাকর, বাজারের মাছয়ালা, আনাজয়ালা, আর গাঁয়ের চাষাভুষোর বুলি হল গিয়ে বাংলা। পাত্তি বানাতে চাও, জ্ঞানফ্যানের বেওসায় নাক গলাতে চাও, মানইজ্জত পেতে চাও, পাঁজ্জন ঘ্যাম লোকের পাশে কি সামনে চেয়ারে বসে পা নাচাতে চাও, বিলিতি মালে চুমুক দিতে দিতে ঝিং চাকচাক ডিস্কো মিউজিক শুনতে চাও, মায় ঠোঁটে গালে রঙ লাগানো জিন পরা ফ্রেশ ডবকা মাল কি জম্পেশ মেয়েছেলে তুলতে চাও — তোমার মুখ থেকে বাওয়া ইংরিজির পপকর্ন ফোটাতে হবে। (তুইত শালা আচ্ছা টিউবলাইট! ওসব খৈমুড়ির দিন কবে চলে গেছে ! দেখিস না ভদ্দরলোকেরা আর ঝলমু়ড়ি খায় না। গলির মোড়ে সবে চুলকুনি জাগা বাবুদের বাড়ির নেকি মেয়েগুলো ইংরিজিতে খুক খুক হাসতে হাসতে হলিউড থেকে আসা পপকর্ন আর বলিউড থেকে আসা ভেলপুরি খায়।)। হ্যাঁ, যা বলছিলাম ননেস্টপ ইঞ্জিরি বকে যেতে হবে আর সঙ্গে সঙ্গে খচাখচ ইঞ্জিরি লিকতে হবে। (পেছন থেকে আরেক বাঞ্চোতের বাচ্চা অ্যাড করল, সকালে দাঁতন দিয়ে দাঁত মেজে রুটিমুটি খেয়ে হাগতে যাওয়া চলবে না, দুপুরে আর রাতে পাত পেতে গাণ্ডে পিণ্ডে গেলা যাবে না। টুথব্রাস করে ব্রেকফাস্ট সেরে টয়লেটে যেতে হবে, ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ আর ডিনার করতে হবে। — মাইরি বলছি, এই ছোটলোকদের কথায় কিছু মাইণ্ড করো না, বস্। বাপের ক্যাপফাটা এসব ছেলেপিলেদের আর মানুষ করা গেলনা!)

কী বলছিলে ? বাংলা বলতে চাও ? বাংলায় লেকালিকি করতে চাও ? মাতাফাতা সব ঠিক আছে ত ? মায়ের ভাষা বাংলা — তাই ত ? চাঁদ আমার মানেওটা। তবে দেখ বাওয়া, ঐ মায়ের ভাষার টানে পোঁদের কাপড় যেন মাতায় উঠে না যায় ! (ঐ যে দেসাওবোদক গান আছে, ঐ যে সেই রজনী সেনের গান — মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই — ছেলের মাঅন্ত প্রাণ, মাতাটা তাই পুরো গেছে, একটা ইসকুরুও আর টাহট নেই। বোঝ ঠ্যালা ! মায়ের দেওয়া কাপড়ে পোঁদ না ঢেকে ওটা মাথায় বেঁধে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে যাচ্ছে !) হ্যাঁ, এতক্ষণে মালটা ক্যাচ করেছি। তার মানে ইংরিজি বুলিটা তোমার ঠিকঠাক আসে না। তুমি শালা ভদ্দরলোকদের দলে পাত পাও না। কী আর করবে, কপালের নাম গোপাল। এখন ছোটজাতদের বাংলার দলে ঢুকে পড়। ছোটলোকদের সঙ্গে গা ঘসাঘসি কর,ও দুটো চুলকোতে চুলকোতে বাংলা বুলিতে গ্যাঁজাও। যত খুশি হ্যাজাতে চাও হ্যাজাতে পার তবে জ্ঞান মারিও না — তাঅলে চারপাশের বুড়ো হাবড়া থেকে ক্যাওড়া ছোঁড়ারা সব্বাই মিলে প্যাঁক দিয়ে গুষ্টির তুস্টি করে ছাড়বে। আর বাংলায় লেকলিকি করবে ? কর — কেউতো তোমায় বারণ কচ্ছে না। তবে কিনা লেকালিকির কথা বলতে গেলে পড়াপড়ির কথাটাও তুলতে হয়। ভদ্দরলোকের বাচ্চারা, বলতে গেলে যেসব মালপয়মালরা একআদটু ক্যাটম্যাটস্যাট ইংরিজি বুলি রপ্ত করেছে তারা কেউ বাংলা লেকালিকি শুঁকেও দেখে না, বাংলায় ছাপা বইয়ের লেজ উল্টেও দেকতে চায় না মালটা কী, গোরু না বকনা। অবশ্যি যে হোঁচট খেতে খেতে নাকানিচোবানি খেয়েও ইংরিজি বই পড়তে পারে সে বাংলা পড়তে যাবে কোন দুঃখে, তুমিই বল। এক ছোটলোক ছাড়া কেউ আর বাংলা বইয়ের পাতা ওলটায় না। ছোটলোক, ছোটজাত — তার মানে ইংরিজিতে যাদের ক অক্ষর গোমাংস, আর যারা বাপমায়ের খুচরো পাপে কখনো ইংরিজি ইস্কুলের মুখ দেখতে পায় নি, আর গরিবগুর্বোর ঘরের যত অগামারা অপোগণ্ডের দল — চোদ্দবার ফেল মেরে শেষ অব্দি কেঁদে ককিয়ে দুএকখানা পাসের চোতা জুটিয়েছে, ইংরিজি পড়তে গেলে চোখে সর্ষেফুল দেখে এরাই হল গিয়ে বাংলা বইয়ের খদ্দের ৷ এছাড়া ধ্যাদ্দেরে গোবিন্দপুরের কিছু আতাক্যালানো দেহাতি — পাড়াগাঁয়ের বাংলা ইস্কুলে যারা হালে পড়াশোনা শেষ করেছে, যাদের চোদ্দগুষ্টি কখনো ইস্কুলের পত মাড়ায় নি, আর কিছু কেরানি কি দোকানদারের বউ — পাঁচপাঁচবার বিয়োনোর পর এখন মুটিয়ে আলুর বস্তা বনে গেছে, দুপুরবেলা পান চিবুতে চিবুতে টিভি দেখার পর কিছুক্ষণ বাংলা বহটই ঘাঁটাঘাঁটি করে, ইংরিজি অক্ষর দেখলেই ওদের বুকের ভেতরটা কাটা ছাগলের মত ধপাস ধপাস করতে থাকে। এই সব এলেবেলে লোকজন, এদের তো আর ভদ্দরলোক বলা যায় না। বাংলায় লেকালিকি করবে ? লেক শালা এদের জন্যে। তার বেওস্থাও আছে। বাংলা বইয়ের হাট। উত্তর থেকে গেলে ঠনঠনেতে মায়ের পায়ে পেন্নাম ঠুকে আর দক্ষিণ থেকে এলে হাড়কাটার মাগিদের বারকয়েক কানকি মেরে কলেজইষ্ট্রিট পাড়ায় ঢুকে পড়। ওটা হল গিয়ে বইপাড়া। চাদ্দিকে গলিঘুঁজি জুড়ে মায় পেচ্ছাবখানার দেয়াল ঘেঁসে বইয়ের হাটের হাটুরেদের সার সার দোকান। বইয়ের পসরা সাজিয়ে অনেকে রাস্তার ওপর বসে পড়েছে। এরা সব বাংলা বই ছাপায়। ঐ যে আমাদের হুগলি জেলার জকপুকুর গ্রামের হারান ঘোষের দুনম্বর বৌযের চারনম্বর ছেলে ঘোঁৎনা গন্ডায় গন্ডায় উজবুককে জক দিয়ে আর উদগান্ডুর মাথায় কাঠাল ভেঙে বেশ মালকড়ি হাতিয়ে আর ঘোঁৎনা রইল না নিবারণবাবু বনে গেল ৷ ঘোঁৎনা ওরফে নিবারণবাবু কলকাতার বইপাড়ায় এসে পেল্লাই একটা দোকান হাঁকিয়ে বসল — ইংরিজিতে তার সাইনবোর্ড — শ্রী শ্রী নিউ কালিমাতা ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং এন্টারপ্রাইজ। নিবারণবাবু ওরফে ঘোঁৎনা এখন শয়ে শয়ে মেয়েছেলে নিয়ে টানাটানি লটকালটকি লদকালদকির রগরগে গপ্পের গাবদা গাবদা বাংলা বই ছাপিয়ে বাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে ফেলেছে, দলবাজি করে প্রকাশক সমিতির সম্পাদক বনে গেছে ৷ সারাক্ষণ সে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে যে বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির জন্যই সে তার জীবন দিচ্ছে। তা যা বলছিলাম, বাংলা লেকালিকির কথা। তা যা বলছিলাম, বাংলা লেকালিকির কথা। এগ্গাদা কাগজ, এতগুলো ঢাউস পুজোসংখ্যা আর বইয়ের হাট — এই নিয়ে লেকালিকির বাংলা বাজার। খেলসা করে বলতে গেলে, দিশি আর চুল্লুর ঠেক আর ঘুপচি ঘাপচি মেরে এখানে ওথানে কিছু তাড়ির ঘড়া। বাংলায় যাঁরা লেকালিকি করেন তাঁরা হরবকত মাল বানিয়ে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছেন — নানান রসের গাদাগুচ্ছের গপ্পোউপন্যাস। হাটুরেরা সেগুলো বেচছেন —খাঁটি বাংলা মাল, দুনম্বর আর তিননম্বর সি এল, ব্লাডারের চুল্লু, আর মাটির ঘড়ার তাড়ি। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু পাগলাচো…  এরা বানাচ্ছে গ্যাঁজলা ওঠা কবতে। এরা নিজেরাই তা বাজারে ছাড়ছে। ঐ মাল দুয়েকজন পবলিক একআদ ঢোক গিলতে ট্রাই করে কুলকুচি করে ফেলে দেয়।

আবার ইংরিজিওয়ালা বাঙালি জ্ঞানের কারবারিদের মধ্যে দুচাজ্জনের দয়ার শরীর। কালেভদ্রে ওঁরা বাংলা বাজারে দর্শন দেন। ছোটলোকদের কথা ভেবে ওঁদের পাঁজরায় ব্যথা হয়। হাজার হলেও দেশতুতো সম্পক্ক ! তাছাড়া এসব জ্ঞানের বেওসায়িরা আগে সবাই ছাত্তর ঠ্যাঙাতেন। তাই জ্ঞান দেওয়ার স্বভাবটাও পুরোদমে রয়ে গেছে। ওঁরা হাটুরেদের ঝুলোঝুলিতে ঢেঁকি গেলেন — দু একটা বাংলা মাল নাবিয়ে দেন। সবাই যুগ যুগ জিয়ো বলে চেল্লায়। তবে কিনা বাংলাপড়া ছোটলোকগুলো সব মাতামোটা, ধুর — তার ওপর ওদের বাংলা বুলিটাও জ্ঞানের শক্ত শক্ত বুকনি ঝাড়ার জন্য সেরকম পোক্ত নয়। তাই জ্ঞানবাবুরা ইংরিজি মালের রঙটা ফিকে করতে করতে উড়িয়ে দেন — একটুখানি এসেনস দিয়ে খুব পাৎলা করে একটা বাংলা পাঁচন ছাড়েন। ইংরিজিতে যা দেওয়া হয় তা বাংলায় দিলে সেটা ছোটলোক পাবলিকের পেটগরম করবে, বুকে কষ্ট দেবে, মাতায় ঘোট পাকাবে। ছোটলোকদের দিতে হলে দুয়েক ফোঁটা বিলিতি মাল এক গেলাস টিপ্ কলের দিশি জল মিশিয়ে দিতে হয়, যা ওদের পেটে সয়।

এ সমস্ত বাদ দিয়ে বাংলা বাজারে আরেক কিসিমের কিম্ভুতকিমাকার মাল বিক্রি হয়। এ মালগুলো যাঁরা বানান তাঁরা হলেন গিয়ে ম্যাস্টর, বিশেষ করে বাংলার ম্যাস্টর। বেচারারা ছোটলোকদের বুলির ম্যাস্টর বলে এমনিতেই পোঁদের ফাঁকে লেজ গুঁজে সিঁটিয়ে থাকেন। না ছাত্তর না চারপাশের পবলিক, কেউ ওঁদের মানুষ বলে গন্যি করে না। সেই খার থেকে ওঁরা ঘরের কোণে বসে গাবদা গাবদা বই বানিয়ে বাজারে ছাড়েন। ঐ মালগুলোর আদ্ধেক হেন্ সায়েব আর তেন্ সায়েবের ইংরিজি বুকনিতে ঠাসা থাকে, আর বাকি আদ্ধেকে থাকে বাংলায় ওসব সায়েবি বুকনি নিয়ে ভুলভাল মানে করে আলটুফালটু কপচানি, ভাট বকা আর হ্যাজানো। তার মধ্যেই আবার এগগাদা সায়েবের প্যান্টুলুন আর মেমসায়েবের গাউন ধরে জাতীয়তাবাদী টানাটানি। আসলে বেচারা ম্যাস্টররা শো করেত চান, বাংলার ম্যাস্টর হলে কী হবে, ওঁরা ফেলনা নন, ইংরিজি পড়ে ওঁরা নিজের পছন্দমাফিক একটা মানে আন্দাজ করে নিতে পারেন। আর ইতিমদ্ধে নামজাদা সব সায়েবের এন্তার বিগ বিগ বই নিয়ে সব ফিনিস করে দিয়েছেন। তবে কিনা স্রিফ দেসওয়ালি আম জন্তার কথা ভেবে দিল দিওয়ানা হয়ে যায় বলে বাংলা বুলির জন্যে জান লড়িয়ে দিচ্চেন, জিন্দিগি বরবাদ কচ্চেন ; তা নইলে কবে শালা বিলেতে গিয়ে সাদা চামড়ার আঁতেলদের জিগরি দোস্ত বনে যেতেন। আর অসুবিদেটাই বা কী ছিল ? ওসব বার্তফার্ত, বাখতিনটাকতিন, স্ট্রাকচারমাকচার, পাওয়ারফাওয়ার, ঘনাদা, টেনিদা, দেরিদামেরিদা — সবই তো ওঁদের কবে জলভাত হয়ে গেছে!

কী বলছ? এসবের পরও তুমি বাংলা বুলিতে লেকালেকি করতে চাও ! তা কী লিকবে বলো ৷ গপ্পো না কবতে? বাংলায় গপ্পো, কবতে ছাড়া আর কীইবা লেখা যায়? মাতাটা যখন গেছে, ইংরিজি বুলিটাও তেমন আসে বলে মনে হয় না তখন আর কী করা ৷ যাও — বাংলা বাজারে ঢুকে পড়, যত মাল পয়মালদের সঙ্গে বার দোয়ারি কী খালাসিটোলায় বেঞ্চিতে পোঁদ ঠেকিয়ে বাংলা টেনে আতাক্যালানো দেহাতি আর ছোটলোকদের জন্যে বাংলা বুলিতে লেকালেকি শুরু করে দাও ৷ জিন্দিগি চোরপোরেশনের ভ্যাটে ফেলে দিতে চাও, দাও ৷ আমার কী এসে যায় ? গরিব কায়েতের ছেলে নেইকো কোনো কতাতে ৷ কেলোর পোঁদ ভুলোয় মারে দাঁড়িয়ে দেকি তপাতে ৷৷ — সব বুঝে শুনে আমি এখন বাপঠাকুদ্দার মুখে শোনা এই নীতিই মেনে চলেছি ৷

এতটা লিখে চোতাটা একজন জানপয়চান বড়বাবুকে দেখালাম ৷ বললাম, বস্ উলটোপালটা বকেছি,মালটায় একটু চোখ বুলিয়ে   দাও ৷ বাবু সেদিন ইংরিজিতে মার্কিন মুল্লুকের আজকালকার লিখিয়েদের লেখায় সেলেং (বাংলা বুলির ম্যাস্টররা বলে অপভাষা অত্থাৎ কিনা তোমার আমার মতো রামা শ্যামা যোদো মোধোর বুলি) বেবহারের ফরে বক্তিমা দিয়ে এসেছেন ৷ দুচার লাইন দেখেই তিনি লেখাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, বললেন, ন্যাস্টি, একে বাংলা, তার ওপর গুন্ডা বদমাসদের অবসিন ভাষা, কোনো ভদ্দরলোক এসব পড়তে পারে ?

ঠিক! একশ পঞ্চাশ ভাগ রাইট! ঐ যে বাগবাজারের অম্রেতবাজারি জয়গৌর মার্কা ঘোষবাড়ির নামকেত্তন করা বোস্টম জামাইয়ের বানানো আর এখন তার আমেরিকাভজা নাতিপুতিদের চালানো সুতারকিন গলির আনন্দবাজার পত্রিকা হরবকত বাংলা ভাষার গুষ্টির তুষ্টি করে ৷ ভদ্দরলোকদের বুলিতে বলতে হয়, সাধু ভাষায় তিরস্কার করত চতুর্দশ পুরুষকে উদ্ধার করে ৷ কেউ বাংলা ভাষার হয়ে রা কাড়তে গেলেই আনন্দবাজার তাকে বাংলাবাজ বলে হেভি খিস্তিখাস্তা করে — সাধু ভাষায় বলতে গেলে সুকঠিন ভাষায় ভর্ৎসনা করে (সাধু ভাষা বোঝ না যাদু? বুঝবেটা কী করে! চব্বিশ ঘন্টা গলির মোড়ে ছোটলোকদের সঙ্গে গুলতানি করছ, শোন , সাধু ভাযা হল গিয়ে তোমাদের চোর ভাষার উলটো) ৷ ভদ্দরলোক বাঙালির প্রাণের বাংলা কাগজ আনন্দবাজারের কেত্তন হল হল ‘এস হে মার্কিনি চন্দ্র সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে করি, এস হে’, মনপছন্দ্ হল ইংরিজিখোররা৷ বল গুরু, ওয়ার্ল্ডে কোথায় এমন আরেকটা কাগজ রযেছে যা যে বুলিতে বেরয় তারই খাল খিচে দেয়ার জন্য সারাক্ষণ রেডি থাকে! সত্যিই তো ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ ৷

এই হল গিয়ে বাংলা বুলির হাল! ইস্কুলে যা পড়েছিলে তা তো কবে খেয়ে হজম করে ফেলেছ, হক কথা বলা একটা লাইন মনে পড়ছে ? তবে শোন: আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্চোত ভূমি বঙ্গে!

Pushkar Dasgupta Scattered thoughts on Bengali language (1) পুষ্কর দাশগুপ্ত বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা (প্রথম কিস্তি)

                                                                 

                   বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা

                                (প্রথম কিস্তি)

…European scholarship is good… but when we speak to the world, let  us speak in our own language. Let those, who feel that they have spring of fresh thought in them, fly to their mother-tongue… I should scorn the pretensions of  that man to be called “educated” who is master of his own language.

…European scholarship is good…but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let those, who feel that they have spring of fresh thought in them, fly to their mother-tongue…I should scorn the pretensions of that man to be called “educated” who is master of his own language.

Madhusudan Dutt’s letter to Gourdas Bysak from Versailles, France, January 26, 1865

বিদ্যাবিস্তারের কথাটা যখন ঠিকমতো মন দিয়া দেখি তখন তার সর্বপ্রধান বাধাটা এই দেখিতে পাই যে, তার বাহনটা ইংরেজি। বিদেশী মাল জাহাজে করিয়া শহরের ঘাট পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছিতে পারে কিন্তু সেই জাহাজটাতে করিয়াই দেশের হাটে হাটে আমদানি রপ্তানি করাইবার দুরাশা মিথ্যা। যদি বিলিতি জাহাজটাকেই কায়মনে আঁকড়াইয়া ধরিতে চাই তবে ব্যবসা শহরেই আটকা পড়িয়া থাকিবে ৻

  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : শিক্ষার বাহন (১৯০৮)

Madhusudan Dutt’s letter to Gourdas Bysak from Versailles, France, January 26, 1865.

.বাংলা অভিধান প্রসঙ্গে

   হাতের কাছে ছিল ছোটবেলা থেকে শোনা বাংলা ভাষার জনপ্রিয় অভিধান রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’ ৷ অন্যমনস্কভাবে বইটা খুলে পাতা ওলটাতে ওলটাতে কেন জানিনা হঠাৎ ‘বাগান’ শব্দটি চোখে পড়ল ৷ পাশে শব্দটির ‘মানে’ (— যা আসলে একটি সমার্থক শব্দরয়েছে ‘উদ্যান’। এবার ঐ অভিধান ঘেঁটে ‘উদ্যান’ শব্দটি বের করলাম,দেখা গেল তার ‘মানে’ রয়েছে ‘বাগান’। মনে হল ‘বাগান’ আর ‘উদ্যান’ এ দুটি সংকেতকের (সোস্যুরএর ভাষায় সিনিফিঅঁ/ signifiant, ইংরেজি অনুবাদে:সিগনিফাইয়ার/ signifier)  কোনোটির সংকেতিত  (সিনিফিএ/ signifé, ইংরেজি অনুবাদেসিগনিফাইড/signified) যার অধিগম্য নয় (যেমন ধরা যাক বাংলা পড়তে সক্ষম অথচ ‘বাগান’ আর ‘উদ্যান’ বলতে কী বোঝায় তা জানে না এরকম বাংলা ভাষার কোনো অবাঙালি/বিদেশি শিক্ষার্থীযদি ‘বাগান’ শব্দটির মানে অর্থাৎ ‘বাগান’ বস্তুটি কী তা বোঝার জন্য অভিধানটি দেখে তাহলে সে যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই থেকে যাবে।

কিছুটা বিষণ্ণভাবে এ সত্যটা উপলব্ধি করলাম যে আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষায় যথার্থ অর্থে কোনো অভিধান নেই বললে খুব একটা ভুল বলা হয় না। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ও জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসেব ‘বঙ্গালা ভাষার অভিধান’ — অনেক কালের ধূলিমলিন আর আধেয়র দিক থেকে অনেকটা পুরনো হয়ে যাওয়া এই দুই বিখ্যাত অভিধান সহ প্রায় সবগুলি বাংলা অভিধানই কিছুটা সংস্কৃত কোষগ্রন্থ (অমর কোষমেদিনী কোষ ইত্যাদি সমার্থক শব্দকোষ), কিছটা গত যুগের ইংরিজি শব্দকোষের (লেক্সিকেরআংশিক ধারণাগত মিশ্রণের উত্পাদন। শব্দকোষতত্ত্ব বা লেক্সিকোগ্রাফির জটিল তাত্ত্বিক অরণ্যে প্রবেশ না করেও শুধুমাত্র ইংরিজি বা ফরাসি ভাষার কয়েকটা পরিচিত (যেমন ইংরেজিতে শর্টার অক্সফোর্ডওয়েবস্টার  (১৯১৩) অথবা  ফরাসিতে  পতি  রবের,  লিত্রে  ইত্যাদি) অভিধানের পাতা ওলটালেই অভিধানে কী থাকে বা থাকা উচিত তা বোঝা যায়। প্রাথমিক ভাবে সাধারণ অভিধান (বনাম ‘বিশেষ’ অভিধান বিজ্ঞান অভিধানদর্শন অভিধানঅপভাষা অভিধান ইত্যাদিহল কোনো ভাষায় ব্যবহার্য (অভিধানের মান ও আয়তন অনুসারে নির্বাচিতশব্দসম্ভরের বর্ণানুক্রমিক উপস্থাপনা। উপস্থাপিত শব্দগুলির প্রত্যেকটির সঙ্গে বা পাশে থাকে শব্দটির:

   ক. (ইদানীংকালে আন্তর্জাতিক ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালায় প্রতিবর্ণীকৃতউচ্চারণ ;

   খ. পদপ্রকরণ (বিশেষ্যবিশেষণ ইত্যাদি) ;

   গ. শব্দটির উত্স ও ব্যুত্পত্তি ;

   ঘভাষায় কোন সময়ে (শতাব্দী বা/এবং সালেশব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে তার উল্লেখ;

   ঙ. সংখ্যা (৩ ইত্যাদিবা অন্য কোনো চিহ্ন দ্বারা নির্দেশিত শব্দটির ক্রমানুসারী   বিভিন্ন অর্থ বা সংজ্ঞার্থ — উক্ত সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী শব্দটির দ্ব্যর্থকতাহীন প্রয়োগের (যথাসম্ভব সাহিত্যসংবাদপত্র ইত্যাদি থেকেদৃষ্টান্ত;

   চ. সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সাহিত্য বা/এবং প্রবচনে শব্দটির বিশেষ বা রূপকার্থে ব্যবহারের উদাহরণ সহ সংজ্ঞার্থ ;

    ছ. ক্ষেত্র বিশেষে শব্দটির সমার্থক বা/এবং বিপরীতার্থক শব্দের নির্দেশ।

এছাড়া আজকাল বেশির ভাগ মান অভিধানের সঙ্গে বা আলাদাভাবে পাওয়া য়ায় উক্ত অভিধানের বৈদ্যুতিন সংস্করণ বা সিডিরম। এতে শব্দগুলির লিখিত রূপের সঙ্গে প্রত্যেকটি বা নির্বাচিত শব্দের শ্রুতিগ্রাহ্য উচ্চারণের রূপও পাওয়া যায়। ফলে ভারি আর মোটা অভিধান বহন কবা আর তার বর্ণানুক্রমিক পাতা উল্টে শব্দ খোঁজার পরিশ্রম ও সময়ের অনেকটা সাশ্রয় হয়সে ভাষার সহজাত ভাষাভাষীর (নেটিভ স্পিকারেরমুখে(প্রয়োজনে একাধিকবারউচ্চারণ শুনে শব্দের মান উচ্চারণের ধারণা করা যায়।

বাংলা অভিধানের অভাব এবং অসম্পূর্ণতা স্পষ্ট করার জন্য আমরা কয়েকটি বাংলা অভিধানে উল্লিখিত বাগান  শব্দটি আর তার পাশপাশি তুলনামূলকভাবে কয়েকটি ইংরেজি ও ফরাসি অভিধানে যথাক্রমে বাগানের ইংরেজি প্রতিশব্দ gardenআর ফরাসি প্রতিশব্দ jardinর উপস্থাপনা লক্ষ করতে পারি:

রাজশেখর বসুচলন্তিকাত্রয়োদশ সংস্করণ১৯৮১:

 বাগান [ফা. বাগ ] বি. উদ্যান। (পৃ. 493) 

 উদ্যান – বাগানবাগিচাউপবন। … উদ্যানপাল, পালক–উদ্যানরক্ষক, মালী।  উদ্যানবিদ্যা- horticulture  উদ্যানসম্মেলন – উদ্যানে মিলিত হইয়া আমোদপ্রমোদ। (পৃ96) 

শৈলেন্দ্র বিশ্বাসসংসদ বাঙ্গালা অভিধান,  চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৮৬, সাহিত্য সংসদকলকাতা:

বাগান [বাগান্ বিউদ্যানউপবন। [ফাবাগ ]। ̃ বাড়ি বি.বাগানশোভিত বা বাগানসমন্বিত প্রমোদভবন। (পৃষ্ঠা৪৮৫) 

উপবন  বিবাগানউদ্যানবাগিচা  ̃(পৃ১০৫

দ্যান – বিবাগানবাগিচাউপবন। [ সং যাঅন(অধি)]। বিণবি. ~পাল, ~পালক, ~ রক্ষক – উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণকারী বা তত্ত্বাবধায়ক । বি. ~বাটী – বাগানবাড়ি দ্রঃ।(পৃ.102 ) 

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়বঙ্গীয় শব্দকোষ ১৯৪১১৯৪৩সাহিত্য অকাদেমি কর্তৃক পুনর্মূদ্রণ ১৯৬৭তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৮দ্বিতীয় খণ্ড:

বাগান১ বি ফা.বাগ্ হ্ বান  উদ্যানপাল১ উদ্যান  বাড়ী  ২জঙ্গল৷ — নি বি [ন উদ্যানরক্ষক  (পৃষ্ঠা ১৪৮৮

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বাঙ্গালা ভাষার অভিধানদ্বিতীয় সংস্করণ,১৯৩৭ইন্ডিয়া পাবলিশিং হাউসকলকাতা:

বাগান [̣◦— বাগ̣ এবং সং  উদ্যান এই দুইয়ের মিশ্রণে বাগান শব্দের উত্পত্তিঅথবা আ̣◦—বাগা̣ (উদ্যানসমূহশব্দের উচ্চারণ বিকারে। ত =] বিউদ্যানউপবনযে ক্ষেত্রে ফল ও পুষ্প বৃক্ষের চাষ হয়। — বাগান বাগিচা ̃বাড়ী বাগবাগিচা দ্রঃ। ̃ফুল বাগান — পু্ষ্পোদ্যান ৷ বাগান বাড়ীবি,উদ্যানবাটিকাবাগান মধ্যস্হ বা বাগান সংলগ্ন বাড়ী। ̃ (পৃষ্ঠা ১৫২৪

সুবল চ্ন্দ্র মিত্রসরল বাঙ্গালা অভিধানসপ্তম সংস্করণ১৯৩৬, কলকাতা:

বাগান – ১উপবনউদ্যান। পার্শী; সং। বাগ করাকায়দা করা;আত্মসা করাবিন্যস্ত করা (ভেড়ি-)। দেশজ; ক্রি। (পৃ৮৯৯০

যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিধিবাঙ্গালাশব্দকোষবঙ্গীয় সাহিত্য পরিষ.  কলকাতা ১৯১৩প্রথম খণ্ড:

বাগানষ্য. (৹ বাগ বান – উদ্যনপাল অর্থ ভুলিয়া) উদ্যান, ()বাটিকা। বাগানবাড়ী…(বৃক্ষবাটিকা। ফুলবাগান… পুষ্পোদ্যান। (পৃ.৬৫৩৬৫৪)

৭. রামকমল বিদ্যালঙ্কার: সচিত্র প্রকৃতিবাদ অভিধান (১৮৬৬), চতুর্থ সংস্করণ১৮৮৭:

বাগান, (দেশজসংউদ্যান। আয়ত্তকরণ। (পৃ১৩৮৭)

৮. দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী: প্রকৃতিনির্ণয় অভিধান,১৮৮০:

বাগান (দেশজসংউদ্যান। আয়ত্তকরণ।(পৃ৮৯৭)

এবার তিনটি ইংরেজি আর তারপর তিনটি ফরাসি অভিধানে যথাক্রমে gardenআর jardin শব্দের উপস্থাপনা লক্ষ করা যাক  আমাদের নির্বাচিত অভিধানগুলি হল:The Shorter Oxford Dictionary, 5th edition, 2002, Electronic Edition (SOED), The Concise Oxford Dictionary. Oxford University Press, Eighth edition , 1990, Fifth impression1994 (COD), The Webster Dictionary, 1913, (on line) ( WD ) Le Petit Robert,editition électronique, 2000 (PRE),  Le Dictionnaire Littré, 1872  (électronique)  (DLE) , Dictionnaire  de l‘Académie  Française  (DAF৷ আমরা আলোচনায়  ব্র্যাকেটের  সংক্ষিপ্ত রূপগুলি ব্যবহার করব ৷

The Shorter Oxford Dictionary, 5th edition, 2002, Electronic Edition:


garden,
noun/ɡɑːd(ə)n/
ME.
[Old Northern French gardin var. of
Old & mod. French
jardin, from
Proto-Romance, from Germanic: cf. YARD
noun1.]
1.
A piece of ground (often enclosed) where fruits, flowers, herbs, or
vegetables are cultivated; without specification esp. one
adjoining a house or other residential building. With specifying noun
esp. an area of this kind where the specified plants are
grown, with the specified function or central feature, or in the
specified place. ME.
flower garden, herb garden, kitchen garden, market garden,
rock garden, roof garden, rose garden, water garden, etc.

V. Brittain A gracious little garden where lilac and laburnum and pink hawthorn were already in flower. 
b. transf. A region of great fertility. L16.

2. An enclosed piece of ground or (now, chiefly US) a large building where public entertainment is provided or where refreshments are served; sing. & in pl., a park or grounds ornamented with plants and trees or with other displays or exhibits for public recreation. Usu. with specification of the type of entertainment, refreshment, or display provided. L16.
bear gardenbeer gardenbotanic garden(s)tea garden,zoological garden(s), etc.

3. (Garden.) sing. & (usu.) in pl. A street, square, etc., with or near gardens, esp. one in which the buildings overlook private communal gardens. Freq. in proper names. M18.
Crown GardensSpring Gardens, etc.

Phrases etc.common or garden: see COMMON adjective.CULTIVATE one’s gardeneverything in the garden is lovely all is well. garden of EDENlead up the garden: see LEAD verb1the Garden (a) the area of Covent Garden in London; (b) the philosophy or school of Epicurus (Greek philosopher who taught in a garden).the garden of Englandspec. (a) Kent; (b) the Vale of Evesham.garden of REMEMBRANCEwinter garden: see WINTER noun.

Attrib. & comb.: Designating a plant, vegetable, etc. that is grown in the garden or cultivated (often opp. to ‘wild’) as garden lettuce,garden rocketgarden thyme, etc. Special combs., as garden balsam: see BALSAM noun 6; garden carpet (a) a grey and brown geometrid moth, Xanthorhoe fluctuata(b) a Persian carpet with a formal design of plants and animals; garden centre a (usu. specialist) establishment where gardening tools, plants, etc., are sold; garden chafer a small brown and metallic-green chafer,Phyllopertha horticola, which sometimes swarms in sunshine and may damage pasture and fruit crops; garden chair: for use in a garden; garden city a town or part of a town of limited size, located in or laid out systematically with spacious rural or landscaped surroundings; garden cress the cruciferous plant Lepidium sativum, grown for its pungent seedlings, which form one of the two components of mustard and cress; garden flat a flat which opens on to a garden, usu. a basement flat with access to a garden at the back;garden gnome a figure of a gnome used as a garden ornament;garden-house (a) a house situated in or having a garden; a suburban house; (b) a small building in a garden; a summer-house; garden-party a party or society event held on a lawn or in a garden; garden path a path in a garden; lead up the garden-path: see LEAD verb1;garden pea (a) any variety of pea cultivated for human consumption;(b) a pea canned or frozen when freshly picked; garden-pot †(a) a watering-can; (b) a plant-pot; garden privet: see PRIVET 1; garden produce vegetables etc. from a garden; garden roller: for use in a garden; garden seat: for use in a garden; garden snail Helix aspersa, commonly found in gardens; Garden State US the State of New Jersey; garden stuff garden produce; garden suburb: laid out like a garden city; garden valerian a valerian, Valeriana phu, grown for its medicinal root; also = red valerian s.v. VALERIAN 1; cf. SETWALL 2; garden-variety adjective (N. Amer.) of the usual or ordinary type; commonplace; garden village: laid out like a garden city; garden warbler a small greyish-brown Eurasian warbler, Sylvia borin.

• gardenage noun horticulture; garden produce: E17.
• garde”nesque adjective resembling a garden or what belongs to a garden M19.
• gardenful noun as many or much as a garden can contain M19.
• gardenist noun a planner of gardens; an enthusiast for gardens: L18.
• gardenless adjective without a garden or gardens M19.

The Concise Oxford Dictionary. Oxford University Press, Eighth edition, 1990, Fifth impression1994:

garden /’gɑ:d(ə)n/ n. & v. – n. 1.esp.Brit. a piece of ground, usu. partly grassed and adjoining a private house, used for growing flowers, fruit, or vegetables, and as a place of recreation. 2 (esp. inpl.) ornamental grounds laid out for public enjoyment (botanical gardens). a similar place with the service of refreshments (tea garden). 4 (attrib.a (of plants) cultivated, not wild. b for use in a garden (garden seat). (usu. in pl. prec. by a name) Brit. a street,square, etc. (Onslow Gardens). an especially fertile region. US a large public hall. 8 (the Garden) the philosophy or school of Epicurus. ― v.intr. Cultivate or work in a garden. □ garden centrean establishment where plants and garden equipment etc. are sold. garden city an industrial or other town laid out systematically with spacious  surroundings, parks, etc. garden cress  a cruciferous  plant, Lepidium sativum, used in salads. garden party a social event held on a lawn or inia garden. Garden suburb Brit. a suburb laid outspaciously with open spaces, parks, etc. garden warbler a European woodland songbird, Sylvia borin. □□gardenesque /-‘nesk/adj.gardening n. [ME, f. ONF gardin (OF jardin) ult. f. Gmc: cf. yard].(পৃষ্ঠা ৪৮৫) 

Webster Dictionary, 1913, (on line)

Gar”den (?; 277), n. [OE. gardin, OF. gardin, jardin, F. jardin, of German origin; cf. OHG. garto, G. garten; akin to AS. geard. See Yard an inclosure.]

1. A piece of ground appropriates to the cultivation of herbs, fruits, flowers, or vegetables.

2. A rich, well-cultivated spot or tract of country.

I am arrived from fruitful Lombardy, The pleasant garden of great Italy. Shak. &hand; Garden is often used adjectively or in self-explaining compounds; as, garden flowers, garden tools, garden walk, garden wall, garden house or gardenhouse. Garden balsam, an ornamental plant (Impatiens Balsamina). — Garden engine, a wheelbarrow tank and pump for watering gardens. — Garden glass. (a) A bell glass for covering plants. (b) A globe of dark-colored glass, mounted on a pedestal, to reflect surrounding objects; — much used as an ornament in gardens in Germany. — Garden house (a) A summer house. Beau & Fl. (b) A privy. [Southern U.S.] — Garden husbandry, the raising on a small scale of seeds, fruits, vegetables, etc., for sale. — Garden mold ∨ mould, rich, mellow earth which is fit for a garden. Mortimer. — Garden nail, a cast nail used, for fastening vines to brick walls. Knight. — Garden net, a net for covering fruits trees, vines, etc., to protect them from birds. — Garden party, a social party held out of doors, within the grounds or garden attached to a private residence. — Garden plot, a plot appropriated to a garden. Garden pot, a watering pot. — Garden pump, a garden engine; a barrow pump. — Garden shears, large shears, for clipping trees and hedges, pruning, etc. — Garden spider, (Zoöl.), the diadem spider (Epeira diadema), common in gardens, both in Europe and America. It spins a geometrical web. See Geometric spider, and Spider web. — Garden stand, a stand for flower pots. — Garden stuff, vegetables raised in a garden. [Colloq.] — Garden syringe, a syringe for watering plants, sprinkling them with solutions for destroying insects, etc. — Garden truck, vegetables raised for the market. [Colloq.] — Garden ware, garden truck. [Obs.] Mortimer. — Bear garden, Botanic garden, etc. See under Bear, etc. — Hanging garden. See under Hanging. — Kitchen garden, a garden where vegetables are cultivated for household use. — Market garden, a piece of ground where vegetable are cultivated to be sold in the markets for table use.

Gar”den, v. i. [imp. & p. p. Gardened (?); p. pr. & vb. n. Gardening.] To lay out or cultivate a garden; to labor in a garden; to practice horticulture.

Gar”den, v. t. To cultivate as a garden.

Le Petit Robert, éditition électronique;2000.

jardin [ʒɑʀdԑ᷈] n. m

• déb. XIIe; de l’a. fr. gart, jart, frq. °gart, °gardo « clôture » 

1 Terrain, généralement clos, où l’on cultive des végétaux utiles ou d’agrément (dans ce cas, plus petit que le parc*). Jardin fruitier, potager.   2. clos1. fruitierpépinièrepotagervergerouche. Jardin ornemental, d’agrément, composé de pelouse et de massifs, généralement attenant à une habitation ( aussi rez-de-jardin).Jardin de curé : petit jardin clos de murs. Jardin paysager.Dessinateur de jardins.  paysagisteJardin fleuri. Les roses du jardin. Fraises, cresson de jardin (par oppos. aux espèces croissant dans un autre milieu). — Allées, massifs, parterres, planches,platebandes d’un jardin. — Entretenir, soigner, arroser son jardin. Faire le jardin.  jardiner— Instruments, outils de jardin : arrosoir, bêche, 1. binette, brouette, cisaille, 1. cloche, cordeau, croc, cultivateur, déplantoir, épandeur, faucille, 2. faux, fourche, houe, hoyau, louchet, motoculteur, pelle, plantoir, râteau, sarcloir, scarificateur, sécateur, serfouette, serpe, tondeuse, transplantoir, tronçonneuse, tuteur. Meubles de jardin; table, banc, chaises de jardin. Nain* de jardin. Pavillon de jardin.  gloriette,kiosquetonnelle— Déjeuner, lire dans le jardin. Réception dans le jardin.  garden-party— Jardin classique, jardin à la française, où les parterres, les pièces d’eau sont disposés géométriquement. S’aligner « comme des bouquets dans un jardin classique de Le Nôtre » (Hugo). Jardin anglais, à l’anglaise,imitant la nature. Jardin japonais, jardin zen, reproduisant un paysage naturel en réduction et constituant un lieu propice à la méditation (voir aussi infra 3o). « Un vrai jardin japonais : un carré minuscule, […] symbolique, où l’on apercevait des montagnes et des plaines, des forêts, une cascade, un torrent, des cavernes et un lac » (Farrère). Jardins suspendus, étagés en terrasses. Les jardins suspendus de Babylone. — Jardin public :espace vert mis à la disposition des citadins.  parcsquareCité*-jardin. Jardin botanique, aménagé pour l’étude scientifique des végétaux. Le Jardin des Plantes, autour du Muséum d’histoire naturelle de Paris. — Par ext. Jardin zoologique ( zoo), d’acclimatation*.

Allus. bibl. Le jardin d’Éden, le jardin de délices : le paradis terrestre. Le jardin des Oliviers*. Myth. Le jardin des Hespérides :jardin des dieux où poussaient les pommes d’or.

◊ Loc. fig. Jeter une pierre, des pierres dans le jardin de qqn,l’attaquer indirectement. C’est une pierre dans son jardin, se dit d’une allusion désobligeante.

◊ Loc. prov. « il faut cultiver notre jardin » (Voltaire)mener une vie calme et laborieuse sans perdre son temps à des spéculations.

2 JARDIN D’HIVER : pièce vitrée où les plantes sensibles au froid sont à l’abri.  1. serre.

3  JARDIN JAPONAIS : vasque contenant un jardin miniature composé de petites plantes, de graviers multicolores, de ponts, de temples évoquant le Japon et ses jardins.

4 (1840; all. Kindergarten) JARDIN D’ENFANTS : établissement privé qui accueille après la crèche les enfants d’âge préscolaire. garderiematernelle.

 5 Théâtre Côté* jardin.

6 Par métaph. Région riche, fertile. « au jardin de France : c’est Touraine » (Rabelais).

7 (1657) Fig. et vx Le jardin des racines grecques : recueil de racines grecques.

8 Jardin secret : domaine des sentiments, des pensées les plus intimes d’un individu. Vous ne voulez pas répondre; c’est votre jardin secret ?

Le Dictinnaire Littré, 1872 (électronique)

 JARDIN [jar-din] s. m.

Espace clos d’ordinaire, planté de végétaux utiles ou d’agrément. Jardin fruitier. Le jardin du Luxembourg, des Tuileries. ♦ Elle avait dès longtemps du sage Quintinie Formé pour les jardins l’admirable génie, PERRAULT, dans RICHELET ♦ Son bonheur consistait aux beautés d’un jardin ; Le Scythe l’y trouva qui, la serpe à la main….,LA FONT., Fabl. XII, 20 ♦ Il [le riche] peut dans son jardin, tout peuplé d’arbres verts, Recéler le printemps au milieu des hivers,BOILEAU, Sat. VI ♦ C’est donc ici d’Esther le superbe jardin, RAC.,Esth. III, 1 ♦ Dans ce dernier palais [à Babylone] étaient ces jardins suspendus, si renommés parmi les Grecs ; ils formaient un carré dont chaque côté avait quatre cents pieds, ROLLIN, Hist. anc. Oeuv. t. II,p. 31, dans POUGENS ♦ L’art des jardins a été créé et perfectionné par le Nostre pour l’agréable et par la Quintinie pour l’utile, VOLT.,Louis XIV, Artist.

Fig. ♦ Jésus [lors de la Passion] est dans un jardin non de délices, comme le premier Adam, où il se perdit et tout le genre humain, mais dans un de supplices, où il s’est sauvé et tout le genre humain,PASC., Pens. XXV, 1, édit. HAVET.

Fig. ♦ Brillante sur ma tige, et l’honneur du jardin, Je n’ai vu luire encor que les feux du matin ; Je veux achever ma journée, A. CHÉNIER, la Jeune captive.

Jardin français, jardin régulier où règne la symétrie et où l’art ne se cache pas.

Jardin anglais, jardin à l’anglaise, jardin irrégulier où l’art est caché sous l’apparence d’une nature agreste. ♦ Le lieu, environné de montagnes, de précipices profonds, de rochers couverts de mousses et de verdure, suffisait à lui seul pour dégoûter à jamais de ces froids jardins à l’anglaise où l’on a voulu follement imiter de semblables effets, GENLIS, Veillées du chât. t. I, p. 240, dans POUGENS

Jardins potagers, jardins dans lesquels se trouvent, à peu près exclusivement, des plantes légumières. Jardins fruitiers, les vergers proprement dits. Jardins botaniques, jardins destinés à l’étude des végétaux. Jardin de pharmacie, jardin où l’on cultive des plantes médicinales. Jardins d’agrément, jardins qui ne rapportent ni légumes ni fruits et ne sont faits que pour le plaisir des yeux.

Jardin des plantes, Jardin du roi, le jardin qui accompagne le Muséum d’histoire naturelle de Paris ; Jardin des plantes est aussi le nom qu’on donne aux jardins botaniques dans toutes les villes de France.

Les jardins d’Épicure, jardin où Épicure philosophait, et, quelquefois, par métonymie, la secte épicurienne. On dit aussi les philosophes, la secte des jardins. ♦ Ô maison d’Aristippe, ô jardins d’Épicure, Vous qui me présentez, dans vos enclos divers, Ce qui souvent manque à mes vers, Le mérite de l’art soumis à la nature,VOLT., Épître 76

Jardin des Hespérides, lieu où, suivant la mythologie, un dragon gardait les pommes d’or. ♦ Vos fruits [des orangers de Versailles] aux écorces solides Sont un véritable trésor ; Et le jardin des Hespérides N’avait point d’autres pommes d’or, LA FONTAINE,Psyché, I, p. 14 ♦ Quelques savants curieux ont cru que le jardin des Hespérides, gardé par un dragon, était une imitation du jardin d’Éden, gardé par un boeuf ailé, ou par un chérubin, VOLT., Dict. phil. Paradis.

Fig. et familièrement. Faire d’une chose comme des choux de son jardin, en disposer comme si on en était le maître, le possesseur.

Fig. Jeter une pierre, des pierres dans le jardin de quelqu’un, attaquer quelqu’un indirectement ; locution prise de l’habitude des gamins de jeter des pierres par-dessus les murs des jardins et d’y causer du dommage. ♦ J’irai voir ces coquins qui jettent des pierres dans le jardin du patron [les Bretons fort échauffés contre le duc de Chaulnes, contre qui, du reste, ils avaient lancé des pierres], SÉV., 3 juill. 1675

Fig. Le fruit de notre jardin, la chose qui nous est propre, qui nous occupe avant les autres. ♦ Voilà bien parler de la Bretagne, ma chère enfant, cela peut-être vous ennuiera ; mais cela est naturel, ce sont des fruits de notre jardin, SÉV., 591

Fig. En termes mystiques, le jardin de l’Époux, la culture religieuse des âmes. ♦ Contentons-nous de savoir qu’il y a des plantes tardives dans le jardin de l’Époux ; que, pour en voir la fécondité, les directeurs des consciences, les laboureurs spirituels doivent attendre avec patience le fruit précieux de la terre…., BOSSUET, Bourgoing.

Fig. Ce qui produit des fruits intellectuels. ♦ Il disait qu’il aimait à voir croître dans les jardins d’autrui des plantes dont il avait fourni les graines, FONTEN., Leibnitz.

Fig. Pays fertile et dont la culture est très variée. ♦ Ils [les Hollandais] font un commerce immense à Cranganor [Inde], qui est, dit-on, un jardin de délices, VOLT., Polit. et législ. Fragm. hist. sur l’Inde, X

Le jardin de la France, nom qu’on donne quelquefois à la Touraine. ♦ Tours, que l’on appelait le jardin de la France, se doit à cette heure nommer le paradis de la terre…., VOIT., Lett. 86

Le jardin de l’Europe, nom qu’on donne quelquefois à l’Italie.

Jardin sec, herbier.

Terme de fauconnerie. Lieu où l’on expose les oiseaux de vol au soleil, le matin. Donner le jardin à l’oiseau, le mettre au grand air.

Vulgairement. Le jardin pavé, la halle.

Terme de marine. Partie supérieure des bouteilles d’un grand bâtiment.

Jardin des racines grecques, nom donné par les grammairiens de Port-Royal au recueil qu’ils avaient fait des racines grecques. On voit que les auteurs jouaient ici sur le mot de racine, qui se prend dans la nature en un sens qui justifie le mot jardin ; et en grammaire dans un autre sens auquel le mot jardin ne peut convenir que par abus.

HISTORIQUE

XIIIe s. ♦ Au jardin le [du] roi [il y] ot mainte table dressée, Berte, II ♦ Dames i aura abeant, Qui ja n’en averont deduit ; Celes plantent jardin sanz fruit, Lai du conseil

XVe s. ♦ Il est sailly de la maison de France, Creu au jardin semé de fleurs de lys, CH. D’ORL., I ♦ Comme le suppliant se alloit esbattre tout seul autour du gard ou jardin…. , DU CANGE, gardignium.♦ Au jardin de deux amans vrais et loyaulx ne peult lever pire herbe [que la jalousie], 20Perceforest, t. VI, f° 105 ♦ L’une lui dit ung brocart, l’autre li gete une pierre en son jardin, Les 15 joies de mariage, p. 31

XVIe s. ♦ Le jardin de la cuisine [le potager], Nouv. coust. génér. t. II, p. 201320349 ♦ Jouer au jardin madame, la substance de ce jeu est que chacun des assistants doit donner un arbre, une beste dessus pour le garder, et un oyseau dessous pour chanter, et faut qu’il contreface le son ou voix de la beste et le chant de l’oyseau, puis l’on demande à la compagnie s’il a bien fait…., DES ACCORDS, Escraignes dijonnoises, p. 10, dans LACURNE  ♦ Jardin aux fauxbourgs vaut cent solz au rebours, COTGRAVE ♦ Cela n’est pas cru en ton jardin, LEROUX DE LINCY, Prov. t. II, p. 256

ÉTYMOLOGIE

Bourguig. jadin ; Berry, jardrin ; picard, gardin, guerdin ; provenç. jardin, gardi ; catal. jardi ; espagn. jardin ; portug. jardim ; ital. giardino ; du germanique : goth. gards, maison ; anc. h. allem. karto, garto ; allem. Garten ; isl. gort. Le latin hortus, jardin, le latin chors, chortis, cour de ferme, le bas-latin curtis, et le français la cour sont de même radical. Comparez l’ancien slave grad, le russe gorod, ville.

Dictionnaire de l’Académie Française , nneuvième édition (inachevé, 1935-) (en ligne) :

JARDIN n. m. XIIe siècle. Probablement issu du gallo-roman (hortus) gardinus, « (jardin) enclos », lui-même issu du francique *gart, *gardo, « clôture ».

1. Lieu découvert, ordinairement clos, le plus souvent attenant à une habitation, dans lequel on cultive des légumes, on plante des fleurs, des arbres, etc. Une maison entourée d’un jardin. Jardin potager, fruitier. Les produits, les fruits du jardin. Jardin ouvrier ou familial, se dit de petits potagers loués à des familles aux revenus modestes. Un jardin de curé, voir Curé. Jardin d’agrément, où l’on cultive des fleurs, des plantes d’ornement. Travailler, jouer au jardin, dans le jardin. Faire un tour de jardin. Chaises, tables de jardin. Jardin d’hiver, voir Hiver. Jardin public, aménagé dans une ville et ouvert aux promeneurs. Les allées, les pelouses d’un jardin. Le jardin du Luxembourg, le Jardin des Plantes, à Paris. Jardin botanique, voir Botanique. Jardin alpin, où sont cultivées des plantes de haute montagne. Jardin zoologique, où l’on élève des animaux, notamment exotiques, pour l’étude scientifique et la curiosité des visiteurs. Jardin d’acclimatation, voir ce mot. Jardin suspendu, disposé en terrasses élevées. Les jardins suspendus de Babylone comptaient parmi les sept merveilles du monde. Jardin à la française, dessiné selon des figures géométriques et symétriques, et où sont ménagées de larges perspectives. Les jardins à la française s’inspirent des jardins italiens de la Renaissance. Les jardins à la française de Vaux-le-Vicomte, de Versailles. Jardin anglais ou à l’anglaise, qui offre l’apparence d’une nature agreste par sa diversité, ses lignes sinueuses, ses vallonnements. Jardin japonais, orné de ponts, de kiosques, dans le style particulier à ce pays ; se dit aussi d’un jardin miniature composé de plantes grasses, d’arbres nains, de cailloux colorés, et disposé parfois dans une coupe de céramique. Spécialt. Le jardin d’Épicure, celui où Épicure, à Athènes, dispensait son enseignement ; par méton., le Jardin, l’école philosophique d’Épicure et de ses disciples. Le jardin des Oliviers, où le Christ passa sa dernière nuit en prière, avant d’être livré par Judas. 2. Par ext. Contrée riche et fertile, aux cultures très variées et au paysage harmonieux. La Touraine est appelée le jardin de la France. MYTH. GRECQ. Le jardin des Hespérides, où les nymphes Hespérides gardaient avec l’aide d’un dragon l’arbre qui produisait des pommes d’or. – ÉCRITURE SAINTE. Le jardin d’Éden, le paradis terrestre où vivaient Adam et Ève avant d’en être chassés. 3. Spécialt. Jardin d’enfants, se dit d’établissements ou de classes accueillant de très jeunes enfants. Le Jardin des racines grecques, nom donné par les grammairiens de Port-Royal à un recueil méthodique et versifié des mots fondamentaux de la langue grecque. Jardin s’emploie parfois par extension dans le titre de certains recueils composés sur ce modèle. 4. Locutions et expressions. Disposer d’une chose comme des choux de son jardin, comme si on en était le maître, le possesseur. Fig. Jardin secret, se dit de sentiments, de pensées, de goûts dont on préserve l’intimité. La poésie est son jardin secret. Jeter une pierre, des pierres dans le jardin de quelqu’un, mêler dans une conversation, un discours, des paroles qui l’attaquent directement. C’est une pierre dans son jardin, une remarque désobligeante à son égard. Spécialt. FAUCONNERIE. Donner le jardin à l’oiseau, voir Jardiner. – THÉÂTRE. Côté jardin, désigne par convention la gauche de la scène pour le spectateur, par opposition au Côté cour. Expr. proverbiale empruntée au Candide de Voltaire. Il faut cultiver notre jardin, l’homme doit s’adonner aux tâches qui sont à sa portée, de sa compétence, sans se soucier du reste du monde ou perdre son temps en vaines spéculations. Titres célèbres : Le Jardin des délices terrestres, triptyque de Jérôme Bosch (vers 1500) ; Le Jardin des supplices, d’Octave Mirbeau (1899) ; Jardins sous la pluie, pièce pour piano de Claude Debussy (1904) ; Un jardin sur l’Oronte, de Maurice Barrès (1922).

বাংলা অভিধানের মধ্যে সাতটা অভিধানে উপস্থাপিত শব্দটির উচ্চারণের কোনো নির্দেশ নেই ৷ শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধানে’ (সংখ্যা ২শব্দটির অভিধানকারের উদ্ভাবিত উপায়ে ‘উচ্চারণ’ দেওয়া হয়েছে  প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে’ (সংখ্যা ৪অভিধানকারের উদ্ভাবিত উপায়ে কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণ নির্দেশ করা হয়েছে (যেমনঅকম্পিত’ — অকোম্ পিতোআর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যায়িত দক্ষিণ  এশিয়া  গ্রন্থাগারে (Digital South Asia Library,  http://dsal.uchicago.edu উপস্থাপিত পূর্বোক্ত ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধানের’ সপ্তম সংস্করণের বৈদ্যুতিন রূপে শব্দের ‘আন্তর্জাতিক ধ্বনিভিত্তিক বর্ণে’ উচ্চারণ নির্দেশ করা আছেঅভিধানটির উক্ত সংস্করণের মুদ্রিত রূপে তা রয়েছে কিনা তা আমাদের জানা নেই  তালিকার ছটি বিদেশি অভিধানের একটি বাদ দিয়ে বাকি সবগুলিতেই প্রথমেই রয়েছে উপস্থাপিত শব্দটির উচ্চারণ ফরাসি DLE (১৮৭২)  আর ইংরেজি WD (১৯১৩)  পুরনো, আন্তর্জাতিক ধ্বনিভিত্তিক বর্ণ ব্যবহার শুরুর আগের অভিধান — তাই এ দুটো অভিধানে আন্তর্জাতিক ধ্বনিভিত্তিক বর্ণের (IPA) বদলে তখনকার প্রথা অনুসারে ঐ অভিধানের শুরুতে অভিধানকার কর্তৃক উদ্ভাবিত ও ব্যাখ্যাত নিয়ম অনুসারে উচ্চারণ নির্দেশ করা হয়েছে ৷ ফরাসি অ্যাকাডেমির (আকাদেমি ফ্রঁসেজঅভিধান DAF– এর অসমাপ্ত নবম সংস্করণে কোনো উচ্চারণনির্দেশ নেই ৷ আসলে ফরাসি অ্যাকাডেমির অভিধান জনসাধারণের ব্যবহার্য অভিধান নয়ফরাসি ভাষার মান ও শুদ্ধতা রক্ষার ঐতিহ্যবাহী প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াসের অঙ্গ ৷ স্মরণীয়সপ্তদশ শতকে অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠা থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অ্যাকাডেমির অভিধানের আটটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছেনবমসংস্করণ এখনো সমাপ্ত হয় নি ৷ এই অভিধানে ঐতিহ্য মেনে কোনো উচ্চারণ নির্দেশ থাকে না ৷ এখানে আলোচ্য ইংরেজি SOED আর ফরাসি  PRE অভিধানদুটি সিডিরম যুক্ত  বৈদ্যুতিন সংস্করণ, ফলে এতে রয়েছে কম্প্যুটারে শ্রাব্য সহজাত ভাষাভাষীর (নেটিভ স্পিকারেরমুখের উচ্চারণ 

উনিশ শতকের দুটি বাংলা অভিধান বাদ দিয়ে বাকি সবগুলি অভিধানে পদপ্রকরণ উপস্থাপিত ৷ বাংলায়  ()  সংক্ষিপ্ত রূপ বিবা (. (বিশেষ্যআর ইংরেজিতে n. (nounদ্বারা তা নির্দেশ করা হয়েছে ৷ পদপ্রকরণে বাংলা আর ইংরেজির সঙ্গে ফরাসির তফাত হলবাংলা আর ইংরেজিতে যেখানে শব্দের কোনো ব্যাকরণগত লিঙ্গ নেই সেখানে ফরাসির বৈশিষ্ট্য হল প্রাতিপদিকের ব্যাকরণগত লিঙ্গ ৷ তাই তিনটি ফরাসি অভিধানেই শব্দটির শ্রেণীর সঙ্গে লিঙ্গ নির্দেশ করা হয়েছে :PRE আর DAF  দুটি অভিধানে রয়েছে সংক্ষিপ্ত নির্দেশ n. m. (nom masculin=বিশেষ্য পুংলিঙ্গআর উনিশ শতকীয় DLEতে রয়েছে s.m. (substantif masculin =নাম/প্রাতিপদিক পুংলিঙ্গঅর্থাৎ  nomএর পরিবর্তে  ল্যাটিন ব্যাকরণ থেকে আসা পুরনো পারিভাষিক শব্দ substantif 

উচ্চারণের পর শব্দটির উৎস বা/এবং ব্যুৎপত্তি ৷ সবগুলি বাংলা আর বিদেশি অভিধানে তা রয়েছে ৷ দুটি বাংলা অভিধানে উৎস বা/এবং ব্যুৎপত্তি স্থান পেয়েছে শব্দের অর্থ হিসেবে উপস্থাপিত সমার্থক শব্দের পরে (আর ইংরেজি COD  ফরাসি DLEতে তা রয়েছে উপস্থাপনার শেষে  DLE-তে তা রয়েছে ব্যুপত্তি (étymologie)শিরোনামে 

কবে থেকে শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছে তা বাংলা অভিধানে অনুপস্থিত আর তা তিনটি ফরাসি অভিধানেই স্থান পেয়েছেঅবশ্য DLEতে তা আলাদাভাবে  ইতিহাস’  (Historiqueশিরোনামে  উপস্থাপিত হয়েছে   ইংরেজি অভিধানগুলির মধ্যে  SOEDতে উচ্চারণের ঠিক পরে আর CODতে রয়েছে উপস্থাপনার শেষে কিছুটা অস্পষ্টভাবে ME/মই. (Middle English /মধ্য ইংরেজিদ্বারা নির্দেশিত হয়েছে

. এর পর সাধারণ অভিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শব্দার্থ বা শব্দের সংজ্ঞার্থ  ওপরের আটটি বাংলা অভিধানে উপস্থাপিত বাগান শব্দের অর্থ হিসেবে এক বা একাধিক তথাকথিত সমার্থক শব্দ  আর  একমাত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে (সংখ্যা ৪বাগান শব্দের অর্থ হিসেবে দুটি সমার্থক  শব্দের পর শব্দটির প্রাথমিক একটা সংজ্ঞার্থ দেওয়া হয়েছে যে ক্ষেত্রে ফল ও পুষ্প বৃক্ষের চাষ হয়’ ৷  বিদেশি অভিধানগুলিতে শ্রেণীবিভক্তভাবে শব্দটির সাধারণ থেকে বিশেষ তথা রূপকাত্মক অর্থ সংজ্ঞার্থের আকারে উপস্থাপিত হয়েছে  ফরাসি DLE বাদে বাকি অভিধানগুলিতে গুরুত্ব অনুসারে ক্রমবিন্যস্ত সংজ্ঞার্থ সংখ্যা দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে DLEতে সংখ্যার বদলে ব্যবহৃত হয়েছে ফাঁক (স্পেস৷ প্রতিটি অর্থের সঙ্গে রয়েছে সাহিত্য থেকে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত ৷

আমরা তিনটি ইংরেজি ও তিনটি ফরাসি অভিধানে ক্রমবিন্যস্ত সংজ্ঞার্থগুলির শুরু অর্থা প্রথম সাধারণ সংজ্ঞার্থের বাংলা অনুবাদ দিয়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট করতে চেষ্টা করছি:

   SOED: .এক খণ্ড জমি (প্রায়শ ঘেরা যেখানে ফলফুলভেষজ লতাপাতা অথবা সব্জির চাষ করা হয়

   COD: বিশেষ ব্রিটিশ অংশত ঘাসে ঢাকা কোনো ব্যক্তিগত বাড়ির সংলগ্ন এক খণ্ড জমি যা ফুলফল বা সব্জি উৎপাদন আর খেলাধুলোর জন্য ব্যবহার করা হয়

    WD: বিভিন্ন ভেষজ লতাপাতাফলফুল বা সব্জি চাষের উপযুক্ত এক খণ্ড জমি ৷

     PRE: .সাধারণত ঘেরা জমি যেখানে লোকে ব্যবহার্য বা দেখতে সুন্দর বিভিন্ন উদ্ভিদের চাষ করে এ ক্ষেত্রে পার্কের চেয়ে ক্ষুদ্রাকারফলের বাগানসব্জি বাগান

   DLE: ব্যবহার্য বা মনোরম গাছগাছড়া লাগানো সাধারণত ঘেরা জায়গা ফলের বাগান ল্যুকজঁবুরএর বাগানত্যুইলরির বাগান

  DAF: .খোলা জায়গা সাধারণত ঘেরা দেওয়াপ্রায়শ কোনো বসতবাড়ির লাগোয়াযার ভেতর লোকে সব্জির চাষ করেফুলগাছ কি অন্য গাছ লাগায় ইত্যাদি বাগানে ঘেরা একটা বাড়িসব্জি বাগানফল বাগান

. সাহিত্য আর প্রবচনে শব্দটির বিশেষ বা রূপকার্থে ব্যবহারের উদাহরণ সহ সংজ্ঞার্থ বাংলা অভিধানগুলিতে স্পষ্টত কিছুই নেইতিনটি ইংরেজি অভিধানে বিশেষ বা/এবং রূপকার্থ পরিচিতিতে আলাদা করা না হলেও শব্দটির বিশেয ব্যবহার সংজ্ঞার্থ সহ ক্রমবিন্যস্ত হয়েছে  ফরাসি অভিধানগুলিতে fig. (figuratif/ইং.figurative)পরিচিতিতে বিশেষ বা রূপকার্থকে আলাদাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে 

. ফরাসি অভিধান PREতে ক্রমবিন্যস্ত সংজ্ঞার্থের পাশে রয়েছে ঐ অর্থের অনুসারী এক বা একাধিক সমা্র্থক শব্দ ৷

ইংরেজিফরাসি বা অন্য কোনো ইয়োরোপীয় ভাষার অভিধানের (‘ইয়োরোপীয় ভাষার’ কেননা এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দৌলতে বৌদ্ধিকভাবে ঔপনিবেশিত আমার চিনেজাপানিফার্সিআরবি ভাষার অভিধান সম্পর্কে কোনো ধারণা নেইপাশে বাংলা ভাষার অভিধান নিয়ে বসলে বাংলা অভিধানের দৈন্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বস্তুত বাংলায় সিডিরম ওয়ালা অভিধান দূরে থাকুক সাধারণ ভাবে পূর্বোক্ত চরিত্রলক্ষণের   (উচ্চারণ,  সংজ্ঞার্থ, প্রয়োগের  দৃষ্টান্ত ইত্যাদিসবগুলি রয়েছে এরকম অভিধান অপ্রাপ্য। ওপরের দৃষ্টান্ত সামনে রাখলেই বোঝা যায়আসলে প্রথমেই থাকা উচিত ছিল আন্তর্জাতিক ধ্বনিভিত্তিক বর্ণে (আইপিএতেপ্রতিবর্ণীকৃত ‘বাগান’ শব্দের উচ্চারণ  (baɡan), তারপর পদপ্রকরণ অনুযায়ী শব্দটির শ্রেণীনির্দেশ — বি. (বিশেষ্য); এর পর যোগ করা উচিত ছিল শব্দটির উত্সব্যুত্পত্তি আর শব্দটি কোন সময় থেকে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত (সম্ভব হলে প্রথম ব্যবহারের সময়/সাল) তার পর অভিধানের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ — শব্দটির প্রাখমিক সাধারণ সংজ্ঞার্থ: যেমন ধরা যাক ‘ফলফুল কিংবা বিশেষ ধরনের কোনো গাছ লাগানো বা উদ্ভিদের চাষ কবা হয় এরকম (সাধারণত বাড়ির সংলগ্ন বা কাছাকাছিসীমা নির্দিষ্ট অথবা ঘেরা জায়গা’ ;উদাহরণ ধরা যাক ‘মাসিমা পুজোর ফুল তুলতে সাজি হাতে বাগানে ঢুকলেন’। সংজ্ঞার্থ অস্পষ্টতাক্লিষ্টতাঅব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তি দোষ থেকে যথাসম্ভব মুক্ত হওয়া দরকার। সাধারণ সংজ্ঞার্থের পর থাকতে পারত বিশেষ সংজ্ঞার্থ সহ ‘বাগান’ শব্দের অন্যান্য প্রয়োগ ও তার উদাহরণ  (বাঁশবাগান — ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ’,চাবাগানআমবাগানবাগানবাড়ি ইত্যাদি)। এর পর ‘বাগান’ শব্দের এক বা একাধিক রূপকার্থে প্রয়োগের উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা (যেমন প্রবচনে ‘কাঠবিড়ালির বাগানভাগ, ‘খাসবাগানে আলকুশী’ আর সাহিত্যে ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’)। এর মধ্যে বা পরে বাংলা অভিধানে ‘শব্দের অর্থ’ হিসেবে দেওয়া সমার্থক শব্দগুলির স্থান হতে পারত 

এছাড়া আজও বাংলা অভিধানের শব্দসংগ্রহের পদ্ধতি আর শব্দর্নিবাচনের প্রধান অবলম্বন হল পুরনো অভিধানফলে তা আজকের অভিধানব্যবহারকারীর চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে পারে না ৷ এসব অভিধানে অনেক বাংলায় অব্যবহৃত শব্দ দেখা গেলেওঅনেক নিত্যব্যবহৃত শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না (যেমন বিদেশি শব্দ বা পরিবর্তিত বিদেশি শব্দ কবিরাজি কাটলেটগণভাষার শব্দ হারামিভোগে যাওয়া,মেরেছে!, ফুটে যাওয়াআসলে কম্প্যুটারের সাহায্যে (পুরনো অভিধানসাহিত্য,প্রাকৃতিক বিজ্ঞানমানবিক বিজ্ঞানসংবাদিক রচনা ইত্যাদি থেকেলিখিত ও (বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কথ্য বাচন সংগ্রহ তার তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবহারের পৌনঃপৌনিকতা বিচার করে শব্দসংগ্রহ তথা শব্দর্নিবাচন তারপর তা যাচাই করে তাকে অভিধানে স্থান দিয়ে আধুনিক অভিধান রচনা এখনো আমাদের বাংলা ভাষায় শুরু হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত এখনো আমাদের চোখে পড়ে নি ৷

প্রসঙ্গত একথাও সত্যি যে কখনো সখনো একমাত্র বানান মিলিয়ে দেখা ছাড়া অভিধানবিশেষ করে বাংলা ভাষার অভিধান ব্যবহার করার অভ্যেস বাংলা ভাষাভাষী বুদ্ধিজীবিদের নেই। আমি যখন বলি যে অভিধান ছাড়া আমি অস্বস্তি বোধ করিআমার বহনযোগ্য গণকযন্ত্রে (ল্যাপটপ বা পোর্টেবল কম্প্যুটারেইংরেজিফরাসি মিলিয়ে ছটা অভিধানের বৈদ্যুতিন সংস্করণ ভরা রয়েছে তখন বাঙালি বুদ্ধিজীবি বন্ধুরা ভাবেন হয় আমি বদ্ধোন্মাদ নয়ত পণ্ডিতির বহর দেখাতে চাই। একজন অবশ্য কালিদাসের শরণ নিয়ে বললেন যে আমার বাগর্থের প্রতিপত্তিতে অভাব রয়েছে। হয়ত তাই। তবে দুঃখের কথা আমার গণকযন্ত্রে ভরার জন্য এযাবৎ কোনো বাংলা ভাষার অভিধান আমি খুঁজে পাইনিএমনকী বানান দেখার জন্যও নয়। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে বিদ্যায়তনিক সাইটে (Digital South Asia Library, http://dsal.uchicago.edu)বাংলা ভাষার অভিধান হিসেবে ‘সংসদ বাঙলা অভিধান’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অবশ্য তা একমাত্র ইন্টারনেট সংযোগ করে দেখা যাবে। আর সংসদের উক্ত অভিধানও সাধারণভাবে বাংলা ভাষার অভিধানের অসম্পূর্ণতা ও দৈন্যের উদাহরণ।