জ্যাভিয়ার থেকে টেরিজা
ভারতে পশ্চিমি খ্রিস্টধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের রণকৌশল১
From Xavier to Teresa: Strategies of the Imperialist Invasion of the Western Christianity in India
De Xavier à Térésa : stratégies de l’invasion impérialist du Christianisme occidentale en Inde
১. ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ও আমি
আমার বিশ্বাস আপনারা যদি আপনাদের চিন্তাশক্তির স্বাভাবিক আলোককে অনুসরণ করেন তাহলেই অন্তত আমার মতো স্পষ্ট আর দ্বিধাহীনভাবে দেখতে পাবেন যে পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম হল মানুষের উদ্ভাবনমাত্র, আর আপনার ধর্ম আপনাকে যা কিছু শেখায় তা আসলে ভুল, মিথ্যাচার, মোহ এবং প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
— জঁ মেসলিয়ে২: ইষ্টপত্র৩৻
ধর্ম সম্পর্কে লুক্রিসিয়াস৪–এর মতই হল আমার নিজের মত ধর্মকে আমি ভয় থেকে জন্মানো একটা রোগ এবং মানবজাতির অবর্ণনীয় দুঃখ–দুর্দশার কারণ বলে মনে করি।
— বার্টান্ড রাসেল: সভ্যতায় কি ধর্মের কোনো মূল্যবান অবদান রয়েছে? ১৯৩০৫
লোকায়তপ্রস্থানে বিশ্বাসী আমি মানবিকতাবাদী নাস্তিক, কোনো ধর্মের সঙ্গে আমার কোনো মানসিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই ৷ না, খ্রিস্টধর্মের প্রতিও আমার আলাদা কোনো বিশেষ প্রীতি বা বিদ্বেষ নেই ৷ আমার ধারণায় খ্রিস্টধর্ম ঈপ্সাপূরক কল্পনায় তৈরি করা কোনো এক ‘ত্রাতা’ জিশুকে ঘিরে কয়েক শতক ধরে গড়ে তোলা ধর্মমত এবং তা তাবৎ ধর্মমতের মতোই অন্ধ বিশ্বাস–ভিত্তিক কুসংস্কারের বান্ডিল ৷ আর পাঁচটা ধর্মের মতোই খ্রিস্টধর্মেরও মূলধন হল দুর্বল মানুষের অজ্ঞাত আর অজ্ঞেয় ভবিষ্যৎ এবং মৃত্যুর ভয় ৷ লোকায়ত বিচার–অনুযায়ী বেদের ‘কর্তা’ হলেন (অর্থাৎ নির্মাতা বা রচয়িতা) ‘ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর (অর্থাৎ মনুষ্যসমাজের ক্ষতিকারক রাক্ষস)’৬ ৷ একইভাবে আমি খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের পুরাতন বিধান তথা নববিধানের রচয়িতাদের ‘ভণ্ড, ধূর্ত’ মানবাধিকারের শত্রু প্রতারক বলে বিবেচনা করি ৷
আমি নাস্তিক অথচ আমার বর্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হল ধর্ম, যথাযথভাবে ভারতে খ্রিস্টধর্মীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহাসিক রূপ ও রূপান্তর, তার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ থেকে নয়া–ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদে উদ্বর্তন ৷ কেন এই বিষয়? তার কারণ কী বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই বিষয়টি আমাকে চিন্তিত করেছে ৷ বস্তুত এই বিষয়কে কেন্দ্র করে আমার উপলব্ধি একাধিক ৷
প্রথমেই যেকথা আমার মনে হয়েছে তা হল: পাশ্চাত্যের খ্রিস্টধর্ম প্রভাবিত ঔপনিবেশিক শিক্ষার ফলস্বরূপ আমরা পাশ্চাত্য তথা তার জীবনযাপন, ভাষা, শিল্পসাহিত্য, রীতিনীতি, ধর্ম সবকিছু সম্পর্কে হীনমন্যতায় ভুগি ৷ তাই পাশ্চাত্যের খ্রিস্টধর্মীয় কুসংস্কার, মৌলবাদ৭, জাত্যহংকার সম্পর্কে কখনো প্রশ্ন তুলতে পারিনা ৷ আর পাশ্চাত্যের বিপুল প্রচারযন্ত্রের মস্তক ধোলাইয়ের ফলে তথা ঔপনিবেশিতের হীনমন্যতার মানসিক নিয়ন্ত্রণে আমরা ধরে নিই তাবৎ কুসংস্কারের আধার হলাম অখ্রিস্টান আমরা, অর্থাৎ আমরা অখ্রিস্টান অইয়োরোপীয় ভারতীয়রা ─ দেবদেবতা, শাখা–সিঁদুর, পুজো–আচ্চা, তীর্থযাত্রা, পাঁজি, জ্যোতিষ, ইত্যাদি, ইত্যাদি; বিপরীতে পাশ্চাত্য হল গিয়ে আলোকায়িত, যুক্তিবাদী, তার ধর্ম, আচার–বিচার সবই যুক্তি–নিয়মিত ৷ আমরা ভাবতে পারিনা বা বলতে সাহস পাই না আসলে ধর্ম মানেই বিচারহীন বিশ্বাস, প্রশ্নহীন বশ্যতা, যুক্তিহীন কুসংস্কার ─ তা হিন্দু হোক, ইসলাম হোক কি খ্রিস্টধর্ম হোক বা অন্য যেকোনো ধর্মই হোক না কেন ৷ এছাড়া বলা দরকার, ধর্ম মানেই কম বেশি বিভেদ আর বৈষম্য, ধর্ম মানেই জাত্যহংকার, ধর্ম মানেই অন্যকে অস্বীকার আর ঘৃণা ৷ খ্রিস্টধর্মের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি ৷ খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র হল তথাকথিত ঈশ্বরপুত্র ঈশ্বর ন্যাজারেথ–এর জিশু ৷ ঐ ন্যাজারেথ–এর জিশুর অস্তিত্ব অযোধ্যার রাম বা বৃন্দাবনের কৃষ্ণের মতোই প্রধানত লোকবৃত্ত–ভিত্তিক, কোনো অর্থেই ঐতিহাসিক নয়৮, এমনকী জিশুর জন্মদিন বলে কথিত ২৫–এ ডিসেম্বর (কৃষ্ণের জন্মদিন জন্মাষ্টমীর মতোই) কল্পিত আর খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতার চাপিয়ে দেওয়া খ্রিস্ট অভিধার সঙ্গে জড়ানো অব্দের সঙ্গে জিশুর কোনো বাস্তব সম্পর্ক নেই৯ ৷ এছাড়া তাবৎ ধর্মের মতোই খ্রিস্টধর্মের ধর্মতত্ত্ব, আচার–অনুষ্ঠান, জীবনচর্যা একান্তভাবে বিচারহীন বিশ্বাস–ভিত্তিক ৷ আর এই বিশ্বাস অন্ধ, এই বিশ্বাসের অবস্থান হল যুক্তির বিপ্রতীপ অক্ষে ৷
খ্রিস্টীয় পাশ্চাত্যের প্রচারে খ্রিস্টধর্ম ছাড়া আর সব ধর্মই হল কুসংস্কারমাত্র৯ ৷ অথচ মানবীর গর্ভে ঈশ্বরের পুত্র ঈশ্বর জিশুর জন্ম, জিশুর মা মেরির অপাপবিদ্ধ গর্ভধান, মানুষের আদি পাপের উত্তরাধিকার, স্বর্গচ্যুত দেবদূত শয়তানের ঈশ্বর–বিরোধী, জিশু–বিরোধী কাণ্ডকারখানা, ‘ত্রাতা’ জিশুর স্মরণ নিলে মোদ্দা কথা, খেরেস্তান হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই, ইহ জীবনে কিছু হোক বা না হোক টেসে যাওয়ার পর গোরের মাটির তলায় পোকামাকড়ের পেটে যাওয়ার পর শেষ বিচারের অন্তে স্বর্গে নিশ্চিন্ত অনন্ত জীবনের পুরস্কার ইত্যাদি অনেক খ্রিস্টধর্মীয় গল্পকথা যেকোনো ধর্মীয় পুরাণের কাহিনির মতোই স্রেফ গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না ৷ এছাড়া খ্রিস্টধর্মের ‘পবিত্র’ সংস্কার (স্যাক্রামেনটস্/Sacraments) অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন সংস্কারের মতোই যুক্তিহীন কুসংস্কার–নির্ভর যেমন নরমাংস–ভক্ষণের আদিম কৌল আচারের স্মৃতিবাহী খ্রিস্টযজ্ঞ (ইউকারিস্ট/Eucharist), আদি পাপ মোছা দীক্ষাস্নান (ব্যাপ্টিজম/baptism) ইত্যাদিও হাস্যকর কুসংস্কার মাত্র, কাঠ বা ধাতুর ক্রস বহন করা, হাত দিয়ে সারাক্ষণ ক্রসচিহ্ন করা, জিশুর নাম করে আর ক্রস দেখিয়ে ভূত ছাড়ানো (এগজরসিজম /exorcism), রোগমুক্ত হওয়ার কামনা নিয়ে ক্যাথলিকদের লুভ্র্–এর ঝর্ণার জল খাওয়ার জন্য পায়ে হেঁটে তীর্থযাত্রা বা গ্রিক অর্থোডক্সদের তিনস দ্বীপে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে গির্জেয় ঢোকা, জিশু আর তথাকথিত খ্রিস্টীয় সন্তদের অলৌকিক কাণ্ড–কারখানায় বিশ্বাস ইত্যাদি অনেক খ্রিস্টধর্মীয় আচারই কুসংস্কারের চূড়ান্ত নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি যুক্তিবিরোধী আর মানবিকতা–বিরোধী কর্মকাণ্ড — অন্যের প্রতি ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, হিংসা, অবিচার, অত্যাচার, হানাহানি আর রক্তপাতের কারণ হল ধর্ম ৷ আর এই ইতিবৃত্তের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়ের স্রষ্টা হল তথাকথিত তিন একেশ্বরবাদী ধর্ম: ইহুদি ধর্ম (জুডাইজম) আর তার থেকে জন্মানো ধর্মতত্ত্বে তার অধমর্ণ খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম ৷ একাধিকার, অন্যের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা আর ঘৃণা হল এই তিন ধর্মের ধর্মতাত্ত্বিক চরিত্র ৷ একথা খ্রিস্টীয় পাশ্চাত্যের চিন্তাশীলদের অনেকেও উপলব্ধি করেছেন:
প্রকৃতপক্ষে অসহিষ্ণুতা একমাত্র একেশ্বরবাদের ক্ষেত্রে অপরিহার্য; একজন অনন্য দেবতা চরিত্রগতভাবে এক ঈর্ষাপরায়ণ দেবতা যিনি আর কোনো দেবতাকে থাকতে দিতে পারেন না ৷ অন্য দিকে বহুঈশ্বরবাদীদের দেবতারা স্বভবাতই সহিষ্ণু, তাঁরা বেঁচে থাকেন আর বাঁচতে দেন…
—আর্থার শোপেনহাওয়ার১০
অনন্য এক ঈশ্বরে বিশ্বাসের সঙ্গে অনিবার্যভাবে জন্ম নিল সেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা যা প্রাচীন সভ্যতার যুগে অপরিচিত ছিল ৷
—সিগমন্ড ফ্রয়েড১১
ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুসারে, তিন একেশ্বরবাদী ধর্ম ঈশ্বরের নামে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিশ্বাস্য রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছে! যুদ্ধ, শাস্তির অভিযান, হত্যাকাণ্ড, খুন, ঔপনিবেশিকতা, জাতিহত্যা, গণহত্যা, ক্রুসেড, ইনকুইজিশন, আজকের বিশ্বব্যাপী অত্যুগ্র সন্ত্রাসবাদ…
অনন্য ঈশ্বরের ধর্ম…অন্যের বিরুদ্ধে অভিক্ষিপ্ত হলে এই ধর্ম উদ্বুদ্ধ করে বিরূপতা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা যার উত্পাদন হল জাত্যহংকার, বিদেশি–আতংক, ঔপনিবেশিকতা, যুদ্ধ, সামাজিক অবিচার ৷
─মিশেল ওঁফ্রে১২
ইহুদি–পুরাণ ‘তানাখ’ (যার কিছুটা পরিবর্তিত রূপ হল খ্রিস্টানদের ‘পুরাতন বিধান’) বর্ণিত ইহুদিদের তথাকথিত অনন্য ঈশ্বরের নির্ধারিত ভূখণ্ড অধিকারের ইতিবৃত্ত জুডাইজম্–এর চরিত্রগত একাধিকার, অন্যের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, ঘৃণা ও আগ্রাসী প্রভুত্বকামিতার প্রকাশক ৷ আর খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের প্রকৃতিতে জুডাইজম থেকে পাওয়া একাধিকার, অন্যের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, ঘৃণা ও আগ্রাসী প্রভুত্বকামিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচারক, ধর্মান্তরক, প্রসারণশীলতা — আমরা যাকে এক কথায় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র বলে অভিহিত করতে পারি ৷ খ্রিস্টধর্মের এই ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কর্মকাণ্ড এদেশে ক্রমশ একটা পরিব্যাপ্ত আর বিপজ্জনক রূপ লাভ করছে ৷
আমার দ্বিতীয় উপলব্ধি হল: ধর্মান্তরীকরণ পৃথিবীর মানবিক–সাংস্কৃতিক প্রতিবেশতত্ত্বের প্রতিকূল । বস্তুত প্রতিবেশতত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীতে সুস্থ জৈব জীবনের অনুকূল পরিবেশের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় হল সযত্নে জীব ও উদ্ভিদ্–জগতের বৈচিত্র্য রক্ষা করা। ইদানীং কালে প্রতিবেশতত্ত্ব সমুদাচারসম্মত (fashionable), তাই বিভিন্ন স্তরে সর্বত্র চর্চিত হচ্ছে উদ্ভিদ্–ভূগোল, জীব–ভূগোল, সংগঠিত হচ্ছে জীব ও উদ্ভিদ্–জগতের বৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য আন্দোলন। ভৌত প্রতিবেশতত্ত্বের কথা হাজারবার বলা হলেও রাজনৈতিক–আর্থনৈতিক নয়া–ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রভাবে মানবিক–সাংস্কৃতিক প্রতিবেশতত্ত্বের আলোচনা বিদ্যায়তনিক জগতে বা তার বাইরে অনুপস্থিত, বলা যায় প্রায় টাবু (taboo)। প্রতিদান বা প্রতিষ্ঠার চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আমরা উপলব্ধি করি, পৃথিবীতে সুস্থ জৈব জীবনের অনুকূল পরিবেশের জন্য জীব ও উদ্ভিদ্–জগতের বৈচিত্র্য রক্ষা করা যেমন আবশ্যক, তেমনই পৃথিবীতে সুস্থ মানবিক–সাংস্কৃতিক জীবনের অনুকূল পরিবেশের জন্য বিকল্পহীনভাবে প্রয়োজনীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির বৈভিন্ন্য আর বৈচিত্র্য রক্ষা করা। ধর্মান্তরীকরণ এই বৈভিন্ন্য আর বৈচিত্র্যের হন্তারক ধ্বংসকারী। গত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে খ্রিস্টধর্ম আমেরিকা, আফ্রিকা , ওসেয়ানিয়া, পলিনেসিয়া আর আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতি বা/এবং উপজাতিকে ধর্মান্তরিত করে তাদের সংস্কৃতি তথা সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে ধ্বংস করেছে আর আমাদের এই পৃথিবীকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে দরিদ্রতর করেছে ৷
এছাড়া কয়েক বছর আগে ভ্যাটিকানের ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলী কর্তৃক আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু ওরফে টেরিজা মা–কে সন্ত খেতাব দেওয়ার প্রশ্নে দেশে বিদেশে আবেগোচ্ছ্বাসের চুনামি আর প্রশস্তির ধ্বনিত–প্রতিধ্বনিত করতালির মধ্যে প্রায় হারিয়ে যাওয়া কিছু বিরল কণ্ঠের প্রতিবাদ আমাকে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে চিন্তিত করে ৷ তার ওপর আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু তথা ক্যাথলিক গণমাধ্যম, দমিনিক লাপিয়ের ইত্যাদির অবদানে আজ পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্র, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসু, সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা আন্তর্জাতিকভাবে টেরিজা মার কলকাতা, নর্দমার কলকাতা, কুষ্ঠরোগের কলকাতায় পরিণত হয়েছে ৷ পশ্চিমি প্রচারমাধ্যমে টেরিজা মার কলকাতা, নর্দমার কলকাতা, কুষ্ঠরোগের কলকাতা শুনতে শুনতে কলকাতার আমি বিষণ্ণ হয়ে উঠি ৷ খ্রিস্টধর্ম প্রচার তথা পশ্চিমি প্রভাব ও স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার প্রয়েজনে নানা কৌশলে গড়ে তোলা টেরিজা মা নামক নাটকের নেপথ্যের কথা বলাটা প্রয়োজনীয় বলে বোধ হল ৷
প্রসঙ্গত বলা দরকার, পোন্তিফিচো ইনস্তিতুতো মিসিয়োন এস্তেরে (Pontificio Instituto Missioni Estere, ইং. The Pontifical Institute for Foreign Missions) হল ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর মোহান্ত বা পোপের অধীন বিদেশে ধর্মপ্রচারকদের শিক্ষাকেন্দ্র ৷ ২০০৪ সাল থেকে এই কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত এশিয়াননিউজ.ইট (AsianNews.it) নামে ইন্টারনেট পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণের শিরোনামের নিচে রয়েছে ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর ভূতপূর্ব মোহান্ত কারল ভোইতিলা–র (এই পোলিশ পাদ্রির পোপ হিসেবে ছদ্মনামের ইংরেজি রূপ: দ্বিতীয় জন–পল) শেষ গ্রন্থ ‘ওঠ,এগিয়ে চল!’ (Alzatevi, andiamo! ইংরেজি অনুবাদে: Rise, Let us be on our way) থেকে উদ্ধৃতি ‘তৃতীয় সহস্রাব্দে আমাদের সবার মিলিত কর্মক্ষেত্র হল এশিয়া’ (Asia, our common task for the Third Millennium) ৷ প্রসঙ্গত মনে পড়ে ১৯৯৫ সালে ম্যানিলায় এশিয়ার ক্যাথলিক বিশপদের সমাবেশে ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর পূর্বোক্ত ভূতপূর্ব মোহান্ত বলেছিলেন:
পৃথিবীব্যাপী খ্রিস্টমণ্ডলীর সঙ্গে এসিয়ায় খ্রিস্টমণ্ডলী তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রবেশপথ পার হবে, আশ্চর্য হয়ে প্রত্যক্ষ করবে শুরু থেকে আজ অব্দি ঈশ্বর যা করেছেন এবং এই প্রত্যয়ে অবিচল থাকবে যে ‘প্রথম সহস্রাব্দে যেরকম ইয়োরোপের মাটিতে ক্রস রোপিত হয়েছে, আর দ্বিতীয় সহস্রাব্দে হয়েছে দুই আমেরিকা আর আফ্রিকায়, আমরা প্রার্থনা করতে পারি তৃতীয় খ্রিস্টীয় সহস্রাব্দে এই বিশাল আর গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশে বিশ্বাসের বিপুল এক ফসল আহৃত হবে’৷
দ্বিতীয় জন–পল: এশিয়ার খিস্টীয় ধর্মমণ্ডলী১৩ ৷
১৯৯৭ সালে আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ু ওরফে মাদার টেরিজা মারা যান ৷ মাত্র ছ বছরের ব্যবধানে ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে ভ্যাটিকানের কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলী আগনেস গোনখা বোইয়াখিয়ুকে ‘পরমানন্দায়ন’ (বিআটিফিকেশন) মঞ্জুর করে অর্থাৎ তিনি ‘ভগবদ্ করুণাপ্রাপ্ত’ (ব্লেসেড) অভিধা লাভ করে ‘সাধ্বী’ বা ‘সন্ত’ হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার প্রথম ধাপ টপকান ৷ এর পর ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর প মোহান্ত জোসেফ রাৎসিঙ্গের (পোপ হিসেবে ছদ্মনামের ইংরেজি রূপ ষোড়শ বেনেডিক্ট/Benedict XVI) ২০০৬ সালে এক ইতালিয়ান কার্ডিনালকে সরিয়ে মৌলবাদী ওপুস দেই–এর (Opus Dei) ঘনিষ্ঠ বংশপরিচয়ে গোয়ার ভারতীয় মুম্বই–এর পূর্বতন আর্চবিশপ আইভান ডায়াসকে ‘জনগোষ্ঠীকে সুভাষিতে দীক্ষিত করার সংসদের’ (Congregation for the Evangelization of Peoples অর্থাৎ অখ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার সংসদের) অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করেন ৷ বুঝতে পারি এ সমস্তই নয়া–ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত পশ্চিমি খ্রিস্টধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের রণকৌশলের অংশমাত্র ৷
টীকা
১. রণকৌশল: খ্রিস্টধর্মের প্রচারের অনুষঙ্গে ‘যুদ্ধ’, ‘সেনাবাহিনী’, ‘সাম্রাজ্য’, ‘বিজয়’, ‘রণকৌশল’, ইত্যাদি হিংসাত্মক যুদ্ধ ও সংঘর্ষভিত্তিক শব্দ পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর শব্দসম্ভারের অপরিহার্য অঙ্গ ৷ এই শব্দগুলি আমাদের এই ধর্মের অন্তর্নিহিত অসহিষ্ণুতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় ৷ মিশনারি পাদ্রিদের বিভিন্ন রচনার শিরোনাম বা রচনা থেকে এই শব্দব্যবহারের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করছি:
Rev. S. B. Munger: The Conquest of India, 1845, Boston, Massachusetts Sabbath School Society.
John Henky Bakkows: The Christian Conquest of Asia,1899, New York, Charles Scribner’s Sons.
James Mills Thoburn: The Christian Conquest of India, 1906, Boston, Young People’s Missionary Movement
Mission Strategy Bulletin, Missions at Ohio Valley University
John L. Jr. Allen:Missionary strategy, National Catholic Reporter, Nov 3, 2000 .
David J. Hesselgrave: Scripture and Strategy, Evangelical Missiological Society Series, number 1, Published by William Carey Library, 1994, Pasadena, California
Chiang H. Ren: At War With the Armies of Darkness, Published by Institute for Christianity, 2001.
প্রসঙ্গত স্মরণীয় ১৮৭৮ সালে একটি খ্রিস্টধর্মীয় মিশনের নাম হয় Salvation Armyমুক্তি বাহিনী ৷
২. জঁ মেসলিয়ে (১৬৬৪– ১৭২৯): এই ফরাসি পল্লীযাজকের (ক্যুরে/curé) মৃত্যুর পর তাঁর লেখা ‘ইষ্টপত্র’ (Testament) নামে অপ্রকাশিত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কয়েকটি কপি জ্ঞানালোকের দার্শনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ৷ ভলতের এই রচনার পরিমার্জিত নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করেন ৷ ভলতের–এর সম্পাদিত উক্ত সংস্করণে মেসলিয়ে খ্রিষ্টধর্ম–বিরোধী ঈশ্বরবাদীতে (theist) পরিণত পরিণত হন ─কেননা ভলতের ছিলেন তাই ৷ আবার নাস্তিক দলবাকও (Paul-Henri Thiry, baron d’Holbach, ১৭২৩–১৭৮৯) মেসলিয়ে–র রচনার নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করেন ৷ তাবৎ ধর্মের বিরোধী এই নাস্তিক বস্তুবাদী দার্শনিকের রচনা প্রথম অবিকৃতভাবে প্রকাশিত হয় উনিশ শতকে ৷
৩. Je m’assure que si vous suivez bien les lumières naturelles de votre esprit, vous verrez au moins aussi bien, et aussi certainement que moi, que toutes les religions du monde ne sont que des inventions humaines, et que tout ce que votre religion vous enseigne, et vous oblige de croire, comme surnaturel et divin, n’est dans le fond qu’erreur, que mensonge, qu’illusion et imposture.
─Jean Meslier: Testament.
৪. লুক্রিসিয়াস: টিটুস লুক্রিসিয়াস কারুস (আ. ৯৯–আ. ৫৫সা–পূ. অ.): ল্যাটিন ভাষার রোমান কবি ৷ তাঁর বিখ্যাত রচনা ইন্দ্রিয়বাদী এপিকুরিয়ান মহাকাব্য ‘বস্তুপ্রকৃতি’ ( De Rerum Natura )৷
৫. My own view on religion is that of Lucretius. I regard it as a disease born of fear and as a source of untold misery to the human race.
─Bertrand Russell: Has Religion Made Useful Contributions to Civilization?, 1930.
৬. त्रयो वेदस्य कर्तारो भण्डधूर्तनिशाचराः चार्वाकदर्शनम ৷ – सायनमाधवाचार्यप्रणीतः सर्वदर्शनसंग्रह
৭. এখানে আমি ধর্মের মৌলবাদ বা মৌলবাদী চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলিনি ৷ বা হীনমন্যতায় ভোগা আমরা পাশ্চাত্যের প্রতিধ্বনি করে মুসলমানদের প্রসঙ্গে কখনো সখনো ‘মৌলবাদী’ বলি ৷ আবার সম্প্রতি পশ্চিমি (প্রধানত খ্রিস্টধর্মীয়) প্রচার মাধ্যমে হিন্দুদের সম্পর্কেও ‘মৌলবাদী’ বিশেষণ ব্যবহার করছেন ৷ এমনকী কিছু দিশি ঔপনিবেশিতও তোতাস্বভাবে তার পুনরাবৃত্তি করছেন ৷ বস্তুত যেকোনো ধর্মের মতোই হিন্দুধর্মেরও ভিত্তি হল বিচারহীন বিশ্বাস ও যুক্তিহীন কুসংস্কার ৷ কিন্তু বহু–ঈশ্বর বা বহুত্ববাদী (শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, এককথায় ‘যত মত তত পথ’–বাদী), জুডাইজম, ইসলাম, বা খ্রিস্টধর্মের মতো প্রচারিত বা অনন্য গ্রন্থ–নির্ভর ধর্ম নয় গড়ে ওঠা বহু লিখন এবং মৌখিক ঐতিহ্য নির্ভর ধর্ম ৷ স্বভাবতই এই ধর্মমতের ‘মৌল’ বলে কিছু নেই ৷ তাই হিন্দুদের ‘মৌলবাদী’ হওয়া সম্ভব নয় ৷
৭. অস্টাদশ শতকে যুক্তিবাদী দর্শনের আবির্ভাবে সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টধর্মী ইয়োরোপের কিছু বুদ্ধিজীবি খ্রিস্টমণ্ডলীর শাসন ও শাস্তির আতঙ্ক জয় করে জিশুর ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন শুরু করেন ৷ ‘দার্শনিক অভিধান’–এর (Dictionnaire philosophique) ‘খ্রিস্টধর্ম’ (Christianisme) নিবন্ধে লিখেছিলেন: “কয়েকজন পণ্ডিত ঐতিহাসিক জোসেফ–এর রচনায় জিশু–খ্রিস্টের কোনো চিহ্ন না দেখে তাঁদের বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কেননা সত্যিকারের পন্ডিতরা এবিষয়ে একমত যে জোসফ–এর ইতিহাসে যে ছোট অনুচ্ছেদে জিশুর কথা রয়েছে তা প্রক্ষিপ্ত ৷” [Plusieurs savants ont marqué leur surprise de ne trouver dans l’historien Josèphe aucune trace de Jésus-Christ: car tous les vrais savants conviennent aujourd’hui que le petit passage où il en est question dans son histoire est interpolé.] ‘দার্শনিক অভিধান’–এর ১৭৬৯ সালের সংস্করণে ভলতের টীকা যোগ করেন: “লোকে যাকে ভক্তিপূর্ণ জোচ্চুরি বলে অভিহিত করে সেরকম একটা জোচ্চুরির মাধ্যমে খ্রিস্টানরা জোসেফ–এর একটি অনুচ্ছেদকে. জালিয়াতি. করে ঢুকিয়ে দেয়…” [Les chrétiens, par une de ces fraudes qu’on appelle pieuses, falsifièrent grossièrement un passage de Josèphe…] ৷ এর পর থেকে জিশু বিতর্কে ঐতিহাসিকরা চার দলে বিভক্ত ৷ প্রথম দলে রয়েছেন ঝামেলা এড়ানোর দল, তাঁরা খ্রিস্টধর্মবিশ্বাসী তথা খ্রিস্টমণ্ডলীকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে চান না, চুপ করে থাকেন ৷ দ্বিতীয় দলে রয়েছেন খ্রিস্টধর্মীয় ঐতিহ্যে লালিত খ্রিস্টধর্মবিশ্বাসী ঐতিহাসিকরা, এঁরা ঐতিহাসিক প্রমাণের সাক্ষ্যকে কোনো গুরুত্ব দেন না, তথাকথিত সুসমাচারকে আপ্তবাক্য জ্ঞানে জিশুর ঐতিহাসিক জীবন বলে প্রচার করেন ৷ তৃতীয় দলে রয়েছেন হ্যাঁ বা না–র মাঝামাঝি মধ্যপন্থীরা ৷ তাঁদের মতে জিশু বলে কেউ একজন ছিলেন তবে খ্রিস্টধর্মের জিশু সুসমাচার আর ধর্মতাত্ত্বিকদের নির্মাণ ৷ চতুর্থ দলে রয়েছেন যুক্তিবাদীরা, ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাবের ভিত্তিতে, বাইবেলের নব বিধানের বিভিন্ন রচনার মধ্যে অসঙ্গতির বিচার করে তাঁরা মনে করেন জিশুর অস্তিত্ব অনৈতিহাসিক, বিভিন্ন মিথের সমাহার তথা প্রচারক পল ও পরবর্তী খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রচারকৌশলের সৃষ্টি ৷ ১৯২৭ সালে ‘আমি কেন খ্রিস্টান নই?’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় বার্টান্ড রাসেল বলেন: “খ্রিস্ট কখনো আদৌ বর্তমান ছিলেন কিনা তা ঐতিহাসিকভাবে যথেষ্ট সন্দেহজনক আর তিনি বর্তমান থেকে থাকলেও তাঁর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা…” (Historically it is quite doubtful whether Christ ever existed at all, and if He did we do not know anything about him… ─Bertrand Russell:Why I Am Not A Christian, a lecture on March 6, 1927) ৷
৮. ২৫–এ ডিসেম্বরকে জিশুর জন্মদিন বলে ধরে নিয়ে খ্রিস্টানরা, এমনকী আমাদের দেশের অখ্রিস্টানরাও খ্রিসমাস উৎসব পালন করে ৷ কিন্তু উক্ত দিনটি কোনো অর্থেই জিশুর জন্মদিন হতে পারে না ৷ আসলে সারা রোমান সাম্রাজ্যে সূর্যের মকরসংক্রান্তি বা দক্ষিণায়নের কয়েকদিন পর পারস্য থেকে আসা সূর্যদেবতা মিথ্রের জন্মোৎসব পালন করা হত ৷ রোমে এর সঙ্গে যুক্ত হয় শনির উৎসব ৷ অখ্রিস্টানদের উৎসবকে প্রভাবহীন করার জন্য সাধারণ অব্দের তৃতীয়–চতুর্থ শতকে খ্রিস্টমণ্ডলী ২৫–এ ডিসেম্বরকে জিশুর জন্মদিন বলে ঘোষণা করে আর জিশুর জন্মোৎসবের অনুষ্ঠান ত্রয়োদশ শতকে খ্রিস্টধর্মালম্বীদের মধ্যে ব্যাপ্তি লাভ করে ৷
অষ্টম শতক পর্যন্ত পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা রোমান বর্ষগণনা ব্যবহার করত ৷ ৫২৫ সাধারণ অব্দে সিথীয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ডিওনিসিয়াস এগজিগুস খ্রিস্টীয় উৎসব ইস্টারের দিনক্ষণ গণনা করার জন্য ৭৫৩ রোমান অব্দের ২৫–এ ডিসেম্বরকে জিশুর তথাকথিত জন্মসাল ও জন্মদিন হিসেবে নির্দেশ করেন এবং ঐ বছরকে খ্রিস্টাব্দ (‘আমাদের ত্রাতা জিশু খ্রিস্টের বছর/ Anni Domini Nostri Jesu Christi) ০১ হিসেবে চিহ্নিত করেন ৷ খ্রিস্টমণ্ডলী এই গণনা অনুমোদন করেন ৷ সম্রাট শার্লমাইনের সময়ে ইয়োরোপ ভূখণ্ডে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টাব্দের গণনা প্রবর্তিত হয় ৷ পরবর্তীকালে জিশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্বে বিশ্বাসী পণ্ডিতরা সুসমাচারের সাক্ষ্য অনুসারে স্থির করেন যে জিশুর জন্মসাল ০১ সাধারণ অব্দ হতে পারেনা ৷ তাঁদের মতে এই জন্মসাল ৭ বা ০৬ সাধারণ পূর্বাব্দ অথবা ০৬ সাধারণ অব্দ ৷
৯. ‘কুসংস্কার’ শব্দটি ইংরেজি superstition শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ৷ ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ ও ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে কুসংস্কার শব্দের অর্থ হল:
বি. যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা বা ধর্মবিশ্বাস, গোঁড়ামি, supestition. [সং. কু + সংস্কার]।…[সংসদ বাংলা অভিধান] ৷
বি. ১. কুৎসিত সংস্কার… ২. ধর্মে অন্ধ বা যুক্তিহীন বিশ্বাস; গোঁড়ামি ৷…[বঙ্গীয় শব্দকোষ] ৷r
ইংরেজি ‘শর্টার অক্সফোর্ড’ (ShorterOxford English Dictionary) অনুসারে superstition শব্দের অন্যতম অর্থ:
2. An irrational religious system; a religion regarded as false or pagan; a ceremony or observance of such a religion. Now rare or obsolete.
কোনো অযৌক্তিক ধর্মীয় তন্ত্র; ভ্রান্ত বা অখ্রিস্টীয় বলে বিবেচিত ধর্ম; এরূপ ধর্মের কোনো অনুষ্ঠান ৷ [এই অর্থে ব্যবহার এখন প্রায় দেখা যায় না বা পুরনো ৷
ফরাসি অভিধান Le Petit Robert ‘superstition’ (স্যুপেরস্তিসিয়োঁ) শব্দের আদি অর্থ উপস্থাপিত করেছে:
religion des idolâtres, culte des faux dieux (পৌত্তলিকদের ধর্ম, ভুয়ো দেবতাদের পুজো)৷
উপর্যুক্ত অর্থে ভারতীয়দের অখ্রিস্টান ধর্ম বা তাবৎ ধর্মাচারকে যাঁরা কুসংস্কার বলে অভিযুক্ত করেছেন সেই ইয়োরোপীয়দের অসংখ্য মন্তব্যের দু–একটা উদ্ধৃত করছি:
ক) যদিও ভারতে ইংল্যান্ডের খ্রিস্টমণ্ডলী তার প্রভাব বিস্তার করুক সব দিক থেকে এটাই আমার পছন্দসই ছিল তবু বাইবেল–এর মূল মতবাদে বিশ্বাস করে খ্রিস্টধর্মের এরকম যেকোনো রূপ হিন্দুধর্মের অমার্জিত কুসংস্কারের চেয়ে যে ভালো হবে ─এ নিয়ে আমার মনে কখনো কোনো প্রশ্ন জাগে নি ৷
─ চার্লস গ্র্যান্ট, কলকাতার শ্রদ্ধেয় বিশপকে লেখা চিঠি, লন্ডন, অগাস্ট ১৮১৭ ৷ হেনরি মরিস: চার্লস গ্র্যান্ট–এর জীবন, লন্ডন: জন মুরে, ১৯০৪, পৃ. ৩৩৮৷
[Although I would, on every account, have preferred the exertions of the Church of England in India, yet I could never make it a question whether any form of Christianity which held the essential doctrines of the Bible would not be better there than the gross superstitions of Hindooism. ─Charles Grant to the Right Rev. the Lord Bishop of Calcutta, London, August 1817.
─Henry Morris: The Life of Charles Grant, London: John Murray, Albermarle Street W, 1904, P338.]
খ) …আমরা দেখেছি যে মনুষ্যজাতির যে–কোনো অংশকে কখনো নাকাল আর নিম্নগামী করেনি এরকম সবচেয়ে প্রকাণ্ড আর যন্ত্রণাদায়ক কুসংস্কারের ওপর গড়ে তোলা একটা পুরোহিতদের চাতুর্যের তন্ত্র তাদের শরীরের চেয়েও আরো অসহ্যভাবে তাদের মনকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে; সংক্ষেপে বলতে গেলে ঐ স্বৈরাচার আর পুরোহিতদের চাতুর্য একসঙ্গে নিলে, হিন্দুরা হল মনুষ্যজাতির সবচেয়ে ক্রীতদাসে পরিণত মানুষ ৷
─জেমস মিল: ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ সংস্করণ, এইচ. এইচ. উইলসন সম্পাদিত, লন্ডন, ১৮৪০, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ.১৮ ৷
[…we have seen that by a system of priestcraft, built upon the most enormous and tormenting superstition that ever harassed and degraded any portion of mankind, their minds were enchained more intolerably than their bodies; in short that, despotism and priestcraft taken together, the Hindus, in mind and body, were the most enslaved portion of the human race.
─James Mill: The History of British India, Vol. II, Fourth edition, Edited by H. H. Wilson, London: James Madden & Co., 1840, Vol. II., p18.]
গ) ব্রাহ্মণ্য পুরাণ এমনই উদ্ভট যে তাকে সত্য বলে যে গ্রহণ করে এরকম প্রতিটি মনকে তা নিম্নগামী করে… সমগ্র হিন্দু দেবমণ্ডলীর মধ্যে প্রাচীন গ্রিসের মন্দিরে যেসব সুন্দর আর মহিমময় রূপ দণ্ডায়মান থাকত তার মতো দেখতে কোনো কিছু দেখতে চাইলে আপনারা হতাশ হবেন ৷ সব কিছুই বীভৎস, আর কদাকার, আর ইতর ৷ এই কুসংস্কার যেরকম তাবৎ কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে অযৌক্তিক আর তাবৎ কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে অর্মাজিত তেমনই তাবৎ কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে নীতিবিগর্হিত ৷ কদাচারের প্রতীক গণ–উপাসনার বস্তু ৷ কদাচারের অনুষ্ঠান গণ–উপাসনার অনুষ্ঠান ৷
─টি. বি. মেকলে: সোমনাথের প্রবেশদ্বার, ১৮৪৩ সলের ৯–ই মার্চ, হাউজ অভ কমনস্ ৷
[The Brahminical mythology is so absurd that it necessarily debases every mind which receives it as truth… Through the whole Hindoo Pantheon you will look in vain for anything resembling those beautiful and majestic forms which stood in the shrines of ancient Greece. All is hideous, and grotesque, and ignoble. As this superstition is of all superstitions the most irrational, and of all superstitions the most inelegant, so is it of all superstitions the most immoral. Emblems of vice are objects of public worship. Acts of vice are acts of public worship.
─T. B. Macaulay: The Gates of Somnauth, a speech delivered in the House of Commons on the 9th of March, 1843.]
১০.As a matter of fact, it is only to monotheism that intolerance is essential; an only god is by his nature a jealous god, who can, allow no other god to exist. Polytheistic gods, on the other hand, are naturally tolrent; they live and let live;…
─Arthur Schopenhauer: Religion: A Dialogue And Other Essays, selected and translated by T. Bailey Saunders, 4th edition, London, Swan Sonneschellan & Co., 1893. p.49.
১১. ...religious intolerance, which was foreign to antiquity…was inevitably born with the belief in one God.
-Sigmund Freud: Moses and Monotheism, (Der Mann Moses und die monotheistische Religion, 1939), Translated by Katherine Jones, Published by The Hogarth Press and Institute of Psycho-Analysis, 1939, P35.
১২. Au nom de Dieu, l’histoire témoigne, les trois monothéismes font couler pendant des siècles d’incroyables fleuves de sang ! Des guerres, des expéditions punitives, des massacres, des assassinats, du colonialisme, des ethnocides, des génocides, des Croisades, des Inquisitions, aujourd’hui l’hyper-terrorisme planétaire…
─Michel ONFRAY : Traité d’athéologie (p.90 ), Paris , Bernard Grasset , 2005
১৩. With the Church throughout the world, the Church in Asia will cross the threshold of the Third Christian Millennium marvelling at all that God has worked from those beginnings until now, and strong in the knowledge that “just as in the first millennium the Cross was planted on the soil of Europe, and in the second on that of the Americas and Africa, we can pray that in the Third Christian Millennium a great harvest of faith will be reaped in this vast and vital continent”.
─The Marvel of God’s Plan in Asia [1]
Ecclesia in Asia – John Paul II – Post-Synodal Apostolic …
1) John Paul II, Address to the Sixth Plenary Assembly of the Federation of Asian Bishops’ Conferences (FABC), Manila (15 January 1995), 11: Insegnamenti …
২. খ্রিস্টধর্মপ্রচারের কালিমালিপ্ত ইতিহাস
উত্তর ইয়োরোপে সাতশ বছরের খ্রিস্টধর্ম প্রসারের সংক্ষিপ্তসার হিসেবে বলা যায় যে ঐ কর্মকাণ্ডটি প্রধানত সংঘটিত হয়েছিল তরবারির সাহায্যে আর তা সংঘটিত হয়েছিল প্রধানত সেসব রাজা আর স্বৈরাচারীদের স্বার্থে যারা তাদের নিজেদের প্রজামণ্ডলীর প্রতিরোধের বিরুদ্ধে ঐ কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছিল আর প্রজারা খ্রিস্টমণ্ডলীকে প্রত্যক্ষ করেছিল তাদের দমিয়ে রাখার একটা উপায় হিসেবে ৷ এক কথায় বলা যায় খ্রিস্টধর্ম ছিল প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মতোই এক তরবারির ধর্ম ৷ ১২২৩ সালে মোঙ্গলরা যখন রাশিয়ার একটি অংশ জয় করে তখন তারা খ্রিস্টানদের শুধু পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতাই দেয় নি যাজকদের তাবৎ কর থেকে রেহাই দিয়েছিল আর ঠিক একইভাবে তুর্কিরা বুলগারিয়ানদের তাদের ধর্মবিশ্বাস, ভূসম্পত্তি আর স্থানীয় বিধিবিধান রক্ষা করতে দিয়েছিল ৷ খ্রিস্টধর্ম সহিষ্ণুতার একরকম কোনো নিদর্শন দেখায় নি; অখ্রিস্টান স্লাভ আর প্রুসীয়দের ভূসম্পত্তি জার্মান বিজেতাদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়েছিল ৷ হরেদরে বলা যায় বিধর্মীদের কখনোই বিশ্বাস উত্পাদন করানো হয় নি, যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয় নি, কখনোই নতুন মতবাদের আবেদনে মন জয় করা হয় নি: হয় রাজারা তাদের গবাদি পশুর দলের মতো খ্রিস্টমণ্ডলীতে স্থানান্তরিত করেছে নয়ত কয়েক প্রজন্মের প্রতিরোধ আর দলে দলে হত্যাকাণ্ডের পর বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা হয়েছে ৷ জার্মান বিজয়ের পরে দীর্ঘকাল ধরে দেশের বাইরে কোনো স্লাভকে দেখা গেলে তাকে তত্ক্ষণাৎ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা যেত অথবা যেকোনো খ্রিস্টান তাকে বন্য জন্তুর মতো হত্যা করতে পারত ৷’— জন এম. রবার্টসন: খ্রিস্টধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, লন্ডন, ১৯০২, পৃ.২১৫৷১৪
ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর ভূতপূর্ব মোহান্ত কারল ভোইতিলা–র ভাষণের ওপরে উদ্ধৃত অংশের মধ্যে ‘প্রথম সহস্রাব্দে ইয়োরোপের ভূমিতে ক্রস রোপিত হয়েছিল’ বাক্যাংশ আমাদের ইয়োরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কালিমালিপ্ত রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ৷ মনে পড়ে প্রথম কনস্টেনটাইন থেকে শার্লমাইন পর্যন্ত ইয়োরোপীয় সম্রাটদের হয় বাইবেল নয় মৃত্যুদণ্ড বেছে নেওয়ার বিধানের মাধ্যমে অখ্রিস্টান ইয়োরোপীয়দের খ্রিস্টধর্মান্তরিত করার ইতিবৃত্ত, স্মরণ করিয়ে দেয় ‘মূর্তি–উপাসক’ বলে অভিহিত করে যারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেনি তাদের প্রতি অত্যাচার, তাদের মন্দিরকে ধ্বংস করা বা গির্জেয় পরিণত করার ইতিহাস, মনে পড়ে আলেকজান্দ্রিয়ার দার্শনিক তথা বিজ্ঞানী মহিলা হাপাশিয়াকে (ইপাতিয়াকে) নৃশংসভাবে খুন করা১৫, ঐ শহরের সেরাপিয়াম মন্দির ও গ্রন্থাগার ধ্বংস করা, রোমের দেবী ভেস্তার মন্দিরের চিরন্তন অগ্নিশিখা নিবিয়ে দিয়ে ঐ মন্দিরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া, অ্যাথেন্স–এ দেবী আথিনার মন্দির পার্থেননকে গির্জেয় রূপান্তর, গ্রিসে পিথিয়ান (ডেলফিক) এবং অলিম্পিক ক্রীড়া–প্রতিয়োগিতার ইতি ঘোষণা করা, অ্যাথেন্স–এর ঐতিহ্যমণ্ডিত দার্শনিক মহাবিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া, ইহুদিদের বিতাড়ন ও তাদের ওপর নানা রকম অত্যাচার, ম্যানিকিয়ানদের হত্যা, এমনকী খ্রিস্টধর্মের কর্তৃপক্ষস্বীকৃত মতবাদের সামান্যতম বিরোধী খ্রিস্টধর্মী ব্যক্তি বা এরিয়ান, নোভেশিয়ানিস্ট, ডোনাটিস্ট প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি অসংখ্য দৃষ্টান্তের কথা) ৷
এর পর দ্বিতীয় সহস্রাব্দের আরম্ভে এই ধর্মান্ধ হিংস্রতা (খ্রিস্টীয় ‘প্রেম’!) একদিকে ইয়োরোপের সীমানা পেরিয়ে বুকে ক্রসচিহ্ন এঁটে মুসলমান আর ইহুদিদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে (ক্রুসেড = খ্রিস্টীয় ‘জিহাদ’) বেরিয়ে পড়ে আর অন্যদিকে ইয়োরোপের মধ্যে ফ্রান্সের লঁগদক প্রদেশে দ্বাদশ শতকের শুরুতে হাজার হাজার ক্যাথারকে হত্যা করে ধর্মীয় বিচারের (ইনকুইজশন–এর) সূত্রপাত করে ৷ ধর্মীয় বিচারের নামে হাজার হাজার মানুষকে নির্যাতন ও পুড়িয়ে মারা, শতবর্ষের যুদ্ধ, তিরিশ বছরের যুদ্ধ, তিনশ বছর ধরে ডাইনি আখ্যা দিয়ে তিন লক্ষ নিরপরাধ নারীকে খুন করা ৷ ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নামে ইয়োরোপের মধ্যে এই অব্যাহত রক্তপাতের পাশাপাশি (পঞ্চদশ শতক থেকে) শুরু হয় ইয়োরোপ মহাদেশের বাইরে বলপ্রয়োগে খ্রিস্টীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ৷ ইয়োরোপের খ্রিস্টমণ্ডলী ও খ্রিস্টীয় শাসকশ্রেণী এই প্রয়াসে সমবেত ভাবে অংশগ্রহণ করে ৷ ১৪১৫ সালে পর্তুগালের রাজা প্রথম জন (জোআঁও) ইসলামের প্রভাব ও প্রসার রোধ করার উদ্দেশ্যে মরক্কোর উত্তর অংশে ভূমধ্যসাগর–তীরবর্তী সিউটা শহর দখল করেন ৷ এর পর ১৪৫২ সালে রোমের ক্যাথলিক ধর্মগুরু তোম্মাসো পারেনতুচেল্লি (Tommaso Parentucelli, ১৩৯৭–১৪৫৫, পোপ হিসেবে ছদ্মনাম পঞ্চম নিকোলাস/Nicholas V, পোপত্ব: ১৪৪৭–১৪৫৫) দুম দিভের্সাস (bull Dum Diversas) নামে ফতোয়ায় পর্তুগালের ক্যাথলিক রাজা পঞ্চম আলফোন্সোকে তাবৎ মুসলমান ও অখ্রিস্টানদের আক্রমণ, অধীনস্ত ও বংশপরম্পরায় ক্রীতদাসে পরিণত করার ধর্মীয় অনুমোদন দেন১৬৷ এর পর একই পোপ–এর ১৪৫৫ সালে রোমানুস পন্তিফেক্স ফতোয়ায় (bull Romanus Pontifex) ইতিপূর্বের ফতোয়ার ঘোষণাকে সমর্থন করে বিশেষভাবে আফ্রিকার মানুষদের অধীনস্ত ক্রীতদাসে পরিণত করার ঢালাও ধর্মীয় অনুমোদন দেওয়া হয়১৭ ৷ ১৪৮১ সালে পোপ চতুর্থ সিক্টাসও তাঁর এক ফতোয়ায় এই অনুমোদনকে সমর্থন করেন ৷ কলম্বাস কর্তৃক ইয়োরোপীয়দের জাহাজে আমেরিকায় যাওয়ার পথ আবিস্কারের পর ১৪৯৩ সালে স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত কুখ্যাততম ক্যাথলিক ধর্মগুরু ষষ্ঠ আলেকজান্ডার এক ফতোয়ায় (Inter caetera) স্পেনের রাজদম্পতি ফার্ডানেন্ড ও ইজাবেলকে ইয়োরপীয়দের কাছে ইতিপূর্বে অজ্ঞাত ভূখণ্ডের (অতএব ইয়োরোপ–কেন্দ্রিক চিন্তায় ‘নতুন জগতের’) অধিকার তথা তার অধিবাসীদের খ্রিস্টধর্মান্তরিত করার দায়িত্ব সমর্পণ করেন ৷ আরব মুর ও ইহুদিদের নিপীড়ন, হত্যা এবং বিতারণের ফলে খ্রিস্টধর্মীয়দের কাছে স্পেনের এই রাজদম্পতি ছিলেন খ্যাতিমান, পোপ এঁদের এই ‘মহৎ’ কর্মের স্বীকৃতিতে ‘ক্যাথলিক’ (অর্থাৎ আদর্শ ‘ক্যাথলিক’) উপাধি দান করেন ৷
এর পর পোপের পরামর্শ অনুসারে স্পেন ও পর্তুগালের ধর্মান্ধ রাজারা কালনেমির লঙ্কা ভাগের মতো অখ্রিস্টান জগতকে দুভাগে ভাগ করে নেন ৷ ধীরে ধীরে পশ্চিম ইয়োরোপের ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট দেশগুলি — ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক — বাইবেল আর কামান নিয়ে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের দৌড়ে নেমে পড়ে ৷ ১৫৭৮ সালে ইংল্যান্ডের রানি তথা অ্যাংলিকান খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রধান প্রথম এলিজাবেথ নাবিক হাম্ফ্রে গিলবার্টকে ‘কোনো খ্রিস্টান রাজা বা জনগোষ্ঠীর দ্বারা অধিকৃত নয় এমন তাবৎ সুদূর ও বর্বর দেশ দখল করার’১৮ অনুমতি দেন ৷ মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অন্যের স্বাধীনতা হরণ, ছলেবলে কৌশলে ধর্মান্তর, দাস–ব্যবসায়, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কয়েক কোটি আদি অধিবাসী এবং আফ্রিকানকে হত্যার মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে কারল ভোইতিলা–উক্ত ‘দ্বিতীয় সহস্রাব্দে দুই আমেরিকা আর আফ্রিকার’ ‘মাটিতে ক্রস রোপিত’ হওয়ার অর্থাৎ ইয়োরোপীয়–খ্রিস্টধর্মীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের পবিত্র ইতিহাস ৷
এবার তৃতীয় সহস্রাব্দে খ্রিস্টমণ্ডলীর অভিযান ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রসারের ঘোষিত লক্ষ্য হল এশিয়া ৷ ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রধান কারল ভোইতিলার ওপরে উদ্ধৃত ঘোষণা, কৈশোরে নাৎসি স্বেচ্ছাসেবক, পূর্বতন গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর কার্ডিনাল থেকে পদোন্নত ক্যাথলিক মোহান্ত জোজেফ রাৎসিঙ্গের–এর (বর্তমান পোপ হিসেবে ছদ্মনাম ষোড়শ বেনেডিক্ট) বাচন, ইভাঞ্জেলিস্ট, সাদার্ন ব্যাপটিস্ট, গসপেল ফর এশিয়া ইত্যাদি অসংখ্য প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রচার, এমনকি গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টমণ্ডলীর কর্মসূচিতেও এই ঘোষিত লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য নিরন্তর বিভিন্ন সক্রিয় প্রয়াস ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায় ৷ কারল ভোইতিলার বাচনের ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণ করে বলা যায় আসলে গত চারশ বছর ধরে নানা কৌশল অবলম্বন করেও খ্রিস্টমণ্ডলীর বিভিন্ন শাখা অন্য মহাদেশগুলির তুলনায় এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে ততটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি ৷ হ্যাঁ, ইয়োরোপ, দুই আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় তাবৎ প্রাচীন ধর্ম–বিশ্বাস আর তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে খ্রিস্টমণ্ডলীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, আফ্রিকায়ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্মরণাতীত কালের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে ইসলামের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খ্রিস্টমণ্ডলীর আধিপত্য কায়েম হয়েছে। অথচ এশিয়া মহাদেশে আজো (হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ইত্যাদি) অন্য ধর্মের তুলনায় খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য অপ্রতিষ্ঠিত ৷ তাই আহত আত্মগৌরব পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর উদ্দেশ্য যে করেই হোক এশিয়া মহাদেশ জয় করতে হবে ৷
এশিয়ায় কম্যুনিস্ট চিন, অর্থোডক্স খ্রিস্টান রাষ্ট্র আর্মেনিয়া, কম্যুনিস্ট ভিয়েৎনাম এবং তাবৎ ঐস্লামিক রাষ্ট্রে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টমণ্ডলীর ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তর বেআইনি অপরাধ ৷ ফলে কারল ভোইতিলা কথিত খ্রিস্টীয় ‘ঈশ্বরের’ ঘাড়ে চাপানো ‘অত্যাশ্চর্য পরিকল্পনা’ অনুযায়ী সেখানে বিভিন্ন খ্রিস্টমণ্ডলীর ধর্মের যাত্রাপালা সম্ভব নয়। তাই এশিয়াকে ধর্মান্তরিত করার ধান্ধায় ভারত হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের হরেক খ্রিস্টমণ্ডলীর সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতার প্রধান লক্ষ্যভূমি ৷ ইতিপূর্বে খ্রিস্টধর্মান্তর বা খ্রিস্টমণ্ডলীর সাম্রাজ্যবাদী ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতা ছিল পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ঔপনিবেশিক বিস্তারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ৷ ইয়োরোপের দেশগুলির ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মপ্রচার এবং ধর্মান্তরীকরণ ছিল ঔপনিবেশিকতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ৷ ভারতীয়দের অসন্তোষ তথা সমবেত বিপজ্জনক বিরোধিতার আশঙ্কায় ইংল্যান্ড বিশেষভাবে ভারতে ঔপনিবেশিকতার ক্ষেত্রে ধর্মপ্রচার এবং ধর্মান্তরীকরণ কিছুটা আড়ালে রাখে ৷ ইংরেজ ঔপনিবেশক শাসকরা প্রত্যক্ষ ভাবে খ্রিস্টধর্মপ্রচার , ধর্মান্তরীকরণের প্রতি পক্ষপাত না দেখালেও পরোক্ষ ভাবে এদেশে ঔপনিবেশিকতার সহায়ক খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন ৷ এছাড়া কম্প্রাদর শ্রেণীর সৃষ্টি ঔপনিবেশিক ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও তার পরোক্ষ লক্ষ্য ছিল খ্রিস্টধর্মপ্রচার তথা ধর্মান্তরীকরণ১৯ ৷ বস্তুত খ্রিস্টমণ্ডলীর সাম্রাজ্যবাদী ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতা ছিল পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব তথা শাসনের পরিপোষক ৷ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্মান্তরিত দেশীয় খ্রিস্টানদের ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সাধারণভাবে অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়, প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মান্তরিত দেশীয় খ্রিস্টানরা ধর্মীয় ভিত্তিতে একই সঙ্গে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক থেকে পাশ্চাত্যের বশংবদ বোধ করেছে — পাশ্চাত্য শাসনের বিরোধিতার বিপক্ষে অবস্থান করেছে ৷ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্মান্তরিত দেশীয় খ্রিস্টানদের অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়, প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মান্তরিত দেশীয় খ্রিস্টানরা ধর্মীয় ভিত্তিতে একই সঙ্গে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক থেকে পাশ্চাত্যের বশংবদ বোধ করেছে — পাশ্চাত্য শাসনের বিরোধিতার বিপক্ষে অবস্থান করেছে ৷ প্রাতঃস্মরণীয় ‘পঞ্চগোরার’২২ অন্যতম ব্যাপ্টিস্ট পাদ্রি জোশুয়া মার্শম্যান বলেছিলেন:
আমি এ ব্যাপারেও সচেতন যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধি আমার চেয়ে অধিক উৎসাহ সহ কামনা করে এরকম কেউ লিডেনহল স্ট্রিট বা এমনকী সারা ব্রিটেনেও নেই… আর আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে ভারতে বৃটিশ শাসন চিরস্থায়ী করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়গুলির একটা হবে শান্ত আর নিঃশব্দ, অথচ স্থির আর বিরামহীন ভাবে দেশীয়দের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের আলোর বিকীরণ ৷…তাদের সত্যিকারের প্রাণদায়ক খ্রিস্টধর্ম দাও, তাহলে তুমি ওদের দেবে নতুন চরিত্র, তুমি সৃষ্টি করবে নতুন ধ্যানধারণা আর নতুন বন্ধন, মৃত্যুর চেয়েও দৃঢ় বন্ধন… তাদের মনে খ্রিস্ট ধর্মের তাবৎ প্রভাবের কথা নাহয় বাদ দেওয়া গেল, ধর্মের ব্যাপারে ব্রিটিশের সঙ্গে একমত হওয়াটা প্রভাবের দিক থেকে একই জাতের অন্তর্গত হওয়ার সমতুল্য হবে আর তা অসচেতন অথচ জোরালোভাবে তাদের একই ব্রিটিশ স্বার্থের সঙ্গে জড়িত করবে ৷ প্রতিটি ধর্মান্তরিত হিন্দু বা মুসলমান নিজের স্বার্থ এবং নিরপত্তার কারণে অবশ্যম্ভাবীভাবে ব্রিটিশের আন্তরিক বন্ধু, কেননা তার অস্তিত্বই নির্ভর করছে ভারতে ব্রিটিশের সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের ওপর ৷ যেসব বন্ধন তাকে দৃঢ়ভাবে তার জাত আর ভুয়ো ধর্মের কুসংস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিল খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে সে শুধু সেগুলিই ছিন্ন করেনি, সে নিজের বিরুদ্ধে তার বন্ধুদের তথা দেশবাসীর ক্রোধের আগুন উদ্দীপ্ত করেছে এবং ভারতে ওদের কর্তৃত্ব লাভ করার ব্যাপারে তার আতঙ্কিত হওয়ার সংগত কারণ রয়েছে ৷ ফলত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিটি পদক্ষেপই তার নিজের তথা যা কিছু তার প্রিয় উভয়ের অস্তিত্ব বিপন্ন বলে মনে হবে ৷ খ্রিস্টধর্মের আংশিক অগ্রগতিতেও ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অনুকূলে কী যে জোরালো ভারসাম্য তৈরি হবে! ধরা যাক হিন্দুস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র পাঁচ লক্ষ মানুষ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে, আমাদের সঙ্গে মানসিকতা তথা স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ এবং ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাঁচ লক্ষ এরকম বন্ধুর মূল্য কেইবা পরিমাপ করতে পারে ৷ এই বিষয়ে পোপপন্থী শপথ করা যাজক বার্তেলোমেও–র সাক্ষ্য শোনা যাক ৷ তাঁর ভ্রমণে রয়েছে, ‘মালাবার উপকূলে সদ্য ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা কোচিনে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সমর্থক এবং সব সময় ঐ কোম্পানিকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র গ্রহণ করতে প্রস্তুত ৷’ মূর্তি–উপাসকরা এবং মুসলমানরা স্বভাবতই ইয়োরোপীয়দের শত্রু কারণ তাদের সঙ্গে ইয়োরোপীয়দের বাইরের চেহারায় বা আচার–আচরণে কোনো সাদৃশ্য নেই ৷ সুতরাং ইংরেজরা যদি ভারতে খ্রিস্টানদের বন্ধুত্ব লাভের চেস্টা না করে তাহলে কার ওপর তারা নির্ভর করতে পারবে? কীভাবে তারা এই সুদূর দেশে তাদের অধিকার রক্ষা করতে পারবে? ওপরের এই আলোচনার মধ্যে কেন হায়দার আলি বা টিপু সুলতান ইংরেজদের এবং ত্রিবাঙ্কুরের রাজার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারল না তার কারণগুলির একটা খুঁজে পাওয়া যাবে ৷ যাদের হায়দার আর তার ছেলে সর্বত্র নির্যাতন করত সেখানে বাস করা সেই বিরাট সংখ্যক খ্রিস্টানরা সব সময় ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছে ৷ — ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার উন্নতিতে খ্রিস্টধর্মের উপকার’ পৃষ্ঠা ৬–৮২০৷
টীকা
১৪.The summary of seven hundred years of Christian expansion in northern Europe is that the work was in the main done by the sword, in the interests of kings and tyrants, who supported it, as against the resistance of their subjects, who saw in the church an instrument for their subjection. Christianity in short was as truly a religion of the sword as Islam. When the Mongols conquered part of Russia in 1223 they not only left the Christians full religious liberty but let the priests go untaxed ; and similarly the Turks left to the Bulgarians their faith, their lands, and their local laws. Christianity gave no such toleration; the lands of the heathen Slavs and Prussians being distributed among their German conquerors. The heathen, broadly speaking, were never persuaded, never convinced, never won by the appeal of the new doctrine: they were either transferred by their kings to the church like so many cattle or beaten down into submission after generations of resistance and massacre. For a long time after the German conquest any Slav found away from home was liable to be executed on the spot, or killed like a wild beast by any Christian who would.
─John M. Robertson: A Short History of Christianity, London, 1902. p 215.
১৫. আলেকজান্দ্রিয়ার হাইপাসিয়া–র (গ্রিক ইপাতিয়া Υπατία, জন্ম ৩৫০ থেকে ৩৭০ সা. অ. – মৃত্যু ৪৫১ সা. অ.) হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বার্টান্ড রাসেল (Bertrand Russell) তাঁর পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস গ্রন্থে গিবন (Edward Gibbon–এর The History of the Decline and Fall of the Roman Empire) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে আলেকজান্দ্রিয়ার প্যাট্রিয়ার্ক
‘…সন্ত সিরিল ছিলেন ধর্মান্ধ অত্যুত্সাহের মানুষ ৷ তিনি তাঁর প্যট্রিয়ার্কের পদমর্যাদাকে আলেকজান্দ্রিয়ার বিরাট ইহুদি উপনিবেশকে খতম করার জন্য উত্তেজিত করার ব্যাপারে ব্যবহার করেছিলেন ৷ হাইপাশিয়ার জনতার হাতে নিগৃহীত হয়ে খুন হওয়াটাই হল তাঁর খ্যাতির কারণ ৷ হাইপাশিয়া ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত মহিলা যিনি ধর্মান্ধতার ঐ যুগে নয়া–প্লেটোনিক দর্শনের অনুরাগী ছিলেন আর অঙ্কশাস্ত্রের চর্চায় নিজের প্রতিভাকে নিয়োজিত করেছিলেন ৷ মহিলাকে ‘ঘোড়ার গাড়ি থেকে টেনে নামানো হল, কাপড়–চোপড় টেনে ছিঁড়ে তাঁকে নগ্ন করে দেওয়া হল, টেনে হেঁচড়ে ঢোকানো হল গির্জের মধ্যে, সেখানে বাইবেল তথা অনুশাসন–পাঠক পিটার এবং নির্দয় একদল বর্বর তাকে জবাই করল: ধারালো ঝিনুক দিয়ে তার হার থেকে মাংস ছাড়িয়ে নেওয়া হল আর তার থরথর করে কাঁপতে থাকা হাত–পা আগুনের শিখায় অর্পণ করা হল…’ ৷ [St. Cyril…was a man of fanatical zeal. He used his position as patriarch to incite pogroms against the very large Jewish colony in Alexandria. His claim to fame is the lynching of Hypatia, a distinguished lady who, in an age of bigotry, adhered to the Neoplatonic philosophy and devoted her talents to mathematics. She was torn from her chariot, stripped naked, dragged to the church, and inhumanly butchered by the hands of Peter the Reader and a troop of savage and merciless fanatics: her flesh was scraped from her bones with sharp oyster-shells and her quivering limbs were delivered to the flames...’─Bertrand Russell: History of Western Philosophy, Page 342]
১৬. আমাদের ঈশ্বর–নির্ধারিত ক্ষমতায় বর্তমান দলিলের দ্বারা আমরা আপনাদের সারাসেন ও মূর্তি–উপাসক এবং অন্য যে–কোনো (খ্রিস্টধর্মে) অবিশ্বাসী ও খ্রিস্ট–শত্রুরা যেখানেই তারা থাকুক না কেন তাদের তথা তাদের রাজ্য, জায়গিরদারি, তালুকদারি, খাসমহল জায়গা–জমি, বাড়ি, গড়, তাদের যাকিছু স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আক্রমণ, তল্লাসি, অধিকার এবং অধীনস্ত করা এবং ব্যক্তি হিসেবে তাদের চিরকালীন ক্রীতদাসে পরিণত করার পূর্ণ এবং অবাধ অনুমতি মঞ্জুর করছি ৷
─দুম দিভের্সাস ফতোয়া. ১৪৫২ ৷
[We grant you by these present documents, with our Apostolic Authority, full and free permission to invade, search out, capture, and subjugate the Saracens and pagans and any other unbelievers and enemies of Christ wherever they may be, as well as their kingdoms, duchies, counties, principalities, and other property […] and to reduce their persons into perpetual slavery
─Bull Dum Diversas, by Pope Nicholas V, June 18, 1452].
১৭. …to invade, search out, capture, vanquish, and subdue all Saracens and pagans whatsoever, and other enemies of Christ wheresoever placed, and the kingdoms, dukedoms, principalities, dominions, possessions, and all movable and immovable goods whatsoever held and possessed by them and to reduce their persons to perpetual slavery…
– Bull Romanus Pontifex by Pope Nicholas V, January 8, 1455 to King Afonso V of Portugal.
১৮.It was in that year [1578] that Queen Elizabeth gave her royal authorisation to Sir Humphrey Gilbert, “to take possession of all remote and barbarous lands, unoccupied by any Christian prince or people.”
Our Empire’s Debt to Missions, The Duff Missionary Lecture, London: Hodder and Stroughton Limited, 1922, p1
১৯. ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ঔপনিবেশিক ইংরেজি–শিক্ষার প্রকল্প পেশ করার দেড় বছর পর ১২ অক্টোবর মেকলে তাঁর বাবাকে একটি চিঠিতে লিখছেন:
আমাদের ইংরেজি স্কুলগুলোর দারুন শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে ৷ অবশ্য যারা চাইছে তাদের সবাইয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে কঠিন, কোনো কোনো জায়গায় অসম্ভব হয়ে উঠছে ৷ শুধু এক হুগলি সহরেই চোদ্দশ ছেলে ইংরেজি শিখছে. হিন্দুদের ওপর এই শিক্ষার প্রভাব বিপুল ৷ ইংরেজি শিক্ষা পেয়েছে এমন কোনো হিন্দুর কখনোই তার ধর্মের প্রতি আন্তরিক টান থাকে না তাদের মধ্যে কেউ কেউ নীতি হিসেবে তা পালন করে যায়, কিন্তু অনেকেই নিজেদের ঈশ্বরবাদী বলে ঘোষণা করে , আর কেউ কেউ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে ৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনাগুলি যদি অনুসরণ করে যাওয়া হয় তাহলে আজ থেকে তিরিশ বছর পর বাংলাদেশে সম্মানিত শ্রেণীর মধ্যে একজনও মূর্তিপূজক থাকবে না ৷ আর ধর্মান্তরীকরণের কোনো প্রয়াস ছাড়াই, ধর্মীয় স্বাধীনতায় এতটুকু হাত না দিয়েই, শুধুমাত্র জ্ঞান এবং অনুধ্যানের স্বাভাবিক চর্চার মাধ্যমেই এটা ঘটবে এই সম্ভাবনার কথা ভেবে আমার দারুণ আনন্দ হয় ৷
Our English schools are flourishing wonderfully. We find it difficult, indeed, in some places impossible, to provide instruction for all who want it. At the single town of Hoogly fourteen hundred boys are learning English. The effect of this education on the Hindoos is prodigious. No Hindoo, who has received an English education, ever remains sincerely attached to his religion. Some continue to profess it as matter of policy ; but many profess themselves pure Deists, and some embrace Christianity. It is my firm belief that, if our plans of education are followed up, there will not be a single idolater among the respectable classes in Bengal thirty years hence. And this will be effected without any efforts to proselytise ; without the smallest interference with religious liberty ; merely by the natural operation of knowledge and reflection. I heartily rejoice in the prospect.
Calcutta: October 12, 1836.
454 LIFE AND LETTERS OF LORD MACAULAY. Vol I 456 LIFE AND LETTEES OF LORD MACAULAY.
২০. I am conscious too that no one in Leadenhall Street, nor even in Britain, more ardently wishes for the permanence and prosperity of the British empire in India than myself…and I am fully convinced that one of the most effectual means of perpetuating the British dominion in India will be the calm and silent, but steady and constant, diffusion of Christian light among the natives. … Impart vital genuine Christianity to them, and you give them a new nature ; you create new ideas, and new attachments attachments stronger than death. But setting aside every effect of Christianity on their minds, their being of the same opinion with the British in matters of religion would be the same thing in effect as being of the same cast, and would insensibly, but powerfully, attach them to the same interest.Every converted Hindoo or Mussulman is necessarily the cordial friend of the British, on the ground of his own interest and security ; for on the continuance of their empire in India his very existence depends. By embracing Christianity he has not only dissolved all the ties which hold him firmly to his cast and superstition, but he has incensed his friends and countrymen against him, and has every thing to dread from their obtaining the ascendency in India. Hence every step which might be taken against the English must threaten the existence both of himself and all that are dear to him. What a powerful counterpoise in favor of the British government would be created in India, even by the partial progress of Christianity ! Say, that of the millions of Hindoostan, only five hundred thousand persons had embraced Christianity ; who can calculate the value of five hundred thousand such friends, thus united to us, both by inclination and interest, and scattered up and down throughout the British dominions in India 1 On this subject let the testimony of Bartelomeo, a professed papist, be heard, as you have it in his Voyage…The newly converted Christians on the coast of Malabar are the chief support of the Dutch East India Company at Cochin, and are always ready to take up arms in their defence. The Pagans and Mahometans are naturally enemies to Europeans, because they have no similarity to them either in their external appearance or in regard to their manners. If the English therefore do not endeavour to secure the friendship of the Christians in India ; on whom can they depend How can they hope to preserve their possessions in that remote country ? In the above considerations may be found one of the reasons why neither Hyder Ali nor Tippoo Sultan could maintain their ground against the English and the king of Travancore on the coast of Malabar. The great number of Christians residing there, whom Hyder and his son every where persecuted, always took part with the English.
―Joshua Marshman: Advantages of Christianity in promoting the Establishment and prosperity of the British Government in India containing Remarks occasioned by Reading a Memoir on The Vellore Mutiny, London, Smith’s Printing Office, 1813, P6
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় দেশীয় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের ভূমিকার বিবরণ পাওয়া যায় আরো কিছু খ্রিস্টধর্ম–প্রচারক পাদ্রির রচনায় ৷ আমরা আরো দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি:
দেশীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় যে শুধুমাত্র সাহসের সঙ্গে সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছিল তাই নয় তারা তাদের বিশ্বস্ততা ও আগ্রহের বিভিন্ন অটুট প্রমাণ দিয়েছিল ৷… উত্তর ভারতে মিশনারি সোসাইটির খ্রিস্টমণ্ডলীর তত্ত্বাবধানে সবচেয়ে বিস্তৃত মিশনগুলির একটা রয়েছে বাংলাদেশের কৃষ্ণনগরে ৷ মিরাট আর দিল্লিতে বিদ্রোহের এবং অন্যান্য স্থানে বিদ্রোহী মনোভাবের প্রকাশের খবর সেখানে দেশীয় খ্রিস্টানদের কাছে পৌঁছানো মাত্র তারা ব্যক্তিগতভাবে অথবা তাদের সম্পত্তি দিয়ে অথবা রাষ্ট্রের কাজে লাগতে পারে এরকম যে কোনো উপায়ে সরকারকে সাহায্য করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠল ৷… বারানসীতে খ্রিস্টমণ্ডলীর মিশনের খ্রিস্টানরা মিশনের বাড়ি তথা তাদের নিজেদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য তাদের সাহসী নায়ক রেভারেন্ড সি. বি. লেউপল্ট–এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হল ৷ প্রচণ্ড বিপদের দিনে তারা তাদের প্রহরায় অবিচল থাকল… ৷
–রেভারেন্ড এম.শেরিং: বিরাট বিদ্রোহের সময়ে ভারতীয় খ্রিস্টমণ্ডলী লন্ডন, জেমস্ নিসবেট এন্ড কোম্পানি, ১৮৫৯, পৃষ্টা ৩৩৯–৩৪২
The native Christian community not only boldly placed itself on the side of the Government, but gave various and solid proofs of its fidelity and zeal… One of the most extensive missions in Northern India is that situated at Krishnaghur, in Bengal, under the superintendence of the Church Missionary Society. No sooner did the news of the revolt in Meerut and Delhi, and the mutinous spirit displayed in other places, reach the native Christians there, than they were eager to render assistance to the Government, either by their persons or their property, or in any way in which they might be of service to the State… In Benares, the Christians of the Church mission united together for the defence of the mission premises, and of their own lives and property, and under the leadership of their gallant chief, the Rev. C. B. Leupolt, remained steadfast at their post during the times of the greatest danger.
─Rev. M. A. Sherring: The Indian –‒–─ Church during the Great Rebellion, London, James Nisbet and Co., 1859.
ভারতের যেসব জেলায় খ্রিস্টধর্ম একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, বিশেষভাবে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে সব কিছুই শান্ত ছিল, শুধুমাত্র যেখানে খ্রিস্টধর্ম–প্রচারের কাজ এখনো আরম্ভের পর্যায়ে, সেই উত্তর–পশ্চিম প্রদেশগুলি আর অযোধ্যা বিদ্রোহ শুরু করে ৷
যে প্রদেশটি এ সময়ে সম্পূর্ণ সুসমাচারের দীক্ষার বাইরে ছিল সেই অযোধ্যা বাদ দিয়ে সর্বত্রই বিদ্রোহ প্রায় পুরোটাই সিপাই বাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ৷ আর এই বাহিনীর সৈন্যেদের ইস্ট ইন্ডিয়া একান্ত দুঃখজনক সতর্কতার সঙ্গে সব রকমের মিশনারি প্রভাব থেকে দূরে নিশ্চিদ্রভাবে আবদ্ধ করে রেখেছিল! তাছাড়া যে প্রদেশটি খ্রিস্টধর্মীয় দৃঢ়চরিত্রের মানুষের বদলে খোলাখুলি আর প্রকাশ্যভাবে খ্রিস্টধর্মীয় নীতিতে শাসিত হয়েছিল সেই পাঞ্জাব শান্ত ছিল আর একা এত অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্রোহ দমন করার রসদ সরবরাহ করেছিল ৷ দেশীয় খ্রিস্টানরা সংখ্যায় খুবই কম হলেও নিজেদের সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত করেছিল ৷ আগ্রা দুর্গে বিপুল সংখ্যক ইংরেজ একসঙ্গে জমায়েত হয়েছিল, সেখানে দেশীয় খ্রিস্টানরা অবিলম্বে তাদের সেবায় ব্রতী হল ৷ সমস্ত বিধর্মী চাকররা পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের স্থান নিয়েছিল দেশীয় খ্রিস্টানরা আর তারা বিশ্বস্ত আর ভালোভাবে তাদের কাজ করেছিল ৷ দেশীয় খ্রিস্টানরা দুর্গের তাবৎ সরবরাহের কাজ করেছিল ৷ বিদ্রোহ শুরু হওয়ার চোদ্দ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে কৃষ্ণনগরের খ্রিস্টানরা কোনোরকম পুরস্কার বা অর্থমূল্য দাবী না করেই সৈন্য,পরিবহন অথবা তাদের সাধ্যের মধ্যে থাকা সবকিছু দিয়ে সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল ৷ বারাণসীর কাছে মির্জাপুর আর কলকাতার উত্তরে হুগলি জেলায় দেশীয় খ্রিস্টানদের নিয়ে গড়া পুলিশ–বাহিনীর চৌকিদারির সাহায্যে শান্তি রক্ষা করেছিল… (তুল. হডজসন প্র্যাট–এর পত্র, বাল–এর মিশনারি পত্রিকা, ১৮৫৬, পৃ.৩৬১) ৷
─জুলিয়াস রিখটের: ভারতে খ্রিস্টান মিশন, সিডনি এইচ মুর কর্তৃক অনূদিত, ফ্লেমিং এইচ রেভেল কম্পেনি, নিউ ইয়র্ক, ১৯০৮ ৷
In those districts of India where Christianity had become a power, and especially in the Presidency of Madras, everything remained peaceful; only the North-Western Provinces and Oudh, where mission work was still in its initial stages, rose in rebellion. With the solitary exception of Oudh, which at that time was wholly unevangelised, the Mutiny was confined almost entirely to the Sepoy Army, and its soldiers were precisely those whom the East India Company, with the most pathetic care, had always kept hermetically sealed from every kind of missionary influence! A comparatively large number of military chaplains and their families fell victims to the Mutiny. Furthermore the very province which had been openly and expressly governed in accordance with Christian principles and not with traditional policy by men of decided Christian character, the Punjab, remained quiet, and alone provided the means whereby the Mutiny was so quickly suppressed. The native Christian communities, feeble as their numbers were, proved themselves to be thoroughly trustworthy. In the fort at Agra, where large numbers of Englishmen were crowded together, the native Christians readily entered their service, filling the places of the heathen servants who had deserted almost to a man; and they served both faithfully and well. Native Christians worked the ordnance of the fortress. In Bengal, within fourteen days of the outbreak of the Mutiny, the Krishnagar Christians volunteered to support the Government with troops, the transport service, or anything else that lay in their power, without claiming any reward or pay. At Mirzapur, near Benares, and in the Hooghly district to the north of Calcutta, peace was preserved by police patrols composed of native Christians… (Cf. Hodgson Pratt’s Dispatch, Basle Missionary Magazine, 1856,p. 381.)
─Julius Richter: History of Missions in India, translated by Sydney H. Moore, Fleming H, Revell Company, New York, 1908, pp. 206-207.