হোয়ান রামোন হিমেনেথ Juan Ramon Jimenez (1881-1958)

হোআন রামোন হিমেনেথ 

Juan Ramon Jimenez (1881-1958)

jimenez

নিকারাগোআর কবি রুবেন দারিও(১৮৬৭১৯১৬) নেতৃত্বে স্প্যানিশ ভাষার আধুনিকতার(Modernismo) আন্দোলনের শুরু, এবং ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ে মূল স্পেনে। কবি (Juan Ramon Jimenez, ১৮৮১১৯৫৮) অল্পবয়সে এ আন্দোলনে যোগ দিয়ে আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী কবি হিসেবে গণ্য হন। ফরাসি প্রভাবিত আধুনিকতার চর্চায় হিমেনেথ যথার্থ ইস্পানি ঐতিহ্য আর চরিত্রের মিশ্রণ ঘটান।

রুবেন দারিওর আন্দোলনের প্রভাবেই হিমেনেথের প্রথম দিকের কবিতা কিছুটা অতিপরিশীলিত। এরপর ক্রমশ তাঁর কবিতা অলংকারবাহুল্য ত্যাগ করে সঙ্গীত ও রহস্যের অভিমুখী হতে থাকে। এপ্রসঙ্গে তাঁর লগ্নকবিতা‘-র স্বীকারোক্তি স্মরণীয়। আর তিনিইতো বলেছিলেন, ‘কবিতা হবে একটা তারার মত, পুরো একা জগৎ আর দেখতে হিরের একটা টুকরোর মতো

তাঁর কাব্যকৃতির সঙ্গে সঙ্গে হিমেনেথ ক্রমে স্প্যানিশ কবিতার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন; তাঁকে ঘিরে একটা সাহিত্যিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। পরবর্তী ইস্পানি কবিদের রচনায় হিমেনেথএর কমবেশি আন্তঃরাচনিক উপস্থিতি অনুভব করা যায়।

স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলা কালে অনেকের মত হিমেনেথও দেশ ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে আশ্রয় নেন। হিমেনেথের কবিতার পরিণতির ইতিহাসে এই দেশত্যাগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় থেকে তাঁর কবিতা গভীর এক উপলব্ধিময় দার্শনিকতার পটভূমিতে স্থাপিত হয়, যার মধ্যে ফিরে ফিরে আন্দালুথিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশের স্মৃতিচিত্র ।

হিমেনেথের শেষের দিকের কবিতায় বিশ্বময় সর্বব্যাপ্ত প্রাণময়তার বোধের প্রকাশ দেখা যায়। স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে। উল্লেখযোগ্য যে, হিমেনেথ স্প্যানিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে স্ত্রীর সহযেগিতা করেন। মনে পড়ছে, শ্রদ্ধেয় পিয়ের ফালোঁ বলেছিলেন, ইউরোপের বিশ শতকের প্রধান কবিদের মধ্যে একমাত্র হিমেনেথের রচনাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

বহুকাল আগে হিমেনেথএর কবিতা পড়তে পড়তে কিছু কবিতার অনুবাদ করি। আমি স্প্যানিশ জানিনা, আমার পড়া আর অনুবাদ তাই হিমেনেথএর ফরাসি আর ইংরেজি অনুবাদের অনুবাদ অর্থাৎ পরোক্ষ অনুবাদ। কখনো সখনো ফরাসি অনুবাদের পাশে স্প্যানিশ মূল কবিতা দেখতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু স্প্যানিশ ভাষায় আমার কোনো বিধিবদ্ধ জ্ঞান না থাকায় তাকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া যায় না।

এছাড়া যেসব সংকলনে কবিতাগুলি ছিল তাও আমার হাতের কাছে আজ আর নেই, আমার স্মৃতিতেও তাদের পরিচয় মুছে গেছে ফলে কোনো রকম সংশোধন বা পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। তবু পুরনো একটা খাতায় একসঙ্গে অনূদিত রচনাগুলি পেয়ে পাঠকের সামনে তা তুলে ধরার ইচ্ছে হল।

পুষ্কর দাশগুপ্ত

হোয়ান রামোন হিমেনেথএর কবিতা

১.

কেউতো ছিল না। জল।— কেউ নয় ?
জল তবে কেউ নয় ? — কেউ
নয়। আছে ফুল। — কেউ নয় ?
ফুল তবে কেউ নয় ? — কেউ নয়।

ছিল হাওয়া। — কেউ নয়?
কেউ নয় হাওয়া ? – কেউ
নয়। মুগ্ধমায়া। – কেউ নয় ?
মুগ্ধমায়া কেউ নয় তবে ?

 

২. সঙ্গীত

সহসা, ঝর্ণার মতো
বিদীর্ণ বুকের থেকে
আবেগ-উচ্ছল ধারা ভেদ করে ছায়া —
একটি নারীর মতো
বারান্দার জানলাগুলি খুলবে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তেমনি
নগ্ন সে যে, নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে চেয়ে থাকে
অকারণ মৃত্যুর ইচ্ছায়,
যেই মৃত্যু হবে তার উন্মাদনা, অনন্ত জীবন।

 

অথচ সে ফিরে আর আসেনা আবার,
—নারী কিংবা জল —
যদিও সে আমাদেরই গভীরে রয়েছে, উচ্ছ্বসিত,
সত্য ও অলীক
স্তব্ধ হতে পারে না, কখনো।

 

৩.

— দাঁড়াও, দাঁড়াও আলো
— আর আমি ছুটে যাই, উদগ্রীব, উন্মাদ —
দাঁড়াও, দাঁড়াও আলো !
— সে দাঁড়ায়, আর যেই আমি
ছুঁতে যাই সীমারেখা তার, অমনি সে আঁধার,
শীতল। —

 

দাঁড়াও, দাঁড়াও, আলো !
—আর আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি শিশুর মতন
একা একা কাঁদি, তাকে দেখিনা যখন;
দাঁড়াও… দাঁড়াও… আলো। —

 

৪.

আমি জানি কাণ্ড আমি
অনন্ত বৃক্ষের।
আমি জানি আমার রক্তের মধ্যে
বাঁচিয়ে রেখেছি আমি তারাদের।
প্রতিটি উজ্জ্বল স্বপ্ন
আমারই নিজস্ব পাখি…
আমি জানি মৃত্যুর কুঠার
আঘাতে লুটিয়ে দেবে আমাকে যখন
ভেঙে পড়বে আকাশ তখনি ।

 

৫. ক্ষণিক

হারিয়ে ফেলছি, হারিয়ে ফেলছি, হারিয়ে ফেলছি তাকে !
… সেতো চলে গেল !
আর ক্ষণিকের সাথে
হারিয়ে ফেলেছি অনন্তকাল আমি ।

 

৬. সঙ্গীত

শান্ত রাত
পবিত্র কোমল সুর, বৃষ্টিধারা তুমি
বাঁচিয়ে রেখেছো ঐ তারাদের
– যেন পদ্মগুলি এক অতল আধারে।

 

৭. ভোর

ঠান্ডার শুরু: মোরগ ডাকছে।
বজ্র জ্যোত্স্না: শিশুটি কাঁদছে।
নির্জন পথ: কুকুর ছুটছে।
রাত্রি এখনো: মানুষ ভাবছে।

 

৮.

কুয়োয় নুড়ির মতো
পড়ে আছে আমার হৃদয়, ঠিক তার
নিচে আর ওপরে আকাশ।

 

৯. মোগেরে ভোর

দেখা দেয় সঙ্গীহীন কালো ষাঁড়, উজ্জ্বল, সু্ন্দর,
শীতল সবুজ ভোরে, উঁচু নীল পর্বতচূড়ায়
ডেকে ওঠে দক্ষিণ – উত্তরে , প্রকাণ্ড মাথায় তার
ঠেলে দেয় ক্রমশ পেছনে
আকাশ, প্রাগাঢ় লাল, তখনো বিরাট কটি
তারকায় ঢাকা।

 

—আতঙ্কিত বিপুল নির্জন;
অন্তহীন নীরবতা সহসা ঘনায়।

 

ষাঁড় — ভগ্ন শিলাখণ্ড — ঢুকে পড়ে
পাতায় আবৃত গিরিপথে ।
সে ছাড়া থাকেনা কিছু,
চলে যায় ? সমন্ত আঁধার,
তখন বেরিয়ে আসে! শাদা আর গোলাপী সজ্জায় সাজা, ওই আলো।

 

১০.

স্তব্দ হলে গান
কী হয় সুরের;
যে-বাতাস থেমে যায় তার,
যে-আলোক নিভে যায়
তার ?

 

বল, মৃত্যু, নিস্তব্ধতা প্রশান্তি ও অন্ধকার ছাড়া
কীবা তুমি আর ?

 

১১.

শাদা মেঘ,
ভাঙা ডানা — কার ?
পৌঁছাতে সে পারেনি — কোথায় ?

 

১২.

ঘুম যেন সেতু
যোগাযোগ আজ আর আগামী কালের।
নীচে তার, স্বপ্নের মতন,
বয়ে যায় জলধারা, ভেসে যায় হৃদয় আমার।

 

১৩.

শুধু ঘন্টাধ্বনি আর পাখি এক শান্তিভ্ঙ্গ করে…
যেনবা দুজনে ওরা কথা বলে পশ্চিমের দিগন্ত-   সীমায়

 

স্তব্ধতা সোনায় গড়া । বিকেল বেলাটা যেন স্ফটিকে নির্মিত ।
সহসা শুদ্ধতা এসে দোলায় সুস্নিগ্ধ বৃক্ষগুলি
সমস্ত পেরিয়ে এক স্বচ্ছধারা নদী স্বপ্ন দেখে,
আর সে ছড়িয়ে মুক্তো ছুটে যায় অসীমের দিকে …

 

নির্জনতা ! নির্জনতা ! সবকিছু উজ্জ্বল, নীরব…
শুধু ঘন্টাধ্বনি আর পাখি এক শান্তিভঙ্গ করে …

 

প্রেম বহু দূরবর্তী… শান্ত, উদাসীন,
হৃদয় সম্পূর্ণ মুক্ত; বিষণ্ণ বা উল্লসিত নয়;
তাকে আলোড়িত করে রঙ, হাওয়া, গন্ধ আর গান…
সে যেন সাঁতার কাটে চেতনায় অবারিত হ্রদে।

 

শুধু ঘন্টাধ্বনি আর পাখি এক শান্তি ভঙ্গ করে …
মনে হয় করতলে আমি অনন্তকে ধরে রাখতে পারি ।

 

১৪. জন্মাবো আবার

শিলা হয়ে জন্মাবো আবার
আর তখনো তো আমি ভালোবাসব তোমাকেই , নারী।

 

হাওয়া হয়ে জন্মাবো আমার,
আর তখনো তো আমি ভালোবাসব তোমাকেই , নারী।

 

ঢেউ হয়ে জন্মাবো আবার,
আর তখনো তো আমি ভালোবোসব তোমাকেই , নারী।

 

শিখা হয়ে জন্মাবো আবার,
আর তখনো তো আমি ভালোবোসব তোমাকেই , নারী।

 

নর হয়ে জন্মাবো আবার,
আর তখনো তো আমি ভালোবাসব তোমাকেই , নারী।

 

১৫.

আমি নই আমি।
আমি সে, যে
আমার অলক্ষ্যে হাঁটে আমার পাশেই ,
যাকে আমি কখনোবা দেখতে চাই ,
যাকে আমি কখনোবা ভুলে যাই।
সে থাকে নীরব, শান্ত যে সময়ে আমি কথা বলি ;
সে বিনয়ে ক্ষমা করে যে সময়ে আমি ঘৃণা করি ;
সে যায় যেখানে আমি নেই ,
সে থাকবে দাঁড়িয়ে ঋজু মৃত্যু হবে যখন আমার।

 

১৬. গাছের শীর্ষ ঘিরে

একটি উঁচু গাছের
শীর্ষ ঘিরে
উড়ছে আমার স্বপ্নগুলি সব।
স্বচ্ছ আলোর মুকুট-পরা
কপোত ওরা
উড়তে উড়তে ছড়িয়ে দিচ্ছে গান।

 

একটি গাছের শীর্ষ থেকে
কেমন যাওয়া-আসা।
আমায় এমন সোনার জালে জড়িয়ে ফেলে ওরা !

 

১৭. আলো আর জল

মাথার ওপরে আলো – স্বর্ণময়, কমলা, সবুজ –
কুহেলি মেঘের মাঝখানে ।

 

পত্রহীন হে বৃক্ষেরা,
জলের গভীরে মূল
শাখাগুলি ছড়ানো আলোয় !

 

নিচে, জল, — সবুজ, কমলা, স্বর্ণময় —
কুহেলি ধোঁয়ার মাঝখানে।

 

কুহেলি ধোঁয়ার মাঝে — কুহেলি মেঘের মাঝখানে
আলো আর জল — কীযে জাদু !—সহসা মিলায়।

 

১৮.

বিকেলের পথগুলো সব
একাকার হয়ে যায় রাতে।
সংগোপন ওপথ ধরেই
প্রেমিকা, তোমার কাছে যাবো।

 

ওপথে তোমার কাছে যাবো,
পর্বতের আলোর মতন,
সমুদ্রের হাওয়ার মতন,
কুসুমের গন্ধের মতন।

 

১৯.শীতের দৃশ্য: তুষার

কোথায় কোথায় আহা সব রঙ লুকিয়েছে তারা
কালো আর সাদা এই পরিম্লান দিনে ?
পাতাগুলি কালো ; জল, ছাইরঙ ; আকাশ ও মাটি
মৃত্যুর মতন এক শাদা আর কালো বিবর্ণতা ;
আর এই বিষণ্ণ শহর
শুধু এক পুরনো খোদাই-করা রোমান্টিক ছবি।

 

পথচারী মানুষেরা কালো ;
কালো, ঐ ভয়ার্ত পাখিটি
তীরের গতিতে যেবা উড়ে যায় বাগান পেরিয়ে ,
এমনকী স্তব্ধতাও বিবর্ণ , কঠিন।

 

সন্ধ্যা নামে। আকাশে
কোথাও কোনো কোমলতা নেই। আর এই সূর্যাস্তে এখন
নীলাভ হলুদ এক আলো, খুবই ম্লান
কিংবা ঠিক আলো নয়। দূরে গ্রাম
জংধরা লোহার তৈরী।
রাত্রি আসে। যেন
এক শবযাত্রা। সবকিছু শোকার্ত,
শীতল, কোথাও তারারা নেই, শাদা
আর কালো এই দিনের মতন : শাদা আর কালো।

 

২০. নব বসন্ত

রক্তিম জলের বুকে
একজোড়া রাজহাঁস পাশাপাশি কাটছে সাঁতার…
যন্ত্রণা সাঁতার কাটে শোণিতে আমার।

 

রক্তিম বাতাসে
পাশাপাশি একজোড়া গোলাপ ব্যাকুল…
যন্ত্রণা ব্যাকুল হল শোণিতে আমার।

 

রক্তিম আকাশে
পাশপাশি একজোড়া শ্যামাপাখি শিস দিয়ে ওঠে…
যন্ত্রণাও শিস দেয় শোণিতে আমার।

 

২১.
আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছো তুমি
অথচ আমিযে তোমার কথাই ভেবে
তোমাকেই যাই ভুলে।

 

২২. পরম গোলাপ

তুলে নাও ওকে ! তোল ওকে , ওই যে গোলাপ !
না না, ওতো সূর্য !

 

অগ্নির গোলাপ,
স্বর্ণের গোলাপ,
পরম গোলাপ !

 

না না, ওতো সূর্য !

 

দীপ্তির গোলাপ,
স্বপ্বের গোলাপ,
পরম গোলাপ।

 

 

না না, ওতো সূর্য !

তুলে নাও ওকে ! তোল ওকে , ওই যে গোলাপ !

 

২৩. দূরের সমুদ্র

ঝর্ণার গান ক্রমশ মিলিয়ে যায়।
পথগুলি সব জেগে ওঠে একে একে…
রূপোলি সাগর, ভোরের সাগর, তুমি
কিযে পবিত্র ঝাউয়ের বনের ফাঁকে !

 

দক্ষিণ হাওয়া, এলে তুমি ধ্বনিময়
রৌত্রের সাথে ? দৃষ্টি হারালো পথ…
দুপুরে সাগর, সোনালি সাগর, তুমি
কিযে উচ্ছল ঝাউবন পার হয়ে !

 

সবুজ পাখিটি বলছে অজানা কিছু…
হৃদয় আমার পথ ধরে চলে যায়…
বিকেলে সাগর, গোলাপী সাগর, তুমি
কিযে প্রশান্ত ঝাউয়ের বনের ফাঁকে !

 

২৪. প্রাক্-বসন্ত

নদীর বুকে বৃষ্টিধারা ঝরে…

 

সবুজ ঐ নদীর পারে
গন্ধময় নলের বন
বৃষ্টিপাতে কাঁপে…
কেমন এক আকুল ঘ্রাণ
শীতল পাপড়ির !

 

নদীর বুকে বৃষ্টিধারা ঝরে…

 

আমার এই নৌকাখানি
স্বপ্ন যেন, স্বপ্নে গড়া
আবছা পৃথিবীতে। ওগো সবুজ তীর
হালছাড়া হে নৌকা ওগো
শীতল অন্তর !

 

নদীর বুকে বৃষ্টিধারা ঝরে…

 

২৫. রাত্রি

আমার অশ্রুর ফোঁটা এবং তারকা
ছুঁলো পরস্পরে ; মুহূর্তেই
দুয়ে মিলে হয়ে গেলো একটি অশ্রুর ফোঁটা
দুয়ে মিলে হয়ে গেলো একটি তারকা।

 

আমিতো হলাম অন্ধ, এবং আকাশ
অন্ধ হলো প্রেমে।
যাকিছু — সমস্ত — হোল
তারকার মর্মব্যথা, অশ্রুর আলোক।

 

২৭. ছোট্ট সবুজ মেয়ে

সবুজ মেয়েটি। তার
সবুজ দুচোখ, সবুজ চুলের বেণী।

 

তার বাগানের গোলাপের কুঁড়ি
সেতো লাল নয় সেতো শাদা নয় সবুজ সবুজ সেযে।

 

সে বেরিয়ে এলো সবুজ হাওয়ায় !
পৃথিবী সবুজ হল।

 

উজ্জ্বল তার রেশমী পোষাক
সেতো লাল নয় সেতো নীল নয় সবুজ সবুজ সেযে।

 

সে বেরিয়ে এলো সবুজ সাগরে !
আকাশ সবুজ হোল।

 

আমার জীবন বারবার তাকে
খুলে দেয় এক ছোট্ট সবুজ দ্বার।

 

২৮.

কবিতা ; শিশিরবিন্দু
প্রতিটি ঊযার, শিশু
প্রতিটি রাত্রির ; প্রথম ফুলের ঐ
কোমল সত্যের ঊর্ধ্বে
সতেজ, নির্মল সত্য অমল
দূরতম নক্ষত্রপুঞ্জের !

 

শিশির, কবিতা ;
প্রত্যূষের ফোঁটাগুলি স্বর্গ থেকে পৃথিবীর বুকে !

                                            অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত বিস্তারিত পড়ুন

Ahmadou Kourouma: Les soleils des indépedances আহমাদু কুরুমা ( ১৯২৭-২০০৩) ‘ স্বাধীনতার সূর্যগুলি’ (= স্বাধীনতার দিনগুলি)

KOUROUMA

Ahmadou Kourouma :

Les soleils des indépedances

Première partie

(Chapitre I)

স্বাধীনতার সূর্যগুলি ;

প্রথম পর্ব

(প্রথম অধ্যায় )

Traduction en bengali:Pushkar Dasgupta

অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত

আহমাদু কুরুমা (Ahmadou Kourouma, ১৯২৭২০০৩) উত্তরপশ্চিম আফ্রিকার পূর্বতন ফরাসি উপনিবেশ আইভরি কোস্টএর (La Côte d’Ivoire/কোৎ দিভোয়ার এর) ফরাসি ভাষার লেখক। মালির রাজধানী বামাকোতে পড়াশোনা করার সময় ১৯৫০ সালে তিনি ফরাসি সেনাবাহিনিতে যোগ দিয়ে ইন্দোচিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন (১৯৫৪), যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি ফ্রান্সের লিয়োঁ শহরে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ সালে আইভরি কোস্ট স্বাধীনতা পেলে অনেক আশা নিয়ে আহমাদু কুরুমা দেশে ফিরে যান। সেখানে দক্ষিণপন্থী সরকারের সন্দেহের শিকার হয়ে কিছুদিন জেলে কাটানোর পর ১৯৬৪ থেকে ১৯৯৪ সাল অব্দি তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান।

এর পর দেশে ফিরে তিনি আইভরি কোস্টে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করে ফের সরকারের সন্দেহভাজন হন। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আহমাদু কুরুমা মারা যান। ‘ স্বাধীনতার সূর্যগুলি’ (Les soleils des indépedances = স্বাধীনতার দিনগুলি) আহমাদু কুরুমার প্রথম উপন্যাস, ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রকাশক পাণ্ডুলিপি পড়ে ফেরৎ দেওয়ার পর ১৯৬৮ সালে তা কানাডার মন্ট্রিল (মোঁরেআল/ Montréal ) শহরের একটি সাহিত্যপত্রিকা বইটি প্রকাশ করে যা বুদ্ধিজীবি পাঠকদের আকৃষ্ট করে। ইতিপূর্বে যারা পাণ্ডুলিপি ফেরৎ দিয়েছিল তার মধ্যে ছিল প্যারিসের বিখ্যাত প্রকাশনসংস্থা এদিসিয়োঁ দ্যু স্যই (Editions du Seuil)। এবার তারা বইটি সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হয়ে ১৯৭০ সালে বইটি প্রকাশ করে। এই উপন্যাস অবিলম্বে আফ্রিকান লেখকেরফরাসি ভাষায় লেখা ধ্রুপদী উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করে। ২০০০ সালে কুরুমার শেষ বিখ্যাত উপন্যাস ‘আল্লা বাধ্য নন ’ প্রকাশিত হয়। ‘স্বাধীনতার সূর্যগুলি’ সহ আহমাদু কুরুমার বিভিন্ন উপন্যাসের ভালো ইংরেজি অনুবাদ না থাকায় কুরুমা ইংরেজিভাষী জগতে খুব একটা পরিচিত নন।

ডালকুত্তা আর তার বসার বেহায়া ধরন

এক সপ্তাহ হল, রাজধানীতে মাল্যাঁকে জাতের কোনে ইরাহিমা ইন্তেকাল করেছে কিম্বা মাল্যাঁকে ভাষায় বলা যায়: সামান্য একটু সর্দির বোঝা ও আর বইতে পারে নি

যেকোনো মাল্যাঁকের মতোই ওকে ছেড়ে প্রাণটা যখন বেরিয়ে গেল তখন ওর ছায়াটা উঠে দাঁড়াল, খক খক কেশে কফ ফেলল, পোশাকআশাক পরে অনেক দূরের জন্মভূমি মাল্যাঁকেদের দেশের দীর্ঘ পথে ও বেরিয়ে পড়ল। ওখানে ওকে দাফনের দুঃখের খবরটা এত্তেলা করতে হবে। লোকবসতিহীন ধু ধু বাদাড়ের মাঝখানে নির্জন কাঁচা রাস্তার ওপর দুজন মাল্যাঁকে ফিরিওয়ালা ছায়াটাকে দেখে চিনে ফেলল। ছায়াটা জোর কদমে হাঁটছিল আর ওদের কোনো আদাব জানাল না। হাটুরে ব্যাপারিরা চিনতে ভুল করে নি: তারা বলাবলি করতে লাগল, ‘ইব্রাহিমা ইন্তেকাল করেছে। বাড়ি এসে ছায়াটা নিজের যাবতীয় সম্পত্তি এদিকওদিক করে গুছিয়ে রাখল। ঘরের পেছন থেকে লোকজন বাক্সপেটরা বন্ধ করার আর লাউয়ের খোলের ঘসাঘসির আওয়াজ শুনতে পেল। এমন কী ওর ছাগলভেড়াগুলোও কেমন অদ্ভুতভাবে ছটফট করতে করতে ডাকতে লাগল। বুঝতে কারো ভুল হল না, লোকে বলাবলি করতে লাগল – ‘ইব্রাহিমা কোনে ইন্তেকাল করেছে,ওটা ওর ছায়া। ছায়াটা রাজধানীতে দাফনে হাজির থাকার জন্যে ওর মরদেহের কাছে ফিরে গেল:পঁচিশ ক্রোশ পথে যাওয়াআসা। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে ব্যাপারটা ঘটে গেল।

মনে হচ্ছে, আপনারা যেন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাহলে আমার কথাটা শুনুন, আমি আপনাদের কাছে কসম খেয়ে বলছি যে ব্যাপারটা সত্যি। আমি আরো বলছি : মারা যাওয়া লোকটি যদি জাতে কামার হত আর আমাদের সময়টা যদি স্বাধীনতার যুগ না হত (মাল্যাঁকেরা বলে, স্বাধীনতার সূর্যগুলো) তাহলে, আমি আপনাদের কাছে কসম খেয়ে বলছি,লোকে কখনোই ওকে অনেক দূরের বিদেশবিভুঁইয়ে গোর দিতে সাহস পেত না। কামার জাতের বুড়ো কোনো এক মাতব্বর ছোট্ট একটা ছড়ি হাতে দেশ থেকে এসে হাজির হত, ধড়টাতে ছড়ির ঘা লাগাত, ছায়াটা ফের ধড়টার সঙ্গে এক হয়ে যেত, মরা লোকটি উঠে দাঁড়াত। ছড়িটা মৃতের হাতে দেওয়া হত, লোকটি বুড়ো মাতব্বরের পেছন পেছন চলতে থাকত, আর দুজনে একসঙ্গে ওরা কয়েকটা দিন আর কয়েকটা রাত হাঁটত । তবে খবরদার! মরা লোকটা যেন ফের বেঁচে না ওঠে! প্রাণ হল একমাত্র আল্লার হাতে! আর মুখে কিছু না দিয়ে, জল অব্দি না খেয়ে, এতটুকু রা না কেড়ে, এমনকী না ঘুমিয়ে মরা লোকটি বুড়োর পেছন পেছন যেত, হাঁটতে হাঁটতে গাঁয়ে এসে পৌঁছাত। গাঁয়ে পৌঁছে বুড়ো কামার ছড়িটা কেড়ে নিয়ে আরেকবার ঘা লাগাত, ছায়া আর ধড়টা ফের আলাদা আলাদা হয়ে যেত। আর জন্মগাঁয়েই একজন কামার জাতের মাল্যাঁকের হরেক দফার জট পাকানো দাফন সম্পন্ন হত।

অতএব ব্যাপারটা সম্ভব, বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করে বলা যায় যে ছায়াটা সত্যি ওর জন্মগাঁ অব্দি হেঁটে গেল, তেমনি আবার দাফনের দেখভাল করার জন্যে তড়িঘড়ি করে রাজধানীতে ফিরে এল। শবযাত্রীদের মধ্যের এক গুনিন ওকে মনমরা হয়ে কফিনের ওপর বসে থাকতে দেখেছিল। দাফনের পর সপ্তম দিন অব্দি কটা দিন কেটে গেল আর ছায়ার সামনে সপ্তম দিনের পারলৌকিক ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হল। তারপর কয়েকটা সপ্তাহ কাটিয়ে চল্লিশ দিনের দিন হাজির হল আর উবু হয়ে বসে থাকা ছায়ার পায়ের কাছে চল্লিশ দিনের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হল। হেঁজিপেঁজি মাল্যাঁকেদের চোখে ছায়াটা অবশ্য সারাক্ষণ অদৃশ্য থেকে গেল। তারপর ছায়াটা চিরতরে বিদায় নিল। হাঁটতে হাঁটতে সে মাল্যাঁকেদের দেশে এসে হাজির হল। সেখানে কোনো একটা মাল্যাঁকে বাচ্চার মধ্যে ও নতুন করে জন্ম নেবে, হয়ে উঠবে একজন মায়ের সুখের আধার।

ছায়াটা যেহেতু নিজে হাজির থেকে সবকিছুর ওপর নজর রেখেছিল, গোনাগুনতি করছিল,শোকরগোজারি করছিল গোর দেওয়াটা তাই ইমানদারভাবে সম্পন্ন হল, পারলৌকিক ক্রিয়া পবিত্রভাবে অনুষ্ঠিত হল। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এমন কী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া সাধারণ লোকজনও দানখয়রাত করল খয়রাতির মালগুলো অতিথি আর রাজধানীর তাবৎ বড় মাল্যাঁকে পরিবারের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হল। প্রতিটি পারলৌকিক অনুষ্ঠানে বেশ কিছুটা রোজগারপাতি হয় বলে এটা খুবই স্বাভাবিক যে মাল্যাঁকে গ্রিয়োরা, স্বাধীনতায় সর্বস্ব খুইয়ে বেচার মতো আর কিছুই যাদের অবশিষ্ঠ নেই সেই বুড়ো মাল্যাঁকেরা (আর রাজধানীতে কত বুড়ো ব্যাপারি যে সর্বস্বাস্ত হয়েছে তার হিসেব একমাত্র আল্লারই জানা রয়েছে) সবাই দাফন আর পারলৌকিক অনুষ্ঠানে কাজ করে। সত্যিকারের পেশাদার ! সকাল সন্ধ্যে ওরা এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাবতীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্যে হাঁটাহাঁটি করে। মাল্যাঁকেরা নিজেদের মধ্যে বদমাইসি করে ওদের নাম দেয়েছে শকুনবা হায়নার পাল

হোরোদুগুর দুম্বুইয়া রাজবাহাদুরদের শেষতম জায়েজ বংশধর, চিতাবাঘ গোত্র, দুম্বুইয়া বাবা,দুম্বুইয়া মা, খাঁটি দুম্বুইয়া, ফামা দুম্বুইয়া হল একজন শকুন‘ ! একজন দুম্বুইয়া রাজবাহাদুর । হায়নার পালে চিতাবাঘ গোত্র ! হায়রে! স্বাধীনতার সূর্যগুলো।

মরহুম কোনে ইব্রাহিমার সপ্তম দিনের পারলৌকিক ক্রিয়ায় যেতে ফামার দেরি হয়ে যাচ্ছিল। সে আরো তাড়াহুড়ো করতে থাকল। অতিসার রুগীর মতো দুগুণ কদমে সে পা ফেলছিল। দ্বিতীয় নামাজের সময় সে তখনো সাহেবদের মহল্লা আর নিগ্রো পাড়ার মাঝখানের পুলের ওপর: অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।

ফামা মনে মনে গজরাতে লাগল: হারামের হারামি ! বেজম্মা! আর সব কিছুই যেন তার মাথা খারাপ করে দেওয়ার জন্যে ঘোট পাকাচ্ছে । সূর্য ! সূর্য ! অলক্ষুণে স্বাধীনতার সূর্য আকাশের পুরো একটা কোণ ভরে ফেলছে , বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সেঁকছে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে দিচ্ছে — যাতে করে মনে হয় বিকেল বেলার অস্বাস্থ্যকর ঝড়বৃষ্টিটা স্বাভাবিক । আর তার ওপর ওই নিষ্কর্মা বাউন্ডুলের গুষ্টি ! হারামজাদা নিষ্কর্মা বাউন্ডুলের পাল ফুটপাতের মাঝখানে আস্তানা গেড়েছে,ফুটপাতটা যেন ওদের বাপের ভিটেমাটি। হাঁটতে গেলে ধাক্কাধাক্কি করতে হয়, ধমকাতে হয়,গালিগালাজ করতে হয়। সব কিছু মিলে কানে তালা লাগানো হট্টগোল: হর্ন, ইঞ্জিনের ভটভট,চাকার ঘরঘর, ড্রাইভার আর পথ চলতি লোকজনের চিত্কার আর ডাকাডাকি। পুলের বাঁদিকের রেলিং থেকে লেগুনটা অসংখ্য আরশিতে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। আরশিগুলো টুকরো টুকরো হয়ে অনেক দূরের পাড়ে গিয়ে ফের জোড়া লেগে যাচ্ছিল। সেখানে ছোট ছোট দ্বীপ আর জঙ্গলের সীমারেখা ছাইরঙ দিগ্বলয়ের খোপের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। পুলটা আসাযাওয়া করা রঙবেরঙের গাড়িঘোড়ায় পিলপিল করছে ; আর ডানদিকের রেলিঙের ওপারে লেগুনটা কোথাও কোথাও সারাক্ষণ ঝকঝক করছে , কোথাও বা রাঙামাটির রঙ; বন্দরটা জাহাজ আর গুদামঘরে ঠাসা; আর আরো কিছুটা দূরে লেগুনটা এবার রাঙামাটির রঙ, জঙ্গলের সীমারেখা আর অবশেষে ছোট্ট এক টুকরো নীল: দিগন্তের নীলে সমুদ্রের শুরু। ভাগ্যি ভাল ! বিসমিল্লা হি রহমান ! ফামাকে আর বেশি দূর হাঁটতে হবে না, বন্দরের শেষ সীমা দেখা যাচ্ছে, ঐ যে, ওখানে পথটা একটা ঢালুর মধ্যে,একটা খাদের ভেতর নেমে হারিয়ে গেছে। ঐ খাদের মধ্যে গিজগিজ করছে আরো গুদামঘরের চকচকে কি ম্যাটম্যাটে টিনের চাল, তালগাছ, পাতার ঝাড় আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে জানলায় খড়খড়ি লাগানো দুতিনটে কোঠাবাড়ি। পারলৌকিক অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার জন্যে ফামা এভাবে ছুটে চলেছে বুঝতে পারাটা মন্ত এক অধঃপতন আর লজ্জার ব্যাপার, মরা জানোয়ার নিয়ে হায়নার পালের সঙ্গে বুড়ো একটা চিতাবাঘের কামড়াকামড়ি করতে দেখে ফেলার মতই মস্ত ঘটনা।

ফামা — সোনাদানা, চর্ব্যচোষ্য, শরিফৎ আর মেয়েছেলের মধ্যে ওর জন্ম। ও তালিম পেয়েছে এক সোনা ছেড়ে অন্য সোনা পছন্দ করার , হরেক চর্ব্যচোষ্যের মধ্যে বেছে নিয়ে খাওয়ার, আর একশ স্ত্রীর মধ্যে থেকে মনের মতন একজনকে নিয়ে শোয়ার। আজ ওর কী হাল ?ও আজ একটা মড়াখেকো শকুন

ছুটতে থাকা একটা হায়না। আকাশটা অনেক ওপরে নিথর, শুধুমাত্র সমুদ্রের দিকটায় ছন্নছাড়া আর বেহায়া মেঘের দল হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে আর একটা ঝড়ঝাপ্টার মতলবে একে অন্যের পেছনে ছুটছে। রোদ আর বৃষ্টির খিচুড়ি পাকানো এদেশের হারামজাদা, বেতাল,বিদঘুটে ঋতুপরিবর্তনের কাল।

একটা বাগান পার হয়ে মোড় ঘুরে ও সরকারি চাকুরেদের পাড়ার রাস্তা ধরল। বিসমিল্লা হি রহমান। হ্যাঁ, এখানেই। তবে ফামার পৌঁছুতে দেরি হয়ে গেল। ব্যাপারটা বিরক্তিকর, কেননা এর ফলস্বরুপ ওকে লোকজনের মাঝখানে একেবারে মুখের ওপর সইতে হবে সেই লাঞ্ছনা আর আক্রোশ যা পাৎলুনের ঢোলা পায়ে যেন সাপ ছুঁড়ে দেয়: অসম্ভব হয়ে ওঠে বসা, দাঁড়িয়ে থাকা,হাঁটা কি শোয়া।

শেষ অব্দি ও এসে পৌঁছল। থামের ওপর তৈরি বাড়িটার তলার অংশটা দিউলাতে ভরে গিয়েছিল। সাদা, নীল, সবুজ, হলদে, — বলা যায় তাবৎ রঙের বুবু গিজগিজ করছিল, হাতগুলো ওঠানামা করছিল আর গালগল্পের খই ফুটছিল। গোরে যাওয়া ইব্রাহিমার সপ্তম দিনের অনুষ্ঠানের ভীড়। শুধু এক ঝলকে দেখে নিলেই হল। সব কটা মহল্লার সব কটা পেশার নাককান গুণে নেওয়া যায় — চেনা যায়। ফামা সালাম জানিয়ে আকর্ণ হাসল, প্রকান্ড শরীরটা থামের ফাঁকে একটা জায়গায় রাখল, বুবুটা গুটিয়ে নিয়ে গুটিসুটি মেরে চাটাইয়ের এক কোনায় বসে পড়ল। রোগাপটকা থুণ্থুরে বুড়ো একটা গ্রিয়ো গলা ফাটিয়ে টিপ্পনী কেটে যাচ্ছিল, সে উতোর ধরল:

হোরোদুগুর রাজবাহাদুর, শেষ জায়েজ দুম্বুইয়া আমাদের মধ্যে সামিল হলেনতবে কিনা একটু দেরি করে।

বিদ্রুপের ভ্রুকুটি আর মুচকি হাসি দেখা দিল। কী আর করা যায়: বলতে গেলে ভিখিরি এক রাজবাহাদুর, যে কোনো সূর্যের তলায় তা বিকট। তবে এ সমস্ত হাসিমস্করা করা কুত্তার বাচ্চাদের গালাগালি করে ফামা অযথা তার রাগ খরচ করল না। গ্রিয়োটা বলে চলেছে, আর তা আরো বেশি বিরক্তিকর:

এই বিলম্বে অবশ্য কোনো ঝামেলা হয় নি ; বড় ঘরের তাবৎ আচার আর হকিকৎ মানা হয়েছে। দুম্বুইয়াদের কথা ভুলে যাওয়া হয় নি। কেতাদের সঙ্গে হোরোদুগুর রাজবাহাদুরদের সম্বন্ধ দেখানো হয়েছে।

ফামা গ্রিয়োকে কথাটা আরেক বার বলতে বলল। সে আমতা আমতা করতে লাগল। যে মাল্যাঁকে নয় তার কাছে ব্যাপারটা অজানা থাকতে পারে: বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা একটা বেইজ্জতি, চোখের মণি গলিয়ে দেওয়ার মতো বেইজ্জতি। কেইবা এভাবে কেতাদের সঙ্গে দুম্বুইয়াদের একাকার করেছে? কেতারা ছিল ওয়াসুলুদের রাজা আর ওদের গোত্র ছিল জলহস্তী,চিতাবাঘ নয়।

রূঢ়, তিরিক্ষি আর ঘৃণা মেশানো গলায় ফামা ফের গ্রিয়োকে কথাটা আরেকবার আউরাতে বলল। সে লোকটি অনর্গল সাফাই গাইতে শুরু করল ; প্রতীকী — আচারঅনুষ্ঠানে সবই তো প্রতীকী, আর এতেই লোকের তুষ্ট থাকা উচিত। একটা গলদ, ধর্ম আর আচারঅনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিরাট একটা গলদ হল, এই শহরের কিছু বুড়োর পেট চালানোর একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে পালাপার্বণের খয়রাতিশেষমেশ একগাদা ন্যক্কারজনক অবান্তর কথা — ওর কাছে যা জানতে চাওয়া হয়নি। হারামজাদা গ্রিয়ো। সাচ্চা গ্রিয়ো বলতে আর কেউই নেই, খাঁটি গ্রিয়োরা সবাই গোরাদের বিজয়ের আগের যুদ্ধের বীর নায়কদের সঙ্গে গত হয়েছে। ফামাকে ওখানেই সাবুদ করতে হবে যে এখনো এমন মানুষ রয়েছে যারা হারামিপনা সইতে পারে না। বেল্লিকের পাদের গন্ধ শুঁকে ভদ্রতাবশত মুখ বুজে থাকলে, ওরা তোমাদের নাক নেই বলে সাব্যস্ত করে নেবে।

ফামা উঠে দাঁড়িয়ে তর্জনগর্জনে বাড়িটা কাঁপিয়ে তুলল। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া রোগাপটকা গ্রিয়োটা কোন নৌকোয় পা রাখবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। জমায়েৎ হওয়া লোকজনকে সে দুম্বুইয়া বংশের ক্ষুব্ধ আর অপমানিত বংশধরের বক্তব্য শুনতে বলল। চিতাবাঘ গোত্র, দুম্বুইয়া বংশের বংশধর নিজেই একটা চিতাবাঘ — ক্ষোভ আর রাগ ও চেপে রাখতে জানে না । গলা চড়িয়ে সে ফামাকে বলল:

বীরের রক্ত, যা সত্যি যা বজ্রের মতো কঠিন তাই জানিয়ে দাও, যা তোমাকে দুঃখ দিয়েছে তাই বল। উগরে দাও, চোখের সামনে বিছিয়ে দাও তোমার ফরিয়াদ।

গ্রিয়োর বিড়ম্বনায় উত্সাহ পেয়ে ফামার নিজেকে বাধাবন্ধহীন বলে বোধ হল। এবার তার মুখ খোলার পালা, তার হক রয়েছে, রয়েছে এক মেঝে শ্রোতা। তাহলে বলুন খাঁটি মাল্যাঁকে হিসেবে আর কী তার চাওয়ার থাকতে পারে। চিতাবাঘের গর্জনে খাঁকারি দিয়ে সে গলাটা পরিষ্কার করে নিল। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ফেজটা ঠিক করে নিল, বুবুর হাতটা নামিয়ে দিল, বুক ফুলিয়ে এমন ভাবে পায়চারি করতে লাগল যেন সবাই তাকে দেখতে পায়, আর এরপর সে মুখ খুলল। গ্রিয়োটা তার কথার পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছিল, ফামা হুংকার ছাড়ছিল আর আরো জোরে হুংকার ছাড়তে যাচ্ছিল কিন্তুহতভাগা গ্রিয়ো, হতচ্ছাড়া কাসি ! প্রচন্ড একটা বিশ্রী কাসি গ্রিয়োর গলাটাকে এমনই উত্যক্ত করে তুলল যে সে বাধ্য হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে কফের সঙ্গে তার কলজে দুটো প্রায় বের করে দিচ্ছিল। ঘটনাটা ফামাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল। গ্রিয়োর জন্যে শেষতম দুম্বুইয়ার এতটুকু সমবেদনা হল না, ঘটনাটায় সে বিন্দুমাত্র দমেও গেল না। বরঞ্চ একটুখানি ভেবে নিয়ে কিংবদন্তীগুলো ফের শুরু করার জন্য সে মাথাটা নিচু করে রইল আর এই পরিস্থিতিতে চারপাশে ভ্রুক্ষেপ করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে তার বোধ হচ্ছিল না,অথচ ব্যাপারটাকে সে কি করে আমল না দিয়ে পারে ? লোকজন হয়রান হয়ে পড়েছিল, ফামার এসব রঙচটা ভ্যানতারা আর নিজের ঢোল পেটানোর তাবৎ কায়দাকানুন উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মুখস্ত হয়ে গেছে । জমায়েতে বুবু আর চাটাইয়ের খসখস শোনা যাচ্ছিল, লোকে নাকমুখ কোঁচকাচ্ছিল আর প্রবল হাতপা ছুঁড়ে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছিল। চিরকাল ফামা,চিরকাল ভাগের কমতি, চিরকাল একটা না একটা কিছু। লোকের আর সইছিল না। ওকে এবার বসিয়ে দেওয়া দরকার।

গ্রিয়ো কাসিটা সামলে উঠল, তবে একটু দেরিতে। চারপাশে একটা তিতিবিরক্তির ভাব ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অবশ্য ফামার চোখে কিছুই পড়ছিল না, কিছুই ওর কানে ঢুকছিল না। ও বকে যাচ্ছিল, ঠোঁট বাঁকিয়ে কিংবদন্তীগুলো কড়মড় করে চিবোতে অশত্থের ডালের মতন হাত দুটোকে আন্দোলিত করে ও অনর্গল বকে যাচ্ছিল। উত্তেজিত, ক্ষিপ্ত অবস্থায় তার নজরে পড়ছিল না যে বিরক্তিতে ওদের মুখের আদল পাল্টে যাচ্ছে, বিকৃত হয়ে উঠছে, তার নজরে পড়ছিল না, উহ্। বেলা বাড়ন্ত, হারামিপনা আর সহ্য হয় না, জাতীয় মন্তব্য মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে । সে ভ্যানতারা করে যাচ্ছিল।

ঠিক সেই মুহুর্তে জমায়েতের মধ্যে থেকে একটা ফতোয়া ফেটে পড়ল:

মুখে কুলুপ এঁটে কোথাও একটা পাছা ঠেকিয়ে বসে পড়। তোর কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান পচে গেছে ।

গাছের গুঁড়ির মতো গোল গেঁটেগাট্টা একটা লোক, পালোয়ানের মত গর্দান, হাত, পাঞ্জা আর ঘাড় নিরেট পাথরের মুখ। ওই লোকটাই চেঁচিয়ে উঠেছিল, ক্ষিপ্ত একটা ঝিঁঝিঁপোকার মত উত্তেজিত হয়ে ফামার সমান লম্বা হওয়ার জন্যে পায়ের ডগার ওপর দাঁড়িয়েছিল।

নিঃশ্বাস টানতে টানতে লোকটা আরো বলে উঠল:

তোর কোনো লজ্জাশরম নেই, সব কিছুর আগে হল লজ্জাশরম।

চারদিকে একটা রৈরৈ কাণ্ড। জঙ্গলের ভেতর একপাল মোষের ঢুকে পড়ার হৈচৈ। রোগাপটকা গ্রিয়োটা অনর্থক ফামার তোলা ঝড়টাকে বাগে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।

সে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে উঠল:

বাম্বা (যে লোকটি আস্ফালন করে উঠেছিল তার নাম ছিল এই ), বাম্বা, দিলটা ঠান্ডা করো।

মেঝের ওপর ঘাপ্টি মেরে থাকা, হিংস্র জানোয়ারের মত চোয়াল নাড়ানো, কনুই, ঘাড় আর মাথা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে বসা বাম্বা কি গ্রিয়োর বকের ডাক শুনতে পাচ্ছিল ? ফামার কানেও কিছুই ঢুকছিল না। ও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছিল, মেঝের ওপর লাথি মারছিল, বাপান্ত করছিল; কুত্তার বাচ্চা বাম্বার খুব বাড় বেড়েছে, তার মাথা মাটিতে নুইয়ে দিতে হবে, তাকে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরতে হবে, দাঁত বসাতে হবে। ওকে যে অপমান করেছে ফামা তার দিকে এগিয়ে গেল। আর দু পা হবে কিনা সন্দেহ ! ফামা তখনো সেই দু পা এগিয়ে যায় নি, এরই মধ্যে গেঁটেগাঁট্টা বাম্বা নাচিয়ের ভঙ্গিতে এক লাফে ওর পায়ের কাছে মাটির ওপর এসে হাজির হল। ওরা দুজনে একে অন্যের বুবুর ঝুল ধরে টানাটানি করতে লাগল । গ্রিয়োটা সরে পড়ল, হট্টগোল আরো তীব্র হয়ে উঠল, চারপাশে সবাই উঠে দাঁড়াল, দুজনকে জাপটে ধরে টানাহেঁচড়া করতে লাগল। বুবুর ঝুল পটাপট্ করে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গেল। ফামা ওর বুবুটা গুটিয়ে ধপাস করে চাটাইয়য়ের ওপর বসে পড়ল। বাম্বাকে তার নিজের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে দুদুজন ষন্ডামার্কা জোয়ানের দরকার হল। দুই প্রতিপক্ষের আসন নেওয়ার পর প্রত্যেকে নিজের নিজের জায়গায় চাটাইয়ের ওপর বসে পড়ল।

ফামা মার্জনা চাইল। অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বর্ষীয়ান সমস্ত মুসলমানদের হয়ে ফামার কাছে ক্ষমা চাইলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, ফামা ভুল করে নি, যা সত্যি তা বলতেই হয়, যতই তা কঠোর হোক না কেন, যা সত্যি তা চোখের মণি রগড়ে দেয় তবে তাকে গলিয়ে দেয় না। শেষমেশ বর্ষীয়ান লোকটি ফামাকে ওর পাওনার চেয়ে বেশি কয়েকটা নোট আর কোলাবাদাম দিয়ে ওর ক্ষতিপূরণ করে দিলেন। স্বভাবতই ফামা তা ছুঁড়ে ফেলে দিল: ও কেবল শরিফতের জন্যে লড়াই করেছে। লোকে ওর কথায় কান দিল না : বর্ষীয়ান লোকটি জোরাজুরি করতে লাগলেন। ফামা টাকা আর বাদাম ট্যাঁকে গুঁজে বেশ কিছুক্ষণ মাল্যাঁকেদের জাতখোয়ানো আর আচারবিচারের অধঃপতন নিয়ে চিন্তা করতে থাকল, গোরে যাওয়া লোকটির ছায়া পিতৃলোকে পূর্বপুরুষদের জানিয়ে দিতে চলেছে যে স্বাধীনতার সূর্যের তলায় মাল্যাঁকেরা তাদের রাজবাহাদুরকে বেইজ্জত করছে এমনকী তার গালে চড় কষাচ্ছে। পিতৃলোকের হে পূর্বপুরুষেরা,রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পিতৃলোকপ্রাপ্ত হে মারিবা, শেষতম খাঁটি দুম্বুইয়ার কপাল নিয়ে তোমাদের দুঃখ করার মুহূর্ত যথার্থ মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে।

অনুষ্ঠান চলতে লাগল। একদল খয়রাত করছে, অন্যেরা হাত পেতে নিচ্ছে। সকলেই বারবার করে মৃতের গুণগান করছে: মানুষকে ভালোবাসা, ধর্মবিশ্বাস, অতিথি সেবা; এমনকি একজন প্রতিবেশী স্মরণ করিয়ে দিল, একদিন রাতে মৃত লোকটি তাকে একটা কাপড় আর জাঙিয়া এনে দিয়েছিল। ঐ কাপড় আর জাঙিয়া ছিল তার মেয়েছেলের (যথার্থভাবে বলতে গেলে ঐ প্রতিবেশীর ধর্মপত্নীর), হাওয়ায় ওগুলো মৃত লোকটির খাটের তলায় উড়ে গিয়েছিল। তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিল: চারপাশের মুখগুলো আর শক্ত হয়ে থাকল না, গালগল্পের ফাঁকে ফাঁকে হাসির উড়নতুবড়ি ফাটতে থাকল। একমাত্র ফামা ওতে হাসল না। পকেটে টাকার নোট আর অন্তরে সত্যি কথা বলার হক নিয়েও তার রাগ পড়ে নি ও মনে মনে গজরাচ্ছিল।

হারামের হারামি। ও ফামা, দুম্বুইয়াদের বংশধর, ওকে নিয়ে মস্করা করছে, ওকে তাতাচ্ছে,গালিগালাজ করছে, কে ? না এক বান্দার বাচ্চা, ও ঘুরে তাকাল। বাম্বা ঠোঁটদুটো কোঁচকাচ্ছে কামড়াচ্ছে, ড্যাবা ড্যাবা চোখদুটো ঘুরিয়ে যাচ্ছে, ওর ছুটে আসা ঘোড়ার নাকের ফুটোদুটো ফোঁসফোঁস করছে, টানটান শরীর, হাতপাগুলো গোলগাল, গাঁটওয়ালা, ঢেঁকির খিলের মত। আর ফামার মনে প্রশ্ন জাগল যে বাম্বাকে লড়াইয়ে আহ্বান করার পক্ষে ওর বয়েসটা কি যথেষ্ট বেশি হয়ে যায় নি। তবে ফামা তার সৎ অভ্যেসগুলো ছাড়ে নি, মরদ আর তার হাতিয়ার কখনো আলাদা হয় না। ও পকেট হাতড়ে দেখে নিল চাকুটা যথাস্থানেই রয়েছে ; কুত্তার বাচ্চার নাড়িভুঁড়ি ফাঁসিয়ে চারদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে দেওয়ার পক্ষে ওটা যাথেষ্টই লম্বা। এবার তাহলে বাম্বা ফিরে আসুক, ফের শুরু করুক, ও টের পাবে দাঁত পড়ে গেলেও হায়নার মুখটা কখনো ছাগলছানার যাতায়াতের সড়ক হয়ে উঠতে পারে না।

হাসির ফোয়ারা, ফামা কান পাতে। একটুও রাগ না পড়া, এতটুকু ক্ষমা না করাটা ওর পক্ষে সমীচীন, গাধার বাচ্চা গ্রিয়োটা মৃতের গুণকীর্তনের মধ্যে বিষাক্ত সব শ্লেষ মিশিয়ে দিচ্ছিল:কাঙালিপনা, খেয়োখেয়ি আর বেইজ্জতির মধ্যে যারা বেশ্যাবৃত্তি করছে সেই মহান বীরের বংশের বংশধরদের সঙ্গে গোরে যাওয়া লোকটির সম্পর্কটা কি ? বেজাত কুত্তার বাচ্চা ! খাঁটি গ্রিয়োদের,শেষতম জাত গ্রিয়োদের সামোরির মহান সেনাপতিদের সঙ্গে গোর দেওয়া হয়েছে। সামনের ঐ প্যাঁকপ্যাঁক করিয়েটা না জানে গান গাইতে , না কথা বলতে, না কারো কথা শুনতে। গ্রিয়োটা বকে যাচ্ছিল, এমনকি জায়গা পাল্টে সে একটা থামের আড়ালে ঠাঁই নিয়েছিল। তার মতো বেহায়ার কাছে একটা থাম নদী কি পর্বতের মতোই পাঁচিল বলে গণ্য হতে পারে। আর এরপর সে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে তাবৎ গন্ডি পার হয়ে গেল: মহান বীরদের বংশধরেরা (ফামা !) মিথ্যের বেসাতি আর কাঙালিপনা করে পেট চালায় (আবার ফামা !) মহান নায়কদের সাচ্চা বংশধরেরা(সারাক্ষণ ফামা !) মানইজ্জতের বদলে শকুনের পালক পরে নেয়েছে। ওরা খোঁজ করতে থাকে যে কোনো একটা উপলক্ষে রান্নার গন্ধ: জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে ; অনুষ্ঠান থেকে অনুষ্ঠানে লাফিয়ে যেতে চায় । জবাব দেবার জন্যে ফামা বুবুটা গুটিয়ে নিল। ও একটুখানি ইতস্তত করছিল। তড়িৎ প্রতিক্রিয়ার অভাবটা হতচ্ছাড়া গ্রিয়োর কাছে একটা আমন্ত্রণ বলে গণ্য হল। সে যার পর নেই অভব্য ইতরামি শুরু করল, বাম্বা মনের আনন্দে ঢোলের দলে সামিল হল।

না, তাহলেও। ফামা উঠে দাঁড়াল, বাধা দিল:

মুসলমানরা, ক্ষমা কর, মুসলমানরা শোন।

একটিমাত্র শব্দ যোগ করাও অসম্ভব। গরম খাওয়া কুত্তার পাল। নিজেদের যারা মুসলমান বলে পরিচয় দেয় সেই বসে থাকা হতচ্ছাড়া মাল্যাঁকেরা খেঁকিয়ে উঠল, দাঁত আর গালিগালাজ খিঁচিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। গন্ডিটা পেরিয়ে গেছে।

লজ্জা আর অপমানে চুপসে যাওয়া ফামা কী করে আর সেখানে থাকতে পারে ? তাছাড়া ওর কোনো অনুতাপ হচ্ছিল না। অনুষ্ঠান নিচে নামতে নামতে বাঁদরনাচে পরিণত হয়েছে। অতএব বাঁদরগুলোকে কামড়াকামড়ি আর লেজ টানাটানি করতে দাও। ও বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল। দুজন লোক ওকে ধরে রাখতে ছুটে এল। ও ধ্বস্তাধ্বস্তি করে লোক দুটোকে হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা বলে বেরিয়ে গেল।

মজা পাওয়ার হাসি। উহ্ ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ! এমন একটা হৈ হৈ করা চুড়ান্ত প্রস্থানের শুধু এতটুকুই প্রতিক্রিয়া । রাজধানীর তাবৎ মাল্যাঁকে অনুষ্ঠানের মতো এর পরের অনুষ্ঠানগুলোতেও ফামার দেখা পাওয়া যাবে; এটাতো জানা কথা ; কেননা কে কোথায় দেখেছে যে হায়না গোরস্থানের আশপাশ ছেড়ে কি শকুন কুঁড়েঘরের পেছন ছেড়ে চলে গেছে । এটাও সবার জানা যে ফামা ঝামেলা করবে আর আরো লজ্জা দেবে। কেননা কোনো জমায়েতে ডালকুত্তা কি তার বেহায়া বসার ধরন ছেড়ে দিতে পারে ?

প্রসঙ্গত

মাল্যাঁকে (Malinké বা Mandingue,বা Mandinka, বা Mandingo, বা Mandé, বা Maninka ) উপজাতি হল পশ্চিম আফ্রিকার একটি জনগোষ্ঠী যারা আজ ছড়িয়ে রয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে । এরা রয়েছে প্রধানত মালি আর গিনিতে, এছাড়া সেনেগাল, বুর্কিনাফাসো, আইভরি কোস্ট আর গিনেবিসোতে।

উপন্যাসের উপস্থাপিত অংশে যে শহরের কথা বলা হয়েছে তা আবিদজঁ (Abidjan)। আইভরি কোস্টএর এই বন্দরশহরটি ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে ১৯৩৪থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আর স্বাধীনতার পর (১৯৬০) ১৯৮৩ অব্দি আইভরি কোস্টএর রাজধানী ছিল। এর পর থেকে ইয়ামুসুক্রো (Yamoussoukro) আইভরি কোস্টএর প্রশাসনিক রাজধানী হলেও অর্থনৈতিকরাজনৈতিক গুরুত্বে আবিদজঁ এখনও আইভরি কোস্টএর প্রধান শহর। কুরুমার বর্তমান উপন্যাস যখন লেখা হয় বা প্রকাশিত হয় তখন আবিদজঁ আইভরি কোস্টএর অদ্বিতীয় রাজধানী।

এই উপন্যাসে কুরুমার অন্যান্য রচনার মতো মাল্যাঁকে শব্দ বা বাগধারাকে ফরাসির সঙ্গে মিশিয়ে এক ধরনের ভাষাসংকরের সৃষ্টি করেছেন যা তাঁর কাহিনিকথনকে অন্যতর চরিত্র দিয়েছে । রচনার প্রান্তিক ঔপরাচনিক উপাদান শিরোনামে Les soleils des indépendances = স্বাধীনতার সূর্যগুলি soleil(সূর্য) আর indépendance (স্বাধীনতা) শব্দের বহুবচন এই ভাষাসাংকর্ষ সম্পর্কে পাঠককে সচেতন করে দেয়। সন্ধানী পাঠকের সক্রিয় পঠন আবিষ্কার করে শিরোনাম বা রচনার ভাষাশরীরে মাল্যাঁকেভাষার ফরাসি শব্দানুবাদ যেমন শিরোনাম বা আরম্ভের প্রথম বাক্যের অংশ (Koné Ibrahima avait fini কোনে ইব্রাহিমা শেষ করে ফেলেছিল) পাঠককে অন্য এক জগতে প্রবেশে উদ্বুদ্ধ করে। কুরুমার উপন্যাসগুলিতে মাল্যাঁকেদের মৌখিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যে মৌখিক কাহিনিকথনের আদল অনুভব করা যায়, ভাষাসাংকর্ষ এই অনুভবকে উদ্বোধন করে।

মাল্যাঁকে সমাজ শ্রেণীবিভক্ত সবার ওপরে অভিজাত শ্রেণী এঁদের পদবির আগে হোরো (শ্রদ্ধেয়) ব্যবহৃত হয়।এর পর রয়েছে একাধিক জাত: গ্রিয়ো, কামার, মুচি এর পর জাতহীন মাল্যাঁকে সমাজে গৃহীত অমাল্যাঁকেরা। মৌখিক সংস্কৃতির জগতের মানুষ মাল্যাঁকেদের ইতিহাস: ঐতিহ্য, রীতিনীতি, পুরাণের প্রতিকী রূপান্তরে অতীতের কথা গেয়ে শোনায় কথকগায়ক গ্রিয়োরা, সে ইতিহাস অবশ্য সনতারিখের তালিকাওয়ালা পাশ্চাত্য ছাদের ইতিহাস নয়। মাল্যাঁকেদের মধ্যে অতীতে গড়ে ওঠা ব্যবসায়ী শ্রেণীকে বলা হয় দিউলা।

স্যাঁ-জন পের্স -এর (Saint-John Perse) : “আনাবাজ” (Anabase, ১৯২৪) ও “নির্বাসন” (Exil , ১৯৪১) কবিতার কয়েকটি অংশ


SAINT-JOHN PERSE

স্যাঁজন পের্স এর (Saint-John Perse) :

আনাবাজ (Anabase, ১৯২৪) নির্বাসন (Exil , ১৯৪১) কবিতার কয়েকটি অংশ

উপস্থাপনা ও অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত

স্যাঁজন পের্স এর (Saint-John Perse, ১৮৮৭১৯৭৫) আসল নাম মারিরনে আলেক্সি স্যাঁলেজে লেজে ( Marie-René Alexis Saint-Leger Leger)। বয়সে ব্লেজ সঁদ্রারএর চেয়ে তিন মাসের ছোট এই কবি বিশ শতকের ফরাসি কবিতায় এক অনন্য রচনারীতির স্রষ্টা। আধুনিক ফরাসি কবিতার আলোচনায় প্রতিকীবাদ, ভবিয্যৎবাদ, দাদা, পরাবাস্তবতাবাদ ইত্যাদি যেসব আন্দোলন আর প্রবণতার কথা বলা হয় পের্সএর কবিতা তার কোনোটার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ছন্দস্পন্দিত গদ্যে লেখা পের্সএর কবিতায় ধ্রুপদী আর আধুনিকের, মহাকাব্য আর গীতিকবিতার কোনো বিরোধ নেই, বিরোধ নেই কবিতা আর গদ্যের। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, অতীত আর বর্তমান সেই কবিতার উচ্চারণে, ভাষাশরীরে মিশে গেছে। পের্সএর কবিতা তথাকথিত অর্থে দুর্বোধ্য অর্থাৎ তার বহুপঠন সম্ভব এবং স্বাভাবিক। ব্যঞ্জক ধ্বনিসংগঠন, শব্দালংকার আর অর্থালংকারের ব্যবহার, ছন্দস্পন্দন আর বহুপঠনের সম্ভাবনা এই কবিতাকে অননুবাদ্য করে তুলেছে। আমাদের অনুবাদের পঠনলিখনে এই কবিতার সামান্যতম অনুরণন যদি ধরা পড়ে থাকে তাহলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল বলে আমরা মনে করব।

এখানে কবির আনাবাজ (. Anabase/ইং. এনাবেসিসAnabasis, ১৯২৪) নির্বাসন (Exil /Exile, ১৯৪১) কবিতার কয়েকটি অংশ অনূদিত হয়েছে। দূরপ্রাচ্যে, চিনে ফরাসি দূতাবাসে সচিবের পদে কাজ করার সময় পিকিং (বেইজিং) থেকে বেশ কিছু দূরে একটি পরিত্যক্ত তাও মন্দিরে পের্স প্রথম কবিতাটি লেখেন। কবিতাটির নাম ধ্রুপদী গ্রিক সাহিত্যের একটি বিখ্যাত রচনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, রচনাটি হল জেনোফনএর (Xenophon /ক্সেনোফন, Ξενοφῶν , সা.পূ. পঞ্চম শতক) আনাবাসিস (Ανάβασις বা কিরু আনাবাসিস Κύρου Ανάβασις), ক্সেনোফোনএর রচনাটির অনুপ্রেরণায় আরিয়ান (Arrian/ আরিয়ানস Ἀρριανός, সাধারণ অব্দের দ্বিতীয় শতক) আলেকজান্ডারএর অভিযানের বিষয় নিয়ে আলেকজান্ডারএর আনাবাসিস (Anabasis of Alexander/আনাবাসিস আলেক্সান্দ্রু Ανάβασις Αλεξάνδρου) রচনা করেন। দীর্ঘ কবিতাটির শিরোনাম উপরচনা Anabase কবিতাটিকে জেনোফন আর আরিয়ানএর ঐতিহাসিক রচনার আন্তঃরাচনিক পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে যেখানে অতীত আর বর্তমান, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য, পুরাণ আর ইতিহাস, একাকার হয়ে যায় আর যেখান থেকে শুরু হয় উপলব্ধির অভিযান বা আনাবাজ। ব্যক্তিগত জীবনে আলেক্সি স্যাঁলেজে লেজে ছিলেন ফরাসি সরকারের বিদেশ দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। যুদ্ধের শুরুতে আলেক্সি লেজে ইংল্যান্ড হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে আশ্রয় নেন। হিটলারের নাৎসি বাহিনি যখন প্যারিসে ঢোকে তখন তারা তদন্তের নামে আলেক্সি স্যাঁলেজে লেজে অর্থাৎ স্যাঁজন পের্সএর বাসস্থানে ঢুকে তাঁর লেখা সহ বহু কাগজপত্র পুড়িয়ে ধ্বংস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসনের সময় নিউ জার্সির লঙ বিচ আইল্যান্ডে তিনি লেখেন তাঁর কবিতা নির্বাসন (. এগজিলExil / ইং.Exile)। কবিতাটি শিকাগোর পোএট্রি (Poetry) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (মার্চ ১৯৪২)

প্রসঙ্গত স্মরণীয় ১৯১২ সালে ২৫ বছরের স্যাঁজন পের্স ছ মাস লন্ডনে ছিলেন, ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর নিজের করা কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ, যা বই আকারে প্রকাশিত হয়। (ওই বই পরের বছর নোবেল পুরস্কার পায়)। পুরস্কার পাওয়ার আগে পের্স রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। তিনিই একটি বই পাঠিয়ে অঁদ্রে জিদকে রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্পর্কে অবহিত করান আর তাঁরই উসাহ আর চেষ্টায় জিদ রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলির অনুমোদিত ফরাসি অনুবাদ করেন। জানা যায় ফরাসি সাহিত্যজগতে সম্পূর্ণ অপরিচিত তিনজন ফরাসি ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলির ফরাসি অনুবাদে আগ্রহ দেখান আর তার মধ্যে একজন ( অজানা কোনো এক জঁ দ রোজেন/Jean de Rosen) পুরো অনুবাদের পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্রনাথ আর তার ইংরেজ বন্ধুবান্ধবদের দেখার জন্য জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পের্সএর প্রয়াসে অঁদ্রে জিদের (André Gide, ১৮৬৯১৯৫১) অনুবাদের প্রস্তাব গ্রাহ্য হয়। নীতিবিরোধী( L’immoraliste,  ১৯০২), “অমিতব্যয়ী পুত্রের ফিরে আসা” ( Le retour de l’enfant prodigue, ১৯০৭), “সরু দরজা” (La porte étroite, ১৯০৯), ইত্যাদি উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবে খ্যাত, ১৯০৮ থেকে বিখ্যাত “নুভেল রভ্যু ফ্রঁসেজ”এর পরিচালকসম্পাদক (Nouvelle Revue Française ) ফরাসি সাহিত্যজগতে খুবই পরিচিত ছিলেন। জিদএর ফরাসি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথকে অইংরেজিভাষী পাশ্চাত্যে পরিচিত করে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ফরাসি সরকারের আহ্বানে স্যাঁজন পের্স “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ” (Hommage à la mémoire de Rabindranath Tagore) নামে একটা রচনা পাঠান।

আনাবাজ”এর একাধিক বাংলা অনুবাদ আমাদের চোখে পড়েছে: বই হিসেবে প্রকাশিত ১. বার্নিক রায়এর অনুবাদ , . শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ও অসীমকুমার রায়এর অনুবাদ (১৯৯৫); একাধিক সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত ৩. পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আর ৪.সুকুমার ঘোষের অনুবাদ। এর মধ্যে দ্বিতীয় অনুবাদটির শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকার কয়েকটি বাক্য সম্পর্কে কিছু বলা দরকার বলে আমাদের মনে হয়েছে। শরৎকুমার লিখেছেন, “রাজনীতিঘেঁষা চাকরি করার পাশাপাশি স্যাঁজন প্যার্স কবিতা অনিয়মিতভাবে লিখে গেছেন।আনাবাজকাব্যের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। প্রথম ইংরেজি অনুবাদ টি. এস. এলিয়টের করা । বেরিয়েছে ১৯৩১ সালে, তারপর তিনবার সংশোধিত হয়ে তার তিনটি নতুন সংস্করণ বেরয়ফরাসি ভাষাভাষীদের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে প্যার্সের দুরূহ রচনা এলিয়টের মধ্যস্থতায় মুক্তি পেয়েছিল, কিন্তু তাতে এলিয়টের মৌলিক অবদান মিশেল ছিল। সে কাব্য সুশ্রাব্য কিন্তু অনুগত নয়। আমরা এখন ফরাসির সঙ্গে এলিয়টকৃত ইংরেজির যে ভাষাগত অসংগতি দেখতে পাই , তাতে মনে হয় মূল রচয়িতার যোগসাজস ছিল। এমনও হতে পারে, বৃহত্তর জগতের সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন এলিয়টের মতো একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, এতে স্যাঁজন প্যার্স খানিকটা কৃতজ্ঞতা ও সৌজন্যবশত বিশেষ বাধা সৃষ্টি করেন নি।” এর আগে তাঁর অনুবাদের আদর্শ বোঝাতে গিয়ে শরৎকুমার বলেছেন, “এলিয়ট নিজে একজন বড় মাপের কবি হওয়ায় মূল রচয়িতার কলাকৌশল উপেক্ষা করে স্থানে স্বাধীনতা নিয়েছেন। — হয়তো বৃহত্তর স্বার্থে। আমরা তা পারি না। আমরা মনে করতে চাই, অনুবাদকের দ্বারা কোনো মৌলিক অনুদান নিষিদ্ধ, এলেয়ট তার তোয়াক্কা করেন নি।” ওপরের বাক্যগুলিতে এমন কিছু বাক্য রয়েছে যা আমাদের মনকে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি করে। যুদ্ধের আরম্ভের কিছু আগে পের্স ফরাসি সরকারের বৈদেশিক দপ্তরের সাধারণ বা প্রধান সচিব ছিলেন, অতএব তিনি ফরাসি বৈদেশিক নীতির সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁর হিটলার বিরোধিতার কথা হিটলারও জানতেন। তাই তিনি “রাজনীতিঘেঁষা চাকরি” করতেন বলাটা সমস্ত ব্যাপারটাকে লঘু করে দেখা, তাছাড়া “প্যার্স অনিয়মিতভাবে কবিতা লিখে গেছেন।” বলতে কী বোঝানো হয়েছে, প্লেইয়াদ সংস্করণের রচনাসমগ্রে তাঁর কবিতার বিস্তার শ চারেক পৃষ্ঠা। বোদলের, ব়্যাঁবো, মালার্মে, লোত্রেয়ামোঁর কবিতা তো এর চেয়ে কম। “ফরাসি ভাষাভাষীদের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে প্যার্সের দুরূহ রচনা এলিয়টের মধ্যস্থতায় মুক্তি পেয়েছিল”—পের্সএর সমসাময়িক ফরাসি ভাষার লেখক হলেন ভালেরি, ক্লোদেল, অঁতোন্যাঁ আর্তো, প্রুস্ত, আপলিনের, সঁদ্রার, ব্রতোঁ, এল্যুয়ার, আরাগোঁ, সার্ত্র্, কাম্যু এবং আরো অনেকে। এঁরাও বুঝি ইংরেজিতে অনুবাদের মাধ্যমেই পরিচিত হয়েছেন? “ফরাসি ভাষাভাষীদের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্তি” এই বাচনের মধ্যে লেখকের ইয়োরোপীয় সাহিত্য সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণার সঙ্গে নিজের ঔপনিবেশিত মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায়। লেখক “ফরাসির সঙ্গে এলিয়টকৃত ইংরেজির যে ভাষাগত অসংগতির” কথা বলেছেন তা প্রায় সমস্ত কবিতার অনুবাদে স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় কেননা কবিতার অনুবাদ পঠনলিখন (Reading-Writing), অনুবাদকের নিজস্ব পঠন নির্ভর নিজস্ব লিখন প্ররচনা আর অনুরচনার মধ্যে স্বাভাবিক দূরত্ব তৈরি করে । অঁদ্রে জিদের করা রবীন্দ্রনাথের ফরাসি অনুবাদের কথা বলতে গিয়ে পের্স বোদলেরএর করা এডগার অ্যালেন পোর ফরাসি অনুবাদের কথা বলেছিলেন। সে অনুবাদও স্বাভাবিকভাবে অনেকটা সরে গেছে, যেমন সরে গেছে বুদ্ধদেব বসুর করা বোদলেরএর বাংলা অনুবাদ । আমরা মনে করতে চাই, অনুবাদকের দ্বারা কোনো মৌলিক অনুদান নিষিদ্ধ,একথা বহু বিখ্যাত অনুবাদ সম্পর্কেই বলা যায় না। তাছাড়া ১৯৩০ সালে এলিয়ট পের্সএর চেয়ে অধিক পরিচিত “বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব” হন নি।

এলিয়টের অনুবাদের আগে ১৯২৬ সালে আদামোবিচ ও ইভানফএর করা “আনাবাজ”এর রুশ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ইতালিয়ান কবি জুসেপ্পে উনগারেত্তি ইতালিয়ানে রচনাটির অনুবাদ শুরু করেন ১৯২৬ সালে, তাঁর অনূদিত রচনাটি প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। ইতিপূর্বে রাইনের মারিয়া রিলকে পের্সএর “প্রশস্তি” কাব্যের একটি অংশ জার্মানে অনুবাদ করেছিলেন, তিনি “আনাবাজ” অনুবাদের কথা ভাবলেও শেষ পর্যন্ত ভাল্তের বেঞ্জামিন আর বের্নার গ্রুতইজেনএর অনুবাদ দেখে নিজের অনুবাদের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। ১৯২৯ সালে ওই অনুবাদের ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬১ সালে অনুবাদটি প্রকাশিত হয়।

আনাবাজ(Anabase) থেকে

গান

ব্রোঞ্জের পাতার তলায় জন্ম নিচ্ছিল একটা ঘোড়ার বাচ্চা। একটি লোক আমাদের হাতে দিল তেতো জাম। ভিনদেশি। সে পথ চলছিল। আর এই তো আমার পছন্দসই অন্যসব দেশগাঁয়ের শোরগোল।কন্যা আমার, বছরের সবচেয়ে বড় গাছের তলায় তোমাকে আমি অভিবাদন জানাই

*

কেননা সূর্য প্রবেশ করছে সিংহরাশিতে আর ভিনদেশিটি তার আঙুল পুরে দিয়েছে মৃতদের মুখের ভেতর ভিনদেশি। সে হাসছিল। আর আমাদের একটা গুল্মের কথা বলে। আহ্ ! দেশগাঁয়ে এত হাওয়া। আমাদের যাত্রাপথে কী যে আরাম। তূর্যধ্বনি আমার কাছে কী যে মন ভোলানো আর ডানার কেলেঙ্কারির মধ্যে জ্ঞানী পালকটি !… আমার অন্তরাত্মা , দীর্ঘকায় কন্যা, তোমার যেসব নিজ্বস্ব রীতিনীতি ছিল তা আমাদের নয়

*

ব্রোঞ্জের পাতার তলায় জন্ম নিল একটা ঘোড়ার বাচ্চা। একটি লোক আমাদের হাতে দিয়ে গেল এই তিক্ত জামগুলো। ভিনদেশি। সে পথ চলছিল। আর এই ব্রোঞ্জের একটা গাছের ভেতর বিরাট একটা শোরগোল। অ্যাসফ্যাল্ট্ আর গোলাপ, গানের অবদান। ঘরগুলোর ভেতর বজ্র আর বাঁশি। আহা ! আমাদের পথে পথে এমন আরাম, আহ্, বছর ধরে এত সব গল্প, আর ভিনদেশি তার রীতি অনুযায়ী সারা পৃথিবীর পথে পথে ! … বছরের সবচেয়ে সুন্দর বসনে ঢাকা, কন্যা আমার, আমি তোমাকে অভিবাদন জানাই

|| . ||

তিনটি মহান ঋতুর বুকে নিজেকে সসম্মানে স্থাপন করে যেখানে আমি আমার বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করেছি সেই ভূমিতে ভবিষ্যতের মঙ্গলচিহ্নগুলি লক্ষ করছি ।

ভোরে অস্ত্রসস্ত্র সুন্দর আর সমুদ্র। আমাদের ঘোড়াগুলোর জন্য উন্মুক্ত নির্বীজ পৃথিবীর

দাম আমাদের কাছে ওই অপাপবিদ্ধ আকাশের সমান। এবং সূর্যের নাম করা না হলেও আর তার শক্তি আমাদের মাঝখানে

আর সকালে সমুদ্র অন্তরের একটি অনুমানের মত।

শক্তি, তুমি আমাদের রাতের যাত্রাপথে গান গাইছিলে।

সকালবেলার শুদ্ধ উত্সবে, আমাদের চেয়ে বয়সে বড়, স্বপ্ন সম্পর্কে কিইবা আমরা জানি?

আরো একটি বছরের জন্য তোমাদের মাঝখানে ! শষ্যের প্রভু, লবণের প্রভু, আর সার্বজনীন বস্তু সঠিক দাঁড়িপাল্লাগুলোর ওপর !

অন্য এক তীরের লোকদের আমি ডাকাডাকি করব না। প্রবালের শর্করা দিয়ে

আমি মোটেই শহরের উৎরায়ের বিরাট পাড়াগুলোর রেখাচিত্র আঁকব না । অথচ তোমাদের মধ্যে বাস করার ইচ্ছে আমার রয়েছে।

তাঁবুগুলোর দোরগোড়ায় তাবৎ জয়গৌরব! আমার ক্ষমতা তোমাদের মধ্যে ! আর নুনের একটা কণার মতো বিশুদ্ধ ধারণা তার আসর শুরু করে

আর আমি তোমাদের স্বপ্নের শহরে বারবার হানা দিচ্ছিলাম এবং জনশূন্য হাটে থামিয়ে দিচ্ছলাম আমার অন্তরাত্মার এই বিশুদ্ধ বাণিজ্য , তোমাদের মাঝখানে

অদৃশ্য আর পুনরাবৃত্ত খোলা হাওয়ায় যেরকম কাঁটার আগুন।

শক্তি, তুমি আমাদের আশ্চর্য যাত্রাপথে গান গাইছিলে !

”…লবণের মধুর স্বাদে মনের সবকটি বল্লম

কামনার মৃত মুখগুলিকে আমি লবণ দিয়ে সজীব করে তুলব !

তৃষ্ণার প্রশস্তি করে, শিরস্ত্রাণে করে কে না পান করেছে বালির জল

আত্মার লেনদেনে আমি তাকে সামান্যই দাম দিই।

(সূর্যের কোনো নাম করা হয় নি, তবু তার শক্তি আমাদের মাঝখানে রয়েছে।)

মানুষেরা, ধুলোর আর সব ধরনের জনতা, সওদাগর আর ব্যস্ততাহীন জনতা, সীমান্তের আর অন্য কোথাকার জনতা, এসব জায়গার স্মৃতিতে যাদের ভার খুবই সামান্য তোমরা সেই সব জনতা, উপত্যকা আর মালভূমি আর আমাদের নদীগুলোর সীমানা পেরিয়ে এই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ঢালুতে, চিহ্নগুলোর, বীর্যের গন্ধশোঁকা, প্রাচ্যের হাওয়ার পাপের স্বীকারোক্তি শোনা গুরুদেবরা: পথের চিহ্ন আর ঋতুগুলোর অনুসরণকারী, ভোরের মৃদু হাওয়ার মধ্যে শিবির গোটানো জনতা, পৃথিবীর খোসায় ওগো জলের সন্ধানীরা, ওগো সন্ধানীরা, অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য কারণের ওগো আবিস্কারকরা, তোমরা আরো জোরালো একটা লবণের চোরা কারবার কর না যখন সকালবেলায় সাম্রাজ্যগুলোর আর নিষ্প্রাণ জলরাশির একটা পূর্বাভাস পৃথিবীর রাশি রাশি ধোঁয়ার ওপরে অনেকটা উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যখন নির্বাসনের মাদলগুলো সীমান্তে বালুকার বুকে হাই তোলা অনন্ত কালকে জাগিয়ে দেয়,

শুদ্ধ বস্ত্রে তোমাদের মাঝখানে, আরো একটা বছর তোমাদের মাঝখানে। “আমার গরিমা সমুদ্রের বুকে আমার ক্ষমতা তোমাদের মধ্যে!

আমাদের অদৃষ্টে রয়েছে অন্য সব তীরভূমির এই হাওয়ার প্রতিশ্রুতি আর সময়ের বীজ বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় তুলাদণ্ডের শাস্তির চরমে একটা শতাব্দীর দীপ্তি

নুনের ভাসমান স্তরে ঝোলানো গণিত । মৃত্যুহীন জাহাজের খোলগুলোকে জাহাজঘাটায় টেনে নিয়ে এসে যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় কবিতা আমার কপালের সেই স্পর্শকাতর বিন্দুতে, আমি লিপিবদ্ধ করি সব চেয়ে মাতাল

পুরো একটা জনগোষ্ঠীর এই গীত !

|| ||

যেসব দেশে বহু লোকের সমাগম সেখানেই বারবার সবচেয়ে বিরাট সব স্তব্ধতা, যেসব দেশে দুপুরে ঝিঁঝিদের সমাগম।

আমি হাঁটছি , তোমরা হাঁটছ নেবুঘাস ওয়ালা উঁচু উঁচু উৎরায়ের একটা দেশে, যেখানে বড়লোকদের ধোয়া জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া হয়।

আমরা পুরোটা জরির কাজ করা আর দুটো উজ্ঝ্বল রঙের পাড় বসানো রানির পোশাক টপকে যাই ( আহা ! নারীর কটু শরীর একটা পোশাকের বগলের জায়গায় কেমন দাগ লাগিয়ে দিতে জানে!)

আমরা পুরোটা জরির কাজ করা আর দুটো উজ্ঝ্বল রঙের পাড় বসানো তাঁর মেয়ের পোশাক টপকে যাই ( আহা ! টিকটিকির জিভ বগলের জায়গা থাকে কেমন পিঁপড়ে চয়ন করতে জানে!)

আর হয়ত দিন মোটেই গড়িয়ে যায় নি যখন না একই পুরুষ একটি নারী আর তার মেয়ের জন্য পুড়ে মরে নি ।

মৃতদের বিজ্ঞ হাসি, খোসা ছাড়িয়ে ওই ফলগুলো আমাদের দেওয়া হোক!কী কাণ্ড! জগতসংসারে বুনো গেলাপের তলায় আর কোনো ক্ষমা নেই ?

জগতের এপাশ থেকে জলের ওপর বিরাট একটা বেগুনি অসুখ আসছে । বাতাস বইতে শুরু করেছে। সমুদ্রের বাতাস। আর ধোয়া কাপড়চোপড়

বিদায় নিচ্ছে ! যেন টুকরো টুকরো করা একজন পুরোহিত

নির্বাসন(Exil) থেকে

॥ ১ ॥

দরজাগুলো খোলা বালির বুকে , দরজাগুলো খোলা নির্বাসনের বুকে ,

চাবি বাতিঘরের লোকদের কাছে, আর চৌকাঠের পাথরের চক্রে

সূর্য জীবন্ত বন্দী

গৃহকর্তা, বালির ওপর আপনার কাচের বাড়িটা আমায় ছেড়ে দিন

খড়িমাটির গ্রীষ্ম আমাদের ক্ষতস্থানে তার বর্শাফলকগুলো শান দেয়,

ঋতুগুলোর অস্থিভাণ্ডের মতো জাজ্বল্যমান আর শূন্য একটা জায়গা আমি বেছে নিচ্ছি,

আর পৃথিবীর সমস্ত তীরভূমিতে, ধূমায়িত দেবতার আত্মা তার অ্যাস্বেস্টসের শয্যা ত্যাগ করে।

বিদ্যুৎচমকগুলি তোরিদএ রাজকুমারদের বিনোদনের জন্য।

॥ ২ ॥

কোনো তীরভূমিতে উৎসর্গিত নয়, কোনো পৃষ্ঠায় উপস্থাপিত নয় এই গানের শুদ্ধ মুখ

অন্যেরা মন্দিরের বেদীর রঙীন শিঙা তুলে নেয়:

আমার জয়গৌরব বালিতে ! আমার জয়গৌরব বালিতে !… আর ব্যাপারটা মোটেই ঘুরে বেড়ানো নয় হে যাযাবর,

নির্বাসনের অপচয় দিয়ে নাস্তি থেকে জন্ম নেওয়া একটা মহৎ কবিতা, নাস্তি থেকে তৈরি করা একটা মহৎ কবিতা সমাহার করার জন্য সবচেয়ে শূন্য পটভূমি চাওয়াটা একটুও ভ্রান্তি নয়

শিস্ দাও, হে পৃথিবীর চারদিকের ফিঙেগুলো, গান কর, জলের বুকে হে শঙ্খেরা !

অতল গহ্বর, তরঙ্গোৎক্ষিপ্ত শীকর আর বালির ধোঁয়ার ওপর আমি ভিত্তি স্থাপন করেছি। আমি শুয়ে পড়বো জলাধার আর ফাঁপা জাহাজে,

তাবৎ অব্যবহার্য আর বিবর্ণ জায়গায় যেখানে সমাহিত রয়েছে মহত্বের আস্বাদ।

কমই বাতাস জুলদের বংশের প্রশস্তি করেছিল, কমই কুটুম্ব বিপুল পুরোহিতগোষ্ঠীকে সহায়তা করেছিল

যেখানে রাশি রাশি বালি তাদের গান গাইতে যায় সেখানেই বিদায় নেয় নির্বাসনের রাজকুমারেরা,

যেখানে ছিল উঁচু খাটানো পালগুলো সেখানেই বীণকরের স্বপ্নের চেয়েও রেশমিকোমল ধ্বংসাবশেষের গতি,

যেখানে ছিল বিরাট সব সামরিক কর্মকাণ্ড সেখানে ইতিমধ্যেই সাদা হয়ে ওঠে গাধার চোয়ালের হাড়।

আর চারপাশে ঘোরার সময় সমুদ্র তীরভূমিগুলিতে তার করোটিনিনাদ ধ্বনিত করে,

আর পৃথিবীর তাবৎ ব্যাপার তার কাছে অর্থহীন হয়ে উঠুক, এ কথাটাই কোনো এক সন্ধ্যায়, পৃথিবীর তীরপ্রান্তে, নির্বাসনের বালুকায়,

বাতাসের রক্ষীবাহিনী আমাদের শোনায়

ফেনার প্রজ্ঞা, নুনের চিড়্ চিড়্ শব্দে আর বাখারিচুনের দুধে হে হৃদয়ের মড়কসমূহ !

অন্তরাত্মার অত্যাচার হিসেবে আমার ভাগে পড়ে একটা বিজ্ঞানবাতাস আমাদের শোনায় তার তাবৎ বোন্বেটেগিরির গল্প, বাতাস আমাদের শোনায় তার যত ভুলভ্রান্তির গল্প !

মরুভূমির প্রবেশপথে, দড়ির পাশ হাতে, অশ্বারোহীর মতো,

রঙ্গভূমিতে আমি সবচেয়ে মঙ্গলসূচক চিহৃগুলির সবচেয়ে বিরাট ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করি।

আর প্রভাত আমাদের জন্য তার ভবিয্যৎজ্ঞাপক আঙুল পবিত্র রচনাবলীর মধ্যে বুলিয়ে যায়।

নির্বাসন কখনোই গতকালের নয় ! নির্বাসন কখনোই গতকালের নয় ! হে পদচিহ্নগুলি ! হে উপলক্ষগুলি !

বালির মধ্যে ভিনদেশি বলে, “জগতে প্রত্যেকটি জিনিসই আমার কাছে নতুন !…” আর তার গানের জন্ন তার কাছে কম অদ্ভুত নয়।

॥ ৩ ॥

“…সব সময় ছিল এই কলকোলাহল, সব সময় ছিল এই জাঁকজমক।

আর পৃথিবী জুড়ে অভিযানে বার হওয়া বীরত্বের ঘনঘটার মতো, নিষ্ক্রমণের মুহূর্তে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকগণনার মতো, সেনাপতিদের গর্জনের মধ্যে সাম্রাজ্যগুলির ভিত্তিস্থাপনের মতো, আহা ! মহৎ গ্রন্থগুলির জন্মক্ষণে ওষ্ঠাধরের স্ফীত হয়ে ওঠার মতো।

পৃথিবী জুড়ে বিপুল এই বধির বস্তুটি আর সহসা তা একটা মাদকতার মতো বেড়ে ওঠে।

সব সময় ছিল এই কলকোলাহল, সব সময় ছিল এই মহিমা।

পৃথিবী জুড়ে এই ভ্রাম্যমান বস্তুটি, পৃথিবী জুড়ে এই ভাবাবেশ, আর এই পৃথিবীর তাবৎ বেলাভূমিতে, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত, একই তরঙ্গ উচ্চারণ করে

চিরকাল অবোধ্য দীর্ঘ যতিবিহীন অনন্য একটি বাক্য

সব সময় ছিল এই কলকোলাহল, সব সময় ছিল ক্রোধের এই উন্মাদনা।

আর প্রবেশপথের চূড়া অব্দি আছাড় খাওয়া ঢেউ, সব সময়, কামনার চূড়া অব্দি, ডানায় ভর করা একই গাংচিল, নিজের বাসায় একই গাংচিল, প্রচণ্ড গতিতে উড়তে উড়তে নির্বাসনের কবিতাগুলির সমাবেশ ঘটায়, এই পৃথিবীর তাবৎ বেলাভূমিতে, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত, ছন্দহীন একই বিলাপ,

বালির বুকে, আমার নুমিডিয় অন্তরাত্মার অনুসরণে

আমি তোমায় চিনি, ওগো দানব! এইতো আবার আমরা মুখোমুখি। যেখানে আমরা থেমে গিয়েছিলাম ঠিক সেখান থেকেই আবার ওই দীর্ঘ বিতর্ক শুরু করা যাক।

আর তুমি তোমার যুক্তিগুলোকে জলের ওপর মাথা নিচু করা পশুতুণ্ডের মতো এগিয়ে দিতে পার: আমি তোমাকে এতটুকু অবসর বা বিরতি দেব না।

দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই ইতিমধ্যে দেখা অনেক বেলাভূমিতে আমার পায়ের ছাপ ধুয়ে মুছে গেছে, অনেক পরিত্যক্ত শয্যায় আমার অন্তরাত্মা নীরবতার কর্কটব্যাধির কাছে নিবেদিত হয়েছে।

হে আদি নিঃশ্বাসবায়ু, আমার কাছ থেকে আরো কী তুমি চাও? আর আমার জীবন্ত ঠোঁট থেকে আরো কী তোমরা টেনে বার করে আনতে পারবে বলে ভাবছ?

আমার ঘরের চৌকাঠের ওপর হে ভ্রাম্যমান শক্তি, আমাদের চলার পথে হে ভিখারিনী, অমিতব্যয়ীর পদচিহ্ন ধরে

বাতাস আমাদের শোনায় তার বার্ধক্যের গল্প , বাতাস আমাদের শোনায় তার যৌবনের গল্পহে রাজকুমার তোমার নির্বাসনকে সম্মান কর!

আরো আরো উঁচুতে, প্রতি রাতে, আমার চৌকাঠে এই মূক কলকোলাহল, আরো আরো উঁচুতে, প্রতি রাতে, খোলসের ভেতরে শতাব্দীগুলির এই জাগরণ.

পৃথিবীর তাবৎ বেলভূমিতে, অমার অস্তিত্বের খাদ্যে পরিপুষ্ট হওয়ার জন্য আরো ভয়ানক একটা শ্লোক!…

এতখানি উচ্চতা তোমার চৌকাঠের খাড়া তীরভূমিকে ফুরিয়ে দিতে পারবে না, হে ঊষার পরশুধারী,

তোমরা যারা নিজেদের কঠোর স্বভাবে যারা ঈগলকে পোষ মানাও তোমরা যারা লোহার কলমের তলায় সবচেয়ে কটু মেয়েদের পরিপুষ্ট কর

জন্ম নিতে চলেছে এরকম প্রতিটি বস্তু পৃথিবীর প্রাচীতে অধৈর্য হয়ে ওঠে, জন্ম নিচ্ছে এরকম প্রতিটি শরীর দিনের প্রথম আগুনে জয়োল্লাস করে

আর এইতো পৃথিবী জুড়ে অন্তরাত্মার বিদ্রোহের মতো বিশাল একটা কলরব জেগে ওঠে,

কলকোলাহল, তুমি তো কখনো নীরব হবে না! হতে পারে বালির ওপর তাবৎ মানবিক বিশ্বস্ততাকে পুরোটা আমি উজার করতে পারি নি। (আমার জন্মস্থান কোথায় কেই বা এখনো তা জানে?)

কবিতার অন্তিক ও দূরান্তিক অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত TRANSLATING POETRY: PROXIMAL AND DISTAL TRANSLATION / TRADUIRE LA POESIE: TRADUCTION PROXIMALE ET DISTALE: PUSHKAR DASGUPTA

অনুবাদ

কবিতার অনুবাদ

সামাজিকসাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত:অন্তিক ও দূরান্তিক অনুবাদ

পুষ্কর দাশগুপ্ত

কবিতার দূরান্তিক অনুবাদ PDF

পরাসাংস্কৃতিকতা(transculturality)প্রতিটি জীবন্ত সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত চরিত্রের অন্যতম মৌল উপাদান। সংস্কৃতির চারিত্রিক ধর্ম এই পরাসাংস্কৃতিকতা বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগের, বিভিন্ন স্তরে আদানপ্রদানের প্রণালী বা গতিপথ তৈরি করে। এই পথ ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক উপাদানের সঞ্চালন (circulation)অর্থা সম্প্রেষণ (emission)ও পরিগ্রহণ (reception) সম্পাদিত হয়, যার পরিণাম হল প্রতিটি সংস্কৃতির মধ্যে সাংস্কৃতিক বহুস্বরের (polyphony)অস্তিত্ব। এই বহুস্বর সংস্কৃতির জীবনের লক্ষণ, একস্বর (monophony) বা তার প্রবণতা সংস্কৃতির বিবর্তনহীন জড়তার, আসন্ন মৃত্যুর ঘোষণা। অন্যদিকে এই পরাসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনের Communication)ফলশ্রুতিতে প্রতিটি সংস্কৃতি আন্তঃসাংস্কৃতিকতার(interculturality) দ্বারা চিহ্নিত হয়। বিদেশি সাহিত্য অন্যতম সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে সম্প্রেষণ ও পরিগ্রহণের মাধ্যমে কোনো ভাষার সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক (intercultural) আন্তঃরাচনিক (intertextual) উপাদান হয়ে ওঠে। বিদেশি সাহিত্য পঠনলিখন (উদ্বিহিতি/decodingউপলব্ধি+নিজের ভাষায় পুনর্সংবিহিতি/re-encoding + পুনর্নির্মাণ) আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্প্রেষণ ও পরিগ্রহণের একটা রূপ। তাই আমরা বলতে পারি বিদেশি কবিতার পঠন (reading)নির্ভর লিখন (writing) অর্থা অনুবাদ প্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে, আর মানুষের সংস্কৃতির বর্তমান রূপ যদি কখনো একেবারে পালটে না যায় তাহলে সাহিত্যের/কবিতার অনুবাদ ভবিষ্যতেও হবে আর পাঠকও অজানা বিদেশি ভাষার কবিতার অনুবাদ পড়বে।

কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে তীর্থরেণু’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন: : ‘এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি — আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে — ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টিকার্য।’ কান্তিচন্দ্র ঘোষের ওমর খৈয়ামের অনুবাদ পড়ে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘ভাল কবিতা মাত্রকেই তর্জ্জমায় নূতন করে সৃষ্টি করা দরকার। … মূল কাব্যের এই রসলীলা যে তুমি বাংলা ছন্দে এমন সহজে বহমান করতে পেরেচ এতে তোমার বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েচে। কবিতা লাজুক বধুর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙেচ,তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে’ সুধীন্দ্রনাথ তাঁর অনূদিত কবিতার সংকলন প্রতিধ্বনির ভূমিকায় লিখেছেন: আমার মতে কাব্য যেহেতু উক্তি ও উপলব্ধির অদ্বৈত, তাই আমি এও মানতে বাধ্য যে তার রূপান্তর অসম্ভব;…।’বিষ্ণু দে তাঁর অনূদিত কবিতার সংকলন হে বিদেশি ফুলএর মুখবন্ধে জানিয়েছেন:যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি মূল কবিতার বিন্যাস, ছন্দ বা নিদেনপক্ষে মেজাজ অনুবাদের আভাসে রক্ষা করাসুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘অন্য দেশের কবিতা’ নামে তাঁর অনূদিত বিদেশি কবিতার সংকলনের ভূমিকায় লিখেছেন: ‘এ বইতে যাঁরা বিশুদ্ধ কবিতাররস খুঁজতে যাবেন, তাঁদের নিরাশ হওয়ার সম্ভাবনাই খুব বেশি। এই বইতে কবিতা নেই আছে অনুবাদ কবিতাআমি এতগুলি কবিতার অনুবাদক তবু আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, অনুবাদ কবিতার পক্ষে কিছুতেই বিশুদ্ধ কবিতা হওয়া সম্ভব নয়, কখনো হয়নি। কবিতার সংজ্ঞা, ব্রহ্মেরই মতন, অনুচ্ছিষ্ট… ’ ‘বহুল দেবতা বহু স্বর’ শঙ্খ ঘোষের অনূদিত কবিতার এই সংকলনে কবিঅনুবাদক জানিয়েছেন, ‘অনেকের মতো আমিও একথা জানি যে কবিতার ঠিক ঠিক অনুবাদ হয় নাএসব লেখাকে অনুবাদ না বলে অনুসর্জন বলাই কি তাই সংগত ?’ শরকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ব়্যাবোঁ , ভের্লেন ও নিজস্ব বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন:‘অনুবাদকর্মে আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল যতদূর সম্ভব মূলের বিন্যাস ছন্দ রক্ষা করে কবির অনুভবটি বাংলায় সঞ্চারিত করা। তারপর সুনীলবাবু কেন (ইংরেজি) অনুবাদ থেকে (অইংরেজি) কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন তা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কবিতার অনুবাদ গুণ সম্পর্কে ঘোরতর অবিশ্বাসী’ হয়েও কেন বিদেশি কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন। শেষ পর্যন্ত অনুবাদক বলেছেন, যে তিনি ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের নির্দেশে ওই অনুবাদ করেছেন।(সর্বত্র নিম্নরেখা আমাদের),

এই উক্তিগুলির মধ্যে আমরা বাংলাভাযায় কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ এবং কয়েকজন পরিচিত কবিঅনুবাদকের চিন্তা বা ধারণার পরিচয় পাই। এই ধারণাগুলি হল কবিতার অনুবাদ :

. সৃষ্টিকার্য,নূতন করে সৃষ্টি করা (রবীন্দ্রনাথ), অনুসর্জন( শঙ্খ ঘোষ);

. অসম্ভব(সুধীন্দ্রনাথ), কবিতার অনুবাদ গুণ সম্পর্কে ঘোরতর অবিশ্বাসী(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়), কবিতার ঠিক ঠিক অনুবাদ হয় না ( শঙ্খ ঘোষ);

. অনুবাদের পদ্ধতি:মূল কবিতার বিন্যাস, ছন্দ বা নিদেনপক্ষে মেজাজ অনুবাদের আভাসে রক্ষা করা (বিষ্ণু দে), মূলের ছন্দ রক্ষা করে কবির অনুভবটি বাংলায় সঞ্চারিত করা(শরকুমার মুখোপাধ্যায় )

উদ্ধৃতিগুলিতে প্রথমত দেখতে পাই কবিতার যথার্থ অনুবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ধারণা ও উচ্চারণ :জন্মান্তর প্রাপ্তি — আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিতইহা সৃষ্টিকার্য।’ তর্জ্জমায় নূতন করে সৃষ্টি করা দরকার। … মূল কাব্যের রসলীলাতুমি বাংলা ছন্দে বহমান করতে পেরেচ । কবিতা লাজুক বধুর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙেচ,তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে।শঙ্খ ঘোষের অনুসর্জন । কবিতার অনুবাদ করলেও অনুবাদে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হলেন সুধীন্দ্রনাথ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আর শঙ্খ ঘোষ না তবে হ্যাঁ অর্থা মধ্যপন্থী। তবে সুনীলের ‘বিশুদ্ধ কবিতা’, কবিতার সংজ্ঞা ব্রহ্মেরই মতন, অনুচ্ছিষ্ট, বিশুদ্ধ কবিতার রস’ ইত্যাদি শব্দব্যবহারে আধুনিকসুধীন্দ্রনাথ আর রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের মিশ্রণ অনুভব করা যায় । বিষ্ণু দে আর শরকুমার মুখোপাধ্যায় মূলের ছন্দ রক্ষা করার কথা বলেছেন। কিন্তু প্রতিটি ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক সংস্থানের সঙ্গে ওই ভাষার ছন্দসংস্থানের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। অতএব ভাষান্তরে কীভাবে মূলের ছন্দ রক্ষা করা যায় তা আমরা বুঝতে পারি নি । ইংরেজি আইয়াম্বিক পেন্টামিটার (Iambic pentameter), কোরিয়াম (choriamb), বা ফরাসি পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ মিলের পরম্পরা (alternance) ইত্যাদি কিভাবে বাংলা অনুবাদে ‘রক্ষা করা ’ যায় তা আমরা জানি না। বেশির ভাগ অনুবাদ কবিতার সংকলনে মোটামুটি এ ধরনের বাচনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

আর সংকলনগুলির আলোচনা বা সমালোচনায় প্রশংসা করে বলা হয় ‘স্বচ্ছন্দ অনুবাদ’, ‘অনুবাদকের নিজস্ব কবিতা’ বলে মনে হয়, ‘মূলের ছন্দ’ (?) অক্ষুণ্ণ রয়েছে। নিন্দা করে বলা হয় ‘আড়ষ্ট’, ‘আক্ষরিকভাবে মূলানুগ রাখতে যাওয়ায় অনুবাদ বাংলায় কবিতা বলে বোধ হয় না’ ইত্যাদি। প্রমথ চৌধুরী কান্তিচন্দ্র ঘোষের ওমর খৈয়ামের অনুবাদগ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন:ওমর খৈয়ামের এত স্বচ্ছন্দ সলীল অনুবাদ আমি বাঙলা ভাষায় ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি।

কিন্তু এসব আলোচনায় অনুবাদের ভাষাতাত্ত্বিক সমস্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশ্রিত সামাজিকসাংস্কৃতিক সমস্যার কথা কেউ বলেন না। মনে হয় সেরকম কোনো সমস্যাই যেন নেই। এর বাইরে বাংলা ভাষায় সাহিত্যের/ কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে কোনো তাত্ত্বিক আলোচনা দেখা যায় না, অর্থাৎ বাংলা ভাষায় সাহিত্যের/ কবিতার অনুবাদতত্ত্বের কোনো অস্তিত্ব নেই। ইংরেজিতে যাঁরা সাহিত্যের/ কবিতার অনুবাদ নিয়ে গবেষণা (Translation Studies) করেন তাঁরা সাহেবদের আকর বইপত্রের বাইরে যান না। সাহেবদের আলোচনায় ইয়োরোপের বিভিন্ন ভাষায় পারস্পরিক অনুবাদের সমস্যার আলোচনা থাকে, অন্য সমাজ, অন্য সংস্কৃতি, অন্য আবহের কোনো ভাষা থেকে বা ভাষায় সাহিত্যের/ কবিতার সৃজনশীল বাচনের অনুবাদের সামাজিকসাংস্কৃতিক সমস্যা তাদের আলোচনার বাইরে। সাহিত্যের/ কবিতার ভাষিক সংগঠনের মধ্যে ইতিহাস, ভূগোল, পরিবেশ, সামাজ আর সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে রয়েছে আর তা বাচনের ব্যঙ্গার্থের উপাদান হিসেবে ক্রিয়াশীল। এ নিয়ে অনুবাদক বা তথাকথিত আলোচকরা আলোচনা করেন না। নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের, ইয়োরোপীয় গ্রেকোরোমান, জুডিওখ্রিস্টান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী, ফ্রান্সের ল্যাটিন ফরাসি ভাষা, অ্যাংগ্লোস্যাক্সন ইংরেজিভাষা আর পূর্বভারতীয়, উষ্ণ মৌসুমী অঞ্চলের, ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুবৌদ্ধলৌকিকঐস্লামিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ইন্দোইরানীয় বাংলা ভাষার সামাজিকসাংস্কৃতিক দূরত্ব বিরাট। এই দূরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার তথা শব্দসম্ভারের পার্থক্য (ইতিহাস, পশু,পাখি, গাছপালা, আচার, রীতিনীতি , খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ইত্যাদি) আর তার বাচক, লক্ষক অথবা ব্যঞ্জক অর্থপরিধির পার্থক্যের পরিমাপে ইংরেজি বা ফরাসি থেকে বাংলা বা হিন্দিতে সাহিত্যের/ কবিতার অনুবাদের সমস্যা ইংরেজি থেকে ফরাসি বা হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদের সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দূরত্বের ভিত্তিতে পূর্বোল্লিখিত প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণীর অনুবাদকে আমরা যথাক্রমে দূরান্তিক ও অন্তিক অনুবাদ বলে অভিহিত করছি। পারিভাষিক শব্দ বাংলায় হলে যিনি বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষাই জানেন না, তিনিও খুব একটা স্বস্তি পান না, সন্দেহের দৃষ্টিতে আড়চোখে তাকান। তাই বন্ধনীতে ঝট করে দুটো ল্যাটিনমূল শব্দ বসিয়েদিলাম: অন্তিক (Proximal), দূরান্তিক(Distal) । এই মুখবন্ধটি

.) রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের করা দুটি বাংলা অনুবাদে ভিক্তর য়ুগোQuia pulvis esকবিতার শিরোনামের পরিবর্তন.)টি. এস. এলিয়টএর Ash Wednesdayকবিতার বিষ্ণু দের করা বাংলা অনুবাদের প্রথম ন পংক্তি .) William Radiceর করা রবীন্দ্রনাথের নববর্ষা’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদের একটি স্তবক.) স্তেফান মালার্মের Brise marine কবিতার সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে আর তুষার চৌধুরির করা বাংলা অনুবাদের প্রথম চার পংক্তি;.) বুদ্ধদেব বসুর করা বোদলেরএর Les Litanies de Satan বাংলা অনুবাদের ছ পংক্তি

এইপাঁচটি দৃষ্টান্তের বিশ্লেষণের মাধ্যমে কবিতার দূরান্তিক অনুবাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার উপস্থাপনা।

আসলে বহু বছর আগে কবিতার অনুবাদ ও আরো দুটি প্রবন্ধ নামে আমার একটি বই বেরিয়েছিল। বইটাতে প্রকাশক হিসেবে রক্তকরবীর নাম থাকলেও বইটা বেরিয়েছিল আমার নিজের খরচে। বইটা কেউ পড়েছিল কিনা, বইয়ের দু চার কপি বিক্রি হয়েছিল কিনা জানি না। সে বইটা আর কোথাও পাওয়া যায় না, তবু আর কখনো বেরুবে না জেনেও পুরো বইটা নতুন করে লিখেছি। যে বই কখনো আর প্রকাশিত হবেনা তারই নতুন শেষ অধ্যায় হল কবিতার দূরান্তিক অনুবাদ। 

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত: নির্বাচিত ফরাসি কবিতার বাংলা অনুবাদ//SATYENDRANATH DATTA : Choix de poèmes français traduits en bengali// SATYENDRANATH DATTA : Selected French Poems translated into Bengali.

 সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নির্বাচিত ফরাসি কবিতার বাংলা অনুবাদ

PDF

Choix de poèmes français traduits en bengali.// সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নির্বাচিত ফরাসি কবিতার বাংলা অনুবাদ

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২১৯২২)

ফরাসি কবিতার অনুবাদ

বাংলা কবিতার ইতিহাসে যে সময়টাকে রবীন্দ্রযুগ বলে চিহ্নিত করা হয় সে সময়ের বেশির ভাগ বাংলাভাষার কবি রবীন্দ্রনাথের লিখনের মাধ্যমে গড়ে তোলা, নির্ধারিত আর প্রতিষ্ঠিত রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার সীমার মধ্যে আবদ্ধ থেকেছেন। রবীন্দ্রানুসারী কবি বলে পরিচিত এই কবিগোষ্ঠী মহীরূহ রবীন্দ্রনাথের ছায়ার আশ্রয়ে থেকে আশ্বস্ত হয়েছেন, কবিতার ভাব ও ভাষাব্যবহারে রাবীন্দ্রিক জগতের বাইরে পা বাড়ানোর সাহস অর্জন করেন নি। কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচি, মোহিতলাল মজুমদার, গোলাম মোস্তাফা রবীন্দ্রানুসারী এই কবিরা তাঁদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু ভালো কবিতা যে লেখেন নি এমন নয়। কিন্তু ইতিহাসবিরোধী বাঙালি তাঁদের ভুলে গেছে। এঁদের পাশাপাশি যে বাঙালি কবিরা নিজস্ব লিখনের সন্ধানের মাধ্যমে রবীন্দ্রানুসারী মণ্ডলের বাইরে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তাঁরা হলেন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়। খেয়ালি কল্পনা, ভাষার তথা শব্দের (সংকেতকের) সঙ্গে অর্থ বা সংকেতিতের সম্পর্কের স্বেচ্ছাচারকে দেখানো আর ভাষাব্যবহারে তথাকথিত যুক্তি ভাঙার মাধ্যমে সুকুমার রায়ের রচনা বাংলা ভাষায় অনন্য, তা আমাদের আন্তঃরাচনিক সূত্রে তাঁর রচনা লুইস ক্যরলএর ( Lewis Carroll,আসল নাম:Charles Lutwidge Dodgsonunder, ১৮৩৮১৮৯৮)জাদুর দেশে অ্যালিসএর অভিজ্ঞতা(Alice in Wonderlandনামে পরিচিত Alice’s Adventures in Wonderland, ১৮৬৫), এডওয়ার্ড লিয়ার এর (Edward Lear, ১৮১২১৮৮৮) কবিতার কথা একআধটু স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে তাঁর ভাষাব্যবহারে আমরা তাঁর বহু পরবর্তী বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের তেআর্ত দ লাবস্যুর্দ আন্দোলনে স্যামুয়েল বেকেট (Samuel Beckett,১৯০৬১৯৮৯), য়্যোজেন ইয়োনেস্কো(Eugène Ionesco, ১৯০৯১৯৯৪), আর্ত্যুর আদামভ (Arthur Adamov, ১৯০৮১৯৭০), ইত্যাদির নাটকের ভাষাচিন্তার পূর্বাভাষ দেখতে পাই। তাঁর এই ভাষাব্যবহার অসচেতন নয় তা তাঁর প্রবন্ধ ভাষার অত্যাচার (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২২, মেজুন ১৯১৫)পড়লেই বোঝা যায়। সুকুমার রায়ের সৃষ্টিকর্মের প্রতি অবিচারের কথা স্মরণ করে আমরা আমরা আমাদের আলোচনার সীমা লঙ্ঘন করে সুকুমার রায়ের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি:

কতকগুলা কৃত্রিম অযৌক্তিক ধ্বনির সংযোগে কেমন করিয়া আমার মনের নাড়ীনক্ষত্র সমস্ত দশজনের কাছে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, তাহার সূত্রান্বেষণ করিতে গেলে মনে হইতে পারে যে এত বড় আজগুবি কাণ্ড বুঝি আর কিছ্ নাই।নামের সঙ্গে নামীর সাদৃশ্য বা সম্পর্ক যে কোথায় তাহা আজ পর্যন্ত কেহ নির্দেশ করিতে পারে নাই।সুতরাং বলিতে হয়, ভাষা জিনিসটা গোড়া হইতে একটা কৃত্রিমতার কারবার ।

বাংলা কবিতার ওই রবীন্দ্রযুগে সুকুমার রায় সম্পূ্র্ণ আলাদা, তাঁর লিখনে রবীন্দ্রনাথ কোথাও নেই। কিন্তু রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতায় লালিত কাব্যচিন্তায় বাঙালি অধ্যাপক সমালোচকরা সুকুমার রায়কে শিশুসাহিত্যিক মার্কা মেরে আলাদা করে রেখেছেন। আর যাঁরা নিজস্ব লিখন খুঁজছিলেন তাঁদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কবি কিন্তু কবিতার ইঞ্জিনিয়ার নন, নজরুল আবেগের উচ্ছ্বাস আর দেশপ্রেমে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও নিজস্ব শিল্পিত লিখনের গুরুত্বপূর্ণ আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ যে সূচকের শব্দব্যবহার, ব্রাহ্মভিক্টোরীয় মানসিকতা থেকে তত্সম শব্দব্যবহারের যে ভাষিক সীমাবদ্ধতা তৈরি করেন তা আজও বাংলা কবিতার আদর্শ। রবীন্দ্রপরিমণ্ডলে থেকেও কোনোরকম বিদ্রোহের ভণিতা না করেই সত্যেন্দ্রনাথ সেই সীমা অতিক্রম করে অরাবীন্দ্রিক নিজস্ব কাব্যিক লিখনের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তদ্ভব, দেশি ও ধ্বন্যাত্মক শব্দে সমৃদ্ধ ভাষাব্যবহারে আর লৌকিকপ্রাকৃতিক চিত্র রচনার মাধ্যমে (যেমন, মেঘের সীমায় রোদ জেগেছে আলতাপাটি সিম, চুপ চুপ ওই ডুব দেয় পানকৌটি দেয় ডুব টুপ টুপ ঘোমটার বৌটি, হাড় বেরুনো খেজুরগুলো ডাইনি যেন ঝামর চুলো,) তাঁর কিছু কবিতাকে ধ্বনিময়তা, ছন্দস্পন্দনে, তুলির লিখনে’ পরিণত করেছেনআমরা কবিতার পাঠককে বিদ্যায়তনিক সমালোকদের সমালোচনা ভুলে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথের যক্ষের নিবেদন, পালকির গান, দূরের পাল্লা, চরকার গান, গ্রীষ্মের সুর, ইলশে গুঁড়ি, পড়তে বলব। রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতায় লালিত ভাববাদী সমালোচকরা সত্যেন্দ্রনাথকে ছন্দের জাদুকর’ অভিধা দিয়ে তাঁর গুরুত্ব লাঘব করতে চেষ্টা করেছেন। ছন্দ কবিতার ভাষাশিল্পের অবিচ্ছেদ্য উপাদান, কবিতার তথাকথিত বিষয় বা বক্তব্যকে তার প্রকাশপদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। উনিশ শতকের ইংরেজি ভাববাদী সাহিত্যসমালোচনায় লালিত বাঙালি সমালোচক আর কবিতাপাঠক সুকুমার রায়ের অনন্য সৃজনশীল প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেন নি আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি অবিচার করেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস হল অনুবাদ বা আনুরাচনিক পরিগ্রহণের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য তথা কবিতাকে সমৃদ্ধ করা এবং তার আন্তঃরাচনিক দিগ্বলয়কে প্রসারিত করা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পাঁচ শ চল্লিশটি বিভিন্ন ভারতীয় ও বিদেশি ভাষার কবিতা বা কবিতাংশের অনুবাদ করেছিলেন। এই রচনাগুলি রয়েছে তাঁর তীর্থসলিল, ‘তীর্থরেণুমণিমঞ্জুষানামক তিনটি অনূদিত কবিতার সংকলনে৷ সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদের একটা বড় অংশ হল ফরাসি কবিতার অনুবাদ ৷ তিনি মোট আটষট্টিটি ফরাসি কবিতার বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।

প্রসঙ্গত এই অনুবাদের পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার। সত্যেন্দ্রনাথের আগে বাংলাভাষায় ফরাসি কবিতার অনুবাদ খুব একটা দেখা যায় না। মধুসূদনের নীতিগর্ভ কবিতাগুলির মধ্যে আটটি লা ফোঁতেনএর আটটি নীতিকবিতার অবলম্বনে লেখা। রসময় দত্তের খ্রিস্টধর্মান্তরিত ছেলেদের (অর্থাৎ তরু দত্তের বাবা গোবিন্দচন্দ্র দত্ত আর তাঁর ভাইদের) ইংরেজি রচনাসংগ্রহ The Dutt Family Album (London, Longman Green & Co, 1870) বইয়ে তাঁদের নিজেদের কবিতার সঙ্গে কয়েকটি জার্মান ও ছটি ফরাসি কবিতা ও কাব্যাংশের ইংরেজি অনুবাদ ছিল। এর পর বাঙালির ফরাসি সাহিত্যের পরিগ্রহণের ইতিহাসে যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নামটি মনে পড়ে তা হল তরু দত্তের(১৮৫৬১৮৭৭)A Sheaf Gleaned from the French Fields ( Calcutta, 1st edition, 1776, 2nd edition, 1778, London, 3rd edition, 1880) তরুর এই বইয়ে ৭৩জন ফরাসি কবির (প্রধানত উনিশ শতকের ) ১৯৪ টি ফরাসি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে, তার মধ্যে আটটি কবিতার অনুবাদ তরুর দিদি অরুর, একটি অনুবাদ তরুর বাবা গোবিন্দ চন্দ্র দত্তের। বইয়ের শেষে ছিল সংক্ষিপ্ত টীকা। বিশ শতকের প্রথমে রবি দত্তের (১৮৮৩১৯১৭) Echoes from East and West (Cambridge, Gallway and Porter, 1909) ইংরেজিতে এই অনুবাদ কবিতা ও নিজের কবিতার সংকলনে সতেরোটি ফরাসি কবিতা এবং কাব্যাংশের অনুবাদ রয়েছে।বাঙালি তরু দত্ত এবং তার পরিবার, রবি দত্ত এঁদের সবারই ফরাসি কবিতার পরিগ্রহণের প্রকাশ ছিল ইংরেজি ভাষায় আনুরাচনিক সৃষ্টি। তা বাঙালির সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিকতার পরিধি প্রসারিত করলেও বাংলা ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে তার কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না।

এর পর বাঙালির ফরাসি কবিতার পরিগ্রহণের ইতিহাসে যাঁদের নাম করতে হয় তাঁরা  হলেন , জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯১৯২৫) প্রিয়নাথ সেন (১৮৫৪ ১৯১৬) , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১১৯৪১)ফরাসি কবিতার পরিগ্রহণের ফলশ্রুতি বাংলা ভাষায় আনুরাচনিক সৃষ্টি বাঙালির সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিকতার পরিধি প্রসারিত করে আর তারই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে বাংলা ভাষার সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতায় আত্তীকৃত হয়তবে একথা মনে রাখা দরকার ইংরেজি রোমান্টিক কবিতা পড়া আর রবীন্দ্রযুগের শুরুর বাঙালিদের ফরাসি কবিতার অনুবাদ ও আলোচনায় প্রাধান্য লাভ করেছিলেন ভিক্তর য়ুগো(Victor Hugo, ১৮০২১৮৮৫)বা তাঁর সমসামায়িক দুএক জন রোমান্টিক কবি। রবীন্দ্রনাথ নিজে ভিক্তর য়ুগোর ছটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহী বন্ধু প্রিয়নাথ সেন রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় তাকে বারবার য়ুগোর ‘অনুধ্যান’(Les Contemplations) কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রিয়নাথ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় য়ুগোর কিছু কবিতারও অনুবাদও করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফরাসি থেকে অনুবাদের পরিমাণ বিপুল হলেও কবিতার অনুবাদ খুবই কম।জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বেশির ভাগ অনুবাদ অসংকলিত অবস্থায় ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁর যেসব কবিতার অনুবাদ আমাদের চোখে পড়েছে তা হল ভিক্তর য়ুগোর নটি কবিতা, ফ্রঁসোয়া কোপে(François Coppée,১৮৪২১৯০৮) দশটি কবিতা, স্যুলি প্র্যুদমএর (René-François SULLY PRUDHOMME,১৮৩৯১৯০৭) একটি কবিতা।

এর পাশাপাশি সত্যেন্দ্রনাথের ফরাসি কবিতার অনুবাদের পরিসর অনেক বিস্তৃত। তাঁর অনূদিত আটষট্টি ফরাসি কবিতার কবিদের মধ্যে চব্বিশ জন ফরাসি, সাত জন বেলজিয়ান। এছাড়া রয়েছে অজ্ঞাতনামা কবির চারটি আর দক্ষিণ ফ্রান্সের উপভাষায় লেখা পাঁচটি কবিতা।

সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদ কবিতার দ্বিতীয় সংকলন তীর্থরেণু’ পড়ে একটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন: ‘এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি — আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে — ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টিকার্য। ’ সাহিত্যিক রচনা বা তার অনুবাদ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হল তা শুধুমাত্র শিল্পকার্য বা শুধুমাত্র সৃষ্টিকার্য এর কোনোটাই নয়, সাহিত্যিক রচনা বা তার অনুরচনা অবিভাজ্যভাবে শিল্পকার্যময় সৃষ্টিকর্ম। সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদ , বর্তমান ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথের ফরাসি কবিতার অনুবাদের মূল্যায়নে আমরা বিভিন্ন মানের অনুবাদের সাক্ষা পাই।

১৯১০ সালে সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদকবিতার দ্বিতীয় সংকলন তীর্থরেণু’ বইয়ে আমরা আধুনিক ইয়োরোপীয় কবিতার উদ্গাতা বোদলেরএর দুটো সম্পূর্ণ কবিতা (Abel etCaïn/সুয়ো আর দুয়ো, Harmonie du soir/সন্ধ্যার সুর) আর দুটো কবিতার (?/জ্ঞানপাপী, Le Voyage/কা বার্ত্তা) আংশিক অনুবাদ দেখতে পাই। ইহুদি তথা খিস্টীয় ধর্মগ্রন্থ বাইবেলএর সৃষ্টি’ খণ্ডের আদম ও হাওয়ার দুই পুত্র এইবেল ও কেনএর কাহিনির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত Abel etCaïn (এইবেল ও কেন) কবিতাটি । বোদলেরএর অমঙ্গলের ফুল কাব্যের ‘বিদ্রোহ’ অংশের তিনটি কবিতার দ্বিতীয় কবিতা ।এই কবিতায় স্বৈরাচারী ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বোদলেরএর বিদ্রোহের প্রতীক হল কেন। স্মরণীয় উক্ত কাব্যের ‘বিদ্রোহ’ অংশের তৃতীয় কবিতা হল ঈশ্বরবিরোধী শয়তানের স্তব’। সামাজিকসাংস্কৃতিক স্থানীয় করণ তার ব্যঙ্গার্থকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করেছে , আংশিক অনুবাদ প্ররচনার প্রসঙ্গ বা ব্যঞ্জনা কোনোটাই প্রকাশ করে না। একমাত্র ‘সন্ধ্যার সুর’ অনুরচনাটি প্ররচনার রোমান্টিক ধ্বনিময়তার সার্থক প্রতিরূপ নির্মাণ করতে পেরেছে, কিন্তু সবগুলি অনুরচনা বোদলেরএর আধুনিকতা সম্পর্কে কোনো ধারণা দেয় না, বরঞ্চ তার একটা রোমান্টিক রূপান্তর উপস্থাপিত করে। বইয়ের শেষে টীকায় সত্যেন্দ্রনাথ বোদলেরএর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন “ফরাসি কবি; ইনি ‘সুন্দরকে মন্দ’ দেখিতেন না, কিন্তু ‘মন্দকে সুন্দর’ দেখিতেন। ইঁহাকে বীভত্স রসের কবি বলা যাইতে পারে।” এই মন্তব্য তাঁর ভাববাদী অনৈতিহাসিক পঠনের নির্দেশক। তবু ভিক্তর য়ুগো, আলফ্রেদ দ ম্যুসে, লকোঁ দ লিল, জোজেমারি এরেদিয়ার একাধিক কবিতা আর পল ভের্লেনএর ‘শিশিরের গান’এর অনুবাদগুলি অনূদিত কবিতা হিসেবে কমবেশি সার্থক বলে আমাদের মনে হয়েছে

এখন শেষ একটা প্রশ্ন:সত্যেন্দ্রনাথ কি ফরাসি জানতেন?অর্থা তিনি কি ফরাসি কবিতাগুলি ফরাসি থেকে অনুবাদ করেছেন, না ওগুলি ইংরেজি অনুবাদের অনুবাদ ? সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংবাদিক অমল হোম,অমর অনুবাদক সত্যেন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের মতে সত্যেন্দ্রনাথ ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন। অনুবাদগুলি পড়তে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে ১. য়ুগোর ‘জিন’ আর পল ভের্লেনএর ‘শিশিরের গান’ এই অনুরচনাদুটিতে অনুরচয়িতা যেভাবে উত্সকবিতার ধ্বনিসংস্থানের সার্থক প্রতিরূপ গড়ে তুলেছেন তা উত্সকবিতার পঠন ছাড়া সম্ভব নয়। ২. সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্কেতগীতিকা নামে অনুরচনা প্রসঙ্গে সুধাকর চট্টোপাধ্যায় বলেছেন উক্ত রচনাটি য়ুগোAutre Chanson কবিতার তরু দত্ত কৃত ইংরেজি অনুবাদ Mornimg Serenade-এর অনুবাদ। আমরা ব্যাপারটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম সুধাকর চট্টোপাধ্যায় যে ইংরেজি অনুবাদটি উদ্ধৃত করেছেন তার অনুবাদিকা তরু নন, তাঁর দিদি অরু। তবে অরু যেখানে মূলানুগ সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ অনেকটা সরে গেছেন, আবার তবে অরু যেখানে অনেকটা সরে গেছেন সত্যেন্দ্রনাথ সেখানে মূলানুগ। এই ব্যাপারটাও সত্যেন্দ্রনাথের অনুরচনার সঙ্গে উত্সকবিতার প্রত্যক্ষ সংযোগ স্পষ্ট করে ৩. অনুবাদে দুএকটা বিশেষ ভাষিক সংগঠন বোঝার ভুল (পরিবর্তন নয় ভুল) অনুরচনার সঙ্গে উত্সকবিতার প্রত্যক্ষ সংযোগ স্পষ্ট করে। ৪. আবার প্রতিবর্ণীকরণ আর টীকা থেকে যা বোঝা যায় তার ভিত্তিতে আমাদের অনুমাননির্ভর ধারণা হল সত্যেন্দ্রনাথ ফরাসি পড়তে পারতেন তবে তিনি বিদ্যায়তনিক শৃঙ্খলা মেনে তা শেখেন নি ।

বর্তমান সংকলনে আমরা পূর্বোক্ত তিনটি সংকলনে ছডিয়ে থাকা ফরাসি কবিতার অনুবাদগুলিকে একসঙ্গে উপস্থাপিত করছি। এই কবিতাগুলি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পূর্বোক্ত তিনটি অনূদিত কবিতার সংকলন তীর্থসলিল, ‘তীর্থরেণুমণিমঞ্জুষাথেকে নেওয়া ৷ কবিতাগুলির নিচে সংকলনের নাম দিয়ে সূত্র নির্দেশ করা হয়েছে ৷ মূল কবিতার কবির ফরাসি নাম যেখানে বাংলা থেকে বোঝা যায় সেখানে তা দেওয়া হয়েছেকিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা খুঁজে পাওয়া বা অনুমান করা সম্ভব হয় নি ৷ অনুবাদের আগে কিছু মূল ফরাসি কবিতাও দেওয়া হয়েছে । প্রথম দুটি জাতীয় সঙ্গীত বাদ দিয়ে বাকি কবিতাগুলি ফরাসি সাহিত্যের কালানুক্রমে উপস্থাপিত করা হয়েছে ৷ কৌতুহলী পাঠকদের জন্য কয়েকটি কবিতার অন্য কোনো বাঙালির করা এক বা একাধিক ইংরেজি অথবা বাংলা অনুবাদও উপস্থাপিত হয়েছে। তেয়োফিল গোতিয়ের একটি কবিতার(Barcarolle) ইংরেজ কবি সুইনবার্নএর (Algernon Charles Swinburne, ১৮৩৭১৯০৯ )ইংরেজি অনুবাদ যোগ করা হয়েছে, কেননা আমদের মনে হয়েছে গোতিয়ের কবিতাটির সত্যেন্দ্রনাথের করা অনুবাদ আন্তঃরাচনিক সূত্রে পূর্বোক্ত ইংরেজি অনুবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত।

বর্তমান সংকলন এই ব্লগেই প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত হল ৷ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনূদিত ফরাসি কবিতার অনুবাদের আলাদা কোনো সংকলন কখনো মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।এই সংকলন এই ব্লগেই প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত হল, এর কোনো মুদ্রিত সংস্করণ নেই ৷

পুষ্কর দাশগুপ্ত