জ্যাভিয়ার থেকে টেরিজা ভারতে পশ্চিমি খ্রিস্টধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের রণকৌশল/From Xavier to Teresa: Strategies of the Imperialist Invasion of the Western Christianity / in India De Xavier à Térésa : stratégies de l’invasion impérialist du Christianisme occidentale en Inde

জ্যাভিয়ার থেকে টেরিজা
ভারতে পশ্চিমি খ্রিস্টধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের রণকৌশল১
From Xavier to Teresa: Strategies of the Imperialist Invasion of the Western Christianity in India
De Xavier à Térésa : stratégies de l’invasion impérialist du Christianisme occidentale en Inde

. ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ও আমি

আমার বিশ্বাস আপনারা যদি আপনাদের চিন্তাশক্তির স্বাভাবিক আলোককে অনুসরণ করেন তাহলেই অন্তত আমার মতো স্পষ্ট আর দ্বিধাহীনভাবে দেখতে পাবেন যে পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম হল মানুষের উদ্ভাবনমাত্র, আর আপনার ধর্ম আপনাকে যা কিছু শেখায় তা আসলে ভুল, মিথ্যাচার, মোহ এবং প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় ৷

জঁ মেসলিয়ে: ইষ্টপত্র

ধর্ম সম্পর্কে লুক্রিসিয়াসএর মতই হল আমার নিজের মত ধর্মকে আমি ভয় থেকে জন্মানো একটা রোগ এবং মানবজাতির অবর্ণনীয় দুঃখদুর্দশার কারণ বলে মনে করি।

বার্টান্ড রাসেল: সভ্যতায় কি ধর্মের কোনো মূল্যবান অবদান রয়েছে? ১৯৩০

লোকায়তপ্রস্থানে বিশ্বাসী আমি মানবিকতাবাদী নাস্তিক, কোনো ধর্মের সঙ্গে আমার কোনো মানসিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই ৷ না, খ্রিস্টধর্মের প্রতিও আমার আলাদা কোনো বিশেষ প্রীতি বা বিদ্বেষ নেই ৷ আমার ধারণায় খ্রিস্টধর্ম ঈপ্সাপূরক কল্পনায় তৈরি করা কোনো এক ‘ত্রাতা’ জিশুকে ঘিরে কয়েক শতক ধরে গড়ে তোলা ধর্মমত এবং তা তাবৎ ধর্মমতের মতোই অন্ধ বিশ্বাসভিত্তিক কুসংস্কারের বান্ডিল ৷ আর পাঁচটা ধর্মের মতোই খ্রিস্টধর্মেরও মূলধন হল দুর্বল মানুষের অজ্ঞাত আর অজ্ঞেয় ভবিষ্যৎ এবং মৃত্যুর ভয় ৷ লোকায়ত বিচারঅনুযায়ী বেদের ‘কর্তা’ হলেন (অর্থাৎ নির্মাতা বা রচয়িতা) ‘ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর (অর্থাৎ মনুষ্যসমাজের ক্ষতিকারক রাক্ষস)’ ৷ একইভাবে আমি খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের পুরাতন বিধান তথা নববিধানের রচয়িতাদের ‘ভণ্ড, ধূর্ত’ মানবাধিকারের শত্রু প্রতারক বলে বিবেচনা করি ৷

আমি নাস্তিক অথচ আমার বর্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হল ধর্ম, যথাযথভাবে ভারতে খ্রিস্টধর্মীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহাসিক রূপ ও রূপান্তর, তার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ থেকে নয়াঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদে উদ্বর্তন ৷ কেন এই বিষয়? তার কারণ কী বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই বিষয়টি আমাকে চিন্তিত করেছে বস্তুত এই বিষয়কে কেন্দ্র করে আমার উপলব্ধি একাধিক

প্রথমেই যেকথা আমার মনে হয়েছে তা হল: পাশ্চাত্যের খ্রিস্টধর্ম প্রভাবিত ঔপনিবেশিক শিক্ষার ফলস্বরূপ আমরা পাশ্চাত্য তথা তার জীবনযাপন, ভাষা, শিল্পসাহিত্য, রীতিনীতি, ধর্ম সবকিছু সম্পর্কে হীনমন্যতায় ভুগি তাই পাশ্চাত্যের খ্রিস্টধর্মীয় কুসংস্কার, মৌলবাদ, জাত্যহংকার সম্পর্কে কখনো প্রশ্ন তুলতে পারিনা আর পাশ্চাত্যের বিপুল প্রচারযন্ত্রের মস্তক ধোলাইয়ের ফলে তথা ঔপনিবেশিতের হীনমন্যতার মানসিক নিয়ন্ত্রণে আমরা ধরে নিই তাবৎ কুসংস্কারের আধার হলাম অখ্রিস্টান আমরা, অর্থা আমরা অখ্রিস্টান অইয়োরোপীয় ভারতীয়রা দেবদেবতা, শাখাসিঁদুর, পুজোআচ্চা, তীর্থযাত্রা, পাঁজি, জ্যোতিষ, ইত্যাদি, ইত্যাদি; বিপরীতে পাশ্চাত্য হল গিয়ে আলোকায়িত, যুক্তিবাদী, তার ধর্ম, আচারবিচার সবই যুক্তিনিয়মিত আমরা ভাবতে পারিনা বা বলতে সাহস পাই না আসলে ধর্ম মানেই বিচারহীন বিশ্বাস, প্রশ্নহীন বশ্যতা, যুক্তিহীন কুসংস্কার তা হিন্দু হোক, ইসলাম হোক কি খ্রিস্টধর্ম হোক বা অন্য যেকোনো ধর্মই হোক না কেন এছাড়া বলা দরকার, ধর্ম মানেই কম বেশি বিভেদ আর বৈষম্য, ধর্ম মানেই জাত্যহংকার, ধর্ম মানেই অন্যকে অস্বীকার আর ঘৃণা খ্রিস্টধর্মের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র হল তথাকথিত ঈশ্বরপুত্র ঈশ্বর ন্যাজারেথএর জিশু ঐ ন্যাজারেথএর জিশুর অস্তিত্ব অযোধ্যার রাম বা বৃন্দাবনের কৃষ্ণের মতোই প্রধানত লোকবৃত্তভিত্তিক, কোনো অর্থেই ঐতিহাসিক নয়, এমনকী জিশুর জন্মদিন বলে কথিত ২৫এ ডিসেম্বর (কৃষ্ণের জন্মদিন জন্মাষ্টমীর মতোই) কল্পিত আর খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতার চাপিয়ে দেওয়া খ্রিস্ট অভিধার সঙ্গে জড়ানো অব্দের সঙ্গে জিশুর কোনো বাস্তব সম্পর্ক নেই এছাড়া তাবৎ ধর্মের মতোই খ্রিস্টধর্মের ধর্মতত্ত্ব, আচারঅনুষ্ঠান, জীবনচর্যা একান্তভাবে বিচারহীন বিশ্বাসভিত্তিক আর এই বিশ্বাস অন্ধ, এই বিশ্বাসের অবস্থান হল যুক্তির বিপ্রতীপ অক্ষে

খ্রিস্টীয় পাশ্চাত্যের প্রচারে খ্রিস্টধর্ম ছাড়া আর সব ধর্মই হল কুসংস্কারমাত্র৷ অথচ মানবীর গর্ভে ঈশ্বরের পুত্র ঈশ্বর জিশুর জন্ম, জিশুর মা মেরির অপাপবিদ্ধ গর্ভধান, মানুষের আদি পাপের উত্তরাধিকার, স্বর্গচ্যুত দেবদূত শয়তানের ঈশ্বরবিরোধী, জিশুবিরোধী কাণ্ডকারখানা, ত্রাতাজিশুর স্মরণ নিলে মোদ্দা কথা, খেরেস্তান হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই, ইহ জীবনে কিছু হোক বা না হোক টেসে যাওয়ার পর গোরের মাটির তলায় পোকামাকড়ের পেটে যাওয়ার পর শেষ বিচারের অন্তে স্বর্গে নিশ্চিন্ত অনন্ত জীবনের পুরস্কার ইত্যাদি অনেক খ্রিস্টধর্মীয় গল্পকথা যেকোনো ধর্মীয় পুরাণের কাহিনির মতোই স্রেফ গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না এছাড়া খ্রিস্টধর্মের পবিত্রসংস্কার (স্যাক্রামেনটস্/Sacraments) অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন সংস্কারের মতোই যুক্তিহীন কুসংস্কারনির্ভর যেমন নরমাংসভক্ষণের আদিম কৌল আচারের স্মৃতিবাহী খ্রিস্টযজ্ঞ (ইউকারিস্ট/Eucharist), আদি পাপ মোছা দীক্ষাস্নান (ব্যাপ্টিজম/baptism) ইত্যাদিও হাস্যকর কুসংস্কার মাত্র, কাঠ বা ধাতুর ক্রস বহন করা, হাত দিয়ে সারাক্ষণ ক্রসচিহ্ন করা, জিশুর নাম করে আর ক্রস দেখিয়ে ভূত ছাড়ানো (এগজরসিজম /exorcism), রোগমুক্ত হওয়ার কামনা নিয়ে ক্যাথলিকদের লুভ্র্এর ঝর্ণার জল খাওয়ার জন্য পায়ে হেঁটে তীর্থযাত্রা বা গ্রিক অর্থোডক্সদের তিনস দ্বীপে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে গির্জেয় ঢোকা, জিশু আর তথাকথিত খ্রিস্টীয় সন্তদের অলৌকিক কাণ্ডকারখানায় বিশ্বাস ইত্যাদি অনেক খ্রিস্টধর্মীয় আচারই কুসংস্কারের চূড়ান্ত নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি যুক্তিবিরোধী আর মানবিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ড — অন্যের প্রতি ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, হিংসা, অবিচার, অত্যাচার, হানাহানি আর রক্তপাতের কারণ হল ধর্ম ৷ আর এই ইতিবৃত্তের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়ের স্রষ্টা হল তথাকথিত তিন একেশ্বরবাদী ধর্ম: ইহুদি ধর্ম (জুডাইজম) আর তার থেকে জন্মানো ধর্মতত্ত্বে তার অধমর্ণ খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম ৷ একাধিকার, অন্যের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা আর ঘৃণা হল এই তিন ধর্মের ধর্মতাত্ত্বিক চরিত্র একথা খ্রিস্টীয় পাশ্চাত্যের চিন্তাশীলদের অনেকেও উপলব্ধি করেছে:

প্রকৃতপক্ষে অসহিষ্ণুতা একমাত্র একেশ্বরবাদের ক্ষেত্রে অপরিহার্য; একজন অনন্য দেবতা চরিত্রগতভাবে এক ঈর্ষাপরায়ণ দেবতা যিনি আর কোনো দেবতাকে থাকতে দিতে পারেন না ৷ অন্য দিকে বহুঈশ্বরবাদীদের দেবতারা স্বভবাতই সহিষ্ণু, তাঁরা বেঁচে থাকেন আর বাঁচতে দেন

আর্থার শোপেনহাওয়ার১০

অনন্য এক ঈশ্বরে বিশ্বাসের সঙ্গে অনিবার্যভাবে জন্ম নিল সেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা যা প্রাচীন সভ্যতার যুগে অপরিচিত ছিল ৷

সিগমন্ড ফ্রয়েড১১

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুসারে, তিন একেশ্বরবাদী ধর্ম ঈশ্বরের নামে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিশ্বাস্য রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছে! যুদ্ধ, শাস্তির অভিযান, হত্যাকাণ্ড, খুন, ঔপনিবেশিকতা, জাতিহত্যা, গণহত্যা, ক্রুসেড, ইনকুইজিশন, আজকের বিশ্বব্যাপী অত্যুগ্র সন্ত্রাসবাদ

অনন্য ঈশ্বরের ধর্মঅন্যের বিরুদ্ধে অভিক্ষিপ্ত হলে এই ধর্ম উদ্বুদ্ধ করে বিরূপতা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা যার উত্পাদন হল জাত্যহংকার, বিদেশিআতংক, ঔপনিবেশিকতা, যুদ্ধ, সামাজিক অবিচার ৷

মিশেল ওঁফ্রে১২

ইহুদিপুরাণ তানাখ(যার কিছুটা পরিবর্তিত রূপ হল খ্রিস্টানদের পুরাতন বিধান) বর্ণিত ইহুদিদের তথাকথিত অনন্য ঈশ্বরের নির্ধারিত ভূখণ্ড অধিকারের ইতিবৃত্ত জুডাইজম্এর চরিত্রগত একাধিকার, অন্যের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, ঘৃণা ও আগ্রাসী প্রভুত্বকামিতার প্রকাশক আর খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের প্রকৃতিতে জুডাইজম থেকে পাওয়া একাধিকার, অন্যের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, ঘৃণা ও আগ্রাসী প্রভুত্বকামিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচারক, ধর্মান্তরক, প্রসারণশীলতা — আমরা যাকে এক কথায় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র বলে অভিহিত করতে পারি ৷ খ্রিস্টধর্মের এই ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কর্মকাণ্ড এদেশে ক্রমশ একটা পরিব্যাপ্ত আর বিপজ্জনক রূপ লাভ করছে

আমার দ্বিতীয় উপলব্ধি হল: ধর্মান্তরীকরণ পৃথিবীর মানবিকসাংস্কৃতিক প্রতিবেশতত্ত্বের প্রতিকূল । বস্তুত প্রতিবেশতত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীতে সুস্থ জৈব জীবনের অনুকূল পরিবেশের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় হল সযত্নে জীব ও উদ্ভিদ্জগতের বৈচিত্র্য রক্ষা করা। ইদানীং কালে প্রতিবেশতত্ত্ব সমুদাচারসম্মত (fashionable), তাই বিভিন্ন স্তরে সর্বত্র চর্চিত হচ্ছে উদ্ভিদ্ভূগোল, জীবভূগোল, সংগঠিত হচ্ছে জীব ও উদ্ভিদ্জগতের বৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য আন্দোলন। ভৌত প্রতিবেশতত্ত্বের কথা হাজারবার বলা হলেও রাজনৈতিকআর্থনৈতিক নয়াঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রভাবে মানবিকসাংস্কৃতিক প্রতিবেশতত্ত্বের আলোচনা বিদ্যায়তনিক জগতে বা তার বাইরে অনুপস্থিত, বলা যায় প্রায় টাবু (taboo)। প্রতিদান বা প্রতিষ্ঠার চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আমরা উপলব্ধি করি, পৃথিবীতে সুস্থ জৈব জীবনের অনুকূল পরিবেশের জন্য জীব ও উদ্ভিদ্জগতের বৈচিত্র্য রক্ষা করা যেমন আবশ্যক, তেমনই পৃথিবীতে সুস্থ মানবিকসাংস্কৃতিক জীবনের অনুকূল পরিবেশের জন্য বিকল্পহীনভাবে প্রয়োজনীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির বৈভিন্ন্য আর বৈচিত্র্য রক্ষা করা। ধর্মান্তরীকরণ এই বৈভিন্ন্য আর বৈচিত্র্যের হন্তারক ধ্বংসকারী। গত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে খ্রিস্টধর্ম আমেরিকা, আফ্রিকা , ওসেয়ানিয়া, পলিনেসিয়া আর আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতি বা/এবং উপজাতিকে ধর্মান্তরিত করে তাদের সংস্কৃতি তথা সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে ধ্বংস করেছে আর আমাদের এই পৃথিবীকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে দরিদ্রতর করেছে ৷

এছাড়া কয়েক বছর আগে ভ্যাটিকানের ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলী কর্তৃক আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু ওরফে টেরিজা মাকে সন্ত খেতাব দেওয়ার প্রশ্নে দেশে বিদেশে আবেগোচ্ছ্বাসের চুনামি আর প্রশস্তির ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত করতালির মধ্যে প্রায় হারিয়ে যাওয়া কিছু বিরল কণ্ঠের প্রতিবাদ আমাকে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে চিন্তিত করে ৷ তার ওপর আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু তথা ক্যাথলিক গণমাধ্যম, দমিনিক লাপিয়ের ইত্যাদির অবদানে আজ পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্র, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসু, সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা আন্তর্জাতিকভাবে টেরিজা মার কলকাতা, নর্দমার কলকাতা, কুষ্ঠরোগের কলকাতায় পরিণত হয়েছে ৷ পশ্চিমি প্রচারমাধ্যমে টেরিজা মার কলকাতা, নর্দমার কলকাতা, কুষ্ঠরোগের কলকাতা শুনতে শুনতে কলকাতার আমি বিষণ্ণ হয়ে উঠি ৷ খ্রিস্টধর্ম প্রচার তথা পশ্চিমি প্রভাব ও স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার প্রয়েজনে নানা কৌশলে গড়ে তোলা টেরিজা মা নামক নাটকের নেপথ্যের কথা বলাটা প্রয়োজনীয় বলে বোধ হল

প্রসঙ্গত বলা দরকার, পোন্তিফিচো ইনস্তিতুতো মিসিয়োন এস্তেরে (Pontificio Instituto Missioni Estere, ইং. The Pontifical Institute for Foreign Missions) হল ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর মোহান্ত বা পোপের অধীন বিদেশে ধর্মপ্রচারকদের শিক্ষাকেন্দ্র ২০০৪ সাল থেকে এই কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত এশিয়াননিউজ.ইট (AsianNews.it) নামে ইন্টারনেট পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণের শিরোনামের নিচে রয়েছে ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর ভূতপূর্ব মোহান্ত কারল ভোইতিলা(এই পোলিশ পাদ্রির পোপ হিসেবে ছদ্মনামের ইংরেজি রূপ: দ্বিতীয় জনপল) শেষ গ্রন্থ ‘ওঠ,এগিয়ে চল!(Alzatevi, andiamo! ইংরেজি অনুবাদে: Rise, Let us be on our way) থেকে উদ্ধৃতি ‘তৃতীয় সহস্রাব্দে আমাদের সবার মিলিত কর্মক্ষেত্র হল এশিয়া’ (Asia, our common task for the Third Millennium) ৷ প্রসঙ্গত মনে পড়ে ১৯৯৫ সালে ম্যানিলায় এশিয়ার ক্যাথলিক বিশপদের সমাবেশে ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর পূর্বোক্ত ভূতপূর্ব মোহান্ত বলেছিলেন:

পৃথিবীব্যাপী খ্রিস্টমণ্ডলীর সঙ্গে এসিয়ায় খ্রিস্টমণ্ডলী তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রবেশপথ পার হবে, আশ্চর্য হয়ে প্রত্যক্ষ করবে শুরু থেকে আজ অব্দি ঈশ্বর যা করেছেন এবং এই প্রত্যয়ে অবিচল থাকবে যে ‘প্রথম সহস্রাব্দে যেরকম ইয়োরোপের মাটিতে ক্রস রোপিত হয়েছে, আর দ্বিতীয় সহস্রাব্দে হয়েছে দুই আমেরিকা আর আফ্রিকায়, আমরা প্রার্থনা করতে পারি তৃতীয় খ্রিস্টীয় সহস্রাব্দে এই বিশাল আর গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশে বিশ্বাসের বিপুল এক ফসল আহৃত হবে’৷

দ্বিতীয় জনপল: এশিয়ার খিস্টীয় ধর্মমণ্ডলী১৩

১৯৯৭ সালে আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু ওরফে মাদার টেরিজা মারা যান মাত্র ছ বছরের ব্যবধানে ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে ভ্যাটিকানের কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলী আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ুকে ‘পরমানন্দায়ন’ (বিআটিফিকেশন) মঞ্জুর করে অর্থাৎ তিনি ‘ভগবদ্ করুণাপ্রাপ্ত’ (ব্লেসেড) অভিধা লাভ করে সাধ্বীবা সন্তহিসেবে স্বীকৃত হওয়ার প্রথম ধাপ টপকান এর পর ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর মোহান্ত জোসেফ রাৎসিঙ্গের (পোপ হিসেবে ছদ্মনামের ইংরেজি রূপ ষোড়শ বেনেডিক্ট/Benedict XVI) ২০০৬ সালে এক ইতালিয়ান কার্ডিনালকে সরিয়ে মৌলবাদী ওপুস দেইএর (Opus Dei) ঘনিষ্ঠ বংশপরিচয়ে গোয়ার ভারতীয় মুম্বইএর পূর্বতন আর্চবিশপ আইভান ডায়াসকে জনগোষ্ঠীকে সুভাষিতে দীক্ষিত করার সংসদের’ (Congregation for the Evangelization of Peoples অর্থাৎ অখ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার সংসদের) অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করেন ৷ বুঝতে পারি এ সমস্তই নয়াঔপনিবেশিকতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত পশ্চিমি খ্রিস্টধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের রণকৌশলের অংশমাত্র ৷

টীকা

. রণকৌশল: খ্রিস্টধর্মের প্রচারের অনুষঙ্গে যুদ্ধ, ‘সেনাবাহিনী, ‘সাম্রাজ্য, ‘বিজয়, ‘রণকৌশল, ইত্যাদি হিংসাত্মক যুদ্ধ ও সংঘর্ষভিত্তিক শব্দ পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর শব্দসম্ভারের অপরিহার্য অঙ্গ এই শব্দগুলি আমাদের এই ধর্মের অন্তর্নিহিত অসহিষ্ণুতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় মিশনারি পাদ্রিদের বিভিন্ন রচনার শিরোনাম বা রচনা থেকে এই শব্দব্যবহারের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করছি:

Rev. S. B. Munger: The Conquest of India, 1845, Boston, Massachusetts Sabbath School Society.

John Henky Bakkows: The Christian Conquest of Asia,1899, New York, Charles Scribner’s Sons.

James Mills Thoburn: The Christian Conquest of India, 1906, Boston, Young People’s Missionary Movement

Mission Strategy Bulletin, Missions at Ohio Valley University

John L. Jr. Allen:Missionary strategy, National Catholic Reporter, Nov 3, 2000 .

David J. Hesselgrave: Scripture and Strategy, Evangelical Missiological Society Series, number 1, Published by William Carey Library, 1994, Pasadena, California

Chiang H. Ren: At War With the Armies of Darkness, Published by Institute for Christianity, 2001.

প্রসঙ্গত স্মরণীয় ১৮৭৮ সালে একটি খ্রিস্টধর্মীয় মিশনের নাম হয় Salvation Armyমুক্তি বাহিনী ৷

. জঁ মেসলিয়ে (১৬৬৪১৭২৯): এই ফরাসি পল্লীযাজকের (ক্যুরে/curé) মৃত্যুর পর তাঁর লেখা ‘ইষ্টপত্র’ (Testament) নামে অপ্রকাশিত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কয়েকটি কপি জ্ঞানালোকের দার্শনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ৷ ভলতের এই রচনার পরিমার্জিত নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করেন ৷ ভলতেরএর সম্পাদিত উক্ত সংস্করণে মেসলিয়ে খ্রিষ্টধর্মবিরোধী ঈশ্বরবাদীতে (theist) পরিণত পরিণত হন ─কেননা ভলতের ছিলেন তাই ৷ আবার নাস্তিক দলবাকও (Paul-Henri Thiry, baron d’Holbach, ১৭২৩১৭৮৯) মেসলিয়ের রচনার নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করেন ৷ তাবৎ ধর্মের বিরোধী এই নাস্তিক বস্তুবাদী দার্শনিকের রচনা প্রথম অবিকৃতভাবে প্রকাশিত হয় উনিশ শতকে ৷

. Je m’assure que si vous suivez bien les lumières naturelles de votre esprit, vous verrez au moins aussi bien, et aussi certainement que moi, que toutes les religions du monde ne sont que des inventions humaines, et que tout ce que votre religion vous enseigne, et vous oblige de croire, comme surnaturel et divin, n’est dans le fond qu’erreur, que mensonge, qu’illusion et imposture.

Jean Meslier: Testament.

. লুক্রিসিয়াস: টিটুস লুক্রিসিয়াস কারুস (. ৯৯. ৫৫সাপূ. .): ল্যাটিন ভাষার রোমান কবি তাঁর বিখ্যাত রচনা ইন্দ্রিয়বাদী এপিকুরিয়ান মহাকাব্য বস্তুপ্রকৃতি( De Rerum Natura )

. My own view on religion is that of Lucretius. I regard it as a disease born of fear and as a source of untold misery to the human race.

Bertrand Russell: Has Religion Made Useful Contributions to Civilization?, 1930.

. त्रयो वेदस्य कर्तारो भण्डधूर्तनिशाचराः चार्वाकदर्शनम सायनमाधवाचार्यप्रणीतः सर्वदर्शनसंग्रह

. এখানে আমি ধর্মের মৌলবাদ বা মৌলবাদী চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলিনি বা হীনমন্যতায় ভোগা আমরা পাশ্চাত্যের প্রতিধ্বনি করে মুসলমানদের প্রসঙ্গে কখনো সখনো মৌলবাদীবলি আবার সম্প্রতি পশ্চিমি (প্রধানত খ্রিস্টধর্মীয়) প্রচার মাধ্যমে হিন্দুদের সম্পর্কেও মৌলবাদীবিশেষণ ব্যবহার করছেন এমনকী কিছু দিশি ঔপনিবেশিতও তোতাস্বভাবে তার পুনরাবৃত্তি করছেন বস্তুত যেকোনো ধর্মের মতোই হিন্দুধর্মেরও ভিত্তি হল বিচারহীন বিশ্বাস ও যুক্তিহীন কুসংস্কার কিন্তু বহুঈশ্বর বা বহুত্ববাদী (শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, এককথায় যত মত তত পথবাদী), জুডাইজম, ইসলাম, বা খ্রিস্টধর্মের মতো প্রচারিত বা অনন্য গ্রন্থনির্ভর ধর্ম নয় গড়ে ওঠা বহু লিখন এবং মৌখিক ঐতিহ্য নির্ভর ধর্ম স্বভাবতই এই ধর্মমতের মৌলবলে কিছু নেই তাই হিন্দুদের মৌলবাদীহওয়া সম্ভব নয়

. অস্টাদশ শতকে যুক্তিবাদী দর্শনের আবির্ভাবে সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টধর্মী ইয়োরোপের কিছু বুদ্ধিজীবি খ্রিস্টমণ্ডলীর শাসন ও শাস্তির আতঙ্ক জয় করে জিশুর ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন শুরু করেন ৷ ‘দার্শনিক অভিধান’এর (Dictionnaire philosophique) খ্রিস্টধর্ম(Christianisme) নিবন্ধে লিখেছিলেন: কয়েকজন পণ্ডিত ঐতিহাসিক জোসেফএর রচনায় জিশুখ্রিস্টের কোনো চিহ্ন না দেখে তাঁদের বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কেননা সত্যিকারের পন্ডিতরা এবিষয়ে একমত যে জোসফএর ইতিহাসে যে ছোট অনুচ্ছেদে জিশুর কথা রয়েছে তা প্রক্ষিপ্ত ৷[Plusieurs savants ont marqué leur surprise de ne trouver dans l’historien Josèphe aucune trace de Jésus-Christ: car tous les vrais savants conviennent aujourd’hui que le petit passage où il en est question dans son histoire est interpolé.]দার্শনিক অভিধান’এর ১৭৬৯ সালের সংস্করণে ভলতের টীকা যোগ করেন:লোকে যাকে ভক্তিপূর্ণ জোচ্চুরি বলে অভিহিত করে সেরকম একটা জোচ্চুরির মাধ্যমে খ্রিস্টানরা জোসেফএর একটি অনুচ্ছেদকে. জালিয়াতি. করে ঢুকিয়ে দেয়[Les chrétiens, par une de ces fraudes qu’on appelle pieuses, falsifièrent grossièrement un passage de Josèphe…] ৷ এর পর থেকে জিশু বিতর্কে ঐতিহাসিকরা চার দলে বিভক্ত ৷ প্রথম দলে রয়েছেন ঝামেলা এড়ানোর দল, তাঁরা খ্রিস্টধর্মবিশ্বাসী তথা খ্রিস্টমণ্ডলীকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে চান না, চুপ করে থাকেন ৷ দ্বিতীয় দলে রয়েছেন খ্রিস্টধর্মীয় ঐতিহ্যে লালিত খ্রিস্টধর্মবিশ্বাসী ঐতিহাসিকরা, এঁরা ঐতিহাসিক প্রমাণের সাক্ষ্যকে কোনো গুরুত্ব দেন না, তথাকথিত সুসমাচারকে আপ্তবাক্য জ্ঞানে জিশুর ঐতিহাসিক জীবন বলে প্রচার করেন ৷ তৃতীয় দলে রয়েছেন হ্যাঁ বা নার মাঝামাঝি মধ্যপন্থীরা ৷ তাঁদের মতে জিশু বলে কেউ একজন ছিলেন তবে খ্রিস্টধর্মের জিশু সুসমাচার আর ধর্মতাত্ত্বিকদের নির্মাণ ৷ চতুর্থ দলে রয়েছেন যুক্তিবাদীরা, ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাবের ভিত্তিতে, বাইবেলের নব বিধানের বিভিন্ন রচনার মধ্যে অসঙ্গতির বিচার করে তাঁরা মনে করেন জিশুর অস্তিত্ব অনৈতিহাসিক, বিভিন্ন মিথের সমাহার তথা প্রচারক পল ও পরবর্তী খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রচারকৌশলের সৃষ্টি ৷ ১৯২৭ সালে ‘আমি কেন খ্রিস্টান নই?’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় বার্টান্ড রাসেল বলেন: খ্রিস্ট কখনো আদৌ বর্তমান ছিলেন কিনা তা ঐতিহাসিকভাবে যথেষ্ট সন্দেহজনক আর তিনি বর্তমান থেকে থাকলেও তাঁর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা(Historically it is quite doubtful whether Christ ever existed at all, and if He did we do not know anything about him…Bertrand Russell:Why I Am Not A Christian, a lecture on March 6, 1927)

. ২৫এ ডিসেম্বরকে জিশুর জন্মদিন বলে ধরে নিয়ে খ্রিস্টানরা, এমনকী আমাদের দেশের অখ্রিস্টানরাও খ্রিসমাস উৎসব পালন করে কিন্তু উক্ত দিনটি কোনো অর্থেই জিশুর জন্মদিন হতে পারে না আসলে সারা রোমান সাম্রাজ্যে সূর্যের মকরসংক্রান্তি বা দক্ষিণায়নের কয়েকদিন পর পারস্য থেকে আসা সূর্যদেবতা মিথ্রের জন্মোৎসব পালন করা হত রোমে এর সঙ্গে যুক্ত হয় শনির উৎসব অখ্রিস্টানদের উৎসবকে প্রভাবহীন করার জন্য সাধারণ অব্দের তৃতীয়চতুর্থ শতকে খ্রিস্টমণ্ডলী ২৫এ ডিসেম্বরকে জিশুর জন্মদিন বলে ঘোষণা করে আর জিশুর জন্মোৎসবের অনুষ্ঠান ত্রয়োদশ শতকে খ্রিস্টধর্মালম্বীদের মধ্যে ব্যাপ্তি লাভ করে

অষ্টম শতক পর্যন্ত পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা রোমান বর্ষগণনা ব্যবহার করত ৫২৫ সাধারণ অব্দে সিথীয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ডিওনিসিয়াস এগজিগুস খ্রিস্টীয় উৎসব ইস্টারের দিনক্ষণ গণনা করার জন্য ৭৫৩ রোমান অব্দের ২৫এ ডিসেম্বরকে জিশুর তথাকথিত জন্মসাল ও জন্মদিন হিসেবে নির্দেশ করেন এবং ঐ বছরকে খ্রিস্টাব্দ (আমাদের ত্রাতা জিশু খ্রিস্টের বছর/ Anni Domini Nostri Jesu Christi) ০১ হিসেবে চিহ্নিত করেন খ্রিস্টমণ্ডলী এই গণনা অনুমোদন করেন সম্রাট শার্লমাইনের সময়ে ইয়োরোপ ভূখণ্ডে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টাব্দের গণনা প্রবর্তিত হয় পরবর্তীকালে জিশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্বে বিশ্বাসী পণ্ডিতরা সুসমাচারের সাক্ষ্য অনুসারে স্থির করেন যে জিশুর জন্মসাল ০১ সাধারণ অব্দ হতে পারেনা তাঁদের মতে এই জন্মসাল ৭ বা ০৬ সাধারণ পূর্বাব্দ অথবা ০৬ সাধারণ অব্দ

. কুসংস্কার’ শব্দটি ইংরেজি superstition শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ৷সংসদ বাংলা অভিধানবঙ্গীয় শব্দকোষঅনুসারে কুসংস্কার শব্দের অর্থ হল:

বি. যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা বা ধর্মবিশ্বাস, গোঁড়ামি, supestition. [সং. কু + সংস্কার]…[সংসদ বাংলা অভিধান]

বি. . কুসিত সংস্কার. ধর্মে অন্ধ বা যুক্তিহীন বিশ্বাস; গোঁড়ামি ৷…[বঙ্গীয় শব্দকোষ] r

ইংরেজি শর্টার অক্সফোর্ড(ShorterOxford English Dictionary)অনুসারে superstition শব্দের অন্যতম অর্থ:

2. An irrational religious system; a religion regarded as false or pagan; a ceremony or observance of such a religion. Now rare or obsolete.

কোনো অযৌক্তিক ধর্মীয় তন্ত্র; ভ্রান্ত বা অখ্রিস্টীয় বলে বিবেচিত ধর্ম; এরূপ ধর্মের কোনো অনুষ্ঠান ৷ [এই অর্থে ব্যবহার এখন প্রায় দেখা যায় না বা পুরনো ৷

ফরাসি অভিধান Le Petit Robert ‘superstition’ (স্যুপেরস্তিসিয়োঁ) শব্দের আদি অর্থ উপস্থাপিত করেছে:

religion des idolâtres, culte des faux dieux (পৌত্তলিকদের ধর্ম, ভুয়ো দেবতাদের পুজো)

উপর্যুক্ত অর্থে ভারতীয়দের অখ্রিস্টান ধর্ম বা তাবৎ ধর্মাচারকে যাঁরা কুসংস্কার বলে অভিযুক্ত করেছেন সেই ইয়োরোপীয়দের অসংখ্য মন্তব্যের দুএকটা উদ্ধৃত করছি:

) যদিও ভারতে ইংল্যান্ডের খ্রিস্টমণ্ডলী তার প্রভাব বিস্তার করুক সব দিক থেকে এটাই আমার পছন্দসই ছিল তবু বাইবেলএর মূল মতবাদে বিশ্বাস করে খ্রিস্টধর্মের এরকম যেকোনো রূপ হিন্দুধর্মের অমার্জিত কুসংস্কারের চেয়ে যে ভালো হবে এ নিয়ে আমার মনে কখনো কোনো প্রশ্ন জাগে নি

চার্লস গ্র্যান্ট, কলকাতার শ্রদ্ধেয় বিশপকে লেখা চিঠি, লন্ডন, অগাস্ট ১৮১৭ হেনরি মরিস: চার্লস গ্র্যান্টএর জীবন, লন্ডন: জন মুরে, ১৯০৪, পৃ. ৩৩৮

[Although I would, on every account, have preferred the exertions of the Church of England in India, yet I could never make it a question whether any form of Christianity which held the essential doctrines of the Bible would not be better there than the gross superstitions of Hindooism. ─Charles Grant to the Right Rev. the Lord Bishop of Calcutta, London, August 1817.

Henry Morris: The Life of Charles Grant, London: John Murray, Albermarle Street W, 1904, P338.]

) …আমরা দেখেছি যে মনুষ্যজাতির যেকোনো অংশকে কখনো নাকাল আর নিম্নগামী করেনি এরকম সবচেয়ে প্রকাণ্ড আর যন্ত্রণাদায়ক কুসংস্কারের ওপর গড়ে তোলা একটা পুরোহিতদের চাতুর্যের তন্ত্র তাদের শরীরের চেয়েও আরো অসহ্যভাবে তাদের মনকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে; সংক্ষেপে বলতে গেলে ঐ স্বৈরাচার আর পুরোহিতদের চাতুর্য একসঙ্গে নিলে, হিন্দুরা হল মনুষ্যজাতির সবচেয়ে ক্রীতদাসে পরিণত মানুষ ৷

জেমস মিল: ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ সংস্করণ, এইচ. এইচ. উইলসন সম্পাদিত, লন্ডন, ১৮৪০, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ.১৮ ৷

[…we have seen that by a system of priestcraft, built upon the most enormous and tormenting superstition that ever harassed and degraded any portion of mankind, their minds were enchained more intolerably than their bodies; in short that, despotism and priestcraft taken together, the Hindus, in mind and body, were the most enslaved portion of the human race.

James Mill: The History of British India, Vol. II, Fourth edition, Edited by H. H. Wilson, London: James Madden & Co., 1840, Vol. II., p18.]

) ব্রাহ্মণ্য পুরাণ এমনই উদ্ভট যে তাকে সত্য বলে যে গ্রহণ করে এরকম প্রতিটি মনকে তা নিম্নগামী করেসমগ্র হিন্দু দেবমণ্ডলীর মধ্যে প্রাচীন গ্রিসের মন্দিরে যেসব সুন্দর আর মহিমময় রূপ দণ্ডায়মান থাকত তার মতো দেখতে কোনো কিছু দেখতে চাইলে আপনারা হতাশ হবেন ৷ সব কিছুই বীভৎস, আর কদাকার, আর ইতর ৷ এই কুসংস্কার যেরকম তাবৎ কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে অযৌক্তিক আর তাবৎ কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে অর্মাজিত তেমনই তাবৎ কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে নীতিবিগর্হিত ৷ কদাচারের প্রতীক গণউপাসনার বস্তু ৷ কদাচারের অনুষ্ঠান গণউপাসনার অনুষ্ঠান ৷

টি. বি. মেকলে: সোমনাথের প্রবেশদ্বার, ১৮৪৩ সলের ৯ই মার্চ, হাউজ অভ কমনস্

[The Brahminical mythology is so absurd that it necessarily debases every mind which receives it as truth… Through the whole Hindoo Pantheon you will look in vain for anything resembling those beautiful and majestic forms which stood in the shrines of ancient Greece. All is hideous, and grotesque, and ignoble. As this superstition is of all superstitions the most irrational, and of all superstitions the most inelegant, so is it of all superstitions the most immoral. Emblems of vice are objects of public worship. Acts of vice are acts of public worship.

T. B. Macaulay: The Gates of Somnauth, a speech delivered in the House of Commons on the 9th of March, 1843.]

১০.As a matter of fact, it is only to monotheism that intolerance is essential; an only god is by his nature a jealous god, who can, allow no other god to exist. Polytheistic gods, on the other hand, are naturally tolrent; they live and let live;…

Arthur Schopenhauer: Religion: A Dialogue And Other Essays, selected and translated by T. Bailey Saunders, 4th edition, London, Swan Sonneschellan & Co., 1893. p.49.

১১. ...religious intolerance, which was foreign to antiquity…was inevitably born with the belief in one God.

-Sigmund Freud: Moses and Monotheism, (Der Mann Moses und die monotheistische Religion, 1939), Translated by Katherine Jones, Published by The Hogarth Press and Institute of Psycho-Analysis, 1939, P35.

১২. Au nom de Dieu, l’histoire témoigne, les trois monothéismes font couler pendant des siècles d’incroyables fleuves de sang ! Des guerres, des expéditions punitives, des massacres, des assassinats, du colonialisme, des ethnocides, des génocides, des Croisades, des Inquisitions, aujourd’hui l’hyper-terrorisme planétaire…

Michel ONFRAY : Traité d’athéologie (p.90 ), Paris , Bernard Grasset , 2005

১৩. With the Church throughout the world, the Church in Asia will cross the threshold of the Third Christian Millennium marvelling at all that God has worked from those beginnings until now, and strong in the knowledge that “just as in the first millennium the Cross was planted on the soil of Europe, and in the second on that of the Americas and Africa, we can pray that in the Third Christian Millennium a great harvest of faith will be reaped in this vast and vital continent”.

The Marvel of God’s Plan in Asia [1] 

Ecclesia in Asia – John Paul II – Post-Synodal Apostolic …

http://www.vatican.va/…/john_paul_ii/apost_exhortations/documents/hf_jp-ii_exh_06111999_ecclesia-in-asia_en.html

1) John Paul II, Address to the Sixth Plenary Assembly of the Federation of Asian Bishops’ Conferences (FABC), Manila (15 January 1995), 11: Insegnamenti

. খ্রিস্টধর্মপ্রচারের কালিমালিপ্ত ইতিহাস

উত্তর ইয়োরোপে সাতশ বছরের খ্রিস্টধর্ম প্রসারের সংক্ষিপ্তসার হিসেবে বলা যায় যে ঐ কর্মকাণ্ডটি প্রধানত সংঘটিত হয়েছিল তরবারির সাহায্যে আর তা সংঘটিত হয়েছিল প্রধানত সেসব রাজা আর স্বৈরাচারীদের স্বার্থে যারা তাদের নিজেদের প্রজামণ্ডলীর প্রতিরোধের বিরুদ্ধে ঐ কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছিল আর প্রজারা খ্রিস্টমণ্ডলীকে প্রত্যক্ষ করেছিল তাদের দমিয়ে রাখার একটা উপায় হিসেবে ৷ এক কথায় বলা যায় খ্রিস্টধর্ম ছিল প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মতোই এক তরবারির ধর্ম ৷ ১২২৩ সালে মোঙ্গলরা যখন রাশিয়ার একটি অংশ জয় করে তখন তারা খ্রিস্টানদের শুধু পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতাই দেয় নি যাজকদের তাবৎ কর থেকে রেহাই দিয়েছিল আর ঠিক একইভাবে তুর্কিরা বুলগারিয়ানদের তাদের ধর্মবিশ্বাস, ভূসম্পত্তি আর স্থানীয় বিধিবিধান রক্ষা করতে দিয়েছিল ৷ খ্রিস্টধর্ম সহিষ্ণুতার একরকম কোনো নিদর্শন দেখায় নি; অখ্রিস্টান স্লাভ আর প্রুসীয়দের ভূসম্পত্তি জার্মান বিজেতাদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়েছিল ৷ হরেদরে বলা যায় বিধর্মীদের কখনোই বিশ্বাস উত্পাদন করানো হয় নি, যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয় নি, কখনোই নতুন মতবাদের আবেদনে মন জয় করা হয় নি: হয় রাজারা তাদের গবাদি পশুর দলের মতো খ্রিস্টমণ্ডলীতে স্থানান্তরিত করেছে নয়ত কয়েক প্রজন্মের প্রতিরোধ আর দলে দলে হত্যাকাণ্ডের পর বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা হয়েছে ৷ জার্মান বিজয়ের পরে দীর্ঘকাল ধরে দেশের বাইরে কোনো স্লাভকে দেখা গেলে তাকে তত্ক্ষণাৎ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা যেত অথবা যেকোনো খ্রিস্টান তাকে বন্য জন্তুর মতো হত্যা করতে পারত ৷’জন এম. রবার্টসন: খ্রিস্টধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, লন্ডন, ১৯০২, পৃ.২১৫৷

ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর ভূতপূর্ব মোহান্ত কারল ভোইতিলার ভাষণের ওপরে উদ্ধৃত অংশের মধ্যে ‘প্রথম সহস্রাব্দে ইয়োরোপের ভূমিতে ক্রস রোপিত হয়েছিল’ বাক্যাংশ আমাদের ইয়োরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কালিমালিপ্ত রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ৷ মনে পড়ে প্রথম কনস্টেনটাইন থেকে শার্লমাইন পর্যন্ত ইয়োরোপীয় সম্রাটদের হয় বাইবেল নয় মৃত্যুদণ্ড বেছে নেওয়ার বিধানের মাধ্যমে অখ্রিস্টান ইয়োরোপীয়দের খ্রিস্টধর্মান্তরিত করার ইতিবৃত্ত, স্মরণ করিয়ে দেয় ‘মূর্তিউপাসক’ বলে অভিহিত করে যারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেনি তাদের প্রতি অত্যাচার, তাদের মন্দিরকে ধ্বংস করা বা গির্জেয় পরিণত করার ইতিহাস, মনে পড়ে আলেকজান্দ্রিয়ার দার্শনিক তথা বিজ্ঞানী মহিলা হাপাশিয়াকে (ইপাতিয়াকে) নৃশংসভাবে খুন করা১৫, ঐ শহরের সেরাপিয়াম মন্দির ও গ্রন্থাগার ধ্বংস করা, রোমের দেবী ভেস্তার মন্দিরের চিরন্তন অগ্নিশিখা নিবিয়ে দিয়ে ঐ মন্দিরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া, অ্যাথেন্সএ দেবী আথিনার মন্দির পার্থেননকে গির্জেয় রূপান্তর, গ্রিসে পিথিয়ান (ডেলফিক) এবং অলিম্পিক ক্রীড়াপ্রতিয়োগিতার ইতি ঘোষণা করা, অ্যাথেন্সএর ঐতিহ্যমণ্ডিত দার্শনিক মহাবিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া, ইহুদিদের বিতাড়ন ও তাদের ওপর নানা রকম অত্যাচার, ম্যানিকিয়ানদের হত্যা, এমনকী খ্রিস্টধর্মের কর্তৃপক্ষস্বীকৃত মতবাদের সামান্যতম বিরোধী খ্রিস্টধর্মী ব্যক্তি বা এরিয়ান, নোভেশিয়ানিস্ট, ডোনাটিস্ট প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি অসংখ্য দৃষ্টান্তের কথা)

এর পর দ্বিতীয় সহস্রাব্দের আরম্ভে এই ধর্মান্ধ হিংস্রতা (খ্রিস্টীয় ‘প্রেম’!) একদিকে ইয়োরোপের সীমানা পেরিয়ে বুকে ক্রসচিহ্ন এঁটে মুসলমান আর ইহুদিদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে (ক্রুসেড = খ্রিস্টীয় ‘জিহাদ’) বেরিয়ে পড়ে আর অন্যদিকে ইয়োরোপের মধ্যে ফ্রান্সের লঁগদক প্রদেশে দ্বাদশ শতকের শুরুতে হাজার হাজার ক্যাথারকে হত্যা করে ধর্মীয় বিচারের (ইনকুইজশনএর) সূত্রপাত করে ৷ ধর্মীয় বিচারের নামে হাজার হাজার মানুষকে নির্যাতন ও পুড়িয়ে মারা, শতবর্ষের যুদ্ধ, তিরিশ বছরের যুদ্ধ, তিনশ বছর ধরে ডাইনি আখ্যা দিয়ে তিন লক্ষ নিরপরাধ নারীকে খুন করা ৷ ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নামে ইয়োরোপের মধ্যে এই অব্যাহত রক্তপাতের পাশাপাশি (পঞ্চদশ শতক থেকে) শুরু হয় ইয়োরোপ মহাদেশের বাইরে বলপ্রয়োগে খ্রিস্টীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ৷ ইয়োরোপের খ্রিস্টমণ্ডলী ও খ্রিস্টীয় শাসকশ্রেণী এই প্রয়াসে সমবেত ভাবে অংশগ্রহণ করে ৷ ১৪১৫ সালে পর্তুগালের রাজা প্রথম জন (জোআঁও) ইসলামের প্রভাব ও প্রসার রোধ করার উদ্দেশ্যে মরক্কোর উত্তর অংশে ভূমধ্যসাগরতীরবর্তী সিউটা শহর দখল করেন ৷ এর পর ১৪৫২ সালে রোমের ক্যাথলিক ধর্মগুরু তোম্মাসো পারেনতুচেল্লি (Tommaso Parentucelli, ১৩৯৭১৪৫৫, পোপ হিসেবে ছদ্মনাম পঞ্চম নিকোলাস/Nicholas V, পোপত্ব: ১৪৪৭১৪৫৫) দুম দিভের্সাস (bull Dum Diversas) নামে ফতোয়ায় পর্তুগালের ক্যাথলিক রাজা পঞ্চম আলফোন্সোকে তাবৎ মুসলমান ও অখ্রিস্টানদের আক্রমণ, অধীনস্ত ও বংশপরম্পরায় ক্রীতদাসে পরিণত করার ধর্মীয় অনুমোদন দেন১৬৷ এর পর একই পোপএর ১৪৫৫ সালে রোমানুস পন্তিফেক্স ফতোয়ায় (bull Romanus Pontifex) ইতিপূর্বের ফতোয়ার ঘোষণাকে সমর্থন করে বিশেষভাবে আফ্রিকার মানুষদের অধীনস্ত ক্রীতদাসে পরিণত করার ঢালাও ধর্মীয় অনুমোদন দেওয়া হয়১৭ ৷ ১৪৮১ সালে পোপ চতুর্থ সিক্টাসও তাঁর এক ফতোয়ায় এই অনুমোদনকে সমর্থন করেন ৷ কলম্বাস কর্তৃক ইয়োরোপীয়দের জাহাজে আমেরিকায় যাওয়ার পথ আবিস্কারের পর ১৪৯৩ সালে স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত কুখ্যাততম ক্যাথলিক ধর্মগুরু ষষ্ঠ আলেকজান্ডার এক ফতোয়ায় (Inter caetera) স্পেনের রাজদম্পতি ফার্ডানেন্ড ও ইজাবেলকে ইয়োরপীয়দের কাছে ইতিপূর্বে অজ্ঞাত ভূখণ্ডের (অতএব ইয়োরোপকেন্দ্রিক চিন্তায় ‘নতুন জগতের’) অধিকার তথা তার অধিবাসীদের খ্রিস্টধর্মান্তরিত করার দায়িত্ব সমর্পণ করেন ৷ আরব মুর ও ইহুদিদের নিপীড়ন, হত্যা এবং বিতারণের ফলে খ্রিস্টধর্মীয়দের কাছে স্পেনের এই রাজদম্পতি ছিলেন খ্যাতিমান, পোপ এঁদের এই মহৎ’ কর্মের স্বীকৃতিতে ক্যাথলিক’ (অর্থাৎ আদর্শ ‘ক্যাথলিক’) উপাধি দান করেন

এর পর পোপের পরামর্শ অনুসারে স্পেন ও পর্তুগালের ধর্মান্ধ রাজারা কালনেমির লঙ্কা ভাগের মতো অখ্রিস্টান জগতকে দুভাগে ভাগ করে নেন ৷ ধীরে ধীরে পশ্চিম ইয়োরোপের ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট দেশগুলি — ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক — বাইবেল আর কামান নিয়ে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের দৌড়ে নেমে পড়ে ৷ ১৫৭৮ সালে ইংল্যান্ডের রানি তথা অ্যাংলিকান খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রধান প্রথম এলিজাবেথ নাবিক হাম্ফ্রে গিলবার্টকে ‘কোনো খ্রিস্টান রাজা বা জনগোষ্ঠীর দ্বারা অধিকৃত নয় এমন তাবৎ সুদূর ও বর্বর দেশ দখল করার’১৮ অনুমতি দেন ৷ মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অন্যের স্বাধীনতা হরণ, ছলেবলে কৌশলে ধর্মান্তর, দাসব্যবসায়, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কয়েক কোটি আদি অধিবাসী এবং আফ্রিকানকে হত্যার মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে কারল ভোইতিলাউক্ত ‘দ্বিতীয় সহস্রাব্দে দুই আমেরিকা আর আফ্রিকার’ ‘মাটিতে ক্রস রোপিত’ হওয়ার অর্থাৎ ইয়োরোপীয়খ্রিস্টধর্মীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের পবিত্র ইতিহাস

এবার তৃতীয় সহস্রাব্দে খ্রিস্টমণ্ডলীর অভিযান ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রসারের ঘোষিত লক্ষ্য হল এশিয়া ৷ ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রধান কারল ভোইতিলার ওপরে উদ্ধৃত ঘোষণা, কৈশোরে নাৎসি স্বেচ্ছাসেবক, পূর্বতন গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর কার্ডিনাল থেকে পদোন্নত ক্যাথলিক মোহান্ত জোজেফ রাসিঙ্গেরএর (বর্তমান পোপ হিসেবে ছদ্মনাম ষোড়শ বেনেডিক্ট) বাচন, ইভাঞ্জেলিস্ট, সাদার্ন ব্যাপটিস্ট, গসপেল ফর এশিয়া ইত্যাদি অসংখ্য প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রচার, এমনকি গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টমণ্ডলীর কর্মসূচিতেও এই ঘোষিত লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য নিরন্তর বিভিন্ন সক্রিয় প্রয়াস ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায় ৷ কারল ভোইতিলার বাচনের ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণ করে বলা যায় আসলে গত চারশ বছর ধরে নানা কৌশল অবলম্বন করেও খ্রিস্টমণ্ডলীর বিভিন্ন শাখা অন্য মহাদেশগুলির তুলনায় এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে ততটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি ৷ হ্যাঁ, ইয়োরোপ, দুই আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় তাবৎ প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস আর তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে খ্রিস্টমণ্ডলীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, আফ্রিকায়ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্মরণাতীত কালের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে ইসলামের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খ্রিস্টমণ্ডলীর আধিপত্য কায়েম হয়েছে। অথচ এশিয়া মহাদেশে আজো (হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ইত্যাদি) অন্য ধর্মের তুলনায় খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য অপ্রতিষ্ঠিত ৷ তাই আহত আত্মগৌরব পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর উদ্দেশ্য যে করেই হোক এশিয়া মহাদেশ জয় করতে হবে

এশিয়ায় কম্যুনিস্ট চিন, অর্থোডক্স খ্রিস্টান রাষ্ট্র আর্মেনিয়া, কম্যুনিস্ট ভিয়েৎনাম এবং তাবৎ ঐস্লামিক রাষ্ট্রে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তর বেআইনি অপরাধ ৷ ফলে কারল ভোইতিলা কথিত খ্রিস্টীয় ‘ঈশ্বরের’ ঘাড়ে চাপানো ‘অত্যাশ্চর্য পরিকল্পনা’ অনুযায়ী সেখানে বিভিন্ন খ্রিস্টমণ্ডলীর ধর্মের যাত্রাপালা সম্ভব নয়। তাই এশিয়াকে ধর্মান্তরিত করার ধান্ধায় ভারত হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের হরেক খ্রিস্টমণ্ডলীর সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতার প্রধান লক্ষ্যভূমি ৷ ইতিপূর্বে খ্রিস্টধর্মান্তর বা খ্রিস্টমণ্ডলীর সাম্রাজ্যবাদী ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতা ছিল পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ঔপনিবেশিক বিস্তারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ইয়োরোপের দেশগুলির ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মপ্রচার এবং ধর্মান্তরীকরণ ছিল ঔপনিবেশিকতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ৷ ভারতীয়দের অসন্তোষ তথা সমবেত বিপজ্জনক বিরোধিতার আশঙ্কায় ইংল্যান্ড বিশেষভাবে ভারতে ঔপনিবেশিকতার ক্ষেত্রে ধর্মপ্রচার এবং ধর্মান্তরীকরণ কিছুটা আড়ালে রাখে ইংরেজ ঔপনিবেশক শাসকরা প্রত্যক্ষ ভাবে খ্রিস্টধর্মপ্রচার , ধর্মান্তরীকরণের প্রতি পক্ষপাত না দেখালেও পরোক্ষ ভাবে এদেশে ঔপনিবেশিকতার সহায়ক খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন এছাড়া কম্প্রাদর শ্রেণীর সৃষ্টি ঔপনিবেশিক ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও তার পরোক্ষ লক্ষ্য ছিল খ্রিস্টধর্মপ্রচার তথা ধর্মান্তরীকরণ১৯ বস্তুত খ্রিস্টমণ্ডলীর সাম্রাজ্যবাদী ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতা ছিল পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব তথা শাসনের পরিপোষক ৷ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্মান্তরিত দেশীয় খ্রিস্টানদের ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সাধারণভাবে অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়, প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মান্তরিত দেশীয় খ্রিস্টানরা ধর্মীয় ভিত্তিতে একই সঙ্গে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক থেকে পাশ্চাত্যের বশংবদ বোধ করেছে — পাশ্চাত্য শাসনের বিরোধিতার বিপক্ষে অবস্থান করেছে ৷ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্মান্তরিত দেশীয় খ্রিস্টানদের অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়, প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মান্তরিত দেশীয় খ্রিস্টানরা ধর্মীয় ভিত্তিতে একই সঙ্গে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক থেকে পাশ্চাত্যের বশংবদ বোধ করেছে — পাশ্চাত্য শাসনের বিরোধিতার বিপক্ষে অবস্থান করেছে ৷ প্রাতঃস্মরণীয় ‘পঞ্চগোরার’২২ অন্যতম ব্যাপ্টিস্ট পাদ্রি জোশুয়া মার্শম্যান বলেছিলেন:

আমি এ ব্যাপারেও সচেতন যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধি আমার চেয়ে অধিক উৎসাহ সহ কামনা করে এরকম কেউ লিডেনহল স্ট্রিট বা এমনকী সারা ব্রিটেনেও নেইআর আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে ভারতে বৃটিশ শাসন চিরস্থায়ী করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়গুলির একটা হবে শান্ত আর নিঃশব্দ, অথচ স্থির আর বিরামহীন ভাবে দেশীয়দের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের আলোর বিকীরণ ৷তাদের সত্যিকারের প্রাণদায়ক খ্রিস্টধর্ম দাও, তাহলে তুমি ওদের দেবে নতুন চরিত্র, তুমি সৃষ্টি করবে নতুন ধ্যানধারণা আর নতুন বন্ধন, মৃত্যুর চেয়েও দৃঢ় বন্ধনতাদের মনে খ্রিস্ট ধর্মের তাবৎ প্রভাবের কথা নাহয় বাদ দেওয়া গেল, ধর্মের ব্যাপারে ব্রিটিশের সঙ্গে একমত হওয়াটা প্রভাবের দিক থেকে একই জাতের অন্তর্গত হওয়ার সমতুল্য হবে আর তা অসচেতন অথচ জোরালোভাবে তাদের একই ব্রিটিশ স্বার্থের সঙ্গে জড়িত করবে ৷ প্রতিটি ধর্মান্তরিত হিন্দু বা মুসলমান নিজের স্বার্থ এবং নিরপত্তার কারণে অবশ্যম্ভাবীভাবে ব্রিটিশের আন্তরিক বন্ধু, কেননা তার অস্তিত্বই নির্ভর করছে ভারতে ব্রিটিশের সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের ওপর ৷ যেসব বন্ধন তাকে দৃঢ়ভাবে তার জাত আর ভুয়ো ধর্মের কুসংস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিল খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে সে শুধু সেগুলিই ছিন্ন করেনি, সে নিজের বিরুদ্ধে তার বন্ধুদের তথা দেশবাসীর ক্রোধের আগুন উদ্দীপ্ত করেছে এবং ভারতে ওদের কর্তৃত্ব লাভ করার ব্যাপারে তার আতঙ্কিত হওয়ার সংগত কারণ রয়েছে ৷ ফলত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিটি পদক্ষেপই তার নিজের তথা যা কিছু তার প্রিয় উভয়ের অস্তিত্ব বিপন্ন বলে মনে হবে ৷ খ্রিস্টধর্মের আংশিক অগ্রগতিতেও ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অনুকূলে কী যে জোরালো ভারসাম্য তৈরি হবে! ধরা যাক হিন্দুস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র পাঁচ লক্ষ মানুষ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে, আমাদের সঙ্গে মানসিকতা তথা স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ এবং ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাঁচ লক্ষ এরকম বন্ধুর মূল্য কেইবা পরিমাপ করতে পারে ৷ এই বিষয়ে পোপপন্থী শপথ করা যাজক বার্তেলোমেওর সাক্ষ্য শোনা যাক ৷ তাঁর ভ্রমণে রয়েছে, ‘মালাবার উপকূলে সদ্য ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা কোচিনে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সমর্থক এবং সব সময় ঐ কোম্পানিকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র গ্রহণ করতে প্রস্তুত ৷’ মূর্তিউপাসকরা এবং মুসলমানরা স্বভাবতই ইয়োরোপীয়দের শত্রু কারণ তাদের সঙ্গে ইয়োরোপীয়দের বাইরের চেহারায় বা আচারআচরণে কোনো সাদৃশ্য নেই ৷ সুতরাং ইংরেজরা যদি ভারতে খ্রিস্টানদের বন্ধুত্ব লাভের চেস্টা না করে তাহলে কার ওপর তারা নির্ভর করতে পারবে? কীভাবে তারা এই সুদূর দেশে তাদের অধিকার রক্ষা করতে পারবে? ওপরের এই আলোচনার মধ্যে কেন হায়দার আলি বা টিপু সুলতান ইংরেজদের এবং ত্রিবাঙ্কুরের রাজার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারল না তার কারণগুলির একটা খুঁজে পাওয়া যাবে ৷ যাদের হায়দার আর তার ছেলে সর্বত্র নির্যাতন করত সেখানে বাস করা সেই বিরাট সংখ্যক খ্রিস্টানরা সব সময় ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছে ৷ — ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার উন্নতিতে খ্রিস্টধর্মের উপকার’ পৃষ্ঠা ৬২০

টীকা

১৪.The summary of seven hundred years of Christian expansion in northern Europe is that the work was in the main done by the sword, in the interests of kings and tyrants, who supported it, as against the resistance of their subjects, who saw in the church an instrument for their subjection. Christianity in short was as truly a religion of the sword as Islam. When the Mongols conquered part of Russia in 1223 they not only left the Christians full religious liberty but let the priests go untaxed ; and similarly the Turks left to the Bulgarians their faith, their lands, and their local laws. Christianity gave no such toleration; the lands of the heathen Slavs and Prussians being distributed among their German conquerors. The heathen, broadly speaking, were never persuaded, never convinced, never won by the appeal of the new doctrine: they were either transferred by their kings to the church like so many cattle or beaten down into submission after generations of resistance and massacre. For a long time after the German conquest any Slav found away from home was liable to be executed on the spot, or killed like a wild beast by any Christian who would.

John M. Robertson: A Short History of Christianity, London, 1902. p 215.

১৫. আলেকজান্দ্রিয়ার হাইপাসিয়া(গ্রিক ইপাতিয়া Υπατία, জন্ম ৩৫০ থেকে ৩৭০ সা. . – মৃত্যু ৪৫১ সা. .) হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বার্টান্ড রাসেল (Bertrand Russell) তাঁর পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস গ্রন্থে গিবন (Edward Gibbonএর The History of the Decline and Fall of the Roman Empire) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে আলেকজান্দ্রিয়ার প্যাট্রিয়ার্ক

সন্ত সিরিল ছিলেন ধর্মান্ধ অত্যুত্সাহের মানুষ তিনি তাঁর প্যট্রিয়ার্কের পদমর্যাদাকে আলেকজান্দ্রিয়ার বিরাট ইহুদি উপনিবেশকে খতম করার জন্য উত্তেজিত করার ব্যাপারে ব্যবহার করেছিলেন হাইপাশিয়ার জনতার হাতে নিগৃহীত হয়ে খুন হওয়াটাই হল তাঁর খ্যাতির কারণ হাইপাশিয়া ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত মহিলা যিনি ধর্মান্ধতার ঐ যুগে নয়াপ্লেটোনিক দর্শনের অনুরাগী ছিলেন আর অঙ্কশাস্ত্রের চর্চায় নিজের প্রতিভাকে নিয়োজিত করেছিলেন মহিলাকে ঘোড়ার গাড়ি থেকে টেনে নামানো হল, কাপড়চোপড় টেনে ছিঁড়ে তাঁকে নগ্ন করে দেওয়া হল, টেনে হেঁচড়ে ঢোকানো হল গির্জের মধ্যে, সেখানে বাইবেল তথা অনুশাসনপাঠক পিটার এবং নির্দয় একদল বর্বর তাকে জবাই করল: ধারালো ঝিনুক দিয়ে তার হার থেকে মাংস ছাড়িয়ে নেওয়া হল আর তার থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতপা আগুনের শিখায় অর্পণ করা হল [St. Cyrilwas a man of fanatical zeal. He used his position as patriarch to incite pogroms against the very large Jewish colony in Alexandria. His claim to fame is the lynching of Hypatia, a distinguished lady who, in an age of bigotry, adhered to the Neoplatonic philosophy and devoted her talents to mathematics. She was torn from her chariot, stripped naked, dragged to the church, and inhumanly butchered by the hands of Peter the Reader and a troop of savage and merciless fanatics: her flesh was scraped from her bones with sharp oyster-shells and her quivering limbs were delivered to the flames...Bertrand Russell: History of Western Philosophy, Page 342]

১৬. আমাদের ঈশ্বরনির্ধারিত ক্ষমতায় বর্তমান দলিলের দ্বারা আমরা আপনাদের সারাসেন ও মূর্তিউপাসক এবং অন্য যেকোনো (খ্রিস্টধর্মে) অবিশ্বাসী ও খ্রিস্টশত্রুরা যেখানেই তারা থাকুক না কেন তাদের তথা তাদের রাজ্য, জায়গিরদারি, তালুকদারি, খাসমহল জায়গাজমি, বাড়ি, গড়, তাদের যাকিছু স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আক্রমণ, তল্লাসি, অধিকার এবং অধীনস্ত করা এবং ব্যক্তি হিসেবে তাদের চিরকালীন ক্রীতদাসে পরিণত করার পূর্ণ এবং অবাধ অনুমতি মঞ্জুর করছি ৷

দুম দিভের্সাস ফতোয়া. ১৪৫২ ৷

[We grant you by these present documents, with our Apostolic Authority, full and free permission to invade, search out, capture, and subjugate the Saracens and pagans and any other unbelievers and enemies of Christ wherever they may be, as well as their kingdoms, duchies, counties, principalities, and other property […] and to reduce their persons into perpetual slavery

Bull Dum Diversas, by Pope Nicholas V, June 18, 1452].

১৭. …to invade, search out, capture, vanquish, and subdue all Saracens and pagans whatsoever, and other enemies of Christ wheresoever placed, and the kingdoms, dukedoms, principalities, dominions, possessions, and all movable and immovable goods whatsoever held and possessed by them and to reduce their persons to perpetual slavery…

– Bull Romanus Pontifex by Pope Nicholas V, January 8, 1455 to King Afonso V of Portugal.

১৮.It was in that year [1578] that Queen Elizabeth gave her royal authorisation to Sir Humphrey Gilbert, “to take possession of all remote and barbarous lands, unoccupied by any Christian prince or people.”

Our Empire’s Debt to Missions, The Duff Missionary Lecture, London: Hodder and Stroughton Limited, 1922, p1

১৯. ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ঔপনিবেশিক ইংরেজিশিক্ষার প্রকল্প পেশ করার দেড় বছর পর ১২ অক্টোবর মেকলে তাঁর বাবাকে একটি চিঠিতে লিখছেন:

আমাদের ইংরেজি স্কুলগুলোর দারুন শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে অবশ্য যারা চাইছে তাদের সবাইয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে কঠিন, কোনো কোনো জায়গায় অসম্ভব হয়ে উঠছে শুধু এক হুগলি সহরেই চোদ্দশ ছেলে ইংরেজি শিখছে. হিন্দুদের ওপর এই শিক্ষার প্রভাব বিপুল ইংরেজি শিক্ষা পেয়েছে এমন কোনো হিন্দুর কখনোই তার ধর্মের প্রতি আন্তরিক টান থাকে না তাদের মধ্যে কেউ কেউ নীতি হিসেবে তা পালন করে যায়, কিন্তু অনেকেই নিজেদের ঈশ্বরবাদী বলে ঘোষণা করে , আর কেউ কেউ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনাগুলি যদি অনুসরণ করে যাওয়া হয় তাহলে আজ থেকে তিরিশ বছর পর বাংলাদেশে সম্মানিত শ্রেণীর মধ্যে একজনও মূর্তিপূজক থাকবে না আর ধর্মান্তরীকরণের কোনো প্রয়াস ছাড়াই, ধর্মীয় স্বাধীনতায় এতটুকু হাত না দিয়েই, শুধুমাত্র জ্ঞান এবং অনুধ্যানের স্বাভাবিক চর্চার মাধ্যমেই এটা ঘটবে এই সম্ভাবনার কথা ভেবে আমার দারুণ আনন্দ হয়

Our English schools are flourishing wonderfully. We find it difficult, indeed, in some places impossible, to provide instruction for all who want it. At the single town of Hoogly fourteen hundred boys are learning English. The effect of this education on the Hindoos is prodigious. No Hindoo, who has received an English education, ever remains sincerely attached to his religion. Some continue to profess it as matter of policy ; but many profess themselves pure Deists, and some embrace Christianity. It is my firm belief that, if our plans of education are followed up, there will not be a single idolater among the respectable classes in Bengal thirty years hence. And this will be effected without any efforts to proselytise ; without the smallest interference with religious liberty ; merely by the natural operation of knowledge and reflection. I heartily rejoice in the prospect.

Calcutta: October 12, 1836.

454 LIFE AND LETTERS OF LORD MACAULAY. Vol I 456 LIFE AND LETTEES OF LORD MACAULAY.

২০. I am conscious too that no one in Leadenhall Street, nor even in Britain, more ardently wishes for the permanence and prosperity of the British empire in India than myself…and I am fully convinced that one of the most effectual means of perpetuating the British dominion in India will be the calm and silent, but steady and constant, diffusion of Christian light among the natives. Impart vital genuine Christianity to them, and you give them a new nature ; you create new ideas, and new attachments attachments stronger than death. But setting aside every effect of Christianity on their minds, their being of the same opinion with the British in matters of religion would be the same thing in effect as being of the same cast, and would insensibly, but powerfully, attach them to the same interest.Every converted Hindoo or Mussulman is necessarily the cordial friend of the British, on the ground of his own interest and security ; for on the continuance of their empire in India his very existence depends. By embracing Christianity he has not only dissolved all the ties which hold him firmly to his cast and superstition, but he has incensed his friends and countrymen against him, and has every thing to dread from their obtaining the ascendency in India. Hence every step which might be taken against the English must threaten the existence both of himself and all that are dear to him. What a powerful counterpoise in favor of the British government would be created in India, even by the partial progress of Christianity ! Say, that of the millions of Hindoostan, only five hundred thousand persons had embraced Christianity ; who can calculate the value of five hundred thousand such friends, thus united to us, both by inclination and interest, and scattered up and down throughout the British dominions in India 1 On this subject let the testimony of Bartelomeo, a professed papist, be heard, as you have it in his VoyageThe newly converted Christians on the coast of Malabar are the chief support of the Dutch East India Company at Cochin, and are always ready to take up arms in their defence. The Pagans and Mahometans are naturally enemies to Europeans, because they have no similarity to them either in their external appearance or in regard to their manners. If the English therefore do not endeavour to secure the friendship of the Christians in India ; on whom can they depend How can they hope to preserve their possessions in that remote country ? In the above considerations may be found one of the reasons why neither Hyder Ali nor Tippoo Sultan could maintain their ground against the English and the king of Travancore on the coast of Malabar. The great number of Christians residing there, whom Hyder and his son every where persecuted, always took part with the English.

Joshua Marshman: Advantages of Christianity in promoting the Establishment and prosperity of the British Government in India containing Remarks occasioned by Reading a Memoir on The Vellore Mutiny, London, Smith’s Printing Office, 1813, P6

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় দেশীয় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের ভূমিকার বিবরণ পাওয়া যায় আরো কিছু খ্রিস্টধর্মপ্রচারক পাদ্রির রচনায় আমরা আরো দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি:

দেশীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় যে শুধুমাত্র সাহসের সঙ্গে সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছিল তাই নয় তারা তাদের বিশ্বস্ততা ও আগ্রহের বিভিন্ন অটুট প্রমাণ দিয়েছিলউত্তর ভারতে মিশনারি সোসাইটির খ্রিস্টমণ্ডলীর তত্ত্বাবধানে সবচেয়ে বিস্তৃত মিশনগুলির একটা রয়েছে বাংলাদেশের কৃষ্ণনগরে ৷ মিরাট আর দিল্লিতে বিদ্রোহের এবং অন্যান্য স্থানে বিদ্রোহী মনোভাবের প্রকাশের খবর সেখানে দেশীয় খ্রিস্টানদের কাছে পৌঁছানো মাত্র তারা ব্যক্তিগতভাবে অথবা তাদের সম্পত্তি দিয়ে অথবা রাষ্ট্রের কাজে লাগতে পারে এরকম যে কোনো উপায়ে সরকারকে সাহায্য করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠল বারানসীতে খ্রিস্টমণ্ডলীর মিশনের খ্রিস্টানরা মিশনের বাড়ি তথা তাদের নিজেদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য তাদের সাহসী নায়ক রেভারেন্ড সি. বি. লেউপল্টএর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হল ৷ প্রচণ্ড বিপদের দিনে তারা তাদের প্রহরায় অবিচল থাকল

রেভারেন্ড এম.শেরিং: বিরাট বিদ্রোহের সময়ে ভারতীয় খ্রিস্টমণ্ডলী লন্ডন, জেমস্ নিসবেট এন্ড কোম্পানি, ১৮৫৯, পৃষ্টা ৩৩৯৩৪২

The native Christian community not only boldly placed itself on the side of the Government, but gave various and solid proofs of its fidelity and zeal… One of the most extensive missions in Northern India is that situated at Krishnaghur, in Bengal, under the superintendence of the Church Missionary Society. No sooner did the news of the revolt in Meerut and Delhi, and the mutinous spirit displayed in other places, reach the native Christians there, than they were eager to render assistance to the Government, either by their persons or their property, or in any way in which they might be of service to the State… In Benares, the Christians of the Church mission united together for the defence of the mission premises, and of their own lives and property, and under the leadership of their gallant chief, the Rev. C. B. Leupolt, remained steadfast at their post during the times of the greatest danger.

Rev. M. A. Sherring: The Indian –‒–─ Church during the Great Rebellion, London, James Nisbet and Co., 1859.

ভারতের যেসব জেলায় খ্রিস্টধর্ম একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, বিশেষভাবে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে সব কিছুই শান্ত ছিল, শুধুমাত্র যেখানে খ্রিস্টধর্মপ্রচারের কাজ এখনো আরম্ভের পর্যায়ে, সেই উত্তরপশ্চিম প্রদেশগুলি আর অযোধ্যা বিদ্রোহ শুরু করে ৷

যে প্রদেশটি এ সময়ে সম্পূর্ণ সুসমাচারের দীক্ষার বাইরে ছিল সেই অযোধ্যা বাদ দিয়ে সর্বত্রই বিদ্রোহ প্রায় পুরোটাই সিপাই বাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ৷ আর এই বাহিনীর সৈন্যেদের ইস্ট ইন্ডিয়া একান্ত দুঃখজনক সতর্কতার সঙ্গে সব রকমের মিশনারি প্রভাব থেকে দূরে নিশ্চিদ্রভাবে আবদ্ধ করে রেখেছিল! তাছাড়া যে প্রদেশটি খ্রিস্টধর্মীয় দৃঢ়চরিত্রের মানুষের বদলে খোলাখুলি আর প্রকাশ্যভাবে খ্রিস্টধর্মীয় নীতিতে শাসিত হয়েছিল সেই পাঞ্জাব শান্ত ছিল আর একা এত অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্রোহ দমন করার রসদ সরবরাহ করেছিল ৷ দেশীয় খ্রিস্টানরা সংখ্যায় খুবই কম হলেও নিজেদের সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত করেছিল ৷ আগ্রা দুর্গে বিপুল সংখ্যক ইংরেজ একসঙ্গে জমায়েত হয়েছিল, সেখানে দেশীয় খ্রিস্টানরা অবিলম্বে তাদের সেবায় ব্রতী হল ৷ সমস্ত বিধর্মী চাকররা পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের স্থান নিয়েছিল দেশীয় খ্রিস্টানরা আর তারা বিশ্বস্ত আর ভালোভাবে তাদের কাজ করেছিল ৷ দেশীয় খ্রিস্টানরা দুর্গের তাবৎ সরবরাহের কাজ করেছিল ৷ বিদ্রোহ শুরু হওয়ার চোদ্দ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে কৃষ্ণনগরের খ্রিস্টানরা কোনোরকম পুরস্কার বা অর্থমূল্য দাবী না করেই সৈন্য,পরিবহন অথবা তাদের সাধ্যের মধ্যে থাকা সবকিছু দিয়ে সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল ৷ বারাণসীর কাছে মির্জাপুর আর কলকাতার উত্তরে হুগলি জেলায় দেশীয় খ্রিস্টানদের নিয়ে গড়া পুলিশবাহিনীর চৌকিদারির সাহায্যে শান্তি রক্ষা করেছিল(তুল. হডজসন প্র্যাটএর পত্র, বালএর মিশনারি পত্রিকা, ১৮৫৬, পৃ.৩৬১)

জুলিয়াস রিখটের: ভারতে খ্রিস্টান মিশন, সিডনি এইচ মুর কর্তৃক অনূদিত, ফ্লেমিং এইচ রেভেল কম্পেনি, নিউ ইয়র্ক, ১৯০৮ ৷

In those districts of India where Christianity had become a power, and especially in the Presidency of Madras, everything remained peaceful; only the North-Western Provinces and Oudh, where mission work was still in its initial stages, rose in rebellion. With the solitary exception of Oudh, which at that time was wholly unevangelised, the Mutiny was confined almost entirely to the Sepoy Army, and its soldiers were precisely those whom the East India Company, with the most pathetic care, had always kept hermetically sealed from every kind of missionary influence! A comparatively large number of military chaplains and their families fell victims to the Mutiny. Furthermore the very province which had been openly and expressly governed in accordance with Christian principles and not with traditional policy by men of decided Christian character, the Punjab, remained quiet, and alone provided the means whereby the Mutiny was so quickly suppressed. The native Christian communities, feeble as their numbers were, proved themselves to be thoroughly trustworthy. In the fort at Agra, where large numbers of Englishmen were crowded together, the native Christians readily entered their service, filling the places of the heathen servants who had deserted almost to a man; and they served both faithfully and well. Native Christians worked the ordnance of the fortress. In Bengal, within fourteen days of the outbreak of the Mutiny, the Krishnagar Christians volunteered to support the Government with troops, the transport service, or anything else that lay in their power, without claiming any reward or pay. At Mirzapur, near Benares, and in the Hooghly district to the north of Calcutta, peace was preserved by police patrols composed of native Christians… (Cf. Hodgson Pratt’s Dispatch, Basle Missionary Magazine, 1856,p. 381.)

Julius Richter: History of Missions in India, translated by Sydney H. Moore, Fleming H, Revell Company, New York, 1908, pp. 206-207.

চিন্তা-ভাবনা ২

Cinta bhabna 2

চিন্তাভাবনা ২

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

পুষ্কর দাশগুপ্ত

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী(১৮৬৪১৯১৯) চনাসমগ্র ওলটাতে গিয়ে কয়েকটা প্রবন্ধ আরো একবার পড়ার ইচ্ছে হল। জানিনা আজকাল কেউ আর এসব প্রবন্ধ পড়ে কিনা। রামেন্দ্রসুন্দর ছিলেন রিপন কলেজের (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) পদার্থ ও রসায়ণবিদ্যার অধ্যাপক , পরে ওই কলেজের অধ্যক্ষ। অথচ বিজ্ঞান ছাড়াও কত বিষয়ে তিনি ভেবেছেন, লিখেছেন। চোখে পড়ল ধ্বনিবিচার” প্রবন্ধটি। ১৯০৭ সাধারণ অব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎপত্রিকায়” প্রকাশিত পরিবর্ধিত আকারে শব্দকথা” বইয়ে স্থান পায়। রামেন্দ্রসুন্দরের প্রতিপাদ্য ছিল:

প্রত্যেক ধ্বনিকাঠিন্য, তারল্য, কোমলতা, শূন্যগর্ভতা প্রভৃতি এক একটা বস্তুধর্মের সম্পর্ক রাখে ও সহকারিতা রাখে; এবং প্রত্যেক ধ্বনি শ্রুতিগত হইবামাত্র ঐ ঐ ধর্ম স্মরণ করায় বা ব্যঞ্জনা করে।”

প্রাচীন ভারতীয় কাব্যতত্ত্বের রীতি ও গুণবাদী প্রস্থানে ধ্বনিবিচারের সূত্রপাত লক্ষিত হলেও রামেন্দ্রসুন্দরের আলোচনা অনেক বিস্তারিত। বই হিসেবে শব্দকথা” বের হয় ১৯১৭ সাধারণ অব্দে। ভূমিকায় রামেন্দ্রসুন্দর লিখছেন যে তিনি ওই সময়ে (১৯১) Henry Bradley-The Making of Englishনামে একটি বই হাতে পেয়েছেন, যাতে ধ্বনিবিচার সম্পর্কে খুবই সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে। বস্তুত আমরা দেখেছি, ব্র্যাডলি পূর্বোক্ত বইয়ে ইংরজি ভাষার ধ্বন্যাত্মক উপাদান সম্পর্কে পাঁচ পৃষ্ঠা (পৃ.১৫৫১৫৯) ধরে কিছু কিছু মন্তব্য করেছেন ;রামেন্দ্রসুন্দরের বিস্তৃত আলোচনার সঙ্গে এর কোনো তুলনা হয় না। পাশ্চাত্যে ধ্বনিবিচার অর্থাৎ ধ্বনির ব্যঞ্জক চরিত্র সম্পর্কে ওই সময়ের একটিমাত্র উল্লেখযোগ্য রচনা আমাদের চোখে পড়েছে:মোরিস গ্রামোঁ:ফরাসি কবিতা। তার প্রকাশের উপায়, তার সুরসঙ্গতি” (Maurice Grammont: Le vers français. Ses moyens d’expression, son harmonie, ১৯০৪)মনস্তত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বে এ বিষয়ে গবেষণাআলোচনা শুরু হয় অনেক পরে। প্রাগ প্রস্থানের (Prague School) উত্তরাধিকার স্বীকার করে সাম্প্রতিক কালে শুরু হয়েছে “ধ্বনিশৈলীতত্ত্ব” (phonostylistics) তবে দুঃখের কথা পাশ্চাত্যের আগে রামেন্দ্রসুন্দর বাংলায় ধ্বনিশৈলীতত্ত্বের সূত্রপাত করলেও তাঁর পর এদেশে এ বিষয়ে তাঁর চিন্তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি।

এই বিজ্ঞানীর বাঙ্গালা ব্যাকরণ(১৯০১) প্রবন্ধটি আরেকবার পড়লাম, পড়লাম বাংলা পরিভাষা সম্পর্কে একাধিক রচনা (১৮৯৪১৯০৭), ইংরাজী শিক্ষার পরিণাম (১৮৯৫)

ভাষার নিয়ম ব্যাকরণকারের বৃদ্ধপিতামহগণের জন্মের বহু পূর্ব হইতে বর্তমান থাকে;তিনি সেইগুলি আবিষ্কার করিয়া অন্যকে দেখাইয়া দেন মাত্র। নিয়ম বাঁধার কথা উঠিতেই পারে না।

বর্তমান কালে বাঙ্গালা ব্যাকরণ নামে যে কয়েকখানি শিশুবোধক পুস্তক প্রচলিত আছে, তাহার কোনোখানিও প্রকৃত বাঙ্গালা ব্যাকরণ নহে। নহে, কেন না বাঙ্গালা ব্যাকরণই এখন নির্মিত হয় নাই, কোন্ ভবিষ্যতে হইবে তাহাও কেহ জানে না।

আমি বাঙ্গালা ব্যাকরণ নামে যে বিজ্ঞান শাস্ত্রের উল্লেখ করিতেছি তাহার উদ্দেশ্য ভাষা শেখান নহে । উহার উদ্দেশ্য নিজে শেখা:ভাষার ভিতরে কোথায় কি নিয়ম প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে , তাহাই আলোচনা দ্বারা আবিষ্কার করা।… (বাঙ্গালা ব্যাকরণ, ১৯০১)

১৯০১১৯০২ সালে বাংলাভাষার ব্যাকরণ সম্পর্কে বিতর্কের কথা মনে পড়ল । রামেন্দ্রসুন্দরের প্রবন্ধটি ওই বিতর্কের অংশ। মনে পড়ল এ বিষয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত সভায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বাবা দার্শনিক হীরেন্দ্রনাথ দত্তের উক্তি: ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করা ব্যাকরণের উদ্দেশ্য নয় —ভাষার বিদ্যমান অবস্থা বুঝাইয়া দেওয়াই ব্যাকরণের কার্য।

বাংলা পরিভাষার প্রয়োজন সম্পর্কে রামেন্দ্রসুন্দরের বক্তব্য হল:

পাশ্চাত্য জাতির উপার্জিত জ্ঞানরাশি আত্মসাৎ করিবার জন্য আমাদিগকে পাশ্চাত্য ভাষার অনুশীলন করিতে হইবে। কিন্তু ওই বিজাতীয় ভাষা কখন আমাদের আপনার ভাষা হইবে না;যদি আমাদের স্বজাতিকেপাশ্চাত্য জাতির উপার্জিত জ্ঞানসম্পত্তির অধিকারী করিতে চাই , তাহা হইলে আমাদের মাতৃভাষাকে এইরূপে সংস্কৃত মার্জিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে সেই মাতৃভাষা এই জ্ঞানবিস্তার কর্মের ও জ্ঞানপ্রচার কর্মের যোগ্য হয়। এই বঙ্গ ভাষারই অঙ্গে নূতন রক্ত সঞ্চালিত করিয়া, তাহাকে পুষ্ট সমর্থ করিয়া তুলিতে হইবে। (বৈজ্ঞানিক পরিভাষা,১৮৯৪)

ইংরেজি শিক্ষার পরিণাম সম্পর্কে রামেন্দ্রসুন্দরের উপলব্ধি:

ইংরাজের প্রদত্ত শিক্ষা হইতেআমরা শিখিয়াছি অনেক ও পাইয়াছি অনেক;কিন্তু তাহাতে বাহ্য ব্যতীত আভ্যন্তরিক বিশেষ কিছু হয় নাই।

আমরা জানিয়াছি অনেক ও শিখিয়াছি অনেক;কিন্তু কিরূপে জানিতে হয় ও কিরূপে শিখিতে হয়, তাহা শেখা আবশ্যক বোধ করি নাই। মনুষ্যজাতির জ্ঞানের রাজ্য আমাদের কর্তৃক এক কাঠা, কি এক ছটাক পরিমাণেও বিস্তার লাভ করে নাই।

ইংরাজের প্রসাদে শিখিয়াছি যথেষ্ট….কিন্তু হায়!আমাদের গড়িবার শক্তি কই, আমাদের উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় কোথায়!আমরা শোনা কথা ও শেখা কথা ভিন্ন জগতে নূতন কথা কি বলিলাম!উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় ত কিছুই দেখি না, এবং আরও কিছু দিনের মধ্যে যে পরিচয় পাওয়া যাইবে, তাহারও কোন শুভ লক্ষণ দেখিতে পাইতেছি না। ইংরাজী শিক্ষার কি এই পরিণাম?

সম্প্রতি বাঙ্গালা সাহিত্যে আছে কি ?উপন্যাস ও কাব্য ?তাই বা কয়খানা ?

ষাট বত্সরের ইংরাজী শিক্ষার ফলে আমরা ভাঙ্গিতে শিখিয়াছি , গড়িতে শিখি নাই,… আমরা পরের কথা আবৃত্তি করিতে পারি, কিন্তু স্বয়ং বাক্য রচনা করিতে জানি না।… (ইংরাজী শিক্ষার পরিণাম, ১৮৯৫)

একশ বছরেরও আগে প্রকাশিত লেখাগুলো পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। ধ্বনিশৈলীতত্ত্বের প্রথম উদ্গাতাদের অন্যতম রামেন্দ্রসুন্দর, কিন্তু পরবর্তী কালের বাঙালি তাঁর চিন্তাকে কোনো গুরুত্ব দেয় নি। মাতৃভাষাকে জ্ঞানবিস্তার ও জ্ঞানপ্রচার কর্মের যোগ্য করারও বিশেষ কোনো চেষ্টা হয় নি, কেউ চেষ্টা করলে টমাস ব্যাবিংটন মেকলের দেশি জারজরা নানা কায়দায় তা বাতিল করেছে । না, আধা সংস্কৃত আধা ইংরেজি ব্যাকরণের মিশ্রণে স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের সীমা পেরিয়ে বর্ণনামূলক বাংলা ব্যাকরণ আজও হয়নি। ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার ষাট বছর পরে রামেন্দ্রসুন্দরের “ইংরাজী শিক্ষার পরিণাম” প্রবন্ধে যে অবস্থার কথা বলেছিলেন তা আজও পালটায় নি। উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগে জ্ঞানের রাজ্যকে আমরা এক কাঠা কেন এক ছটাকও বেশি বিস্তৃত করতে পারি নি। বাংলা সাহিত্যে গল্পকবিতা ছাড়া আর প্রায় কিছুই লেখা হয় না। আর বদ্ধ জলায় জন্মানো ওই গল্প কবিতাও ক্রমশ গ্যাঁজিয়ে উঠছে। “আমরা পরের কথা আবৃত্তি করিতে পারি, কিন্তু স্বয়ং বাক্য রচনা করিতে জানি না।”

মধুসূদন দত্ত: বাংলা সাহিত্যের অনন্য বিপ্লব

পুষ্কর দাশগুপ্ত

বাংলা কবিতায় অথবা আরো বিস্তৃতভাবে বলা যায় বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয়দের মধ্যে মধুসূদনই একমাত্র আর অদ্বিতীয় বিপ্লব। বাকিরা, ভারতচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দএঁদের সবারই সাহিত্যকর্ম অবশ্যই স্মরণীয়;কিন্তু এঁরা সবাই উদ্বর্তন বা ক্রমবিবর্তনের পরিণাম। বিবর্তন, কেননা এঁদের সাহিত্যজীবনের শুরু হয়েছে পূর্বজ আর সমসাময়িকদের রচনার শৈলী আর লিখনের অনুসরণের মাধ্যমে, ভারতচন্দ্রের লিখনের বিবর্তনের দলিল তাঁর সমসাময়িকদের মঙ্গলকাব্য, তাঁর নিজের সত্যপীরের ব্রতকথা; বঙ্কিমচন্দ্রের বিবর্তন বোঝা যায় তাঁর সমসাময়িকদের গদ্যে, তাঁর ছাত্রজীবনের বিভিন্ন রচনায়; কবিতাসংকলন প্রভাতসঙ্গীত, সন্ধ্যাসঙ্গীতের বিভিন্ন কবিতায়, বিশেষ করে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাটি আদিরূপ থেকে চূড়ান্ত সংশোধিত রূপ দেখলেই রবীন্দ্রনাথের বিবর্তন আর রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার ইতিহাস অনুধাবন করা যায়। জীবনানন্দের ঝড়া পালক কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি কবির ক্রমবিবর্তনের ইতিবৃত্তকে উপস্থাপিত করে। উদ্বর্তন বা ক্রমবিবর্তন খারাপ বা ভালো এ ধরনের গুণগত মূল্যায়ন অর্থহীন, আর গুণগত শ্রেণী বিভাজন আমার উদ্দেশ্যও নয়। আমার চেষ্টা হল সাহিত্যকর্মের পঠনের মধ্যে দিয়ে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা।

বাংলা সাহিত্যর ইতিহাসে মধুসূদনের রচনা অনন্য। তাঁর যুগের শৈলী পূর্বজ ও সমসাময়িকদের লিখনে কোথাও তাঁর লিখনের পূর্বাভাস নেই।

চ্যবন মুনির পুত্র নাম রত্নাকর।

দস্যুবৃত্তি করে সেই বনের ভিতর।।

বিরিঞ্চি নারদ দোঁহে সন্ন্যাসী হইয়া।

রত্নাকর কাছে দোঁহে মিলিল আসিয়া।। (কৃত্তিবাস)

হ্যাদেরে নিদয় বিধি ধিক্ ধিক্ তোরে।

কি হেতু বেলাক্ হিঁদু কোরেছিস্ মোরে।।

প্রেমানন্দে পিস্ করি সুখে খায় মিস্।

বলিহারি যায় তোরে ওরে ম্যাঙ্গোফিস।। (ঈশ্বর গুপ্ত)

সর্বসুলক্ষণবতী, ধরাধামে যে যুবতী,

লোকে বলে পদ্মিনী তাহারে।

সেই নাম নাম যার, সেরূপ প্রকৃতি তার,

কত গুণ কে কহিতে পারে? (রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়)

পড়তে পড়তে হঠা:

সম্মুখ সমরে পড়ি, বীরচূড়ামণি

বীরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে,

অকালে, কহ হে দেবি, অমৃতভাষিণি,

কোন বীরবরে বরি

 

একেবারে নতুন কণ্ঠস্বর! নতুন লিখন ! মুদ্রিত হয়েও রঙ্গলাল অব্দি চলতে থাকা মুদ্রণের আগের মৌখিকশ্রাব্য (পড়তে জানে এরকম একজন সুর করে পড়বে অন্যেরা শুনবে) পুঁথিসংস্কৃতির অভ্যস্ত সুরে এ রচনা কিছুতেই পড়া সম্ভব নয় । বিপ্লব ছাড়া একে কী বলা যায়!

 

 

 

রমানাথ রায়ের শাস্ত্রবিরোধিতার উদবর্তন পুষ্কর দাশগুপ্ত Ramanath Roy: Organic Evolution of Anti-canonism (Shastravirodhita) of his writing : Pushkar Dasgupta / Ramanath Roy: Évolution organique de l’anti-canonisme (shastravirodhita) de son écriture: Pushkar Dasgupta

রমানাথ রায়ের শাস্ত্রবিরোধিতার উদবর্তন

পুষ্কর দাশগুপ্ত

লেখালিখির জগতে আমার বন্ধু নেই বললেই হয়;হাতে গোণা যে কয়েকজন রয়েছে তার মধ্যে রমানাথ সবচেয়ে পুরনো আর স্থায়ী । আমার অন্য যেসব বন্ধু রয়াছে তাদের সঙ্গে দেখা হলে কেমন আছ, কোথায় আছ, ছেলে কী করছে, এক আধটু রাজনীতি এসবের পর আর প্রায় বলার কথা থাকেনা । রমানাথের সঙ্গে দেখা হলে জীবনের অনেক ঝড়ঝাপ্টা সত্ত্বেও আজও সাহিত্য, ভাষাব্যবহারআর লিখনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলে আসে । পেছনে ফেলে আসা সুদূর ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে আজ পর্যন্ত এই সম্পর্ক প্রায় অটুট রয়েছে ।

রমানাথের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কফি হাউসে । রমানাথ তখন এম.এ পরীক্ষা দিয়েছে। আমার সঙ্গে তার পরিচয় অবশ্য গল্পকার রমানাথ হিসেবে । তখনও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়নি, রমানাথ গল্প লেখে, অল্পপ্রচারিত ক্ষীণকায় অবাণিজ্যিক কিছু কাগজে তা ছাপা হয় । কফি হাউসের টেবিলে গল্পকবিতা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, তর্কবিতর্ক চলে। কখনো কে কী লিখছে বা লিখেছে তা নিয়ে কথা হয়, কখনো সখনো কেউ একজন নিজের নতুন লেখা পড়ে । কে কোন নতুন বই বা লেখা পড়ছে কি সম্প্রতি পড়েছে তা নিয়েও আলোচনা হয় । এ ছাড়া ক্ষীণকায় অবাণিজ্যিক সাহিত্যপত্রের প্রকাশকসম্পাদকরাও কফিহাউসে আসে, লেখার দেওয়ানেওয়া চলে । তারপর,কিছুদিনের মধ্যে আস্তে আস্তে আমাদের (রমা, আমি…) দলটা একটু ছোট, কিছুটা আলাদা হয়ে যায় । সবাই আসে, তবে বেশির ভাগ দুচারটে কথা বলে অন্য কোনো টেবিলে গিয়ে বসে । আসলে কোন পত্রিকায়, কী লিখছি/লিখছর বাঁধা গৎ, অমুকতমুক, অমুকদাতমুকদা, অমুক পত্রিকাতমুক পত্রিকার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কী লিখব, কেন লিখব, কেমন করে লিখব এসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা অল্প কয়েকজন মাথা তখন ঘামাতে শুরু করেছি, আর এই ব্যাপারগুলো বেশির ভাগের কাছে অপ্রয়োজনীয় বা অবান্তর বলে মনে হচ্ছিল । তা মৌখিক বা লিখিত যাই হোক না কেন, ভাষাব্যবহারের উদ্দেশ্য হল সংজ্ঞাপন । বাস্তব জীবনের সাধারণ সংজ্ঞাপনে ‘কেমন করে’ বলা হয়েছের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হল ‘কী’ বলা হয়েছে । আর এর বিপরীতে সাহিত্যিক সংজ্ঞাপনে অর্থাৎ সৃষ্টিশীল রচনায় ‘কী’ অর্থাৎ বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘কেমন করে’ লেখা অর্থাৎ লিখন ।

রমানাথ গল্প লিখত । বাংলা ভাষার, বাঙালির সাহিত্যের জগতে সাহিত্যকর্মের (গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকের), আলোচনায় যে ধারণাবোধক শব্দবীজগুলি সবসময় সর্বস্তরে উপস্থিত থাকে, বাচনকে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলির কয়েকটা হল:বিষয় বা বিষয়বস্তু, জগত, জীবন, জীবনব্যাখ্যা, জীবনবোধ, বক্তব্য, কবিত্ব ইত্যাদি আর এসবের মাঝখানের কেন্দ্রবিন্দু হল ‘কী?’। এসব ধারণাকে ঘিরে একই ধরনের যে শব্দগুলি বারবার পুনরাবৃত্ত হয় সেগুলি প্রশ্নহীনভাবে আউড়ানোর বদলে মনোযোগ দিয়ে শুনলে বা পড়লেই বোঝা যায় সেগুলি কতটা ফাঁপা : ‘ঔপন্যাসিকের মানসদৃষ্টি, বিস্তৃত জীবনপটে অভিজ্ঞতার বিন্যাসউপন্যাসোচিতসমস্যা— একটি উপন্যাসের এই প্রধান ত্রিশর্তের...’, ‘ব্যক্তিস্বরূপের বিশেষ বিন্যাসে…’ (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘আমরা যে কবিতায় একত্রে যত অধিক চিত্তবৃত্তির চরিতার্থতা লাভ করি তাহাকে ততই উচ্চশ্রেণীর কবিতা বলিয়া সম্মান করি…’ (রবীন্দ্রনাথ), ভাষা, ভাব, ছন্দ, এই তিনের সন্নিপাতে কাব্য গড়ে ওঠে।কাব্য যখন মহত্ত্বের কোঠায় পৌঁছায়তখন তার ভিতর পাওয়া যায় বিরাট একটা সহজতা কাব্যের ভাষা যেমন অকৃত্তিমতার কণ্ঠস্বর, কাব্যের ছন্দ তেমনই অকৃত্তিমতার পদধ্বনি(সুধীন্দ্রনাথ দত্ত), আধুনিক ‘গীতিকাব্যের মতো ছোটগল্পের রসেরও পাক লেখকপাঠকের সমরসানুভূতির উষ্ণতায়(সুকুমার সেন) ‘কিছুদিন কিছু কবির সহজ ভাষার পর ….জীবনানন্দের ….সন্ধ্যাভাষা... (সমর সেন)। প্রশ্ন হল নিম্নরেখ (নিম্নরেখা আমাদের) শব্দগুলির অর্থ কী? এই সব পুরনো শূন্যগর্ভ শব্দের শেকল ভেঙে, অর্থহীন ভানভণিতার সীমানা পেরিয়ে, আমরা পথ খুঁজতে লাগলাম । এই সময়ে আমাদের চারদিকে সন্ধানের এলোমেলো কিছু প্রথম পদক্ষেপও শুরু হয়েছে: ছোট গল্প নতুন রীতি, কৃত্তিবাস, হাংরি জেনারেশন । বিমল কর সম্পাদিত ছোট গল্প নতুন রীতি শিরোনামে পাঁচটি পুস্তিকায় যে গল্পগুলি প্রকাশিত হয় তার মধ্যে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জটায়ু’ আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিজনের রক্তমাংস’ আমাদের চোখ এড়াই নি । পঞ্চাশের দশকের শেষে কৃত্তিবাস কবিতাপত্রিকাকে কেন্দ্র করে কিছু কবি কিছুটা চমক, কিছুটা তথাকথিত বোহেমিয়ান জীবনের প্রদর্শক মিথ আর প্রচারের মাধ্যমে পরিচিত হন । কৃত্তিবাসের কবিরা বলতেন সাহিত্যে, কবিতায় মুখের ভাষা ব্যবহার করতে হবে । কে, কাকে, কী পরিস্থিতিতে, কী বিষয়ে, কেন কথা বলছে সে অনুসারে মুখের ভাষা সব সময় পালটাচ্ছে । এর মধ্যে কোন মুখের ভাষাটা সাহিত্যে ব্যবহার্য ?হাংরি আন্দোলনের চ্যাঁচামিচিতে দাদার বিভিন্ন ইস্তাহার আর বিট জেনারেশনের বিভিন্ন উক্তির এলোমেলো প্রতিধ্বনি আর আর্ত চিত্কার শোনা যেত । এর কোনোটাই আমাদের সন্তুষ্ট বা সে অর্থে আকর্ষণ করতে পারেনি । আর শেষ পর্যন্ত লেখা আর লেখার যাবতীয় আলোচনাসমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কী নিয়ে লেখা হবে — ভালোবাসা, যৌনতা, প্রকৃতি, ব্যক্তি, সমাজ, বাস্তবতা, বিচ্ছিন্নতা, ইত্যাদি । বস্তুত আজও অবস্থাটা খুব একটা পালটায় নি । আর একদিকে গদ্যে বাস্তবতাবাদ আর অন্যদিকে কবিতায় আমিকেন্দ্রিক রাবীন্দ্রিক রোমান্টিসিজম পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য আজও খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকীয় দৃষ্টবাদপ্রভাবিত সাহিত্যভাবনার নিরঙ্কুশ আধিপত্যে রচয়িতার তুলনায় লিখননির্মিত রচনাকে , বাস্তবতাবাদ বর্জন করে রচনার সৃষ্ট বাস্তবকে গুরুত্ব দেওয়ার দৃষ্টান্ত আজও বিরল । রমানাথ এদিক থেকে আমার জানা একমাত্র ব্যতিক্রম ।

আবার ফিরে যাচ্ছি পুরনো দিনের কথায়, আমাদের চিন্তাভাবনা আর সন্ধানের কথায় । রচনা, রচয়িতা (রচনায় রচয়িতার স্থান, উপস্থিতি/অনুপস্থিতি), লেখা (√লিখ্ সকর্মক/অকর্মক), লিখন (ভাষাসংগঠন, শব্দনির্বাচন, বাক্য), কাহিনিকথন (পুরুষ, ক্রিয়ার কাল, দৃষ্টিকোণ বা আলোকায়ন), পঠনপাঠ (=পুনর্নির্মাণ), পাঠলিখন (=আলোচনাসমালোচনা) এগুলিই ছিল আমাদের লেখালিখির পেছনের চিন্তা । আমাদের ছোট্ট দলটির কেমন করে লিখব চিন্তার প্রথম প্রকাশ ‘এই দশক’ বুলেটিন (১৯৬২)। রমানাথ ছিল তার হোতা । তারপর আমার দায়িত্বে বেরুল কবিতা পত্রিকা ‘শ্রুতি’ (১৯৬৪)। এর পর গল্পের পত্রিকার আকার নিয়ে ‘এই দশকের’ প্রকাশ ‘শাস্ত্রবিরোধী গল্পের’ [শাস্ত্র √শাস্– (শাসন করা, উপদেশ বা শিক্ষা দেওয়া) –ষ্ট্রন (শাস্ত্র বিধিবিধান, তত্ত্ব, ধর্মগ্রন্থ)] আন্দোলন বা বিদ্রোহের সূচনা হয় । ‘গতকাল পর্যন্ত আমরা ছিলাম অন্ধ, ছিলাম শাস্ত্রের হাতে বন্দী।শিল্প ও সাহিত্যে শাস্ত্রসম্মত পথকে বর্জন করতে হবে সাহিত্য দীর্ঘদিনের সংস্কার ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হোক ।’ রমানাথের অধিরাচনিক বাচনের উদ্ধৃত এই অংশের উপাদান তিনটি বাক্য ।প্রথম বাক্যটি কমা দ্বারা যুক্ত দুটি সরল বাক্যের সমবায়ে গঠিত যৌগিক বাক্য, ইতিহাসনির্দেশক সরল অতীত কাল ( ছিলাম)। পরের দুটি বাক্য সরল বাক্য ।দ্বিতীয় বাক্যে যৌগিক ক্রিয়ার (- তে+√-)ঔচিত্যকরণীয়নির্দেশক ভবিষ্যৎ কাল আর তৃতীয় বাক্য আকাঙ্ক্ষানির্দেশক অনুজ্ঞা ব্যবহৃত । এর মধ্য দিয়ে গল্পে (শিল্পসাহিত্যে) শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের অবস্থান ও অভীষ্ট স্পষ্ট: ইতিহাস / অতীত — করণীয়/ লক্ষ্য — সংস্কার / কুসংস্কার থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ।

মার্ক টোয়েনএর উপন্যাস Adventures of Huckleberry Finn-র শুরুতে একটা বিজ্ঞপ্তি রয়েছ:

Persons attempting to find a motive in this narrative will be prosecuted;

persons attempting to find a moral in it will be banished ;

persons attempting to find a plot in it will be shot…

যারা এই আখ্যানের মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে;

যারা এর মধ্যে কোনো নীতিউপদেশ খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের নির্বাসিত করা হবে ;

যারা এর মধ্যে কোনো কাহিনি খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের গুলি করা হবে

মার্ক টোয়েনএর উপন্যাসের এই উপরচনার তৃতীয় বাক্যটি শাস্ত্রবিরোধীদের বিভিন্ন ইস্তেহারে ব্যবহৃত হয় । দশটি প্রস্তাবের ঐ ইস্তেহারের উত্পাদক ছিল রমানাথ, এই বাক্যের মধ্যে যে নাগরিক হাস্যরস রয়েছে তা রমানাথের কিছু কিছু লেখার অন্যতম চরিত্রলক্ষণ হয়ে দাঁড়ায় । এছাড়া এই দশকের প্রথম সংখ্যার ঘোষণায় একটি বাক্য ছিল:অতীতের মহৎ সৃষ্টি অতীতের কাছে মহৎ, আমাদের কাছে নয় । এই বাক্যটি ছিল অঁতোন্যাঁ আর্তো(Antonin Artaud) নাটক আর তার প্রতিরূপ’ (Le Théâtre et son double)বইয়ের ‘মহৎ সাহিত্যকর্মের ব্যাপারটার ইতি করা যাক’ (En finir avec les chefs d’œuvres)প্রবন্ধ থেকে নেওয়া একটি বাক্যের (Les chefs-d’œuvres du passé sont bons pour le passé : ils ne sont pas bons pour nous ) অনুবাদ । মার্ক টোয়েন আর আর্তোর রচনার ব্যবহার রমানাথের, শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের চিন্তার আন্তঃসাংস্কৃতিকতা আর রচনার আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার স্বাক্ষর।

আসলে আমরা বাংলায় লিখলেও বাংলায় কী লেখা হয়েছে, হচ্ছে তার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কী লেখা হচ্ছে, বিশেষ করে কীভাবে লেখা হচ্ছে তার খবরাখবর রাখতে চেষ্টা করতাম । বলা যায় আজকের যুগের রচনার অন্তঃসাংস্কৃতিক আর আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতা সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম । রমানাথ পয়সা পেলেই কফিহাউসের ওপরে রূপা কোম্পানির, গ্র্যান্ড হোটেলের আর্কেডের বইয়ের দোকান থেকে নতুন বই কিনত । ইতিমধ্যে রমানাথ ফরাসি ‘নতুন উপন্যাস’ (Nouveau Roman)আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিবোধ হয়,ওই সময়ে বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে একমাত্র রমানাথই ইংরেজি অনুবাদে আল্যাঁরব গ্রিয়ে ( The Jealousy/ La Jalousie, The Voyeur/ Le Voyeur) , স্যামুয়েল বেকেট (Molloy , Malone Dies , The Unnamable ), ক্লোদ সিমোঁ (The Passage to Milan/ Passage de Milan, The Modification/ La Modification), নাতালি সারোত (The Age of Suspicion/L’Ère du soupçon, The Planetarium/Le Planetarium), ইতালো কালভিনো ( The Nonexistent Knight/ Il cavaliere inesistente, Invisible Cities/ Le città invisibili), পিটার বিকসেল (A Table is a Table​/ Ein Tisch ist ein Tisch) ইত্যাদি লেখকের লেখা পড়েছিল । ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘একটা নতুন উপন্যাসের জন্য’ বইয়ে ‘কিছু বাতিল হওয়া ধারণা সম্পর্কে’ (Sur quelques notions périmées, 1957) প্রবন্ধে রবগ্রিয়ে উপন্যাসে চরিত্র, কাহিনি, প্রকরণ ও বিষয়ের দ্বৈত অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, অন্য দুটি প্রবন্ধে তিনি বলেন, নতুন উপন্যাস একটা তত্ত্ব নয়, একটা অনুসন্ধান’, নতুন উপন্যাসে ‘বাস্তববাদের বদলে রয়েছে বাস্তব’ । রমানাথ এসব পড়ে ভাবত, আলোচনা করত।

প্রসঙ্গত দুটি মজার ঘটনা বলছি । ১৯৬৩ বা ১৯৬৪ সালে বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের কর্তৃপক্ষ মার্কাসস্কোয়ারে সম্মেলনের বার্ষিক প্রদর্শনীতে বিনিপয়সায় আমাদের ছোট একটা স্টল দিয়েছিল । স্টল সাজানোর রেস্ত আমাদের ছিল না, তাই আমরা চারদিকে নানান স্লোগান ঝুলিয়ে দিলাম, তারপর হঠাৎ একটা ঘট পাওয়া গেল । কী করা যায়? আমরা তখনো তথাকথিত মঙ্গলঘটের সংস্কার থেকে বেরুতে পারিনি। আমি রমানাথকে কলেজস্ট্রিট মার্কেট থেকে একটা ডাব নিয়ে আসতে বললাম । কোনো এক অজানা কারণে সেদিন সন্ধ্যের বাজারে ডাব না পেয়ে রমানাথ ডাবের বদলে একটা ছোট কাঁঠাল (এঁচড়) নিয়ে এসেছিল । এঁচড় দিয়ে কী করা যায় ? আর কিছু না ভেবে এঁচড়টাকে ঘটের ওপর বসিয়ে দিলাম। প্রতিক্রিয়া অভাবনীয় !দলে দলে লোক স্টলে এসে কেউ রাশভারি গলায়, কেউবা চটে লাল হয়ে, কেউবা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করতে লাগল ঘটের ওপর এঁচড়, এর মানেটা কী ? আমরা ‘মানে’ তৈরি করতে থাকলাম। ঘট আর ডাবের রচনা = (শাস্ত্র, সংস্কার অনুসারী ) মঙ্গলঘট, কিন্তু ঘট আর এঁচড়ের রচনা = ? মানে? মানে তো সবসময় পঠনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় । এসব কথায় অনেকে কৌতূহলী হল, অনেকে রেগে গেল, কেউ কেউ ‘এঁচরে পাকা’মন্তব্য করে চলে গেল। এর পরের দ্বিতীয় ঘটনাটা অন্য ধরনের, তার সংজ্ঞাপিত ‘ব্যঙ্গার্থ’ও ভিন্নতর । শাস্ত্রবিরোধী ‘এই দশক’ আর ‘শ্রুতি’, অন্তত প্রথম দিকে, রমানাথ আর আমার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণে আন্দোলন বা পত্রিকাপ্রকাশ ‘আমাদের’ যৌথ উদ্যোগে পরিণত    হয়েছিল । ‘এই দশকর ’ চতুর্থ সংখ্যায় আমি প্রথম তিনটি সংখ্যায় প্রকাশিত গল্পগুলির ওপর আলোচনা করেছিলাম । অন্য দিকে ‘শ্রুতির’ চতুর্থ সংখ্যা ছিল অনূদিত কবিতার সংকলন । তাতে রমানাথ ফরাসি কবি জাক প্রেভেরএর কবিতার অনুবাদ করেছিল । আমাদের টাকাপয়সার সংস্থানটা ছিল খুবই সীমিত । তাই কিছুটা সস্তায় ছাপানোর জন্য আমরা মির্জাপুর স্ট্রিটের শেষে আমজাদিয়া রেস্টুরেন্টের আগে দীপক প্রিন্টার্স (৪৫ সূর্য সেন স্ট্রিট) বলে একটা ছোট্ট ছাপাখানায় পত্রিকা ছাপাতে শুরু করি । ঐ ছাপাখানার মালিক বঙ্কিমবাবু (বঙ্কিম সাহা) ঢাকার পয়সাওয়ালা   লোক । ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত । মুসলমানদের সঙ্গে সম্পত্তি বদল করে বাড়িঘর সবই করেছেন । ঢাকায় ছাপাখানা ছিল, তাই বাড়ির সবার আপত্তি সত্ত্বেও এখানে ছাপাখানা করেছেন । বঙ্কিমবাবু সব সময় সুবেশ, পরনে ধবধবে শাদা ফিনফনে গিলে করা পাঞ্জাবি, ধুতি । বঙ্কিমবাবুর প্রেসে দুপুরে ছাপা হত এক ধরনের ট্যাবলয়ড । একদিন, বড় বড় হরফে শিরোনাম শোলমারির সাধু কে? নেতাজি? আরেকদিন, কুম্ভমেলায় কে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন? কেন এত গোপনে ? বিকেলে প্রেস থেকে দু তিনজন কাগজবিক্রেতা ওই কাগজগুলো নিয়ে নেতাজির নতুন খবর, বা কুম্ভমেলায় কে? কারা? চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে কাছেই শিয়ালদহ স্টেশনে চলে যেত । ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা গরম তেলেভাজার মতো কাগজগুলো কিনে নিত । বঙ্কিমবাবুর প্রেসে আর যা ছাপা হত তা হল কার্ড — বিয়ে, জন্মদিন, পৈতে, মুখে ভাত, শ্রাদ্ধ , হালখাতা, সরস্বতীপুজো ইত্যাদির কার্ড, মফস্বলের অসংখ্য লোক স্টেশন থেকে নেমে চলে আসত এই কার্ড ছাপাতে । এখানেই আমার কাহিনির শুরু । আমাদের দলের কেউ একটা প্রেসে গেলেই বঙ্কিমবাবু সব সময় বলতেন, আপনাগো কামেই হাত লাগাইছে, কাইল বিকালে অ্যাকবার আহেন, অনেকটা প্রুফ পাইয়া যাইবেন । আপনাগো কামেই হাত লাগাইছে! কিন্তু ভেতরে গেলে দেখা যেত তিনজন কর্মীর দুজন বিয়ের কি শ্রাদ্ধের কার্ড আর তৃতীয় জন খনার বচন বা ছাত্রপাঠ্য ভূগোলের বই কম্পোজ করছে । এখন প্রুফ পেতে হলে হত্যে দিয়ে বসে থাকতে হবে । তাই সেদিনও বললাম, এই বসলাম! অন্তত কিছুটা প্রুফ না নিয়ে আর উঠছি না । ইতিমধ্যে বেশ লম্বাচওড়া এক ভ্দ্রলোক প্রচণ্ড রাগে চিত্কার করতে করতে ছাপাখানায় ঢুকলেন । তাঁর হাতে সুন্দর ডিজাইন করা একটা বিয়ের কার্ড । ‘আপনাকে চেয়ারশুদ্দু তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে । দেখুন কী কান্ড করেছেন, দেখুন একবার!‘ নির্লিপ্ত, নিরুদ্বিঘ্ন বঙ্কিমবাবু শান্ত গলায় বললেন, ‘কী হইছে? বানান ভুল?‘ ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বানান ভুল ! দেখুন বদমাইশিটা একবার দেখুন! বিয়ের কার্ডে বাপের নামের জায়গায় ছেলের নাম আর ছেলের নামের জায়গায় বাপের নাম ছাপা হয়েছে ।‘ বঙ্কিমবাবু অবিচলিত শান্ত গলায় তাঁর বিশুদ্ধ পূর্ববঙ্গীয় উপভাষায় লোকটিকে বোঝালেন, পুরো ব্যাপারটার মূলে রয়েছে মেশিনের স্বেচ্ছাচারিতা । মেশিন কম্পোজ করা শব্দ, লাইন, প্যারা, পৃষ্ঠা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়, কিছুই করার নেই, খদ্দেরের কপাল । কথায় বলে, ছাপাখানার ভূত! বঙ্কিমবাবু ভেতরে চলে গেলেন, ফিরলেন হাতে একটা লাল কালির কলম নিয়ে, দেখালেন কীভাবে লাল কালিতে বাপের আর ছেলের নাম ঠিক জায়গায় লিখতে হবে । অদৃষ্টবাদীর মতো নীরবে কলমটা হাতে নিয়ে ভদ্রলোক কীরকম একটা অস্বস্তি নিয়ে টেবিলের ওপর রাখা তিনশ কার্ডের দিকে তাকিয়ে রইলেন । আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না । ভদ্রলোককে বললাম ওভাবে লাল কালিতে শুদ্ধ করলে বিশ্রী দেখাবে, একটা কাজ করুন, নতুন কার্ড কিনে আনুন, বঙ্কিমবাবু কোনো পয়সা না নিয়ে শুদ্ধভাবে আবার একবার ছাপিয়ে দেবেন । বঙ্কিমবাবু না করতে পারলেন না, ভদ্রলোক ঝড়ের বেগে নতুন কার্ড কিনতে বেরিয়ে গেলেন । প্রচণ্ড রেগে বঙ্কিমবাবু আমায় বললেন, উনি ব্যাপারটা প্রায় মিটিয়ে দিয়েছিলেন আমিই আবার গন্ডগোল পাকালাম । তারপর বললেন, ‘আসল কথাটা আমার কওয়ার কথা নয়, তাও কই, আপনার, আপনার বন্ধু রমানাথবাবু আর আপনাগো দলবলের স্বভাবটাই হইল সব কিছুতে প্যাচাল পারা আর ঝুটঝামেলা বাঁধানো । আপনাগো ল্যাখালেখিতেও দ্যাখছি তাই, উলট পালট, প্যাচাল আর ঝুটঝামেলা ।’

এই দ্বিতীয় বৃত্তান্তের তিনটি অংশ, অন্যভাবে বলা যায় এই কাহিনিতে তিনটি আখ্যান রয়েছে । প্রথম দুটি অংশ বাদ দিয়ে আমরা তৃতীয় অংশে গিয়ে দেখছি আখ্যানের চরিত্র বঙ্কিমবাবু বাইরে থেকে আমাদের লিখনকে ওলটপালট আর ঝুটঝামেলা বা ‘প্যাচাল‘ (গণ্ডগোল, বাজে কথা, তর্ক, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ; পৃ. ১৯৭, দ্বিতীয় খণ্ড। ) ছাড়া আর কিছু বলেই ভাবতে পারছিলেন না । তাতে লৌকিক আধুনিকতার লক্ষণ রগরগে যৌনতা বা আবেগের উচছ্বাস — এর কোনোটাই ছিল না । এমন কী তথাকথিত বামপন্থী বিপ্লবী স্লোগানও নয় । আবার ‘মানুষ,ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে । কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়’ — ইয়োরোপের সামাজিকসাংস্কৃতিক আর শিল্পসাহিত্যর ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তের মিথষ্ক্রিয়ার উত্পাদন ক্ষণস্থায়ী দাদা আন্দোলনের সমাপ্তির বহুকাল পরে জুরিখের ‘কাবারে ভলতের’ থেকে বহু দূরে কলকাতা নামক গাঁয়েঁর চণ্ডীমণ্ডপে দাদা সাহেবদের কণ্ঠস্বরের নকল করে এ জাতীয় অর্থহীন ভড়ং বা প্রলাপের চিত্কার করাও আমাদের লেখায় ছিল   না । তাহলে এগুলি কী? সাধারণ পাঠকের সাহিত্য, গল্প, কবিতা সম্পর্কে গড়ে ওঠা ধারণার বাইরের, বাংলা ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস তথা পরিগ্রহণ দ্বারা গড়ে ওঠা আর নিয়ন্ত্রিত তার প্রত্যাশার দিগন্তের  (Erwartungshorizont ) সীমানা পেরুনো আমাদের এই রচনাগুলিকে পরিগ্রহণ করা বাঙালি পাঠকদের অনেকের পক্ষেই তখনো সম্ভব ছিল না ।

আসলে ক্ষণস্থায়ী ‘শ্রুতি’ বা তার চেয়ে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী পত্রিকা শাস্ত্রবিরোধী ‘এই দশক’ ছিল আমাদের অনুসন্ধানের কাল । আমরা খুঁজছিলাম । খুঁজছিলাম আমাদের প্রত্যেকের, নিজস্ব সৃজনশীলতার পরিচায়ক ‘আমার’ লিখন । ‘শ্রুতি’ আর ‘শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’ সমবেতভাবে বা /এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সন্ধানের ইতিহাসের একটা অধ্যায় । রমানাথের ওই সময়ের একটা গল্পের কথা মনে পড়ছে । গল্পটি আজও অনেকের কাছে পরিচিত । গল্পটির শিরোনাম ‘বলার আছে’, গল্পটি প্রথম বেরিয়েছিল ‘এই দশক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (১৯৬৬)। ১৯৭৩ সালের মে মাস থেকে কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজএর তখনকার পরিচালক জঁফ্রসোয়া মোর , ফরাসির ছাত্র স্বপন দাশমহাপাত্র (পরে বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষাসাহিত্যের অধ্যাপক)আর আমার চেষ্টায় (দাদা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত পত্রিকা 391আর অঁদ্রে ব্রতোঁর কবিতাসংকলন Arcane 17 –এর কথা মনে রেখে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের তখনকার ঠিকানা ২৪ পার্ক ম্যানসন্স্ থেকে) ২৪ /Le 24,নামে একটি ক্ষীণকায় বাংলাফরাসি দ্বিভাষিক সাহিত্যপত্রিকা বের হয় । ওই পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় (নভেম্বর, ১৯৭৩) রমানাথের ‘বলার আছে’ গল্পটি পাশাপাশি বাংলা আর ফরাসিতে বেরিয়েছিল । ফরাসি অনুবাদ করেছিলাম আমি আর জঁফ্রসোয়া মোর । কয়েকজন ফরাসি কিছুটা কৌতুহলী হয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করল, তোমাদের বাংলাতে এ ধরনের গল্প লেখা হয় ?বলার আছে’ গল্পটি রমানাথের ওই একই নামের দ্বিতীয় গল্পসংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল (১৯৭৩)। এই সময়ের স্মৃতিচারণার পটভূমিকায় ‘শাস্ত্রবিরোধী’ রমানাথের লিখনের দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা ‘বলার আছে’ গল্পের একটি অংশ উদ্ধৃত করছি:

আমার কিছু বলার আছে

বলতে গেলে একটা উঁচু টুলের দরকার

ভাল গলার দরকার

আমার উঁচু টুল নেই

আমার ভাল গলা নেই

টুল ধার চেয়েছি কেউ দেয়নি

ভাঙা গলা ভালো করার চেষ্টা করেছি পারিনি

অথচ আমাকে বলতে হবে বলার আছে

আমি বলব

আমি বলব সবার বিরুদ্ধে সব কিছুর বিরুদ্ধে গাছে পাতা গজানোর বিরুদ্ধে ঝরে পড়ার বিরুদ্ধে যৌবনের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে বার্দ্ধক্যের বিরুদ্ধে সূর্যের বিরুদ্ধে অন্ধকারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে মরে যাওয়ার বিরুদ্ধে সাহিত্যের বিরুদ্ধে রাজনীতির বিরুদ্ধে কাপড়ের বিরুদ্ধে প্যান্টের বিরুদ্ধে

( বলার আছে)

শাস্ত্রবিরোধী গল্পআন্দোলনের মুখপত্র ‘এই দশকের’ প্রথম সংখ্যায় আলোচ্য রচনাটি প্রকাশিত হয় । ‘এই দশক’, ‘শাস্ত্রবিরোধী গল্পআন্দোলন’, ‘গল্প’ এই রচনাবহির্ভূত শব্দগুলি বর্তমান রচনার উপরচনা প্রস্তাবনার কাজ করে । শব্দগুলি সমকালীনতা (বম. গতকালীনতা) বাচক ‘এই দশক’, বর্গবাচক ‘গল্প’, চরিত্রলক্ষণবাচক ‘শাস্ত্রবিরোধী’ আর বিশেষ ধরনের সাহিত্যপ্রয়াসবাচক ‘গল্পআন্দোলন’ — এই সংকেতগুলি সম্ভাব্য পাঠকের মনকে রচনাটি পড়ার জন্য প্রস্তুত করে । বিশেষ করে যেসব পাঠক এর আগে রমানাথ রায়ের সম্পাদিত ‘এই দশক’ বুলেটিন পড়েছিল তাদের মনে এই সংকেতগুলির অনুষঙ্গ আরো গভীরতর প্রভাব বিস্তার করে । এর পর রচনাটি পড়া শুরু করার আগে কিছুটা সাদা মার্জিনের বিরতির সীমানায় রয়েছে মূল রচনা থেকে আলাদা করা যায় এমন হরফে ছাপা শিরোনাম ‘বলার আছে’, তার পর লেখকের নাম ‘রমানাথ রায়’ । লেখকের নাম আর শিরোনাম রচনান্তর্গত উপরচনা । লেখকের অন্য লেখা পড়ে থাকলে অথবা লেখকের সম্পর্কে কোনো আলোচনা কোথাও শুনে বা পড়ে থাকলে, তাহলে লেখকের এই নাম সংকেত হিসেবে রচনাটির পঠনের প্রস্তুতিকে (কৌতুহলপ্রত্যাশা জাগিয়ে) দিগনির্দেশ করে । শিরোনাম ভাববাচ্যে যৌগিক ক্রিয়া ‘বলার আছে’, তার রবিভক্তিযুক্ত কর্তৃপদ (আমার /তোমার/ তার…) আর কর্মপদ (কিছু /একটা কথা /অনেক কিছু/অনেক কথা…) উহ্য থাকায় (যা বাংলা ভাষায় সম্ভব) শিরোনামটি ধ্বনিগত দিক থেকে ক্ষিপ্র আর জোরালো আর তার অর্থসংকেত অনির্দিষ্ট বিস্তার লাভ করেছে; পাঠকের মনে প্রশ্ন/কৌতূহল: ‘বলার আছে’? — ‘কার’? এই উপরচনাগুলিই সংপ্রেষকলেখক আর পরিগ্রাহক পাঠকের মধ্যে পঠনপরিগ্রহণের চুক্তি প্রতিষ্ঠিত করে ।

এর পর সাদা মার্জিনের বিরামের পর রচনার পঠন শুরু: আমার কিছু বলার আছেশিরোনামের খণ্ডিত ভাববাচ্যের বাক্যটি এবার পুনরাবৃত্ত তবে তা সম্পূর্ণ । এই কাহিনিতে একটি মাত্র চরিত্র রয়েছে: নামহীন, পরিচয়হীন উত্তমপুরুষ একবচন সর্বনাম আমি, কাহিনিকথক আর চরিত্র এক আর অনন্য, ফলে কাহিনিটি আত্মবৃত্তান্তমূলক (autodiegetic)স্বগতোক্তি, অতএব সর্বব্যপ্ত দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত । এই কাহিনিতে পুরনো অর্থে কোনো ক্রিয়াশীল চরিত্র, ঘটনা আর পরিস্থিতির বুননে সংগঠিত কোনো প্লট নেই, যা আছে একটা তা মিশ্রিত কালানুক্রমিকতা: সদ্যসমাপ্ত অতীত (বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের পুরাঘটিত বর্তমান), সমাপিত অতীত, কালাতীত নিত্য বর্তমান, অসমাপ্ত বর্তমান, ভবিয্যৎ ।

প্রথম অনুক্রমের পরিগণনার পর সাদা ফাঁকের পর দ্বিতীয় অনুক্রমের শুরু:

আমি বলব

আমার কিছু বলার আছে

জানি আমার উঁচু টুল নেই

জানি আমার ভাল গলা নেই

জানি বলতে গেলে আমার চারফুট দেহ দেড় ফুট হয়ে যায়

জানি আমার হাত হারিয়ে যায়

এখন রাস্তায় অনেক লোক

গল্প লেখা হয় গদ্যে । ছেদচিহ্ন আর অনুচ্ছেদবিভাজন ঘটনা আর পরিস্থিতির বিবর্তন নির্দেশ করে । কিন্তু বর্তমান রচনা গদ্যে লেখা হলেও তাতে কোনো ছেদচিহ্ন নেই, গদ্যের মতো প্রবহমানভাবে উপস্থাপিত (মুদ্রিত) নয়, আমাদের উদ্ধৃত অংশে দেখা যাচ্ছে শুরুতে এগারোটি ছোট (বলা যায় প্রায় ন্যূনতম) বাক্য নটি লাইনে ছাপা হয়েছে, ছাপা লাইনের পাশে অনেকটা সাদা খালি জায়গা, এর পর ‘আমি বলব’ বাক্যের পুনরাবৃত্তি করে তাতে যোগ করা হয়েছে অব্যয় ‘বিরুদ্ধে’ তারপর ‘বিরুদ্ধে’ অনুসর্গের বিপ্রতীপ সম্পূরক (পাতা গজানো বম. ঝরে পড়া, যৌবন বম. বার্দ্ধক্য, সূর্য বম. অন্ধকার, বেঁচে থাকা বম. মরে যাওয়া…) সহ দীর্ঘ পরিগণনা যা স্বাভাবিক গদ্যের মতো ছাপা । ছেদচিহ্নের অনুপস্থিতি আর মুদ্রণবিন্যাসের বিশেষত্ব রচনাটিকে সাধারণ মুদ্রিত গল্প থেকে আলাদা করে দিয়েছে, পাঠককে তা ছেদচিহ্নহীন আধুনিক (মালার্মে থেকে শুরু, তারপর সঁদ্রার, আপলিনের ও অন্যান্যদের) কবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । মুদ্রণবিন্যস্ত লাইনগুলির মধ্যে তিনবার দুলাইনের মাঝখানের ফাঁকের চেয়ে বেশি ফাঁক কবিতার স্তবকবিভাজনের কথা মনে করিয়ে দেয় । প্রথানুসারী মুদ্রণবিন্যাসে উপস্থাপিত গদ্য/গল্প পাঠকপরিগ্রাহকের পঠনকে নিষ্ক্রিয়, নিশ্চেতন করে দেয় । বর্তমান রচনার ছেদচিহ্নহীন বিশেষ বিন্যাস ছন্দস্পল্দন আর ছাল্দিক বিরতি পঠনকে সক্রিয় করে তোলে । আর পূর্বোক্ত কবিতার স্তবকবিভাজনের মত বিভাজক সাদা ফাঁক বা বিরতি তিনবার কাহিনির ঘটনা বা / এবং পরিস্থিতির পরিবর্তন নির্দেশ করে বর্তমান কাহিনিটিকে চারটি অনুক্রমে বিভক্ত করেছে । এই অনুক্রমগুলির দীর্ঘ বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার অবকাশ আমাদের নেই, তাই আমরা এখানে শুধুমাত্র উক্ত অনুক্রমগুলির ভাষিক আপাত সংস্থানের কিছু উপাদানগত বৈশিষ্ট্যের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব । ভারতীয় সাহিত্যতত্ত্বে যে পাঠকদের ‘সহৃদয়’ বলে নির্দেশ করা হয়েছে সেই মনোযোগী পাঠকদের আলোচ্য কাহিনির সক্রিয় পঠনে সামান্যতম সহায়তা করতে পারলেই আমরা কৃতার্থ বোধ করব । ‘বলার আছে’ গল্পটির চারটি অনুক্রম:

.প্রথম/ প্রারম্ভিক অনুক্রম: [ কাহিনিবীজ: বলার আছে] আত্মবৃত্তান্তমূলক কাহিনির কথক অনন্য চরিত্র ‘আমি’‘বলতে চাওয়া’, না পারা,আকাঙ্ক্ষা — ‘আমার বলার আছে’… চেয়েছিদেয়নিকরেছি পারিনি… ‘আমি বলব’…‘আমি বলব বিরুদ্ধে’; স্থান:অনির্দিষ্ট; কাল : কালাতীত নিত্য বর্তমান (পরিস্থতি), সদ্যসমাপ্ত অতীত (নাস্ত্যর্থক প্রয়াস/ফল),ভবিয্যৎ (আকাঙ্ক্ষা)বিরোধ : আমি বম.সবাই (ব্যক্তি, আমি), সবকিছু (বস্তু, ভাব)

. দ্বিতীয়/ বিবর্তক অনুক্রম : [ কাহিনিবীজ: আমি বলব] কাহিনিকথক অনন্য চরিত্র ‘আমি’বলতে ‘চাওয়ার’ আবেশ, না পারা,আকাঙ্ক্ষা, আমির প্রতিবন্ধক:বস্তু,শরীর,স্থান : রাস্তা, পরিবেশ : রাস্তায় অনেক লোক, কাল/বিবর্তন: বলব, করব, লিখব (ভবিয্যৎ — প্রশ্ন, আকাঙ্ক্ষা), আছে, নেই, যায়… (কালাতীত নিত্য বর্তমান —পরিস্থতি/ অবস্থা), যাচ্ছে, উঠছে, নেমে পড়ছে… (অসমাপ্ত বর্তমান — বর্ণনা), করলাম, তাকাল না… (সমাপিত অতীত — ঘটনা), গেছি, গেছে (সদ্যসমাপ্ত অতীত — ফল)

. তৃতীয় / বিবর্তক অনুক্রম : [ কাহিনিবীজ: আমি লিখব, লিখেই সব বলব] ….

তৃতীয় অনুক্রমে ‘আমি’র ‘অন্যদের’ দেওয়া অবমাননা নীরবে সহ্য করে ঘরে ফেরা ।

. চতুর্থ অনুক্রমে বলতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার আবেশ, বলতে না পারার তীব্র যন্ত্রণা ক্রমশ এক শ্বাসরোধী দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে কাহিনিকথকের নিজস্ব বস্তুজগৎ, শরীরী অস্তিত্ব, সমগ্র সত্তা ছিন্নবিছিন্ন হয়ে অবাস্তব রূপ নিয়ে চাঁদের আলোয় ভাসতে লাগল, ঘরময় ঘুরতে লাগল । পরিসমাপ্তিসূচক এই অনুক্রমে ক্রিয়াপদের কাল অর্থসংকেতবাহী আর পরিসমাপ্তির দিকে কাহিনির গতিপথের নির্দেশক:

বর্ণনামূলক কালাতীত বর্তমান (দেখি), ঘটনার বিবরণ বোধক সমাপিত অতীত (বললাম না), আকাঙ্ক্ষা/পরিকল্পনা বোধক ভবিষ্যৎ (লিখব, বলব), ইচ্ছাবোধক ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা (হোক,যাক, বাড়ুক), অবস্থা বা নিত্যতা ভাবের (যৌগিক ক্রিয়ার) কালাতীত বর্তমান (শুয়ে থাকি, অপেক্ষা করতে থাকি,ভাবতে থাকি), কর্মবাচক যৌগিক ক্রিয়াবিশেষ্য (উঠে বসা, শুরু করা), ঘটনার বিবরণ বোধক সমাপিত অতীত: (যৌগিক ক্রিয়া, আরব্ধনিত্যতা ভাব — শুয়ে রইলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম; অবস্থা বা ঘটনা বোধক — হল, যৌগিক ক্রিয়া, সর্তসাপেক্ষ আরব্ধ ভাব — এলেওতাড়িয়ে দিলাম) , ফলাফল বোধক (যৌগিক ক্রিয়ার) সদ্যসমাপ্ত অতীত (ফিরে গেছে, শান্ত হয়েছে, ফাঁকা হয়েছে, [অবস্থা/বর্ণনা বাচক কালাতীত বর্তমান —থমকে আছে ] ভরে গেছে), আকাঙ্ক্ষা/পরিকল্পনা বোধক ভবিষ্যৎ (উঠব, জ্বালব, লিখব, বলব), অবস্থা বাচক কালাতীত বর্তমান (আছে), ঘটনাবাচক সমাপিত অতীত (পারিনি), আকাঙ্ক্ষা/পরিকল্পনা /সংকল্প বোধক ভবিষ্যৎ (পারব, পারতে হবে, উঠব ), প্রারম্ভিকতাবোধক (যৌগিক ক্রিয়ার) অসমাপিকা (উঠতে গিয়ে), বর্ণনামূলক কালাতীত বর্তমান (দেখি) আরব্ধভাব বাচক (যৌগিক ক্রিয়ার) সমাপিত অতীত (হয়ে গেল, সরে গেল, হয়ে গেল, হয়ে গেল), প্রারম্ভিকতাআরব্ধভাব বোধক অসমাপিকা (যৌগিক ক্রিয়া: সরে গিয়ে, সম্পূরক সহ মৌলিক ক্রিয়া: দুভাগ হয়ে), প্রারম্ভিকতানিরন্তরতা বোধক সমাপিত অতীত (ভাসতে লাগল), প্রারম্ভিকতাবোধক (যৌগিক ক্রিয়ার) অসমাপিকা (ধরতে গিয়ে, দাঁড়াতে গিয়ে, [ঘাড়] ঘোরাতে গিয়ে ), আরব্ধসমাপ্ত ভাব বাচক (যৌগিক ক্রিয়ার) সমাপিত অতীত (খসে গেল, হয়ে গেল, উঠে গেল), প্রারম্ভিকতানিরন্তরতা বোধক সমাপিত অতীত (ভাসতে লাগল), অবস্থাবর্ণনা বোধক সমাপিত অতীত (ছিল), প্রারম্ভিকতাপৌনঃপুনিকতা বোধক সমাপিত অতীত (ঘুরতে লাগল), অবস্থাবর্ণনা বোধক সমাপিত অতীত (ছিল), প্রারম্ভিকতাপৌনঃপুনিকতা বোধক সমাপিত অতীত (ঘুরতে লাগল)

সংকেতবিজ্ঞানের চতুর্ভুজকে কিছুটা পরিবর্তিত করে আমরা আলোচ্য গল্পের বিষয়বীজকে উপস্থাপিত করতে পারি

RAMA 1

ছেদচিহ্নের অনুপস্থিতি, কবিতার মতো ছোট ছোট বাক্যের ছন্দস্পল্দন অনুযায়ী লাইন সাজানো ধ্বনি, শব্দ, বাক্যাংশ ও বাক্যের পুনরাবৃত্তি, পরিগণনা ইত্যাদি শব্দালংকারের ব্যবহার গদ্যে তথা গল্পে এতকাল অপ্রত্যাশিত ধ্বনিময়তার ব্যঞ্জনাবৃত্তি তৈরি করেছে । রোমান য়াকবসন প্রস্তাবিত ভাষিক সংজ্ঞাপনের ছক অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি যে গদ্য গল্পে এখানে কাব্যবৃত্তি যুক্ত হয়েছে । রচনা হিসেবে গল্প বৃত্তান্তমূলক, বিবরণমূলক বা /এবং বর্ণনামূলক, কখনো অংশত কথপোকথনমূলক আর এর বিপরীতে কবিতা রচনা হিসেবে ধ্বনিময়, অলঙ্কৃতকাব্যিক । এ গল্পে এই শ্রেণীবিভাজন বিলুপ্ত । এই গল্পের ‘আমি’ চরিত্র আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিক পরিপ্রেক্ষিতে স্যমুয়েল বেকেট আর য়্যোজেন ইয়োনেস্কোর রচনার কিছু চরিত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয় । সূচনায় কিছু বলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার আবেশ থেকে পরিণতিতে ঘরের ভেতর বিছানা আর আসবাবপত্র সহ গল্পের আমি চরিত্রের টুকরো টুকরো হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে কি পরাবাস্তবতা রয়েছে না জাদুবাস্তবতা রয়েছে না এটা কোনো ফ্রয়েডীয় গূঢ়ৈষার স্বপ্নমাধ্যম প্রতিকী প্রকাশ তা পাঠকরাই স্থির করবেন ।

এর পর উদবর্তনের মধ্যে দিয়ে রমানাথ ক্রমশ এগিয়ে গেছে পরিণতির দিকে, সে উপলব্ধি করেছে লিখন বা/এবং রচনা সংজ্ঞাপন, সংজ্ঞাপনসংপ্রেষণ অক্ষের এক সীমান্তে রয়েছে সংপ্রেষকরচয়িতা আর অন্য সীমান্তে পাঠকপরিগ্রাহক। যে কোনো রচনার শুরুতেই পরিগ্রাহকপাঠকের সঙ্গে রচয়িতাসংপ্রেষকের একটা পঠনের চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, রচনালিখন যদি পাঠকের প্রত্যাশার দিগন্তের সঙ্গে সঙ্গতি বা সামঞ্জস্যহীন হয় অথবা তা যদি ওই দিগ্বলয়ের সীমা অতিক্রম করে যায় তাহলে শুরুতেই পূর্বোক্ত চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না বা চুক্তি ভেঙে যায় ( সহজ কথায় পাঠক পড়ে না বা পড়া বন্ধ করে দেয় )। দেশবিদেশের সাহিত্যের পঠ থেকে রমানাথ এই সত্যটা উপলব্ধি করেছিল । না, রমানাথ গতানুগতিক লেখার জগতে ফিরে গেল না, তার শাস্ত্রবিরোধী লিখনকে সংবেদনশীলভাবে আর প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত করতে থাকল । ক্রমশ শাস্ত্রবিরোধী গল্পআন্দোলনের বাহ্যিক উত্তাপআলোড়ন পেরিয়ে রমানাথের কাহিনিকথন পদ্ধতি আর তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত লিখন বিবর্তিত, স্থিতিশীল হতে থাকে, গড়ে ওঠে বাঙালি পাঠকের প্রত্যাশাপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রমানাথ রায়ের নিজস্ব কাহিনিকথনরীতি, তার নিজস্ব লিখন । রমানাথের এই নিজস্ব লিখন, অন্য সবার, জনপ্রিয় গতানুগতিক গল্পউপন্যাসের লিখন থেকে আলাদা, স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত, সদর্থে শাস্ত্রবিরোধী । রমানাথের লিখনের উদ্বর্তনপরিবর্তনে তার দেশবিদেশের সাহিত্যকর্মের সক্রিয় পঠনের আন্তরিক অভিজ্ঞতাও ফলপ্রসূ হয়েছিল

প্রসঙ্গত কিছু ঘটনা মনে পড়ছে বহুকাল ধরে আমি কলকাতায় থাকি না, কিন্তু কলকাতায় এলেই রমানাথ আমায় বলত, তুমি অঁদ্রে ব্রতোঁর ‘অ্যান্থোলজি অব ব্ল্যাক হিউমার’ বইটার অনুবাদ কর, পাবলিশার আছে । কলকাতায় ব্ল্যাক হিউমার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় বলে আমার জানা ছিল না । ‘য়ূমুর নোয়ার’ (humour noir) কথাটা অঁদ্রে ব্রতোঁ(André Breton) প্রথম ব্যবহার করেছিলেন । ১৯৩৯ সালে ব্রতোঁ ‘অঁতোলজি দ ল্যূমুর নোয়ার’ (Anthologie de L’Humour noir) প্রকাশ করেন, ইংরেজি ভাষার আইরিশ লেখক জনাথন সুইফটকে দিয়ে সংকলনটির শুরু, সুইফটকে ব্রতোঁ ব্ল্যাক হিউমারএর আদি গুরু বা প্রবর্তক (initiateur) বলে অভিহিত করেন । ১৯৬৬ সালে ব্রতোঁ কর্তৃক পরিমার্জিত বইটার দ্বিতীয় সংস্করণ আমার কাছে আছে । রমানাথ তা জানত । ইংরেজি অনুবাদে ও বইটা কিনে পড়েছিল । বাংলা ভাষায় ত্রৈলোক্যনাথের রচনায় কোথাও কোথাও এই ব্ল্যাক হিউমার দেখা যায়, ব্রতোঁর ভাষায় ‘ভাবালুতার মারাত্মক শত্রু’ (l’ennemi mortel de la sentimentalité)ব্ল্যাক হিউমার চরিত্রগতভাবে ভাবালু বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় না । রমানাথের বিভিন্ন রচনা এই ব্ল্যাক হিউমার দ্বারা চিহ্নিত (যেমন গল্প ‘কাঁকর’) । সাংস্কৃতিক সংলাপচারিতা (Dialogism)আর তার পরিণতিতে সংস্কৃতির বহুস্বর চরিত্রে আমার বিশ্বারয়েছে । তাই বেশ কিছু বছর ধরে কলকাতায় এলে এদেশে পশ্চিম থেকে আসা বিভিন্ন রীতিনীতি বা বস্তুর পাশাপাশি কিছু ধ্যানধারণার সঞ্চালনও আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে, যেমন আমি শুনতে পাই, উত্তরআধুনিকতা (আধুনিকোত্তর নয়, উত্তরআধুনিক /Postmodern), রচয়িতার মৃত্যু ( বার্তএর চিন্তা: পাঠকের জন্মের জন্য রচয়িতার মৃত্যুর মূল্য দিতে হবে / la naissance du lecteur doit se payer de la mort de l’Auteur .), জাদুবাস্তবতা (জার্মান magischer Realismusথেকে ল্যাটিন আমেরিকায় হিস্পানি realismo mágico, আবার তার ভাষান্তরিত ইংরেজি রূপে কলকাতায় ম্যাজিক রিয়ালিজম) আর বেশ কিছু শব্দ,নাম । পরাসাংস্কৃতিকতা তথা আন্তঃসাংস্কৃতিকতায় বিশ্বাসী রমানাথ যে খুবই আগ্রহের সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য পড়ছে ( Jorge Luis Borges, Miguel Ángel Asturias, Julio Cortázar, Gabriel García Márquez) তা তার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম । নিজের উদবর্তিত লিখনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রমানাথ জাদুবাস্তবতাকেও তার কাহিনিকথনের অন্যতম কৌশল হিসেবে গ্রহণ করল (দৃষ্টান্ত: অমুকচন্দ্র অমুক)

কলকাতায় এলে বাংলাভাষায় লেখালেখির জগতের তরুণদের মুখে বারবার ল্যাটিনআমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজম ম্যাজিক রিয়ালিজম শুনে কান কিছুটা ঝালাপালা হয়। তাই এখানে একটা কথা যোগ করার ইচ্ছে হচ্ছে। আস্তুরিয়াস আর মার্কেসএর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ল্যাটিন আমেরিকার লেখকসমালোচকরা জোরগলায় প্রচার করতে থাকলেন যে কাহিনিতে জাদুবাস্তবতার ব্যবহার, এক কথায় জাদুবাস্তবতাবাদ তাঁদের আবিষ্কার । তাদের দাবি আমাদের দেশেও স্বীকৃত । এ নিয়ে কোনো বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে আমি বলতে পারি যে সাহিত্যে এক ধরনের জাদুবাস্তবতা প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান । রামায়ণ, মহাভারত, কথাসরিত্সাগর, বেতালপঞ্চবিংশতির অনেক কাহিনিতে জাদুবাস্তবতাবাদের ব্যবহারের কথা না হয় বাদ দিলাম । ইয়োরোপীয় ধ্রুপদী যুগের ( রাবলে) কথাও নাহয় তুললাম না। তবু এই মুহূর্তে আমার সামনের ব়্যাকে একটা বই চোখে পড়ছে, মার্সেল এইমে(Marcel Aymé)গল্প সংকলন, ‘প্রাচীরভেদী’ (Le passe-muraille,১৯৪৩ সালে প্রকাশিত) । প্রথম গল্পের শিরোনামেই গল্পের বইটির নাম । এই প্রথম গল্পটির সংক্ষিপ্তসার হল: দ্যুতিয়ল নামে একজন অধস্তন সরকারি কর্মচারী একদিন আবিষ্কার করল যে সে দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারে । এই ক্ষমতার জন্য সে কর্মক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পেল । কিন্তু তারপর একদিন একটা বড় দেয়ালেরভেতরে মাঝখানে এসে সে বুঝতে পারল তার দেয়াল ভেদের ক্ষমতা উধাও, তখন ওখানেই সে তার জীব্ন্ত সমাধি লাভ করল। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত ফ্রানত্স্ কাফকা( Franz Kafka) গল্প ‘রূপান্তর’ (জার্মান : Die Verwandlung,ইংরেজি অনুবাদে: The Metamorphosis, The Transformation), বা মার্সেল এইমের পূর্বোক্ত রচনা সহ বেশ কিছু রচনা, ইতালো কালভিনো (Italo Calvino)-র কিছু লেখায় যা দেখা যায় তাকে জাদুবাস্তবতা বললে কী ভুল বলা হবে । ত্রৈলোক্যনাথের নেই আঁকুরে দাদার গল্পে ব্ল্যাক হিউমারের (বসন্ত রোগে আক্রান্ত সারা গায়ে বাটা চন্দন মাখানো নেই আঁকুরে দাদাকে ধরে যমালয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যমদূতদের তিনদিন ধরে ‘পিছলাপিছলি খেলা’) সঙ্গে জাদু বাস্তবতার মিশ্রণ ঘটেছে ।

ভাষিক রচনা সংজ্ঞাপন। তাই রোমান য়াকবসনএর ‘ভাষাতত্ত্ব ও কাব্যতত্ত্ব’ (Linguistics and poetics) প্রবন্ধে প্রস্তাবিত সংজ্ঞাপনসংপ্রেষণের রেখাচিত্রের কথা মনে রেখে ভাষিক রচনার বর্গ হিসেবে গল্পউপন্যাসের প্রাথমিক উপাদানগুলিকে আমরা সংজ্ঞাপনসংপ্রেষণের অক্ষে স্থাপন করতে পারি :

RAMA 2

এবার সংক্ষেপে রমানাথের লিখনের উদ্বর্তনপরিবর্তন আর তারই সঙ্গে তার রচনার সাধারণ চরিত্রলক্ষণ বোঝার চেষ্টা করা যাক। রমানাথের রচনার লিখনের পরিবর্তন দেখানোর জন্য তার ‘এই দশকের’ কালের (ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি) গদ্য () আর তার পরবর্তী কালের গদ্যের দৃষ্টান্ত () উপস্থিত করছি:

() . জানি বলতে গেলে আমার চারফুট দেহ দেড় ফুট হয়ে যায়

জানি আমার হাত হারিয়ে যায়

জানি কাপড়ে আমার পা জড়িয়ে যায়.

জানি আমার চুল ঝরে যায়

জানি আমার জিভ নাড়াতে পারি না

জানি আমার দাঁত আলগা হয়ে যায়

তবু আমাকে বলতে হবে

আমি বলব

আমার কিছু বলার আছে

র এই তার উপযুক্ত সময়

এখন রাস্তায় অনেক লোক

এদের মধ্যে বুড়ো আছে বুড়ি আছে যুবক আছে যুবতী আছে কিশোর আছে কিশোরী আছে বালক আছে বালিকা আছে

(বলার আছে)

. এবার সামনে নয়, পাশে । দু পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। দরজা। বন্ধ দরজা। উঁচু দরজা। আর দুটোর মত উঁচু। সমান সমান। গায়ের রংটাও একরকম। হলদে। কিন্তু এবাক কি করব? আগের মত শব্দ করব? অপেক্ষা করব? না, এখন ভাবা দরকার। কিছু করার আগে কিছু ভাবা দরকার। আগের বার ভাবিনি। ভাবিনি বলে হাত তুলতে হল। হাত নামাতে হল। পা তুলতে হল। পা নামাতে হলব্যথা এখনো মরেনি। এখনো আছে। একটু শুলে হত। শুলে ব্যথা মরে যেত। কোথায় শোব? ঘরে। ঘরে শুতে হলে ফিরে যেতে হবে। ঘরে ফিরে যেতে পারি। তবে ফিরলে কি বেরোতে পারব? ঘরে পালক আছে। আমসত্ত্ব আছে। ছুরি আছে। ব্যাঙবাজী আছে। ঘরে গেলে কানে পালক দিতে ইচ্ছে করবে। আমসত্ত্ব খেতে ইচ্ছে পারবে। গা চুলকোতে ইচ্ছে করবে। ব্যাঙবাজী বাজাতে ইচ্ছে করবে। পালক ছেড়ে আসতে পারব না। আমসত্ত্ব ফেলে আসতে পারব না। ছুরির জন্যে মন খারাপ করবে।

(সাক্ষাত্কার)

. হাঁটতে হাঁটতে আমার ইচ্ছে হল কারো বাড়ি যাই, গিয়ে গল্প করি। কিন্তু মিস্টার দত্ত, বিভু ও দোকানদারের কথা মনে হতেই কোথাও যেতে পারলাম না। মনে হল যার কাছেই যাব তার কাছ থেকে হয়ত আবার সেই এক খোঁচা খেতে হবে। শুনতে হবে, আমি বিয়েথা করিনি। অতএব কত সুখে আছি। এসব কথা কেন আমি যেচে শুনতে যাব? তার চেয়ে বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকাই ভাল। জানলার পাশে বসে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, লোকজন দেখা ভাল। কিন্তু বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে হল না। আমি চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে মনটা এক সময় খারাপ হয়ে গেল। আমার মার কথা মনে পড়ল। মা যদি এই সময় বেঁচে থাকত তাহলে আমার কোন কষ্ট হত না। এভাবে বেঁচে থাকা যে কি বিচ্ছিরি তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অবশ্য আমি ইচ্ছে করলে বিয়ে করতে পারতাম। মাও বেঁচে থাকতে কতবার সেকথা বলেছিল।

(ভালবাসা চাই)

. আমার স্ত্রীর নাম অলকা । আমার নাম নরেন্দ্র । আমরা সাতের বি সদানন্দ রোডের দোতলায় বাঁদিকের ফ্ল্যাটে থাকি । আমাদের ফ্ল্যাটে একটা বসবার ঘর, দুটো শোবার ঘর, একটা খাবার ঘর । এই ফ্ল্যাটে আমরা দুজন ছাড়া এক বিধবা থাকে । সে রান্না করে, বাসন মাজে, কাপড় কাচে । অলকা শুধু বিছানায় চাদর পাতে, আলনায় কাপড় গুছিয়ে রাখে । আর বসে বসে চুল আঁচড়ায়, রেডিও শোনে । আমি সকালে অফিসে যাই, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি । আমি অলকাকে ভালবাসি, অলকা আমাকে ভালোবাসে । আমরা একঘরে এক খাটে পাশাপাশি শুই । আমাদের মাথার ওপর একটা পাখা ঘোরে । আমরা মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াই, সিনেমা দেখি, নেমন্তন্ন খেতে যাই । আমরা সবসময় গল্প করি । বসে বসে গল্প করি, শুয়ে শুয়ে গল্প করি । আমাদের কথা ফুরোয় না ।

একদিন সন্ধেবেলা বাবু এসে সোনাকে জোর করে নিয়ে চলে গেল । আমরা কত করে বললাম । বাবু আমাদের কারো কথা শুনল না । আমরা চুপচাপ কিচুক্ষণ বসে রইলাম । তারপর পাশাপাশি শুয়ে পড়লাম । কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না । আমাদের আর কোনো কথা নেই । কথা শেষ । মাথার ওপর শুধু পাখা ঘুরতে লাগল ।

(ঘর সংসার)

) গল্পের গদ্য এখানে ছন্দলয়যুক্ত তার ফলে কাব্যবৃত্তিপ্রধান, বিবরণমূলক হলেও এই গদ্য শব্দ বা বাক্যের পুনরাবৃত্তিতে ধ্বনিময়, অলঙ্কৃতকাব্যিক (সাধারণভাবে বাংলায় ‘কাব্যিক’ বললে বোঝায় ‘ভাবালু’ যা কাব্যবিরোধী। অলংকৃতকাব্যিক বলতে আমি rhetorical-poetic বোঝাতে চেয়েছি) । লক্ষ্যণীয় বাক্যগুলির বেশির ভাগ সরলবাক্য, প্রথম দৃষ্টান্তে জানি দিয়ে শুরু যে কটি জটিল বাক্য আছে সেগুলি ন্যূনতম গঠনের। কোনো বিমূর্ত ভাববাচক বিশেষ্য বা গুণবাচক বিশেষণ নেই । একই গঠনের বাক্যের পুনরাবৃত্তি আবেশের নির্দেশক। এখানে কালানুক্রমিক কোনো ঘটনার অগ্রগতি বা পশ্চাদগতি নেই অর্থাৎ কোনো কথাবস্তু বা প্লট নেই। এখানে বিবরণের গতি বৃত্তাকার।

) অংশের গদ্যে সরল বাক্যের সংখ্যা বেশি হলেও বিবরণের প্রয়োজনে যৌগিক ও জটিল বাক্যও রয়েছে, তা রচনা অনুসারে রচনার মোট বাক্যের শতকরা দশ থেকে পনেরো ভাগ (প্রথমবার ভোট দিতে গিয়ে দেখি আমার হয়ে আগেই একজন ভোট দিয়ে গেছে। ফাঁসির আগের দিন। রান্নার লোক আছে, বাসন মাজার লোক আছে, ঘর মোছার লোক আছে ।আর কাপড় কাচার জন্যে আছে ওয়াশিং মেশিন ।খুশি ও রকি । তার পর ভাবলাম, সত্যি কথা বলাটা বোধহয় উচিত হবে না ।বললে পিয়ালির বাবা আমার সঙ্গে পিয়ালির আর বিয়ে দেবেন না। — অমুকচন্দ্র অমুক) । অনতিদীর্ঘ সরল বাক্যগুলির (কর্তৃপদ ‘আমি’ বা ‘আমার’ হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা উহ্য) দৈর্ঘ্য আর অনেক ক্ষেত্রে সমান্তর গঠন রমানাথের গদ্যে গতিময় ছন্দলয় সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে রমানাথ যে সচেতন তার প্রমাণ রয়েছে। ওপরে খুশি ও রকি গল্প থেকে উদ্ধৃতিতে কমা দ্বারা সংযোজিত তিনটি সরল বাক্যের সমবায়ে একটি যৌগিক বাক্য রয়েছে। তার পরে রয়েছে বাক্যসমাপক দাঁড়ি। দাঁড়ির পর অনুবর্তন বাচক এছাড়া’অর্থে সংযোজক অব্যয় আরদিয়ে শুরু একটি সরল বাক্য: আর কাপড় কাচার জন্যে আছে ওয়াশিং মেশিন। প্রথমত দাঁড়ি তুলে দিয়ে এই বাক্যটিকে পূর্ববর্তী যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত করা যেত। দ্বিতীয়ত এই সরল বাক্যটিতে সচেতনভাবে স্বাভাবিক অন্বয় (আপাত কর্তৃপদ + ক্রিয়া + সম্পূরক) পালটানো হয়েছে (সম্পূরক + ক্রিয়া +আপাত কর্তৃপদ)এর উদ্দেশ্য অনুভূত ছন্দলয়ে সুরবৈচিত্র্য আর বিশেষ ধরনের স্বরক্ষেপ সৃষ্টি করা।এই ছন্দলয় তার আগের (ক অংশের) গদ্যের কাব্যবৃত্তিময় ছন্দলয় নয়, কিন্তু তারই ধারাবাহী, তারই বিবর্তিত রূপ (১৯৭৩ সালের উপন্যাস ‘সাক্ষাত্কার’ আর ১৯৯৩ সালের উপন্যাস ‘ভালবাসা চাই’এর দুটি অংশ এর দৃষ্টান্ত)। বিমূর্ত ধারণাবাচক বিশেষ্য, গুণবাচক বিশেষণ, বাক্যের সম্প্রসারক, বিশেষ্য আর ক্রিয়াপদের সম্পূরক (সম্বন্ধ, করণ, অপাদান বা অধিকরণ সম্পূরক) সংখ্যা খুবই কম থাকায় রমানাথের গদ্য, অন্যভাবে বলা যায় রমানাথের কথাসাহিত্যিক বাচন তার ক্ষিপ্র গতিময়তায় দ্বারা স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত হয়েছে । এছাড়া এই গদ্যে বাংলা ভাষার বাক্যের সাধারণস্বাভাবিক অন্বয় (বিদ.+ ক্রিদ.) খুব কম ক্ষেত্রেই লঙ্ঘন করা হয়েছে । সব মিলিয়ে রমানাথের গদ্য আলাদা ভাবে চেনা যায়। ঐ নমনীয় গদ্য নিম্ন মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবন, বার্ধক্যের নিসঃঙ্গতা (যেমন, ঘর সংসার, তিনতলার ঘর, বউ রান্না করে), ব্যঙ্গ,(নমস্কার ভালোবাসা) তিক্ত রসিকতা , ক্রোধ, (বিদ্যাসাগর ও ভানু পাল ), ব্ল্যাক হিউমার (রঙিন টিভি, কাঁকর, রাখাল বসুর ইচ্ছাপুরণ ) বিভিন্ন বিষয়ের প্রকাশে সক্ষম। ক) পর্বের রচনার শিরোনাম রচনাগুলির পরিচয়পত্র বা লেবেলমাত্র, উপরচনা হিসেবে তার কোনো ভূমিকা নেই, তার পরবর্তী রচনাগুলির শিরোনাম পাঠকপরিগ্রাহকের পঠনের দিগনির্দেশক। আমরা সংক্ষেপে রমানাথের আরেকটি গল্পের বিন্যাস পরীক্ষা করতে পারি। গল্পটিরঘর সংসার’ শিরোনাম পাঠককে কাহিনির সীমা আর পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে গল্পটির পঠনের জন্য প্রস্তুত করে :

কথাসাহিত্যিক রচনা: বর্গ: গল্প

উপরচনা: শিরোনাম: ঘর সংসার

কহিনিকথক: উত্তমপুরুষ

দৃষ্টিকোণ: মিশ্র

চরিত্র: আমি (নরেন্দ্র) অলকা বাবু সোনা

বৃত্তান্ত: আন্তর্বৃত্তান্তমূলক, আত্মবৃত্তান্তমূলক, অনন্যবৃত্তান্তমূলক

স্থান: সদানন্দ রোড (কলকাতা শহর)

কাল : প্রারম্ভিক অনুক্রমে আখ্যানের সমান্তরাল: কালাতীত বর্তমান, পরের অনুক্রমগুলিতে: সমাপিত অতীত: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাব (aspect) বাচক যৌগিক ক্রিয়া, নিত্যবৃত্ত অতীত (হত, আসত, যেতাম…),পুরাঘটিত অতীত (এসেছিল…), পরোক্ষ উক্তিতে অতীতভবিষ্যৎ ( আসবে,করবে…), পরোক্ষ উক্তিতে সদ্যসমাপ্ত অতীত (হয়েছে. বলেছে…)

.প্রথম বা প্রারম্ভিক অনুক্রম : শান্ত ঘটনাহীন নিম্ন মধ্যবিত্ত দম্পতির জীবন

বিবর্তন : একঘেয়েমির ক্লান্তি

..পরিবর্তন: ছেলে — উত্সাহ উদ্যোগ —

.২ ছেলের বড় হওয়া — ব্যবধান: প্রজন্মের তফাত

.. বিচ্ছেদ

.নাতি: জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া

. অবসর: শূন্যতা নাতিকে নিয়ে জীবন

সমাপ্তির আশভঙ্গ

রমানাথ কোনো অর্থেই বাস্তববাদী লেখক নয় ।তাই তথাকথিত বাস্তবের প্রতিরূপ দেখানোর কোনো ভনিতা তার নেই, কল্লোলীয় আন্দোলনের (?) উত্তরাধিকার অনুসরণ করে বিশেষ করে কিশোরকিশোরীদের কাছে আকর্ষণীয় রগরগে যৌনতা নেই ।অথবা নিম্ন মধ্যবিত্তের সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী জীবনসংগ্রামের ক্লিশেও তার রচনায় পাওয়া যাবে না ।তবে বিভিন্ন কাহিনির আপাতসংস্থানে ‘বাস্তবের আবহ’ যোগ করার জন্য কাহিনির দিক থেকে অপ্রয়োজনীয় কিছু উপকরণ ব্যবহার করে সত্যসাদৃশ্য তৈরি করা হয়েছে (যেমন ‘ঘর সংসার’ গল্পে আমরা সাতেরবি সদানন্দরোডের দোতলায় বাঁদিকের ফ্ল্যাটেথাকি।’এই ঠিকানা বা ‘দু ঘন্টার ভালোবাসা’ গল্পে ‘মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলাম’)

রমানাথের এই দশকের আমলের গল্পউপন্যসের বেশির ভাগের কাহিনিকথক উত্তমপুরুষ। এর পরে কথাসাহিত্যিক রচনার কাহিনিকথনে রমানাথ বেশির ভাগ প্রথম পুরুষের কণ্ঠস্বর ব্যবহৃত। তার কাহিনির আলোকায়ন বা দৃষ্টিকোণও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে । তা কাহিনির প্রয়োজনে অন্তঃস্থ,বহিঃস্থ, সর্বব্যপ্ত বা মিশ্র। রমানাথের গল্পউপন্যাসের চরিত্ররা বাঙালি, মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত কলকতার তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি । তাদের বেশিরভাগ মাঝারি ধরনের সাধারণ চাকুরে, স্কুলমাস্টার । তাদের মধ্যে দু একজন রাজনীতি করেন, এমনকী মন্ত্রীও রয়েছেন । তবে এর মধ্যে বড় ব্যবসায়ী, প্রযুক্তিবিদ, বৈজ্ঞানিক, গবেষক ইত্যাদি প্রায় নেই । বলা যায় রমানাথের সৃষ্ট চরিত্ররা আর বাংলা ভাষার সাহিত্যের পাঠকগোয্ঠী বাঙালি সমাজের একই স্তরের মানুষ । তার ফলে রমানাথের কাহিনির পরিপ্রেক্ষিত স্থান (কলকাতা), কাল (এই সময় — রাজ নারায়ণ বসুর ভাষায় ‘একাল’) ও পাত্র (পাঠকের চারপাশের মানুষ) রচনার সম্ভাব্য পাঠকপরিগ্রাহকের কাছে অপরিচিত নয় । ব্যঙ্গ, রসিকতা, কাহিনিকথনের নানা কৌশল, নিপুণ ভাষাব্যবহার, স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত লিখন সবকিছুর গভীরে একটা বিষণ্ণতার অনুভূতি ছড়িয়ে রয়েছে। সেই বিষণ্ণতা সমাজের পুরনো মূল্যবোধগুলি ভেঙে যাওয়ার (বিয়ে করেছ করেছিলাম। কিন্তু টেকেনি।আমার বিয়েও টেকেনি। আজকাল বিয়ে চুক্তি করে করা উচিত। — রাস্তায় হঠাৎ, একটা গল্প বলি ), আদর্শহীন রাজনীতি (ফুঃ, বিদ্যাসাগর ও ভানুপাল )বিচ্ছিন্নতার (লোলা), নিঃসঙ্গতার (ঘরসংসার, দুজন) বিষণ্ণতা। ‘মানুষ এখন দুঃখ পেতে ভালোবাসে না। দুঃখ নিয়ে মজা করতে ভালোবাসে।তারপর তারা হো হো করে হেসে উঠল।’ এই উক্তি, এই হাসি যেন নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার, বিষণ্ণতাকে ভুলে যাওয়ার বিযন্ন, করুণ চেষ্টার প্রতিধ্বনি। বস্তুত রমানাথের বেশ কিছু কাহিনির আপাত পরিচিত চরিত্রগুলি আস্তে আস্তে চারদিকের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, অপরিচিত হয়ে ওঠে।এই বিচ্ছিন্ন চরিত্রগুলির বিষণ্ণ একাকিত্ব রমানাথের কলকাতাকে আচ্ছন্ন অপরিচিত করে তোলে।

পরিভাষা

আন্তর্বৃত্তান্তমূলক intradiegetic

আত্মবৃত্তান্তমূলক autodiegetic

অনন্যবৃত্তান্তমূলকhomodiegetic

অধিরাচনিক metatextual

ন্তঃসাংস্কৃতিকintracultural

আন্তঃরাচনিক intertextual

আন্তঃরাচনিকতা intertextuality

আন্তঃসাংস্কৃতিক intercultural

আন্তঃসাংস্কৃতিকতা interculturality

আপাত সংস্থানsurface structure

আলোকায়ন focalization

উপরচনা paratext

কাব্যবৃত্তি poetic function

ক্রিদ. ক্রিয়াদল verb phrase

ছন্দলয় cadence

ছাল্দিক বিরতি metric pause

দৃষ্টবাদ Positivism

পঠন reading

পঠনের চুক্তি pact of reading

পরিগণনা enumeration

পরিগ্রহণ reception

পরিগ্রাহক receiver

পরিসাংস্কৃতিকতা transculturality

পাঠ reading

প্রত্যাশার দিগন্ত Erwartungshorizont, horizon of expectation

প্রদর্শক exhibitionist

বম.=বনাম vs =versus

বর্গ genre

বহুস্বর polyphony

বাস্তবের আবহ l’effet de réel(R. Barthes)

বিদ. বিশেষ্যদল noun phrase

ভাব (ব্যাকরণ, যাস্ক: নিরুক্ত) aspect (grammar)

মিথস্ক্রিয়া interaction

রচনা text

রচয়িতা author

লিখন writing

লেখক writer

সংকেতবিজ্ঞান Semiotics

সক্রিয় পঠন active reading

সংজ্ঞাপন communication

সত্যসাদৃশ্য verisimilitude

সংপ্রেষণ emission

সম্পূরক complement

সম্প্রেষক sender, emitter

সংস্থান structure

Blaise Cendrars: Poèmes, Traduction en bengali: Pushkar Dasgupta (Deuxième série) Blaise Cendrars: Poems translated into Bengali by Pushkar Dasgupta (Second series) ব্লেজ সঁদ্রার : কবিতা (দ্বিতীয় পর্ব) অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত (প্রথম পর্ব এর আগে উপস্থাপিত হয়েছে)

Bahuswar | বহুস্বর

Blaise Cendrars: Poèmes,

Traduction en bengali: Pushkar Dasgupta

(Deuxième série)

Blaise Cendrars: Poems

Translated into Bengali by Pushkar Dasgupta

(Second series)

ব্লেজ সঁদ্রার:কবিতা

অনুবাদ : পুষ্কর দাশগুপ্ত

(দ্বিতীয় পর্ব)

ডাইরি(Journal)


খ্রিস্ট

আমার আগের আগের কবিতা ‘ইস্টার’ লেখার পর থেকে

এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল তোমার কথা আমি আর ভাবি

                                                                  নি

ইতিমধ্যে আমার জীবনটা অনেকটাই পালটে গেছে

অথচ আমি চিরকাল সেই একই রয়ে গেছি

এমন কী আমি চিত্রশিল্পী হব বলে ভেবেছিলাম

আজ সন্ধ্যায় ঐ যে আমার আঁকা ছবিগুলো দেয়ালে ঝুলছে

ঐ ছবিগুলো আমার কাছে আমার নিজের সম্পর্কে এমন সব

                                               …

View original post 6,915 more words

Blaise Cendrars: Poèmes, Traduction en bengali: Pushkar Dasgupta (Première série) ব্লেজ সঁদ্রার : কবিতা , অনুবাদ : পুষ্কর দাশগুপ্ত ( প্রথম পর্ব) Blaise Cendrars: Poems Translated into Bengali by Pushkar Dasgupta (First series)

Bahuswar | বহুস্বর

ব্লেজ সঁদ্রার: কবিতা / Blaise Cendrars : Poèmes
(
প্রথম পর্ব / Première série)



অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত / Traduits par Pushkar Dasgupta /Translated by Pushkar Dasgupta

Toute vie n’est qu’un poème, un mouvement. Je ne suis qu’un mot, un verbe, une profondeur dans le sens le plus sauvage, le plus mystique, le plus vivant.

Blaise Cendrar

[প্রত্যেকটি জীবন একটা কবিতা, একটা গতি ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ সবচেয়ে আদিম, সবচেয়ে মরমি, সবচেয়ে জীবন্ত অর্থে আমি হলাম একটা শব্দ, একটা ক্রিয়াপদ, একটা গভীরতা ৷

ব্লেজ সঁদ্রার]

উনিশ শতকের ইয়োরোপীয় আধুনিক কবিতার প্রথম উদ্গাতা হলেন শার্ল বোদলের (Charles Baudelaire, ১৮২১-১৮৬৭) ৷ রোমান্টিক কাব্যান্দোলনের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বোদলের যাত্রা শুরু করেছিলেন কাব্যিক অন্বেষণের নতুন এক দিগন্তের রোমান্টিক কাব্যান্দোলনের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বোদলের যাত্রা শুরু করেছিলেন কাব্যিক
অন্বেষণের নতুন এক দিগন্তের অভিমুখে ৷ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকেরর শুরু অব্দি ‘প্রতিকীবাদী’ বলে চিহ্নিত কবিদের রচনায় এই আধুনিক…

View original post 8,492 more words