বাংলায় বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ
পুষ্কর দাশগুপ্ত
আমার হাতের কাছে রয়েছে ‘আকাদেমি বানান অভিধান’ (পঞ্চম সংস্করণ, আগস্ট ২০০৫) । পাতা ওলটাতে ওলটাতে চোখে পড়ল ‘প্যারি [রী নয়]’ (পৃষ্ঠা ২৮৪)। অনুমান করলাম এই শব্দটি ফ্রান্সের রাজধানীর নাম Paris–এর প্রতিবর্ণীকরণ । মনে পড়ল বেশ কিছু বিদগ্ধ বাঙালি ফ্রান্সের রাজধানীর নাম লেখেন ‘পারী’। অতৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ–কার বর্জনীয় — এই বিধি মেনে বানান–অভিধানে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে নির্দেশ করা হয়েছে ‘রী’ নয়। প্রসঙ্গত একাধিক কথা বলার থাকে। ফ্রান্সের রাজধানী উনিশ শতক থেকে ইংরেজি উচ্চারণের অনুসরণে বাঙালিদের কাছে বাংলা ভাষায় ‘প্যারিস’ নামে পরিচিত। তাকে পালটানোর প্রয়োজন বা/এবং যুক্তিটা কী ? যদি বলা হয় ‘প্যারি’ বা ‘পারী’ ‘মূল’ ভাষার ‘শুদ্ধ’ বা ‘সঠিক’ উচ্চারণ তাহলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রথমত এক ভাষার কিছু কিছু ধ্বনিমূল (ফোনিম/phoneme) অন্য একটি ভাষায় অনুপস্থিত থাকতে পারে আর তখন উক্ত অনুপস্থিত ধ্বনিমূলকে লিখিতভাবে প্রকাশ করার জন্য কোনো বর্ণ–প্রতীক ও (বর্ণমূল = গ্রাফিম/grapheme) ঐ দ্বিতীয় ভাষায় থাকে না ৷ বানান অভিধানের ‘প্যারি’–র অ্যা/æ (বাংলায় ‘দেখা’, ইংরেজি cat) ফরাসি ভাষায় নেই। Paris নামের a ‘আ’ (ɑ :) ‘অ্যা’ নয়। আবার প্যারিসীয় ফরাসি R–এর উচ্চারণ বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতিতে নেই। তাই বাংলা বর্ণ ‘র’ দিয়ে তার যথাযথ প্রকাশ সম্ভব নয়, যেমন বাংলা ‘ড়’, ‘ঢ়’ বা ‘ঢ’ দ্বারা প্রকাশিত ধ্বনিমূলকে ইয়োরোপীয় (গ্রিক, ল্যাটিন) বর্ণমালার কোনো বর্ণমূল দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। ফরাসি i-এর দীর্ঘত্ব প্রকাশ করার জন্য যদি দীর্ঘ ঈকার ব্যবহার করা হয় তাহলেও বাঙালির উচ্চারণে তা হ্রস্ব রূপ লাভ করবে। কেননা বাংলা উচ্চারণপদ্ধতিতে ‘ই’ আর ‘ঈ’–এর কোনো তফাত নেই — একাক্ষর শব্দে (যেমন ‘চিল’, ‘ধীর’) দুটোই দীর্ঘ, অন্যত্র দুটোই হ্রস্ব (যেমন ‘প্রতিবাদী’, ‘টীকাটিপ্পনী’। দ্বিতীয়ত ‘প্যারিস’ জাতীয় বিভিন্ন বিদেশি ভৌগোলিক বা ব্যক্তির নামের তথাকথিত ‘মূলানুগ’, ‘শুদ্ধ’ বা ‘সঠিক’ উচ্চারণের প্রতিবর্ণীকরণের শুদ্ধিয়জ্ঞ যদি একবার শুরু হয় তাহলে আমরা যে গোলকধাঁধায় প্রবেশ করব তার মধ্যে পথ হারিয়ে ঘোরা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। ইতালি, রোম, মিলান, লিসবন, গ্রিস, অ্যাথেন্স, ইজিপ্ট/মিশর, কাইরো, মেক্সিকো ইত্যাদি আর বলা বা লেখা যাবে না, বলতে বা/এবং লিখতে হবে ইতালিয়া, রমা (ইতালীয়r-এর উচ্চারণ বাংলা ভাষার ‘র’–এর উচ্চারণ এক নয়), মিলানো, লিসবোআ, এলাস বা এলাদা, আথিনা (গ্রিক θ থিতা বাংলা ‘থ’ দিয়ে প্রতিবর্ণীকরণ করা যায় না), কেমেৎ/মিস্র্ বা গুমহুরিয়াৎ মিস্র্ আল আরাবিয়া, আল–কাহিরা, মেহিকো (আরবি ‘হ’ আর ইস্পানি x ঠিক বাংলা ‘হ’ নয়, আবার তা মহাপ্রাণ ‘খ’ ও নয়)।
আকাদেমি বানান অভিধানের ৪৫৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘শ্যাম্পেন’। ‘শ্যাম্পেন’ ফ্রান্সের উক্ত নামের প্রদেশে উৎপাদিত ফেনাওঠা সাদা মদবিশেষ। champagne–এর ইংরেজি উচ্চারণের অনুসরণে বাংলা ভাষায় বহু কাল ধরে উক্ত বিশেষ ধরনের মদের নাম হিসেবে ‘শ্যাম্পেন’ শব্দটি প্রচলিত আর এই প্রচলিত রূপটি রক্ষা করাই আমাদের মতে যুক্তিযুক্ত। তবে প্রশ্ন হল ‘শঁপাইন’ (ফরাসিতে gn–এর তরল ‘J’ ধ্বনি বাংলায় নেই) যদি তার প্রচলিত রূপ ‘শ্যাম্পেন’ নামে স্বীকৃত হয় তাহলে ‘প্যারিস’–এর বদলে বাংলায় ‘প্যারি’ বা ‘পারী’ বলা বা/এবং লেখার লেখার যুক্তিটা কী ?
বানান অভিধানের ২৮৪ পৃষ্ঠায় দেখলাম ‘প্যাস্কাল’। এতদিন শুনে আসা সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞানী–দার্শনিক ‘পাস্কাল’–এর নাম অভিধান–কর্তাদের ইচ্ছায় ‘প্যাস্কাল’–এ পরিণত হল কেন তা বোঝা গেল না।
পূর্বোক্ত প্রসঙ্গের জের টেনে বলা যায় যে বেশ কিছুকাল ধরে বাংলা ভাষায় বিদেশি আখ্যাবাচক বিশেষ্যের, বিশেষ ভৌগোলিক ও ব্যাক্তিনামের প্রতিবর্ণীকরণে একটা নৈরাজ্য লক্ষ করা যায়। এখানে ঐ অরাজকতা সম্বন্ধে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। আমার মনে হয়েছে উক্ত নৈরাজ্যের মূলে রয়েছে দু ধরনের অপ্রকৃস্থ মানসিক প্রবণতা। প্রথমত এক ধরনের প্রদর্শক (একজিবিশনিস্ট), পণ্ডিতম্মন্য আত্মস্ভরিতা (ওরা/অন্যেরা যা বলে বা লেখে তা ভুল, আমিই হলাম জ্ঞানের জিম্মাদার আমি যা বলব/লিখব তাই ধ্রুবসতা, তাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য)। দ্বিতীয়ত ঔপনিবেশিতের উপসর্গে (কলোনাইজড সিনড্রম/ colonized syndrome) ভোগা বাঙালি/ভারতীয় বুদ্ধিজীবিশ্রেণীর পাশ্চাত্যের মুখোমুখি হীনমন্যতা; তাই জাপানি, চিনে, থাই, ভিয়েতনামীয়, ইন্দোনেশীয়, আরবি ইত্যাদি ভাষার নাম সম্পর্কে বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু পশ্চিমি নামের ‘মূল’, ‘সঠিক’ উচ্চারণ দিতে না পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ! —এই প্যারানোইয়ায় তারা মুহ্যমান। কী কাণ্ড ! লোকে ভাববে ও জানে না !
ঘটনাচক্রে বেশ কিছু বছর ধরে আমি ইয়োরোপ–প্রবাসী । তাছাড়া অন্নসংস্থানের জন্য তার বহু আগে থেকেই আমাকে অ–ইংরেজি একটি ইয়োরোপীয় ভাষা পড়াতে হত, ঐ ভাষার সূত্রে বারবার ইয়োরোপেও আসতে হত। ফলে কলকাতায় দেখা হলে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, অমুক নামের সঠিক উচ্চারণটা কী হবে? নামটা বাংলায় কীভাবে লেখা যাবে?’ আমি জবাব দিই, ‘সাহেবরা আমাদের নাম–ধাম ওদের উচ্চারণপদ্ধতিতে, ওদের মতো করে উচ্চারণ করে। আমাদেরও উচিত বাংলা ভাষায় ওদের নাম–ধামের প্রচলিত উচ্চারণ আর বানানগুলি রাখা আর নতুন নাম–ধামের ক্ষেত্রে তথাকথিত শুদ্ধ বা আসল উচ্চারণ নিয়ে মাথা খারাপ না করে বাঙালির উচ্চারণ–অভ্যাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, বাঙালির ধাতে সয় এরকম বানানে প্রতিবর্ণীকরণ করা।’ প্রশ্নকর্তা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন — আমার জ্ঞানের বহর সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে বলে বোধ হয়।
ইয়োরোপ আমেরিকার নাম করলে এ দেশের বুদ্ধিজীবিরা কিছুটা নড়েচড়ে বসেন, বেশ খানিকটা স্বস্তি পান। তাই ইয়োরোপীয় পরিপ্রেক্ষিতে যাওয়া যাক, ঐ পশ্চিমি পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে আমাদের হীনমন্যতা আর মানসিক দৈন্যের ছবিটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের রাজধানীর নামের বাংলা ভাষায় উচ্চারণ–প্রতিবণীকরণ নিয়ে প্যারিস–প্যারি–পারী–র টানা–হ্যাঁচড়ার কথা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। ঐ নগরীকে ফরাসি বাদ দিয়ে অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষায় বলা বা/এবং লেখা হয়ে থেকে প্যারিস, পারিস, পারিয়িস, পারিসি, ইত্যাদি। ঐ সব ভাষা বলা বা লেখার সময় কেউ উক্ত নগরীর নামের তথাকথিত ‘শুদ্ধ’, ‘মূলানুগ’ উচ্চারণ — প্রতিবর্ণীকরণের চেষ্টা করে না। বস্তুত এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তথাকথিত শুদ্ধ করার চেষ্টা করলে ভাষা–ব্যবহারের উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হবে অর্থাৎ তখন ভাষা আর তার উদ্দিষ্ট পরিগ্রাহকের (রিসিভারের) কাছে বক্তব্যের সংজ্ঞাপন (কম্যুনিকেশন) করতে পারবে না। ইয়োরোপে সরু এক চিলতে ইংলিশ চ্যানেলের দুপাশে রয়েছে দুটি দেশ — গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স — ভাষা ইংরেজি আর ফরাসি। ফরাসিতে গ্রেট ব্রিটেনকে বলা হয় গ্রঁদ ব্রতাইন, ইংল্যান্ডকে অঁগলতের, ওয়েলসকে গাল, শেকসপিয়ারকে শেকসপির, লন্ডনকে লোঁদর্। আর ইংরেজিতে ফ্রঁসকে বলা হয় ফ্রান্স, পারিকে প্যারিস, ব্রতাইনকে ব্রিট্যানি, মঁশকে ইংলিশ চ্যানেল, তুর এফেলকে আইফেল টাওয়ার, জান দার্ককে জোয়ান অব আর্ক ৷ ফরাসি বলতে পারে এরকম একজন ইংরেজকে ফরাসিতে সংজ্ঞাপন করতে গিয়ে বলতে হয় গ্রঁদ ব্রতাইন, অঁগলতের, গাল, শেকসপির, লোঁদর্ আর ঠিক একই ভাবে একজন ফরাসিকে ইংরেজিতে বলতে হয় ফ্রান্স, প্যারিস, ব্রিটানি, ইংলিশ চ্যানেল, আইফেল টাওয়ার, জান দার্ক ৷ অথচ বাংলায় বহুকাল ধরে প্রচলিত জার্মান মহাকবি গেটে–র নাম ‘শুদ্ধভাবে’ উপস্থাপিত করতে গিয়ে গ্যেটে, গয়টে, গ্যোয়টে, গ্যোটে, ইত্যাদি কত কিছুই না বলা বা/এবং লেখা হয়। ‘ইডিপাস’ নামে পরিচিত গ্রিক ধ্রুপদী নাটক তথা তার নায়কের নাম ইডিপাস, ঈডিপাস, অয়দিপুস, অয়দিপাউস, ইত্যাদির মধ্যে কোনটা ‘সাঠিক’ তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ তর্ক হয়। উনিশ শতকের এক বিখ্যাত ফরাসি কবির নাম ব়্যাঁবো, হ্র্যাম্বো, হ্র্যাঁবো, খ্যাম্বো ইত্যাদির মধ্যে কোনটা ‘মূলানুগ’ তা নিয়ে লড়াই বেধে যায়। অথচ ফরাসিতে সংজ্ঞাপন করতে গেলে তথাকথিত ‘সঠিক’, ‘মূলানাগ’ উচ্চারণ ভুলে গিয়ে একজন জার্মান, একজন গ্রিক, একজন ইতালিয়ান, এমন কী একজন বাঙালিকেও বলতে হয় ‘গ্যোৎ ’ (গেটে), ‘য়্যদিপ’ (ইডিপাস), দঁত (দান্তে)।
ইদানীং কালের বাংলা ভাষার তাবৎ লিখিত উৎপাদনে (সংবাদপত্র, সামায়িক পত্র, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনায়) পশ্চিমি আখ্যাবাচক নামপদের উচ্চারণ–প্রতিবর্ণীকরণের অরাজকতার অজস্র দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। আমার সামনে রয়েছে সুবল সামন্ত সম্পাদিত সাম্প্রতিক কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য–পত্রিকা ‘এবং মুশেয়ারা’–র একটি সংখ্যা। এই বিশেষ সংখ্যাটির বিষয়বস্তু হল ষোড়শ শতকের বিখ্যাত ইস্পানি উপন্যাস Don Quixote। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং সাহিত্যস্রষ্টা উপন্যাসটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন ৷ এসব আলোচনার বিচার বা মূল্যায়ন এখানে আমার আলোচ্য নয় আর তা আমার ক্ষমতারও বাইরে। তবে পাত্রিকাটিতে প্রকাশিত বিভিন্ন রচনায় উক্ত উপন্যাসের শিরোনাম তথা প্রধান চরিত্র, প্রধান চরিত্রের সঙ্গী ও উপন্যাসের রচয়িতার নামের যে উচ্চারণ–প্রতিবর্ণীকরণগুলি চোখে পড়ল তা হতবুদ্ধি করার মতো:
১. উপন্যাস ও তার প্রধান চরিত্রের নাম Don Quixote : ডন কুইকসোট, ডন কুইক্ সোট, ডন কুইকজোট, ডন কুইক্ জোট, ডন কিহ্বোতে (বাংলায় ‘হ্বো’–র উচ্চারণটা কী ?), ডন কিহোতে, দন কিহোতে, দোন কিখোতে, ডন কিওটি, ডন কুইক্সোট, দোন কিহোতি, ডন কুইজোট, ডন কিহোটে, দন কিশোটে, দন কিহোটে।
২. প্রধান চরিত্রের পদবির অংশ de la Mancha: দি লা মাঞ্চা, দ্য লা মাংকা, দ্য লা মাঞ্চা, ডি লা মাঞ্চা, দে লা মানচা, দে লা মাঞ্চা।
৩. প্রধান চরিত্রের সঙ্গীর নাম Sancho Panza : সাঙ্কো, স্যাঙ্কো, সাঙ্কো পাঞ্জা, সাংকো পাঞ্জা, সানচো পানসা, সাঞ্চো পাঞ্জা, সাঙ্কো পানসা, সাঁকো পাঁজা।
৪. উপন্যাসের রচয়িতার নাম Miguel de Cervantes Saavedra: মিগুয়েল দি থেরভান্তেস, সার্ভান্টিস, সের্ভান্তেস, সার্ভেন্তেজ, সেরভান্তেস, সের্ভান্তেস, মিগেল দে সেরভানতেস সাভেদ্রা, সারভেন্তিস, সারভেন্তেস, সারভ্যানটিস, মিগুয়েল সারভানতিস, দোন মিহুয়েল দে সের্ভান্তেস সাভেদ্রা, সেরভেন্তেস, সার্ভান্তিস, মিগেল দে সেরভান্তেস সাবেদ্রা, মিগেল দ থেরভান্টে সাআভেদ্রা, মিগেল দ্য সেরবানতেস, মিখুয়েল দে সেরভানতেস সাভেদ্রা।
ওপরের তালিকা থেকে সাধারণভাবে বাংলা ভাষার অস্থির নৈরাজ্যের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই অস্থিরতা তার পরিপুষ্টি ও পরিণতির অভাবকে সূচিত করে। আমি ‘ভারতীয়’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘গান্ধি’–র দেশের লোক, ‘কলকাতা’ থেকে এসেছি। একথা বোঝানোর জন্য আমাকে ইংরেজিতে বলতে হয়, আমি ‘ইন্ডিয়া’ থেকে আসা ‘ইন্ডিয়ান’ (আমেরিকার ‘ইন্ডিয়ান’ নই), ‘টেগোর’ আর ‘গ্যান্ডি’–র দেশের লোক, ‘ক্যালকাটা’ (‘কোলক্যাটা’এখনো পরিচিত নয়) থেকে এসেছি ; ফরাসিতে পরিচয় দিতে হয়, আমি ‘অ্যাঁদ’ (ল্যাঁদ) থেকে আসা ‘অ্যাঁদিয়্যাঁ’, ‘তাগোর’ আর ‘গঁদি’–র দেশের লোক, ‘কালক্যুতা’ খেকে এসেছি ; গ্রিকে বলতে হয়, আমি ‘ইন্দিয়া’ থেকে আসা ‘ইন্দস’ (আমেরিকার ‘ইন্দিয়ানস’ নই), ‘তাগোর’ আর ‘গান্দি’–র দেশের লোক, ‘কালকুতা’ (‘কলকাতা’ এখানো কেউ জানে না) থেকে এসেছি। আমাকে ব্রিটিশ ইংরেজিতে বলতে হয় ডন কুইকজোট, (টেক্স–মেক্স–এর দেশ আমেরিকার) মার্কিন ইংরেজিতে ডন (বা দন) কিহোতে। অর্থাৎ সংজ্ঞাপনের সর্বস্তরে ব্যবহৃত যে–কোনো পরিণত ভাষায় আখ্যাবাচক বিদেশি নামপদের (ভৌগোলিক বা ব্যত্তির নামের) অনন্য একটি সর্বজনগ্রাহ্য মান উচ্চারণ–প্রতিবর্ণীকরণের রূপ রয়েছে। ঐ রূপ উক্ত ভাষার ধ্বনি–উৎপাদন–পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে উঠেছে। সেখানে ঔপনিবেশিতের উপসর্গের প্রকাশক হীনমন্যতা থেকে ‘আসল’ , ‘সঠিক’, ‘মূলানুগ’ উচ্চারণের অর্থহীন অনুকরণের প্রয়াস দেখা যায় না। বহু ভাষায় সংজ্ঞাপনে সক্ষম বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা তাঁরা কি এ জাতীয় প্রয়াস কোনো পরিণত ভাষায় লক্ষ করেছেন?
এমনকী বাঙালির হীনমন্যতার প্রকাশ ভারতীয় ভাষার আখ্যাবাচক নামপদের প্রতিবর্ণীকরণেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। হিন্দিতে বংগাল, কলকাত্তা, হাবড়া ইত্যাদি বলা বা লেখা হত এবং এখানো হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় সম্প্রতি গাঁধি, পটনা, গ্বার্লিয়র (শব্দের আদি অক্ষরে বাংলায় ব–যুক্ত ব্যঞ্জনে ‘ব’ বা ‘ব–ফলার’ কোনো উচ্চারণ নেই যেমন ‘স্বাধীনতা’, তাহলে ‘গ্বা’–এর উচ্চারণ কী ?) ইত্যাদি লেখা শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গত আরেকটি প্রশ্ন : আখ্যাবাচক নামপদের উচ্চারণ—প্রতিবর্ণীকরণের মান, সর্বজনগ্রাহ্য রূপ স্থির করা — যা চলে আসছে (প্যারিস, অ্যাথেন্স, ইডিপাস, গেটে, ডন কুইকজোট ইত্যাদি) তাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া আর বাংলা ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক সংস্থান (স্ট্রাকচার) মেনে নতুন বিদেশি নামের উচ্চারণ — প্রতিবর্ণীকরণের একটা নিয়ম–প্রণালী তৈরি করা কি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আর ঢাকার বাংলা একাডেমির যৌথ কর্তব্য হয়ে উঠতে পারে না ? তবে এ প্রয়াসেও বিদেশি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বে জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে যা দরকার তা হল বাংলা ভাষার উচ্চারণরীতির কাঠামোয় বিদেশি শব্দ তথা ধ্বনিকে (প্রয়োজন অনুসারে রূপান্তরিত করে) স্থান দেওয়া — বাঙালির ধ্বনি–উৎপাদন স্বভাবের সঙ্গে তাকে খাপ খাওয়ানো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান–সংস্কার সমিতি ১৯৩৬ সালে তাঁদের প্রস্তাবে Z–র প্রতিবর্ণীকরণের নিম্নরেখাযুক্ত অথবা দুটি বিন্দু বা ফুটকিযুক্ত জ* ব্যবহারের কথা বলেছিলেন, তারপর বুদ্ধদেব বসু pleasure-এর S বা ফরাসি j আর g(+e/ i)-এর জন্য একটা বিন্দু বা ফুটকিওয়ালা ‘জ’*–এর প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু বিদেশি ভাষার উচ্চারণে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত নয় এরকম বাঙালির উচ্চারণে ফুটকি ছাড়া ‘জ’ বা/এবং নিম্নরেখাযুক্ত তথা দুটি বা একটি ফুটকিওয়ালা ‘জ*’ এক আর অনন্য বাংলা ‘জ’–এ* পরিণত হতে বাধ্য ৷
আমার শেষ জিজ্ঞাসা : বাংলা ভাষা কি কখনো সাবালক হবে না ? আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের সহজাত নিয়ম মেনে বিদেশি শব্দকে নিজস্ব ধ্বনিসংস্থানের মধ্যে রূশান্তরিত তথা আত্মীকৃত করে নিতে পারবে না ? বাংলা ভাষা কি চিরকাল শৈশবের অস্ফুট, অপটু অনুকরণে সাহেবদের নাম–ধাম আউড়াতে থাকবে ? বাংলা ভাষার চিরশৈশব কি কাটবে না ?