Scattered thoughts on the Bengali language 3 Pushkar Dasgupta বাংলা ভাষা নিয়ে বিক্ষিপ্ত চিন্তা ৩ নয়া-ঔপনিবেশিকতার জমানায় বাংলা ভাষার কোণঠাসা হওয়ার ইতিহাস পুষ্কর দাশগুপ্ত

 

নয়াঔপনিবেশিকতার জমানায় বাংলা ভাষার কোণঠাসা হওয়ার ইতিহাসের একটি পর্ব

পুষ্কর দাশগুপ্ত

ঔপনিবেশিকতার যুগের পুরনো ইতিহাস: মেকলের জারজরা

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় শিকড় গেড়ে বসার পর থেকে তাদের সরকার, মুত্সুদ্দি, দালালের কাজ করে কিছু দিশি লোক জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। তারপর কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাবকে পরাজিত করে ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ ও ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠা করে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দখলদারি পাওয়ার পর এই উপনিবেশের পরিধি দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে । কলকাতা হয় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। দলে দলে ভাগ্যান্বেষী ‘কলিকাতা কমলালয়ে’ এসে হাজির হল। ঔপনিবেশক সাহেবদের অধীনে কাজ করতে গেলে এক আধটু সাহেবদের বুলি বোঝা দরকার, উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা দু চারটে ইংরেজি বুকনি আউড়াতে শিখে সাহেবদের নেক নজরে পড়ল আর বেশ দু পয়সা কামিয়ে দিশি সমাজে কেউকেটা বনে গেল । হেস্টিংসের ব্যক্তিগত ব্যবসার মুন্সি শোভাবাজারের নব মুন্সি মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবে পরিণত হল। কোম্পানির আফিঙের চোরাই চালানে সহায়ক চিপুরের পিরালি ব্রাহ্মণ দ্বারকানাথ ঠাকুর হয়ে গেলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। দিশি সমাজে ইংরেজি শেখার চাহিদা দেখা দিল। সেই চাহিদা মেটানোর জন্য প্রথমে কিছু বিদেশি, ফিরিঙ্গি, অল্পস্বল্প ইংরেজি জানা লোক ইংরেজি পাঠশালা খুলল। তারপর ১৮১৭ সালে দিশি সমাজের কেউকেটা নবকৃষ্ণের দত্তক পুত্র রাজা রাধাকান্ত দেব এবং আরও কয়েকজনের মদতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি ও ইয়োরোপীয় বিদ্যা শেখার জন্য হিন্দু কলেজ স্থাপিত হল। ১৮৩০ সালের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার বিবরণ অবস্থাটা স্পষ্ঠ করে:

হিন্দুকালেজাদি নানা পাঠশালাদ্বারা অনেক বিষয়ি লোকের সন্তানেরা ইঙ্গরেজী বিদ্যায় পারগ হইয়াছে হইতেছে ও হইবেক। ইহারা কেহ দেওয়ানের পুত্র কেহ কেরাণির ভাই কেহ খাজাঞ্চির ভাতৃপুত্র কেহ গুদাম সরকারের পৌত্র কেহ নীলামের সেলসরকারের সম্বন্ধী ইত্যাদি প্রায় বিষয়ি লোকের আত্মীয় তাহারদিগকে কর্ম্মে উক্ত ব্যক্তিরা অবশ্যই নিযুক্ত করিয়া দিবেন এবং এই প্রথমতঃ কর্ম্ম হইয়া থাকে

(সমাচার চন্দ্রিকা, ১৫ চৈত্র ১২৩৬)

এই অবস্থায় ১৮৩৪ সালে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ঔপনিবেশিত ভারতে আসেন। ভারতবর্ষের বিশাল উপনিবেশের শাসনশোষণের প্রয়োজনে দিশি কম্প্রাদরকর্মচারি তৈরি করার জন্য ঔপনিবেশকদের ভাষায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। মনে পড়ে, ১৪৯২ সালে ইস্পানি পণ্ডিত আন্তোনিয়ো দে নেব্রিহা (Antonio de Nebrija, ১৪৪১১৫২২) স্প্যানিশ ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশ করেন।এই ব্যকরণ তিনি রানি ইজাবেলাকে উৎসর্গ করেছিলেন। ওই বই দিয়ে তিনি কী করবেন রানির এই প্রশ্নের উত্তরে নেব্রিহা বলেন, শ্রদ্ধেয় রানি, ভাষা হল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র।’ সে বছরই স্প্যানিশ রানি ইজাবেলার পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার ও ইস্পানি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য সমুদ্রপথে যাত্রা করেন।

মেকলে ১৮৩৫ সালে তাঁর ঔপনিবেশিত ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে স্মারকলিপিতে স্বল্পসংখ্যক ভারতীয়দের ইংরেজিমাধ্যম যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব করেন তার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ছিল::

এই মুহূর্তে আমরা অবশ্যই এমন একটা শ্রেণী গড়ে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব যারা হবে যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আমরা শাসন করি তাদের আর আমাদের মধ্যে দোভাষি, এমন একটা শ্রেণীর মানুষ যারা হবে রক্তে আর গায়ের রঙে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মতামত, নৈতিকতা আর বিচারবুদ্ধিতে ইংরেজ।

[We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect.]

ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মেকলের অভিপ্রেত কিছু ‘রুচি, মতামত, নৈতিকতা আর বিচারবুদ্ধিতে ইংরেজ’ আর ‘গায়ের রঙে ভারতীয়’ তৈরি হল। কোটি কোটি ভারতীয়দের মধ্যে এরা সংখ্যয় নগণ্য। এদেরই বড় একটা অংশ ইংরেজের বশংবদ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিশ্বস্ত কম্প্রাদরের ভূমিকা নেয়, আাবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যখন ভারতীয় উপমহাদেশে তথাকথিত ‘স্বাধীনতার’ নামে মার্কিনি নেতৃত্বে দলবদ্ধ পশ্চিমের নয়াঔপনিবেশিকতা কায়েম হল তখন থেকে সুবিধাভোগী পূর্বোক্ত কম্প্রাদরদের বংশধররা নয়াকম্প্রাদরের ভূমিকা নিয়ে দেশের শাসনশোষণ ব্যবস্থার কর্ণধার হয়ে বসল। ‘মেকলের জারজ’ এই সামান্য সংখ্যক সুবিধাভোগী দেশের সংখ্যাগুরু বিপুলসংখ্যক মানুষকে মানবিক তথা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ইংরেজি ভাষাকে শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, উচ্চশিক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা করে রাখল। এই অবস্থায় ইংরেজি না জানা বা/এবং কম জানা বিপুলসংখ্যায় সংখ্যাগুরু বাংলাভাষীর অবস্থাটা করুণ। সরকারি কাগজপত্র, চিঠি, আইনকানুন, পড়া, বোঝা, জানার, কোনো সমস্যায় আবেদন করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, ভোগ্যপণ্য বা ওষুধ কিনে তার নাম অথবা ব্যবহারের নিয়ম বোঝার অধিকার তাদের নেই, বৈদ্যুতিন জগৎ তাদের আয়ত্তের বাইরে। অন্যদিকে মেকলের জারজ বা ইংরেজিনবিশ বাঙালিদের অবস্থাটা কী? এরা তোতাবৃত্তিতে বিভিন্ন বিদ্যায় পাশ্চাত্যবাচন আউড়ায়। এদের অবদান, মৌলিক মনন, বিশ্লেষণ, সৃষ্টি, আবিষ্কার অতি নগণ্য। গত দুশ বছরের ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। সাম্প্রতিককালে যেসব ইংরেজিনবিশ ভারতীয় বা/এবং বাঙালি তোতাবৃত্তিতে নৈপুণ্য দেখিয়ে খ্যাতি লাভ করেন বা/এবং ইংরেজিতে (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে) আবোলতাবোল লেখেন পশ্চিমের নয়াঔপনিবেশক শক্তি বিদেশে চাকরি বা/এবং পুরস্কার দিয়ে তাদের পিঠ চাপড়ে দেয়। এটা হল গিয়ে নয়াঔপনিবেশিকতার প্রোথিতমূল প্রতিষ্ঠার কৌশলের অঙ্গ। স্মরণীয়, ১৯৪৩ সালে হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিক ডিগ্রি নেওয়ার অভিভাষণে উইনস্টন চার্চিল ইংরেজি ভাষার প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে ভাষার নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের সাম্রাজ্যের (অর্থা নয়াঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের) প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্টের সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা বলেন। এই পরিকল্পনার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তিনি যা বলেন তাই হল নয়াঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশের ভিত্তি:

ভাষার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা লোকের দেশ বা জমিজমা কেড়ে নিয়ে তাদের শোষণের মাধ্যমে পিষে ফেলার চেয়ে অধিকতর মূল্যবান লভ্যাংশ এনে দেয়। ভবিষ্যতের সাম্রাজ্য হবে মানসিকতার সাম্রাজ্য।

[The power to control language offers far better prizes than taking away people’s provinces or lands or grinding them down in exploitation. The empires of the future are the empires of the mind.

Winston Churchill, 1943]

যাঁরা মেকলের জারজের দলে ঢোকেন নি

অবশ্য উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষা সামান্য সংখ্যক বাঙালিকে মেকলের জারজদের শ্রেণীভুক্ত করতে পারে নি, তার পরিবর্তে ঐ শিক্ষা তাদের চেতনাকে জাগ্রত এবং প্রসারিত করে। এঁরা দেশ, জাতি আর বাঙালি সংস্কৃতির ধারকবাহক বাংলা ভাষার ব্যবহারের পরিধির বিস্তার এবং সমৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা করতে লাগল।

যে মধুসূদন দত্ত প্রথম যৌবনে ইংরেজি ভাষার কবি হবার স্বপ্ন দেখতেন, যিনি ইংরেজি বাদ দিয়েও সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি ও ইতালিয়ান ভাষা জানতেন, তিনি ১৮৬৫ সালে ফ্রান্সের ভের্সাই শহর থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন:

তুমি জান, গৌর আমার, গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটা ইয়োরোপীয় ভাষায় জ্ঞান হল বিরাট আর আবাদ করা একটা ভূখণ্ড অধিকার করার মতো — ঐ ভূখণ্ড অবশ্যই বৌদ্ধিক ।ইয়োরোপ সম্পর্কে পাণ্ডিত্য প্রশংসনীয় ব্যাপার, … কিন্তু আমরা যখন পৃথিবীকে কিছু বলব তখন তা যেন আমরা আমাদের নিজের ভাষায় বলি। নিজেদের ভেতরে নতুন চিন্তার উত্সার রয়েছে বলে যারা বোধ করে তারা যেন অবিলম্বে নিজেদের মাতৃভাষার দিকে যাত্রা করে।নিজের ভাষায় দক্ষতা নেই এমন কোনো ব্যক্তির ‘শিক্ষিত’ বলে পরিচিত হতে চাওয়ার আত্মম্ভরিতাকে আমি ঘৃণা করি।

[European scholarship is good…but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let those, who feel that they have springs of fresh thought in them, fly to their mother-tongue…I should scorn the pretensions of that man to be called “educated” who is not master of his own language.]

শেষ পর্যন্ত, আমাদের নিজেদের ভাষার চর্চা আর তার সমৃদ্দ্ধিসাধনের তুলনীয় আর কিছুই হতে পারে না। তুমি কি ভাব যে ইংল্যাণ্ড কি ফ্রান্স অথবা জার্মানি কি ইতালির কবি আর প্রবন্ধকারের দরকার আছে ? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি মিল্টনের নিজের মাতৃভাষা আর জন্মভূমির জন্য কিছু করার মহৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে তাবৎ প্রতিভাধর মানুষকে উদ্বুদ্ধ করুক।

[After all, there is nothing like cultivating and enriching our own tongue. Do you think England, or France or Germany or Italy wants Poets and Essayists? I pray God, the noble ambition of Milton to do something for his mother-tongue and his native land may animate all men of talent among us.]

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অভিভাষণে বলেন:

আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের মাতৃভাষাগুলির মাধ্যমে জ্ঞান প্রচারিত না হলে জাতি হিসেবে আমরা কোনো সর্বব্যাপ্ত আর বিস্তৃত কৃষ্টির অধিকারী হতে পারব না। অতীত আমাদের যে শিক্ষা দেয় তার কথা ভেবে দেখুন। অসংখ্য আধুনিক ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো দীপ্তিময় হয়ে ওঠার আগে অব্দি ইয়োরোপে মধ্যযুগের অন্ধকার সম্পূর্ণ বিদূরিত হয় নি। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, ― তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো জনসাধারণের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত চারপাশের অজ্ঞানের গভীর অন্ধকার কখনোই আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে না ।

[I firmly believe that we cannot have any thorough and extentsive culture as a nation, unless the knowledge is disseminated through our own vernaculars. Consider the lesson the past teaches. The darkness of Middle Ages of Europe was not completely dispelled until the light of knowledge shone through the medium of the numerous modern languages. So in India, ― the dark depth of ignorance all round will never be illuminated until the light of knowledge reaches the masses through the medium of their own vernaculars.

Gurudas Bandyopadhay: Convocation Address , 1891]

গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে উদ্বুদ্ধ তরুণ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে মাতৃভাষা বাংলা, হিন্দি বা উর্দুকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন, বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু ইত্যাদি কয়েকজন সমর্থন করলেও মেকলের জারজ বাঙালিদের দলবদ্ধ বিরোধিতায় সে প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়।

১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতী পত্রিকায় লেখেন:

বঙ্গ বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক। ইংরাজিতে শিক্ষা কখনোই দেশের সর্বত্র ছড়াইতে পারিবে না। তোমরা দুটিচারটি লোক ভয়ে ভয়ে ও কী কথা কহিতেছ, সমস্ত জাতিকে একবার দাবি করিতে শিখাও কিন্তু সে কেবল বিদ্যালয় স্থাপনের দ্বারা হইবে, Political agitationএর দ্বারা হইবে না।

(ন্যাশনল ফন্ড , ভারতী, কার্তিক, ১২৯০)

তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ২২ বছর। এর পর সারা জীবন তিনি সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন:

আমাদের ভীরুতা কি চিরদিনই থাকিয়া যাইবে? ভরসা করিয়া এটুকু কোনোদিন বলিতে পারিব না যে, উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের ভাষায় দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে? পশ্চিম হইতে যা কিছু শিখিবার আছে জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল, তার প্রধান কারণ, এই শিক্ষাকে তারা দেশী ভাষার আধারে বাঁধাই করিতে পারিয়াছে। আমরা ভরসা করিয়া এ পর্যন্ত বলিতেই পারিলাম না যে, বাংলাভাষাতেই আমরা উচ্চশিক্ষা দিব এবং দেওয়া যায়, এবং দিলে তবেই বিদ্যার ফসল দেশ জুড়িয়া ফলিবে।আমি জানি তর্ক এই উঠিবে তুমি বাংলা ভাষার যোগে উচ্চশিক্ষা দিতে চাও কিন্তু বাংলাভাষায় উঁচুদরের শিক্ষাগ্রস্থ কই? নাই সে কথা মানি কিন্তু শিক্ষা না চলিলে শিক্ষাগ্রস্থ হয় কী উপায়ে? শিক্ষাগ্রস্থ বাগানের গাছ নয় যে, শৌখিন লোকে শখ করিয়া তার কেয়ারি করিবে,–কিংবা সে আগাছাও নয় যে, মাঠে বাটে নিজের পুলকে নিজেই কণ্টকিত হইয়া উঠিবে!…. বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষাগ্রন্থ বাহির হইতেছে না এটা যদি আক্ষেপের বিষয় হয় তবে তার প্রতিকারের একমাত্র উপায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষা প্রচলন করা।

(শিক্ষার বাহন, ১৩২২)

ছিয়াত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেন:

আজ কোনো ভগীরথ বাংলাভাষায় শিক্ষাস্রোতকে বিশ্ববিদ্যার সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে চলুন, দেশের সহস্র সহস্র মন মূর্খতার অভিশাপে প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে, এই সঞ্জীবনী ধারার স্পর্শে বেঁচে উঠুক, পৃথিবীর কাছে আমাদের উপেক্ষিত মাতৃভাষার লজ্জা দূর হোক, বিদ্যাবিতরণের অন্নসত্র স্বদেশের নিত্যসম্পদ হয়ে আমাদের আতিথ্যের গৌরব রক্ষা করুক।

(শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ, ভাষণ : ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬)

না, রবীন্দ্রনাথের কামনা পূর্ণ হয় নি। বহুকাল কেটে গেল, বাংলা ভাষা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল, তার সঙ্গে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে রইল সংখ্যাগুরু কোটি কোটি বাঙালি। তারপর বিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকে ষষ্ঠ দশক অব্দি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার ব্যবহার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক পা এগোল; শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৩৪১৯৩৮) তখন তাঁর প্রয়াসে ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মাধ্যমিক ম্যাট্রিকুলেশন পর্যায়ে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা বাদ দিয়ে আর যেকোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা আর পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বাংলাক স্বীকৃতি দেওয়া হল। বিভিন্ন বিষয়ে বই আর পরিভাষার অভাব নিয়ে যথারীতি প্রচুর হৈচৈ হল। শ্যামাপ্রসাদের চেষ্টায় বিশেজ্ঞদের নিয়ে গঠিত পরিভাষাসমিতি আর বাংলাবানান সংস্কার সমিতি বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেন আর বাংলা শব্দের বানানের নৈরাজ্য দূর করার জন্য কিছু সংস্কারের প্রস্তাব উপস্থাপিত করে। বানান সংস্কার সমিতির নির্ধারিত বানানবিধি মেনে নেওয়ার লিখিত স্বীকৃতি জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্র তাকে মর্যাদা দেন। ১৯৩৭ সালে শ্যামাপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে অভিভাষণ দিতে আমন্ত্রণ জানান, রবীন্দ্রনাথ বাংলায় অভিভাষণ দেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথা ভেঙে এই প্রথম বাংলা অভিভাষণ। ছিয়াত্তর বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথ এই অভিভাষণে তাঁর বাইশ বছর বয়স থেকে বারবার মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে যেকথা বলে এসেছেন সেকথা আরো একবার বললেন। তাঁর ভাষায়:

ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেই শিক্ষার ভাষা আর শিক্ষার্থীর ভাষার মধ্যে আত্মীয়তাবিচ্ছেদের অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না।

ওই একই সালে অর্থাৎ ১৯৩৭ সাধারণ অব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রথম পিএইচ.ডির জন্য বাংলায় লেখা গবেষণাগ্রন্থক স্বীকৃতি দিয়ে গবেষক বিমানবিহারী মজুমদারকে পিএইচ.ডি ডিগ্রিতে ভূষিত করে। ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার্থীরা প্রথম ইংরেজি ব্যতীত অন্য সব বিষয়ে বাংলাভাষায় উত্তর লিখতে পারে। তারপর ১৯৪৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক স্তর (অনার্স ছাড়া বি. ., বি.এসসি ও বি. কম্ ) পর্যন্ত বাংলাভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে। বই আর পারিভাষিক শব্দ নিয়ে যথারীতি সোরগোল উঠল, ব্যঙ্গবিদ্রুপ হল। ক্রমশ নির্ভরযোগ্য, মান পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হতে লাগল আর পরিভাষার স্থিতিশীলতা দেখা দিল। স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে স্থির করা হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক ধানাই পানাই হলেও তা কখনোই কার্যকরী করা হয় নি।

বাংলা ভাষার সূর্যাস্ত

তার পর সত্তরের দশক থেকে নতুন করে সর্ব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অঘোষিত বিদায় সূচিত হল। তারপর চার দশক পরে এখন বাংলা ভাযার করুণ অবস্থা। বাংলা ভাযা প্রশাসনে ব্যবহৃত হয় না, পাড়ার মুদি, বেঞ্চিওয়ালা চায়ের দোকান, রাস্তার হকার, বাজারের সব্জি, ফল কি মাছবিক্রেতার বাইরে ব্যবসাবাণিজ্যে এই ভাষার ব্যবহার নেই, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রাকৃতিক বা মানবিক বিজ্ঞান, উচ্চশিক্ষা, গবেযণা কোথাও বাংলা ব্যবহৃত হয় না, এ ভাষা আজও মোটামুটিভাবে কম্প্যুটারায়িত হয়নি, ২৪ কোটি ভাষাভাষীর এই ভাষা আজো বৈদ্যুতিন জগতের খুদে একটা টুকরো দখল করে নিজের ন্যূনতম আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি । ক্রমশ বাংলা ভাযা ‘নিম্নবর্গীয়’ বাঙালির পারস্পরিক সংজ্ঞাপনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড় ছে, কলকাতা আর ঢাকায় বড় দোকান কি রেস্তোরাঁয় ঢুকে ইংরেজি না বলে বাংলা বললে খুব একটা ইজ্জত পাওয়া যায় না। মোটামুটি সঙ্গতি থাকলেই লোকে শিশুবয়স থেকে ছেলেমেয়েকে ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পাঠায়, ইংরেজি না বললে চলনসই চাকরি বাকরিও পাওয়া ষাবে না। বাংলায় শুধু কিছু গপ্পোকবিতা লেখা হয়, তবে যে ভাষায় সর্ববিদ্যার চর্চা হয় না সে ভাষার স্রোত মজে যায়, জলে পচন ধরে, তার সৃজনশীলতা হ্রাস পায়, সাহিত্যের মান ক্রমশ নিম্নমুখী হতে থাকে, চর্বিতচর্বণে পরিণত হয়, তার পাঠকের মানও নিম্নগামী হয়, পাঠকের প্রত্যাশার দিগন্তের পরিধির বিস্তারও ক্রমশ কমে যায়। বাংলা সাহিত্যের অবস্থা আজ দীপ্তিহীন, মেধাহীন — করুণ থেকে করুণতর হয়ে উঠছে ।

গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষা নিয়ে কী ভেবেছিলেন বা কী বলেছিলেন তা নিয়ে কেউ আর আজ মাথা ঘামায় না। সব কিছুর মাথায় বসে রয়েছে মেকলের জারজরা আর ইংরেজি ভাষা যা শতকরা ৯ জন বাঙালি জানে না, বুঝতে পারে না।

বাংলা ভাষার পক্ষ নিয়ে রা কাড়ার উপায় নেই, মেকলের জারজরা তো বটেই, ‘কলকাতা থেকে নিয়মিত বিমানে ভ্রমণকারী প্রতি দু’জনের একজন, পশ্চিমবঙ্গে নামকরা গাড়ির মালিকদের ৪০%, রাজ্যের ওয়াশিং মেশিন আছে, এমন মানুষদের অর্ধেকেরও বেশি, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক মাইক্রোওয়েভ মালিক, রাজ্যের সমস্ত এয়ার কন্ডিশন মালিকের ৪০%’ এইসব সংস্কৃতির কমলবনে বিএনডব্ল্যুতে করে মত্ত মাতঙ্গের মতো বিহারকারী পাঠকরা যে খবরের কাগজ নিয়মিত পড়েন বাংলা ভাষার সেই দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ‘বাংলাবাজ’ বলে গালি দেবে।

২৪ কোটি ভাষাভাষীর ভাষা বাংলার এই দুরবস্থা, অবক্ষয়ের ইতিহাস নিয়ে আজকাল কেউ আর মাথা ঘামায় না। কোনো আলোচনা হয় না এ ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের কথা কেন জানিনা কেউ কেন কখনোই বলেন না। এই পর্বটা হল ষাটের দশকের শেষে আর সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গে নক্সাল আন্দোলন নামে পরিচিত মাওবাদী কম্যুনিস্ট আন্দোলন। বস্তুত এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমরা নয়াঔপনিবেশিকতার পরিবর্তিত রণকৌশল বাজারঅর্থনীতি আর তার বিবর্তিত পরিণত রূপ বিশ্বায়নের পরিপোষক ভাষিক আর সাংস্কৃতিক নীতির আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা ও বিতর্কে কেন জানি না এই দুই বিষয় সম্পর্কে নীরবতা পালন করা হয়।

১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীনহয় তখন কলকাতা শহর তথা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মাধ্যমিক স্কুল ছিল বাংলামাধ্যম। ১৯৫১ সালে কলকাতা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল দুশ বিয়াল্লিশটি (স্থায়ী অনুমোদনপ্রাপ্ত ছেলেদের স্কুল ৭৩ + মেয়েদের স্কুল ৬৩ + অস্থায়ী অনুমোদনপ্রাপ্ত স্কুল ১০৬) । এর মধ্যে ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দুমাধ্যম স্কুল ছিল সব মিলিয়ে পনেরোষোলোটি, বাকি সবই বাংলামাধ্যম। ইংরেজিমাধ্যম স্কুল ছিল সাতআটটি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ক্যাথলিক বা প্রটেস্ট্যান্ট (খ্রিস্ট) ধর্মীয় মিশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত মিশনারি স্কুল নামে পরিচিত এই স্কুলগুলিতে যাঁরা ছেলেমেয়েদের পাঠাতেন তাঁরা হলেন : . অ্যাংলোইন্ডয়ান সম্প্রদায়; . বাঙালি খ্রিস্টানদের একটি অংশ, করণ এসব মিশনারি স্কুলে খ্রিস্টান ছাত্ররা নানান ধরনের সুবিধা পেত, এছাড়া খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে ইংরেজি ভাষার একটা ভাবানুষঙ্গ গড়ে উঠেছিল ; . গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলির চাকরি করা ভারতীয়রা — যাঁরা ঘনঘন স্থান পরিবর্তনের বাস্তব কারণে সস্তানদের ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হতেন ; . ছেলেকে ইংল্যাণ্ডে ইটন বা হ্যারোর পাবলিক স্কুল, মেয়েকে সুইজারল্যাণ্ডের ফিনিশিং স্কুল তো দূরের কথা, সিমলা, নৈনিতাল কি দার্জিলিংএর ইংরেজি স্কুলে পাঠানোও যাঁদের সাধ্যে কুলোত না অথচ যাঁরা ছেলেমেয়েকে ব্রাউন ছোটসাহেব কি ছোটিমেমসাহেব বানানোর স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা পিটুলিগোলা জলে দুধের সাধ মেটানোর জন্য ছেলেমেয়েদের কলকাতার অ্যাংলোইন্ডিয়ান স্কুলে পাঠেতেন। এসব স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এদেশে বসে ইয়র্কশায়ারের মিস্টার ও মিসিস মার্টিনের ছেলে ক্রিসমাসে কী করে তার বিবরণ পড়ত। সাধারণত এরা দেশের অবস্থা, সমাজ বা রাজনীতির সমস্যা বা পরিবর্তন নিয়ে মাথা ঘামাত না, কর্মজীবনে বিলিতি সওদাগরী হৌসে সাদা চামড়ার বড় সাহেবদের বশংবদ মেজ, সেজ কি ছোট সাহেব হওয়াটাই ছিল এদের জীবনের চরম লক্ষ্য। বস্তুত এসব ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের বাঙালি ছাত্ররা পরবর্তী জীবনে সাধারণত বিলিতি সওদাগরি অফিস, চাবাগান, সওদাগরি জাহাজ ইত্যাদির ছোট সাহেব হতেন। শিক্ষা আর ভাষার নিয়ন্ত্রণে এরা দেশের মানুষ, সংস্কৃতি এবং জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় স্যুটকোটটাইগাউন, লাঞ্চডিনার, ড্রয়িং রুম, ডাইনিং টেবল ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকত। অন্যদিকে যেসব ছেলেমেয়ে শিক্ষা, প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রাকৃতিক বা মানবিক বিজ্ঞানের গবেষণা, প্রশাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতেন তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন বাংলামাধ্যম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উত্পাদন।

বিশ শতকের প্রথম থেকে, বিশেষ করে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জোয়ারের পর বাঙালি স্কুলগুলিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এই চেতনা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার পর প্রগতিশীল বামপন্থী চিন্তা ও মানসেকতার পরিণতি লাভ করে, এই মানসিকতা কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ক্রমশ কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সহমর্মী করে তুলতে থাকে। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বামপন্থী প্রবণতা পঞ্চাশের মাঝামাঝি থেকে অনুমোদিত, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানিক পরিণতি লাভ করল। এর পর বাইেরর ঘটনাক্রমে দেখা যায়, যাটের দশকের গোড়ায় চিনভারত বিরোধ ও সংঘর্ষের ফলস্বরূপ ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। এরপর আবার আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনের (রুশ ও চিনে পন্থার) বিভাগের ঢেউ ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টিকে আরো বিভক্ত করে, দেখা দেয় সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী মাওবাদী নকশালপন্থীরা (১৯৬৭) । তবে ভেতরের দিক থেকে বলা যায়, নিম্নমধ্যবিত্ত দ্বিধা, বাঙালি/ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণীর সামাজিক স্কিজোফ্রেনিয়া, ক্ষমতালোভী সুবিধাবাদ, প্রতিষ্ঠানিক বামপন্থার নাস্ত্যর্থক পরিণতির মধ্যে ক্রমশ স্পষ্ঠ হয়ে উঠছিল। তাই প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থার মধ্যে পথের সন্ধান না পেয়ে ষাটের দশকের শেষে বাঙালি মধ্যিবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর আদর্শবাদী নতুন প্রজন্মের আশাভঙ্গ এবং অন্বেষণের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটল। অপরিকল্পিত, স্বতঃস্ফুর্ত এই অতর্কিত বিস্ফোরণই হল নকশালআন্দোলন। এই আন্দোলনের সময় তথাকথিত বুর্জোয়া শিক্ষার বিরুদ্ধে পরিকল্পনাহীন, বিকল্পের চিন্তাহীন বিক্ষিপ্ত আক্রমণের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন শক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে যে পরিকল্পিত ধ্বংসাত্মক অরাজকতার সৃষ্টি করল তার প্রথম শিকার হল বাঙলামাধ্যম মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলো। এই নকশালপন্থী বিদ্রোহের আক্রমাণের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে ওঠে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা। শুরু হয় শিক্ষায়তন, পরীক্ষা ভণ্ডুল ইত্যাদির মাধামে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের কার্যক্রম। নকশালপন্থীরা শহরাঞ্চলে লুম্পেনপ্রলেতারিয়েৎদের বিপ্লবের সঙ্গী করে তথাকথিত আর্বান গেরিলাবাহিনী গড়ে তুলতে চাইলেন। নকশালপন্থীদের যথার্থ সংগঠন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বা পরিকল্পনা বলে প্রায় কিছুই ছিল না। এছাড়া কর্মীদের আদর্শে দীক্ষিত এবং তাত্ত্বিক দিক থেকে শিক্ষিত করে তোলার কর্মসূচিও ছিল না বললেই হয়। একথা আজ যেকোনো পর্যবেক্ষকের কাছে স্পষ্ট যে এঁদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও হঠকারিতার সুযোগ নিয়ে দলের তথাকথিত লুম্পেনপ্রলেতারিয়েৎদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক লুম্পেনপ্ররোচক বেনোজলের মতো ঢুকে পড়ে। এদের কাজ হয় একদিকে আতঙ্ক সৃষ্টি করে নকশালপন্থী আন্দোলনকে জনসাধারণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা, অন্যদিকে বামপন্থী ধ্যানধারণার বীজতলা বাংলামাধাম স্কুলগুলির প্রতিষ্ঠানিক মূর্তি ধ্বংস করা। আর এই অবস্থাকে নানা উপায়ে রাজনীতিবিমুখীনতার বিস্তারের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হল। বাংলা মাধ্যম, দীর্ঘকালের ঐতিহ্যপূর্ণ স্কুলগুলোর আর্থিক অবস্থা, শিক্ষার মান এবং পরিবেশের দ্রুত চূড়ান্ত অধোগতি হল, আর পাশাপাশি গজিয়ে উঠল, ফুলে ফেঁপে উঠল অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। এসব স্কুল আক্রান্ত হল না, এসব স্কুলে পরীক্ষা ভন্ডুল হল না, শিক্ষকশিক্ষিতরা নিগৃহীত হল না। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার বাংলা স্কুলের অরাজকতা ও নিম্নমান এড়িয়ে যে কোন মূল্যে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুলে পাঠাতে শুরু করলেন। এই পরিস্থিতিটা ক্রমশ স্বাভাবিক হিসেবে স্থিতি লাভ করল। উচ্চতর শিক্ষা, পেশাদারী শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র এমন কি সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রেও রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামানো, বহিমুর্খী (extravert) চটপটে ইংরেজি বুলিআউড়ানো ছেলেমেয়েদের অগ্রাধিকার স্বীকৃত হল। গত বিশ বছরে ইংরেজি স্কুলের উত্পাদন নতুন প্রজন্ম চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ক্ষমতাসীন সুবিধাভোগী শাসকশোষক শ্রেণীর পক্ষে নিরাপদ, দেশের রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক অবস্থা, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহহীন, স্বার্থপর এবং সুযোগসন্ধানী এই প্রজন্ম ক্রমশ পরিপুষ্ট হচ্ছে, শাসকশোষক শ্রেণীর কাছে মদত পাচ্ছে। অনগ্রসরবাংলাভাষা নিয়ে এদের কোনো মাথা ব্যথা নেই, নিজেদের স্বার্থ এবং প্রতিষ্ঠা বজায় রাখার জন্য কর্মের জগতে ইংরাজির আধিপত্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে এরা বাধ্য। সুতরাং বাংলাভাষার সর্বন্তরে ব্যবহারের সম্ভাবনা সুদুরপরাহত। এই ব্যাপারটা যে পরিকল্পিত ও সংগঠিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই; এর পেছনে ছিল শাসন কর্তৃপক্ষের গুপ্ত আরক্ষা কৃত্যকের মদত ও পরিচালনা এবং অনুমান করা যায়, বিদেশি (নয়াঔপনিবেশিক ধনতান্ত্রিক বা/এবং তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক) গুপ্ত আরক্ষা চক্রের যোগসাজশ, পরামর্শ ও পরিকল্পনা। কলকাতা তথা সারা পশ্চিমবঙ্গে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের নামে দীর্ঘ ঐতিহ্যযুক্ত বাংলামাধ্যম স্কুলগুলি আক্রান্ত হল; গণটোকাটুকি, পরীক্ষা ভণ্ডুল, পরীক্ষককে অপমান ও আক্রমণ ইত্যাদির মাধ্যমে পরীক্ষাব্যবস্থায় চূড়ান্ত অরাজকতা সৃষ্টি করা হল, বিশৃঙ্খলা ও ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে তৈরি হওয়া নিরাপত্তাহীন অবিদ্যায়তনিক পরিস্থিতিতে সাধারণভাবে এই স্কুলগুলির শিক্ষণব্যবস্থা শিকেয় উঠল। একই সময়ে ছাত্রদের কাছ থেকে সামান্য আর্থিক পাওনার আদায় প্রায় বন্ধ হওয়া এবং সরকারি সাহায্যের অপর্যাপ্তি ও অনিয়মিততার ফলে বেশিরভাগ বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক দুরবস্থাও চরমে ওঠে। ফলে এই নৈরাজ্যের মধ্যে মানসিকভাবে নির্যাতিত বাংলামাধ্যম স্কুলের শিক্ষকদের নিয়মিত মাসমাইনে পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসম্মানের কারণে যাঁর অন্য কোনোভাবে জীবিকাঅর্জনের এতটুকু উপায় আছে, নিদেনপক্ষে সরকারি বা বেসরকারি অফিসে অবরবর্গীয় কেরানির পদ পাওয়ার সন্ভাবনা রয়েছে তিনি বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করতে আর রাজি ছিলেন না। পড়ানোর যোগ্যতা, ক্ষমতা এবং ইচ্ছে রয়েছে এমন কেউ আর বাংলামাধ্যম স্কুলের পথে পা বাড়াতে চাইলেন না। পাশাপাশি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলগুলির দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকল। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, বলা যায়, দোকান হিসেবে কলকাতা ও শহরতলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য নতুন ইংরেজিমাধ্যম স্কুল গজিয়ে উঠল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই ইংরেজিমাধ্যম স্কুলগুলির একটিও নকশাল অরাজকতার শিকার হল না, স্কুল আক্রান্ত হল না, পরীক্ষা ভণ্ডুল হল না। অ্যাসবেসটসের ছাউনিওয়ালা বালিগঞ্জের সাউথ পয়েন্ট স্কুলের কয়েকটি নতুন বাড়ি হল — ছাত্রসংখ্যা বাড়তে বাড়তে বারো হাজার ছুঁল, স্কুলের নাম ছাত্রসংখ্যার রেকর্ডের জন্য গিনিজ বুকে স্থান পেল। দুতিনটি সরকারি স্কুল বাদ দিয়ে বাকি বাংলা স্কুলগুলি বাত, পিত্ত, কফে ভোগা রোগীর মতো কোনোরকমে খুঁকতে থাকল। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালিরা — যাঁদের বাড়িতে একাধিক প্রজম্মের পড়াশোনার চল ছিল তাঁরা অন্যান্য খরচ যতটা পারেন কমিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ছেলেমেয়েদের ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পাঠাতে লাগলেন। বর্ধিষ্ঞু মফস্বল শহরগুলিতেও কিছু কিছু ইংরেজিমাধ্যম স্কুল গড়ে উঠতে লাগল। শহরে নিতান্ত গরিব বা/এবং পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কহীন লোকেরা আর গ্রামবাসীরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিম্লমানের বাংলামাধ্যম স্কুলে পাঠাতে লাগলেন। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার সম্পর্কে যে চিন্তা উনিশ থেকে বিশ শতকের ষাটের দশক অবধি বিবর্তিত হচ্ছিল, যা নিয়ে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক চলছিল, তা হঠাৎ পুরোপুরি থেমে গেল। আজকের শহুরে বাঙালি উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের জন্য নির্বাচিত প্রথম ভাষা হল ইংরেজি। দ্বিতীয় ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দি (সর্বভারতীয় সরকারি ভাষা ! হিন্দিতে বলে রাষ্ট্রভাষা!) এসব ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগের বাংলা অক্ষরপরিচয় নেই। চিনে, জাপানি, জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ান, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষা পরিচয়ে কেউ চিনে, কেউ জাপানি, কেউ জার্মান, কেউ ফরাসি, কেউ ইতালিয়ান, কেউ ইংরেজ, ভাষার আত্মপরিচয় হারানো বঙ্গবাসী শেষ পর্যন্ত সুকুমার রায়ের “কিম্ভূত”এ পরিণত হতে চলেছে :

কোথাকার তুই কেরে, নাম নেই ধাম নেই ?

জবাব কি দেবে ছাই, আছে কিছু বলবার ?

কাঁচুমাচু বসে তাই, মনে শুধু তোল্‌পাড়

নই ঘোড়া, নই হাতি, নই সাপ বিচ্ছু,

মৌমাছি প্রজাপতি নই আমি কিচ্ছু ।

মাছ ব্যাং গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই,

নই জুতা নই ছাতা, আমি তবে কেউ নই !