ফরাসি সাহিত্যের বাঙালি পরিগ্রহণ: জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুর
Réception bengali De la littérature fraçaise : jyotirindranath thakur (1849-1925)
১
ফরাসি সাহিত্যের বাঙালি পরিগ্রহণ:
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৫–১৯২৫)
প্রথম অংশ
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ষষ্ঠ সন্তান, পঞ্চম পুত্র। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৪৯ সালে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট ভাইদের একজন তিনি বয়সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চেয়ে বারো বছরের ছোট। ১৯২৫ সালে ছিয়াত্তর বছর বয়সে রাঁচিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মারা যান।
রবীন্দ্রনাথ তথা ঠাকুরবাড়ি প্রসঙ্গে আলোচনায় বারবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাম করা হয়, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভার পরিপোষক, ভারতী পত্রিকার প্রকাশের প্রধান উদ্যোক্তা, জোড়াসাঁকো নাট্যশালা স্থাপন তথা ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যোগের উত্সাহী সংগঠক হিসেবে তাঁর নাম করা হলেও তাঁর জীবন বা রচনা সম্পর্কে সাধারণভাবে একটা নীরবতা পালন করা হয়। ১৯৬৩ সালে কবি সুশীল রায় গবেষণা হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থেও তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন বা তাঁর সম্পর্কে নীরবতা সম্পর্কে সে অর্থে কোনো বিস্তৃত আলোচনা না করে যথারীতি ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিয়ে অনেকটা আলোচনা করেছেন। এই বইয়ের ভূমিকায় সুকুমার সেন লিখেছেন ‘তাঁর জীবন সম্বন্ধে আরো অনেক জানতে ইচ্ছে করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে আমার কেমন tragic figure বলে মনে হয়।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত, তবে তিনি যে বইয়ের ভূমিকায় একথা লিখেছেন সে বইটিতেও পূর্বোল্লিখিত নীরবতা পালন করা হয়েছে। এছাড়া বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখ থেকে শোনা তাঁর জীবনস্মৃতি ১৩২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে চৈত্র মাস (১৯১৪ সালের এপ্রিল থেকে ১৯১৫ সালের মার্চ–এপ্রিল) পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ‘ভারতী’ পত্রিকায় আর তারপর ১৯২০ সালে ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি’ বই আকারে প্রকাশ করেন। তারপর সে বইও বহুকাল অপ্রাপ্য হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে ‘প্রজ্ঞাভারতী’ প্রকাশনী তা পুনর্মুদ্রিত করে। মন্মথনাথ ঘোষ ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথ’ নামে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একটি জীবনীগ্রন্থরচনা করেন (১৯২৬)।
পিতার ইচ্ছানুসারে ১৮৬৮ সালে আঠারো বছর বয়সী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরী গঙ্গোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাত বছর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়স যখন পঁয়ত্রিশ কাদম্বরী দেবী হঠাৎ আত্মহত্যা করেন (১৯ এপ্রিল, ১৯৮৪) এই ঘটনার পর থেকেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নিসঃঙ্গতা আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্পর্কে চারপাশের নীরবতার শুরু। কিন্তু কেন ? সবাই এ প্রশ্ন এড়িয়ে অন্য কোনো প্রসঙ্গে চলে যান। রবীন্দ্রনাথের ঐ সময়ের বিভিন্ন রচনা আর পারিপার্শ্বিক ঘটনা থেকে বোঝা যায় কাদম্বরী দেবী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কাদম্বরী দেবী যখন আত্মহত্যা করেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স তেইশ বছর । তার আগের বছর পিতার ইচ্ছানুসারে রবীন্দ্রনাথ এগারো বছরের মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন। কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দুবছরের বড়। রবীন্দ্রনাথের বিয়ে বা/এবং অন্য কী কারণে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন তা কখনোই প্রকাশিত হয় নি। তাছাড়া চূড়ান্ত রক্ষণশীল পিতৃশাসিত ঠাকুর–পরিবার কাদম্বরীর সমস্ত চিঠিপত্র পুড়িয়ে ফেলে আর পয়সার জোরে পুলিশ, আদালত ইত্যাদিকে নিষ্ক্রিয় করে দ্রুত কাদম্বরীর মৃতদেহের সৎকার করে ঐ ইতিহাসে দাঁড়ি টেনে দেয়। এর পর ক্রমশ বিখ্যাত হয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথকে ঘেরা ঠাকুরবাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিচ্ছিন্ন আর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রজীবনীকার তথা রবীন্দ্রসাহিত্যের ব্যাখ্যাকাররা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক যেমন কাব্যিক ব্যাখ্যার বেশি কিছু করেন না আর কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক সম্বন্ধ নীরব থাকেন। আমরা জানিনা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের tragic figure হওয়ার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাটা কী। কিন্তু আমরা দেখতে পাই ১৯২৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কখনো শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রিত হন নি । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ফরাসি দার্শনিক ভিক্তর ক্যুজাঁ–র (Victor Cousin, ১৭৯২–১৮৬৭) রচনা ‘দ্যু ভ্রে, দ্যু বো, দ্যু বিয়াঁ–র’ (Du Vrai, du Beau et du Bien, ১৮৫৩), অনুবাদ ‘সত্য, সুন্দর, মঙ্গল’ ছাড়া জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আর কোনো রচনা বিশ্বভারতী প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় নি। কবি সুশীল রায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ওপর ডক্টরেট করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কয়েক দশক পরে তিনি যখন বিশ্বভারতী গ্রন্থণা বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন তখন তাঁর সম্পাদনায় বিশ্বভারতী গ্রন্থণা বিভাগে থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাট্যসংগ্রহ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে তাঁর মৌলিক নাটক ছাড়া আর কিছুই নেই। স্ত্রীর আত্মহত্যার পর তাঁর মৌলিক লেখা প্রায় থেমে যায় । তার পর জীবনের শেষ অব্দি অক্লান্তভাবে তিনি যা করেছেন তা হল অনুবাদ: সংস্কৃত থেকে, ফরাসি থেকে, মারাঠি থেকে, ইংরেজি থেকে প্রচুর অনুবাদ। এসব অনুবাদের বড় অংশ কখনোই সংগৃহীত হয়নি, ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যেসব অনুবাদ তাঁর জীবৎকালে একবার বই হিসেবে ছাপা হয় তা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার আর কখনো ছাপা না হওয়ায় অপ্রাপ্য হয়ে যায়। বসুমতী সাহিত্যমন্দির বেশ কিছু বই আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রচনা নিয়ে পাঁচ খণ্ডে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ–রচনাবলি প্রকাশ করে (কম দাম আর আর এমন এক ধরনের সস্তা নিউজ–প্রিন্ট কাগজে ছাপা যা কয়েক বছরের মধ্যে হলুদ থেকে লাল হয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে সবকিছুর অমোঘ নশ্বরতা প্রমাণ করে)। অবশ্য ঐ রচনাবলিও এখন আর পাওয়া যায় না। আর ঐ রচনাবলির বাইরেও ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় হদিশহীন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অসংখ্য অনূদিত রচনা।
১৯১০ সালে রাঁচির ‘মোরাবাদ’ পাহাড়ের ওপর ‘শান্তিধাম’ নামে বাড়ি তৈরি করিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রায় ১৫ বছর আত্মনির্বাসিত জীবন কাটান। এখানেই নিঃসঙ্গ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শান্তিধাম বিহারি কর্মচারিদের তত্ত্বাবধানে থাকে, তাঁর গ্রন্থসংগ্রহ, অপ্রকাশিত রচনা বা পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা হয়নি অর্থাৎ কোনো ব্যবস্থা কেউ করেনি। শোনা যায়, বিহারি কর্মচারিরা বই আর কাগজপত্র জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে । তাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যেসব রচনার অনুবাদ, বিশেষত ফরাসি রচনার অনুবাদ খুঁজে ঘটনাক্রমে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলেও তার উৎস রচনা, কোন বই বা সাহিত্য–পত্রিকা থেকে তা নেওয়া, এমন কী কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেখকের নাম কী তাও নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না।
এখানে নাট্যকার, প্রবন্ধকার, সংজ্ঞীতজ্ঞ, রেখাচিত্রকার, সাহিত্য–অনুবাদক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুবাদকর্মের বিশেষ একটা অংশই শুধু এখানে আমাদের আলোচ্য, এই খণ্ডিত বিশেষ অংশটি হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফরাসি সাহিত্যের অনুবাদ ।
প্রথমেই বলা দরকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেসব ফরাসি রচনার অনুবাদ করেছেন, তা প্রত্যক্ষ অনুবাদ, অর্থাৎ ফরাসি রচনার ইংরিজি বা (অন্য কোনো ভাষার) অনুলিখনের অনুলিখন নয়, ফরাসি ভাষার প্ররচনা বা উত্স–রচনার অনুলিখনে সৃষ্ট বাংলা অনুরচনা । ফলত এই অনুরচনা তৃতীয় কোনো অনুরচয়িতার পঠন–লিখন, তৃতীয় কোনো ভাষাসংবিধির সাহিত্যরীতি তথা সাহিত্যের ইতিহাস, আর তৃতীয় কোনো অনুলিখনের রচনা–পদ্ধতির মধ্যস্থতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। এখানে প্রশ্ন হল ফরাসি যেহেতু এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যতালিকার অন্তর্গত নয় অতএব জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কখন কোথায় ফরাসি শিখেছিলেন। এ ব্যাপারে ইতিপূর্বে উল্লিখিত বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ও মন্মথনাথ ঘোষের বইয়ের সামান্য কিছু পংক্তি ছাড়া আর কোনো বিবরণ আমাদের চোখে পড়ে নি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখন হিন্দু কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র :
এই সময়ে শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় সিভিলিয়ান হইয়া এবং শ্রীযুক্ত মনোমোহন ঘোষ ব্যরিষ্টারী পাশ করিয়া আসিয়া, কাশীপুর বাগানবাড়ীতে অবস্থান করিতেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও আসিয়া, এই খানে ইঁহাদের সঙ্গে মিলিত হইলেন।… পরীক্ষার পড়া ছাড়িয়া তিনি মিষ্টার ঘোষের নিকট ফরাসী ভাষা শিক্ষা আরম্ভ করিয়া দিলেন।… ফরাসী ভাষায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রথম শিক্ষারম্ভ হইল, এই কাশীপুর উদ্যানবাটিকায়। মনোমোহন ঘোষ মহাশয় প্রথমেই ভল্টেয়ার কৃত সীজার (César) নাটক তাঁহাকে পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। তিনি বলিলেন, তাহার প্রথম চরণের একটু অংশ এখনও তাঁহার কর্ণে যেন অহরহ ধ্বনিত হইতেছে:—
‘ César tu va régner’— সীজার তু ভা রেঙিয়ে; অর্থাৎ —সীজার তুমি রাজত্ব করিতে যাইতেছ — ইত্যাদি।
— বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়: জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, কলকাতা, শিশির পাবলিশিং হাউস, ১৯২০.,পৃ.৮৭।
১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে… সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইল্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পর বত্সর তিনি ভারতবর্ষে প্রত্যাগমন করেন… তাঁহার বাল্যবন্ধু মনোমোহন ঘোষ…ব্যারিষ্টার হইয়া ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের শেষভাগে এদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। কলিকাতার উপকণ্ঠে কাশীপুরে এক উদ্যানবাটিকায় তিনি প্রথমে অবস্থান করেন। সত্যেন্দ্রনাথ কিছুদিনের জন্য সস্ত্রীক কলিকাতারয় আসিয়া তাঁহার সহিত বাস করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও তাঁহাদিগের সহিত মিলিত হইলেন। তিনি এফ্–এ পরীক্ষা প্রদানের ইচ্ছা পরিত্যগ করিয়া মনোমোহনের নিকট ফরাসী ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করিলেন…
— মন্মথনাথ ঘোষ: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কলকাতা, আদি ব্রাহ্ম সমাজ, ১৯২৭, পৃ. পৃ. ৮–৯।
তিনি [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] তখন আহম্ণদাবাদে সত্যেন্দ্রনাথের নিকট। গণেন্দ্রনাথকে লিখিত সত্যেন্দ্রনাথের নিম্নোদ্ধৃত ইংরাজি পত্রাংশের অনুবাদ পাঠে প্রতীত হয় যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন ফরাসীভাষা, চিত্রাংকনবিদ্যা ও সেতার বাদন শিক্ষা করিতেছিলেন:—
১১–৫–৬৭— জ্যোতি আমার নিকট ফরাসীভাষা শিক্ষা আরম্ভ করিয়াছে।…
৪–৯–৬৭— আমি তাহাকে ফরাসী শিখাই তেছি। সে খুব খাটিতেছে ।…
— মন্মথনাথ ঘোষ: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কলকাতা, আদি ব্রাহ্ম সমাজ, ১৯২৭, পৃ. ২০–২১।
এই সময়ে [১৮৬৮ সাল নাগাদ] কাথ্রাঁ ( Cathrin ) নামে একজন ফরাসী হেমেন্দ্রনাথের নিকট চাকরীর জন্য আসিয়াছিল। হেমেন্দ্রবাবু তাহাকে ত্রিশটাকা বেতনে পাচক নিযুক্ত করিলেন সর্ত্ত হইল, সে পাকও করিবে, ফরাসী ভাষাও পড়াইবে। একবার হেমেন্দ্রনাথ সপরিবারে বোলপুরে গিয়াছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথও তাঁহাদের সঙ্গে ছিলেন। …সে আমাদের সঙ্গে ফরাসীতেই কথা বলিত, ফরাসীতেই গল্প করিত। তাহার কারণ, সে ফরাসী ভিন্ন আর কোনও ভাযাই জানিত না।… অনেক দিন পর্য্যন্ত সে আমাদের নিকট ছিল, তারপর একবার ছুটি লইয়া বাড়ী যায়। সেখান হইতে সে নিয়মিত পত্রাদিও লিখিত; কিন্তু ফরাসী–জার্ম্মান্ (Franco-German) যুদ্ধ বাধার পর হইতে তাহার কোনো খবর পাওয়া যায় নাই।
— বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়: জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, কলকাতা, শিশির পাবলিশিং হাউস, ১৯২০.,পৃ.১৩২–১৩৫।,
বাঙালির ফরাসি সাহিত্যের পরিগ্রহণের ইতিহাসে প্রথমেই যে দুটি নাম মনে পড়ে তা হল তরু দত্ত (১৮৫৬–১৮৭৭) আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর মধ্যে তরুর পরিগ্রহণের প্রকাশ ইংরেজি ভাষায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে এই ভাষা বাংলা। এদিক থেকে বাঙালির ফরাসি সাহিত্যের পরিগ্রহণের ইতিহাসে দুজনের ভূমিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন। খুব সহজভাবে বলা যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফরাসি সাহিত্যের পরিগ্রহণের ফলশ্রুতি বাংলা ভাষায় আনুরাচনিক সৃষ্টি বাঙালির সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিকতার পরিধি প্রসারিত করে আর তারই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে বাংলা ভাষার সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতায় আত্তীকৃত হয়, এর পাশাপাশি বাঙালি তরু–র ফরাসি সাহিত্যের পরিগ্রহণ তথা তার ফলশ্রুতি ইংরেজি ভাষায় আনুরাচনিক সৃষ্টি (A Sheaf Gleaned from the French Fields, Calcutta, 1st edition, 1776, 2nd edition, 1778, London, 3rd edition,1880) বাঙালির সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিকতার পরিধি প্রসারিত করলেও বাংলা ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে তার কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই।
বহুকাল ধরে অপ্রাপ্য বলে ফরাসি থেকে অনূদিত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনা আজকের বাংলা ভাষার পাঠকের অচেনা। তাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফরাসি থেকে অনুবাদের অনুবাদতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বা মূল্যায়ন না করে এখানে আমাদের উদ্দেশ্য হল :
১. ক) জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফরাসি থেকে অনূদিত রচনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় সহ একটা অসমাপ্ত তালিকা বা পঞ্জি রচনা, ‘অসমাপ্ত’, কেননা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফরাসি থেকে অনূদিত বহু রচনা হদিশ ছাড়া ভাবে আজো ছড়িয়ে রয়েছে পুরনো দিনের পত্র–পত্রিকায়।
খ) বাংলায় অনূদিত রচনার পঞ্জি তৈরির আরেকটি অসুবিধে হল বাংলা ভাষায় অনুবাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্স–রচনার নাম নির্দেশ করা হয় না, আবার অনেক সময় সামাজিক–সাংস্কৃতিক কারণে শিরোনামও পালটানো হয়; এছাড়া বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় উত্স–রচনার রচয়িতার প্রকৃত নামও অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন ভিক্তর য়ুগো–র একটি কবিতার শিরোনাম Quia pulvis es (ক্যথলিক খ্রিস্টানদের ইস্টারের আগের চল্লিশ দিনের লেন্টের শুরুর অ্যাশ ওয়েডনেসডে–র খ্রিস্টপর্বে পাদ্রি ল্যাটিন বাইবেল–এর আদিপুস্তকের (৩.১৯) বাক্যাংশকে ব্যবহার করে বলেন, Memento homo quia pulvis es et in pulverem reverteris স্মরণ করো মানুষ, যেহেতু তুমি ধূলি আর ধূলিতেই তুমি ফিরে যাবে)। কবিতাটির দুটি বাংলা অনুবাদ রয়েছে: একটি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের যার শিরোনাম ‘জীবন মরণ’, দ্বিতীয় অনুবাদটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের, শিরোনাম ‘আসলে জীবিত’ ; দুটি অনুবাদেই মূল কবিতার কোনো নির্দেশ না থাকায় উত্স–রচনা খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে । মোপাসঁ–র (Maupassant) ‘অলংকার’ (La Parure) বলে একটা গল্প রয়েছে, বাংলায় তার অনুবাদের নাম ‘কণ্ঠমালা’ (ভারতী, বৈশাখ, ১৩০২/এপ্রিল ১৮৯৫, অনুবাদকের নাম নেই), ‘নেকলেস (শীতাংসু মৈত্র: মোপাসাঁ থেকে, ১৯৪৬), ‘হীরের হার’ (বিমল দত্ত: মোপাসাঁ পঞ্চবিংশতি, তারিখহীন; অরুণ চক্রবর্তী, গীতা গুহ রায়: মোপাসাঁ–র সেরা প্রেমের গল্প, ১৯৭৮), প্ররচনার কোনো নাম না থাকায় খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত বোঝা যায় যে অনুরচনার শিরোনামের সূত্র হল ইংরেজি অনুরচনার শিরোনামThe Necklaceবা The Diamond Necklace ৷
২.আজকের বাংলা ভাষার পাঠকের* কাছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফরাসি থেকে অনূদিত রচনার প্রাথমিক পরিচয় দেওয়ার জন্য আমরা তাঁর পুস্তকাকারে প্রকাশিত অনূদিত গল্প–কবিতার সংকলন ‘ফরাসী–প্রসূন’ (১৯০৪) আর তার সঙ্গে ‘আরো কিছু অনুবাদ’ অংশে ‘বসুমতী সাহিত্যমন্দির’ প্রকাশিত ‘ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ– গ্রন্থাবলীতে’ সাময়িক প ত্র থেকে সংকলিত ফরাসি থেকে অনূদিত কয়েকটি গল্প এবং এর বাইরে ছড়িয়ে থাকা আরো কিছু ফরাসি থেকে অনূদিত গল্প–কবিতা উপস্থাপিত করেছি।
(dasgupta2812@gmail.com)