ফরাসি সাহিত্যের বাঙালি পরিগ্রহণ ২ : মাইকেল মধুসূদন দত্ত
পুষ্কর দাশগুপ্ত
১. প্রস্তাবনা
১.১ ঐতিহাসিক কারণে কোনো একটি ভাষা/সংস্কৃতির সঙ্গে দ্বিতীয় একটি ভাষা/সংস্কৃতির যোগাযোগের ফলে যে সাংস্কৃতিক আদান–প্রদানের সূত্রপাত হয় তাকে আমরা অতিসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপন প্রক্রিয়া বলে অভিহিত করতে পারি। এই অতিসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয় এক ভাষা/সংস্কৃতির পরিধি থেকে দ্বিতীয় এক ভাষা/সংস্কৃতির জগতে সাংস্কৃতিক সংকেত বা/এবং রচনার অতিসাংস্কৃতিকসঞ্চালন। আর এই অতিসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপন–সঞ্চালনের বিশেষ ঐতিহাসিক মুহর্তে দুটি ভাষা/সংস্কৃতির একটি সম্প্রেষক ভাষা/সংস্কৃতি ও অন্যটি পরিগ্রাহক ভাষা/সংস্কৃতির ভুমিকা গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ায় অনুসূচিত হয় সম্প্রেষক ভাষা/সংস্কৃতির অতিসাংস্কৃতিক সম্প্রেষণ আর পরিগ্রাহক ভাষা/সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণ। অন্য দিকে এই পরিগ্রহণের ফলশ্রুতি হল পরিগ্রাহক ভাষা/সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিকতা তথা আন্তরাচনিকতার দিগবলয়ের প্রসার। প্রসঙ্গত সম্প্রেষক ভাষা/সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিত থেকে আলোচিত ‘সাবেকি প্রভাবতত্ত্বের’ সীমা থেকে বেরিয়ে আমাদের মনে রাখা দরকার আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণ (অর্থাৎ নির্বাচন, পঠন ও পুনর্নির্মান)নির্ধারিত–নিয়ন্ত্রিত হয় পরিগ্রাহক ভাষা/সংস্কৃতির সংস্থান, চরিত্র ও ইতিহাস–নিয়মিত প্রত্যাশা দ্বারা১।
১.২ বর্তমান নিবন্ধে আমাদের আলোচ্য হল মধুসূদনের ফরাসিচর্চা। মধুসূদনের এই ফরাসিচর্চা ইয়োরোপীয়/ফরাসি সাহিত্যের ভারতীয়/বাঙালি পরিগ্রহণের একটি দৃষ্টান্ত, যা আবার বৃহত্তর অর্থে ফরাসি সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিক বাঙালি পরিগ্রহণের একটি পর্ব। অবশ্য যেহেতু এ নিবন্ধে আমাদের আলোচনার পরিধি মধুসূদন কর্তৃক ফরাসি কবি লা ফোঁতেনের কয়েকটি নীতিকবিতার (ফাবল/fables–এর) অবলম্বন–অনুকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ অতএব আমাদের আলোচনা আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের একটি বিশেষ ক্ষেত্রে সীমিত। এই বিশেষ ক্ষেত্রটি হল অতিসাংস্কৃতিক সম্প্রেষণ–পরিগ্রহণের মিথষ্ক্রিয়ার ফল স্বরূপ আন্তর্ভাষিক তথা আন্তঃসাহিত্যিক অনুলিখন।
১.৩ এখানে একথাও বলা দরকার যে প্রাক–ঔপনিবেশিক পুঁথি–সংস্কৃতির যুগের বাংলা ভাষার সাহিত্য–উত্পাদন প্রধানত পদ্যে রচিত লিখিত–শ্রাব্য বা পাঠ্য–শ্রাব্য২ সাহিত্যের সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আর তা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক গোষ্ঠীবদ্ধ বাঙালি জীবনের প্রত্যাশার দিগবলয়ের অনুসারী। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে জন্মানো নতুন বাঙালি প্রজন্মের মনে পুরনো পাঠ্য–শ্রাব্য সাহিত্যের পরিবর্তে নতুন ব্যক্তি–পাঠকের ভোগ্য পাঠ্য সাহিত্যের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। আর এই নতুন প্রজন্মের ঐতিহাসিক পঠন–চাহিদা মেটানোর জন্য সৃষ্ট হল গদ্য ও পদ্যে রচিত নতুন পাঠ্য সাহিত্য। পাশাপাশি মুদ্রণ–পদ্ধতির আবির্ভাব এই চাহিদা ও উত্পাদনের সহায়ক হয়ে উঠল। বাংলা ভাষার এই নতুন সাহিত্য নতুন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইয়োরোপীয় সাহিত্য থেকে তার ভাষিক–সাংস্কৃতিক সংস্থান–নিয়ন্ত্রিত চাহিদা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী নির্বাচিত বিভিন্ন উপাদান পরিগ্রহণ ও আত্তীকৃত করল।
২. বাংলা সাহিত্যের আন্তঃরাচনিকতার পরিধির বিস্তারে মধুসূদনের ভূমিকা
২.১ অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার পরিধি ছিল পূর্ববর্তী বাংলা, প্রাকৃত–অপভ্রংশ ও সংস্কৃত সাহিত্য। আর তারপর মুসলমান শাসনের সময়ে এই সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার পরিধি ফরাসি ও আরবি সাহিত্য পর্যন্ত। উনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সহযোগী উপকরণ হিশেবে ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রবর্তন করা হল। এর ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালির ইংরেজি ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়ের পরোক্ষ পরিণাম হল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ইয়োরোপীয় সাহিত্য–সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির যোগাযোগ। এই যোগসূত্রের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের আন্তঃসাস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার দিগন্ত ইয়োরোপীয় সাহিত্য পর্যন্ত প্রসারিত হয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে ঈশ্বর গুপ্ত থেকে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অব্দি কবিদের কাব্যকৃতি আন্তঃরাচনিকতার এই নতুন ভূখণ্ডে প্রবেশে দ্বিধাগ্রস্ত। মধুসূদনই প্রথম ইয়োরোপীয় কাব্যাদর্শ এবং কবিকৃতিকে সক্ষম ও সার্থকভাবে বাংলা কাব্যবাচনের আন্তঃরাচনিক উপাদান হিসেবে নিজের রচনায় অঙ্গীকৃত করেন। বাংলা কাব্যবাচনকে আন্তঃরাচনিকতার যোগসূত্রে ফরাসি কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রথম প্রয়াসও মধুসূদনেরই।
২.২ মধুসূদনের প্রথম যৌবনের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যচর্চা ঐতিহাসিক পরিণামের বিচারে তাঁর মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্যরচনার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে গণ্য করা যায়। মাদ্রাজে অবস্থানকালে মধুসূদন তাঁর ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাপটিভ লেডি’(Captive Lady, ১৮৪৯) প্রকাশ করেন। বন্ধু গৌরদাসের মাধ্যমে কলকাতায় বেথুন সাহেব (John Drinkwater Bethune) এই গ্রন্থ পান। মধুসূদনের উচিত মাতৃভাষার উন্নতি সাধনের চেষ্টা করা —বেথুন এই অভিমত প্রকাশ করেন৩। গৌরদাস নিজের সমর্থনসহ বেথুনের অভিমত জানালে মধুসূদন উত্তরে লেখেন (১৮ই অগাষ্ট, ১৮৪৯):
My life is more busy than that of a school boy. Here is my routine: 6-8 Hebrew, 8-12 School, 12-2 Greek, 2-5 Telugu and Sanskrit, 5-7 Latin, 7-10 English. Am I not preparing for the great object of embellishing the tongue of my fathers?…৪
এর মধ্যে মধুসূদনের ‘পিতৃপরুষের ভাষা‘ বাংলার ‘সৌন্দর্য–বিধানের মহৎ উদ্দেশ্য’‘স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। পরবর্তী কালে মধুসূদন ইউরোপীয় (গ্রিক, লাতিন ও ইংরেজি)ধ্রুপদী কাব্যের আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় একে একে ভিলোত্তমাসম্ভব, মেঘনাদবধ ওবীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর কোনো আকর্ষণ দেখা যায় নি। শুধুমাত্র বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি মেঘনাদবধ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন:
…I think I have constructed the Poem on the most rigid principles and even a French critic would not find fault with me.৫
কিন্তু মধুসূদনের ফরাসি–চর্চা অনেক পরের ঘটনা।
৩. মধুসূদনের ফরাসি–সংস্পর্শ
৩.১ প্রসঙ্গত মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবনে ফরাসি সংম্পর্শ–বিষয়ে আলোচনা করা যাক। মূল বিষয়বস্ত্তর ভূমিকায় এ আলোচনার স্থান হতে পারে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে মধুসূদনের দ্বিতীয় জীবনসঙ্গিনী হেনরিয়েটা ছিলেন ফরাসি। কিন্তু তাঁর হেনরিয়েটা (আমেলিয়া এনরিয়েত্তা সোফিয়া Amelia Henrietta Sophia) নাম আপাত পরিচয়ে ইতালীয়। তাছাড়া মধুসূদন–হেনরিয়েটার যে বংশধররা হেনরিয়েটার সমাধিফলক প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরা ইতালিতে বাস করেন। এটা হেনরিয়েটার ইতালীয় বংশ–পরিয়ের কোনো প্রমাণ কিনা আমরা জানি না। স্বভাবতই হেনরিয়েটা ফরাসি বংশোদ্ভব ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাই না।
৩.২ ১৮৬২ সালে মধুসূদন ইংল্যাণ্ডে যান। উদ্দেশ্য ব্যরিস্টার হওয়া। কিন্তু অর্থভাবে ব্যারিস্টারি পড়া স্থগিত রেখে ১৮৬৩ সালের মাঝামাঝি তিনি সপরিবারে ফ্রান্সে গেলেন। প্রথমে কিছুদিন প্যারিসে এবং পরে প্যারিস থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ভের্ভাই–এ তিনি সপরিবেরে বাস করতে থাকেন। ১৮৬৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন। ফ্রান্সে তিনি ফরাসি ভাষা আয়ও করেন, ফরাসি সাহিত্য–সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এই আকর্ষণ তাঁর শেষ–জীবন পর্যন্ত বর্তমান ছিল।৬
ফ্রান্সে অবস্থানকালে মধুসূদনের যথার্থ ফরাসি–চর্চার শুরু। এই সময়ে মধুসূদন ইতালীয় সনেটের অনুপ্রেরণায় চতুর্দশপদী কবিতাবলী রচনা করেন। ৭ এই কবিতাবলীর মধ্যে একটি কবিতায় ফরাসি প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ‘বসন্তে একটি পাখীর প্রতি’৮ শীর্ষক এই কবিতাটিতে কবি ফরাসি দেশের(কবির পাদটীকা, ‘ফরাসীস্ দেশে’) হেমন্তকাল সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন:
দুরন্ত কৃতান্ত–সম হেমন্ত এ দেশে
নির্দ্দয়;ধরার কষ্টে দুষ্ট তুষ্ট অতি!
না দেয় শোভিতে কভু ফুলরত্নে কেশে,
পরায় ধবল বাস বৈধব্যে যেমতি!—
অন্য একটি কবিতা রচিত হয়েছে ‘ভরসেলস নগরে রাজ পুরী ও উদ্যান’ দর্শনে।৯
স্মরণীয়, ফ্রান্সে এই সময় সম্রাট নাপোলেওঁ–র ভ্রাতুষ্পুত্র লুই নাপোলেওঁ (তৃতীয় নাপোলেওঁ) প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের কাল (১৮৫২–১৮৭০)।১০ ফ্রান্সে অবস্থানকালে মধুসূদন ফরাসি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন, একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে লেখা একটি চিঠিতে (৯ই জুন ১৮৬৪) তিনি লিথেছেন:
…Though I have been very unhappy and full of anxiety here. I have very nearly mastered French. I speak it well and write it better…১১
৩.৩ মধুসূদনের জীবনীকার যোগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ফরাসি ভাষায় কবিতা রচনার কথা উল্লেখ করেছেন।১২ আমরা তা দেখি নি বা খুঁজে পাই নি। ‘জীবনচরিত’ এবং ‘মধুস্মৃতি’ গ্রন্থের গ্রন্থকারদ্বয় মধুসূদনের একাধিক ফরাসি চিঠির উল্লেখ করেছেন আর তার মনোমোহন ঘোষ কৃত অনুবাদ উপস্থাপিত করেছেন। ফ্রান্সে থাকার সময়ে মধুসূদন দান্তের (১২৬৫–১৩২১) ষষ্ঠ জন্ম–শতবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি দান্তের উদ্দেশে রচিত একটি চতুর্দশপদী কবিতা স্বকৃত ফরাসি ও ইতালীয় অনুবাদ সহ ইতালির রাজার কাছে প্রেরণ করেন। ‘কবিগুরু সান্তে’ শীর্ষক কবিতাটি তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাবলিরঅন্যতম।১৩ মধুসূদনের ফরাসি–চর্চার নিদর্শন হিসেবে কবিতাটির মধুসূদন–কৃত ফরাসি গদ্য–অনুবাদ উদ্ধৃত করছি:
A Dante
Telle à l’aube du jour, l’étoile doree, la messagère du soleil, chasse de ses rayons lumineux la masse des ténébres, telle, Ô poète, ta splendeur a chassé l’ignorance du monde intellecutal. Ô, béni soit le jour qui te vit naitre! — toi, qui fus le père d’une nouvelle race de poètes dans cette belle partie de notre globe! C’est pour ton culte que la Muse s’est oncore réveillée de son sommeil. Elle avait permis que tu entrasses dans les ténébreuses régions par cette porte ou passent aussi les âmes pécheresses abandonnées de l’espérance : mais toi, noble enfant de la terre, ce fut avec transport que tu y pénètres! Une étoile comme toi, tombe-t-elle jamais du ciel de la renommée? Une fleur comme toi, peut-elle être rongée des vers?
৩.৪ মধুসূদনের চতুর্দশপদীগুলির মধ্যে একটি চতুর্ধশপদী হল ‘কবিবর ভিকতর হু্গো’১৫। মধুসূদন যখন ফ্রান্সে তখন ফ্রান্সে তখন যে ফরাসি কবির খ্যাতি গগনস্পর্শী তিনি হলেন ভিক্তর য়্যুগো (Victor Hugo, ১৮০২–১৮৮৫)। এই খ্যাতিমান কবির রচনা বিদেশি কবি মধুসূদনকে আকৃষ্ট আর মুগ্ধ করেছিল। য়্যুগো–র উদ্দেশে রচিত কবিতায় মধুসূদনের এই উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া এই কবিতা বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ফরাসি সাহিত্যের প্রথম যোগাযোগ–নির্দেশক রচনা। পরবর্তীকালে বাংলাভাষায় ফরাসি সাহিত্য–চর্চার প্রস্তাবনা হিসেবেও এই কবিতা স্মরণীয়।১৬
৩.৫ প্রসঙ্গত মধুসূদনের সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতাগুলির চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা যায়। ভের্সাই–এ মধুসূদন এই কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি অনুসারে পেত্রার্কার অনুসরণেই এই সনেটগুলি রচিত হয়েছিল।১৭ তবে পেত্রার্কা এবং নবজাগরণ–পরবর্তী বেশিরভাগ সনেটের বিষয়বস্ত্ত ছিল আদর্শ প্রেম। এদিক থেকে মধুসূদনের সনেট ভিন্নধর্মী। ইয়োরোপে প্রবাসী কবির মনে স্বদেশের স্মৃতিময় যে বিধুরতা জেগেছিল অনেকগুলি কবিতা তারই স্বাক্ষর বহন করছে। মধুসূদনের সনেট এদিক থেকে ষোড়শ শতকের ফরাসি সাহিত্যের ‘সপ্তর্ষি–মণ্ডল’–এর(La Pléiade) অন্যতম কবি জোয়াকিম দ্যু বেলে–র (Joachim du Bellay, ১৫২২–১৫৬০) কিছু সনেটের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতালিতে প্রবাসী কবি দ্যু বেলের কিছু সনেটেও (Les Regrets) রয়েছে স্বদেশ ফ্রান্সের বিধুর স্মৃতি। মধুসূদনের‘কপোতাক্ষ নদ’১৮ র্শীর্ষক চতুর্দশপদী কবিতায় আছে:
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া–মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে —
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ–দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ?
দুগ্ধ–স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি–স্তনে!
আর কি হে হবে দেখা ?
একই মানসিকতা থেকে দ্যু বেলে জন্মভূমি ফ্রান্সেকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন:
Tu m’as nourri longtemps du lait de ta mamelle.
Les Regrets : France mère des arts…১৯
অন্য একটি সনেটে তিনি বলেছেন:
Quand revoiray-je, hélas, de mon petit village
Fumer la Cheminée…
Plus mon Loyre Gaulois, que le Tybre Latin,
Plus mon petit Lyré, que le mont Palatin,
Et plus que l’air marin la douleur Angevine
[হায়! কবে আবার আমি দেখতে পারো আমার ছোট্ট গ্রামের
চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে…
ইতালীয় টাইবারের চেয়ে গলীয় লোআর আমার কাছে মনোরম
পালাত্যাঁ শৃঙ্গের চেয়ে আমার ছোট্ট লিরে
আর সামুদ্রিক বাতাসের চেয়ে অঁজুর মাধুর্য।]
Les Regrets: Heureux qui comme Ulysse২০
মধুসূদন যে সপ্তদশ শতকের ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলেন তার প্রমাণ আছে।২১ অনুমান করা যায়, ষোড়শ শতকের বিখ্যাত কবি পিয়ের দ রোঁসার (Pierre de Ronsard, ১৫২৪–১৫৮৫) এবং জোয়াকিম দ্যু বেলের রচনার সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটোছিল। অবশ্য চিঠিপত্র বা অন্য কোথাও সে পরিচয়ের কোনো প্রমাণ নেই।২২ মধুসূদন দ্যু বেলে দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন একথা আমরা বলছি না, তবু দ্যু বেলে এবং মধুসূদন প্রায় একই পরিস্থিতিতে ইতালীয় কবিতার (সনেটের) দ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়ে যে কবিতা রচনা করেছিলেন তাতে কোথাও কোথাও মানসিকতার সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে মধুসূদনের ফ্রান্সে অবস্থান, ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে মনোযোগ, আদর্শ প্রেমের ঐতিহ্য থেকে সরে সনেটের বিষয় বির্বাচন — এ সমস্ত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমরা মধুসূদনের আলোচ্য রচনায় দ্যু বেলে–র আন্তঃরাচনিক উপস্থিতি অনুমান করতে পারি।
৪. মধুসূদন কর্তৃক লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার অনুলিখন
৪.১ ফরাসি দেশে অবস্থান কালে মধুসূদন কয়েকটি অসমাপ্ত কাহিনিকাব্য রচনারও সূত্রপাত করেন। ‘ভারত বৃত্তান্ত’ শীর্ষক অসমাপ্ত কবিতাটির ও পরে কবির নির্দেশত তারিখ রয়েছে Versailles, 9th September 1863২৩। চতুর্দশপদী কবিতাগুলি রচনার সমসাময়িক কালে তিনি ‘নীতিগর্ভ কবিতা’ রচনার সূত্রপাত করেন। এর কয়েকটি ফ্রান্সে থাকাকালে লিখিত। বাকিগুলি কলকাতায় ফিরে এসে লেখা।২৪ এই নীতিকবিতাগুলির মাধ্যমে মধুসূদন বাংলা ভাষার সাহিত্য–সৃষ্টিকে আন্তঃরাচনিকতার সূত্রেম প্রথম প্রত্যক্ষভাবে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত করেন। সপ্তদশ শতকের ধ্রুপদী ফরাসি–সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল প্রতিভা জঁ দ লা ফোঁতেন (Jean de La Fontaine, ১৬২১–১৬৯৫)। নীতিকবিতা বা ছন্দে ফাবল (fables) রচনা লা ফোঁতেনকে ফরাসি সাহিত্যে অমরতা দিয়েছে। ফরাসি সাহিত্য পড়তে গিয়ে মধুসূদন ফরাসি সাহিত্যের অবশ্যপাঠ্য লা ফোঁতেনের নীতিকবিতা দ্বারা আকৃষ্ট হন। এই নীতিকবিতার অবলম্বনে ও অনুসরণে অর্থাৎ অনুলিখনের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় নীতিকবিতা রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য লা ফোঁতেনের বেশির ভাগ নীতিকবিতার অবলম্বন ছিল ইশপ (Æsop, গ্রিক ইসপস/Αἴσωπος, ফ.এজপ/Ésope,আনুমানিক সাধারণ–পূর্ব ষষ্ঠ শতক), ফেদ্রুস (Phaedrus, আনু. সা.-পূ. ১৫– আনু. ৫০ সা. অ.) এবং আরো কিছু প্রাচীন নীতিকথাকারদের রচনা। লা ফোঁতেন তাঁর নীতিকথার সংকলন ‘ফাবল/Fables’–এর প্রথম খণ্ডে (১৬৬৮) ‘নীতিকথা শ্রীযুক্ত দ লা ফোঁতেন দ্বারা নির্বাচিত ও পদ্যে উপস্থাপিত’ (Fables choisies mises en vers par M. de La Fontaine) ― এই ঔপরাচনিক শিরোনামে তাঁর নীতিকবিতার চরিত্র নির্দেশ করেন ও ঐ খণ্ডের উত্সর্গপত্রে লা ফোঁতেন ইসপ–এর নীতিকথায় ‘কবিতার অলংকার’ (les ornements de la poésie) যোগ করার কথা উল্লেখ করেন২৫। প্রসঙ্গত আমরা জানি প্রাচীন যেসব নীতিকথাকারকে তিনি অনুসরণ করেছেন তাঁদের রচনার অন্যতম প্রধান সূত্র ছিল প্রাচ্য, বিশেষভাবে ভারতীয় নীতিকথা ― পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ ও জাতকের কাহিনি। আরবি ও ফারসি অনুরচনার মাধ্যমে ভারতীয় নীতিকথার সঞ্চালন ইয়োরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
জঁ দ লা ফোঁতেন তাঁর নীতিকবিতার সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডের (১৬৭৮) ভূমিকায় ভারতীয় জ্ঞানী পিলপাই–এর (Pilpay) কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করেন:
নীতিকবিতার দ্বিতীয় একটি সংকলন আমি জনসাধারণের সামনেউপস্থিত করছি… কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে আমি জানাতে চাই যে এর সবচেয়ে বড় অংশের জন্য আমি ভারতীয় জ্ঞানী পিলপায়–এর কাছে ঋণী। এই জ্ঞানীর বই সমস্ত ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর দেশের লোক তাঁকে খুবই প্রাচীন বলে বিবেচনা করে…।
[Voici un second recueil de fables que je présente au public… je dirai, par reconnaissance, que j’en dois la plus grande partie à Pilpay, sage Indien. Son livre a été traduit en toutes les langues. Les gens du pays le croient fort ancien…২৬]
এছাড়া আরো তিনটি নীতিকবিতায় লা ফোঁতেন পিলপাই–এর নাম করেন২৭। মুখে মুখে প্রচলিত কিছু প্রাচীন ভারতীয় নীতিকাহিনি (কথা/कथा)সাধারণ–পূর্ব চতুর্থ বা তৃতীয় শতকে পাঁচটি খণ্ডে (তন্ত্রে)বিভক্ত নীতিশাস্ত্র’ (नीतिशास्त्रम्) পঞ্চবতন্ত্র (पञ्चतन्त्रम्)শিরোনামে সংকলিত হয়। ঐতিহ্যানুসারে এই সংকলনের রচয়িতা (সংকলক) বিষ্ণুশর্মা (विष्णुशर्मन्)। এই নীতিকাহিনিগুলি সাধারণ অব্দের ষষ্ঠ শতকে পহ্লবি ভাষায় অনূদিত হয়। এর পর এই কাহিনিগুলির সিরিয়াক, আরবি এবং আরবি থেকে হিব্রু, গ্রিক ও ল্যাটিন ও বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষায় অনুলিখিত হয়। বিভিন্ন অনুবাদে এই কাহিনিগুলির রচয়িতার নাম নির্দেশিত হয় পিপলাই (Pilpai/Pilpay/Pilpaï) বা বিদপাই(Bidpai/Bidpay/Bidpaï) যা মনে হয় সংস্কৃত ‘বিদ্যাপতি’ (विद्यापति) নামের বিকৃত প্রতিবর্ণীকরণ। লা ফোঁতেন ত্রয়োদশ শতকে হিব্রু থেকে জন অভ কাপুয়া (Johannis de Capua) কর্তৃক ল্যাটিনে অনূদিত Liber Kelile et Dimne, Directorium Vite Humane ও আরবি থেকে ইস্পাহানের দাভিদ সাহিব (দাভিদ সাইব দিস্পাঅঁ/David Sahib d’Ispahan) অভিধায় পরিচিত গোলম্যাঁ (David Gaulmin) নামে ফরাসির ফরাসিতে অনূদিত Le Livre des lumières ou la Conduite des Rois (১৬৪৪) গ্রন্থে এই নীতিকাহিনিগুলি পড়েন। লা ফোঁতেন–এর নীতিকবিতার অন্তত বারোটি কবিতার কাহিনি পঞ্চতন্ত্র থেকে নেওয়া২৮। বস্তুত লা ফোঁতেনের এই নীতিকবিতাগুলি আন্তঃসাংস্কৃতিক, আন্তঃসাহিত্যিক তথা আন্তর্ভাষিক পরিগ্রহণ তথা অনুরাচনিক সৃষ্টির দৃষ্টান্ত। আবার যেসব নীতিকাহিনির বেশির ভাগেরই উত্স প্রাচ্য–ঐতিহ্য তার রূপান্তরিত পাশ্চাত্য রূপ ইংরেজি অনুবাদে ইশপ–এর নীতিকথা হিসেবে এদেশে ফিরে আসতে শুরু করে। নীতিকাহিনির এই দেশ–পরিক্রমা, রূপান্তর বা/এবং প্রত্যাবর্তন কৌতুহলোদ্দীপক। মধুসূদনের নীতিকবিতাগুলি তাই নীতিকথার পরাসাংস্কৃতিক সঞ্চালন ও রূপান্তরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মধুসুদনের বাংলা নীতিকবিতার প্রাথমিক অবলম্বন ছিল সংস্কৃত নীতিকাহিনি নয়, লা ফোঁতেন–এর ফরাসি নীতিকবিতা। গৌরদাস বসাককে একটি চিঠিতে (২৬–এ অক্টোবর, ১৮৬৪) তিনি লিখেছেন:
…I have not been doing much in poetical line of late, beyond imitating a few Italian and French things.২৯
এখানে ‘Italian and French thing’ বলতে মধুসূদন অবশ্যই সনেট ও নীতিমূলক কবিতার প্রতি নির্ধেশ করেছেন।
৪.২ মধুসূদনের নীতিগর্ভ কাব্য–এর সংখ্যা এগারো। এর মধ্যে ‘দেবদৃষ্টি’ কবিতাটি রচনারীতির দিক থেকে মধুসুদনের নীতি–কবিতাগুলির সমগোকত্রীয় হলেও চরিত্রে নীতিকবিতা নয়, বাকি দশটি কবিতা নীতিমূলক। এর মধ্যে অনন্ত আটটি কবিতা লা ফোঁতেনের কবিতার অবলম্বনে রচিত। বাকি দুটি কবিতাও একই আদর্শে লেখা। লা ফোঁতেনের মূল কবিতাগুলির নির্দেশ–সহ আমরা মধুসূদনের আটটি কবিতার তালিকা উপস্থিত করছি:
মধুসূদনের কবিতা
|
লা ফোঁতেনের কবিতা
|
ময়ুর ও গৌরী
কাক ও শৃগালী
রসাল ও স্বর্ণলতিকা
অশ্ব ও কুরঙ্গ
গদা ও সদা
কুক্কুট ও মণি
পীড়িত সিংহ ও অন্যান্য পশু
সিংহ ও মশক
|
Le Paon se plaignant à Junon [II-XVII]*
Le Corbeau et le Renard [I-II]
Le Chène et le Roseau [I-XXII]
Le Cheval s’étant voulu venger du Cerf [II-XIII]
Les Deux Mulets [I-IV]
Le Coq et la Perle [I-XX]
Le Lion malade et le Renard [VI-XIV]
Le Lion et le Moucheron [II-IX]
|
* তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে রোমান সংখ্যা লা ফোঁতেন–এর নীতিকবিতার সংকলনের খণ্ড ও কবিতার সংখ্যা নির্দেশক।
এই কবিতাগুলির৩০ মধ্যে ‘কাক ও শৃগালী‘ কবিতার শেষ কয়েকটি চরণ পাওয়া যায়নি, ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’‘ কবিতার মাঝের কয়েকটি চরণ কীটদস্ট হয়ে হারিয়ে গেছে এবং ‘‘সিংহ ও মশক’‘ কবিতাটি অসমাপ্ত।
৫. মধুসূদনের অনুরচনার অনুলিখন– পদ্ধতি
৫.১ তাঁর জীবনের অন্তিমপর্বে (১৮৬৭ নাগাদ) মধুসূদন হোমার–এর (Homer,গ্রিক. ওমিরস/Ὅμηρος) ‘ইলিয়াড’ (Iliad, গ্রিক ইলিয়াস /ইলিয়াদাস /Ιλιάς/Ιλιάδας)মহাকাব্যের অবলম্বনে ‘হেক্টরবধ’ শিরোনামে একটি গদ্যরচনা শুরু করেন। রচনাটি ১৮৭১ সালে অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি উত্সর্গ করা হয় ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে। উত্সর্গপত্রে আন্তঃসাহিত্যিক, আন্তর্ভাষিক পরিগ্রহণ তথা অনুলিখনের আদর্শ ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে মধুসূদনের মতামত স্পষ্ট:
কাব্যখানি পাঠ করিলে টের পাইবে, যে আমি কবিগুরুর মহাকাব্যের অবিকল অনুবাদ করি নাই, তাহা করিতে হইলে অনেক পরিশ্রম হইত,এবং সে পরিশ্রমও যে সর্ব্বতোভাবে আনন্দোত্পাদন করিত, এ বিষয়ে আমার সংশয় আছে। স্থানে স্থানে এই গ্রন্থের অনেকাংশ পরিত্যক্ত এবং স্থানে স্থানে অনেকাংশ পরিবর্ত্তিত হইয়াছে।…বিদেশীয় একখানি কাব্য দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করিয়া আপন গোত্রে আনা বড় সহজ ব্যাপার নহে, কারণ তাহার মানসিক ও শারীরিক ক্ষেত্র হইতে পর বংশের চিহ্ন ও ভাব সমুদায় দূরীভূত করিতে হয়।৩১
এই বক্তব্যের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক (বর্তমান ক্ষেত্রে ইয়োরোপীয়/ফরাসি থেকে ভারতীয়/বাঙালি সংস্কৃতিতে) পরিগ্রহণের ভিত্তিতে আন্তঃসাহিত্যিক (বর্তমান ক্ষেত্রে ফরাসি থেকে বাংলা সাহিত্যে), আন্তর্ভাষিক (বর্তমান ক্ষেত্রে ফরাসি থেকে বাংলা ভাষায়) অনুলিখনের (অনুকরণ/অনুবাদ/অবলম্বনের) অন্যভাবে অনুরাচনিক সংকরায়ণের (টীকা ১ দ্রষ্টব্য) সমস্যা সম্পর্কে মধুসূদনের সচেতনতা ও তার সমাধানের পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা প্রকাশিত। বস্তুত আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের ভিত্তিতে আন্তঃসাহিত্যিক, আন্তর্ভাষিক অনুলিখন কেবলমাত্র একটি ভাষায় যা বলা হয়েছে অন্য একটি ভাষায় মোটামুটি তা বলে দেওয়া নয়৩২, তার চেয়ে অনেক বেশি, বলা যায় এক সংস্কৃতিকে অন্য এক সংস্কৃতিতে, জটিল এক সাংস্কৃতিক তন্ত্রের জগৎকে অন্য এক সাংস্কৃতিক তন্ত্রের জগতে স্থানান্তর–উপস্থাপন। এই পরিপ্রেক্ষিতে উৎস ও লক্ষ্য ভাষা/সাহিতের ভৌগোলিক–ঐতিহাসিক তথা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিক সান্নিধ্য বনাম দূরত্বের ভিত্তিতে আমরা আন্তঃসাহিত্যিক, আন্তর্ভাষিক অনুলিখনকে অন্তিক এবং দূরান্তিক এই দু শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি। ভৌগোলিক(আবহাওয়া, উদ্ভিৎ–জগৎ, প্রাণী–জগৎ) –ঐতিহাসিক সান্নিধ্য এবং ইয়োরোপীয় গ্রেকো–রোমান ও জুডিও–খ্রিস্টান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে ফরাসি সংস্কৃতি/সাহিত্য/ভাষা যথাক্রমে ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ইংরেজি বা জার্মানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক/সাহিত্যিক/ভাষিক দিক থেকে যতটা নিকটবর্তী বাংলা, হিন্দি বা তামিল সংস্কৃতি/সাহিত্য/ভাষার সঙ্গে তা নয়। তাই কোনো ফরাসি সাহিত্যিক রচনার ইয়োরোপীয় কোনো ভাযায় অনুরচনা (অনুকরণ/অবলম্বন/অনুবাদ) আপেক্ষিকভাবে অন্তিক অনুলিখন আর ঐ একই রচনার বাংলা, হিন্দি, তামিল ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় অনুরচনা দূরান্তিক অনুলিখন/ দুক্ষেত্রে সমস্যার চরিত্র এবং বিস্তার সম্পূর্ণ ভিন্ন। লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার অনুলিখনে মধুসূদন তাঁর কথিত ‘দত্তক’ গ্রহণ ও তাকে ‘আপন গোত্রে’ অভিযোজনের ‘ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
৫.২ মুদ্রণ–সংস্কৃতির ষুগের ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তি–পাঠকের প্রত্যাশা পুরণের জন্য পাঠ্য কবিতা রচনা করতে গিয়ে মধুসূদন বাংলা কাব্যের প্রকাশ–প্রকরণে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য থেকে চতুর্দশপদী কবিতবলি পর্যন্ত কবিতার মধ্যে বাক্যের অর্থবোধক ছেদ ও ছন্দ–সংগঠনের যতির সহাবস্থান লুপ্ত করে প্রবহমানতার (enjambement) প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতায় ছন্দে বিপ্লব সম্পন্ন করেন ― সৃষ্টি করেন মিলহীন (অমিত্রাক্ষর) ও সমিল প্রবহমান কাব্যভাষা।মধুসূদনের নীতিকবিতাগুলিতে এই বিপ্লবকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস দেখা যায়। তাঁর এই প্রয়াস লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার অনুলিখনের অপরিহার্য অংশ। অন্যভাবে বলা যায় লা ফোঁতেনের রচনার আদর্শে মধুসূদন তাঁর অনুরচনায় তাঁর ইতিপূর্বে ব্যবহৃত সমিল প্রবহমান ছন্দসংগঠনকে আরো গতিময়, আরো পরিবর্তিত করেন। লা ফোঁতেন তাঁর পদ্যে রচিত ফাবল বা নীতিকথায় ‘মিশ্র ছন্দ’ বা ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’৩৩ ব্যবহার করেছিলেন। বস্তুত নীতিকবিতা রচনার বেশ কয়েক বছর আগে লা ফোঁতেন তাঁর পদ্যে রচিত ‘কাহিনি’–র (Contes et Nouvelles en vers, ১৬৬৫) প্রথম খণ্ডের ‘প্রস্তাবনা’য় (Avertissement) জানান:
কাহিনিগুলিকে সমিল পদ্যে প্রকাশ করার জন্য কোন রূপটা সবচেয়ে যথাযথ হতে পারে রচয়িতা তা বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে অসম ছন্দোবদ্ধ পদ্যের মধ্যে অনেকটা গদ্যের ভাব রয়েছে বলে এই ধরনটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক আর তার ফলে সবচেয়ে ভালো বলে মনে হওয়া সম্ভব।
[L’auteur a voulu éprouver lequel caractère est le plus propre pour rimer des contes. Il a cru que les vers irréguliers ayant un air qui tient beaucoup de la prose, cette manière pourrait sembler la plus naturelle, et par conséquent la meilleure.৩৪ ]
উক্ত উপলব্ধি থেকে তিনি প্রথমে তাঁর কাহিনিতে পরে তাঁর নীতিকবিতায় পরপর সমান অক্ষর (বা দল, সিলেবল/syllable) সমন্বিত চরণের পরিবর্তে বিভিন্ন চরণে অক্ষরের সংখ্যা কমিয়ে বাড়িয়ে কাহিনির উপযোগী নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য অসম অক্ষর–বিন্যাসের। চরণ ব্যবহার করেছিলেন। মধুসূদনও লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার অনুরচনায় লা ফোঁতেনেরই আদর্শে প্রবহমানতা রক্ষা করে অক্ষরবৃত্তের বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের পর্ব (৮/৬/১০) বা/এবং পর্ব–সমবায়ে ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ বা ‘মিশ্র পর্বের অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’৩৪ উদ্ভাবন ও ব্যবহার করেন আর তার সঙ্গে যোগ করেন মিল–বিন্যাসের অভিনবত্ব। লা ফোঁতেনের আদর্শে রচিত এই নীতিকবিতাগুলির ছন্দ ও মিল–বিন্যাসের বৈচিত্র্যের দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করছি:
১. ময়র কহিল কাঁদি গৌরীর চরণে, (৮।৬ = ১৪) ক
কৈলাস ভবনে — (৬) ক
“অবধান কর দেবি, (৮) খ
আমি ভৃত্য নিত্য সেবি (৮) খ
প্রিয়োত্তম সুতে তব ও পৃষ্ঠ–আসনে। (৮।৬ = ১৪) ক
রথী যথা দ্রুত রথে, (৮) গ
চলেন পবন–পথে (৮) গ
দাসের এ পিঠে চড়ে সেনানী সুমতি; (৮। ৬ = ১৪)ঘ
তবু, মা গো, আমি দুখী অতি ! (৪।৬ = ১০) ঘ
(ময়ুর ও গৌরী৩৬)
২. ধিক্, দুষ্টমতি (৬) ক
মারি তোরে বন–জীবে দিব, রে, কু–মতি। (৮।৬ = ১৪) ক
হইল বিষম রণ, তুলনা না মিলে; (৮।৬ = ১৪) খ
ভীম দুর্যোধনে, (৬) গ
ঘোর গদা–রণে, (৬) গ
হ্রদ–দ্বৈপায়নে, (৬) গ
তীরস্থ সে রণ–ছায়া পড়িল সলিলে; (৮।৬ = ১৪) খ
(সিংহ ও মশক৩৭)
৫.৩. লা ফোঁতেনের কবিতার বহিরঙ্গ–প্রকরণ ও অন্তরঙ্গ চরিত্রকে অনুসরণ করলেও একথা অনস্বীকার্য যে ঐ ফরাসি কবির কবিতার স্বচ্ছন্দ গতিময়তা মধুসূদনের নীতিকবিতায় নেই। লা ফোঁতেনের ধ্রুপদী স্বচ্ছতা, ছন্দ, মিল ও বাগভঙ্গির আশচর্য স্বাভাবিকতা, সর্বোপরি বুদ্ধি ও কৌতুকদীপ্ত গতিময় কাব্যবাচন মধুসূদনের নীতিকবিতায় প্রায় অনুপস্থিত। বস্ত্ততপক্ষে মধুসূদনের লিখন ছিল লা ফোঁতেন–এর সরস, স্বচ্ছন্দ নীতিকবিতার লিখনের প্রায় বিপ্রতীপ। সেই লিখনকে যথাসাধ্য পরিবর্তন করে মধুসূদন নীতিকবিতা রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। দেখা যায়, একই সময়ে লেখা কবির সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতাগুলির বেশিরভাগ নীতিকবিতার তুলনায় সাবলীল,স্বভাবিক — কারণ মধুসূদনের লিখনকে সেখানে খুব একটা পরিবর্তিত করতে হয় নি। সঙ্গে সঙ্গে একথাও স্মরনীয় যে মহাকবির গান্ভীর্য নিয়ে কাব্যরচনার স্তিমিত–প্রায় শেষ পর্বে মধুসূদন এই নীতিকিতাগুলি রচনা করেছিলেন।৩৮ লা ফোঁতেন–এর নীতিকবিতায় কাহিনি, চরিত্র, নাটকীয়তা, সহাস্য সাবলীলতা, কবিতার ছন্দ ও ধ্বনিময়তা হল প্রধান, নীতি–উপদেশ অনুচ্চারিত, ব্যঞ্জিত। পক্ষৈন্তরে মধুসূদনের কবিতাগুলি ক্লিষ্ট ও নীরস — নীতি উপদেশ সেখানে সরব, শেষপর্যন্ত এই রচনাগুলি একান্তভাবে ‘নীতিগর্ভ কবিতা’। তবু মধুসূদনের এই কাব্যকৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সনেট ও এই নীতিকবিতার মাধ্যমে মধুসূদন ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য আধুনিক ইউরোপীয় ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে সরাসরি বাংলা সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিক যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাছাড়া তাঁর কাব্যরচনার স্তিমিত পর্বেও লা ফোঁতেনের আদর্শে মধুসূদন বাংলাভাষায় নতুন এক ধরনের কবিতা সৃষ্টি করলেন,প্রকরণ এবং ছন্দেরও নতুন সম্ভাবনার পথ দেখিয়ে গেলেন। প্রসঙ্গত একথাও বলা দরকার যে, মধুসূদনের নীতিকবিতাকে পেরিয়ে পরবর্তীকালের বাংলা নীতিকবিতা খুব একটা এগোতে পারেনি। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বিখ্যাত নীতিকবিতার সংকলনসদ্ভাবশতক–এ বা সমসাময়িক অন্যান্য লেখকের নীতিকবিতায় আমরা যে ধরণের ক্লিষ্ট, সাহিত্যগুণ বিবর্জিত লিখনের সাক্ষাৎ পাই তা মধুসূদন–পরবর্তী বাংলা নীতিকিতার পশ্চাদপসারণই সূচিত করে। এমনকি রবীন্দ্রনাথও এই ধারাকে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যান নি। তাঁর কণিকা কাব্যের নীতিকবিতাগুলি (‘প্রচীরের গায়ে এক নাম গোত্রহীন…’, ‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম…’ ইত্যাদি) পরীক্ষার ভাবসম্প্রসারণের জন্য ব্যবহার্য হলেও কাব্যকৃতি হিসেবে উচ্চ মার্গের নয়।
৫.৪ আলোচ্য নীতিকবিতাগুলির রচনাকালে মধুসূদন যে লা ফোঁতেনের কবিতার অবলম্বন বা অনুসরণ করেছেন একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর নিজের ভাষায়তিনি ‘‘ফরাসি বিষয়ের’ ‘imitation’ বা অনুকরণ করেছেন। কিন্তু মধুসূদনের বাংলা ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টির শুরু থেকেই দেখা যায় যে, তিনি আন্তঃসাংস্কৃতিক, আন্তর্ভাষিক পরিগ্রহণের পদ্ধতিগত কৌশল হিসেবে বিদেশি সাহিত্য থেকে পরিগৃহীত উপাদানকে দেশীয়করণ বা স্থানীয়করণে অর্থাৎ দেশীয় ঐতিহ্যের উপাদানে রূপান্তরের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আত্তীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন। বস্তুত আন্তঃসাংস্কৃতিক, আন্তর্ভাষিক দূরান্তিক পরিগ্রহণের মাধ্যমে বাংলায় লা ফোঁতেনের ফরাসি নীতিকবিতার অনুলিখনেও মধুসূদন একই মানসিকতা দ্বারা অনুপ্রাণিত–পরিচালিত হয়েছিলেন। প্রথমেই উদ্দিষ্ঠ পাঠকের পঠনের সহায়ক, দিগনির্দেশক উপরচনা রচনার শিরোনামের দিকে তাকালে দেখা যায় ইয়োরোপের পৌরাণিক ঐতিহ্য–অনুষঙ্গের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত রোমক দেবি জুনো ভারতীয় দেবী গৌরীতে রূপান্তরিত হয়েছেন, ওক (ইয়োরোপীয় গাছ) আর নল খাগড়া দেশীয় ঐতিহ্যানুগ রসাল ও স্বর্ণলতিকার রূপান্তর লাভ করেছে। কবিতার কাহিনি–নির্মাণ ও বিন্যাসে মধুসূদন কিভাবে কতটা লা ফোঁতেনকে গ্রহণ ও পরিবর্তন করেছেন তা দৃস্টান্ত–সহ আলোচনা করা যায়।
৫.৫ মধুসূদনের ‘কুক্কুট ও মণি’ কবিতাটি লা ফোঁতেনের ‘মোরগ (= কুক্কুট) ও মুক্তা’(Le Coq et la Perle) অবলম্বনে রচিত। মূল কবিতাটি দুই স্তবকের, পঙক্তি সংখ্যা: ১২। কবিতাটি উদ্ধৃত করা যাক:
Un jour un coq détourna
Une perle, qu’il donna
Au beau premier lapidaire.
“Je la crois fine, dit-il.
Mais le moindre grain de mil
Serait bien mieux mon affaire.”
Un ignorait hérita
D’un manuscrit qu’il porta
Chez son voisin le libraire.
”Je crois, dit-il, qu’il est bon;
Mais le moindre ducaton
Serait bien mieux mon affaire.”৩৯
[শব্দার্থ: একটি মোরগ (মাটি) খুঁড়ে বের করল / একটি মুক্তা, যা ও দিল / প্রথম(দেখা পাওয়া) জহুরিটিকে / সে বলল, ‘মনে হয় ওটা (=জিনিষটা) সুন্দর; / তবে সবচেয়ে ছোট্ট একটা ভুট্টার দানা / ওর চেয়ে আমার বেশি কাজে লাগত।’
এক মূর্থ উত্তরাধিকারসূত্রে পেল / একটা পুঁথি যা সে নিয়ে গেল / তার প্রতিবেশী বইয়ের দোকানদারের কাছে ।’/ সে বলল, ‘মনে হয় এটা ভালো; / তবে সামান্যতম একটা পয়সা / এর চেয়ে আমার অনেক বেশি কাজে লাগত।’]
এর অবলম্বনে রচিত মধুসূদনের কবিতাটি নিম্নরূপ:
খুঁটিতে খুঁটিতে ক্ষুদ্র কুকুট পাইল
একটি রতন: —
বণিকে সে ব্যগ্রে জিজ্ঞাসিল; —
‘ঠোঁটের বলে না টুটে, এ বস্ত্ত কেমন?’
বণিক্ কহিল, — ‘ভাই,
এ হেন অমূল্য রত্ন, বুঝি, দুটি নাই।’
হাসিল কুকুট শুনি; — ‘তণ্ডুলের কণা
বহুমূল্যতের ভাবি; — কি আছে তুলনা?’
‘নহে দোষ তোর, মূঢ়, দৈব এ ছলনা,
জ্ঞানশূন্য করিল গোঁসাই!’ —
এই কয়ে বণিক্ ফিরিল!
মূর্খ যে, বিদ্যার মূল্য কভু কি সে জানে?
এর–কুলে পশু বলি লোকে তারে মানে; —
এই উপদেশ কি দিলা এই ভানে।৪০
চোদ্দ পংক্তির এই কবিতায় মধুসূদন লা ফোঁতেনের কবিতার ছয় পংক্তির প্রথম স্তবকের কাহিনিকে গ্রহণ করেছেন। উত্স কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের কাহিনিকে তিনি বর্জন করেছেন৪০। তবে ‘মূর্খ যে বিদ্যার মূল্য কভু কি সে জানে’ পংক্তিটি মূল কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের কাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাছাড়া লা ফোঁতেনের কবিতায় নীতি–উপদেশ অনুচ্চারিত, কাহিনির মধ্যে নিহিত। বিশেষভাবে প্রথম কাহিনির যৌক্তিক অনুক্রম হিসেবে দ্বিতীয় কাহিনি নিহিত নীতি–বার্তাকে উপলব্ধি করায়। কিন্ত্ত মধুসূদনের কবিতায় নীতি–উপদেশ সোচ্চার, কাহিনি এবং বাচনের ব্যঞ্জনাবৃত্তিকে অগ্রাহ্য করে, কাহিনি–কথক বাখথাকারকে সরিয়ে দিয়ে রচয়িতা কবি নিজে সেখানে উপদেষ্টা–বক্তার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
৫.৬ এবার দৃষ্টান্ত হিসেবে মধুসূদনের সুপরিচিত ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’ কবিতাটি নেওয়া যাক। লা ফোঁতেনের ‘ওকগাছ ও নলখাগড়া’ (Le chêne et le Roseau)অবলম্বনে কবিতাটি রচিত। মূলের তুলনায় মধুসূদনের কবিতাটি দীর্ঘতর। মূলের আরম্ভে আছে:
Le chêne, un jour, dit au Roseau:
‘Vous avez bien sujet d’accuser la nature;
Un roitelet pour vous est un pesant fardeau;
Le moindre vent qui d’aventure
Fait rider la face de l’eau
Vous oblige à baisser la tête;
Cependant que mon front, au Caucase pareil.
Non content d’arrêter les rayons du soleil,
Brave l’effort de la tempête.
Tout vous est aquilon, tout me semble Zéphyr.৪১
[শব্দার্থ: একদিন ওকগাছ নলখাগড়াকে বলল: / ‘প্রকৃতিকে দোযারোপ করার যথার্থ কারণ আপনার রয়েছে; / একটি রোআৎলে৪২ পাখি আপনার কাছে একটি ভারি বোঝা; / সামান্যতম বাতাস যা হঠাৎ /জলের মুখমণ্ডলকে রেখাঙ্কিত করে / (তা) আপনাকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করে; সেখানে ককেসাস পর্বত–সদৃশ আমার কপাল /সূর্যরশ্মিকে প্রতিহত করেও সন্ত্তষ্ট না হয়ে / ঝড়ের তৎপরতার সম্মুখীন হয়। / আপনার কাছে সবই উত্তরের হিমবায়ু, আমার কাছে সবই যেন মলয়–পবন।’]
মধুসূদনের কবিতার প্রথমাংশে রয়েছে:
রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে; —
‘শুনে মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে।
নিদারশ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি:
তেই ক্ষুদ্র–কায়া করি সৃজিলা তোমারে।
মলয় বহিলে, হায়,
নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর–ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি–সদৃশ আমি
বন–বৃক্ষ–কুল–স্বামী,
মেঘলোকে উঠে শির আকাশ ভেদিয়া !
কালাগ্নির মত তপ্ত তপন তাপন, —
আমি কি লো ভরাই কখন? ৪৩
এখানেও মূল কবিতার কাহিনি অনুসরণ করে মধুসূদন অনেকটা স্বাধীনভাবে তাকে বিন্যস্ত করেছেন। দেশীয় ভৌগোলিক ও পরিচিত ঐহিত্যানুগ পরিবেশে কাহিনিকে সংস্থাপনের প্রয়োজনে উপকরণগত পরিবর্তন এসেছে — ‘ওক’, ‘নলখাগড়া’, ‘প্রকৃতি’, ‘রোআৎলে পাখি’ এবং ‘ককেসাস’ যথাক্রমে ‘রসাল’, ‘স্বর্ণলতিকা’, ‘বিধাতা’, ‘মধুকর’ এবং ‘হিমাদ্রি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। এই রূপান্তরিত দেশীয় উপকরণগুলির অনুযঙ্গ–অনুসারে ও বাস্তবতার যুক্রিক্রমে কাহিনিরও পরিবর্তন ঘটেছে।
লা ফোঁতেনের কবিতার শেষ অংশে আছে:
Du bout de l’horizon accourt avec furie
Le plus terrible des enfants
Que le Nord eût portés jusque-là dans ses flancs.
L’arbre tient bon ; le Roseau plie.
Le vent redouble ses efforts,
Et fait si bien qu’il déracine
Celui de qui la tête au ciel était voisine
Et dont les pieds touchaient à l’empire des morts.
[শব্দার্থ: দিগবলয়ের প্রচণ্ডভাবে ছুটে আসে / সবচেয়ে দুরন্ত / শিশুটি /উত্তরদিক যাকে এ তাবৎ কক্ষে ধারণ করে ছিল। / গাছের কিছুই হয় না, / নলখাগড়া নুয়ে পড়ে। / বায়ু তার তত্পরতাকে দ্বিগুণ করে / আর এমনই দারুণ করে যে সে উপড়ে ফেলে / তাকে যার মাথা আকাশের প্রতিবেশী হয়ে ছিল / আর যার পা ছুঁয়ে ছিল মৃতের সাম্রাজ্য(পাতালকে)।]
মধুসূদনের রূপন্তর:
…উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীরা স্বননে;
আইলেন প্রভঞ্জন,
সিংহনাদ করি ঘন,
যথা ভীম ভানসেন কৌরব সমরে।
আইল খাইতে মেঘ দৈত্যকূল রড়ে;
ঐরাবত পিঠে চড়ি
রাগে দাঁত কড়মড়ি,
ছাড়িলেন বজ্র ইন্দ্র কড় কড় কড়ে।
উরু ভাঙ্গি কুরুরাজে বধিলা যেমতি
ভীম যোধপতি,
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি,
হায়, বায়ুবলে
হারাইলা আয়ুসহ সর্প বনস্থলে।
উর্ধ্বশিরা যদি তুমি কুল মান ধনে:
করিওনা ঘৃণা তবু নীচশির জনে !
এই উপদেশ কবি দিলা এ কৌশলে।৪৪
এখানে স্থানীয়করণের মাধ্যমে মূল কাহিনির সূত্রটিকে দেশীয় ঐতিহ্যে সংস্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে তা নিজস্ব গতিতে এগিয়ে গেছে। শুধু কাহিনির সমাপ্তি মূলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মনে হয়, ‘প্রভঞ্জন’ এবং উপমান–বাচক ‘ভুীমসেন’ সহসা মেঘনাদবধরচয়িতা মধুসূদনের সহাকাব্য–রচনার স্মৃতিকে মুহূর্তের জন্য জাগ্রত করেছে। সেই স্মৃতির উদবোধন ‘হারাইলা আয়ু–সহ দর্প বনস্থলে’–তে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। অতঃপর মধুসূদন নীতি–উপদেশ রচনার দায়িত্ব স্মরণ করেছেন। আলোচ্য অংশের প্রায় বীররসাত্মক বর্ণনা এবং অবশেষে সোচ্চার নীতি–উপদেশ কবিতার কাহিনিরস ও স্বচ্ছন্দ গতির পরিপন্থী বলে বোধ হয়। তাছাড়া অন্যান্য নীতিকবিতার মত এই কবিতাকেও বাগাড়ম্বরে বিস্তৃত করা হয়েছে। লা ফোঁতেনের ধ্রুপদী সংহতি মধুসূদনের রচনায় থাকে নি। মূল কবিতাটি যেখানে বত্রিশ পংক্তির, সেখানে মধুসূদনের কবিতার পংক্তি–সংখ্যা (পাণ্ডুলিপির বিনষ্ট কয়েক পংক্তি বাদ দিয়েও)।
৫.৭ আমরা শেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করছি লা ফোঁতেনের ‘কাক ও শেয়াল’ (Le Corbeau et le Renard) কবিতাটি:
Maître Corbeau, sur un arbre perché ;
Tenait en son bec un fromage.
Maître Renard, par l’odeur alleché
Lui tint a peu près ce langage :
”Hé ! Bonjour, Monsieur du Corbeau,
Que vous êtes joli ! que vous me semblez beau !
Sans mentir, si votre ramage
Se rapporte à votre plumage.
Vous êtes le phénix des hôtes de ces bois.
A ces mots le corbeau ne se sent pas de joie :
Et, pour montrer sa belle voix,
Il ouvre un large bec, laisse tomber sa proie.
Le Renard s’en saisit, et dit : ”Mon bon Monsieur,
Apprenez que tout flatteur
Vit aux dépens de celui qui l’écoute.
Cette leçon vaut bien un fromage, sans doute”
Le Corbeau, honteux et confus,
Jura, mais un peu tard, qu’on ne l’y prendrait plus.৪৫
[শব্দার্থ: কাক মশায়, গাছের দাঁড়ে বসে, / তার ঠোঁটে ধরে রেখেছিল এক খণ্ড পনির। / শেয়ালমশায় গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে, / তার উদ্দেশে প্রায় একরকম বাক্য প্রয়োগ করল: / ‘এই যে’ নমস্কার শ্রীযুত কাকেশ্বর /আপনি কী ভালো দেখতে ! আপনাকে আমার কী যে সুন্দর বলে মনে হচ্ছে। / সত্যি বলতে কি, আপনার কাকলি আপনার পালকের সমতুল্য হলে / আপনি এই বনের অধিবাসীদের মধ্যে ফিনিক্স হতেন।’এসব কথায় কাক আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল / আর তার মনোহর কণ্ঠস্বর দেখাতে গিয়ে / সে বিরাট এক হাঁ করল, ফেলে দিল তার লুঠের মাল। / শেয়াল সেটা লুফে নিল আর বলল: ‘সদাশয় মশাই, /জেনে রাখুন প্রতিটি চাটুকার / তার কথা যে শোনে তার ঘাড়ে জীবন কাটায়। / নিঃসন্দেহে এ শিক্ষার দাম এক খণ্ড পনির তো বটে,’ /লজ্জিত আর হতবুদ্ধি কাক, / প্রতিজ্ঞা করল, / তবে একটু দেরিতে,যে তাকে আর এভাবে কেউ ঠকাতে পারবে না।]
এই কবিতা অবলম্বনে রচিত মধুসূদনের ‘কাক ও শৃগালী’ কবিতাটি। পাণ্ডুলিপি কীটদষ্ট হওয়ায় এই কবিতার শেষ কিছু পংক্তি পাওয়া যায় নি। অসমাপ্ত কবিতাটি হল:
একটি সন্দেশ চুরি করি,
উড়িয়া বসিলা বৃক্ষোপরি,
কাক, হৃষ্ট–মনে;
সুখাদ্যের বাস পেয়ে
আইল শৃগালী ধেয়ে,
দেখি কাকে কহে দুষ্টা মধুর বচনে; —
‘অপরূপ রূপ তব, মরি
তুমি কি গো ব্রজের শ্রীহরি,
গোপিনীর মনোবাঞ্ছা? —
হে নব নীরদ–কান্তি,
ঘুচাও দাসীর ভ্রান্তি,
জুড়াও এ কান দুটি করি বেণু–ধ্বনি।
পুণ্যবতী গোপ–বধু অতি।
তেঁই তারে দিলা বিধি,
তব সম রূপ–নিধি, —
মোহ হে মদনে তুমি; কি ছার যুবতী?
গাও গীত, গাও, সখে করি এ মিনতি।
কুড়াইয়া কুসুম রতনে
গাঁথি মালা সুচারু গাঁথনে…৪৬
প্রথমেই চোখে পড়ে মূল কবিতার ‘শেয়াল’ এখানে ‘শৃগালী’তে রূপান্তরিত। মনে হয় মূলের কাহিনি–সূত্রটিকে মধুসূদন বৈষ্ঞব সাহিত্যের ঐতিহ্যানুগ পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে চেয়েছেন বলেই এই রূপান্তর, সেই অনুষঙ্গই পরবর্তী অংশের প্রকাশ ও গতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং এসেছে বাগাড়স্বব। যার ফলে মূল কবিতায় শৃগালের প্রথম উক্তি যেখানে পাঁচ পংক্তিতে সমাপ্ত, সেখানে মধুসূদনের কবিতার অসমাপ্ত রূপে তের পংক্তিতে ‘শৃগালী’র উক্তি সম্পূর্ণ হয় নি। এখানেও যেন নীতি–কবিতা রচনাকারী মধুসূদনের মধ্যে ‘ব্রজাঙ্গনা’–রচয়িতা মধুসূদনের স্মৃতি আবির্ভূত হয়েছে।
৫.৮ আর দৃষ্টান্ত না বাড়িয়ে উপরের উদ্ধৃতিগুলির পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদন কর্তৃক লা ফোঁতেনের কবিতার রূপান্তর ও রূপায়ণ–পদ্ধতির কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে পারি:
ক. মধুসূদন লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার কাহিনি–সংগঠনের মূলসূত্র অনুসরণ করেছেন। মধুসূদনের অনুলিখিত নীতিকবিতাগুলির কাহিনির আরম্ভ এবং পরিণতি লা ফোঁতেনের অনুসারী হলেও কাহিনির উপাস্থাপনা ও বিন্যাসে মধুসূদন যথাসম্ভব ‘স্বাধীনতা’ গ্রহণ করেছেন। এই ‘স্বাধীনতা’–গ্রহণ তাঁর আন্তঃসাংস্কৃতিক, আন্তর্ভাষিক পরিগ্রহণের পদ্ধতিগত কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এই ‘স্বাধীনতা’ গ্রহণের উদ্দেশ্য অনুরচনাকে উদ্দিষ্ট সম্ভাব্য পাঠকের কাছে পরিগ্রহণীয় করে তোলা।
খ. ‘পদ্মাবতী নাটক’ থেকে শুরু করে মধুসূদনের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের পদ্ধতিগত কৌশল হিসেবে পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে পরিগৃহীত বিভিন্ন উপাদানকে দেশীয়করণ অর্থাৎ দেশীয় ঐতিহ্যের উপাদানে রূপান্তরের মাধ্যমে আত্তীকরণের যে প্রবণতা দেখা যায়, আলোচ্য নীতিকবিতাগুলির মধ্যে তা বিশেষভাবে স্পষ্ট। মধুসূদন সাধারণত প্ররচনার কাহিনি–সংস্থানকে দেশীয় পরিবেশে সংস্থাপিত করেছেন বা/এবং দেশীয় কোনো ঐতিহ্যের সঙ্গে অন্বিত করেছেন। এই পদ্ধতিগত প্রয়োজনে প্ররচনার ভৌগোলিক পরিবেশ বা/এবং পরিপ্রেক্ষিতের উপকরণও রূপান্তরিত হয়েছে। এছাড়া প্রায়শ দেশীয় উপকরণের অনুষঙ্গে কাহিনি এবং প্রকাশভঙ্গির গতি পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিপূর্বে কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনায় আমরা কাব্যিক বাচনের অনুবাদ–প্রক্রিয়ার সমস্যা, পদ্ধতি এবং প্রকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি৪৬। ঐ আলোচনার সূত্রে মধুসূদনের নীতিকবিতাগুলিকে আমরা অনুরচনার একটা বিশেষ বর্গের অন্তর্গত করতে পারি, এই বর্গটি হল ‘অবলম্বন’। অনুরচনার তির্যক অনুলিখন–পদ্ধতি হিসেবে অবলম্বনের ক্ষেত্রে আমরা ভাষিক–সাংস্কৃতিক রূপান্তর তথা স্থানীয়করণকে প্রধান চরিত্র–লক্ষণ বলে নির্দেশ করতে পারি। ইতিপূর্বে প্ররচনার পাশাপাশি অনুরচনা হিসেবে নির্বাচিত নীতিকবিতাগুলির আলোচনায় আমরা এই ভাষিক–সাংস্কৃতিক রূপান্তর তথা স্থানীয়করণের কৌশলের বিশ্লেষণ করেছি। এই স্থানীয়করণও অনুরচনাকে ভাষিক–সাংস্কৃতিকভাবে উদ্দিষ্ট বাঙালি পাঠকের কাছে পরিগ্রহণীয় করে তোলার পদ্ধতিগত কৌশলের অঙ্গ।
গ. লা ফোঁতেনের কবিতার নীতি–উপদেশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাহিনির মধ্যে নিহিত বা এমন পরোক্ষভাবে (যেমন কাহিনির কোনো চরিত্রের মুখে ) বলা যে তাতে কাহিনিরস বা কবিতার গীতিময়তা ব্যাহত হয় না। বস্তুত লা ফোঁতেন তাঁর নীতিকবিতায় ‘আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদানের ধ্রুপদী আদর্শকে অনুসরণ করেছেন। মধুসূদনের নীতিকবিতায় (‘সূর্য্য ও মৈনাক গিরি’ শীর্ষক কবিতা বাদ দিয়ে) নীতি–উপদেশ সোচ্চার ― আলোকায়িত; কাহিনি–সমাপ্তির পর কবি উপদেশ–দাতার ভূমিকা গ্রহণ করে তা উচ্চারণ করেছেন। এর মধ্যেও দেশীয়(সংস্কৃত) নীতিকথার ঐতিহ্যের অনুসরণ বা ভাষিক–সাংস্কৃতিক স্থানীয়করণের কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে। কাহিনি–কথনের মধ্যে রচয়িতার আবির্ভাব এবং উপদেশ–দাতার ভূমিকা–গ্রহণ তথা সোচ্চার নীতি–উপদেশ দান আন্তঃরাচনিকভাবে নীতিকথার সংকলন ‘পঞ্চতন্ত্র’ (पञ्चतन्त्रम्) ও ‘হিতোপদেশ’কে (हितोपदेशः) স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঘ. লা ফোঁতেনের কবিতার ধ্রুপদী সংহতি এবং স্বচ্ছন্দ, সাবলীল গতিময়তা মধুসূদনের নীতিকবিতায় অনুপস্থিত।
৬. উপসংহার
সবশেষে আবার বলা যায়, মধুসূদনের নীতি কবিতাগুলি বাংলা ভাষার সঙ্গে ফরাসি সাহিত্যের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে ফরাসি সাহিত্যের অনুরাচনিক উপাস্থিতির ঐতিহাসিক সূত্রপাত। এদিক থেকেও মধুসূদন আমাদের পথপ্রদর্শক। বিভিন্ন ভাষার কাব্যোদ্যানের ফুলসংগ্রহ করে‘মাতৃভাষা–কম–কলেবর’কে সজ্জিত করার যে মনোভাব দ্ধারা মধুসূদন বারবার উদবুদ্ধ হয়েছিলেন, তা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। স্মরণীয় তাঁর উপলব্ধি, যার দ্ধারা তিনি এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে আমাদের প্রতিটি নতুন চিন্তার বাহন হতে পারে একমাত্র মাতৃভাষা।
I have been for months like a ship becalmed in France, though thank God, I have had the strength of mind and resolution to make the best use of my misfortune in learning three continental languages, viz Italian, German and French languages, which are worth knowing for their literary worth… ‘the knowledge of a great European language is like the acquisition of a vast and well cultivates state ― intellectual of course. Should I live to return, I hope to familiarize my educated friends with these languages through the medium of our own tongue… European scholarship is good in as much as it renders us masters of the intellectual resources of the most civilized quarters of the globe but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let those, who feel that they have spring of fresh thought in them, fly to their mother-tongue… I should scorn the pretensions of that man to be called ‘educated’ who is not master of his own language.৪৭
১৮৬৫ সালের ২৬–র জানুয়ারি ভের্সাই থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা একটি চিঠিতে এই উক্তি করেছেন বিদেশি গ্রিক, লাতিন, হিব্রু, ইংরেজি, ইতালিয়ান, ফরাসি ও জর্মন ভাষাভিজ্ঞ মধুসূদন।
টীকা / তথ্য–সংযোজন
১. ‘সাবেকি প্রভাবতত্ত্ব’ (anachronic influenceology) শব্দের ব্যবহারের দ্বারা আমরা‘প্রভাব’ সম্পর্কে স্লোভাক সাহিত্যতাত্ত্বিক দিওনিজ দুরিসিন–এর (Dionýz Ďurisin,১৯২৯–১৯৯৭) চিন্তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছি। দুরিসিন–এর মতে ‘খ’ ‘ক’–কে কিছু পাঠাচ্ছে ― এটাই হল গিয়ে ‘প্রভাবের’ অন্তর্নিহিত ধারণা আর যেখানে প্রকৃত ঘটনা হল‘খ’ ‘ক’ থেকে বেরিয়ে আসা কিছু উপাদান বেছে নিয়ে আত্মস্থ করছে। আর এক্ষেত্রে আমরা ভাষাবিজ্ঞানী রোমান য়াকবসন–এর দুটি ভাষার সম্পর্ক বিষয়ে বাচন সাংস্কৃতিক সংকরায়ণের ক্ষেত্রে ― আমাদের ভাষায় অতিসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনের ফলশ্রুতি আন্তঃসাংস্কৃতিক তথা আন্তর্ভাষিক–আন্তর্সাহিত্যিক পরিগ্রহণের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য বলে মনে করি:
…Lorsque le système de l’idiome A ‘imite’ le système de l’idiome B la sélection et la révision des valeurs fonctionnelles des éléments adoptés ont toujours lieu du point de vue système A, en correspondance avec les possibilités d’évolution et les penchants de ce dernier ; dans le cas contraire, on est en présence d’une simple substitution du système B au système A, de l’extinction du système A. L’hybridation est un processus de synthèse et non une soudure mécanique.
― Roman Jakobson
Remarques sur l’évolution phonologique du russe,
Prague, 1929
ব্যবহারিক মূল্যমানের নির্বাচন ও পুনরীক্ষণ সবসময় তন্ত্র ‘ক’–এর দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পাদিত হয়ে থাকে, আর তা হয়ে থাকে শেষোক্ত তন্ত্রের উদবর্তনের সম্ভাব্যতা ও প্রবণতা অনুসারে। আর এর বিপরীত ক্ষেত্রে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তা হল তন্ত্র ‘ক’–এর জায়গায় ‘খ’–এর প্রতিস্থাপন, তন্ত্র ‘ক’–এর অবলুপ্তি। সংকরায়ণ হল একটা সংশ্লেষণ–প্রক্রিয়া, কোনোভাবেই তা যান্ত্রিক জোড়া লাগানোর ব্যাপার নয়।
― রোমান য়াকবসন : রুশ ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বিবর্তন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ,
প্রাগ, ১৯২৯]।
২. প্রাক্–ঔপনিবেশিক যুগের (এদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বর্ণনা বা বিশ্লেষণে আমরা ইয়োরোপীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত এবং প্রযোজ্য যুগ–নির্দেশক ‘মধ্যযুগ‘সংজ্ঞা অব্যবহার্য বলে মনে করি) বাংলা সাহিত্যের চরিত্র বোঝাতে আমরা তাকে মৌখিক সংস্কৃতির (Oral Culture) পরবর্তী এবং মুদ্রণ–সংস্কৃতির (Print culture) পূর্ববর্তী পুঁথি–সংস্কৃতির (Manuscript culture) যুগের সাহিত্য বলে নির্দেশ করেছি। এছাড়া এই সাহিত্য সম্পর্কে আমরা লিখিত–শ্রাব্য বা/এবং পাঠ্য–শ্রাব্য এ দুটি বিশেষণ ব্যবহার করেছি। প্রথমত এ সাহিত্য ছিল লিপিবদ্ধ, পুঁথিতে হস্তলিখিত বা প্রতিলিপি করা (অমুদ্রিত ― লিখিত), সাধারণত পারিবারিক/সামাজিক সমাবেশে সুর করে একজনের দ্বারা পঠিত হওয়ার জন্য রচিত (পাঠ্য) ও অন্যদের দ্বারা শ্রুত হওয়ার (শ্রাব্য) জন্য রচিত।
৩. যোগীন্দ্রনাথ বসু: মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা,চক্রবর্ত্তী, চাটার্জ্জি এণ্ড কোং, ১৯২৫ (এর পর থেকে সংক্ষেপে ‘জীবনচরিত’ অভিধা য় নির্দেশ করা হবে) , পৃষ্ঠা ১৫৯–১৬২।
৪. জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ১৮২।
৫. জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৪৮২। এই পত্র তারিখহীন। তবে পত্রে দেখা যায় যে তখন‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র দ্বিতীয় সর্গ ছাপা হচ্ছে। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা যায়, চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৮৬১ সালের মার্চ–এপ্রিল মাসে। আমাদের অনুমান, বিখ্যাত ধ্রুপদী‘কাব্যকলা’ (L’Art poétique) রচয়িতা বোআলো–র (Nicolas Boileau, ১৬৩৬–১৭১১)কথা স্নরণ করে মধুসুদন এ–উক্তি করেছিলেন।
এ চিঠির আগে রাজনারায়ণ বসুকে ২৪–এ এপ্রিল, ১৮৬০ তারিখে লেখা অন্য একটি পত্রে .[জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৩১৫] মধুসূদন জানান: :
I am that man, though I have no father, I am, besides engaged in…But n’importe as the French say…
‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ প্রকাশের দু–এক দিন পরে ১৮৬১ সালের অগাস্ট মাসে রাজনারায়ণ বসুকে লেখা একখানি তারিখহীন চিঠিতে [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৪৯০] Hindu Patriot পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়–এর মৃত্যুতে মধুসুদন লেখেন:
Harish is dead… I loved and valued that man… Vale as the Latins used to say or au revoir as the French say.
কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে [১–৯–১৮৬০, জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৪৬৭] মধুসূদন জানান:
I am very fond of busy and varied scenes; and as for the French idea of not allowing one set of actors to retire and introduce another, I have no great respect for it, and yet I like to preserve ‘unity of time’ and as far as I can, that of time also.
মধুসূদন রাজনারায়ণ বসুকে তারিখহীন অন্য একটি পত্রে [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৪৭৪]লেখেন:
I had a long talk with Runga Lal…he said, ‘I acknowledge Blank verse to be the noblest measure in the language, but I say that no one but men accustomed to Poetry of England would appreciate it…’ I grinned and said ‘n’importe’.
৬. ‘জীবনচরিত’ ও ‘মধুস্মৃতি’–র (নগেন্দ্রনাথ সোম: মধুস্মৃতি, কলিকাতা,গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স্, ১৯২০, সংক্ষেপে ‘মধুস্মৃতি’ অভিধায় নির্দেশ করা হবে)পরিশিষ্টে সন্নিবিষ্ট একাধিক স্মৃতিমুলক রচনা দ্রষ্টব্য।
উত্তর–পাড়ার রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় লিখেছেন :
ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে :
French which was the vehicle of conversation with his wife and children, he may be said to have completely mastered. To the best of my recollection, he spoke French, far more fluently than English. Molière, Racine, Fénelon, Lamartine, and Victor Hugo were his favourite French authors. (Reminiscences Of Michæl Modhu Sudan Datta by Babu Rashbihari Mukherjee, জীবনচরিত,পৃষ্ঠা ৬৭৪)।
ফরাসি জাতি সম্পর্কে :
The French, whom perhaps he loved more than his own nation, he estimated the most refined dilettante, in the world. The English he called boors.(তদৈব,জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৬৭৫)।
তিনি (মধুসূদন) হোমর, দান্তে, মিলটন, মোলিয়ার, ভিক্টর হ্যুগো, বায়রণ, শেলি,কীটস, টেনিসন — এই সকল কবির স্তুতিবাদক ছিলেন।… মধুসূদন বলিতেন,ফরাসির ন্যায় প্রাঞ্জল, সুমার্জ্জিত, দ্ব্যর্থসম্ভাবনা–পরিশূন্য ভাষা জগতে নাই। ফরাসিদের যেমন তীক্ষ্ণ, সুমার্জ্জিত মস্তিষ্ক, তাহাদের ভাষাও তেমনি স্বচ্ছ।(মাইকেল মধুসূদন দত্ত : রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়, মধুস্মৃতি, পরিশিষ্ট, পৃ. ৪৭৭)।
ফ্রান্সে থাকাকালে মধুসুদনের লেখা চিঠিতেও তাঁর ফরাসি–প্রীতির পরিচয় রয়েছে׀ভের্সাই থেকে বিদ্যাসাগরকে লেখা এক চিঠিতে (৯–৬–১৮৬৪, জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৪০] তিনি লিখেছেন:
You will be pleased to hear that I have been saved the disgrace of a French Jail by a young, beautiful and gracious French lady, whose acquaintance I made in a Railway-carriage and who has ever since taken great interest in us, consoled us in our misfortunes, and assisted us with her purse. She went with me to our Land-lord and spoke to the man as only a French woman can speak and got him to consent to take the security of a friend of mine in London and to let us remain here till the end of the current month.
অন্য একটি চিঠিতে [১৬–১০–১৮৬৪, জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৬৮] ইংল্যান্ডের পরিবর্তে ফ্রান্সে কেন রয়েছেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মধুসুদন বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিথেছেন:
You are, no doubt, anxious to know why I am here in France. I will tell you. London is not half so pleasant a place to live in as this country.
‘মধুস্মৃতি’–র ‘বিবিধ আখ্যায়িকা’’ অধ্যায়ে মধুসুদনের ফরাসি ভাষায় দক্ষতা আর ফরাসি–প্রীতি সম্পর্কে একটি কাহিনি উল্লেখযোগ্য:
বিজ্ঞান–বিষয়ে ইংরাজ জাতি বেশী উন্নতি করিয়াছে, কি ফরাসী জাতি অধিক সমুন্নত, এই বিষয়টি লইয়া সুপ্রসিদ্ধ ফরাসী–ভাষাবিৎ ও সামুদ্রিক বিদ্যাবিশারদ(Phrenologist) ডাক্তার কালীকুমার দাসের সহিত ফরাসী–ভাষায় মধুসূদনের ঘোরতর তর্কযুদ্ধ উপস্থিত হয়। মধুসূদন, জলের ন্যায় অনর্গল ফরাসী–ভাষায় প্রায় তিন ঘণ্টাকাল তাঁহার সহিত তর্কবিতর্ক করেন। দুই মনস্বীর বিদেশীয় ভাষায় বাকযুদ্ধে উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী বিস্মিত ও বিমোহিত হন। বিজ্ঞান–বিষয়ে ফরাসী জাতিই যে সমধিক উন্নত, তর্কে ইহা মধুসূদন প্রতিপন্ন করিয়াছিলেন। (মধুস্মৃতি ,সপ্তদশ অধ্যায়, বিবিধ আখ্যায়িকা, পৃ. ৩৪৫)।
মধুসূদন–দম্পতীর সমাধিক্ষেত্রে স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে শ্রীযুক্ত মনোমোহন ঘোষের বক্তৃতায়ও মধুসুদনের ফরাসি ভাষায় দক্ষতা তথা ইয়োরোপীয় ভাষা ও সাহিত্যে ব্যুত্পত্তি এবং মাতৃভাষা–প্রীতির কথা রয়েছে।
…we have met here… to pay publicly …homage… to the memory of, perhaps, the greatest poetical genius that Bengal has yet produced. And this reminds me vividly a conversation which I had with Mr. Datta about 24 years ago, when I found him in the historical city of Versailles, composing his well known sonnet on Dante, which most of you have read. The sonnet was being composed for the then approaching tercentenary festival in honour of the great Italian poet.
…he remarked, referring to his own attempt in translating his sonnet into the French language, that no man, however great his mastery over a foreign language, should ever attempt to write poetry except in his own mother-tongue….
As a linguist and scholar, he had scarcely an equal among his contemporaries, and there is hardly any individual, even in these days, among his countrymen, who could excel him in his knowledge of the European languages, and in literature both ancient and modern, of European countries. Nevertheless, he had himself made the discovery early in life that he could not succeed, as a poet, unless he expressed himself in his own mother-tongue.
[মধুস্মৃতি, পরিশিষ্ট, পৃ. ৪৮৬]
৭. ছাত্র–অবস্থায় ১৮৪১ সালে মধুসুদন ইংরেজিতে বেশ কিছু সনেট রচনা করেন। তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন ১৮৬০ সালে। সনেটির নাম ‘কবি–মাতৃভাষা।‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের তৃতীয় সর্গ রচনার সময় (১৮৬০) মধুসুদন রাজনারায়ণ বসু–কে একটি চিঠিতে [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৪৭৭] লেখেন:
I want to introduce the sonnet into our language and, some mornings ago, made the following…
এর পর তিনি ‘কবি–মাতৃভাষা’ কবিতাটি উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেন [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৪৭৭]:
What say you to this my good friend! In my humble opinion, if cultivated by men of genious our sonnet in time would rival the Italian.
মধুসুদনের চতুদর্শপদী কবিতাবলীর অন্তর্ভুক্ত ‘বঙ্গভাষা’ [চতুদর্শপদী–কবিতাবলি,কলিকাতা, শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং স্ট্যানহোপ্ যন্ত্রে মুদ্রিত, ১৮৬৬ —এর পর থেকে ‘চ.ক.’ অভিধা দ্বারা নির্দেশ করা হবে, কবিতা ১। ইয়োরোপ থেকে মধুসুদন তাঁর চতুদর্শপদী কবিতাগুলি আর কিছু অসমাপ্ত কবিতা কলকাতায় তাঁর প্রিয় প্রকাশক ঈশ্বরচন্দ্র বসুকে পাঠান,শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং মধুসুদনের ইয়োরোপ থেকে ফেরার(ফেব্রুয়ারি ১৮৬৭) আগেই ১৮৬৬ সালের অগাস্ট মাসে কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে । সনেটটি পূর্ববর্তী ‘কবি–মাতৃভাষা’ কবিতার পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রূপ।পাহাড়তলী’ (৬ষ্ঠ প্রকাশ, বিশেষ কবিতা সংখ্যা, ১৯৭৯) পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে বর্তমান আলোচক কবিতাদুটির রাচনিকতার তুলনামুলক বিশ্লেষণ করেছেন।
৮. চ.ক., কবিতা ৩৪।
৯. চ.ক., কবিতা ৪৩ । আবার চতুর্দশপদী কবিতাবলির শুরুতে ‘উপক্রম’ শীর্ষক দুটি চতুর্দশপদী কবিতা রয়েছে। আমরা চতুর্দশপদী কবিতাবলির প্রথম সংস্করণ (শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং স্ট্যানহোপ যন্ত্রে মুদ্রিত, ১৮৬৬) ব্যবহার করেছি। তার প্রকাশক–দিগের ‘বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক ভূমিকায় বলা হয়েছে ‘ইউরোপ খণ্ড হইতে ইতিপূর্ব্বে কখন বাঙ্গালা কবিতা লিখিত হইয়া মুদ্রিত হইবার নিমিত্ত কলিকাতায় প্রেরিত হয় নাই এই জন্য আমরা কবিবরের ব্ন্ধুদিগের এবং সাধারণের সন্তোষার্থে কবিতাগুলির উপক্রমভাগটী মুদ্রাক্ষরে না ছাপাইয়া যেরূপ লিখিত ছিল অবিকল তদনুরূপ হস্তাক্ষরে ছাপাইলাম।’ হস্তাক্ষরে উপস্থাপিত দ্বিতীয় কবিতাটির নিচে নির্দেশ রয়েছে ‘ফরাসীস দেশস্থ ভরশেলস নগরে। ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে।।’ [চ.ক., উপক্রম]। মনে হয়, উচ্চারণ তথা প্রতিবর্ণীকরণের ক্ষেত্রে মধুসূদন বাংলাভাষীর উচ্চারণ–তন্ত্রের অনুসারী আত্তীকরণ বা দেশীয়করণের (স্থানীয়করণের) পক্ষপাতী ছিলেন। বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষার এই প্রবণতা রয়েছে ― বহুভাষাবিদ্ মধুসুদন তা অবশ্যই লক্ষ্য করেছিলেন। এছাড়া রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়ের স্স্মৃতিকথায় দেখা যায় যে, মধুসুদন ইংরেজি ভাষায় কথা বলার সময় দেশীয় নামের দেশীয় উচ্চারণের বিরোধী ছিলেন [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৬৭৬], হয়তো এই মানসিকতা থেকেই তিনি বাংলায় ফরাসি Versailles-কে ‘ভরসেলস’ও Victor Hugo-কে ‘ভিকতর হ্যূগো’–তে [চ. চ., কবিতা ৮৫] পরিণত করেছেন।
১০. ১৮৬৪–র ২৬–এ অক্টোবর গৌরদাসকে লেখা এক চিঠিতে মধুসুদন জানিয়েছেন যে ফরাসি সভ্রাট ও সভ্রাজ্ঞীকে দেখে তিনি উচ্চ চিৎকারে ‘Vive l’Empéreur ! Vive l’Impératrice!’ বলে অভিবাদন জানিয়েছেন [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৭০]। ৩০–এ অক্টোবর মনোমোহন ঘোষকে লেখা চিঠিতে [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৬৬] মধুসুদন লিখেছেন:
A few days ago I had the honour of saluting and of being saluted in return by the famous Emperor of the French ― a truly greatman. I amused myself by shouting ‘Vive l’Empéreur! Vive Napoléon!’
লুই নাপোলেওঁ সম্পর্কে মধুসুদনের উক্তি তাঁর নাপোলেওঁ বোনাপার্ত সম্পর্কে উচ্ছ্বাস স্মরণ করিয়ে দেয়׀ ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত The Anglo-Saxon and the Hindu শীর্ষক ইংরেজি রচনায় মধুসুদন লিখেছিলেন:
Empires and kingdoms, such as would have gratified the boundless ambition of that earthborn Titan ― Napoleon the Grand;… see the grandest of warriors, the loftiest of mortals, the most glorious, the most awful, the most mystical, the most inconceivably sublime Brim of hero-worshippers ― the son of the Corsican Attorney ― surrounded by his eagles with their terrific beaks dried the blood torrents which flowed at Austerlitz, at Jena, at Wigram, at Friedland, at Borodino and then pining away in the solitude of St. Helena ― his island-prison in the midst of the vast Atlantic…[রচনাবলী, হরফ, ইংরেজি অংশ, পৃষ্ঠা ২৪৭–২৪৮]
১১ চিঠির [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৪২] উদ্ধৃত অংশটির পরের বাক্যগুলি হল:
I have also commenced Italian and mean to add German to my stock of languages, ― if not Spanish and Portuguese before I leave Europe.
এছাড়া মধুসুদনের আরো কিছু চিঠিতে তাঁর ফরাসি ও অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষা শিক্ষার প্রসঙ্গ রয়েছে׀ যেমন:
I hope to be a capital sort of European scholar before I leave Europe, I am getting on well with French and Italian. I must commence German soon. Spanish and Portuguese will not be difficult after Latin, French and Italian.[বিদ্যাসাগরকে লেখা, ১১ই জুলাই, ১৮৬৪,জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৫২–৫৫৩]
I have greater facilities for mastering French and Italian than there.To these two languages which I already read and write with great ease, I am going (in fact I have already begun) to add German. [গৌরদাস বসাককে লেখা, ২৬–এ অক্টোবর, ১৮৬৪,জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৬৯]
You must not fancy, my good friend, that I am idling here. I have nearly mastered French and Italian and am going on with German, all without any assistance from hired teachers. [বিদ্যাসাগরকে লেখা, ৩রা নভেম্বর,১৮৬৪,জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৫৫]৷
…I have had strength of mind and resolution to make the very best use of my misfortune in learning the three great continental languages, viz, Italian, German and French languages, which are well worth knowing for their literary worth. You know, my Gour, that the knowledge of great European language is like the acquisition of a vast and well cultivated state ― intellectual o#f course.[গৌরদাস বসাককে লেখা, ২৬–এ জানুয়ারি, ১৮৬৪,জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৭৪]
১২. মধুসুদনের ফরাসি কবিতার কোনো দৃষ্টান্ত তাঁর জীবনীকাররা দেন নি। অন্য কেউ দিয়েছেন বলেও আমাদের জানা নেই। তাছাড়া আবেগ–প্রবণ মধুসুদন তাঁর সব খবরই চিঠিতে কলকাতার বন্ধুদের জানাতেন, অথচ তাঁর ফরাসিতে কবিতা লেখার কথা কোনো চিঠিতেই তিনি উল্লেখ করেন নি। তাঁর ফরাসি–রচনার একমাত্র নির্দশন দান্তের উদ্দেশে রচিত সনেটটির ফরাসি গদ্য–অনুবাদ। এছাড়া যোগীন্দ্রনাথ বসুর ‘মাইকেল মধুসুদন দত্তের জীবন– চ রিত’ থেকে জানা যায় যে, ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে মনোমোহন ঘোষকে লেখা মধুসুদনের পত্রের কয়েকটি ছিল ফরাসিতে [জীবনচরিত,পৃষ্ঠা ৫৬৩]। ‘মধুস্মৃতির’ রচয়িতাও মধুসূদনের লেখা ফরাসি চিঠির মনোমোহন ঘোষ কৃত ইংরেজি অনুবাদ উপস্থাপিত করেছেন (মধুস্মৃতি, পৃষ্ঠা ৩৬০)
১৩. চ.চ., কবিতা ৮২।
১৪. সূত্র ‘প্রতিলিপি’ মধুসূদন রচনাবলী , কলকাতা, সাহিত্য সংসদ।
১৫. চ.চ., কবিতা ৮৫।
১৬. ভিক্তর য়ূগোর প্রতি এই শ্রদ্ধা নিবেদন প্রসঙ্গে অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার মজুমদার তাঁর ‘বাংলা কাব্যে পাশ্চাত্য প্রভাব’ নামক গবেষণা–মুলক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: ‘মাইকেল যখন ফ্রান্সে, তখন য়ুগো–পরবর্তী লেখকদের প্রাধান্য, কিন্তু তাঁদের উল্লেখ মাইকেলে নেই।’ আবার ফরাসি–সাহিত্য, বিশেষ করে বোদলের-এর অনুরাগী এই সমালোচক লিখেছেন: ‘বিশেষ করে বোদল্যেরের কথা মনে হয়। তাঁর Les Fleurs du Mal ১৮৫৭ খ্রীষ্টান্দে প্রকাশিত হয়েছে, সারা ফ্রান্সে যে বই নিয়ে হৈ চৈ, এবং ঐ বছরইLes Fleurs du Mal–এর ছটি কবিতাকে অশ্লীল বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি মধুসুদন ভের্সাঈ–তে গেছেন। বোদল্যের প্যারিস থেকে বেলজিআমে গেছেন বক্তৃতা সফরে। কিন্তু মধুসুদনের মনে এবং চিঠিপত্রে তার কোন স্পর্শ নেই।’ এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, মধুসুদন যখন ফ্রান্সে তখন য়ূগো রাজনৈতিক কারণে ফ্রান্সের বাইরে স্বেচ্ছানির্বাসনে (১৮৫১–৭০)। তবুও ঐ সময়ে তিনি অবিসংবাদীভাবে ফরাসি সাহিত্য–সম্রাট। নির্বাসনে থাকলেও তাঁর রচনা ফরাসি দেশে নিয়মিত প্রকাশিত, আলোচিত ও বিপুলভাবে পঠিত। ১৮৫৩ সালে তাঁর ‘শাস্তি’ (Les Châtiments), ১৮৫৬–তে ‘অনুধ্যান’ (Les Contemplations) আর ১৮৬৭–তে ‘ইতিকথা’(La Légende) কাব্যের প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে; ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাস‘হতভাগ্যেরা’ (Les Misérables)। মধুসূদনের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই এই সাহিত্য–সম্রাটের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ইংরেজি রোমান্টিক কবিটার সঙ্গে মধুসূদনের আকৈশোর পরিচয় ছিল, তাঁর কাছে রোমান্টিক য়ূগোর আবেদন তাই স্বাভাবিক। আমরা জানি,বোদলেরের কবিতা রোমন্টিক রবীন্দ্রনাথেরও ভালো লাগে নি, মধুসুদনের কাছে তা আকর্ষণীয় হতে পারে এটা ভাবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাছাড়া বোদলের তখনো নতুন কবিতার স্বল্পসংখ্যক অনুরাগীদের কাছেই পরিচিত। তাই ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ সম্পর্কে সারা ফ্রান্সে ‘যে বই নিয়ে হৈ–চৈ’ অনুরাগের আবেগ–প্রসূত অতিশয়োক্তি।উপরন্তু বোদলেরের মৃত্যুর (১৮৬৭) আগে উক্ত বইটির দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল׀ ১৮৫৭ সালে প্রথম সংস্করণে ছাপা হয়েছিল ১৩০০ কপি (সঙ্গে ভালো কাগজে আরো ২০ কপি), ১৮৬১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণে ছাপা হয়েছিল ১৫০০ কপি (এর সঙ্গে ভালো কাগজে আরো সামান্য কিছু কপি)। এই সংখ্যা থেকে বোদলেরের পরিচিতির সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করা যায়। তুলনায় ভিক্তর য়ূগোর খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা তখন যে কী সুবিপুল তা হয়তো আরেকটি ব্যাপার থেকে অনুমান করা যায়। ১৮৫৭ সালে বোদলের এবং ফ্লোবের যথাক্রমে ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ ও ‘মাদাম বোভারি’–র জন্য প্রকাশকের সঙ্গে যথাক্রমে ২৫০ এবং ৪০০ ফ্রঁ প্রাপ্যের চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ১৮৬১ সালে বোদলের তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য ৩০০ ফ্রঁ প্রাপ্যের চুক্তি করেন। সেখানে ১৮৬১ সালে ‘লে মিজেরাবল্’ উপন্যাসের জন্য য়ূগো প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন এবং তদনুযায়ী সে যুগেও পান তিনলক্ষ ফ্রঁ, আর প্রকাশক সমস্ত খরচখরচা বাদ দিয়ে লাভ করেছিলেন পাঁচ লক্ষ সতের হাজার ফ্রঁ।
যাই হোক, কোনো দিক থেকেই বিদেশি মধুসুদনের পক্ষে এই সময়ে বোদলের সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় কোনো কারণ ছিল না। তুলনামূলক ভাবে বলা যায় যে তিরিশের দশকের শেষে কোনো বিদেশি কবি যদি বাংলাদেশে আসতেন, বাংলাও শিখতেন, তবে কি তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আগ্রহী এবং উচ্ছুসিত হওয়টাই স্বাভাবিক হত না? আর ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৩), ‘অপরাজিত’ (১৯৩২), ‘আরণ্যক’(১৯৩৮), ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০), ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬) বেরিয়ে যাওয়ার পরও কি বিভুতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু বা জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে ঐ বিদেশির অনবহিত থাকাটা নিতান্ত অস্বাভাবিক হত ?
১৭. ফ্রান্স থেকে গৌরদাস বসাককে লেখা একটি চিঠিতে [২৬–এ জানুয়ারি, ১৮৬৫,জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৭৫] মধুসূদন জানান:
I have been lately reading Petrarca ― the Italian Poet, and scribling some ‘sonnets’ after his manner…I dare say the sonnet ‘চতুর্দ্দশপদী’ will do wonderfully well in our language.
এছাড়া তাঁর ‘চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী’–র ‘উপক্রম’ শীর্ষক দুটি চতুর্দশপদী কবিতার দ্বিতীয়টিতে মধুসূদন ‘ভারতে ভারতী–পদে’ চতুর্দ্দশপদী কবিতা–রূপ ‘রতন’ অর্পণ করতে গিয়ে ‘বাকদেবীর বরে বড়ই যশস্বী সাধু, কবি–কুল–ধন’ ‘ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরার্কা কবিকে’ শ্রদ্ধাপূর্বক স্মরণ করছেন। [চ.চ., উপক্রম ২]।
১৮.চ.চ., কবিতা ৩২ ।
১৯. Joachim du Bellay: Les Regrets et autres œuvres poetiques, Paris, Frederic Morel, 1558, পৃষ্ঠা ৩ ।
২০. তদৈব, পৃষ্ঠা ৮ । সনেটটির তরু দত্ত কৃত ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে তাঁর A Sheaf Gleaned in French Fields (3rd edition, London, C. Kegan Paul & Co.1880, পৃষ্ঠা ১) গ্রন্থে।
২১. টীকা ৬ দ্রষ্টব্য।
২২. আমাদের অনুমান, ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ইতালীয় নবজাগরণের সঙ্গে পরিচিত বাঙালি বন্ধুদের কাছে মধুসূদন তাঁর চিঠিতে ইতালীয় কবি পেত্রার্কা–র (Francesco Petrarca, ১৩০৪–১৩৭৫) নাম করলেও ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়হীন বন্ধুদের কাছে কোনো ফরাসি সাহিত্যস্রষ্টার নাম করা অর্থহীন বলে বোধ করেছেন। তাই গৌরদাস বসাককে লেখা একটা চিঠিতে ‘ফরাসি বিষয়ের অনুকরণের’ (imitating a few…French things) কথা বললেও [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৭১] বা ভিক্তর য়ূগোর উদ্দেশে একটি চতুর্দশপদী কবিতা [চ.চ. কবিতা ৮৩] রচনা করলেও মধুসূদন অন্য কোথাও ফরাসি সাহিত্যকারদের নাম করার সে অর্থে কোনো প্রয়োজনবোধ করেন নি, ‘ফরাসি বিষয়ের অনুকরণ’ প্রসঙ্গেও কী বিযয়ের বা কার অনুকরণের কথা তিনি উল্লেখ করেন নি।
২৩. মধুসূদন গ্রন্থাবলী, সম্পাদক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস,কলকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য–পরিষৎ, [এর পর থেকে ম.গ্র.বলে নির্দেশ করা হবে], বিবিধ কাব্য, চতুর্থ সংস্করণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ১০।
২৪. ১৯২২ সালে সেযুগের খ্যাতনামা মধুসূদন–বিশেষজ্ঞ দীননাথ সান্যাল তাঁর সম্পাদিত ও ব্যাখ্যাত ‘চতুদর্শপদী কবিতাবলি‘র ভূমিকায় মন্তব্য করেছিলেন:
পরিশিষ্ঠে যে কয়েকটি নীতিগর্ভ কবিতা সন্নিবেশিত হইল, তাহাদের মধ্যে ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা‘ ও ‘ময়ূর ও গৌরী‘ এই দুইটি ফ্রান্সে প্রবাস–কালে এবং অন্যগুলি জীবনের শেষভাগে রচিত। ফ্রান্সে থাকিতে, বোধ হয়, ফ্রান্স–দেশীয় কবি Jean La Fontaine–এর কবিতার অনুকরণে মধুসুদন সেইরূপ ভাঙ্গা মিত্রাক্ষর ছন্দে…নীতি–গর্ভ কবিতা রচনা করিতে প্রবৃত্ত হয়েন।
কিন্তু মধুসূদনের দেশে ফেরার আগেই ১৮৬৬ সালে কলকাতায় তাঁর পাঠানো কবিতার সংকলন ‘চতুদর্শপদী–কবিতাবলি‘ নামে প্রকাশিত হয়। এই সংকলনের ভূমিকা হিসেবে উপস্থাপিত ‘প্রকাশক–দিগের নিবেদনে‘ জানানো হয়:
মাইকেল মধুসূদন ইংলণ্ডে দেড় বত্সর থাকিয়া ১৮৬৩ সালের অক্টোবর মাসে ফ্রান্স রাজ্যে গমন করেন এবং ভরসেলস নামক তথাকার সুপ্রসিদ্ধ নগরে দুই বত্সর কাল অবস্থিতি করেন। তিনি এই সময়ে ‘চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি‘ নাম দিয়া একশতটি কবিতা ছাপাইবার জন্য আমাদিগের নিকট পাঠাইয়া দেন।… ইউরোপ খণ্ড হইতে ইতিপূর্ব্বে আর কখন বাঙ্গালা কবিতা লিখিত হইয়া মুদ্রিত হইবার নিমিত্ত কলিকাতায় প্রেরিত হয় নাই… আমরা সুভদ্রাহরণ,তিলোত্তমা, ও হিতোপদেশের যে যে অংশ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম তাহা অসমাপ্ত কাব্যাবলি শিরোনাম দিয়া চতুর্দ্দশপদীর শেষ ভাগে সংযোজিত করিয়া দিলাম।
এই ‘অসমাপ্ত কাব্যাবলি‘ অংশে দীননাথ সান্যাল ফ্রান্সে লেখা বলে যে দুটি নীতিগর্ভ কবিতার উল্লেখ করেছেন তা বাদ দিয়ে তৃতীয় একটি নীতিগর্ভ কবিতা রয়েছে ‘কাক ও শৃগালী‘ । এই কবিতাগুলিকে পূর্বোক্ত ‘প্রকাশক–দিগের নিবেদনে‘ ‘হিতোপদেশের যে যে অংশ‘ বলে নির্দেশ করা হয়েছে। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা যায়, মধুসূদন ফ্রান্সে থাকার সময় দুটি নয় অন্তত তিনটি নীতিগর্ভ কবিতা লিখেছিলেন। এছাড়া অন্যদিক থেকে যা উল্লেখযোগ্য তা হল দীননাথ সান্যাল নীতিগর্ভ কবিতার সঙ্গে লা ফোঁতেন–এর রচনার আন্তঃরাচনিক সম্পর্কের উল্লেখ করেছেন।
চতুদর্শপদী কবিতাবলি, দীননাথ সান্যাল কর্ত্তৃক ব্যাখ্যাত ও সম্পাদিত, কলকাতা, এম.সি. সান্যাল এণ্ড কোং, ১৯২২, পৃ.৭।
চতুদর্শপদী কবিতাবলি, শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং স্ট্যানহোপ্ যন্ত্রে মুদ্রিত, ১৮৬৬,পৃষ্ঠা ৷৷৵৹ ,১১৪–১২২।
২৫. এই উৎসর্গপত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষিত রাজা চতুর্দশ লুইয়ের ছ বছরের পুত্র‘রাজকুমার মহোদয়ের উদ্দেশে’ (à Monseigneur le Dauphin)। আমরা যে সম্পূর্ণ সংস্করণটি ব্যবহার করেছি তা হল Fables de La Fontaine, Garnier Frères, Paris, 1855(এর পর থেকে সংক্ষেপে ‘ Fables’ অভিধা ব্যবহার করা হবে)।
ইশপ–এর নীতিকথার ছন্দোবদ্ধ অনুরচনায় লা ফোঁতেনের উল্লেখযোগ্য পূর্বসূরী হলেন ল্যাটিনে ফেদ্রুস (Phædrus, আনু. সা.-পূ. ১৫– আনু. ৫০ সা. অ), আভিয়ানুস (Flavius Avianus, সাধারণ অব্দের চতুর্থ শতকের শেষ থেকে পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধ). গ্রিকে বাব্রিয়াস/বাব্রিয়স (Βαβρίας/Βάβριος, সাধারণ অব্দের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতক),ফরাসিতে মারি দ ফ্রঁস (Marie de France, সাধারণ অব্দের দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ)।
২৬. Fables পৃষ্ঠা ২৪৬।
২৭. দ্বিতীয় খণ্ড, নবম পুস্তক, নীতিকথা ৭, মেয়ের রূপ পাওয়া ইঁদুর (Livres IX, Fables VII, La Souris métamorphosée en fillle), Fables পৃষ্ঠা ৪১৪; দ্বিতীয় খণ্ড,দ্বাদশ পুস্তক, নীতিকথা ১২, রাজা, চিল আর শিকারি (Livres XII, Fables XII, Le Milan, le Roi et le chasseur), Fables পৃষ্ঠা ৫৫৪; দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বাদশ পুস্তক, নীতিকথা ১৫, কাক, হরিণ, কচ্ছপ আর ইঁদুর (Livres XII, Fables XV, Le Corbeau, la Gazelle, la tortue et le Rat), Fables পৃষ্ঠা ৫৫৪।
২৮. Jean Biès: Littérature française et pensée hindoue, Paris, Librairie C. Klincksieck, 1974, পৃষ্ঠা ৪১–৪২।
২৯. জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৭১। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস–বিদ্ অধ্যাপক ভুদেব চৌধুরী ‘দেশ’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় (২০–এ জুন ১৯৭০) ‘রবীন্দ্রনাথের ফরাসী–চর্চা’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন:
‘…বহুভাষাবিদ্ কবি মধুসুদনের কবিতা সম্পর্কেও হোমর, ভার্জিল, দান্তে, ভালো, মিল্টন, পিত্রার্কার কথাই শোনা যায় প্রতীচ্য–প্রভাবকদের তালিকায়; কিন্তু ফরাসী কোন কবির প্রসঙ্গ তাতে অনুপস্থিত। ফরাসী দেশে বাসকালে মধুসুদন খোদ ফরাসীতেই কবিতা লিথেছিলেন;অথচ তাঁর বাংলা কবিতায় তার কোন প্রভাব নেই।’
― জানি না এই মন্তব্য করার সময় অধ্যাপক চৌধুরী মধুসুদনের নীতিকবিতাগুলির কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন কিনা।
৩০. ম.গ্র., বিবিধ কাব্য, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ১৫–৩৭।
৩১. ম.গ্র., হেকটর বধ, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ৷৷৴৹।
৩২. বস্তুত ‘একটি ভাষায় যা বলা হয়েছে অন্য একটি ভাষায় ‘মোটামুটি তা বলে দেওয়া’ ― এটাই হল সাধারণভাবে অনুবাদ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা। ইতালীয় সংকেতবিজ্ঞানী উম্বের্তো একো (Umberto Eco) তাঁর অনুবাদ সম্পর্কে ‘প্রায় একই কথা বলা,’ (Dire quasi la stessa cosa , Milano, Biompani, 2003; ফরাসি অনুবাদ Dire presque la même chose, tr. Myriem Bouzaher, Paris, Bernard Grasset, 2006) গ্রন্থের ভূমিকায় এই ধারণার পরীক্ষা করতে গিয়ে বলেছেন যে তবে প্রথমেই ‘প্রায় একই কথা বলা’ বলতে কী বোঝায় তা বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে, আর শেষ পর্যন্ত ‘কথাটাই’ বা কী কিংবা কখনো কখনো ‘বলা’ বলতেও বা কী বোঝায় তা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়।
৩৩. উনিশ শতকের শেষ থেকে ফরাসি সাহিত্যে ‘মুক্ত ছন্দ’ (vers libre) বলতে বোঝায় অক্ষরের সংখ্যা, পর্বের নিয়মিত সংগঠন, মিলবিন্যাস বা স্তবকের প্রথাগত বিধান না মেনে শ্রুতিনির্ভর ছন্দোস্পন্দনের ভিত্তিতে পর্ববিন্যস্ত কবিতার ছন্দ। ‘মুক্ত ছন্দ’ সমিল,মিলাভাসযুক্ত বা মিলহীন হতে পারে। আধুনিক এই ‘মুক্ত ছন্দের’ পাশাপাশি ছন্দের নিয়ম মানা অসম অক্ষর–বিন্যাসের মিত্রাক্ষর চরণের লা ফোঁতেন ব্যবহৃত ‘মুক্ত ছন্দকে’ ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ (vers libre classique) বা বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য ‘মিশ্র ছন্দ’ (vers mêlés) বলা হয়।
পুরনো ফরাসি ছন্দ–শাস্ত্রে ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দের সংজ্ঞার্থ হল: On appelle vers libres ceux qui n’ont aucune uniformité ni pour le nombre des syllabes ni pour le mélange des rimes… On met ordinairement en vers libres les sujets qui ne demandent qu’un style simple et familier, comme les fables, les contes, et même quelquefois les comédies… [যে পদ্যবন্ধে অক্ষরের সংখ্যা বা মিলের মিশ্রণের কোনো সমতা থাকে না সেই পদ্যবন্ধকে মুক্ত ছন্দ বলা হয়। যেসব বিষয় শুধুমাত্র সহজ আর ঘরোয়া প্রকাশ–প্রকরণের দাবি করে তাতে মুক্ত ছন্দ ব্যবহার করা হয় যেমন নীতিকথা,কাহিনি, এমন কী কখনো কখনো কমেডি…] (Pierre Restaut : Abrégé des règles de la versification française, 1732; আল্যাঁ ফ্রোঁতিয়ে–র ‘কবিতা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত Alain Frontier : La Poésie, Paris, 1992. পৃষ্ঠা ১৯১)। মোরিস গ্রামোঁ–র (Maurice Grammont, ১৮৬৬–১৯৪৬ ) মতে, Pour nous… c’est La Fontaine qui a fait l’usage le plus habile du vers libre [আমাদের মতে…লা ফোঁতেনই সবচেয়ে নিপুণভাবে মুক্ত ছন্দের ব্যবহার করেছেন]. (M. Grammont : Le vers français. Ses moyens d’expression, son harmonie, Paris, 1923, পৃষ্ঠা ১০৭).।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, বাংলায় ছন্দ সম্পর্কিত আলোচনায় ‘মুক্ত ছন্দের’ ধারণাটা খুবই গোলমেলে। Free verse, vers libre, ‘মুক্তছন্দ’ গৈরিশ ছন্দ, ‘মুক্তক’ ‘অতিমুক্তক’ ‘মুক্তবন্ধ’, ‘স্বৈরবন্ধ’, ‘মুক্তবৃত্ত’, ‘স্বৈরবৃত্ত’ ‘গদ্যছন্দ’, ‘গদ্যিকা’ ইত্যাদি সংজ্ঞা এবং তার অস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও মতভেদের অরণ্য ভেদ করে মুক্তছন্দ কী সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট উপপত্তিতে পৌঁছানো অসম্ভব। আসলে অক্ষর–স্বরাঘাত ভিত্তিক (syllabotonic) ইংরেজি ভাযার ছন্দ–বিশ্লেষণের ছাঁচকে অক্ষর ভিত্তিক (syllabic) বাংলা ভাষার ছন্দের বিচারে আরোপ করতে গিয়েই তাবৎ বিপত্তির, তাবৎ অস্পষ্টতার সৃষ্টি। ছন্দতাত্ত্বিক অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁহার কাব্যজীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছিয়া যথার্থ free verse বা মুক্ত ছন্দের কবিতা লিখিয়াছেন, বলা যাইতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আমরা তাঁহার শেষ রচনা ― ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ কবিতাটি উল্লেখ করিতে পারে (বাংলা ছন্দের মূলসূত্র, কলকাতা,পঞ্চম সংস্করণ, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ১৮২); ‘পদ্যের পর্ব্ব লইয়া গদ্যের মত স্বেচ্ছায় গ্রথিত করা যাইতে পারে। ইহাই যথার্থ free verse বা মুক্ত ছন্দ। গিরিশ ঘোষ ইহার পথ প্রদর্শন করিয়াছিলেন, পরে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন…(ঐ, পৃষ্ঠা ২৪২)। তারাপদ ভট্টাচার্যের মতে, ‘মাত্রাবৃত্তে প্রথম মুক্তক দেখা যায় চর্যাপদে। অক্ষরবৃত্তে মুক্তক প্রবর্তনের গৌরব মাইকেলের প্রাপ্য׀ ছাত্র–পাঠ্য ‘নীতিগর্ভ কবিতাবলী’তে মাইকেলই প্রথম সমিল অক্ষরবৃত্তকে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের চরণ বন্ধন হইতে মুক্তি দিয়াছেন;ইহাতে কোন নিদিষ্ট প্যাটার্নের স্তবক বন্ধন নাই।’ (তারাপদ ভট্টাচার্য : ছন্দ–তত্ত্ব ও ছন্দোবিবর্তন, কলকাতা, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৪০৯); ‘গৈরিশ ছন্দ অক্ষরবৃত্ত ‘মুক্তক’ গোত্রীয়,কিন্তু প্রকৃত মুক্তক নহে। মধুসূদনের নীতিগর্ভ কবিতাবলী ও রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যের প্রধান ছন্দকেই যথার্থ মুক্তক বলিতে পারা যায়’ (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৫০); ‘গদ্যিকা অর্থাৎ গদ্যকবিতার রচনারীতি যদিও ছন্দেবর্জিত তথাপি চরণবদ্ধতা–জাত পদ্যাভাস ইহাতে আছে; এই কারণে কোন কোন ছন্দোমুগ্ধ ব্যক্তি প্রচার করিয়াছেন,গদ্যকবিতায় গুপ্তছন্দ বা ভাবছন্দ বর্তমান।’ (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৫৭);। প্রবোধচন্দ্র সেনের মতে, ‘পয়ারের এই পঙক্তিসীমার বন্ধনটুকু কবিদের হাতে ছিন্ন হল। তার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় মধুসুদনেরই ‘গদা ও সদা’, ‘সিংহ ও মশক’ প্রভৃতি কোনো–কোনো খণ্ডকবিতায়। আর পাওয়া যায় গিরিশচন্দ্র ও রাজকৃষ্ণের নাট্যরচনায় এবং রবীন্দ্রনাথার বহু কবিতায়। যতি ও পঙক্তিসীমার বন্ধনহীন এই যে মুক্ততর পয়ার, তাকেই বলি মুক্তক পয়ার।’ (নূতন ছন্দ–পরিক্রমা,কলকাতা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৮১); ‘গদ্যকবিতায় ছন্দ থাকে না, কিন্তু ছন্দের ভঙ্গিটুকু থাকে׀ গদ্যকবিতার এই যে ধ্বনিভঙ্গি বা স্পন্দনলীলা,তাকেই বলা হয়েছে ‘গদ্যছন্দ’।’ (ঐ, পৃষ্ঠা ১৮৯); ‘পদ্যের রঙ–লাগা গদ্যই হচ্ছে গদ্যকবিতার বাহন।’ (ঐ, পৃষ্ঠা ১৯০)।
আমদের মতে, মধুসূদন প্রবর্তিত (এবং রাজকৃষ্ণ রায়, গিরিশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ অনুসৃত) মুক্তক বা মুক্তক পয়ার হল ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ বা ‘মিশ্র পর্বের অক্ষরবৃত্ত(মিশ্রবৃত্ত) ছন্দ’। আর শ্রুতি–নির্ভর ছন্দস্পন্দনের ভিত্তিতে পর্ববিন্যস্ত তথাকথিত গদ্যকবিতার (দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘শিশুতীর্থ’, ‘আমি’; অমিয় চক্রবর্তীর মিল বা/এবং মিলাভাসযুক্ত ‘বড়োবাবুর কাছে নিবেদন’, ‘সাবেকি’,জীবনানন্দের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতা) ছন্দ মুক্তছন্দ। অবশেযে পর্ববিন্যাসহীন গদ্যে লেখা কবিতা (যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’, অরুণ মিত্রের ‘অমরতার কথা’)হল যথার্থ গদ্যকবিতা।
৩৪. Œuvres de J. de La Fontaine, t. I, Paris, Alphonse Lemerre, 1875, পৃষ্ঠা ৩।
৩৫. আমরা যাকে ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ বা ‘মিশ্র পর্বের অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’ বলে অভিহিত করছি তার প্রথম আড়ষ্ট প্রয়াস দেখা যায় মধুসূদনের ‘পদ্মাবতী নাটকে’ কলির স্বগতোক্তিতে:
ঐ শুন ― ৪
বীর দর্পে তা সবার সঙ্গে যুজে এবে ৮│৬ ১৪
ইন্দ্রনীল। ৪
এই অবসরে যদি আমি ১০
রাণী পদ্মাবতীরে লইতে পারি হরি― (৭│৭ বা ৪│১০) ১৪
………….
আসিয়াছি হেথা আমি ৮
কি আশ্চর্য! ৪
অহো ― ২
এ রাজকুলের লক্ষ্মী মহাতেজস্বিনী! (৮│৬) ১৪
………….
এ কি! ২
ওই না যে পদ্মাবতী? আইলো কামিনি ― (৮│৬) ১৪
― চতুর্থাঙ্ক:প্রথম গর্ভাঙ্ক
নাটকের সংলাপে ব্যবহৃত এই ছন্দ মিলহীন ও প্রবহমান। ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ বা ‘মিশ্র পর্বের অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’ নির্মাণের এই প্রয়াসের পরিণত রূপ মধুসূদনের নীতিকবিতার ছন্দ। আর এই পরিণতিতে লা ফোঁতেন হয়ে উঠেছেন তাঁর আদর্শ।
৩৬. ম.গ্র., বিবিধ কাব্য, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ১৫।
৩৭. ম.গ্র., বিবিধ কাব্য, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ৩৬।
৩৮. ভের্সাই থেকে গৌরদাসকে লেখা যে চিঠিতে মধুসুদন ‘ইতালীয় ও ফরাসি কিছু বিষয়ের’ অনুকরণের সংবাদ দিয়েছেন তাতেই [জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৭১–৫৭২] তিনি লিখছেন: ‘The fit has passed away and I do not know if it will ever come back again. You know I write by fits and starts.’ মধুসুদনের সেই ‘fit’আর ফিরে আসেনি׀
৩৯ . Fables, livre I, fable XX, p.45। লা ফোঁতেনের এই নীতিকবিতাটির উত্স মনে হয় ইশপ–এর নীতিকাহিনির অবলম্বনে ল্যাটিন পদ্যে ফেদ্রুস–এর অনুরচনা ‘মোরগ ও মুক্তা’ (Pullus ad Margaritam)। ল্যাটিন, ফরাসি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় ‘মোরগ ও মুক্তা’, ‘মোরগ ও মণি’, ‘মোরগ ও হিরে’ ইত্যাদি শিরোনামে ইশপ–এর অনুরচনা হিসেবে এই নীতিকাহিনিটি পাওয়া গেলেও গ্রিকে মূল কাহিনিটি অপ্রাপ্য। লা ফোঁতেনের নীতিকবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকের কাহিনি মনে হয় নীতি নির্দেশ করার জন্য লা ফোঁতেনের নিজস্ব সংযোজন। কৌতুহলী পাঠকের জন্য আমরা লা ফোঁতেনের নীতিকবিতাটির অন্য এক বাঙালি কবির ইংরেজি অনুবাদ উপস্থিত করছি:
THE COCK AND THE PEARL.
Once a cock did run away
With a pearl, which he did lay
With the greatest jeweller ;
‘I do think it fine,’ said he ;
‘But the smallest corn would be
Just the thing I would prefer.’
Once a man unletter’d got
Book handwritten, which he brought
To his next-door bookseller;
‘I do think it good,’ said he;
‘But the smallest coin would be
Just the thing I would prefer.’
September, 1908.
― Roby Dutt: Echoes from East and West
Cambridge, 1909.পৃষ্ঠা ২৭০
৪০. ম.গ্র., বিবিধ কাব্য, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ২৯।।
৪১. টীকা ৩৯ দ্রষ্টব্য।
৪২. Fables, livre I, fable XXII, p.48। লা ফোঁতেনের ‘ওক ও নলখাগড়া’ (Le Chêne et le Roseau) নীতিকবিতাটির সূত্র ইশপ। ইশপ–এর নীতিকাহিনিটির ঔপরাচনিক শিরোনাম বিভিন্ন সংকলনে ‘নলখাগড়া ও অলিভ গাছ’ (Κάλαμος καί ’Ελαία),‘নলখাগড়াগুলি ও ওক’ (Κάλαμοι καί Δρύς), ‘দেবদারু ও কাঁটাঝোপ’ (’Ελάτη καίΒάτος), আর বাব্রিয়াস/বাব্রিয়স–এর (Βαβρίας/Βάβριος) নীতিকাহিনির সংকলনে এই কাহিনি ‘বিচগাছ ও নলখাগড়া’ (Φηγός καί Κάλαμος), বা ‘দেবদারু ও কাঁটাঝোপ’(’Ελάτη και Βάτος) নামে চিহ্নিত।
৪৩. ফরাসিতে যে ছোট গায়ক পাখির নাম রোয়াৎলে/roitelet (চড়≈ইয়ের চেয়ে ছোট চড়াই জাতীয় পাখি/Oiseau passereau plus petit que le moineau.― Le Petit Robert)। একে ইংরেজিতে বলা হয় রেন/wren।
৪৪. ম.গ্র., বিবিধ কাব্য, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ১৮।
৪৫. Fables, livre I, fable II, p.7। লা ফোঁতেনের এই নীতিকবিতাটির উত্স ইশপ–এর নীতিকথা ‘কাক ও শেয়াল’ (Κόραξ και ’Αλώπηξ)।
৪৬. ম.গ্র., বিবিধ কাব্য, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ২০।
৪৭. ম.গ্র., বিবিধ কাব্য, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬, পৃষ্ঠা ১৭।
৪৮. কবিতার অনুবাদ ও আরো দুটি প্রবন্ধ, কলকাতা, রক্তকরবী, ১৯৯৮।
৪৯, জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৫৭৪–৫৭৫।
পরিভাষা
এই নিবন্ধে বেশ কিছু বাংলা পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।ইয়োরোপীয় পারিভাষিক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দের অনেকগুলিই আমাদের নির্বাচন। এছড়া কিছু বাংলা পারিভাষিক শব্দ রয়েছে যেগুলি আমাদের নিজস্ব ধারণা প্রকাশের প্রয়োজনে সৃষ্ট, এই শব্দগুলির সম্ভাব্য ইংরেজি (ইয়োরোপীয়) প্রতিশব্দ আমরা প্রস্তাব করেছি।আমাদের উদ্ভাবিত বাংলা পারিভাষিক শব্দও তার প্রস্তাবিত ইংরেজি প্রতিশব্দ হল: প্ররচনা (প্রকৃষ্ট রচনা বা মূল রচনা) primotext, প্রলিখন(প্রকৃষ্ট বা মূল রচনার লিখন) primowriting, অনুরচনা(অনুকরণ,অবলম্বন বা/এবং অনুবাদ দ্বারা সৃষ্ট শব্দ) mimotext,অনুলিখন (অনুরচনার লিখন) mimowriting, অন্তিক(সাংস্কৃতিক/ভাষিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারে আপেক্ষিক ভাবে পরস্পরের নিকটস্থ) proximal, দূরান্তিক (সাংস্কৃতিক/ভাষিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারে আপেক্ষিক ভাবে দূরবর্তী) distal।
অক্ষর syllable
অক্ষর ভিত্তিক syllabic
অক্ষর–স্বরাঘাত ভিত্তিক syllabotonic
অতিসাংস্কৃতিক transcultural
অন্তিক proximal
অনুরচনা mimotext
অনুরাচনিক mimotextual
অনুলিখন mimowriting
অবলম্বন adaptation
আত্তীকরণ assimilation
আন্তঃরাচনিক intertextual
আন্তঃরাচনিকতা intertextuelality
আন্তঃসাংস্কৃতিক intercultural
আন্তঃসাংস্কৃতিকতা interculturalality
আন্তর্ভাষিক Interlingual
আন্তর্সাহিত্যিক Interliterary
আলোকায়ন focalisation
উপরচনা paratext
ঔপরাচনিক paratextual
কাহিনি–কথন narration
কাহিনিরস narrativity
তন্ত্র system
দূরান্তিক distal
পঠন reading
পুঁথি সংস্কৃতি Manuscript culture
প্রত্যাশার দিগ্ববলয়
Erwartungshorizont/
horizon of expectations
প্রবহমানতা enjambement
প্রভাবতত্ত্ব influenceology
প্ররচনা primotext
প্রলিখন primowriting
পরিগ্রহণ reception
পরিগ্রাহক receiver
বর্গgenre
মুদ্রণ–সংস্কৃতি Print culture
মৌখিক সংস্কৃতির Oral Culture
রচনা text
রাচনিকতা textuality
সংকরায়ণ hybridization
সংকেত sign
সংজ্ঞাপন communication
সংশ্লেষণ synthesis
সংস্থান structure
সঞ্চালন circulation
স্থানীয়করণ localisation
সম্প্রেষক emitter
সম্প্রেষণ emission