চিন্তাভাবনা ১ গোরাদের গোসা পুষ্কর দাশগুপ্ত

 চিন্তাভাবনা ১

চিন্তাভাবনা ১

গোরাদের গোসা

পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কালনেমির লঙ্কাভাগ শুরু হয়। ১৪৫২ সালে ইয়োরোপের ক্যাথলিক খ্রিস্টমণ্ডলীর তৎকালীন মোহান্ত পোপ পঞ্চম নিকোলাস (Pope Nicholas V,আসল নাম তোম্মাসো পারেনতুচেল্লি/Tommaso Parentucelli,পোপত্ব:১৪৪৭১৪৫৫) দুম দিভের্সাস (Dum Diversas) নামক ফতোয়া জারি করে পর্তুগালের রাজাকে মুসলমান ও মূর্তিউপাসক, আর অন্য কোনো বিধর্মী আর খ্রিস্টের শত্রুরা যেখানেই থাকুক না কেন সেখানে গিয়ে তাদের আক্রমণ, বন্দী, অধীনস্ত করে তাদের প্রত্যেককে চিরকালের জন্য দাসে পরিণত করার অবাধ অধিকার অনুমোদন করলেন:

আমাদের ঈশ্বরনির্ধারিত ক্ষমতায় বর্তমান দলিলের দ্বারা আমরা আপনাদের সারাসেন ও মূর্তিউপাসক এবং অন্য যেকোনো (খ্রিস্টধর্মে) অবিশ্বাসী ও খ্রিস্টশত্রুরা যেখানেই তারা থাকুক না কেন তাদের তথা তাদের রাজ্য, জায়গিরদারি, তালুকদারি, খাসমহল আর অন্যন্য সম্পত্তি আক্রমণ, তল্লাসি, অধিকার এবং অধীনস্ত করা এবং ব্যক্তি হিসেবে তাদের চিরকালীন ক্রীতদাসে পরিণত করার পূর্ণ এবং অবাধ অনুমতি মঞ্জুর করছি৷

 ─দুম দিভের্সাস ফতোয়া. ১৪৫২ ৷

এর পর ঐ একই পোপ ১৪৫৫ সালে আবার ঐ একই অনুমতি ঘোষণা করে রোমানুস পন্তিফেক্স (Romanus Pontifex) নামে আরেকটি ফতোয়া জারি করেন। এর পর ১৪৯২ সালে কুখ্যাত ইস্পানি পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার (Alexander VI, আসল নাম রদরিগো লিয়ান্থল দে বোর্হা/ Rodrigo Lanzol de Borja, পোপত্ব: ১৪৯২১৫৯৩) ইন্তের ক্যাতেরা (Inter caetera) ফতোয়ায় ক্যাস্টিল ও আরাগনের ক্যাথলিক রাজা ও রানিকে পশ্চিম ও দক্ষিণের তাবৎ ভূমি দখল করার অনুমতি দেন। এর পর ১৫৭৮ সালে অ্যাংলিকান খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রধান ইংল্যোন্ডের রানি (প্রথম) এলিজাবেথ (Elizabeth I, ১৫৩৩১৬০৩, রাজত্ব: ১৫৫৮১৬০৩) হাম্ফ্রে জিলবার্টকে (Humphrey Gilbert, . ১৫৩৯১৫৮৩) খ্রিস্টান রাজা বা জনগোষ্ঠীর দ্বারা অধিকৃত হয় নি এরকম তাবৎ দূরবর্তী আর বর্বর দেশ দখল করার” ২   রাজকীয় অনুমতি দিলেন।

একে একে ইয়োরোপের ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট অনেকগুলি দেশ (ডেনমার্ক, ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদি) উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতায় নামল। এশিয়া, আফ্রিকার বহু দেশ ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশে পরিণত হল, এই দেশগুলি হয়ে উঠল তাদের শাসনের নামে শোষণের ক্ষেত্র। প্রশ্ন উঠতে পারে কে বা কারা পোপ বা ব্রিটিশ রানিকে, অন্যভাবে বলা যায়, খ্রিস্টমণ্ডলীকে এই অধিকারবিতরণের অধিকার দিল বা এই অধিকারবিতরণের অধিকারে বৈধতাটাই বা কী? এই জিজ্ঞাসারএকমেব অদ্বিতীয় উত্তর হল খ্রিস্টধর্ম(খ্রিস্টমণ্ডলীর ভাষায় সত্যধর্ম) আর সভ্যতার (বর্বরতার?) বিস্তার।যে ইয়োরোপ যুক্তির বড়াই করে তাকে এই উত্তরের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করলে ইয়োরোপীয়দের বেশির ভাগ তার উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না, ভাবটা যুক্তি, মানবাধিকার, নৈতিকতা এসব আমাদের ঘরের ব্যাপার, শুধু আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তোমরা তার বাইরে, আমরা যা করব তাকেই তোমাদের যৌক্তিক আর নীতিসম্মত বলে মেনে নিতে হবে।

এখানে আমরা অবশ্য দুই আমেরিকা মহাদেশ আর ওসেয়ানিয়ার কথা বাদ দিচ্ছি, কেননা সভ্যতার (বর্বরতার?) গর্ব করা ইয়োরোপীয়রা ঐ তিন মহাদেশের কোটি কোটি অধিবাসীকে হত্যা করে বা ক্রীতদাসে পরিণত করে সেখানে জমিজমা জবর দখল করে তাদের স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। ইয়োরোপীয়রা বড় গলায় বিভিন্ন দেশে গণহত্যা (জেনোসাইড), হলোকস্ট (holocaust) ইত্যাদির কথা বলে, কিন্তু উপর্যুক্ত মহাদেশগুলিতে ইয়োরোপীয়দের কর্মকাণ্ড নিয়ে আজো কোনো বিচার, নিদেনপক্ষে সত্যোদ্ঘাটন হল না।পঞ্চদশ শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের মধ্যে দুই আমেরিকায় আদি অধিবাসীদের শতকরা সাড়ে সাতানব্বই জন বিলুপ্ত হয়েছে, ওসেয়ানিয়ায় অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে শতকরা নিরানব্বই জন, ইয়োরোপীয়দের দাসব্যবসায়ে এক কোটি আফ্রিকাবাসী প্রাণ হারিয়েছে। হিটলারএর নাৎসিবাদকে ইয়োরোপ একবাক্যে নিন্দা করে, ঘৃণা করে, অথচ ইয়োরোপীয় ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে নাৎসিবাদের কোনো তফাৎ নেই, শুধু ঔপনিবেশিকতার শিকার ছিল অইয়োরোপীয় দেশ ও অশ্বেতকায় জাতি, আরনাৎসিবাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইয়োরোপ আর শ্বেতকায় জাতি:

হিটলারের যে ব্যাপারটা বিশ শতকের একান্ত খ্রিস্টান বুর্জোয়া ক্ষমা করতে পারেনা আসলে তা তার অপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ নয়, আসলে তা মানুষের অবমাননা নয়, আসলে তা হল তার সাদা মানুযের বিরুদ্ধে অপরাধঔপনিবেশক পদ্ধতির প্রয়োগ যা এতকাল অব্দি আরব, ভারতীয় কুলি আর নিগ্রোদের ওপর প্রযোজ্য ছিল।

এমে সেজার ঔপনিবেশিকতা বিযয়ক সন্দর্ভ, ১৯৫৫। 

ফরাসি ভাষার কৃষ্ণাঙ্গ কবি এমে সেজারএর সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত। হিটলার ষাট লক্ষ ইহুদিকে মেরেছিলেন (ইহুদি বাদ দিয়ে, জিপসিদের হত্যা আর কালো মানুষদের হত্যা বা জোর করে নির্বীজ করার কথা ইয়োরোপীয়রা খুব একটা বলে নাওরা তো সে অর্থে ইয়োরোপীয় নয়) হ্যাঁ, হিটলার ষাট লক্ষ ইহুদিকে মেরেছিলেন। কিন্তু অন্য সব জনগোষ্ঠীর জমি দখল করার জন্য, ধর্মান্তরিত করে ক্রীতদাস বানানাোর জন্য বিভিন্ন মহাদেশে কত কোটি মানুষকে হত্যা করেছে ইয়োরোপ তার কোনো হিসেব কখনো দেয় নি, দোওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে নি।আমেরিকার প্রকৃত অধিবাসীদের (অর্থাৎ প্রকৃত আমেরিকানদের) যে অল্পসংখ্যক করুণভাবে বেঁচে রইল তারা তাদের আত্মপরিচয় পর্যন্ত হারিয়ে আমেরিকার ভারতীয়(জোর করে চাপানো ভ্রান্তি থেকে জাত এই অভিধা প্রকৃত আমেরিকান এবং ভারতীয় উভয়ের কাছেই অবমাননাজনক) নামে চিহ্নিত। আজ আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় বহিরাগত অভিবাসী ইয়োরোপীয়রাই হল গিয়ে আমেরিকান বা অস্ট্রেলিয়ান আর প্রকৃত আমেরিকান বা অস্ট্রেলিয়ানরা অধিকারহীন আদিবাসী। ঔপনিবেশিকতার কালিমালিপ্ত ইতিহাস ইয়োরোপ বিকৃত করে বা গ্রাহ্য করেনা।অষ্টাদশ শতক থেকে একুশ শতক পর্যন্ত ইয়োরোপের যে সমৃদ্ধি আর কর্তৃত্ব তার মূলে রয়েছে ঔপনিবেশিকতা অর্থাৎনীতি, যুক্তি, মানবাধিকার (ইয়োরোপীয়রা যেসব বিষয়ে অবিরত বক্তৃতা দেয়) সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ছলে বলে কৌশলে অইয়োরোপীয় দেশ জবর দখল আর তার তাবৎসম্পদ অপহরণ।এর ফলেই ইয়োরোপের শিল্পবিপ্লব, জীবনযাপনের মানের উন্নতি, তাদের জাত্যাংকার ও গর্ব। ইয়োরোপের যেসব দেশ উপনিবেশ স্থাপন করেনি বা করতে পারেনি সে দেশগুলিও ঔপনিবেশক দেশগুলির সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য বা/এবং ঔপনিবেশক শক্তির ছত্রছায়ায় থেকে ঔপনিবেশিত দেশগুলিতে ব্যবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

আধুনিক ইয়োরোপীয় জাতিগুলির সমৃদ্ধির বেশির ভাগেরই ভিত্তি হল বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার প্রতিনিধি জতি গুলির সম্পদলুণ্ঠন।

উইলিয়াম ডিগবি সমৃদ্দ্ধিশালী ব্রিটিশ ভারত, ১৯০১, লন্ডন, টি. ফিশার আনউইন

পৃ. ৩০।

জবর দখল, শোষণ, সম্পদ অপহরণের মাধ্যমে ঔপনিবেশক দেশ কীভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে আর তার পরিণামে ঔপনিবেশিত দেশ কীভাবে সমান্তরালভাবে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর, বাস্তব এমনকী মানসিকভাবে পরনির্ভর হয়ে ওঠে আর শেষপর্যন্ত নয়াঔপনিবেশিকতার শিকার হয় তার দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা আমাদের দেশ ভারতউপমহাদেশকে গ্রহণ করতে পারি। ভারত থেকে অপহৃত সম্পদের নিদর্শন তথা প্রতীক ব্রিটেনের রানির মুকুটের ১০৫ ক্যারেটের হীরে ‘কোহিনুর’। যা তাঁর রাজত্বের ৬০ বত্সর পূর্তিউত্সবে এই লুটের মাল মাথায় পরতে ব্রিটিশ রানির আর ইংরেজ তথা ইয়োরোপীয়দের কোনো লজ্জা হয় না, তা ফেরত দেওয়ার কথা মাথায় আসা দূরের কথা !

ভারতে ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধি কার্জনের (George Nathaniel Curzon,  ১৮৫৯১৯২৫) ১৯০৫ সালের একটি উক্তিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের, বলা যায়, সাধারণভাবে ইয়োরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র উদ্ঘাটিত:

দেশশাসন আর শোষণ হাত ধরাধরি ধরে এগিয়ে চলে। — কার্জন।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে দু বছর কাটানোর পর ওয়ালটার স্ট্রিকল্যান্ড  ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন অন্যান্য ইয়োরোপীয় জাতির ঔপনিবেশিক বিস্তার সম্পর্কে সমভাবে প্রযোজ্য:

ব্রিটিশ সামাজ্য হল ফিনিসীয়সাম্রাজ্যেরমতো। এক দঙ্গল ঠক আর জবর দখলদারের সমবায়, যারা অন্য জনগোষ্ঠীর জমি জবর দখল করে, তবে তা ঐ জনগোষ্ঠীর হিতার্থে তাদের কৃষির উন্নতি করার উদ্দেশ্যে নয়, তাদের মূল্যবান খনিজ অপহরণ করার জন্য; আর তাই যেখানেই এই ব্যবসায়ী দস্যুরা হাজির হয় সেখানেই এই একই ঘটনা ঘটে থাকে।

ইংরেজরা যেখানে এই পদ্ধতিটা চালু করতে সক্ষম হয়, সেখানেই দেশজ মানুষদের সমৃদ্ধি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে অথবা তারা বিলুপ্ত হয়।

স্যারওয়ালটার স্ট্রিকল্যান্ড: মূর্তিউপাসক আর খ্রিস্টানরা; অথবা পূর্বে কালো ছায়া,লন্ডন, অ্যালড্রেড, ১৯২০, পৃ. ৩৫

প্রায় দুশ বছর ঔপনিবেশিক শাসনের পর ভারতের দারিদ্র্য আর দুরবস্থার চেহারার দৃষ্টান্ত আর প্রতীক হল মুর্শিদাবাদ শহর। ক্লাইভ পলাশির যুদ্ধের সময়ের মুর্শিদাবাদের বর্ণনায় লিখেছেন:

মুর্শিদাবাদ শহর লন্ডন শহরের মতোই বিস্তৃত, জনবহুল আর সম্পদসমৃদ্ধ, দুইয়ের মধ্যে তফাতটা হল: প্রথম শহরটিতে অপরিমিত বিশাল সম্পত্তির অধিকারী কিছু ব্যক্তি ছিল, যা দ্বিতীয় শহরটিতে ছিল না।

ইস্ট ইন্ডিয়া স্টকএর মালিকদের উদ্দেশে লেখা লর্ড ক্লাইভের একটা চিঠি, ক্যাথরিন স্ট্রিটের বিপরীতে, স্ট্র্যান্ডে, রাজামহোদয়ের অনুমোদিত পুস্তকবিক্রেতা জে, এন. নাউর্সএর জন্য মুদ্রিত১৭৬৪।

 

ফ্রান্স আর রাশিয়া বাদ দিয়ে ইয়োরোপের যে কোনো রাজ্যের চেয়ে বিস্তৃত এক সাম্রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অর্জন করেছে। তারা অর্জন করেছে চল্লিশ লক্ষ পাউন্ডের রাজস্ব আর সমপরিমাণ ব্যবসা ।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লর্ড ক্নাইভের বক্তৃতা, মার্চ ৩০১৭৭২।

আজ ঐ মুর্শিদাবাদ তথা পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের করুণ, দরিদ্র চেহারা ঔপনিবেশক ইংরেজদের সুলুণ্ঠন আর সুশাসনের চেহারা স্পষ্ট করে। সুসভ্য ব্রিটিশ সুশাসনআর সুশোষণেরফলে সারা ভারতে বারবার দুর্ভিক্ষ হয়। ইতিহাস অনুসারে ব্রিটিশ শাসনের আগে এগারো থেকে সতেরো শতকের মধ্যে ভারতে ১৪ বার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল আর ব্রিটিশ রাজত্বে ১৭৬৯ থেকে ১৯০৮এর মধ্যে ভারতে একান্নবার দুর্ভিক্ষ হয়, আর আঠারো থেকে বিশ শতকের মধ্যে ছয় কোটি ভারতবাসী মারা যায়। উইলিয়াম ডিগবি(William Digby, ৪৯১৯০৪) হিসেব অনুসারে ১৭৯৩ থেকে ১৯০০ অর্থাৎ১০৭ বছরে সারা পৃথিবীতে যুদ্ধে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মারা যায় আর ১৮৯১ থেকে ১৯০০ সাল এই দশ বছরের মধ্যে ভারতে দুর্ভিক্ষে এক কোটি নব্বই লক্ষ ভারতবাসী মারা যায়। আর ভারতে ইংরেজপ্রবর্তিত যে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ইংরেজরা আর মেকলের জারজমানসিকভাবে ঔপনিবেশিত ভারতীয়রা গর্ব করে তার ফল হিসেবে ইংরেজরা যখন আপাতভাবে বিদায় নেয় তখন ভারতে স্বাক্ষরের সংখ্যা শতকরা বারোভাগ।

আর এ দেশে শোষণ, আর লুণ্ঠন আর তার ফলে ব্রিটেনের সমৃদ্ধি সম্পর্ক আমরা প্রথমে মার্কিন ঐতিহাসিক ব্রুকস্ অ্যডামস্এর (Brooks Adams, ১৮৪৮১৯২৭) মতামত উদ্ধৃত করছি:

ভারতীয় ধনসম্পদের আগত প্রবাহ, (ব্রিটিশ) জাতির নগদ মূলধন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে, তার কর্মক্ষমতার সঞ্চয়কেই যে শুধুমাত্র বৃদ্ধি করল তা নয়, তা তার গতির স্থিতিস্থাপকতা আর বেগকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিল।

পলাশির অল্পকাল পর থেকে বাংলায় লুঠ করা সম্পদ লন্ডনে আসতে শুরু করল, আর তার ফল যা হল তাকে বলা যায় তত্ক্ষণাৎ, কেননা তাবৎ বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একমত যে উনিশ শতককে যে ঘটনা তার আগের সমস্ত যুগ থেকে আলাদা করেছে সেই শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছিল ১৭৬০ সাল থেকে। ১৭৬০ সালের আগে ল্যাংকাশায়ারে সুতো তৈরির জন্য যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হত তা প্রায় ভারতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মতোই সাধারণ, ১৭৫০ সাল নাগাদ জ্বালানির জন্য বনভূমি ধ্বংস করার ফল হিসেবে ব্রিটিশ লৌহশিল্প প্রায় ধ্বংস হতে চলেছিল । ঐ সময়ে ব্রিটিশ রাজ্যে যে লৌহ ব্যবহার করা হত তার পাঁচ ভাগের চারভাগ আসতসুইডেন থেকে।

পলাশির যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৫৭ সালে, আর সম্ভবত তার পরের পরিবর্তনের দ্রুতগতির সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কিছুই কখনো ঘটে নি। ১৭৬০ সালে ঝোলানো মাকু (flying-shuttle) দেখা দিল আর আকরিক ধাতু গলানোর জন্য কাঠের জায়গায় কয়লার ব্যবহার শুরু হল। ১৭৬৪সালে হারগ্রিভস স্পিনিং জেনি (spinning-jenny)নামে তাঁত কল উদ্ভাবন করেন, ১৭৭৯ সালে ক্রম্পটন মিউল (mule) নামে আরেক ধরনের তাঁত কল আবিষ্কার করেন, ১৭৮৫ সালে কার্টরাইট (Cartwright) যন্ত্রচালিত তাঁত পেটেন্ট করেন, আর সব কিছুর ওপরে ১৭৬৮ সালে ওয়াট (Watt)বাষ্পচালিত ইঞ্জিন  বা স্টিম ইঞ্জিনের পরিণতি দিল, শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার সবচেয়ে নিখুঁত পথ। কিন্তু এসব যন্ত্র সময়ের গতিকে দ্রুততর করার প্রকাশপথের ভূমিকা নিলেও এই যন্ত্রগুলি কিন্তু দ্রুত গতির কারণ ছিল না। উদ্ভাবন নিজে অক্রিয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের অনেকগুলিকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে যথেষ্ট শক্তির সঞ্চয় জমা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে শতাব্দী পর পর তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। এই সঞ্চয় অবশ্যই অর্থের আকার পাবে, তবে জমা করে রাখা অর্থ নয়, সঞ্চলনশীল অর্থ।

ভারতীয় ধনসম্পদের আগমনের আগে, আর তার পরের দাদনের ব্যয়ের পরিধি বিস্তৃত হল, এই কাজের জন্য যথেষ্ট কোনো শক্তি ছিল না;আর ওয়াট যদি পঞ্চাশ বছর আগে বেঁচে থাকতেন, তিনি আর তাঁর উদ্ভাবন একসঙ্গে অবলুপ্ত হত।

ভারত থেকে লুট করা সম্পদ থেকে যে ফায়দা আহৃত হয়েছে সম্ভবত পৃথিবীর শুরু থেকে কখনো কোনো বিনিয়োগথেকে এতটা মুনাফা আসে নি, কারণ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে গ্রেট ব্রিটেন প্রতিযোগীহীন একচ্ছত্র আধিপত্য করেছে।

ব্রুকস্ অ্যডামস্: সভ্যতা আর অবক্ষয়ের বিধান, ইতিহাস সম্পর্কে নিবন্ধ, লন্ডন, সোয়ান সোনেনশাইন অ্যান্ড কো., লিমি., নিউ ইয়র্ক : ম্যাকমিলান অ্যান্ড কোং., ১৮৯৫,  

পৃ. ২৫৯২৬৩।১০

১৭০০ সালে ভারতের আয় ছিল পৃথিবীর আয়ের ২৭ ভাগ, ব্রিটিশদের প্রায় দুশ বছরের সুশাসনের পর ১৯৫০ সালে ভারতের আয় হয় পৃথিবীর আয়ের ৩ ভাগ। ভারত হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির একটা।

ভারতীয় ধনসম্পদের ইংল্যাণ্ডে নিষ্কাশিত হওয়ার শুরুর সঙ্গে ব্রিটিশ শিল্পোদ্যোগোর দ্রুত উন্নতির সম্পর্কটা কাকতালীয় ছিল না: তা ছিল কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ।

উইলিয়াম ডিগবি: সমৃদ্দ্ধিশালী ব্রিটিশ ভারত, ১৯০১, লন্ডন, টি. ফিশার আনউইন, পৃ. ৩০ ।

 

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকেপ্রথম মহাযুদ্ধ, তারপর তিরিশের যুগের বিশ্বব্যাপী মন্দা, তারপর পুরো ইয়োরোপকে জার্মান উপনিবেশে পরিণত করার জন্য হিটলারের চেস্টা আর তার ফলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েট রাশিয়ার অংশগ্রহণে শেয পর্যন্ত জয় হলেও ফতুর হওয়া ইয়োরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির পক্ষে আর সামরিক শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত পুরনো ধাঁচের উপনিবেশ বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে উঠল। পাশাপাশি ইয়োরোপ দেখতে পেল তাদের নতুন নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত, ফিলিপিনজ, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নয়াঔপনিবেশিকতার নীতি আর কৌশলের সফল প্রয়োগ। এই নীতি আর কৌশল হল সামরিক শক্তি ও শাসনব্যবস্থার পরিচালনার মাধ্যমে কোনো দেশকে অধীন রাখার পরিবর্তে বহুজাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগ, দাদন ইত্যাদির মাধ্যমে ঐ দেশের অর্থনীতিরাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ এবং ভাষিকসাংস্কৃতিক প্রভাববিস্তারের মাধ্যমে দেশের মানুষের মানসিকতার নিয়ন্ত্রণ, পরিনামে মানসিক নির্ভরতা বা পরাধীনতা। পুরনো ধাঁচের উপনিবেশ বজায় রাখতে অক্ষম ইয়োরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭০এর প্রায় সবগুলি উপনিবেশকে আপাতভাবে স্বাধীনতাদিয়ে দিল। আর একই সঙ্গে ইয়োরোপের দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত ও নেতৃত্ব মেনে যৌথ ভাবে নয়াউপনিবেশে পরিণত করার নীতি আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ইংরেজদের ব্রিটিশ কমনওয়েলথ (Commonwealth of Nations), ফরাসিদের ফ্রাংকোফোনি (Francophonie), স্প্যানিশপর্তুগিজদের আইবেরোআমেরিকান রাষ্ট্রসংঘ (স্প্যানিশ: Organización de Estados Iberoamericanos, পর্তুগিজ: Organização dos Estados Ibero-americanos), এই সংস্থাগুলি ইয়োরোপের নয়াঔপনিবেশিক কৌশলের অঙ্গ। আর এর সঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিক ধনভাণ্ডার (International Monetary Fund সংক্ষেপে I.M.F. ), বিশ্বব্যাংক  (World Bank ), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা(World Trade Organisationসংক্ষেপে W.T.O.), বিশেষভাবে বিদেশি সাহায্য পাওয়া বেসরকারি সংস্থা (Non Governmental Organisation সংক্ষেপে N.G.O.) ইত্যাদি নয়াঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র।

এত সব কৌশল সত্ত্বেও সব সময় দুয়ে দুয়ে চার হচ্ছে না, একাট্টা সব সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। ইয়োরোপীয়দের পুরনো উপনিবেশগুলো দীর্ঘকালের শোষণ আর লুণ্ঠনে হৃতসর্বস্ব, রক্তহীন, নিঃস্ব; তার মধ্যে যেসব দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ (পেট্রল, গ্যাস, বিভিন্ন ধাতু, হিরে ইত্যাদি) রয়েছে তা ইয়োরোপআমেরিকার বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থার অধিকারে, দেশের মানুষ তার আয়ের কানাকড়িও চোখে দেখে না, শুধু ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া দুর্নীতির পাঁকে ডোবা নয়াঔপনিবেশিকতার কম্প্রাদর দেশের শাসকগোষ্ঠী সামান্য কিছু বখশিস পাচ্ছে। কিন্তু ঝমেলাটা অন্য জায়গায় আর এ নিয়ে সাহেবদের রাগ আর অভিযোগের শেষ নেই! ঔপনিবেশিকতা আর তারপর নয়াঔপনিবেশিকতার শোষণলুণ্ঠনে সর্বহারা এসিয়া আর আফ্রিকার দেশগুলি থেকে দলে দলে অভিবাসী ইয়োরোপে এসে হাজির হচ্ছে, উদ্দেশ্য কাজ খুঁজে পাওয়া, কাজ করা, দু পয়সা কামানেো, ভাগ্য ফেরানো। তাদের বেশির ভাগেরইবৈধ কাগজপত্র (পাসপোর্ট, ভিজা, কাজ তথা থাকার অনুমতিপত্র ইত্যাদি) বলতে কিছুই নেই, অনেক ক্ষেত্রে জায়গাজমি, ঘরবাড়ি বিক্রি করে আন্তর্জাতিক চোরাই পারাপার চক্রকে প্রচুর নজরানা দিয়ে প্রাণান্তকর নানা দুর্ভোগ সহ্য করে তারা ইয়োরোপের কোনো একটা দেশে গিয়ে হাজির হয়। প্রথম দিকে ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশ এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় নি, দেশের বেশ কিছু লোক বৈধ বেতন আর অন্যান্য বাধ্যতামূলক সর্ত (সামাজিক নিরাপত্তা, সবেতন ছুটি, কাজের সময়সীমাইত্যাদি) অমান্য করে এক তৃতীয়াংশ কি একচতুর্থাংশ দৈনিক বেতনে এই সব অভিবাসীদের অঘোষিতভাবে কাজ করিয়ে নিজেদের মুনাফার অঙ্ক বাড়িয়েছে। কিছু কিছু ইয়োরোপীয় দেশ সুবিধাজনক বলে প্রথম দিকের বেআইনি অভিবাসীদের একটা অংশকে কাগজপত্র দিয়ে আইনি করে নিয়েছে, কম বেতনের কায়িক পরিশ্রমের যেসব কাজ দেশের লোক করতে চায় না, সেসব কাজ তারা পেয়েছে। তারপর ক্রমশ অবস্থাটা পালটে গেছে, নানা কৌশল সত্ত্বেও ইয়োরোপের দেশগুলির অর্থনৈতিক সংস্থান সামান্য কমতে শুরু করল, পুরনো উপনিবেশের সম্পদ আর নামমাত্র মূল্যে কাঁচা মাল শেষ, উত্পাদন নেই — ফলে রপ্তানি কম, বেকারবৃদ্ধি, দেশের মানুষের অসন্তোষ দিন দিন বেড়ে উঠতে থাকে। সরকার বিদেশিদের সম্পর্কে কড়া হতে বাধ্য হয়, দক্ষিণের দেশগুলি থেকে ইউরোপের কোনো দেশে আসতে চেয়ে ভিজাচাইলে হাজার প্রশ্ন, বিরক্তিকর, নির্বোধ, এমন কী অপমানজনক, তারপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান। তাতে অবশ্য দক্ষিণের অবৈধ অভিবাসীদের আসাও বন্ধ হয় না। ইয়োরোপে ঔপনিবেশিকতার মানসিকতায় লালিত জাত্যহংকারীর অভাব নেই। তাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়: একদল চরমপন্থী, তারা দলবদ্ধভাবে অবৈধ অভিবাসী সহ তাবৎ বিদেশি অশ্বেতকায় মানুষকে অপমান, ভীতিপ্রদর্শন এমন কী শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত করে, অন্যেরা আইনকানুনের কড়াকড়ির মাধ্যমে তাদের দেশে বিদেশি অশ্বেতকায়দের আগমন বা অবস্থান বন্ধ করতে চায়।

কিন্তু কেউ ইয়োরোপীয়দের একথা স্মরণ করিয়ে দেয় না যে তারা দক্ষিণের অশ্বেতকায়দের দেশ থেকে যে ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছে, অপহরণ করেছে, শোষণ করেছে যা তাদের বর্তমান সমৃদ্দ্ধির ভিত্তি তার পরিমাণ আজ সুদেআসলে কত হয়, আর অশ্বেতকায় বিদেশিদের আগমন বা অবস্থানে তার শতকরা কতভাগ খরচ হয় অথবা মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ইয়োরোপীয় দেশগুলি কি ঐ লুণ্ঠিত, অপহৃত, শোষিত ধনসম্পদ অর্থমূল্যে সুদেআসলে দক্ষিণের দেশগুলিকে ফেরত দিতে আর তারপর তাদের দেশে বিদেশি অশ্বেতকায়দের আগমন বা অবস্থান নিষিদ্ধ করতে রাজি। অথবা কেউ ইয়োরোপীয়দের এ প্রশ্ন করে না যে তারা কোন কোন বৈধ কাগজপত্র নিয়ে আমেরিকা, আফ্রিকা, ওসেয়ানিয়া বা এশিয়ার মানুষদের ভূমি জবরদখল করতে, তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন, অপহরণ আর শোষণ করতে, মানবাধিকার পায়ে মাড়িয়ে তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করতে, দাস বা কুলি হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করতে গিয়েছিল। এসব অপরাধের জন্য তারা কী ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি? অথবা অন্ততপক্ষে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অপরাধ স্বীকার করতে তারা কী প্রস্তুত?

তথ্যসূত্র

.We grant you by these present documents, with our Apostolic Authority, full and free permission to invade, search out, capture, and subjugate the Saracens and pagans and any other unbelievers and enemies of Christ wherever they may be, as well as their kingdoms, duchies, counties, principalities, and other property […] and to reduce their persons into perpetual slavery .

Bull Dum Diversas 1452.

It was in that year [1578] that QueenElizabeth gave her royal authorisation to Sir Humphrey Gilbert,“to take possession of allremote and barbarous lands, unoccupied by anyChristian prince or people.”

— J. N. OGILVIE, D.D.: Our Empire’s Debt to Missions, The Duff Missionary Lecture, London: Hodder and Stroughton Limited, 1922, p.1.

. Ce que le très chrétien bougeeois du XXe siècle ne pardonne pas à Hitler, ce n’est pas le crime en soi, le crime contre l’homme, ce n’est pas l’humiliation de l’homme en soi, c’est le crime contre l’homme blanc… ; d’avoir appliqué des procédés colonialistes dont ne relevaient jusqu’ici que les Arabes, les coolies del’Inde et des nègres d’Afriques.

Aimé Césare: Discours sur le colonialisme, 1955.

. Much of modern European national prosperity is based upon the plunder of nations representing ancient civilisations.

William Digby: ‘Prosperous’ British India, London,

T. Fisher Unwin. 1901, p.30.

. Administration and exploitation go hand in hand. — Curzon .

. The English Empire is like the Phœnician one. It consists of host of projectors and squatters, who overrun the lands of other people, not in order to devlop their agriculture for the advantage of the people themselves, but to steal their precious metals; and so whereever these commercial brigands betake themselves the same phenomena occur.

Where the English can carry out this system, native populations gradually decline in prosperity or die out.

Sir Walter Strickland: Pagans and Christians; Or, The Black Spot in the East, London, Aldred, 1920 , p.35.

. The city of Maxadavad is as extensive, populous and rich as the city of London, with this difference that there were individuals in the first possessing infinitely greater property than in the last city.

A Letter to proprietors of the East India Stock from Lord Clive, Printed for J. N. Nourse, opposite Catherine-Street, in the Strand, Bookseller in Ordinary to His Majesty, 1764.

. The Company had acquired an empire more extensive than any Kingdom in Europe, France and Russia excepted. They have acquired a Revenue offour million sterling, and a Trade in proportion.

Lord Clive’s Speech in the House of Commons, March 30 1772.

. …Therefore the influx of the Indian treasure, by adding considerably to the nation’s cash capital, not only increased its stock of energy, but added much to its flexibility and the rapidity of its movement.

Very soon after Plassey, the Bengal plunder began to arrive in London, and the effect appears to have been instantaneous, for all authorities agree that the ” industrial revolution,” the event which has divided the nineteenth century from all antecedent time, began with the year 1760. Prior to 1760, according to Baines, the machinery used for spinning cotton in Lancashire was almost as simple as in India ;while about 1750 the English iron industry was in full decline because of the destruction of the forests for fuel. At that time four-fifths of the iron used in the kingdom came from Sweden.

Plassey was fought in 1757, and probably nothing has ever equalled the rapidity of the change which followed. In 1760 the flying-shuttle appeared, and coal began to replace wood in smelting. In 1764 Hargreaves invented the spinning-jenny, in 1779 Crompton contrived the mule, in 1785 Cartwright patented the power-loom, and, chief of all, in 1768 Watt matured the steam-engine, the most perfect of all vents of centralizing energy. But, though these machines served as outlets for the accelerating movement of the time, they did not cause that acceleration. In them- selves inventions are passive, many of the most important having lain dormant for centuries, waiting for a sufficient store of force to have accumulated to set them working. That store must always take the shape of money, and money not hoarded, but in motion.

…Before the influx of the Indian treasure, and the expansion of credit which followed, no force sufficient for this purpose existed ; and had Watt lived fifty years …

…Possibly since the world began, no investment has ever yielded the profit reaped from the Indan plunder, because for nearly fifty years Great Britain stood without a competitor .

Brooks Adams: The Law of Civilization and Decay, An Essay on History, London, Swan Sonnenschein & Co, Lim, New York: Macmillan & Co , 1895, pp. 259-263.

১০. The connection of the beginning of the drain of Indian wealth to England and the swift uprising of British industries was not casual: it was causal.

William Digby: ‘Prosperous’ British India, London,

T. Fisher Unwin. 1901, p. 31

.

২৪ LE 24 Revue bilingue (français-bengali) দ্বিভাষিক সাহিত্য-পত্র (ফরাসি-বাংলা)

VOLUME 1 Cover

LE 24 VOLUME ONE

২৪

LE 24

২৪ দ্বিভাষিক সাহিত্যপত্র (ফরাসিবাংলা)

LE 24 Revue bilingue (français-bengali) 

উপস্থাপনা

১৯৪০ সালে কলকাতায় ফরাসি ভাষা শিক্ষার কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তঃসাংস্কৃতিক (বিনয় সরকারি ভাষায় আন্তর্মানুষিকযোগাযোগ আর আদানপ্রদানে বিশ্বাসী) সমাজবিজ্ঞানী বিনয় কুমার সরকার (১৮৮৭১৯৪৯) ১৯৪৪ সালে তাঁর বিখ্যাত আড্ডায় (হেমেন্দ্রবিজয় সেনের প্রশ্নের উত্তরে ) এ সম্পর্কে তাঁর মতামত জানান , তাঁর মতে এদেশে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ফরাসী তাঁবে ফরাসী প্রচার আপনি ফরাসী প্রচারের জন্য বাংলা দেশে কিরূপ প্রতিষ্ঠান চান ? ‘ এ প্রশ্নের উত্তরে বিনয় সরকার বলেন :

বিলকুল বাঙালী প্রতিষ্ঠান। তাতে একজন ফরাসীকেও কর্ম্মকরত্তাদের ভেতর রাখা উচিত নয়। ফরাসীরা অতিথিরূপে আসতে পারে। ফরাসীদের প্রচারক ও বক্তাভাবে আনা চলতে পারে। ফরাসী লোকজনদের সম্বর্ধনার জন্য জলসার ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটার নাম দেওয়া উচিত বঙ্গীয় ফরাসীপরিষৎ। তার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকবে বাঙালীকে রকমারি ভাবে ফরাসীদক্ষ করে তোলা। ফরাসী জাতের ভাযা , সাহিত্য, সঙ্গীত, বিজ্ঞান, শিল্পবাণিজ্য, চিত্রস্থাপত্য, আর্থিক ব্যবস্থা, আইনকানুন, সমাজসংস্কার ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি সম্বন্ধে বাঙালীর বাচ্চাকে ওআকিবহাল করে তোলা তার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।

বিনয় সরকারের বৈঠকে, খণ্ড ২,

কলকাতা, চক্রবর্ত্তী, চ্যাটার্জ্জি এণ্ড কোং লিমিটেড,

১৯৪৫, পৃ.৩০৬০৭।

বিনয় সরকারের মন্তব্যের অনুবর্তনে আমরা যোগ করতে পারি প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ তার আমলাতান্ত্রিক সংস্থান তথা তার ঔপনিবেশিক একালাপী (monological বনাম দ্বৈতালাপী /dialogical) চারিত্রিক সংগঠনের কারণে পরাসাংস্কৃতিক সম্প্রেষণের মাধ্যমে বাঙালির ফরাসি সাহিত্যসংস্কৃতির পরিগ্রহণে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে নি। প্রথম থেকে এই প্রতিষ্ঠানের তিনটি ভূমিকা দেখা যায়:

. ফরাসি ভাষার শিক্ষাকেন্দ্র যা সাংস্কৃতিক স্তরে ফরাসি সংস্কৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার অভাবে ফরাসি ভাষার পাঠ বিক্রির দোকানে পরিণত হয়।

. ফরাসি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যা কিছু ফরাসিকে বিদেশে আরামদায়কভাবে (ভারত বা এরকম কোনো দেশ হলে বলা যায় রাজার হালে) থাকা আর বিশেয কিছু আর্থিক সুবিধার (বিদেশে থাকার ভাতা ইত্যাদি) সুযোগ করে দেয়। গত তিন দশক ধরে খরচ কমানোর উপায় হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মপ্রার্থীদের কর্মচারী বা এবং শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ফরাসিরা কাজ করে ফরাসি সরকারপ্রেরিত সরকারি কর্মী হিসেবে, আইনগতভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আইনের ফাঁকে অফরাসি স্থানীয় কর্মীদের নামমাত্র পারিশ্রমিকে তাবৎ সামাজিক দ্বায়িত্ব (অবসর, পেনশন, চিকিৎসা ইত্যাদি) অস্বীকার করে অস্থায়ীভাবে বা ঘন্টার মজুরিতে নিয়োগ করা হয়। ফরাসিদের মাসিক মাইনে হয় এদের মজুরির ৩০ থেকে ৫০ গুণ। না, মানবাধিকার ইত্যাদি সাদা মানুষের ক্ষেত্রেই শুধু প্রয়োজ্য, অন্যদের ক্ষেত্রে নয়।

.আর এই প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ভূমিকা হল আর পাঁচটা ক্লাবের মতো শহরের বুর্জোয়াদের মিলনক্ষেত্র ক্লাবে পরিণত হওয়া।

আর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে যেসব ফরাসি কর্মী পড়নো বা কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়ে আসে তারা সাধারণত গড়পরতা মাঝারি ফরাসি (যাদের ফরাসিতে বলা হয় Français  moyens বা franchouillards), সংকীর্ণমনা, প্রায়শ রেসিস্ট, কোনো সংস্কৃতি নিয়েই তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, বেশি পয়সা রোজগারের ধান্ধায় কলকাতায় এসেছে , এখানকার মেয়াদ শেয হলে জাকার্তা কি সাঁও পাওলোতে বদলির চেষ্টা করবে।

তবু সত্তরের দশকে কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এল যে পরিবর্তন আশির দশকের শেষ অব্দি স্থায়ী হয়েছিল। এই সময়ে ঘটনাক্রমে পরপর বেশ কয়েকজন ফরাসি এলেন যাঁদের নিজেদের ইয়োরোপীয় ফরাসি সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন আগ্রহের পাশাপাশি এদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে মনোযোগ আর ঔত্সুক্য ছিল ব্যতিক্রমী । এঁরাই কিছু বাঙালির সহযোগিতায় কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজকে দুটো দশক ধরে ফরাসিবাংলা আন্তঃসাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের একটি কেন্দ্রে (অন্যভাবে বলা যায় আন্তঃসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনের প্রণালীতে) পরিণত করার চেষ্টা করেন। আর এই প্রয়াসেরই অন্যতম প্রকাশ হল দ্বিভাষিক বাংলাফরাসি সাহিত্যপত্রিকা যার প্রথম সাতটি সংকলনের নাম ছিল ২৪, পরের সাতটি সংকলনের নাম কঁফ্লুয়ঁস । নব্বইয়ের দশকে কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ পুনর্মুষিক ভব হয়ে আবার তার পুরনো চরিত্র ফিরে পায়, ফরাসি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তথা ফরাসি ভাষার পাঠ বিক্রির বিপণিতে পরিণত হয়।

দ্বিভাষিক বাংলাফরাসি সাহিত্যপত্রিকা ব্যাপারে কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের বুর্জোয়া পরিচালকমণ্ডলী প্রথমে সরাসরি আপত্তি জানায়। পরে পত্রিকার সাফল্যে তেতো গেলার মতো প্রতি সংখ্যর প্রকাশে সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য করে। কাগজ ছাপানো হত হাতে কম্পোজ করা লেটার প্রেস থেকে, লাইনো টাইপের বা শেষের দিকে কম্প্যুটারওয়ালা বড় প্রেস থেকে আর্থিক কারণে পত্রিকা ছাপানো সম্ভব ছিল না।

১৯৭৩ কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পরিচালক সাহিত্যশিল্প সম্পর্কে বিশেষ উত্সাহী জঁফ্রসোয়া মোর (Jean-François Maure) ফরাসী শিক্ষার্থী স্বপন দাশমহাপাত্রকে (পরে বারাণসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসির অধ্যাপক) থেকে একটি দ্বিভাষিক বাংলাফরাসি সাহিত্যপত্রিকা বের করা যায় কিনা জানতে চান। স্বপন এই ব্যাপারে আমার*সঙ্গে পরামর্শ করে মোরএর পরিকল্পনায় আমাদের সম্মতি আর সমর্থন জানায়। কিন্তু কয়েকদিন পর মোর আমাদের জানান যে কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পরিচালকমণ্ডলী পত্রিকাপ্রকাশের বিরোধী। অতএব পরিকল্পনা বাতিল। শেষ পর্যন্ত তিনি জানতে চান আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ঠিকানা ব্যবহার না করে আমরা ঐ সাহিত্যপত্রিকা বার করতে পারি কিনা, তিনি আমাদের সব ব্যপারে ব্যক্তিগতভাবে যথাসম্ভব সাহায্য করবেন। আমরা আমলাতান্ত্রিক বিরোধিতার মুখোমুখি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বললাম পত্রিকা বার করা সম্ভব। ফরাসিবাংলা আন্তঃসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের প্রকৃত ভূমিকা কী হতে পারে এই ভাবনার আলোচনার মাঝখানে মোর প্রস্তাব করলেন যে কাগজের নাম হতে পারে ২৪, ফরাসিতে Le 24 ; কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের তখনকার ঠিকানা ছিল ২৪ পার্ক ম্যানসন্স্, পার্ক স্ট্রিট। অঁদ্রে ব্রতোঁর বিখ্যাত রচনা আর্কান ১৭র কথা স্মরণ করে নামটা আমাদের বেশ রহস্যময়, স্যুররেয়ালিস্ত বলে মনে হল। নাম স্থির হয়ে গেল।

এর পর মোর দুশ টাকা চাঁদা দিলেন। স্বপন আর আমি, আমরা নিজেরাও একশ টাকা করে দিলাম। স্বপন ছোট একটা বিজ্ঞাপনও জোগাড় করল। কিন্তু ঐ টাকায় কলকাতার কোনো প্রেসে ফরাসি ছাপানো অসম্ভব, তাই স্বপন আর আমি চন্দননগরে গিয়ে পুরনো পায়ে চাপা মেশিনে চারপৃষ্ঠা করে ছাপতে পারে এরকম একটা লেটার প্রেসে (মুক্তি প্রেস) গিয়ে হাজির হলাম। ট্রেনের মাসিক টিকিট কাটলাম, কলকাতা থেকে কাগজ কিনে এনে পৌঁছে দিলাম। অনুবাদ, প্রুফ দেখা, টাইপ করার ব্যাপারে মোর অক্লান্তভাবে যথাসাধ্য সহায়তা করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত কাগজের প্রথম সংখ্যা বের হল। এর পর কলকাতায় লেটার প্রেস অমি প্রেসেরমালিক পৃথ্বীশ সাহাকে পুরনো ফরাসি লেটার টাইপ কিনতে রাজি করিয়ে দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে আমরাকলকাতায় ছাপাতে শুরু করলাম। এই পত্রিকার সংখ্যাগুলি আজ অপ্রাপ্য। এখানে আমরা প্রথম দুটি সংখ্যা উপস্থাপিত করছি।

পুষ্কর দাশগুপ্ত

*পুষ্কর দাশগুপ্ত তখনো ফরাসি ভাষাসাহিত্যের শিক্ষার্থী, পরে কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ফরাসির শিক্ষক আর শেষ পর্যন্ত নব্বইয়ের দশকে পরিবর্তিত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ফরাসি আমলাতান্ত্রিক বৈষম্য আর রেসিজম্এর প্রতিবাদে শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করে কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ত্যাগ করেন।

 

Pushkar DASGUPTA: Réception de la littérature française au Bengale 2: Michael Madhusudan Dutt পুষ্কর দাশগুপ্ত : ফরাসি সাহিত্যের বাঙালি পরিগ্রহণ ২ : মাইকেল মধুসূদন দত্ত

Micheal Mudhusudan Dutt.

ফরাসি সাহিত্যের বাঙালি পরিগ্রহণ ২ মাইকেল মধুসূদন দত্ত

পুষ্কর দাশগুপ্ত

প্রস্তাবনা

.১ ঐতিহাসিক কারণে কোনো একটি ভাষা/সংস্কৃতির সঙ্গে দ্বিতীয় একটি ভাষা/সংস্কৃতির যোগাযোগের ফলে যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সূত্রপাত হয় তাকে আমরা অতিসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপন প্রক্রিয়া বলে অভিহিত করতে পারি। এই অতিসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয় এক ভাষা/সংস্কৃতির পরিধি থেকে দ্বিতীয় এক ভাষা/সংস্কৃতির জগতে সাংস্কৃতিক সংকেত বা/এবং রচনার অতিসাংস্কৃতিকসঞ্চালন। আর এই অতিসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনসঞ্চালনের বিশেষ ঐতিহাসিক মুহর্তে দুটি ভাষা/সংস্কৃতির একটি সম্প্রেষক ভাষা/সংস্কৃতি ও অন্যটি পরিগ্রাহক ভাষা/সংস্কৃতির ভুমিকা গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ায় অনুসূচিত হয় সম্প্রেষক ভাষা/সংস্কৃতির অতিসাংস্কৃতিক সম্প্রেষণ আর পরিগ্রাহক ভাষা/সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণ। অন্য দিকে এই পরিগ্রহণের ফলশ্রুতি হল পরিগ্রাহক ভাষা/সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিকতা তথা আন্তরাচনিকতার দিগবলয়ের প্রসার। প্রসঙ্গত সম্প্রেষক ভাষা/সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিত থেকে আলোচিত ‘সাবেকি প্রভাবতত্ত্বের’ সীমা থেকে বেরিয়ে আমাদের মনে রাখা দরকার আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণ (অর্থাৎ নির্বাচনপঠন ও পুনর্নির্মান)নির্ধারিতনিয়ন্ত্রিত হয় পরিগ্রাহক ভাষা/সংস্কৃতির সংস্থানচরিত্র ও ইতিহাসনিয়মিত প্রত্যাশা দ্বারা

.২ বর্তমান নিবন্ধে আমাদের আলোচ্য হল মধুসূদনের ফরাসিচর্চা। মধুসূদনের এই ফরাসিচর্চা ইয়োরোপীয়/ফরাসি সাহিত্যের ভারতীয়/বাঙালি পরিগ্রহণের একটি দৃষ্টান্তযা আবার বৃহত্তর অর্থে ফরাসি সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিক বাঙালি পরিগ্রহণের একটি পর্ব। অবশ্য যেহেতু এ নিবন্ধে আমাদের আলোচনার পরিধি মধুসূদন কর্তৃক ফরাসি কবি লা ফোঁতেনের কয়েকটি নীতিকবিতার (ফাবল/fablesএরঅবলম্বনঅনুকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ অতএব আমাদের আলোচনা আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের একটি বিশেষ ক্ষেত্রে সীমিত। এই বিশেষ ক্ষেত্রটি হল অতিসাংস্কৃতিক সম্প্রেষণপরিগ্রহণের মিথষ্ক্রিয়ার ফল স্বরূপ আন্তর্ভাষিক তথা আন্তঃসাহিত্যিক অনুলিখন।

.৩ এখানে একথাও বলা দরকার যে প্রাকঔপনিবেশিক পুঁথিসংস্কৃতির যুগের বাংলা ভাষার সাহিত্যউত্পাদন প্রধানত পদ্যে রচিত লিখিতশ্রাব্য বা পাঠ্যশ্রাব্য২ সাহিত্যের সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলআর তা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক গোষ্ঠীবদ্ধ বাঙালি জীবনের প্রত্যাশার দিগবলয়ের অনুসারী। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে জন্মানো নতুন বাঙালি প্রজন্মের মনে পুরনো পাঠ্যশ্রাব্য সাহিত্যের পরিবর্তে নতুন ব্যক্তিপাঠকের ভোগ্য পাঠ্য সাহিত্যের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। আর এই নতুন প্রজন্মের ঐতিহাসিক পঠনচাহিদা মেটানোর জন্য সৃষ্ট হল গদ্য ও পদ্যে রচিত নতুন পাঠ্য সাহিত্য। পাশাপাশি মুদ্রণপদ্ধতির আবির্ভাব এই চাহিদা ও উত্পাদনের সহায়ক হয়ে উঠল। বাংলা ভাষার এই নতুন সাহিত্য নতুন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইয়োরোপীয় সাহিত্য থেকে তার ভাষিকসাংস্কৃতিক সংস্থাননিয়ন্ত্রিত চাহিদা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী নির্বাচিত বিভিন্ন উপাদান পরিগ্রহণ ও আত্তীকৃত করল।

বাংলা সাহিত্যের আন্তঃরাচনিকতার পরিধির বিস্তারে মধুসূদনের ভূমিকা

.১ অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার পরিধি ছিল পূর্ববর্তী বাংলাপ্রাকৃতঅপভ্রংশ ও সংস্কৃত সাহিত্য। আর তারপর মুসলমান শাসনের সময়ে এই সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার পরিধি ফরাসি ও আরবি সাহিত্য পর্যন্ত। উনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সহযোগী উপকরণ হিশেবে ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রবর্তন করা হল। এর ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালির ইংরেজি ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়ের পরোক্ষ পরিণাম হল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ইয়োরোপীয় সাহিত্যসংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির যোগাযোগ। এই যোগসূত্রের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের আন্তঃসাস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার দিগন্ত ইয়োরোপীয় সাহিত্য পর্যন্ত প্রসারিত হয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে ঈশ্বর গুপ্ত থেকে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অব্দি কবিদের কাব্যকৃতি আন্তঃরাচনিকতার এই নতুন ভূখণ্ডে প্রবেশে দ্বিধাগ্রস্ত। মধুসূদনই প্রথম ইয়োরোপীয় কাব্যাদর্শ এবং কবিকৃতিকে সক্ষম ও সার্থকভাবে বাংলা কাব্যবাচনের আন্তঃরাচনিক উপাদান হিসেবে নিজের রচনায় অঙ্গীকৃত করেন। বাংলা কাব্যবাচনকে আন্তঃরাচনিকতার যোগসূত্রে ফরাসি কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রথম প্রয়াসও মধুসূদনেরই।

.২ মধুসূদনের প্রথম যৌবনের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যচর্চা ঐতিহাসিক পরিণামের বিচারে তাঁর মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্যরচনার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে গণ্য করা যায়। মাদ্রাজে অবস্থানকালে মধুসূদন তাঁর ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাপটিভ লেডি’(Captive Lady১৮৪৯প্রকাশ করেন। বন্ধু গৌরদাসের মাধ্যমে কলকাতায় বেথুন সাহেব (John Drinkwater Bethune) এই গ্রন্থ পান। মধুসূদনের উচিত মাতৃভাষার উন্নতি সাধনের চেষ্টা করা —বেথুন এই অভিমত প্রকাশ করেন। গৌরদাস নিজের সমর্থনসহ বেথুনের অভিমত জানালে মধুসূদন উত্তরে লেখেন (১৮ই অগাষ্ট১৮৪৯):

My life is more busy than that of a school boy. Here is my routine: 6-8 Hebrew, 8-12 School, 12-2 Greek, 2-5 Telugu and Sanskrit, 5-7 Latin, 7-10 English. Am I not preparing for the great object of embellishing the tongue of my fathers?…

এর মধ্যে মধুসূদনের পিতৃপরুষের ভাষা বাংলার ‘সৌন্দর্যবিধানের মহৎ উদ্দেশ্য’স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। পরবর্তী কালে মধুসূদন ইউরোপীয় (গ্রিকলাতিন ও ইংরেজি)ধ্রুপদী কাব্যের আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় একে একে ভিলোত্তমাসম্ভবমেঘনাদবধ বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর কোনো আকর্ষণ দেখা যায় নি। শুধুমাত্র বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি মেঘনাদবধ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন:

…I think I have constructed the Poem on the most rigid principles and even a French critic would not find fault with me.

কিন্তু মধুসূদনের ফরাসিচর্চা অনেক পরের ঘটনা।

মধুসূদনের ফরাসিসংস্পর্শ

.১ প্রসঙ্গত মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবনে ফরাসি সংম্পর্শবিষয়ে আলোচনা করা যাক। মূল বিষয়বস্ত্তর ভূমিকায় এ আলোচনার স্থান হতে পারে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে মধুসূদনের দ্বিতীয় জীবনসঙ্গিনী হেনরিয়েটা ছিলেন ফরাসি। কিন্তু তাঁর হেনরিয়েটা (আমেলিয়া এনরিয়েত্তা সোফিয়া Amelia Henrietta Sophia) নাম আপাত পরিচয়ে ইতালীয়। তাছাড়া মধুসূদনহেনরিয়েটার যে বংশধররা হেনরিয়েটার সমাধিফলক প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরা ইতালিতে বাস করেন। এটা হেনরিয়েটার ইতালীয় বংশপরিয়ের কোনো প্রমাণ কিনা আমরা জানি না। স্বভাবতই হেনরিয়েটা ফরাসি বংশোদ্ভব ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাই না।

.২ ১৮৬২ সালে মধুসূদন ইংল্যাণ্ডে যান। উদ্দেশ্য ব্যরিস্টার হওয়া। কিন্তু অর্থভাবে ব্যারিস্টারি পড়া স্থগিত রেখে ১৮৬৩ সালের মাঝামাঝি তিনি সপরিবারে ফ্রান্সে গেলেন। প্রথমে কিছুদিন প্যারিসে এবং পরে প্যারিস থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ভের্ভাইএ তিনি সপরিবেরে বাস করতে থাকেন। ১৮৬৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন। ফ্রান্সে তিনি ফরাসি ভাষা আয়ও করেনফরাসি সাহিত্যসংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এই আকর্ষণ তাঁর শেষজীবন পর্যন্ত বর্তমান ছিল।

ফ্রান্সে অবস্থানকালে মধুসূদনের যথার্থ ফরাসিচর্চার শুরু। এই সময়ে মধুসূদন ইতালীয় সনেটের অনুপ্রেরণায় চতুর্দশপদী কবিতাবলী রচনা করেন।  এই কবিতাবলীর মধ্যে একটি কবিতায় ফরাসি প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বসন্তে একটি পাখীর প্রতি’ শীর্ষক এই কবিতাটিতে কবি ফরাসি দেশের(কবির পাদটীকা, ‘ফরাসীস্ দেশে’হেমন্তকাল সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন:

দুরন্ত কৃতান্তসম হেমন্ত এ দেশে

নির্দ্দয়;ধরার কষ্টে দুষ্ট তুষ্ট অতি!

না দেয় শোভিতে কভু ফুলরত্নে কেশে,

পরায় ধবল বাস বৈধব্যে যেমতি!—

অন্য একটি কবিতা রচিত হয়েছে ‘ভরসেলস নগরে রাজ পুরী ও উদ্যান’ দর্শনে।

স্মরণীয়ফ্রান্সে এই সময় সম্রাট নাপোলেওঁর ভ্রাতুষ্পুত্র লুই নাপোলেওঁ (তৃতীয় নাপোলেওঁপ্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের কাল (১৮৫২১৮৭০)১০ ফ্রান্সে অবস্থানকালে মধুসূদন ফরাসি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেনএকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে লেখা একটি চিঠিতে (৯ই জুন ১৮৬৪তিনি লিথেছেন:

…Though I have been very unhappy and full of anxiety here. I have very nearly mastered French. I speak it well and write it better…১১

.৩ মধুসূদনের জীবনীকার যোগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ফরাসি ভাষায় কবিতা রচনার কথা উল্লেখ করেছেন।১২ আমরা তা দেখি নি বা খুঁজে পাই নি। ‘জীবনচরিত’ এবং ‘মধুস্মৃতি’ গ্রন্থের গ্রন্থকারদ্বয় মধুসূদনের একাধিক ফরাসি চিঠির উল্লেখ করেছেন আর তার মনোমোহন ঘোষ কৃত অনুবাদ উপস্থাপিত করেছেন। ফ্রান্সে থাকার সময়ে মধুসূদন দান্তের (১২৬৫১৩২১ষষ্ঠ জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি দান্তের উদ্দেশে রচিত একটি চতুর্দশপদী কবিতা স্বকৃত ফরাসি ও ইতালীয় অনুবাদ সহ ইতালির রাজার কাছে প্রেরণ করেন। কবিগুরু সান্তে’ শীর্ষক কবিতাটি তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাবলিরঅন্যতম।১৩ মধুসূদনের ফরাসিচর্চার নিদর্শন হিসেবে কবিতাটির মধুসূদনকৃত ফরাসি গদ্যঅনুবাদ উদ্ধৃত করছি:

 

A Dante

Telle à l’aube du jour, l’étoile doree, la messagère du soleil, chasse de ses rayons lumineux la masse des ténébres, telle, Ô poète, ta splendeur a chassé l’ignorance du monde intellecutal. Ô, béni soit le jour qui te vit naitre! — toi, qui fus le père d’une nouvelle race de poètes dans cette belle partie de notre globe! C’est pour ton culte que la Muse s’est oncore réveillée de son sommeil. Elle avait permis que tu entrasses dans les ténébreuses régions par cette porte ou passent aussi les âmes pécheresses abandonnées de l’espérance : mais toi, noble enfant de la terre, ce fut avec transport que tu y pénètres! Une étoile comme toi, tombe-t-elle jamais du ciel de la renommée? Une fleur comme toi, peut-elle être rongée des vers?

.৪ মধুসূদনের চতুর্দশপদীগুলির মধ্যে একটি চতুর্ধশপদী হল কবিবর ভিকতর হু্গো’১৫। মধুসূদন যখন ফ্রান্সে তখন ফ্রান্সে তখন যে ফরাসি কবির খ্যাতি গগনস্পর্শী তিনি হলেন ভিক্তর য়্যুগো (Victor Hugo, ১৮০২১৮৮৫) এই খ্যাতিমান কবির রচনা বিদেশি কবি মধুসূদনকে আকৃষ্ট আর মুগ্ধ করেছিল। য়্যুগোর উদ্দেশে রচিত কবিতায় মধুসূদনের এই উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া এই কবিতা বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ফরাসি সাহিত্যের প্রথম যোগাযোগনির্দেশক রচনা। পরবর্তীকালে বাংলাভাষায় ফরাসি সাহিত্যচর্চার প্রস্তাবনা হিসেবেও এই কবিতা স্মরণীয়।১৬

.৫ প্রসঙ্গত মধুসূদনের সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতাগুলির চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা যায়। ভের্সাইএ মধুসূদন এই কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি অনুসারে পেত্রার্কার অনুসরণেই এই সনেটগুলি রচিত হয়েছিল।১৭ তবে পেত্রার্কা এবং নবজাগরণপরবর্তী বেশিরভাগ সনেটের বিষয়বস্ত্ত ছিল আদর্শ প্রেম। এদিক থেকে মধুসূদনের সনেট ভিন্নধর্মী। ইয়োরোপে প্রবাসী কবির মনে স্বদেশের স্মৃতিময় যে বিধুরতা জেগেছিল অনেকগুলি কবিতা তারই স্বাক্ষর বহন করছে। মধুসূদনের সনেট এদিক থেকে ষোড়শ শতকের ফরাসি সাহিত্যের সপ্তর্ষিমণ্ডল’এর(La Pléiade) অন্যতম কবি জোয়াকিম দ্যু বেলে (Joachim du Bellay, ১৫২২১৫৬০কিছু সনেটের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতালিতে প্রবাসী কবি দ্যু বেলের কিছু সনেটেও (Les Regrets) রয়েছে স্বদেশ ফ্রান্সের বিধুর স্মৃতি। মধুসূদনেরকপোতাক্ষ নদ’১৮ র্শীর্ষক চতুর্দশপদী কবিতায় আছে:

সততহে নদতুমি পড় মোর মনে।

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়ামন্ত্রধ্বনিতব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে —

বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদদলে

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ?

দুগ্ধস্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমিস্তনে!

আর কি হে হবে দেখা ?

একই মানসিকতা থেকে দ্যু বেলে জন্মভূমি ফ্রান্সেকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন:

Tu m’as nourri longtemps du lait de ta mamelle.

            Les Regrets : France mère des arts…১৯

অন্য একটি সনেটে তিনি বলেছেন:

Quand revoiray-je, hélas, de mon petit village

Fumer la Cheminée…

Plus mon Loyre Gaulois, que le Tybre Latin,

Plus mon petit Lyré, que le mont Palatin,

Et plus que l’air marin la douleur Angevine

[হায়কবে আবার আমি দেখতে পারো আমার ছোট্ট গ্রামের

চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে

ইতালীয় টাইবারের চেয়ে গলীয় লোআর আমার কাছে মনোরম

পালাত্যাঁ শৃঙ্গের চেয়ে আমার ছোট্ট লিরে

আর সামুদ্রিক বাতাসের চেয়ে অঁজুর মাধুর্য।]

                           Les Regrets: Heureux qui comme Ulysse২০

মধুসূদন যে সপ্তদশ শতকের ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলেন তার প্রমাণ আছে।২১ অনুমান করা যায়ষোড়শ শতকের বিখ্যাত কবি পিয়ের দ রোঁসার (Pierre de Ronsard, ১৫২৪১৫৮৫এবং জোয়াকিম দ্যু বেলের রচনার সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটোছিল। অবশ্য চিঠিপত্র বা অন্য কোথাও সে পরিচয়ের কোনো প্রমাণ নেই।২২ মধুসূদন দ্যু বেলে দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন একথা আমরা বলছি নাতবু দ্যু বেলে এবং মধুসূদন প্রায় একই পরিস্থিতিতে ইতালীয় কবিতার (সনেটেরদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়ে যে কবিতা রচনা করেছিলেন তাতে কোথাও কোথাও মানসিকতার সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে মধুসূদনের ফ্রান্সে অবস্থানফরাসি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে মনোযোগআদর্শ প্রেমের ঐতিহ্য থেকে সরে সনেটের বিষয় বির্বাচন — এ সমস্ত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমরা মধুসূদনের আলোচ্য রচনায় দ্যু বেলের আন্তঃরাচনিক উপস্থিতি অনুমান করতে পারি। 

মধুসূদন কর্তৃক লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার অনুলিখন

.১ ফরাসি দেশে অবস্থান কালে মধুসূদন কয়েকটি অসমাপ্ত কাহিনিকাব্য রচনারও সূত্রপাত করেন। ভারত বৃত্তান্ত’ শীর্ষক অসমাপ্ত কবিতাটির ও পরে কবির নির্দেশত তারিখ রয়েছে Versailles, 9th September 1863২৩। চতুর্দশপদী কবিতাগুলি রচনার সমসাময়িক কালে তিনি নীতিগর্ভ কবিতা’ রচনার সূত্রপাত করেন। এর কয়েকটি ফ্রান্সে থাকাকালে লিখিত। বাকিগুলি কলকাতায় ফিরে এসে লেখা।২৪ এই নীতিকবিতাগুলির মাধ্যমে মধুসূদন বাংলা ভাষার সাহিত্যসৃষ্টিকে আন্তঃরাচনিকতার সূত্রেম প্রথম প্রত্যক্ষভাবে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত করেন। সপ্তদশ শতকের ধ্রুপদী ফরাসিসাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল প্রতিভা জঁ দ লা ফোঁতেন (Jean de La Fontaine, ১৬২১১৬৯৫)। নীতিকবিতা বা ছন্দে ফাবল (fables) রচনা লা ফোঁতেনকে ফরাসি সাহিত্যে অমরতা দিয়েছে। ফরাসি সাহিত্য পড়তে গিয়ে মধুসূদন ফরাসি সাহিত্যের অবশ্যপাঠ্য লা ফোঁতেনের নীতিকবিতা দ্বারা আকৃষ্ট হন। এই নীতিকবিতার অবলম্বনে ও অনুসরণে অর্থাৎ অনুলিখনের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় নীতিকবিতা রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য লা ফোঁতেনের বেশির ভাগ নীতিকবিতার অবলম্বন ছিল ইশপ (Æsop, গ্রিক ইসপস/Ασωπος.এজপ/Ésope,আনুমানিক সাধারণপূর্ব ষষ্ঠ শতক), ফেদ্রুস (Phaedrus, আনুসা.-পূ১৫– আনু৫০ সা.) এবং আরো কিছু প্রাচীন নীতিকথাকারদের রচনা। লা ফোঁতেন তাঁর নীতিকথার সংকলন ফাবল/Fablesএর প্রথম খণ্ডে (১৬৬৮নীতিকথা শ্রীযুক্ত দ লা ফোঁতেন দ্বারা নির্বাচিত ও পদ্যে উপস্থাপিত’ (Fables choisies mises en vers par M. de La Fontaine) ― এই ঔপরাচনিক শিরোনামে তাঁর নীতিকবিতার চরিত্র নির্দেশ করেন ও ঐ খণ্ডের উত্সর্গপত্রে লা ফোঁতেন ইসপএর নীতিকথায় কবিতার অলংকার’ (les ornements de la poésie) যোগ করার কথা উল্লেখ করেন২৫। প্রসঙ্গত আমরা জানি প্রাচীন যেসব নীতিকথাকারকে তিনি অনুসরণ করেছেন তাঁদের রচনার অন্যতম প্রধান সূত্র ছিল প্রাচ্যবিশেষভাবে ভারতীয় নীতিকথা ― পঞ্চতন্ত্রহিতোপদেশ ও জাতকের কাহিনি। আরবি ও ফারসি অনুরচনার মাধ্যমে ভারতীয় নীতিকথার সঞ্চালন ইয়োরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।

জঁ দ লা ফোঁতেন তাঁর নীতিকবিতার সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডের (১৬৭৮ভূমিকায় ভারতীয় জ্ঞানী পিলপাইএর (Pilpay) কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করেন:

নীতিকবিতার দ্বিতীয় একটি সংকলন আমি জনসাধারণের সামনেউপস্থিত করছি… কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে আমি জানাতে চাই যে এর সবচেয়ে বড় অংশের জন্য আমি ভারতীয় জ্ঞানী পিলপায়এর কাছে ঋণী। এই জ্ঞানীর বই সমস্ত ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর দেশের লোক তাঁকে খুবই প্রাচীন বলে বিবেচনা করে

[Voici un second recueil de fables que je présente au public… je dirai, par reconnaissance, que j’en dois la plus grande partie à Pilpay, sage Indien. Son livre a été traduit en toutes les langues. Les gens du pays le croient fort ancien…২৬]

এছাড়া আরো তিনটি নীতিকবিতায় লা ফোঁতেন পিলপাইএর নাম করেন২৭ মুখে মুখে প্রচলিত কিছু প্রাচীন ভারতীয় নীতিকাহিনি (কথা/कथा)সাধারণপূর্ব চতুর্থ বা তৃতীয় শতকে পাঁচটি খণ্ডে (তন্ত্রে)বিভক্ত নীতিশাস্ত্র’ (नीतिशास्त्रम्) পঞ্চবতন্ত্র (पञ्चतन्त्रम्)শিরোনামে সংকলিত হয়। ঐতিহ্যানুসারে এই সংকলনের রচয়িতা (সংকলকবিষ্ণুশর্মা (विष्णुशर्मन्)। এই নীতিকাহিনিগুলি সাধারণ অব্দের ষষ্ঠ শতকে পহ্লবি ভাষায় অনূদিত হয়। এর পর এই কাহিনিগুলির সিরিয়াকআরবি এবং আরবি থেকে হিব্রুগ্রিক ও ল্যাটিন ও বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষায় অনুলিখিত হয়। বিভিন্ন অনুবাদে এই কাহিনিগুলির রচয়িতার নাম নির্দেশিত হয় পিপলাই (Pilpai/Pilpay/Pilpaï) বা বিদপাই(Bidpai/Bidpay/Bidpaï) যা মনে হয় সংস্কৃত ‘বিদ্যাপতি’ (विद्यापति) নামের বিকৃত প্রতিবর্ণীকরণ। লা ফোঁতেন ত্রয়োদশ শতকে হিব্রু থেকে জন অভ কাপুয়া (Johannis de Capua) কর্তৃক ল্যাটিনে অনূদিত Liber Kelile et Dimne, Directorium Vite Humane ও আরবি থেকে ইস্পাহানের দাভিদ সাহিব (দাভিদ সাইব দিস্পাঅঁ/David Sahib d’Ispahan) অভিধায় পরিচিত গোলম্যাঁ (David Gaulmin) নামে ফরাসির ফরাসিতে অনূদিত Le Livre des lumières ou la Conduite des Rois (১৬৪৪গ্রন্থে এই নীতিকাহিনিগুলি পড়েন। লা ফোঁতেনএর নীতিকবিতার অন্তত বারোটি কবিতার কাহিনি পঞ্চতন্ত্র থেকে নেওয়া২৮। বস্তুত লা ফোঁতেনের এই নীতিকবিতাগুলি আন্তঃসাংস্কৃতিকআন্তঃসাহিত্যিক তথা আন্তর্ভাষিক পরিগ্রহণ তথা অনুরাচনিক সৃষ্টির দৃষ্টান্ত। আবার যেসব নীতিকাহিনির বেশির ভাগেরই উত্স প্রাচ্যঐতিহ্য তার রূপান্তরিত পাশ্চাত্য রূপ ইংরেজি অনুবাদে ইশপএর নীতিকথা হিসেবে এদেশে ফিরে আসতে শুরু করে। নীতিকাহিনির এই দেশপরিক্রমারূপান্তর বা/এবং প্রত্যাবর্তন কৌতুহলোদ্দীপক। মধুসূদনের নীতিকবিতাগুলি তাই নীতিকথার পরাসাংস্কৃতিক সঞ্চালন ও রূপান্তরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মধুসুদনের বাংলা নীতিকবিতার প্রাথমিক অবলম্বন ছিল সংস্কৃত নীতিকাহিনি নয়, লা ফোঁতেনএর ফরাসি নীতিকবিতা। গৌরদাস বসাককে একটি চিঠিতে (২৬এ অক্টোবর, ১৮৬৪তিনি লিখেছেন:

I have not been doing much in poetical line of late, beyond imitating a few Italian and French things.২৯

এখানে Italian and French thing’ বলতে মধুসূদন অবশ্যই সনেট ও নীতিমূলক কবিতার প্রতি নির্ধেশ করেছেন।

.২ মধুসূদনের নীতিগর্ভ কাব্যএর সংখ্যা এগারো। এর মধ্যে দেবদৃষ্টি’ কবিতাটি রচনারীতির দিক থেকে মধুসুদনের নীতিকবিতাগুলির সমগোকত্রীয় হলেও চরিত্রে নীতিকবিতা নয়বাকি দশটি কবিতা নীতিমূলক। এর মধ্যে অনন্ত আটটি কবিতা লা ফোঁতেনের কবিতার অবলম্বনে রচিত। বাকি দুটি কবিতাও একই আদর্শে লেখা। লা ফোঁতেনের মূল কবিতাগুলির নির্দেশসহ আমরা মধুসূদনের আটটি কবিতার তালিকা উপস্থিত করছি:

মধুসূদনের কবিতা

লা ফোঁতেনের কবিতা

ময়ুর ও গৌরী

কাক ও শৃগালী

রসাল ও স্বর্ণলতিকা

অশ্ব ও কুরঙ্গ

গদা ও সদা

কুক্কুট ও মণি

পীড়িত সিংহ ও অন্যান্য পশু

সিংহ ও মশক

Le Paon se plaignant à Junon [II-XVII]*

Le Corbeau et le Renard [I-II]

Le Chène et le Roseau [I-XXII]

Le Cheval s’étant voulu venger du Cerf  [II-XIII]

Les Deux Mulets [I-IV]

Le Coq et la Perle [I-XX]

Le Lion malade et le Renard [VI-XIV]

Le Lion et le Moucheron [II-IX]

তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে রোমান সংখ্যা লা ফোঁতেনএর নীতিকবিতার সংকলনের খণ্ড ও কবিতার সংখ্যা নির্দেশক।

এই কবিতাগুলির৩০ মধ্যে কাক ও শৃগালী‘ কবিতার শেষ কয়েকটি চরণ পাওয়া যায়নি, ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’ কবিতার মাঝের কয়েকটি চরণ কীটদস্ট হয়ে হারিয়ে গেছে এবং সিংহ ও মশক’‘ কবিতাটি অসমাপ্ত।

মধুসূদনের অনুরচনার অনুলিখন– পদ্ধতি

.১ তাঁর জীবনের অন্তিমপর্বে (১৮৬৭ নাগাদমধুসূদন হোমারএর (Homer,গ্রিকওমিরস/μηρος) ‘ইলিয়াড’ (Iliad, গ্রিক ইলিয়াস /ইলিয়াদাস /Ιλιάς/Ιλιάδας)মহাকাব্যের অবলম্বনে হেক্টরবধ’ শিরোনামে একটি গদ্যরচনা শুরু করেন। রচনাটি ১৮৭১ সালে অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি উত্সর্গ করা হয় ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে। উত্সর্গপত্রে আন্তঃসাহিত্যিকআন্তর্ভাষিক পরিগ্রহণ তথা অনুলিখনের আদর্শ ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে মধুসূদনের মতামত স্পষ্ট:

কাব্যখানি পাঠ করিলে টের পাইবেযে আমি কবিগুরুর মহাকাব্যের অবিকল অনুবাদ করি নাইতাহা করিতে হইলে অনেক পরিশ্রম হইত,এবং সে পরিশ্রমও যে সর্ব্বতোভাবে আনন্দোত্পাদন করিতএ বিষয়ে আমার সংশয় আছে। স্থানে স্থানে এই গ্রন্থের অনেকাংশ পরিত্যক্ত এবং স্থানে স্থানে অনেকাংশ পরিবর্ত্তিত হইয়াছে।বিদেশীয় একখানি কাব্য দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করিয়া আপন গোত্রে আনা বড় সহজ ব্যাপার নহেকারণ তাহার মানসিক ও শারীরিক ক্ষেত্র হইতে পর বংশের চিহ্ন ও ভাব সমুদায় দূরীভূত করিতে হয়।৩১

এই বক্তব্যের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক (বর্তমান ক্ষেত্রে ইয়োরোপীয়/ফরাসি থেকে ভারতীয়/বাঙালি সংস্কৃতিতেপরিগ্রহণের ভিত্তিতে আন্তঃসাহিত্যিক (বর্তমান ক্ষেত্রে ফরাসি থেকে বাংলা সাহিত্যে), আন্তর্ভাষিক (বর্তমান ক্ষেত্রে ফরাসি থেকে বাংলা ভাষায়অনুলিখনের (অনুকরণ/অনুবাদ/অবলম্বনেরঅন্যভাবে অনুরাচনিক সংকরায়ণের (টীকা ১ দ্রষ্টব্যসমস্যা সম্পর্কে মধুসূদনের সচেতনতা ও তার সমাধানের পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা প্রকাশিত। বস্তুত আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের ভিত্তিতে আন্তঃসাহিত্যিকআন্তর্ভাষিক অনুলিখন কেবলমাত্র একটি ভাষায় যা বলা হয়েছে অন্য একটি ভাষায় মোটামুটি তা বলে দেওয়া নয়৩২তার চেয়ে অনেক বেশিবলা যায় এক সংস্কৃতিকে অন্য এক সংস্কৃতিতেজটিল এক সাংস্কৃতিক তন্ত্রের জগৎকে অন্য এক সাংস্কৃতিক তন্ত্রের জগতে স্থানান্তরউপস্থাপন। এই পরিপ্রেক্ষিতে উৎস ও লক্ষ্য ভাষা/সাহিতের ভৌগোলিকঐতিহাসিক তথা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিক সান্নিধ্য বনাম দূরত্বের ভিত্তিতে আমরা আন্তঃসাহিত্যিকআন্তর্ভাষিক অনুলিখনকে অন্তিক এবং দূরান্তিক এই দু শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি। ভৌগোলিক(আবহাওয়াউদ্ভিৎজগৎপ্রাণীজগৎ) ঐতিহাসিক সান্নিধ্য এবং ইয়োরোপীয় গ্রেকোরোমান ও জুডিওখ্রিস্টান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে ফরাসি সংস্কৃতি/সাহিত্য/ভাষা যথাক্রমে ইতালিয়ানস্প্যানিশইংরেজি বা জার্মানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক/সাহিত্যিক/ভাষিক দিক থেকে যতটা নিকটবর্তী বাংলাহিন্দি বা তামিল সংস্কৃতি/সাহিত্য/ভাষার সঙ্গে তা নয়। তাই কোনো ফরাসি সাহিত্যিক রচনার ইয়োরোপীয় কোনো ভাযায় অনুরচনা (অনুকরণ/অবলম্বন/অনুবাদআপেক্ষিকভাবে অন্তিক অনুলিখন আর ঐ একই রচনার বাংলাহিন্দিতামিল ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় অনুরচনা দূরান্তিক অনুলিখন/ দুক্ষেত্রে সমস্যার চরিত্র এবং বিস্তার সম্পূর্ণ ভিন্ন। লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার অনুলিখনে মধুসূদন তাঁর কথিত দত্তক’ গ্রহণ ও তাকে ‘আপন গোত্রে’ অভিযোজনের  পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।

.২ মুদ্রণসংস্কৃতির ষুগের ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিপাঠকের প্রত্যাশা পুরণের জন্য পাঠ্য কবিতা রচনা করতে গিয়ে মধুসূদন বাংলা কাব্যের প্রকাশপ্রকরণে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য থেকে চতুর্দশপদী কবিতবলি পর্যন্ত কবিতার মধ্যে বাক্যের অর্থবোধক ছেদ ও ছন্দসংগঠনের যতির সহাবস্থান লুপ্ত করে প্রবহমানতার (enjambement) প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতায় ছন্দে বিপ্লব সম্পন্ন করেন ― সৃষ্টি করেন মিলহীন (অমিত্রাক্ষর) ও সমিল প্রবহমান কাব্যভাষা।মধুসূদনের নীতিকবিতাগুলিতে এই বিপ্লবকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস দেখা যায়। তাঁর এই প্রয়াস লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার অনুলিখনের অপরিহার্য অংশ। অন্যভাবে বলা যায় লা ফোঁতেনের রচনার আদর্শে মধুসূদন তাঁর অনুরচনায় তাঁর ইতিপূর্বে ব্যবহৃত সমিল প্রবহমান ছন্দসংগঠনকে আরো গতিময়আরো পরিবর্তিত করেন। লা ফোঁতেন তাঁর পদ্যে রচিত ফাবল বা নীতিকথায় মিশ্র ছন্দ’ বা ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’৩৩ ব্যবহার করেছিলেন। বস্তুত নীতিকবিতা রচনার বেশ কয়েক বছর আগে লা ফোঁতেন তাঁর পদ্যে রচিত ‘কাহিনি’র (Contes et Nouvelles en vers, ১৬৬৫) প্রথম খণ্ডের ‘প্রস্তাবনা’য় (Avertissement) জানান:

কাহিনিগুলিকে সমিল পদ্যে প্রকাশ করার জন্য কোন রূপটা সবচেয়ে যথাযথ হতে পারে রচয়িতা তা বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে অসম ছন্দোবদ্ধ পদ্যের মধ্যে অনেকটা গদ্যের ভাব রয়েছে বলে এই ধরনটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক আর তার ফলে সবচেয়ে ভালো বলে মনে হওয়া সম্ভব।

[L’auteur a voulu éprouver lequel caractère est le plus propre pour rimer des contes. Il a cru que les vers irréguliers ayant un air qui tient beaucoup de la prose, cette manière pourrait sembler la plus naturelle, et par conséquent la meilleure.৩৪ ]

উক্ত উপলব্ধি থেকে তিনি প্রথমে তাঁর কাহিনিতে পরে তাঁর নীতিকবিতায় পরপর সমান অক্ষর (বা দলসিলেবল/syllable) সমন্বিত চরণের পরিবর্তে বিভিন্ন চরণে অক্ষরের সংখ্যা কমিয়ে বাড়িয়ে কাহিনির উপযোগী নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য অসম অক্ষরবিন্যাসের। চরণ ব্যবহার করেছিলেন। মধুসূদনও লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার অনুরচনায় লা ফোঁতেনেরই আদর্শে প্রবহমানতা রক্ষা করে অক্ষরবৃত্তের বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের পর্ব (//১০বা/এবং পর্বসমবায়ে ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ বা মিশ্র পর্বের অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’৩৪ উদ্ভাবন ও ব্যবহার করেন আর তার সঙ্গে যোগ করেন মিলবিন্যাসের অভিনবত্ব। লা ফোঁতেনের আদর্শে রচিত এই নীতিকবিতাগুলির ছন্দ ও মিলবিন্যাসের বৈচিত্র্যের দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করছি:

ময়র কহিল কাঁদি গৌরীর চরণে, ( ১৪

কৈলাস ভবনে — (

অবধান কর দেবি, (

আমি ভৃত্য নিত্য সেবি (

প্রিয়োত্তম সুতে তব ও পৃষ্ঠআসনে। (৬ ১৪) 

রথী যথা দ্রুত রথে, (

চলেন পবনপথে (

দাসের এ পিঠে চড়ে সেনানী সুমতি; ( ৬ ১৪)

তবুমা গোআমি দুখী অতি ! (৬ ১০

(ময়ুর ও গৌরী৩৬)

ধিক্দুষ্টমতি (

মারি তোরে বনজীবে দিবরেকুমতি। (৬ ১৪

হইল বিষম রণতুলনা না মিলে; (৬ ১৪

ভীম দুর্যোধনে, (

ঘোর গদারণে, (

হ্রদদ্বৈপায়নে, (

তীরস্থ সে রণছায়া পড়িল সলিলে; (৬ ১৪

(সিংহ ও মশক৩৭)

.লা ফোঁতেনের কবিতার বহিরঙ্গপ্রকরণ ও অন্তরঙ্গ চরিত্রকে অনুসরণ করলেও একথা অনস্বীকার্য যে ঐ ফরাসি কবির কবিতার স্বচ্ছন্দ গতিময়তা মধুসূদনের নীতিকবিতায় নেই। লা ফোঁতেনের ধ্রুপদী স্বচ্ছতাছন্দমিল ও বাগভঙ্গির আশচর্য স্বাভাবিকতাসর্বোপরি বুদ্ধি ও কৌতুকদীপ্ত গতিময় কাব্যবাচন মধুসূদনের নীতিকবিতায় প্রায় অনুপস্থিত। বস্ত্ততপক্ষে মধুসূদনের লিখন ছিল লা ফোঁতেনএর সরসস্বচ্ছন্দ নীতিকবিতার লিখনের প্রায় বিপ্রতীপ। সেই লিখনকে যথাসাধ্য পরিবর্তন করে মধুসূদন নীতিকবিতা রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। দেখা যায়একই সময়ে লেখা কবির সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতাগুলির বেশিরভাগ নীতিকবিতার তুলনায় সাবলীল,স্বভাবিক — কারণ মধুসূদনের লিখনকে সেখানে খুব একটা পরিবর্তিত করতে হয় নি। সঙ্গে সঙ্গে একথাও স্মরনীয় যে মহাকবির গান্ভীর্য নিয়ে কাব্যরচনার স্তিমিতপ্রায় শেষ পর্বে মধুসূদন এই নীতিকিতাগুলি রচনা করেছিলেন।৩৮ লা ফোঁতেনএর নীতিকবিতায় কাহিনিচরিত্রনাটকীয়তাসহাস্য সাবলীলতাকবিতার ছন্দ ও ধ্বনিময়তা হল প্রধাননীতিউপদেশ অনুচ্চারিতব্যঞ্জিত। পক্ষৈন্তরে মধুসূদনের কবিতাগুলি ক্লিষ্ট ও নীরস — নীতি উপদেশ সেখানে সরবশেষপর্যন্ত এই রচনাগুলি একান্তভাবে ‘নীতিগর্ভ কবিতা’। তবু মধুসূদনের এই কাব্যকৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সনেট ও এই নীতিকবিতার মাধ্যমে মধুসূদন ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য আধুনিক ইউরোপীয় ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে সরাসরি বাংলা সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিক যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাছাড়া তাঁর কাব্যরচনার স্তিমিত পর্বেও লা ফোঁতেনের আদর্শে মধুসূদন বাংলাভাষায় নতুন এক ধরনের কবিতা সৃষ্টি করলেন,প্রকরণ এবং ছন্দেরও নতুন সম্ভাবনার পথ দেখিয়ে গেলেন। প্রসঙ্গত একথাও বলা দরকার যেমধুসূদনের নীতিকবিতাকে পেরিয়ে পরবর্তীকালের বাংলা নীতিকবিতা খুব একটা এগোতে পারেনি। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বিখ্যাত নীতিকবিতার সংকলনসদ্ভাবশতকএ বা সমসাময়িক অন্যান্য লেখকের নীতিকবিতায় আমরা যে ধরণের ক্লিষ্টসাহিত্যগুণ বিবর্জিত লিখনের সাক্ষাৎ পাই তা মধুসূদনপরবর্তী বাংলা নীতিকিতার পশ্চাদপসারণই সূচিত করে। এমনকি রবীন্দ্রনাথও এই ধারাকে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যান নি। তাঁর কণিকা কাব্যের নীতিকবিতাগুলি (‘প্রচীরের গায়ে এক নাম গোত্রহীন…’, ‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম…’ ইত্যাদিপরীক্ষার ভাবসম্প্রসারণের জন্য ব্যবহার্য হলেও কাব্যকৃতি হিসেবে উচ্চ মার্গের নয়।

.৪ আলোচ্য নীতিকবিতাগুলির রচনাকালে মধুসূদন যে লা ফোঁতেনের কবিতার অবলম্বন বা অনুসরণ করেছেন একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছেতাঁর নিজের ভাষায়তিনি ‘ফরাসি বিষয়ের’ imitation’ বা অনুকরণ করেছেন। কিন্তু মধুসূদনের বাংলা ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টির শুরু থেকেই দেখা যায় যেতিনি আন্তঃসাংস্কৃতিকআন্তর্ভাষিক পরিগ্রহণের পদ্ধতিগত কৌশল হিসেবে বিদেশি সাহিত্য থেকে পরিগৃহীত উপাদানকে দেশীয়করণ বা স্থানীয়করণে অর্থাৎ দেশীয় ঐতিহ্যের উপাদানে রূপান্তরের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আত্তীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন। বস্তুত আন্তঃসাংস্কৃতিকআন্তর্ভাষিক দূরান্তিক পরিগ্রহণের মাধ্যমে বাংলায় লা ফোঁতেনের ফরাসি নীতিকবিতার অনুলিখনেও মধুসূদন একই মানসিকতা দ্বারা অনুপ্রাণিতপরিচালিত হয়েছিলেন। প্রথমেই উদ্দিষ্ঠ পাঠকের পঠনের সহায়কদিগনির্দেশক উপরচনা রচনার শিরোনামের দিকে তাকালে দেখা যায় ইয়োরোপের পৌরাণিক ঐতিহ্যঅনুষঙ্গের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত রোমক দেবি জুনো ভারতীয় দেবী গৌরীতে রূপান্তরিত হয়েছেনওক (ইয়োরোপীয় গাছআর নল খাগড়া দেশীয় ঐতিহ্যানুগ রসাল ও স্বর্ণলতিকার রূপান্তর লাভ করেছে। কবিতার কাহিনিনির্মাণ ও বিন্যাসে মধুসূদন কিভাবে কতটা লা ফোঁতেনকে গ্রহণ ও পরিবর্তন করেছেন তা দৃস্টান্তসহ আলোচনা করা যায়।

.৫ মধুসূদনের কুক্কুট ও মণি’ কবিতাটি লা ফোঁতেনের ‘মোরগ (= কুক্কুটও মুক্তা’(Le Coq et la Perle) অবলম্বনে রচিত। মূল কবিতাটি দুই স্তবকেরপঙক্তি সংখ্যা১২। কবিতাটি উদ্ধৃত করা যাক:

Un jour un coq détourna

Une perle, qu’il donna

Au beau premier lapidaire.

“Je la crois fine, dit-il.

Mais le moindre grain de mil

Serait bien mieux mon affaire.”

Un ignorait hérita

D’un manuscrit qu’il porta

Chez son voisin le libraire.

”Je crois, dit-il, qu’il est bon;

Mais le moindre ducaton

Serait bien mieux mon affaire.”৩৯

[শব্দার্থ: একটি মোরগ (মাটিখুঁড়ে বের করল একটি মুক্তাযা ও দিল প্রথম(দেখা পাওয়াজহুরিটিকে সে বলল, ‘মনে হয় ওটা (=জিনিষটাসুন্দর; / তবে সবচেয়ে ছোট্ট একটা ভুট্টার দানা ওর চেয়ে আমার বেশি কাজে লাগত।’

এক মূর্থ উত্তরাধিকারসূত্রে পেল একটা পুঁথি যা সে নিয়ে গেল তার প্রতিবেশী বইয়ের দোকানদারের কাছে ।’সে বলল, ‘মনে হয় এটা ভালো; / তবে সামান্যতম একটা পয়সা এর চেয়ে আমার অনেক বেশি কাজে লাগত।’]

এর অবলম্বনে রচিত মধুসূদনের কবিতাটি নিম্নরূপ:

খুঁটিতে খুঁটিতে ক্ষুদ্র কুকুট পাইল

একটি রতন: —

বণিকে সে ব্যগ্রে জিজ্ঞাসিল; —

ঠোঁটের বলে না টুটেএ বস্ত্ত কেমন?’

বণিক্ কহিল, — ‘ভাই,

এ হেন অমূল্য রত্নবুঝিদুটি নাই।’

হাসিল কুকুট শুনি; — ‘তণ্ডুলের কণা

বহুমূল্যতের ভাবি; — কি আছে তুলনা?’

নহে দোষ তোরমূঢ়দৈব এ ছলনা,

জ্ঞানশূন্য করিল গোঁসাই!’ —

এই কয়ে বণিক্ ফিরিল!

মূর্খ যেবিদ্যার মূল্য কভু কি সে জানে?

এরকুলে পশু বলি লোকে তারে মানে; —

এই উপদেশ কি দিলা এই ভানে।৪০

চোদ্দ পংক্তির এই কবিতায় মধুসূদন লা ফোঁতেনের কবিতার ছয় পংক্তির প্রথম স্তবকের কাহিনিকে গ্রহণ করেছেন। উত্স কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের কাহিনিকে তিনি বর্জন করেছেন৪০। তবে ‘মূর্খ যে বিদ্যার মূল্য কভু কি সে জানে’ পংক্তিটি মূল কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের কাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাছাড়া লা ফোঁতেনের কবিতায় নীতিউপদেশ অনুচ্চারিতকাহিনির মধ্যে নিহিত। বিশেষভাবে প্রথম কাহিনির যৌক্তিক অনুক্রম হিসেবে দ্বিতীয় কাহিনি নিহিত নীতিবার্তাকে উপলব্ধি করায়। কিন্ত্ত মধুসূদনের কবিতায় নীতিউপদেশ সোচ্চারকাহিনি এবং বাচনের ব্যঞ্জনাবৃত্তিকে অগ্রাহ্য করেকাহিনিকথক বাখথাকারকে সরিয়ে দিয়ে রচয়িতা কবি নিজে সেখানে উপদেষ্টাবক্তার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।

.৬ এবার দৃষ্টান্ত হিসেবে মধুসূদনের সুপরিচিত ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’ কবিতাটি নেওয়া যাক। লা ফোঁতেনের ‘ওকগাছ ও নলখাগড়া’ (Le chêne et le Roseau)অবলম্বনে কবিতাটি রচিত। মূলের তুলনায় মধুসূদনের কবিতাটি দীর্ঘতর। মূলের আরম্ভে আছে:

Le chêne, un jour, dit au Roseau:

Vous avez bien sujet d’accuser la nature;

Un roitelet pour vous est un pesant fardeau;

Le moindre vent qui d’aventure

Fait rider la face de l’eau

Vous oblige à baisser la tête;

Cependant que mon front, au Caucase pareil.

Non content d’arrêter les rayons du soleil,

Brave l’effort de la tempête.

Tout vous est aquilon, tout me semble Zéphyr.৪১

[শব্দার্থ: একদিন ওকগাছ নলখাগড়াকে বলল: / ‘প্রকৃতিকে দোযারোপ করার যথার্থ কারণ আপনার রয়েছে; / একটি রোআৎলে৪২ পাখি আপনার কাছে একটি ভারি বোঝা; / সামান্যতম বাতাস যা হঠাৎ /জলের মুখমণ্ডলকে রেখাঙ্কিত করে / (তাআপনাকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেসেখানে ককেসাস পর্বতসদৃশ আমার কপাল /সূর্যরশ্মিকে প্রতিহত করেও সন্ত্তষ্ট না হয়ে ঝড়ের তৎপরতার সম্মুখীন হয়। আপনার কাছে সবই উত্তরের হিমবায়ুআমার কাছে সবই যেন মলয়পবন।’]

মধুসূদনের কবিতার প্রথমাংশে রয়েছে:

রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে; —

শুনে মোর কথাধনিনিন্দ বিধাতারে।

নিদারশ তিনি অতি;

নাহি দয়া তব প্রতি:

তেই ক্ষুদ্রকায়া করি সৃজিলা তোমারে।

মলয় বহিলেহায়,

নতশিরা তুমি তায়,

মধুকরভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;

হিমাদ্রিসদৃশ আমি

বনবৃক্ষকুলস্বামী,

মেঘলোকে উঠে শির আকাশ ভেদিয়া !

কালাগ্নির মত তপ্ত তপন তাপন, —

আমি কি লো ভরাই কখন৪৩

এখানেও মূল কবিতার কাহিনি অনুসরণ করে মধুসূদন অনেকটা স্বাধীনভাবে তাকে বিন্যস্ত করেছেন। দেশীয় ভৌগোলিক ও পরিচিত ঐহিত্যানুগ পরিবেশে কাহিনিকে সংস্থাপনের প্রয়োজনে উপকরণগত পরিবর্তন এসেছে — ‘ওক’, ‘নলখাগড়া’, ‘প্রকৃতি’, ‘রোআৎলে পাখি’ এবং ‘ককেসাস’ যথাক্রমে ‘রসাল’স্বর্ণলতিকা’, ‘বিধাতা’, ‘মধুকর’ এবং ‘হিমাদ্রি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। এই রূপান্তরিত দেশীয় উপকরণগুলির অনুযঙ্গঅনুসারে ও বাস্তবতার যুক্রিক্রমে কাহিনিরও পরিবর্তন ঘটেছে।

লা ফোঁতেনের কবিতার শেষ অংশে আছে:

Du bout de l’horizon accourt avec furie

Le plus terrible des enfants

Que le Nord eût portés jusque-là dans ses flancs.

L’arbre tient bon ; le Roseau plie.

Le vent redouble ses efforts,

Et fait si bien qu’il déracine

Celui de qui la tête au ciel était voisine

Et dont les pieds touchaient à l’empire des morts.

[শব্দার্থ: দিগবলয়ের প্রচণ্ডভাবে ছুটে আসে / সবচেয়ে দুরন্ত / শিশুটি /উত্তরদিক যাকে এ তাবৎ কক্ষে ধারণ করে ছিল। / গাছের কিছুই হয় না/ নলখাগড়া নুয়ে পড়ে। / বায়ু তার তত্পরতাকে দ্বিগুণ করে / আর এমনই দারুণ করে যে সে উপড়ে ফেলে / তাকে যার মাথা আকাশের প্রতিবেশী হয়ে ছিল / আর যার পা ছুঁয়ে ছিল মৃতের সাম্রাজ্য(পাতালকে)]

মধুসূদনের রূপন্তর:

উড়িল গগনে

যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীরা স্বননে;

আইলেন প্রভঞ্জন,

সিংহনাদ করি ঘন,

যথা ভীম ভানসেন কৌরব সমরে।

আইল খাইতে মেঘ দৈত্যকূল রড়ে;

ঐরাবত পিঠে চড়ি

রাগে দাঁত কড়মড়ি,

ছাড়িলেন বজ্র ইন্দ্র কড় কড় কড়ে।

উরু ভাঙ্গি কুরুরাজে বধিলা যেমতি

ভীম যোধপতি,

মহাঘাতে মড়মড়ি

রসাল ভূতলে পড়ি,

হায়বায়ুবলে

হারাইলা আয়ুসহ সর্প বনস্থলে।

উর্ধ্বশিরা যদি তুমি কুল মান ধনে:

করিওনা ঘৃণা তবু নীচশির জনে !

এই উপদেশ কবি দিলা এ কৌশলে।৪৪

এখানে স্থানীয়করণের মাধ্যমে মূল কাহিনির সূত্রটিকে দেশীয় ঐতিহ্যে সংস্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে তা নিজস্ব গতিতে এগিয়ে গেছে। শুধু কাহিনির সমাপ্তি মূলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মনে হয়প্রভঞ্জন’ এবং উপমানবাচক ‘ভুীমসেন’ সহসা মেঘনাদবধরচয়িতা মধুসূদনের সহাকাব্যরচনার স্মৃতিকে মুহূর্তের জন্য জাগ্রত করেছে। সেই স্মৃতির উদবোধন ‘হারাইলা আয়ুসহ দর্প বনস্থলে’তে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। অতঃপর মধুসূদন নীতিউপদেশ রচনার দায়িত্ব স্মরণ করেছেন। আলোচ্য অংশের প্রায় বীররসাত্মক বর্ণনা এবং অবশেষে সোচ্চার নীতিউপদেশ কবিতার কাহিনিরস ও স্বচ্ছন্দ গতির পরিপন্থী বলে বোধ হয়। তাছাড়া অন্যান্য নীতিকবিতার মত এই কবিতাকেও বাগাড়ম্বরে বিস্তৃত করা হয়েছে। লা ফোঁতেনের ধ্রুপদী সংহতি মধুসূদনের রচনায় থাকে নি। মূল কবিতাটি যেখানে বত্রিশ পংক্তিরসেখানে মধুসূদনের কবিতার পংক্তিসংখ্যা (পাণ্ডুলিপির বিনষ্ট কয়েক পংক্তি বাদ দিয়েও)

.৭ আমরা শেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করছি লা ফোঁতেনের ‘কাক ও শেয়াল’ (Le Corbeau et le Renard) কবিতাটি:

Maître Corbeau, sur un arbre perché ;

Tenait en son bec un fromage.

Maître Renard, par l’odeur alleché

Lui tint a peu près ce langage :

”Hé ! Bonjour, Monsieur du Corbeau,

Que vous êtes joli ! que vous me semblez beau !

Sans mentir, si votre ramage

Se rapporte à votre plumage.

Vous êtes le phénix des hôtes de ces bois.

A ces mots le corbeau ne se sent pas de joie :

Et, pour montrer sa belle voix,

Il ouvre un large bec, laisse tomber sa proie.

Le Renard s’en saisit, et dit : ”Mon bon Monsieur,

Apprenez que tout flatteur

Vit aux dépens de celui qui l’écoute.

Cette leçon vaut bien un fromage, sans doute”

Le Corbeau, honteux et confus,

Jura, mais un peu tard, qu’on ne l’y prendrait plus.৪৫

[শব্দার্থ: কাক মশায়গাছের দাঁড়ে বসেতার ঠোঁটে ধরে রেখেছিল এক খণ্ড পনির। শেয়ালমশায় গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে, / তার উদ্দেশে প্রায় একরকম বাক্য প্রয়োগ করল: / ‘এই যে’ নমস্কার শ্রীযুত কাকেশ্বর /আপনি কী ভালো দেখতে আপনাকে আমার কী যে সুন্দর বলে মনে হচ্ছে। সত্যি বলতে কিআপনার কাকলি আপনার পালকের সমতুল্য হলে আপনি এই বনের অধিবাসীদের মধ্যে ফিনিক্স হতেন।এসব কথায় কাক আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল আর তার মনোহর কণ্ঠস্বর দেখাতে গিয়ে সে বিরাট এক হাঁ করলফেলে দিল তার লুঠের মাল। শেয়াল সেটা লুফে নিল আর বলল: ‘সদাশয় মশাই, /জেনে রাখুন প্রতিটি চাটুকার তার কথা যে শোনে তার ঘাড়ে জীবন কাটায়। নিঃসন্দেহে এ শিক্ষার দাম এক খণ্ড পনির তো বটে,’ /লজ্জিত আর হতবুদ্ধি কাক, / প্রতিজ্ঞা করল, / তবে একটু দেরিতে,যে তাকে আর এভাবে কেউ ঠকাতে পারবে না।]

এই কবিতা অবলম্বনে রচিত মধুসূদনের ‘কাক ও শৃগালী’ কবিতাটি। পাণ্ডুলিপি কীটদষ্ট হওয়ায় এই কবিতার শেষ কিছু পংক্তি পাওয়া যায় নি। অসমাপ্ত কবিতাটি হল:

একটি সন্দেশ চুরি করি,

উড়িয়া বসিলা বৃক্ষোপরি,

কাকহৃষ্টমনে;

সুখাদ্যের বাস পেয়ে

আইল শৃগালী ধেয়ে,

দেখি কাকে কহে দুষ্টা মধুর বচনে; —

অপরূপ রূপ তবমরি

তুমি কি গো ব্রজের শ্রীহরি,

গোপিনীর মনোবাঞ্ছা? —

হে নব নীরদকান্তি,

ঘুচাও দাসীর ভ্রান্তি,

জুড়াও এ কান দুটি করি বেণুধ্বনি।

পুণ্যবতী গোপবধু অতি।

তেঁই তারে দিলা বিধি,

তব সম রূপনিধি, —

মোহ হে মদনে তুমিকি ছার যুবতী?

গাও গীতগাওসখে করি এ মিনতি।

কুড়াইয়া কুসুম রতনে

গাঁথি মালা সুচারু গাঁথনে৪৬

প্রথমেই চোখে পড়ে মূল কবিতার ‘শেয়াল’ এখানে ‘শৃগালী’তে রূপান্তরিত। মনে হয় মূলের কাহিনিসূত্রটিকে মধুসূদন বৈষ্ঞব সাহিত্যের ঐতিহ্যানুগ পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে চেয়েছেন বলেই এই রূপান্তরসেই অনুষঙ্গই পরবর্তী অংশের প্রকাশ ও গতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং এসেছে বাগাড়স্বব। যার ফলে মূল কবিতায় শৃগালের প্রথম উক্তি যেখানে পাঁচ পংক্তিতে সমাপ্তসেখানে মধুসূদনের কবিতার অসমাপ্ত রূপে তের পংক্তিতে ‘শৃগালী’র উক্তি সম্পূর্ণ হয় নি। এখানেও যেন নীতিকবিতা রচনাকারী মধুসূদনের মধ্যে ‘ব্রজাঙ্গনা’রচয়িতা মধুসূদনের স্মৃতি আবির্ভূত হয়েছে।

.৮ আর দৃষ্টান্ত না বাড়িয়ে উপরের উদ্ধৃতিগুলির পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদন কর্তৃক লা ফোঁতেনের কবিতার রূপান্তর ও রূপায়ণপদ্ধতির কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে পারি:

মধুসূদন লা ফোঁতেনের নীতিকবিতার কাহিনিসংগঠনের মূলসূত্র অনুসরণ করেছেন। মধুসূদনের অনুলিখিত নীতিকবিতাগুলির কাহিনির আরম্ভ এবং পরিণতি লা ফোঁতেনের অনুসারী হলেও কাহিনির উপাস্থাপনা ও বিন্যাসে মধুসূদন যথাসম্ভব স্বাধীনতা’ গ্রহণ করেছেন। এই স্বাধীনতাগ্রহণ তাঁর আন্তঃসাংস্কৃতিকআন্তর্ভাষিক পরিগ্রহণের পদ্ধতিগত কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এই স্বাধীনতা’ গ্রহণের উদ্দেশ্য অনুরচনাকে উদ্দিষ্ট সম্ভাব্য পাঠকের কাছে পরিগ্রহণীয় করে তোলা।

. ‘পদ্মাবতী নাটক’ থেকে শুরু করে মধুসূদনের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের পদ্ধতিগত কৌশল হিসেবে পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে পরিগৃহীত বিভিন্ন উপাদানকে দেশীয়করণ অর্থাৎ দেশীয় ঐতিহ্যের উপাদানে রূপান্তরের মাধ্যমে আত্তীকরণের যে প্রবণতা দেখা যায়আলোচ্য নীতিকবিতাগুলির মধ্যে তা বিশেষভাবে স্পষ্ট। মধুসূদন সাধারণত প্ররচনার কাহিনিসংস্থানকে দেশীয় পরিবেশে সংস্থাপিত করেছেন বা/এবং দেশীয় কোনো ঐতিহ্যের সঙ্গে অন্বিত করেছেন। এই পদ্ধতিগত প্রয়োজনে প্ররচনার ভৌগোলিক পরিবেশ বা/এবং পরিপ্রেক্ষিতের উপকরণও রূপান্তরিত হয়েছে। এছাড়া প্রায়শ দেশীয় উপকরণের অনুষঙ্গে কাহিনি এবং প্রকাশভঙ্গির গতি পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিপূর্বে কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনায় আমরা কাব্যিক বাচনের অনুবাদপ্রক্রিয়ার সমস্যাপদ্ধতি এবং প্রকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি৪৬। ঐ আলোচনার সূত্রে মধুসূদনের নীতিকবিতাগুলিকে আমরা অনুরচনার একটা বিশেষ বর্গের অন্তর্গত করতে পারিএই বর্গটি হল ‘অবলম্বন’। অনুরচনার তির্যক অনুলিখনপদ্ধতি হিসেবে অবলম্বনের ক্ষেত্রে আমরা ভাষিকসাংস্কৃতিক রূপান্তর তথা স্থানীয়করণকে প্রধান চরিত্রলক্ষণ বলে নির্দেশ করতে পারি। ইতিপূর্বে প্ররচনার পাশাপাশি অনুরচনা হিসেবে নির্বাচিত নীতিকবিতাগুলির আলোচনায় আমরা এই ভাষিকসাংস্কৃতিক রূপান্তর তথা স্থানীয়করণের কৌশলের বিশ্লেষণ করেছি। এই স্থানীয়করণও অনুরচনাকে ভাষিকসাংস্কৃতিকভাবে উদ্দিষ্ট বাঙালি পাঠকের কাছে পরিগ্রহণীয় করে তোলার পদ্ধতিগত কৌশলের অঙ্গ।

. লা ফোঁতেনের কবিতার নীতিউপদেশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাহিনির মধ্যে নিহিত বা এমন পরোক্ষভাবে (যেমন কাহিনির কোনো চরিত্রের মুখে বলা যে তাতে কাহিনিরস বা কবিতার গীতিময়তা ব্যাহত হয় না। বস্তুত লা ফোঁতেন তাঁর নীতিকবিতায় আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদানের ধ্রুপদী আদর্শকে অনুসরণ করেছেন। মধুসূদনের নীতিকবিতায় (‘সূর্য্য ও মৈনাক গিরি’ শীর্ষক কবিতা বাদ দিয়েনীতিউপদেশ সোচ্চার ― আলোকায়িতকাহিনিসমাপ্তির পর কবি উপদেশদাতার ভূমিকা গ্রহণ করে তা উচ্চারণ করেছেন। এর মধ্যেও দেশীয়(সংস্কৃতনীতিকথার ঐতিহ্যের অনুসরণ বা ভাষিকসাংস্কৃতিক স্থানীয়করণের কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে। কাহিনিকথনের মধ্যে রচয়িতার আবির্ভাব এবং উপদেশদাতার ভূমিকাগ্রহণ তথা সোচ্চার নীতিউপদেশ দান আন্তঃরাচনিকভাবে নীতিকথার সংকলন পঞ্চতন্ত্র’ (पञ्चतन्त्रम्) ও ‘হিতোপদেশ’কে (हितोपदेशः) স্মরণ করিয়ে দেয়।

লা ফোঁতেনের কবিতার ধ্রুপদী সংহতি এবং স্বচ্ছন্দসাবলীল গতিময়তা মধুসূদনের নীতিকবিতায় অনুপস্থিত।

. উপসংহার

সবশেষে আবার বলা যায়মধুসূদনের নীতি কবিতাগুলি বাংলা ভাষার সঙ্গে ফরাসি সাহিত্যের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে ফরাসি সাহিত্যের অনুরাচনিক উপাস্থিতির ঐতিহাসিক সূত্রপাত। এদিক থেকেও মধুসূদন আমাদের পথপ্রদর্শক। বিভিন্ন ভাষার কাব্যোদ্যানের ফুলসংগ্রহ করেমাতৃভাষাকমকলেবর’কে সজ্জিত করার যে মনোভাব দ্ধারা মধুসূদন বারবার উদবুদ্ধ হয়েছিলেনতা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। স্মরণীয় তাঁর উপলব্ধিযার দ্ধারা তিনি এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে আমাদের প্রতিটি নতুন চিন্তার বাহন হতে পারে একমাত্র মাতৃভাষা।

I have been for months like a ship becalmed in France, though thank God, I have had the strength of mind and resolution to make the best use of my misfortune in learning three continental languages, viz Italian, German and French languages, which are worth knowing for their literary worth… ‘the knowledge of a great European language is like the acquisition of a vast and well cultivates state ― intellectual of course. Should I live to return, I hope to familiarize my educated friends with these languages through the medium of our own tongue… European scholarship is good in as much as it renders us masters of the intellectual resources of the most civilized quarters of the globe but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let those, who feel that they have spring of fresh thought in them, fly to their mother-tongue… I should scorn the pretensions of that man to be called ‘educated’ who is not master of his own language.৪৭

১৮৬৫ সালের ২৬র জানুয়ারি ভের্সাই থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা একটি চিঠিতে এই উক্তি করেছেন বিদেশি গ্রিকলাতিনহিব্রুইংরেজিইতালিয়ানফরাসি ও জর্মন ভাষাভিজ্ঞ মধুসূদন।

টীকা তথ্যসংযোজ

 

. ‘সাবেকি প্রভাবতত্ত্ব’ (anachronic influenceology) শব্দের ব্যবহারের দ্বারা আমরাপ্রভাব’ সম্পর্কে স্লোভাক সাহিত্যতাত্ত্বিক দিওনিজ দুরিসিনএর (Dionýz Ďurisin,১৯২৯১৯৯৭) চিন্তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছি। দুরিসিনএর মতে খ’ ‘ক’কে কিছু পাঠাচ্ছে ― এটাই হল গিয়ে ‘প্রভাবের’ অন্তর্নিহিত ধারণা আর যেখানে প্রকৃত ঘটনা হলখ’ ‘ক’ থেকে বেরিয়ে আসা কিছু উপাদান বেছে নিয়ে আত্মস্থ করছে। আর এক্ষেত্রে আমরা ভাষাবিজ্ঞানী রোমান য়াকবসনএর দুটি ভাষার সম্পর্ক বিষয়ে বাচন সাংস্কৃতিক সংকরায়ণের ক্ষেত্রে ― আমাদের ভাষায় অতিসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনের ফলশ্রুতি আন্তঃসাংস্কৃতিক তথা আন্তর্ভাষিকআন্তর্সাহিত্যিক পরিগ্রহণের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য বলে মনে করি:

  …Lorsque le système de l’idiome A ‘imite’ le système de l’idiome B la sélection et la révision des valeurs fonctionnelles des éléments adoptés ont toujours lieu du point de vue système A, en correspondance avec les possibilités d’évolution et les penchants de ce dernier ; dans le cas contraire, on est en présence d’une simple substitution du système B au système A, de l’extinction du système A. L’hybridation est un processus de synthèse et non une soudure mécanique.

Roman Jakobson

Remarques sur l’évolution phonologique du russe,

Prague, 1929

ব্যবহারিক মূল্যমানের নির্বাচন ও পুনরীক্ষণ সবসময় তন্ত্র এর দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পাদিত হয়ে থাকেআর তা হয়ে থাকে শেষোক্ত তন্ত্রের উদবর্তনের সম্ভাব্যতা ও প্রবণতা অনুসারে। আর এর বিপরীত ক্ষেত্রে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তা হল তন্ত্র এর জায়গায় ‘খ’এর প্রতিস্থাপনতন্ত্র এর অবলুপ্তি। সংকরায়ণ হল একটা সংশ্লেষণপ্রক্রিয়াকোনোভাবেই তা যান্ত্রিক জোড়া লাগানোর ব্যাপার নয়।

― রোমান য়াকবসন রুশ ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বিবর্তন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ,

প্রাগ১৯২৯]

প্রাক্ঔপনিবেশিক যুগের (এদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বর্ণনা বা বিশ্লেষণে আমরা ইয়োরোপীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত এবং প্রযোজ্য যুগনির্দেশক মধ্যযুগসংজ্ঞা অব্যবহার্য বলে মনে করিবাংলা সাহিত্যের চরিত্র বোঝাতে আমরা তাকে মৌখিক সংস্কৃতির (Oral Culture) পরবর্তী এবং মুদ্রণসংস্কৃতির (Print culture) পূর্ববর্তী পুঁথিসংস্কৃতির (Manuscript culture) যুগের সাহিত্য বলে নির্দেশ করেছি। এছাড়া এই সাহিত্য সম্পর্কে আমরা লিখিতশ্রাব্য বা/এবং পাঠ্যশ্রাব্য এ দুটি বিশেষণ ব্যবহার করেছি। প্রথমত এ সাহিত্য ছিল লিপিবদ্ধপুঁথিতে হস্তলিখিত বা প্রতিলিপি করা (অমুদ্রিত ― লিখিত), সাধারণত পারিবারিক/সামাজিক সমাবেশে সুর করে একজনের দ্বারা পঠিত হওয়ার জন্য রচিত (পাঠ্য) ও অন্যদের দ্বারা শ্রুত হওয়ার (শ্রাব্য) জন্য রচিত।

যোগীন্দ্রনাথ বসু: মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিতপঞ্চম সংস্করণকলকাতা,চক্রবর্ত্তীচাটার্জ্জি এণ্ড কোং১৯২৫ (এর পর থেকে সংক্ষেপে ‘জীবনচরিত’ অভিধা য় নির্দেশ করা হবে) , পৃষ্ঠা ১৫৯১৬২।

জীবনচরিতপৃষ্ঠা ১৮২।

জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৪৮২। এই পত্র তারিখহীন। তবে পত্রে দেখা যায় যে তখনমেঘনাদবধ কাব্যের দ্বিতীয় সর্গ ছাপা হচ্ছে। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা যায়চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৮৬১ সালের মার্চএপ্রিল মাসে। আমাদের অনুমানবিখ্যাত ধ্রুপদীকাব্যকলা’ (L’Art poétique) রচয়িতা বোআলোর (Nicolas Boileau১৬৩৬১৭১১)কথা স্নরণ করে মধুসুদন এউক্তি করেছিলেন।

এ চিঠির আগে রাজনারায়ণ বসুকে ২৪এ এপ্রিল১৮৬০ তারিখে লেখা অন্য একটি পত্রে .[জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৩১৫মধুসূদন জানান: :

I am that man, though I have no father, I am, besides engaged in…But n’importe as the French say…

কৃষ্ণকুমারী নাটক’ প্রকাশের দুএক দিন পরে ১৮৬১ সালের অগাস্ট মাসে রাজনারায়ণ বসুকে লেখা একখানি তারিখহীন চিঠিতে [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৪৯০Hindu Patriot পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়এর মৃত্যুতে মধুসুদন লেখেন:

Harish is dead… I loved and valued that man… Vale as the Latins used to say or au revoir as the French say.

কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে [১৮৬০জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৪৬৭] মধুসূদন জানান:

I am very fond of busy and varied scenes; and as for the French idea of not allowing one set of actors to retire and introduce another, I have no great respect for it, and yet I like to preserve ‘unity of time’ and as far as I can, that of time also.

মধুসূদন রাজনারায়ণ বসুকে তারিখহীন অন্য একটি পত্রে [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৪৭৪]লেখেন:

I had a long talk with Runga Lal…he said, ‘I acknowledge Blank verse to be the noblest measure in the language, but I say that no one but men accustomed to Poetry of England would appreciate it…’ I grinned and said ‘n’importe’.

. ‘জীবনচরিত’ ও ‘মধুস্মৃতি’র (নগেন্দ্রনাথ সোম: মধুস্মৃতিকলিকাতা,গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স্১৯২০সংক্ষেপে ‘মধুস্মৃতি’ অভিধায় নির্দেশ করা হবে)পরিশিষ্টে সন্নিবিষ্ট একাধিক স্মৃতিমুলক রচনা দ্রষ্টব্য।

উত্তরপাড়ার রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় লিখেছেন :

ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে :

French which was the vehicle of conversation with his wife and children, he may be said to have completely mastered. To the best of my recollection, he spoke French, far more fluently than English. Molière, Racine, Fénelon, Lamartine, and Victor Hugo were his favourite French authors. (Reminiscences Of Michæl Modhu Sudan Datta by Babu Rashbihari Mukherjee, জীবনচরিত,পৃষ্ঠা ৬৭৪)

ফরাসি জাতি সম্পর্কে :

The French, whom perhaps he loved more than his own nation, he estimated the most refined dilettante, in the world. The English he called boors.(তদৈব,জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৬৭৫)

তিনি (মধুসূদনহোমরদান্তেমিলটনমোলিয়ারভিক্টর হ্যুগোবায়রণশেলি,কীটসটেনিসন — এই সকল কবির স্তুতিবাদক ছিলেন।… মধুসূদন বলিতেন,ফরাসির ন্যায় প্রাঞ্জলসুমার্জ্জিতদ্ব্যর্থসম্ভাবনাপরিশূন্য ভাষা জগতে নাই। ফরাসিদের যেমন তীক্ষ্ণসুমার্জ্জিত মস্তিষ্কতাহাদের ভাষাও তেমনি স্বচ্ছ।(মাইকেল মধুসূদন দত্ত : রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়মধুস্মৃতিপরিশিষ্টপৃ৪৭৭)

ফ্রান্সে থাকাকালে মধুসুদনের লেখা চিঠিতেও তাঁর ফরাসিপ্রীতির পরিচয় রয়েছে׀ভের্সাই থেকে বিদ্যাসাগরকে লেখা এক চিঠিতে (১৮৬৪জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৪০] তিনি লিখেছেন:

You will be pleased to hear that I have been saved the disgrace of a French Jail by a young, beautiful and gracious French lady, whose acquaintance I made in a Railway-carriage and who has ever since taken great interest in us, consoled us in our misfortunes, and assisted us with her purse. She went with me to our Land-lord and spoke to the man as only a French woman can speak and got him to consent to take the security of a friend of mine in London and to let us remain here till the end of the current month.

অন্য একটি চিঠিতে [১৬১০১৮৬৪জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৬৮] ইংল্যান্ডের পরিবর্তে ফ্রান্সে কেন রয়েছেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মধুসুদন বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিথেছেন:

You are, no doubt, anxious to know why I am here in France. I will tell you. London is not half so pleasant a place to live in as this country.

মধুস্মৃতি ‘বিবিধ আখ্যায়িকা’’ অধ্যায়ে মধুসুদনের ফরাসি ভাষায় দক্ষতা আর ফরাসিপ্রীতি সম্পর্কে একটি কাহিনি উল্লেখযোগ্য:

বিজ্ঞানবিষয়ে ইংরাজ জাতি বেশী উন্নতি করিয়াছেকি ফরাসী জাতি অধিক সমুন্নতএই বিষয়টি লইয়া সুপ্রসিদ্ধ ফরাসীভাষাবিৎ ও সামুদ্রিক বিদ্যাবিশারদ(Phrenologistডাক্তার কালীকুমার দাসের সহিত ফরাসীভাষায় মধুসূদনের ঘোরতর তর্কযুদ্ধ উপস্থিত হয়। মধুসূদনজলের ন্যায় অনর্গল ফরাসীভাষায় প্রায় তিন ঘণ্টাকাল তাঁহার সহিত তর্কবিতর্ক করেন। দুই মনস্বীর বিদেশীয় ভাষায় বাকযুদ্ধে উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী বিস্মিত ও বিমোহিত হন। বিজ্ঞানবিষয়ে ফরাসী জাতিই যে সমধিক উন্নততর্কে ইহা মধুসূদন প্রতিপন্ন করিয়াছিলেন। (মধুস্মৃতি ,সপ্তদশ অধ্যায়বিবিধ আখ্যায়িকাপৃ৩৪৫)

মধুসূদনদম্পতীর সমাধিক্ষেত্রে স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে শ্রীযুক্ত মনোমোহন ঘোষের বক্তৃতায়ও মধুসুদনের ফরাসি ভাষায় দক্ষতা তথা ইয়োরোপীয় ভাষা ও সাহিত্যে ব্যুত্পত্তি এবং মাতৃভাষাপ্রীতির কথা রয়েছে।

…we have met here… to pay publicly …homage… to the memory of, perhaps, the greatest poetical genius that Bengal has yet produced. And this reminds me vividly a conversation which I had with Mr. Datta about 24 years ago, when I found him in the historical city of Versailles, composing his well known sonnet on Dante, which most of you have read. The sonnet was being composed for the then approaching tercentenary festival in honour of the great Italian poet.

…he remarked, referring to his own attempt in translating his sonnet into the French language, that no man, however great his mastery over a foreign language, should ever attempt to write poetry except in his own mother-tongue….

As a linguist and scholar, he had scarcely an equal among his contemporaries, and there is hardly any individual, even in these days, among his countrymen, who could excel him in his knowledge of the European languages, and in literature both ancient and modern, of European countries. Nevertheless, he had himself made the discovery early in life that he could not succeed, as a poet, unless he expressed himself in his own mother-tongue.

[মধুস্মৃতিপরিশিষ্টপৃ৪৮৬]

ছাত্রঅবস্থায় ১৮৪১ সালে মধুসুদন ইংরেজিতে বেশ কিছু সনেট রচনা করেন। তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন ১৮৬০ সালে। সনেটির নাম কবিমাতৃভাষা।মেঘনাদ বধ’ কাব্যের তৃতীয় সর্গ রচনার সময় (১৮৬০মধুসুদন রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৪৭৭] লেখেন:

I want to introduce the sonnet into our language and, some mornings ago, made the following…

এর পর তিনি ‘কবিমাতৃভাষা’ কবিতাটি উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেন [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৪৭৭]:

What say you to this my good friend! In my humble opinion, if cultivated by men of genious our sonnet in time would rival the Italian.

মধুসুদনের চতুদর্শপদী কবিতাবলীর অন্তর্ভুক্ত ‘বঙ্গভাষা’ [চতুদর্শপদীকবিতাবলি,কলিকাতাশ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং স্ট্যানহোপ্ যন্ত্রে মুদ্রিত১৮৬৬ —এর পর থেকে ‘চ..’ অভিধা দ্বারা নির্দেশ করা হবে, কবিতা ১। ইয়োরোপ থেকে মধুসুদন তাঁর চতুদর্শপদী কবিতাগুলি আর কিছু অসমাপ্ত কবিতা কলকাতায় তাঁর প্রিয় প্রকাশক ঈশ্বরচন্দ্র বসুকে পাঠান,শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং মধুসুদনের ইয়োরোপ থেকে ফেরার(ফেব্রুয়ারি ১৮৬৭আগেই ১৮৬৬ সালের অগাস্ট মাসে কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে । সনেটটি পূর্ববর্তী ‘কবিমাতৃভাষা’ কবিতার পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রূপ।পাহাড়তলী’ (৬ষ্ঠ প্রকাশবিশেষ কবিতা সংখ্যা১৯৭৯পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে বর্তমান আলোচক কবিতাদুটির রাচনিকতার তুলনামুলক বিশ্লেষণ করেছেন।

.., কবিতা ৩৪।

.., কবিতা ৪৩ । আবার চতুর্দশপদী কবিতাবলির শুরুতে ‘উপক্রম’ শীর্ষক দুটি চতুর্দশপদী কবিতা রয়েছে। আমরা চতুর্দশপদী কবিতাবলির প্রথম সংস্করণ (শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং স্ট্যানহোপ যন্ত্রে মুদ্রিত১৮৬৬ব্যবহার করেছি তার প্রকাশকদিগের বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক ভূমিকায় বলা হয়েছে ইউরোপ খণ্ড হইতে ইতিপূর্ব্বে কখন বাঙ্গালা কবিতা লিখিত হইয়া মুদ্রিত হইবার নিমিত্ত কলিকাতায় প্রেরিত হয় নাই এই জন্য আমরা কবিবরের ব্ন্ধুদিগের এবং সাধারণের সন্তোষার্থে কবিতাগুলির উপক্রমভাগটী মুদ্রাক্ষরে না ছাপাইয়া যেরূপ লিখিত ছিল অবিকল তদনুরূপ হস্তাক্ষরে ছাপাইলাম।’ হস্তাক্ষরে উপস্থাপিত দ্বিতীয় কবিতাটির নিচে নির্দেশ রয়েছে ‘ফরাসীস দেশস্থ ভরশেলস নগরে। ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে।।’ [.., উপক্রম] মনে হয়উচ্চারণ তথা প্রতিবর্ণীকরণের ক্ষেত্রে মধুসূদন বাংলাভাষীর উচ্চারণতন্ত্রের অনুসারী আত্তীকরণ বা দেশীয়করণের (স্থানীয়করণেরপক্ষপাতী ছিলেন। বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষার এই প্রবণতা রয়েছে ― বহুভাষাবিদ্ মধুসুদন তা অবশ্যই লক্ষ্য করেছিলেন। এছাড়া রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়ের স্স্মৃতিকথায় দেখা যায় যেমধুসুদন ইংরেজি ভাষায় কথা বলার সময় দেশীয় নামের দেশীয় উচ্চারণের বিরোধী ছিলেন [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৬৭৬]হয়তো এই মানসিকতা থেকেই তিনি বাংলায় ফরাসি Versailles-কে ভরসেলসও Victor Hugo-কে ভিকতর হ্যূগোতে [., কবিতা ৮৫] পরিণত করেছেন।

১০১৮৬৪র ২৬এ অক্টোবর গৌরদাসকে লেখা এক চিঠিতে মধুসুদন জানিয়েছেন যে ফরাসি সভ্রাট ও সভ্রাজ্ঞীকে দেখে তিনি উচ্চ চিৎকারে Vive l’Empéreur ! Vive l’Impératrice!’ বলে অভিবাদন জানিয়েছেন [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৭০] ৩০এ অক্টোবর মনোমোহন ঘোষকে লেখা চিঠিতে [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৬৬] মধুসুদন লিখেছেন:

A few days ago I had the honour of saluting and of being saluted in return by the famous Emperor of the French ― a truly greatman. I amused myself by shouting ‘Vive l’Empéreur! Vive Napoléon!’

লুই নাপোলেওঁ সম্পর্কে মধুসুদনের উক্তি তাঁর নাপোলেওঁ বোনাপার্ত সম্পর্কে উচ্ছ্বাস স্মরণ করিয়ে দেয়׀ ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত The Anglo-Saxon and the Hindu শীর্ষক ইংরেজি রচনায় মধুসুদন লিখেছিলেন:

Empires and kingdoms, such as would have gratified the boundless ambition of that earthborn Titan ― Napoleon the Grand;… see the grandest of warriors, the loftiest of mortals, the most glorious, the most awful, the most mystical, the most inconceivably sublime Brim of hero-worshippers ― the son of the Corsican Attorney ― surrounded by his eagles with their terrific beaks dried the blood torrents which flowed at Austerlitz, at Jena, at Wigram, at Friedland, at Borodino and then pining away in the solitude of St. Helena ― his island-prison in the midst of the vast Atlantic…[রচনাবলীহরফইংরেজি অংশপৃষ্ঠা ২৪৭২৪৮]

১১ চিঠির [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৪২] উদ্ধৃত অংশটির পরের বাক্যগুলি হল:

I have also commenced Italian and mean to add German to my stock of languages, ― if not Spanish and Portuguese before I leave Europe.

এছাড়া মধুসুদনের আরো কিছু চিঠিতে তাঁর ফরাসি ও অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষা শিক্ষার প্রসঙ্গ রয়েছে׀ যেমন:

I hope to be a capital sort of European scholar before I leave Europe, I am getting on well with French and Italian. I must commence German soon. Spanish and Portuguese will not be difficult after Latin, French and Italian.[বিদ্যাসাগরকে লেখা১১ই জুলাই১৮৬৪,জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৫২৫৫৩]

I have greater facilities for mastering French and Italian than there.To these two languages which I already read and write with great ease, I am going (in fact I have already begun) to add German. [গৌরদাস বসাককে লেখা২৬এ অক্টোবর১৮৬৪,জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৬৯]

You must not fancy, my good friend, that I am idling here. I have nearly mastered French and Italian and am going on with German, all without any assistance from hired teachers. [বিদ্যাসাগরকে লেখা৩রা নভেম্বর,১৮৬৪,জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৫৫]

…I have had strength of mind and resolution to make the very best use of my misfortune in learning the three great continental languages, viz, Italian, German and French languages, which are well worth knowing for their literary worth. You know, my Gour, that the knowledge of great European language is like the acquisition of a vast and well cultivated state ― intellectual o#f course.[গৌরদাস বসাককে লেখা, ২৬এ জানুয়ারি, ১৮৬৪,জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৭৪]

১২মধুসুদনের ফরাসি কবিতার কোনো দৃষ্টান্ত তাঁর জীবনীকাররা দেন নি। অন্য কেউ দিয়েছেন বলেও আমাদের জানা নেই। তাছাড়া আবেগপ্রবণ মধুসুদন তাঁর সব খবরই চিঠিতে কলকাতার বন্ধুদের জানাতেনঅথচ তাঁর ফরাসিতে কবিতা লেখার কথা কোনো চিঠিতেই তিনি উল্লেখ করেন নি। তাঁর ফরাসিরচনার একমাত্র নির্দশন দান্তের উদ্দেশে রচিত সনেটটির ফরাসি গদ্যঅনুবাদ। এছাড়া যোগীন্দ্রনাথ বসুর ‘মাইকেল মধুসুদন দত্তের জীবন– চ রিত’ থেকে জানা যায় যেফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে মনোমোহন ঘোষকে লেখা মধুসুদনের পত্রের কয়েকটি ছিল ফরাসিতে [জীবনচরিত,পৃষ্ঠা ৫৬৩]। ‘মধুস্মৃতির’ রচয়িতাও মধুসূদনের লেখা ফরাসি চিঠির মনোমোহন ঘোষ কৃত ইংরেজি অনুবাদ উপস্থাপিত করেছেন (মধুস্মৃতিপৃষ্ঠা ৩৬০)

১৩.., কবিতা ৮২।

১৪সূত্র প্রতিলিপি’ মধুসূদন রচনাবলী কলকাতাসাহিত্য সংসদ।

১৫. .., কবিতা ৮৫।

১৬ভিক্তর য়ূগোর প্রতি এই শ্রদ্ধা নিবেদন প্রসঙ্গে অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার মজুমদার তাঁর ‘বাংলা কাব্যে পাশ্চাত্য প্রভাব’ নামক গবেষণামুলক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: ‘মাইকেল যখন ফ্রান্সেতখন য়ুগোপরবর্তী লেখকদের প্রাধান্যকিন্তু তাঁদের উল্লেখ মাইকেলে নেই।’ আবার ফরাসিসাহিত্যবিশেষ করে বোদলের-এর অনুরাগী এই সমালোচক লিখেছেন: ‘বিশেষ করে বোদল্যেরের কথা মনে হয়। তাঁর Les Fleurs du Mal ১৮৫৭ খ্রীষ্টান্দে প্রকাশিত হয়েছেসারা ফ্রান্সে যে বই নিয়ে হৈ চৈএবং ঐ বছরইLes Fleurs du Malএর ছটি কবিতাকে অশ্লীল বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি মধুসুদন ভের্সাঈতে গেছেন। বোদল্যের প্যারিস থেকে বেলজিআমে গেছেন বক্তৃতা সফরে। কিন্তু মধুসুদনের মনে এবং চিঠিপত্রে তার কোন স্পর্শ নেই।’ এ প্রসঙ্গে বলা দরকারমধুসুদন যখন ফ্রান্সে তখন য়ূগো রাজনৈতিক কারণে ফ্রান্সের বাইরে স্বেচ্ছানির্বাসনে (১৮৫১৭০) তবুও ঐ সময়ে তিনি অবিসংবাদীভাবে ফরাসি সাহিত্যসম্রাট। নির্বাসনে থাকলেও তাঁর রচনা ফরাসি দেশে নিয়মিত প্রকাশিতআলোচিত ও বিপুলভাবে পঠিত। ১৮৫৩ সালে তাঁর শাস্তি’ (Les Châtiments), ১৮৫৬তে ‘অনুধ্যান’ (Les Contemplations) আর ১৮৬৭তে ‘ইতিকথা(La Légende) কাব্যের প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসহতভাগ্যেরা’ (Les Misérables) মধুসূদনের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই এই সাহিত্যসম্রাটের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ইংরেজি রোমান্টিক কবিটার সঙ্গে মধুসূদনের আকৈশোর পরিচয় ছিলতাঁর কাছে রোমান্টিক য়ূগোর আবেদন তাই স্বাভাবিক। আমরা জানি,বোদলেরের কবিতা রোমন্টিক রবীন্দ্রনাথেরও ভালো লাগে নিমধুসুদনের কাছে তা আকর্ষণীয় হতে পারে এটা ভাবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাছাড়া বোদলের তখনো নতুন কবিতার স্বল্পসংখ্যক অনুরাগীদের কাছেই পরিচিত। তাই ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ সম্পর্কে সারা ফ্রান্সে যে বই নিয়ে হৈচৈ’ অনুরাগের আবেগপ্রসূত অতিশয়োক্তি।উপরন্তু বোদলেরের মৃত্যুর (১৮৬৭আগে উক্ত বইটির দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল׀ ১৮৫৭ সালে প্রথম সংস্করণে ছাপা হয়েছিল ১৩০০ কপি (সঙ্গে ভালো কাগজে আরো ২০ কপি), ১৮৬১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণে ছাপা হয়েছিল ১৫০০ কপি (এর সঙ্গে ভালো কাগজে আরো সামান্য কিছু কপি) এই সংখ্যা থেকে বোদলেরের পরিচিতির সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করা যায়। তুলনায় ভিক্তর য়ূগোর খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা তখন যে কী সুবিপুল তা হয়তো আরেকটি ব্যাপার থেকে অনুমান করা যায়। ১৮৫৭ সালে বোদলের এবং ফ্লোবের যথাক্রমে লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ ও মাদাম বোভারির জন্য প্রকাশকের সঙ্গে যথাক্রমে ২৫০ এবং ৪০০ ফ্রঁ প্রাপ্যের চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ১৮৬১ সালে বোদলের তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য ৩০০ ফ্রঁ প্রাপ্যের চুক্তি করেন। সেখানে ১৮৬১ সালে লে মিজেরাবল্’ উপন্যাসের জন্য য়ূগো প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন এবং তদনুযায়ী সে যুগেও পান তিনলক্ষ ফ্রঁআর প্রকাশক সমস্ত খরচখরচা বাদ দিয়ে লাভ করেছিলেন পাঁচ লক্ষ সতের হাজার ফ্রঁ।

যাই হোককোনো দিক থেকেই বিদেশি মধুসুদনের পক্ষে এই সময়ে বোদলের সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় কোনো কারণ ছিল না। তুলনামূলক ভাবে বলা যায় যে তিরিশের দশকের শেষে কোনো বিদেশি কবি যদি বাংলাদেশে আসতেনবাংলাও শিখতেনতবে কি তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আগ্রহী এবং উচ্ছুসিত হওয়টাই স্বাভাবিক হত না? আর পথের পাঁচালী’ (১৯২৩), ‘অপরাজিত’ (১৯৩২), ‘আরণ্যক(১৯৩৮), ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০), ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬বেরিয়ে যাওয়ার পরও কি বিভুতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়বুদ্ধদেব বসু বা জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে ঐ বিদেশির অনবহিত থাকাটা নিতান্ত অস্বাভাবিক হত ?

১৭ফ্রান্স থেকে গৌরদাস বসাককে লেখা একটি চিঠিতে [২৬এ জানুয়ারি১৮৬৫,জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৭৫] মধুসূদন জানান:

I have been lately reading Petrarca ― the Italian Poet, and scribling some ‘sonnets’ after his manner…I dare say the sonnet ‘চতুর্দ্দশপদী’ will do wonderfully well in our language.

এছাড়া তাঁর চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী’র উপক্রম’ শীর্ষক দুটি চতুর্দশপদী কবিতার দ্বিতীয়টিতে মধুসূদন ‘ভারতে ভারতীপদে’ চতুর্দ্দশপদী কবিতারূপ ‘রতন’ অর্পণ করতে গিয়ে বাদেবীর বরে বড়ই যশস্বী সাধুকবিকুলধন’ ‘ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরার্কা কবিকে’ শ্রদ্ধাপূর্বক স্মরণ করছেন। [.., উপক্রম ২]

১৮..., কবিতা ৩২ ।

১৯Joachim du Bellay: Les Regrets et autres œuvres poetiques, Paris, Frederic Morel, 1558, পৃষ্ঠা ৩ ।

২০তদৈবপৃষ্ঠা ৮ । সনেটটির তরু দত্ত কৃত ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে তাঁর A Sheaf Gleaned in French Fields (3rd edition, London, C. Kegan Paul & Co.1880, পৃষ্ঠা ১গ্রন্থে।

২১টীকা ৬ দ্রষ্টব্য।

২২আমাদের অনুমানইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ইতালীয় নবজাগরণের সঙ্গে পরিচিত বাঙালি বন্ধুদের কাছে মধুসূদন তাঁর চিঠিতে ইতালীয় কবি পেত্রার্কার (Francesco Petrarca, ১৩০৪১৩৭৫নাম করলেও ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়হীন বন্ধুদের কাছে কোনো ফরাসি সাহিত্যস্রষ্টার নাম করা অর্থহীন বলে বোধ করেছেন। তাই গৌরদাস বসাককে লেখা একটা চিঠিতে ফরাসি বিষয়ের অনুকরণের’ (imitating a few…French things) কথা বললেও [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৭১] বা ভিক্তর য়ূগোর উদ্দেশে একটি চতুর্দশপদী কবিতা [.কবিতা ৮৩] রচনা করলেও মধুসূদন অন্য কোথাও ফরাসি সাহিত্যকারদের নাম করার সে অর্থে কোনো প্রয়োজনবোধ করেন নি, ‘ফরাসি বিষয়ের অনুকরণ’ প্রসঙ্গেও কী বিযয়ের বা কার অনুকরণের কথা তিনি উল্লেখ করেন নি।

২৩মধুসূদন গ্রন্থাবলীসম্পাদক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়সজনীকান্ত দাস,কলকাতাবঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ, [এর পর থেকে ম.গ্র.বলে নির্দেশ করা হবে], বিবিধ কাব্যচতুর্থ সংস্করণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ১০।

২৪১৯২২ সালে সেযুগের খ্যাতনামা মধুসূদনবিশেষজ্ঞ দীননাথ সান্যাল তাঁর সম্পাদিত ও ব্যাখ্যাত চতুদর্শপদী কবিতাবলির ভূমিকায় মন্তব্য করেছিলেন:

পরিশিষ্ঠে যে কয়েকটি নীতিগর্ভ কবিতা সন্নিবেশিত হইলতাহাদের মধ্যে রসাল ও স্বর্ণলতিকা ও ময়ূর ও গৌরী এই দুইটি ফ্রান্সে প্রবাসকালে এবং অন্যগুলি জীবনের শেষভাগে রচিত। ফ্রান্সে থাকিতেবোধ হয়ফ্রান্সদেশীয় কবি Jean La Fontaineএর কবিতার অনুকরণে মধুসুদন সেইরূপ ভাঙ্গা মিত্রাক্ষর ছন্দেনীতিগর্ভ কবিতা রচনা করিতে প্রবৃত্ত হয়েন।

কিন্তু মধুসূদনের দেশে ফেরার আগেই ১৮৬৬ সালে কলকাতায় তাঁর পাঠানো কবিতার সংকলন চতুদর্শপদীকবিতাবলি নামে প্রকাশিত হয়। এই সংকলনের ভূমিকা হিসেবে উপস্থাপিত প্রকাশকদিগের নিবেদনে জানানো হয়:

মাইকেল মধুসূদন ইংলণ্ডে দেড় বত্সর থাকিয়া ১৮৬৩ সালের অক্টোবর মাসে ফ্রান্স রাজ্যে গমন করেন এবং ভরসেলস নামক তথাকার সুপ্রসিদ্ধ নগরে দুই বত্সর কাল অবস্থিতি করেন। তিনি এই সময়ে চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি‘ নাম দিয়া একশতটি কবিতা ছাপাইবার জন্য আমাদিগের নিকট পাঠাইয়া দেন।… ইউরোপ খণ্ড হইতে ইতিপূর্ব্বে আর কখন বাঙ্গালা কবিতা লিখিত হইয়া মুদ্রিত হইবার নিমিত্ত কলিকাতায় প্রেরিত হয় নাই… আমরা সুভদ্রাহরণ,তিলোত্তমাও হিতোপদেশের যে যে অংশ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম তাহা অসমাপ্ত কাব্যাবলি শিরোনাম দিয়া চতুর্দ্দশপদীর শেষ ভাগে সংযোজিত করিয়া দিলাম।

এই অসমাপ্ত কাব্যাবলি অংশে দীননাথ সান্যাল ফ্রান্সে লেখা বলে যে দুটি নীতিগর্ভ কবিতার উল্লেখ করেছেন তা বাদ দিয়ে তৃতীয় একটি নীতিগর্ভ কবিতা রয়েছে কাক ও শৃগালী । এই কবিতাগুলিকে পূর্বোক্ত প্রকাশকদিগের নিবেদনে‘ ‘হিতোপদেশের যে যে অংশ বলে নির্দেশ করা হয়েছে। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা যায়মধুসূদন ফ্রান্সে থাকার সময় দুটি নয় অন্তত তিনটি নীতিগর্ভ কবিতা লিখেছিলেন। এছাড়া অন্যদিক থেকে যা উল্লেখযোগ্য তা হল দীননাথ সান্যাল নীতিগর্ভ কবিতার সঙ্গে লা ফোঁতেনএর রচনার আন্তঃরাচনিক সম্পর্কের উল্লেখ করেছেন।

চতুদর্শপদী কবিতাবলিদীননাথ সান্যাল কর্ত্তৃক ব্যাখ্যাত ও সম্পাদিতকলকাতাএম.সিসান্যাল এণ্ড কোং১৯২২পৃ.৭।

চতুদর্শপদী কবিতাবলিশ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং স্ট্যানহোপ্ যন্ত্রে মুদ্রিত১৮৬৬,পৃষ্ঠা ৷৷৵৹ ,১১৪১২২।

২৫এই উৎসর্গপত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষিত রাজা চতুর্দশ লুইয়ের ছ বছরের পুত্ররাজকুমার মহোদয়ের উদ্দেশে’ (à Monseigneur le Dauphin)। আমরা যে সম্পূর্ণ সংস্করণটি ব্যবহার করেছি তা হল Fables de La Fontaine, Garnier Frères, Paris, 1855(এর পর থেকে সংক্ষেপে ‘ Fables’ অভিধা ব্যবহার করা হবে)

ইশপএর নীতিকথার ছন্দোবদ্ধ অনুরচনায় লা ফোঁতেনের উল্লেখযোগ্য পূর্বসূরী হলেন ল্যাটিনে ফেদ্রুস (Phædrus, আনুসা.-পূ১৫– আনু৫০ সা), আভিয়ানুস (Flavius Avianus, সাধারণ অব্দের চতুর্থ শতকের শেষ থেকে পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধ). গ্রিকে বাব্রিয়াস/বাব্রিয়স (Βαβρίας/Βάβριος, সাধারণ অব্দের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতক),ফরাসিতে মারি দ ফ্রঁস (Marie de France, সাধারণ অব্দের দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ)

২৬Fables পৃষ্ঠা ২৪৬।

২৭দ্বিতীয় খণ্ডনবম পুস্তকনীতিকথা ৭মেয়ের রূপ পাওয়া ইঁদুর (Livres IX, Fables VII, La Souris métamorphosée en fillle), Fables পৃষ্ঠা ৪১৪দ্বিতীয় খণ্ড,দ্বাদশ পুস্তকনীতিকথা ১২রাজাচিল আর শিকারি (Livres XII, Fables XII, Le Milan, le Roi et le chasseur), Fables পৃষ্ঠা ৫৫৪; দ্বিতীয় খণ্ডদ্বাদশ পুস্তকনীতিকথা ১৫কাকহরিণকচ্ছপ আর ইঁদুর (Livres XII, Fables XV, Le Corbeau, la Gazelle, la tortue et le Rat), Fables পৃষ্ঠা ৫৫৪।

২৮Jean Biès: Littérature française et pensée hindoue, Paris, Librairie C. Klincksieck, 1974, পৃষ্ঠা ৪১৪২।

২৯জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৭১। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্যবাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদ্ অধ্যাপক ভুদেব চৌধুরী দেশ’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় (২০এ জুন ১৯৭০) ‘রবীন্দ্রনাথের ফরাসীচর্চা’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন:

বহুভাষাবিদ্ কবি মধুসুদনের কবিতা সম্পর্কেও হোমরভার্জিলদান্তেভালোমিল্টনপিত্রার্কার কথাই শোনা যায় প্রতীচ্যপ্রভাবকদের তালিকায়কিন্তু ফরাসী কোন কবির প্রসঙ্গ তাতে অনুপস্থিত। ফরাসী দেশে বাসকালে মধুসুদন খোদ ফরাসীতেই কবিতা লিথেছিলেন;অথচ তাঁর বাংলা কবিতায় তার কোন প্রভাব নেই।

― জানি না এই মন্তব্য করার সময় অধ্যাপক চৌধুরী মধুসুদনের নীতিকবিতাগুলির কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন কিনা।

৩০.গ্র.বিবিধ কাব্যচতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ১৫৩৭।

৩১.গ্র.হেকটর বধচতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ৷৷৴৹।

৩২বস্তুত একটি ভাষায় যা বলা হয়েছে অন্য একটি ভাষায়  ‘মোটামুটি তা বলে দেওয়া’ ― এটাই হল সাধারণভাবে অনুবাদ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা। ইতালীয় সংকেতবিজ্ঞানী উম্বের্তো একো (Umberto Eco) তাঁর অনুবাদ সম্পর্কে প্রায় একই কথা বলা,’ (Dire quasi la stessa cosa , Milano, Biompani, 2003; ফরাসি অনুবাদ Dire presque la même chose, tr. Myriem Bouzaher, Paris, Bernard Grasset, 2006) গ্রন্থের ভূমিকায় এই ধারণার পরীক্ষা করতে গিয়ে বলেছেন যে তবে প্রথমেই ‘প্রায় একই কথা বলা’ বলতে কী বোঝায় তা বোঝানো কঠিন হয়ে পড়েআর শেষ পর্যন্ত ‘কথাটাই’ বা কী কিংবা কখনো কখনো ‘বলা’ বলতেও বা কী বোঝায় তা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়।

৩৩উনিশ শতকের শেষ থেকে ফরাসি সাহিত্যে মুক্ত ছন্দ’ (vers libre) বলতে বোঝায় অক্ষরের সংখ্যাপর্বের নিয়মিত সংগঠনমিলবিন্যাস বা স্তবকের প্রথাগত বিধান না মেনে শ্রুতিনির্ভর ছন্দোস্পন্দনের ভিত্তিতে পর্ববিন্যস্ত কবিতার ছন্দ। ‘মুক্ত ছন্দ’ সমিল,মিলাভাসযুক্ত বা মিলহীন হতে পারে। আধুনিক এই ‘মুক্ত ছন্দের’ পাশাপাশি ছন্দের নিয়ম মানা অসম অক্ষরবিন্যাসের মিত্রাক্ষর চরণের লা ফোঁতেন ব্যবহৃত মুক্ত ছন্দকে’ ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ (vers libre classique) বা বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য ‘মিশ্র ছন্দ’ (vers mêlés) বলা হয়।

পুরনো ফরাসি ছন্দশাস্ত্রে ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দের সংজ্ঞার্থ হল: On appelle vers libres ceux qui n’ont aucune uniformité ni pour le nombre des syllabes ni pour le mélange des rimes… On met ordinairement en vers libres les sujets qui ne demandent qu’un style simple et familier, comme les fables, les contes, et même quelquefois les comédies… [যে পদ্যবন্ধে অক্ষরের সংখ্যা বা মিলের মিশ্রণের কোনো সমতা থাকে না সেই পদ্যবন্ধকে মুক্ত ছন্দ বলা হয়। যেসব বিষয় শুধুমাত্র সহজ আর ঘরোয়া প্রকাশপ্রকরণের দাবি করে তাতে মুক্ত ছন্দ ব্যবহার করা হয় যেমন নীতিকথা,কাহিনিএমন কী কখনো কখনো কমেডি] (Pierre Restaut : Abrégé des règles de la versification française, 1732; আল্যাঁ ফ্রোঁতিয়ের কবিতা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত Alain Frontier : La Poésie, Paris, 1992. পৃষ্ঠা ১৯১) মোরিস গ্রামোঁর (Maurice Grammont, ১৮৬৬১৯৪৬ মতেPour nous… c’est La Fontaine qui a fait l’usage le plus habile du vers libre [আমাদের মতেলা ফোঁতেনই সবচেয়ে নিপুণভাবে মুক্ত ছন্দের ব্যবহার করেছেন]. (M. Grammont : Le vers français. Ses moyens d’expression, son harmonie, Paris, 1923, পৃষ্ঠা ১০৭).

প্রসঙ্গত বলা দরকারবাংলায় ছন্দ সম্পর্কিত আলোচনায় মুক্ত ছন্দের’ ধারণাটা খুবই গোলমেলে। Free verse, vers libre, ‘মুক্তছন্দ’ গৈরিশ ছন্দ, ‘মুক্তক’ ‘অতিমুক্তক’ ‘মুক্তবন্ধস্বৈরবন্ধমুক্তবৃত্তস্বৈরবৃত্ত’ ‘গদ্যছন্দ, ‘গদ্যিকা’ ইত্যাদি সংজ্ঞা এবং তার অস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও মতভেদের অরণ্য ভেদ করে মুক্তছন্দ কী সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট উপপত্তিতে পৌঁছানো অসম্ভব। আসলে অক্ষরস্বরাঘাত ভিত্তিক (syllabotonic) ইংরেজি ভাযার ছন্দবিশ্লেষণের ছাঁচকে অক্ষর ভিত্তিক (syllabic) বাংলা ভাষার ছন্দের বিচারে আরোপ করতে গিয়েই তাবৎ বিপত্তিরতাবৎ অস্পষ্টতার সৃষ্টি। ছন্দতাত্ত্বিক অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের মতেরবীন্দ্রনাথ তাঁহার কাব্যজীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছিয়া যথার্থ free verse বা মুক্ত ছন্দের কবিতা লিখিয়াছেনবলা যাইতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আমরা তাঁহার শেষ রচনা ― ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ কবিতাটি উল্লেখ করিতে পারে (বাংলা ছন্দের মূলসূত্রকলকাতা,পঞ্চম সংস্করণ, ১৯৫৭পৃষ্ঠা ১৮২); ‘পদ্যের পর্ব্ব লইয়া গদ্যের মত স্বেচ্ছায় গ্রথিত করা যাইতে পারে। ইহাই যথার্থ free verse বা মুক্ত ছন্দ। গিরিশ ঘোষ ইহার পথ প্রদর্শন করিয়াছিলেনপরে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন…(, পৃষ্ঠা ২৪২)। তারাপদ ভট্টাচার্যের মতে, ‘মাত্রাবৃত্তে প্রথম মুক্তক দেখা যায় চর্যাপদে। অক্ষরবৃত্তে মুক্তক প্রবর্তনের গৌরব মাইকেলের প্রাপ্য׀ ছাত্রপাঠ্য নীতিগর্ভ কবিতাবলীতে মাইকেলই প্রথম সমিল অক্ষরবৃত্তকে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের চরণ বন্ধন হইতে মুক্তি দিয়াছেন;ইহাতে কোন নিদিষ্ট প্যাটার্নের স্তবক বন্ধন নাই।’ (তারাপদ ভট্টাচার্য : ছন্দতত্ত্ব ও ছন্দোবিবর্তনকলকাতা১৯৭১পৃষ্ঠা ৪০৯); ‘গৈরিশ ছন্দ অক্ষরবৃত্ত মুক্তক’ গোত্রীয়,কিন্তু প্রকৃত মুক্তক নহে। মধুসূদনের নীতিগর্ভ কবিতাবলী ও রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যের প্রধান ছন্দকেই যথার্থ মুক্তক বলিতে পারা যায়’ (পৃষ্ঠা ৪৫০); ‘গদ্যিকা অর্থাৎ গদ্যকবিতার রচনারীতি যদিও ছন্দেবর্জিত তথাপি চরণবদ্ধতাজাত পদ্যাভাস ইহাতে আছেএই কারণে কোন কোন ছন্দোমুগ্ধ ব্যক্তি প্রচার করিয়াছেন,গদ্যকবিতায় গুপ্তছন্দ বা ভাবছন্দ বর্তমান।’ (পৃষ্ঠা ৪৫৭); প্রবোধচন্দ্র সেনের মতে, ‘পয়ারের এই পঙক্তিসীমার বন্ধনটুকু কবিদের হাতে ছিন্ন হল। তার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় মধুসুদনেরই গদা ও সদা, ‘সিংহ ও মশক’ প্রভৃতি কোনোকোনো খণ্ডকবিতায়। আর পাওয়া যায় গিরিশচন্দ্র ও রাজকৃষ্ণের নাট্যরচনায় এবং রবীন্দ্রনাথার বহু কবিতায়। যতি ও পঙক্তিসীমার বন্ধনহীন এই যে মুক্ততর পয়ারতাকেই বলি মুক্তক পয়ার।’ (নূতন ছন্দপরিক্রমা,কলকাতা১৯৮৬পৃষ্ঠা ১৮১); ‘গদ্যকবিতায় ছন্দ থাকে নাকিন্তু ছন্দের ভঙ্গিটুকু থাকে׀ গদ্যকবিতার এই যে ধ্বনিভঙ্গি বা স্পন্দনলীলা,তাকেই বলা হয়েছে গদ্যছন্দ’ (পৃষ্ঠা ১৮৯); ‘পদ্যের রঙলাগা গদ্যই হচ্ছে গদ্যকবিতার বাহন।’ (পৃষ্ঠা ১৯০)

আমদের মতেমধুসূদন প্রবর্তিত (এবং রাজকৃষ্ণ রায়গিরিশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ অনুসৃতমুক্তক বা মুক্তক পয়ার হল ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ বা মিশ্র পর্বের অক্ষরবৃত্ত(মিশ্রবৃত্ত) ছন্দ’। আর শ্রুতিনির্ভর ছন্দস্পন্দনের ভিত্তিতে পর্ববিন্যস্ত তথাকথিত গদ্যকবিতার (দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের সাধারণ মেয়ে’শিশুতীর্থ’আমি’অমিয় চক্রবর্তীর মিল বা/এবং মিলাভাসযুক্ত ‘বড়োবাবুর কাছে নিবেদন’সাবেকি’,জীবনানন্দের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতাছন্দ মুক্তছন্দ। অবশেযে পর্ববিন্যাসহীন গদ্যে লেখা কবিতা (যেমন রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যা ও প্রভাতঅরুণ মিত্রের অমরতার কথা’)হল যথার্থ গদ্যকবিতা।

৩৪Œuvres de J. de La Fontaine, t. I, Paris, Alphonse Lemerre, 1875, পৃষ্ঠা ৩।

৩৫আমরা যাকে ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ বা মিশ্র পর্বের অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’ বলে অভিহিত করছি তার প্রথম আড়ষ্ট প্রয়াস দেখা যায় মধুসূদনের পদ্মাবতী নাটকে’ কলির স্বগতোক্তিতে:

ঐ শুন ― 

বীর দর্পে তা সবার সঙ্গে যুজে এবে ৮৬ ১৪

ইন্দ্রনীল। 

এই অবসরে যদি আমি ১০

রাণী পদ্মাবতীরে লইতে পারি হরি― (৭ বা ৪১০১৪

………….

আসিয়াছি হেথা আমি ৮

কি আশ্চর্য

অহো ― 

এ রাজকুলের লক্ষ্মী মহাতেজস্বিনী! (১৪

………….

এ কি

ওই না যে পদ্মাবতী? আইলো কামিনি ― (১৪

― চতুর্থাঙ্ক:প্রথম গর্ভাঙ্ক

নাটকের সংলাপে ব্যবহৃত এই ছন্দ মিলহীন ও প্রবহমান। ‘ধ্রুপদী মুক্ত ছন্দ’ বা মিশ্র পর্বের অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’ নির্মাণের এই প্রয়াসের পরিণত রূপ মধুসূদনের নীতিকবিতার ছন্দ। আর এই পরিণতিতে লা ফোঁতেন হয়ে উঠেছেন তাঁর আদর্শ।

৩৬.গ্র.বিবিধ কাব্যচতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ১৫।

৩৭.গ্র.বিবিধ কাব্যচতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ৩৬।

৩৮ভের্সাই থেকে গৌরদাসকে লেখা যে চিঠিতে মধুসুদন ‘ইতালীয় ও ফরাসি কিছু বিষয়ের’ অনুকরণের সংবাদ দিয়েছেন তাতেই [জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৭১৫৭২] তিনি লিখছেন: ‘The fit has passed away and I do not know if it will ever come back again. You know I write by fits and starts.’ মধুসুদনের সেই fit’আর ফিরে আসেনি׀

৩৯ . Fables, livre I, fable XX, p.45 লা ফোঁতেনের এই নীতিকবিতাটির উত্স মনে হয় ইশপএর নীতিকাহিনির অবলম্বনে ল্যাটিন পদ্যে ফেদ্রুসএর অনুরচনা মোরগ ও মুক্তা’ (Pullus ad Margaritam) ল্যাটিনফরাসিইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় মোরগ ও মুক্তা, ‘মোরগ ও মণি, ‘মোরগ ও হিরে’ ইত্যাদি শিরোনামে ইশপএর অনুরচনা হিসেবে এই নীতিকাহিনিটি পাওয়া গেলেও গ্রিকে মূল কাহিনিটি অপ্রাপ্য। লা ফোঁতেনের নীতিকবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকের কাহিনি মনে হয় নীতি নির্দেশ করার জন্য লা ফোঁতেনের নিজস্ব সংযোজন। কৌতুহলী পাঠকের জন্য আমরা লা ফোঁতেনের নীতিকবিতাটির অন্য এক বাঙালি কবির ইংরেজি অনুবাদ উপস্থিত করছি:

THE COCK AND THE PEARL.

Once a cock did run away

With a pearl, which he did lay

With the greatest jeweller ;

I do think it fine,’ said he ;

But the smallest corn would be

Just the thing I would prefer.’

Once a man unletter’d got

Book handwritten, which he brought

To his next-door bookseller;

I do think it good,’ said he;

But the smallest coin would be

Just the thing I would prefer.’

September, 1908.

― Roby Dutt: Echoes from East and West

Cambridge, 1909.পৃষ্ঠা ২৭০

৪০.গ্র.বিবিধ কাব্যচতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ২৯।।

৪১টীকা ৩৯ দ্রষ্টব্য।

৪২Fables, livre I, fable XXII, p.48 লা ফোঁতেনের ওক ও নলখাগড়া’ (Le Chêne et le Roseau) নীতিকবিতাটির সূত্র ইশপ। ইশপএর নীতিকাহিনিটির ঔপরাচনিক শিরোনাম বিভিন্ন সংকলনে নলখাগড়া ও অলিভ গাছ’ (Κάλαμος καί ’Ελαία),নলখাগড়াগুলি ও ওক’ (Κάλαμοι καί Δρύς), ‘দেবদারু ও কাঁটাঝোপ’ (’Ελάτη καίΒάτος), আর বাব্রিয়াস/বাব্রিয়সএর (Βαβρίας/Βάβριος) নীতিকাহিনির সংকলনে এই কাহিনি বিচগাছ ও নলখাগড়া’ (Φηγός καί Κάλαμος), বা দেবদারু ও কাঁটাঝোপ(’Ελάτη και Βάτος) নামে চিহ্নিত।

৪৩ফরাসিতে যে ছোট গায়ক পাখির নাম রোয়াৎলে/roitelet (চড়ইয়ের চেয়ে ছোট চড়াই জাতীয় পাখি/Oiseau passereau plus petit que le moineau.― Le Petit Robert)। একে ইংরেজিতে বলা হয় রেন/wren।

৪৪.গ্র.বিবিধ কাব্যচতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ১৮।

৪৫Fables, livre I, fable II, p.7 লা ফোঁতেনের এই নীতিকবিতাটির উত্স ইশপএর নীতিকথা কাক ও শেয়াল’ (Κόραξ και ’Αλώπηξ)

৪৬.গ্র.বিবিধ কাব্যচতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ২০।

৪৭.গ্র.বিবিধ কাব্যচতুর্থ মুদ্রণ ১৯৫৬পৃষ্ঠা ১৭।

৪৮কবিতার অনুবাদ ও আরো দুটি প্রবন্ধ,  কলকাতারক্তকরবী১৯৯৮।

৪৯জীবনচরিতপৃষ্ঠা ৫৭৪৫৭৫।

পরিভাষা

এই নিবন্ধে বেশ কিছু বাংলা পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।ইয়োরোপীয় পারিভাষিক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দের অনেকগুলিই আমাদের নির্বাচন। এছড়া কিছু বাংলা পারিভাষিক শব্দ রয়েছে যেগুলি আমাদের নিজস্ব ধারণা প্রকাশের প্রয়োজনে সৃষ্টএই শব্দগুলির সম্ভাব্য ইংরেজি (ইয়োরোপীয়প্রতিশব্দ আমরা প্রস্তাব করেছি।আমাদের উদ্ভাবিত বাংলা পারিভাষিক শব্দও তার প্রস্তাবিত ইংরেজি প্রতিশব্দ হল: প্ররচনা (প্রকৃষ্ট রচনা বা মূল রচনাprimotextপ্রলিখন(প্রকৃষ্ট বা মূল রচনার লিখনprimowritingঅনুরচনা(অনুকরণ,অবলম্বন বা/এবং অনুবাদ দ্বারা সৃষ্ট শব্দmimotext,অনুলিখন (অনুরচনার লিখনmimowritingঅন্তিক(সাংস্কৃতিক/ভাষিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারে আপেক্ষিক ভাবে পরস্পরের নিকটস্থproximalদূরান্তিক (সাংস্কৃতিক/ভাষিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারে আপেক্ষিক ভাবে দূরবর্তীdistal

অক্ষর syllable

অক্ষর ভিত্তিক syllabic

অক্ষরস্বরাঘাত ভিত্তিক syllabotonic

অতিসাংস্কৃতিক transcultural

অন্তিক proximal

অনুরচনা mimotext

অনুরাচনিক mimotextual

অনুলিখন mimowriting

অবলম্বন adaptation

আত্তীকরণ assimilation

আন্তঃরাচনিক intertextual

আন্তঃরাচনিকতা intertextuelality

আন্তঃসাংস্কৃতিক intercultural

আন্তঃসাংস্কৃতিকতা interculturalality

আন্তর্ভাষিক Interlingual

আন্তর্সাহিত্যিক Interliterary

আলোকায়ন focalisation

উপরচনা paratext

ঔপরাচনিক paratextual

কাহিনিকথন narration

কাহিনিরস narrativity

তন্ত্র system

দূরান্তিক distal

পঠন reading

পুঁথি সংস্কৃতি Manuscript culture

প্রত্যাশার দিগ্ববলয়

Erwartungshorizont/

horizon of expectations

প্রবহমানতা enjambement

প্রভাবতত্ত্ব influenceology

প্ররচনা primotext

প্রলিখন primowriting

পরিগ্রহণ reception

পরিগ্রাহক receiver

বর্গgenre

মুদ্রণসংস্কৃতি Print culture

মৌখিক সংস্কৃতির Oral Culture

রচনা text

রাচনিকতা textuality

সংকরায়ণ hybridization

সংকেত sign

সংজ্ঞাপন communication

সংশ্লেষণ synthesis

সংস্থান structure

সঞ্চালন circulation

স্থানীয়করণ localisation

সম্প্রেষক emitter

সম্প্রেষণ emission