গিয়োম আপলিনের (১৮৮০– ১৯১৮)
[এখানে টীকাসহ আপলিনের–এর যে কবিতাগুলির অনুবাদ উপস্থাপিত হয়েছে সেগুলি পুষ্কর দাশগুপ্তের ‘আপলিনের–এর কবিতা’ (দ্বিতীয় সংস্করণ) বই থেকে নেওয়া।]
বিশ শতকের প্রথম থেকে ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ আর তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত চিন্তা ও ভাবাদর্শের জগতে দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই নতুন পরিস্থিতির সামাজিক–ঐতিহাসিক প্রথম মহাযুদ্ধ, রুশবিপ্লব, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ইত্যাদি। ইয়োরোপীয় শিল্পকলার জগতে এই ক্রান্তির প্রথম প্রকাশ ঘটে চিত্রকলার জগতে ফোভিসম্ (ফ. Fauvisme, ইং. Fauvism), ক্যুবিজম্ (ফ. Cubisme, ইং. Cubism ), সাহিত্যের জগতে নাত্যুরিসম (ফ. Naturisme, ইং. Naturism), য়্যুনানিমজম (ফ. Unanimisme, ইং. Unanimism ), দ্রামাতিসম্ (ফ. Dramatisme, ইং. Dramatism), ভর্তিসিজম (ইং. Vorticism) ইত্যাদি আন্দোলনের অস্থির সন্ধানের মধ্যে। এর পর পরিবর্তনের প্রবণতার চরমপন্থী বিস্ফোরক প্রকাশ ঘটে ফিউচারিজম (ইং. Futurism, ইতা.ফুতুরিস্মো/Futurismo, ফ. ফ্যুতিরিরসম/Futurisme) ও দাদা (Dada) আন্দোলনে।
ফরাসি কবিতায় বিশ শতকের পরিবতর্নের চরিত্র ও বিভিন্ন প্রবণতা প্রথম স্পষ্টভাবে অঙ্গীকৃত হয়েছে গিয়োম আপলিনের ও ব্লেজ সঁদ্রারের কবিতায়। এ দুজনের মধ্যে আমাদের বিচারে কবি হিসেবে ব্লেজ সঁদ্রার বিপ্লবী চরিত্রের, কবিতার জগতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রথাবিরোধী। সাহিত্যগোষ্ঠী, আন্দোলন ইত্যাদি চিহ্নিতকরণের তাবৎ সীমানার বাইরে থেকে সত্যিকারের নতুন কিছু কবিতা লিখে কবিতার জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। অন্যদিকে আপলিনের–এর কাব্যকৃতিতে বিবতর্নের চরিত্র স্পষ্ট । শেষ অব্দি আপলিনের তাঁর কবিতায় পুরনোকে নতুনের আধারে মিশিয়ে দিয়েছেন আর নতুনকে পুরনোর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন । বস্তুত আধুনিক ফরাসি কবিতার ইতিহাসে আপলিনের–এর কাব্যসৃষ্টি সেই সংযোগক্ষেত্র যেখানে অনেক পুরনো রাস্তা শেষ হয়েছে আর যেখান থেকে শুরু হয়েছে অনেক নতুন পথ।
আপলিনের সম্পর্কে:
On peut dire que le grand poète que fut Apollinaire a mis fin à l’ère des « poètes maudits ». Avec lui commence celle de « la poésie conquérante ». Tout est conquête dans ce vaste domaine où la poésie est constante invention, comme désormais il ne s’agira plus vivre sa vie, mais de l’inventer à chaque instant. ―Tristan Tzara
[ বলা যায় বিরাট কবি হিসেবে আপলিনের ‘অভিশপ্ত কবিদের’ যুগের অবসান ঘটিয়েছেন। তাঁর রচনাতেই শুরু হয়েছে ‘বিজয়ী কবিতার’ যুগ। বিশাল এই ক্ষেত্রে সব কিছুই হল বিজয় যেখানে কবিতা হল নিরন্তর উদ্ভাবন। যেন এর পর থেকে জীবন যাপন করা বলা যাবে না, বরং বলতে হবে প্রতি মুহূর্তে জীবনকে আবিস্কার করা। — ―ত্রিস্তঁ জারা।]
আপলিনের থেকে:
তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সুরাসার’ (Alcools) সম্পর্কে আপলিনের একটি চিঠিতে (৩০ এপ্রিল ১৯১৪) যেকথা লিখেছিলেন তা তাঁর সমস্ত কাব্যসৃষ্টি সম্পর্কে প্রযোজ্য:
…vous le classerez dans l’école poétique qui vous plaira, je ne prétends faire partie d’aucune, mais il n’en est également aucune à laquelle je ne sente pas un peu attaché.
[…বইটাকে তোমরা তোমাদের খুশিমতো কবিতার যেকোনো একটা প্রস্থানে স্থান দিতে পার, আমি নিজেকে কোনো একটা বিশেষ প্রস্থানের অন্তর্ভুক্ত বলে ভাবি না, আবার এমন কোনো প্রস্থান নেই যার সঙ্গে আমি কিছুটা সম্পর্ক বোধ করি না।]
গিয়োম আপলিনের–এর ‘নতুন মানসিকতা আর কবিরা’ (Guillaume Apollinaire : L’esprit nouveau et les poètes) থেকে:
Les artifices typographiques poussés très loin avec une grande audace ont l’avantage de faire naître un lyrisme visuel qui était presque inconnu avant notre époque. Ces artifices peuvent aller très loin encore et consommer la synthèse des arts, de la musique, de la peinture et de la littérature.
[দারুণ সাহসে বহুদূর অব্দি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মুদ্রণলিপির তাবৎ কৌশলের মধ্যে রয়েছে আমাদের আগে প্রায় অজ্ঞাত দৃষ্টিগ্রাহ্য একটা গীতিময়তার জন্ম দেওয়ার সুযোগ ৷ এসব কৌশল আরো অনেক দূরে এগিয়ে গিয়ে বিভিন্ন শিল্পকলা, সঙ্গীত, চিত্রকলা আর সাহিত্যের সংশ্লেষণ ঘটাতে পারে ৷]
L’esprit nouveau est… dans la surprise. C’est ce qu’il y a en lui de plus vivant, de plus neuf. La surprise est le grand ressort nouveau. C’est par la surprise, par la place importante qu’il fait à la surprise que l’esprit nouveau se distingue de tous les mouvements artistiques et littéraires qui l’ont precedé.
[নতুন মানিসকতা রয়েছে… বিস্ময়ের মধ্যে ৷ নতুন মানিসকতার মধ্যে এটাই হল গিয়ে সবচেয়ে জীবন্ত, সবচেয়ে আনকোরা নতুন ৷ বিস্ময় হল নতুন এক বিরাট প্রেরণা ৷ বিস্ময়ের জন্যই, বিস্ময়কে যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান সে দেয় তার জন্যই নতুন মানিসকতা তার আগের তাবৎ শিল্প আর সাহিত্যের আন্দোলন থেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত ৷]
L’esprit nouveau est avant tout ennemi de l’esthétisme, des formules et de tout snobisme. Il ne lutte point contre quelque école que ce soit, car il ne veut pas être une école, mais un des grands courants de la littérature englobant toutes les écoles, depuis le symbolisme et le naturisme.
[নতুন মানসিকতা সবকিছুর আগে নান্দনিকতা,বাঁধা গতের ফর্মুলা আর তাবৎ উন্নাসিকতার শত্রু । এই নতুন মানসিকতা বিশেষ কোনো প্রস্থানের বিরুদ্ধে লড়াই করে না, কেননা তা নিজে কোনো প্রস্থান হতে চায় না, প্রতীকিবাদ থেকে প্রকৃতিবাদ সমস্ত প্রস্থানকে আত্মস্থ করে নতুন মানসিকতা হয়ে উঠতে চায় সাহিত্যের বিরাট একটা ধারা ৷]
গিয়োম আপলিনের তাঁর ‘তিরেজিয়াস–এর স্তন’ (Guillaume Apollinaire: Les Mamelles de Tirésias) নাটকের ভূমিকায় তাঁর উদ্ভাবিত ‘পরাবাস্তবতা’ (surréalisme) ও ‘পরাবাস্তব’ (surréaliste) শব্দদুটি প্রথম ব্যবহার করেন :
Pour caractériser mon drame je me suis servi d’un néologisme qu’on me pardonnera car cela m’arrive rarement et j’ai forgé l’adjectif surréaliste qui ne signifie pas du tout symbolique…Quand l’homme a voulu imiter la marche, il a créé la roue qui ne ressemble
pas à une jambe. Il a fait ainsi du surréalisme sans le savoir.
[আমার নাটকটির চরিত্র নিদের্শ করার জন্য আমি একটা নতুন শব্দ ব্যবহার করেছি, এর জন্য লোকে আমাকে ক্ষমা করবেন কেননা আমি তা প্রায় করি না বললেই হয় আর আমি পরাবাস্তব (স্যুররেআলিস্ত/surréaliste) এই বিশেষণটা তৈরি করেছি যার মানে কোনোক্রমেই প্রতীকি নয়…মানুষ যখন হাঁটার ব্যপারটাকে অনুকরণ করতে চাইল তখন সে সৃষ্টি করল চাকা যা দেখতে একটা পায়ের মতো নয় ৷ এভাবে সে না জেনে যা করেছে তাই হল পরাবাস্তবতা।]
গিয়োম আপলিনের
এলাকা (Zone)
অবশেষে সেকেলে এই জগত্টা ক্লান্ত করছে তোমাকে
মেষপালক হে আইফেল টাওয়ার আজ ভোরে সেতুর পাল ব্যা ব্যা করে ডাকে
গ্রিস আর রোমের প্রাচীন সভ্যতায় বেঁচে থাকতে থাকতে তুমি ক্লান্ত
এখানে মোটরগাড়িগুলোর চোহারা অব্দি কেমন যেন সেকেলে হয়ে গেছে
শুধু ধর্মই একমাত্র আনকোরা নতুন থেকে গেছে শুধু একমাত্র ধর্মই
সাদাসিধে থেকে গেছে বিমান–বন্দরের হ্যাঙারের মতোই
খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপে তুমিই কেবল পুরনো হয়ে যাওনি
পোপ দশম পাইয়াস সবচেয়ে আধুনিক ইয়োরোপীয় হলেন আপনিই
আর জানলাগুলো সব তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বলে লজ্জার পিছুটানে তুমি কিছুতেই
আজ সকালে পাপ স্বীকার করতে পারছ না ঢুকে পড়ে কোনো একটা গির্জেয়
তুমি পড়ে যাচ্ছ দরাজ গলায় যারা গান করে সেই প্রসপেকটাস ক্যাটালগ আর পোস্টার
আজ সকালে এই হল কবিতা আর খবরের কাগজে রয়েছে গদ্যের সম্ভার
আছে ২৫ পয়সার বেসাতি গোয়েন্দাগল্পে ঠাসা
বড় বড় মানুষের জীবনী আর হাজার শিরোনাম খাসা
আজ সকালে সুন্দর একটা রাস্তা আমি দেখেছি তার নামটা আমার মনে নেই
যেন একটা তূর্য সূর্যের আলোয় ঝকঝকে আর নতুন একেবারেই
বড়সাহেব মজুর আর সুন্দরী স্টেনোটাইপিস্টরা সবাই
সোমবার সকাল থেকে শনিবার সন্ধে অব্দি দিনে চারবার করে ঐ পথ দিয়ে আসে যায়
সকালে তিন তিনবার ওখানে সাইরেন ওঠে গুমরে
দুপুরে বারোটা নাগাদ গির্জের খেপে যাওয়া একটা ঘন্টা ঘেউ ঘেউ করে
সাইনবোর্ড আর পাঁচিলের গায়ে লেখা যত ফলক আর বিজ্ঞাপন
চেঁচাতে থাকে একপাল টিয়ে পাখির মতন
.ব্যু ওমঁ–তিয়েভিল আর আভন্যু দে তের্ন–এর মাঝামাঝি প্যারিসের
কলকারখানায় ভরা ঐ রাস্তাটাকে আমার বড় ভালো লাগে
ঐ তো কমবয়সি একটি রাস্তা আর তুমি তো কেবল একটা শিশু তখনো
তোমার মা তোমাকে নীল আর সাদা রঙের জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই পরান না কখনো
ধর্মে তোমার খুবই ভক্তি আর তোমার সঙ্গে তোমার সবচেয়ে পুরনো বন্ধু রনে দালিজের
গির্জের জাঁকজমকের মতো আর কিছুই অতটা ভালো লাগে না তোমাদের
নটা বাজে কমিয়ে দেওয়া গ্যাসের আলোটা একেবারে নীল তোমরা চুপি চুপি বেরিয়ে পড়
শোয়ার ঘর ছেড়ে
রাতভর তোমরা প্রার্থনা কর স্কুলের উপাসনা–ঘরে
অপরূপ এক গভীরতা নীলকান্তমণির আভা আর চিরন্তন
খ্রিস্টের দীপ্ত মহিমা ঘুরতে থাকে অনুক্ষণ
এই তো সেই স্থলপদ্ম যাকে ফুটিয়ে তুলি আমরা সবাই
এই তো সেই লালচুল মশাল যা কখনো নিভে যায় না হাওয়ায়
এই তো সেই যান্ত্রণা–কাতর মায়ের সিঁদুরে–রঙ ছেলে
এই তো সেই গাছ প্রার্থনার ভারে যা চিরতরে পড়েছে হেলে
এই তো সেই গৌরব আর অমরতার যুগল ফাঁসিকাঠ
এই তো সেই ছটি জ্যোতির তারা আর
এই তো সেই ঈশ্বর যিনি শুক্রবার মারা গিয়ে পুনর্জীবন পান রবিবার
এই তো সেই খ্রিস্ট যিনি বিমানচালকদের চেয়েও নিপুণভাবে আকাশে ওড়েন
উচ্চতার এক তুলনাহীন বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেন
চোখের খ্রিস্টমণি
শতাব্দীর বিংশতি মণি তার জানা রয়েছে কী করতে হয় কী করে
আর এই শতাব্দী জিশুর মত শূন্যে উঠে যায় পাখির রূপ ধরে
পাতালের শয়তানেরা ওকে দেখবে বলে মাথা তোলে
ও জুডিয়ার সাইমন গুণিনের নকল করছে তারা সবাই বলে
তারা চেঁচাতে থাকে ও যদি উড়তে পারে তবে চোর বলে ডাকা হোক ওকে
দেবদূতেরা সব উড়ে বেড়ায় সুন্দর ঐ উডুক্কু ভবঘুরের চারদিকে
ইকারুস, ইনক, ইলাইজা, আপলোনিয়ুস দ তিয়ান
প্রথম উড়োজাহাজকে ঘিরে সবাই তাঁরা ভেসে বেড়ান
পবিত্র রূপান্তরের উত্সব যাঁদের বয়ে নিয়ে যায় তাঁদের ওঁরা মাঝে পথ ছেড়ে দেন
সেই সব পুরোহিতদের যাঁরা চিরতরে পবিত্র অর্ঘ্য তুলে ধরেন
অবশেষে বিমানপোত ডানা না গুটিয়েই বসে পড়ে স্থির হয়ে
আকাশ তখন লক্ষ লক্ষ বাবুই পাখিতে যায় ছেয়ে
অবিরত ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে আসে যত বাজ পেঁচা কাক
আফ্রিকা থেকে এসে পড়ে সারস ফ্ল্যামিংগো আর মারাবুর ঝাঁক
কথাকার আর কবিরা যার গুণগান করেছেন সেই রক পাখি ভেসে বেড়ায়
আদি মানব আদমের করোটি ধরে থাকে থাবায়
তীব্র আর্তনাদে দিগন্ত থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঈগল
আমেরিকা থেকে হাজির হয় খুদে হামিংবার্ডের দল
লম্বা আর তুলতুলে যত পিহিপাখি চিনদেশ থেকে এসে যায়
একটিমাত্র তাদের ডানা তারা উড়ে বেড়ায় জোড়ায় জোড়ায়
তারপর ঐ তো নিষ্পাপ–হৃদয় কপোতকে পথ দেখিয়ে
লায়ার পাখি আর চাকা চাকা দাগওয়ালা ময়ুর সঙ্গে এল নিয়ে
ঐ তো জ্বলন্ত চিতা ফিনিক্স নিজে নিজেই সে জন্ম নেয়
মুহূর্তের জন্য তার ছাইয়ে সব কিছু ঢেকে দেয়
ভয়ংকর প্রণালী থেকে মত্স্যকন্যারা
গান গাইতে গাইতে উঠে আসে তিন তিনজনে তারা
আর ঈগল ফিনিক্স চিনের পিহিরা সবাই
উড়ন্ত যন্ত্রটার সঙ্গে ভাব করে গলায় গলায়
একা একা তুমি হাঁটছ প্যারিসের ভিড়ে
তোমার পাশ দিয়ে পালে পালে বাস বেরিয়ে যাচ্ছে ডাক ছেড়ে
ভালোবাসার যন্ত্রণা কণ্ঠনালীকে চেপে ধরেছে তোমার
যেনবা কখনোই তুমি যোগ্য ছিলে না ভালোবাসার
সেকালে বেঁচে থাকলে তুমি বরণ করে নিতে কোনো একটা মঠের জীবন
প্রার্থনার স্তব উচ্চারণ করতে করতে ধরা পড়ে গেলে তোমাদের কিযে লজ্জা হয় এখন
নিজেকে নিয়ে তুমি মজা কর আর তোমার হাসি নরকের আগুনের মত চনমন করতে থাকে
তোমার হাসির ফুলকিগুলো সোনালি করে দেয় তোমার জীবনের গভীরতাকে
অন্ধকার যাদুঘরের দেয়ালে একটি ছবি টাঙানো আছে
আর সেটা দেখার জন্যে মাঝে মাঝে তুমি এগিয়ে যাও তার খুব কাছে
আজ তুমি প্যারিসে হেঁটে চলেছ মেয়েমানুষেরা সব রক্তে রক্তময়
তখন ছিল অথচ আমি কিছুতেই মনে করতে চাইছিলাম না যে তখন ছিল সৌন্দর্যের
বিদায়ের সময়
শার্ত্র–এর মেরীমাতা আমার দিকে তাকালেন আগুনের দীপ্ত শিখার ভেতর থেকে
মোঁমার্ত্র–এর পবিত্র–হৃদয়ের রক্ত ভাসিয়ে দিল আমাকে
পরম সুখের বাণী শুনে শুনে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে আমার
যে ভালোবাসায় আমি ভুগছি সেটা একটা অসুখ নিতান্তই লজ্জার
আর যে ছবিটা তোমার ওপর ভর করেছে তোমাকে তা অনিদ্রা আর উদ্বেগের মধ্যে
রাখে জিইয়ে
আর সব সময় সে ছবিটা চলে যায় তোমার পাশ দিয়ে
এইতো এখন তুমি ভূমধ্যসাগরের কূলে
সেই নেবুগাছের তলায় যে নেবুগাছগুলো সারা বছর ছেয়ে থাকে ফুলে ফুলে
বন্ধুদের সঙ্গে নৌকোয় করে তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছ
একজন হল নিসার, একজনের বাড়ি মঁতোতে আর বাকি দুজন তুরবিয়াস্ক
ভয়ে ভয়ে আমরা অনেক তলার অক্টোপাসগুলোর দিকে তাকাই
আর জলের শ্যাওলার ফাঁকে ফাঁকে ত্রাণকর্তার প্রতিমূর্তি মাছগুলি ঘুরে বেড়ায়
তুমি প্রাগের শহরতলিতে একটা বাগানের ভেতর
নিজেকে তোমার বেজায় সুখী বলে বোধ হচ্ছে একটা গোলাপ তোমার টেবিলের ওপর
গদ্যে তোমার গল্পটা না লিখে
তুমি তাকিয়ে রয়েছে গোলাপের বুকে ঘুমন্ত পোকাটির দিকে
সন্ত ভিৎ গির্জের কষ্টিপাথরে নিজের ছবি আঁকা দেখে ভয়ে তুমি আঁতকে উঠলে
ওখানে নিজেকে দেখতে পেয়ে সত্যি তুমি ভেঙে পড়লে
অনেকটা দিনের আলোয় ভ্যাবাচাকা খাওয়া ল্যাজারাসের মত দেখাচ্ছিল তোমাকে
ইহুদিপাড়ার ঘড়ির কাঁটাগুলো উল্টোদিকে ছুটতে থাকে
হ্রাদচিন প্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সন্ধেবেলায়
তোমার কানে আসে চেকভাষায় গান হচ্ছে সরাইখানায়
সে গান শুনতে শুনতে নিজের জীবনের পথে তুমি পিছিয়ে যেতে থাক ধীরে ধীরে
এইতো তুমি মার্সেই–এ চারপাশে গাদা করা যত তরমুজ তোমাকে ঘিরে
এইতো তুমি কোব্লঁস–এ দানব–নিবাসে
এইতো তুমি রোমে জাপানি চেরিগাছের ছায়ায় বসে
এইতো কমবয়সি একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তুমি আমস্টারডামে তাকে তোমার সুন্দরী
বলে মনে হলেও আসলে সে কদাকার
লেইডের এক ছাত্রের সঙ্গে বিয়ে হবে তার
সেখানে ভাড়া পাওয়া যায় ল্যাটিন সাইনবোর্ড ওয়ালা যত ভাড়ার ঘর
মনা পড়ছে আমি কাটিয়েছিলাম তিন দিন করে সেখানে আর গুডা শহরে পরপর
প্যারিসে তুমি দায়রা জজের আদালতে
আসামির মতন তোমায় ওরা পুরে রেখেছিল হাজতে
বেদনা আর আনন্দের মধ্যে তুমি ঘুরে বেড়িয়েছ দেশ–দেশান্তরে
মিথ্যে আর বয়সের ভারের উপলব্ধি হয়েছে তোমার আরো পরে
বিশ আর তিরিশ বছর বয়সে তুমি ভোগ করেছ ভালোবাসার দুর্বহ কষ্ট
আমি পাগলের মত জীবন কাটিয়েছি আর বৃথাই সময় করেছি নষ্ট
নিজের হাতের দিকে তাকাতেও তোমার আর ভরসা হয় না আর প্রতি মুহুর্তে যেন
ইচ্ছে করে
তোমার জন্য যে মেয়েটিকে আমি ভালোবাসি ওর জন্য যা কিছু তোমায় আতঙ্কিত করে
তার জন্য কেঁদে উঠি গুমরে গুমরে
জলভরা চোখে তুমি তাকাও ঐ ছন্নছাড়়া দেশত্যাগীদের দিকে
ঈশ্বরে ওদের আস্থা রয়েছে ওরা প্রার্থনা করে মেয়েছেলেরা বাচ্চাদের দুধ দিতে থাকে
নিজেদের গায়ের গন্ধে ওরা ভরে রেখেছে স্যাঁ–লাজার স্টেশনের হলঘর
বাইবেলের জ্ঞানী রাজাদের মতোই ওদের বিশ্বাস রয়েছে নিজের নিজের নক্ষত্রের ওপর
ওদের আশা আর্জেন্টিনায় গিয়ে ওরা পয়সা রোজগার করবে
তারপর বড়লোক হয়ে নিজের দেশে ফিরে আসবে
একটি পরিবার লাল একটা লেপ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে যেমন তোমরা বয়ে বেড়াও
তোমাদের হৃদয়
ঐ লেপ আর আমাদের স্বপ্ন একইরকম অবাস্তব
ঐ দেশছাড়াদের কেউ কেউ এখানেই থেকে যায়
আর বাসা বাঁধে .ব্যু দে রোজিয়ে আর .ব্যু দেজেকুফ–এর খুপরিগুলোয়
প্রায় সন্ধেবেলা ওদের আমি দেখি ওরা হাওয়া খেতে বেরোয় রাস্তায়
আর ঠিক যেন সব দাবার ঘুঁটি কখনো সখনো জায়গা পাল্টায়
বিশেষ করে ঐ ইহুদিরা ওদের বাড়ির মেয়েরা পরচুলা–পরা মাথায়
ওরা ফ্যাকাশে মতন বসে থাকে দোকানের এক কোণায়
হতচ্ছাড়া একটা শুঁড়িখানায় কাউন্টারের সামনে
তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছে সন্তার কফি গিলছ অভাগাদের মাঝখানে
রাত্রিবেলা তুমি বিরাট একটা রেস্তোরাঁয়
ঐ মেয়েগুলো সবাই বদ নয় তবু অনেক দুশ্চিন্তা ওদের মাথায়
ওরা প্রত্যেকে এমনকী ওদের মধ্যে সবচেয়ে যে কুচ্ছিৎ দেখতে সেও তার প্রেমিককে
ভুগিয়েছে অনেক যন্ত্রণায়
জার্সি দ্বীপের এক দারোগা ওর বাবা
ওর যে হাতগুলো আমি দেখিনি সেগুলো শক্ত আর ফুটিফাটা
ওর পেটের কাটা কাটা দাগগুলোর জন্য ওর ওপর আমার খুবই করুণা হয়
বীভত্স হি হি হাসির হতভাগা একটা মেয়ের দিকে আমি এখন আমার মুখ নামাই
তুমি একা ভোর হয়ে এল বলে
রাস্তায় রাস্তায় দুধওয়ালারা তাদের দুধের পাত্রের টুংটাং আওয়াজ তোলে
দো–আঁশলা রূপসী মেয়েটির মতোই রাত্রি দূরে মিলিয়ে যায়
সে যেন ঠিক জালি ফের্দিন কি যত্ন–আত্তি করা লেয়া
আর তুমি খেয়ে চলেছ ঐ মদ যা জ্বালা–ধরানো তোমার জীবনের মতন
তোমার জীবন যা তুমি খেয়ে চলেছ মদের মতন
ওত্যই–এর দিকে তুমি হেঁটে যাচ্ছ পায়ে হেঁটে তুমি বাড়ি পৌঁছবে
ওসেয়ানা আর গিনির দেবদেবীদের মাঝখানে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে
ওরা সব অন্য এক চেহারার অন্য এক বিশ্বাসের খ্রিস্ট
ওরা হল অন্ধকার আশার নিকৃষ্ট খ্রিষ্ট
বিদায় বিদায়
কাটামুণ্ড সূর্য
মিরাবো সেতু
(Le Pont Mirabeau)
মিরাবো সেতুর তলা দিয়ে সেন বয়ে চলে অনিবার
আর আমাদের যত প্রেম
স্মৃতি হবে কি জাগাতে তার
সুখ দেখা দিত দুঃখের জ্বালা জুড়োলে বারংবার
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন
হাতে হাত রেখে এসো মুখোমুখি থাকি শুধু দুজনায়
আর আমাদের বাহুর
সেতুর তলা দিয়ে বয়ে যায়
নিরবধি যত দৃষ্টির ঢেউ অবসিত জড়িমায়
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন
প্রেম চলে যায় যেন জলধারা ছুটে যায় তরতর
প্রেম চলে যায় এ জীবন
যেন কিরকম মন্থর
দুরাশার মায়া যেন কিরকম তীব্র ভয়ংকর
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন
পার হয়ে যায় দিনগুলি আর সপ্তাহ হয় পার
গতকাল আর গত যত
প্রেম ফিরে আসেনা তো আর
মিরাবো সেতুর তলা গিয়ে সেন বয়ে চলে অনিবার
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন
অঁরি রুসো–র (Henri Rousseau) আঁকা ছবি ‘মিউজ কবিকে অনুপ্রাণিত করছেন’’
(La Muse inspirant le poète)
বন্ধন (Liens)
চিত্কারে বোনা দড়িগুলো
ইয়োরোপ জুড়ে গির্জের ঘন্টার ধ্বনি
ফাঁসিতে লটকানো যত শতাব্দী
যত রেলের লাইন ওগুলিই তো সমস্ত জাতির হাতে–পায়ে বেড়ি
পরিয়ে দিয়েছে
আমরাই শুধু দু–তিন জন মানুষ
সবরকমের বাঁধন থেকে মুক্ত
এসো আমরা হাতে হাত মেলাই
ঝমঝম বৃষ্টি ধোঁয়াকে চিরুনি দেয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে
দড়ি
পাকানো যত দড়ি
জলের তলার ডুবো তার
সেতু হয়ে যাওয়া ব্যাবেলের মিনার
মাকড়সা–মোহান্ত
একসূত্রে বাঁধা তাবৎ প্রেমিক–প্রেমিকা
সূক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর আরো সব বাঁধন
আলোর সাদা রশ্মি
সূত্র আর যোগসূত্র
আমার লেখালেখি তো শুধু তোমাদেরই জয়গান করার জন্য
আমার ইন্দ্রিয়গুলি প্রিয় ইন্দ্রিয়গুলি
স্মৃতির শত্রু
কামনার শত্রু
অনুতাপের শত্রু
চোখের জলের শত্রু
যা কিছু আমি এখনো ভালোবাসি তার শত্রু
জানলা (Les fenêtres)
লাল থেকে সবুজের মধ্যে সবটা হলুদ মরে যায়
যখন বনের জন্মভুমিতে গান গাইতে থাকে কাকাতুয়ারা
পিহি পাখিদের নাড়িভুড়ি
একটিমাত্র ডানাওয়ালা ঐ পাখিটিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে হবে
আমরা তা টেলিফোন–বার্তায় পাঠিয়া দেব
বিশাল আকারের আতঙ্ক
চোখ থেকে যা জল বের করে দেয়
কমবয়েসি তুরিনিজদের মধ্যে ঐতো সুন্দরী একটি মেয়ে
বেচারা ছেলেটা নিজের সাদা টাই দিয়ে নাক মুছছে
পর্দাটা তুলে দেবে
আর ঐতো এবার জানলাটা খুলে যাচ্ছে
মাকড়সারা যখন হাতগুলি সব আলো বুনছিল
সৌন্দর্য পাণ্ডুরতা অপরিমেয় বেগুনি
অনর্থক আমরা বিশ্রাম করার চেষ্টা করব
মাঝরাতে শুরু করা হবে
যখন সময় থাকে স্বাধীনতা থাকে
ঝিনুক অ্যাঙলার মাছ অনেক অনেক সূর্য আর অস্তবেলার সমুদ্র–সজারু
জানলার সামনে একজোড়া হলুদ জুতো
মিনার
মিনার হল রাস্তা
কুয়ো
কুয়ো হল চক
কুয়ো
ফাঁপা গাছগুলো উড়নচণ্ডী কাপ্রেসদের আশ্রয় দেয়
শাব্যাঁরা প্রাণান্তকর কিছু সুর শোনায়
উধাও হওয়া শাবিনদের
আর রাজহাঁস ক্রেংকার উত্তরে তুর্যধ্বনি
সেখানে ভোঁদড়–শিকারীরা
চামড়ায় ব়্যাঁদা ধার দেয়
ঝলমল হীরে
ভ্যাংকুভার
যেখানে রাতের আগুন আর তুষারে হয়ে যাওয়া রেলগাড়ি শীতের নাগাল ছেড়ে
পালিয়ে যায়
আহারে প্যারিস
লাল থেকে সবুজের মধ্যে সবটা হলুদ মরে যায়
প্যারিস ভ্যাংকুভার ইয়ের ম্যাঁৎনোঁ নিউ ইয়র্ক আর পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ
জানলাটা খুলে যায় যেন একটা কমলালেবুর মতো
আলোর সুন্দর ফল
স্যাঁ–মেরির বাঁশিবাজিয়ে (Le Musicien de Saint-Merry)
যেসব জীবকে আমি চিনি না অবশেষে তাদের সম্ভাষণ করার অধিকার আমি পেয়েছি
আমার সামনে দিয়ে চলে গিয়ে দূরে ওরা জমায়েৎ হয়
তখন ওদের যা কিছু আমার চোখে পড়ে সবই আমার অজানা
আর ওদের আশা আমার নিজের আশার চেয়ে কম জোরদার নয়
এই জগৎ কি অন্য সব জ্যোতিষ্ক নিয়ে আমি গান গাই না
আমি গান গাই এই জগৎ আর জ্যোতিষ্কগুলির সীমানার বাইরে আমার নিজের তাবৎ
সম্ভাবনা নিয়ে
আমি গান গাই ঘুরে বেড়ানো আর এভাবে ঘুরতে ঘুরতে মরে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে
১৯১৩ সালের মে মাসের ২১ তারিখ
মৃতদের সীমান্ত পারাপারের কাণ্ডারী আর মৃত্যুদাতা দুপুরের ঘুম
লক্ষ লক্ষ মাছি আশ্চর্য একটা ঘটনাকে ভনভন করে হাওয়া করে যাচ্ছিল
যখন যার চোখ নেই কান নেই নাক নেই এরকম একটা লোক
সেবাস্তো থেকে বেরিয়ে এসে ওব্রি–ল–বুশে রাস্তায় ঢুকল
কমবয়সি ঐ লোকটির গায়ের রঙ ছিল বাদামি আর তার গালে স্ট্রবেরির সেই রঙ
লোকটি আহারে! আরিয়ান
ও বাঁশি বাজাচ্ছিল আর সুরের মুর্ছনা ওর পাদুটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল
স্যাঁ–মার্ত্যাঁ রাস্তার মোড়ে এসে ও দাঁড়িয়ে পড়ল
যে সুরে আমি গান গাই আর যে সুর আমি আবিস্কার করেছি সেই সুর ও বাজাতে লাগল
পথচলতি মেয়েরা ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছিল
চারদিক থেকে তারা আসছিল
যখন আচমকা স্যাঁ–মেরি গির্জের ঘন্টাগুলো বাজতে শুরু করল
তখন বাঁশিবাজিয়ে বাজনা থামিয়ে ফোয়ারায় জল খেল
ফোয়ারাটা হল সিমোঁ–ল–ফোর রাস্তার মোড়ে
তারপর স্যাঁ–মেরি নীরব হল
অজানা লোকটি আবার ওর বাঁশি বাজাতে শুরু করল
আর যে পথে গিয়েছিল সে পথ ধরেই .ব্যু দ লা ভেররি অব্দি হেঁটে এল
পেছন পেছন আসা ঐ মেয়ের দঙ্গল নিয়ে ও ঐ রাস্তায় ঢুকল
ঐ মেয়েগুলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল
ঐ মেয়েগুলি উল্টোদিকের তাবৎ রাস্তা ধরে আসছিল উন্মাদ তাদের দৃষ্টি
সুরেলা ঐ মনের মানুষটির দিকে দুহাত বাড়ানো
বাঁশিতে ওর নিজস্ব সুর তুলে ও নির্বিকার চলে যাচ্ছিল
ও চলে যাচ্ছিল ভয়ংকরভাবে
তাছাড়া
প্যারিসে যাওয়ার ট্রেন কটায় ছাড়বে
ঐ মুহুর্তে
মালুক দ্বীপের পায়রাদের বিষ্ঠায় জায়ফল বেরুচ্ছে
একই সঙ্গে
বোমা–র ক্যাথলিক মিশন ঐ ভাস্করটিকে নিয়ে তুমি কী করেছ
অন্য কোথাও
মেয়েটি বন আর ব্যোয়েল–এর মাঝখানের সেতু পেরিয়ে প্যুত্জেশন–এর মধ্যে
হারিয়ে যায়
একই মুহূর্তে
মেয়রের প্রেমে পড়া এক যুবতী
অন্য এক পাড়ায়
কবি তখন আতরওয়ালার লেবেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে
মোট কথা তোমরা রঙ্গরসিকের দল তোমরা মানুষের কাছ থেকে খুব একটা কিছু
আদায় করে উঠতে পার নি
আর ওদের দুঃখ–দুর্দশা থেকে বলতে গেলে তোমরা শুধু একটুখানি চর্বি বের করে
নিতে পেরেছ
অথচ আমরা যারা একে অন্যের কাছ থেকে অনেক দূরে বাঁচতে গিয়ে মরে যাই
আমরা হাত বাড়িয়ে দিই আর এই রেললাইনগুলোর ওপর দিয়ে লম্বা একটা মালগাড়ি
গড়িয়ে যায়
একটা ঘোড়ার গাড়ির ভেতর আমার পাশে বসে তুমি কাঁদছিলে
আর এখন
তোমাকে আমার মতন দেখাচ্ছে দুঃখের কথা তোমাকে আমার মতন দেখাচ্ছে
আমরা একে অন্যের মতো দেখতে যেরকম গত শতকের শ্থাপত্যে
ঐ উঁচু উঁচু চিমনিগুলো দেখতে অবিকল মিনারের মতো
আমরা এখন আরো উঁচুতে উঠে যাচ্ছি আর মাটি ছুঁচ্ছি না
আর যখন জগৎ–সংসার বেঁচে–বর্তে থাকত আর পাল্টে যেত
একটাও রুটি জোগাড় করতে না পারা দিনের মতোই দীর্ঘ মেয়েদের শোভাযাত্রাটা
.ব্যু দ লা ভেররি ধরে খোসমেজাজ বাঁশিবাজিয়েটার পেছন পেছন যাচ্ছিল
শোভাযাত্রা আহারে শোভাযাত্রা
সেকালে যখন রাজা ভ্যাঁসেন–এ যাত্রা করতেন
যখন রাষ্ট্রদূতরা এসে পৌঁছতেন প্যারিসে
যখন রোগাপটকা স্যুজের ছুটে যেতেন সেন–এর দিকে
যখন স্যাঁ–মেরি–র আশেপাশে দাঙ্গাহাঙ্গামা থিতিয়ে আসত
শোভাযাত্রা আহারে শোভাযাত্রা
মেয়েদের সংখ্যাটা এমনই বিরাট ছিল যে আশেপাশের সবগুলি রাস্তায়
তারা উপছে পড়ছিল
আর টানটান কামানের গোলার মতন ছুটে যাচ্ছিল
বাঁশিবাজিয়ের পেছন পেছন যাওয়ার জন্য
আহা ! আরিয়ান আর তুমি পাকেৎ আর তুমি আমিন
আর তুমি মিয়া আর তুমি সিমন আর তুমি মাভিজ
আর তুমি কোলেৎ আর তুমি রূপসী জনভিয়েভ
অবয়বহীন তারা চলে গেল কাঁপতে কাঁপতে
আর তাদের উদগ্র কানকে পথ দেখাচ্ছিল সেই রাখালিয়া সুর
যে সুরের তালে তালে
তাদের হালকা আর চঞ্চল পা গতিময় হয়ে উঠছিল
অচেনা লোকটি একটা বাড়ির সামনে এসে মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল
বিক্রির জন্য রাখা ছাড়া বাড়ি
তার কাচের জানলাগুলো ভাঙা
ষোড়শ শতকের একটা বসতবাটি
উঠোনটা মালবওয়া গাড়ি রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়
সেই বাড়িটাতেই বাঁশিবাজিয়েটা ঢুকে পড়ল
দূরে মিলিয়ে যাওয়া তাঁর বাঁশির সুর স্তিমিত হয়ে উঠল
মেয়েরা তার পেছন পেছন ছাড়া বাড়িটার মধ্যে ঢুকে গেল
আর তারা সবাই একসঙ্গে দঙ্গল বেঁধে সেখানে ঢুকে পড়ল
পেছনে এতটুকু না তাকিয়ে সবাই সেখানে ঢুকে পড়ল সবাই
যা তারা ছেড়ে এসেছে যা তারা ফেলে এসেছে
তার জন্য এতটুকু আফশোস না করে
দিনের আলো জীবন আর স্মৃতির জন্য একটুকু আফশোস না করে
অবিলম্বে এক আমি আর স্যাঁ–মেরি–র একজন পাদ্রি ছাড়া
.ব্যু দ লা ভেররিতে আর কেউই রইল না
পুরনো বাড়িটার ভেতর আমরা ঢুকে পড়লাম
কিন্তু কাউকে আমরা সেখানে দেখতে পেলাম না
এখন সন্ধে নেমে এসেছে
স্যাঁ–মেরিতে বেজে ওঠে সন্ধের প্রার্থনার সুর
শোভাযাত্রা আহারে শোভাযাত্রা
এই সময়েই আগেকার দিনে রাজা ভ্যাঁসেন থেকে ফিরে আসতেন
একদল টুপিওয়ালা এল
এল কলাওয়ালারা
এল প্রজাতন্ত্র–বাহিনীর সিপাইরা
আহারে রাত্রি
মেয়েদের অবসন্ন চাউনির পাল
আহারে রাত্রি
তুমি আমার বেদনা আর আমার নিস্ফল প্রতীক্ষা
আর আমি শুনতে পাচ্ছি অনেক দূর থেকে আসা একটা বাঁশির সুর মিলিয়ে যাচ্ছে
মেঘের এক ছায়ামূর্তি (Un fantôme de nuées)
যেহেতু দিনটা ছিল ১৪ই জুলাইয়ের আগের দিন
তাই বিকেল চারটে নাগাদ
মাদারিদের দেখার জন্যে আমি বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়
ঐ যে লোকগুলো খোলা জায়গায় খেলা দেখিয়ে বেড়ায়
আজকাল প্যারিসে ওদের বড় একটা চোখে পড়ে না
আমার ছেলেবেলায় আজকের তুলনায় অনেক বেশি ওদের দেখা যেত
ওরা প্রায় সবাই চলে গেছে গ্রামগঞ্জের দিকে
বুলভার স্যাঁ–জের্ম্যাঁ ধরে আমি হাঁটতে লাগলাম
আর স্যাঁ–জের্ম্যাঁ দে প্রে আর দঁতোঁ–র মূর্তির মাঝামাঝি ছোট্ট একটা চকে
মাদারিদের দেখা পেলাম
কী হয় দেখার অপেক্ষায় এক দঙ্গল লোক ওদের ঘিরে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল
সব কিছু দেখব বলে আমিও ঐ বৃত্তের মধ্যে জায়গা করে নিলাম
ভার তোলার দারুণ খেলা
লোঁউই–র একটা রুশ মজুরের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ওপরে উঠে পড়েছে
বেলজিয়ামের শহরগুলো
কালো কালো ফাঁপা বারবেলের মাঝখানের ডাণ্ডাটা জমাট এক একটা নদী
আঙুলগুলো পাকিয়ে চলেছে জীবনের মতো তেতো আর উপাদেয় একটা সিগারেট
অসংখ্য নোংরা সতরঞ্চি মাটির ওপর পাতা সতরঞ্চিগুলো ভাঁজ–পড়া সে ভাঁজ
আর কখনো খোলা হবে না
সতরঞ্চিগুলো প্রায় পুরোপুরি ধুলোর রঙের
আর কয়েকটা হলুদ নয়তো সবুজ দাগ তাতে সেঁটে আছে
কোনো একটা সুর যেমন তোমাদের পেছনে লেগে থাকে
রোগা ঐ জংলি লোকটাকে দেখতে পাচ্ছো তো
ওর কাঁচাপাকা দাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ওর পূর্বপুরুষের ছাই
ও যেন এভাবেই বংশের সমস্ত ধারাটা ওর চেহারার মধ্যে ধরে রেখেছে
যন্ত্রের মতো একটা ব্যারেল–অর্গানের হাতল ঘোরাতে ঘোরাতে
ও যেন আগামী দিনের স্বপ্ন দেখছে
আর ঐ অর্গানের একটানা আওয়াজ গুমরে গুমরে অদ্ভুত কেঁদে চলেছিল
গুব্ গুব্ ক্যাঁ ক্যাঁ আর চাপা একটা গোঙানি
মাদারিরা নড়াচড়া করছিল না
সবচেয়ে বুড়ো মাদারিটার গায়ে বেগনে গোলাপি রঙের একটা গেঞ্জি যে রঙটা দেখা
যায় তরতাজা অথচ মৃত্যুমুখী কিছু অল্পবয়সি মেয়ের গালে
ঐ গোলাপি রঙটা বিশেষ করে বাসা বাঁধে তাদের মুখের চারপাশে হামেশা দেখা–দেওয়া
ভাঁজগুলোর মধ্যে
কিংবা নাকের ফুটোর আশেপাশে
ঐ গোলাপি রঙটাকে এতটুকু ভরসা করা যায় না
তাই বলা যায় লোকটির গায়ে ছিল
তার কদাকার ফুসফুসের ছাপ
হাতদুটো সব জায়গায় পাহারা দিচ্ছিল হাতদুটো
দ্বিতীয় মাদারিটা
তার পরনে কেবল তার ছায়া
তার দিকে অনেকক্ষণ আমি তাকিয়ে ছিলাম
তার মুখটা আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না
ঐ লোকটির কোনো চেহারাই ছিল না
শেষের আরেক জনকে দেখতে অনেকটা মাস্তানের মতো
একই সঙ্গে ভোলাভালা আর বদমাস একটা ডাকাতের মতো
ঢোলা পাৎলুন আর মোজা বাঁধার ফিতে সুদ্ধু
ওর হাবভাব দেখে মনে হতে পারে যেন একটা বেশ্যার দালাল সাজগোজ করছে
বাজনা থেমে গেল আর শুরু হল দর্শকদের সঙ্গে দর–কষাকষি
এক এক পয়সা করে তারা মোট দুটাকা পঞ্চাশ পয়সা সতরঞ্চির ওপর ছুঁড়ে দিল
বুড়োর ঠিক করা খেলার মজুরি তিনটি টাকাও পুরো হল না
কিন্তু যখন পরিষ্কার বোঝা গেল কেউ আর কিছুই দেবে না
তখন ঠিক হল এবার খেল শুরু হবে
অর্গানের তলা থেকে ফুসফুসের রঙের গোলাপি জামা–পরা খুদে একটি মাদারি
বেরিয়ে এল
ওর হাতের কব্জি আর পায়ের গাঁটে পশম জড়ানো
থেকে থেকে ও চিত্কার করে উঠছিল
আর হাত দুটো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিয়ে
খোলা মুঠোয় সবাইকে অভিবাদন করছিল
একটা পা পেছনে নিয়ে অনেকটা নতজানু হওয়ার ভঙ্গিতে
প্রধান চারটি দিককে ও প্রণাম জানাল
আর যখন ও একটা বলের ওপর উঠে হাঁটতে শুরু করল
তখন তার ক্ষীণ শরীরটা এমন এক কমনীয় সঙ্গীত হয়ে উঠল যে দর্শকদের
কেউই তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারল না
প্রত্যেকেরই মনে হল
এইটুকু একটা অশরীরী আত্মা যার মধ্যে কিছুমাত্র মানবিক ব্যাপার নেই
আর নানান ভঙ্গির ঐ সুরমূর্ছনা
পূর্বপুরুষে মুখ ঢাকা লোকটির যান্ত্রিক অর্গানের জাঁতাকলে পেষাই করা
সঙ্গীতকে ভেঙে চুরমার করে দিল
খুদে মাদারিটা এমন তালে তালে ডিগবাজি খেতে লাগল যে
অর্গানের বাজনা স্তব্ধ হয়ে গেল
আর অর্গান–বাজিয়ে দুহাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে ফেলল
তার হাতের আঙুলগুলো দেখতে তারই ভাগ্যের বংশধরদের মতন
তার দাড়ি থেকে বেরিয়ে–আসা একরত্তি সব ভ্রূণ
রেড়–ইণ্ডিয়ানদের নতুন নতুন সব চিত্কার
গাছের কিন্নর–কষ্ঠ গান
বাচ্চা ছেলেটির অদৃশ্য হওয়া
মাদারিরা হাতের নাগাল অব্দি বিরাট বিরাট সব বারবেল তুলতে লাগল
নানান ওজনের জিনিষ নিয়ে
ওরা লোফালুফির খেলা দেখাচ্ছিল
কিন্তু প্রতিটি দর্শক তখন নিজের ভেতর খুঁজে বেড়াচ্ছিল অলৌকিক
ঐ শিশুটিকে
শতাব্দী হে মেঘের শতাব্দী
হৃদয় রাজমুকুট আর আয়না (Cœur couronne et miroir)
পিকাসো–র আঁকা .যুদ্ধে আহত গিয়োম আপলিনের
বিজয় (Victoire)
একটা মোরগ ডেকে ওঠে আমি স্বপ্ন দেখছি আর পাতায় ভরা ডাল
দেখতে হতচ্ছাড়া জাহাজিদের মতন পাতাগুলো দোলাতে থাকে
জাল ইকারুস–এর মতো ডানাওয়ালা আর ঘুরে পাক খেতে থাকা
অন্ধেরা পিঁপড়ের মতো হাত–পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে
বৃষ্টির ভেতর ফুটপাতের আলোর প্রতিফলনে নিজেদের দিকে তাকিয়ে ছিল
তাদের হাসি আঙুরের থোকার মতো টাল করা
মণি আমার তুমি তো কথা বলে যাচ্ছিলে আমার ঘর ছেড়ে তুমি আর বেরিয়ো না
শান্ত হয়ে ঘুমোও তোমার নিজের ঘরেই তুমি রয়েছো সবকিছুই তোমার
আমার বিছানা আমার বাতি আর আমার ফুটো হয়ে যাওয়া লোহার টুপি
চোখের চাউনি স্যাঁ–ক্লোদ–এর আশেপাশে কাটা দামি নীলা আর দিনগুলি ছিল
নিখুঁত এক একটা পান্না
তোমাকে আমার মনে পড়ছে উল্কার শহর
কিছুই যখন ঘুমোয় না সেই সব রাতে শূন্যে ওরা ফুটে উঠত
আলোর সব বাগান যেখান থেকে আমি তুলে এনেছি ফুলের তোড়া
ঐ আকাশটাকে ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে তোমার তো বিরক্ত হয়ে পড়ার কথা
নিজের হেঁচকি সে সামলে রাখুক
সাফল্য মানুষকে কতটা নির্বোধ আর নির্জীব করে দেয়
তা কল্পনা করা কঠিন
তরুণ অন্ধদের শিক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন করা হল
আপনাদের হাতে কি কোনো ডানাওয়ালা তরুণ অন্ধ নেই
মুখের দল মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে নতুন একটা বাগভঙ্গি
যার সম্পর্কে কোনো ভাষার ব্যাকরণবিদের কিছুই বলার থাকবে না
আর এই পুরনো ভাষাগুলো এমনই মরোমরো যে
সত্যি বলতে কি শুধু অভ্যাসবশে আর সাহসের অভাবে
আজও ওদের কবিতায় ব্যবহার করা হচ্ছে
অথচ ওরা অরুচিধরা রোগীর মতন
আমার ধারণা লোকে অবিলম্বে চুপ করে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে
চলচ্চিত্রে মূকাভিনয়ই তো যথেষ্ট
তবু এসো কথা বলার জন্যে গোঁ ধরে থাকি
এসো জিব নাড়াই
এসো থুতু ছেটাই
আমাদের চাই নতুন ধ্বনি নতুন ধ্বনি নতুন ধ্বনি
আমাদের চাই স্বরধ্বনিহীন ব্যঞ্জন
যে ব্যঞ্জন অঘোষ ফটফট আওযাজ করে
লাট্টুর ধ্বনির নকল কর
অনুনাসিক একটা ধ্বনিকে একনাগাড়ে টিকটিক করে যেতে দাও
জিব দিয়ে চক চক শব্দ করে যাও
যে লোকটা অসভ্যের মতো খায় তার চাপা গপগপ আওয়াজকে ব্যবহার কর
থুথু ফেলার মহাপ্রাণ ঘর্ষণও সুন্দর একটা ব্যঞ্জনধ্বনি তৈরি করতে পারে
নানান ধরনের ওষ্ঠ্য বায়ুনিঃসরণও তোমার বাচনকে ধ্বনিময় করে তুলতে পারে
খুশিমত ঢেকুর তোলার অভ্যেস কর
আর আমাদের স্মৃতির ভেতর
কোন অক্ষরটাই বা গির্জের ঘণ্টাধ্বনির মতো গম্ভীর
নতুন নতুন সুন্দর জিনিস দেখার আনন্দ
আমাদের খুব একটা ভালো লাগে না
বান্ধবী আমার তাড়া করো
ভুলে যোয়ো না একদিন একটা রেলগাড়ি তোমাকে আর নাও মুগ্ধ
করতে পারে
যতটা পারো চটপট করে তার দিকে তাকাও
চলন্ত রেললাইনগুলো অবিলম্বে জীবনের বাইরে চলে যাবে
হয়ে যাবে সুন্দর আর হাস্যকর
দুটো বাতি আমার সামনে জ্বলছে
দুটি নারী যেন হি হি করে হাসছে
দীপ্ত তামাসার সামনে
আমি বিষন্নভাবে মাথা নোয়াই
ঐ হাসি ছড়িয়ে পড়ছে
সর্বত্র
হাত দিয়ে কথা বল আঙুল দিয়ে তুড়ি দাও
ঢোল বাজানোর ভঙ্গিতে গালের ওপর চাঁটি মারো
আহারে কথাগুলো
ওরা মার্টেলের বনে
অশ্রুসজল কাম ও নিষ্কামের পিছু নেয়
আমি মহানগরীর আকাশ
সমুদ্রের দিকে কান পাতো
সমুদ্র অনেক দূরে গোঙাচ্ছে আর একা একা চিত্কার করে উঠছে
ছায়ার মতো বিশ্বস্ত আমার কণ্ঠস্বর
শেষ অব্দি আমার জীবনের ছায়া হতে চায়
হতে চায় হে প্রাণচঞ্চল সমুদ্র তোমারই মতন অবিশ্বস্ত
যে সমুদ্র অগুনতি মাঝি–মাল্লার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বারে বারে
আমার প্রচণ্ড আর্তনাদকে সে ডুবে যাওয়া দেবতাদের মতো গিলে ফেলে
আর রৌদ্রোজ্জ্বল সমুদ্র একমাত্র সইতে পারে
সেই সব পাখিদের ছায়া যারা উড়ে যায় ডানা মেলে
বচন আকস্মিক আর ঐতো কাঁপতে থাকা এক ঈশ্বর
এগিয়ে এসো আর আমায় ধরে থাক তাদের ঐ হাতগুলি নেই বলে আমি কষ্ট পাই
যারা আমায় একসঙ্গে হাত বাড়িয়ে করত আদর
আগামীকাল বাহুর কোন মরুদ্যান অভ্যর্থনা জানাবে আমায়
নতুন নতুন জিনিস দেখার আনন্দের সঙ্গে তোমার কি পরিচয় হয়েছে
হে কণ্ঠস্বর আমি সমুদ্রের ভাষায় কথা বলছি
আর বন্দরে শেষ সরাইখানাগুলোর রাত
লের্ন–এর হায়ড্রা যতটা একরোখা হতে পারে তার চেয়েও আমি বেশি একরোখা
শহরময় তল্লাশি করা নিপুণ আঙুল নিয়ে
আমার হাতদুটো সাঁতার কাটে যেখানে
সেই রাস্তাটা বিদায় নেয় আজকের দিনটা পেরোলে
রাস্তাটা অনড় হয়ে যাবে কিনা কে জানে
কে জানে আমার গতি হবে কোন দিকে
মনে রেখো রেলরাস্তা
কিছুদিনের মধ্যেই সেকেলে আর বাতিল হয়ে পড়বে
তাকিয়ে থাকো
সবার আগে জয় হবে
অনেক দূরে ভালো করে দেখার
কাছ থেকে
সব কিছু দেখার
আর সব কিছুরই হোক নতুন এক একটা নাম
টীকা
এলাকা (Zone)
আপলিনের–এর ‘সুরাসার’ (Alcools) কাব্যগ্রন্থের প্রথম রচনা ‘এলাকা’ (Zone) কালানুক্রমিক দিক থেকে এ কাব্যের সবচেয়ে শেষে লেখা কবিতা। আসলে ‘সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি কালানুক্রমিকভাবে সাজানো নয়। হয়ত একঘেঁয়েমির ভয়ে, বিষয় ও প্রকাশের বৈচিত্র্যের কথা মনে রেখে কবি কালানুক্রমিকতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন। কিংবা এও হতে পারে যে বিচিত্র সুরের স্তরবিন্যস্ত পর্যায় ও বিভিন্নতা একটা সাংগীতিক ঐকতান সৃষ্টি করবে — এটাই ছিল কবির উদ্দেশ্য।
বর্তমান কবিতাটির রচনাকাল সম্ভবত ১৯১২–র মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর –অক্টোবর মাসের মধ্যে। ‘সুরাসার’ কবিতার বইয়ের প্রথম প্রুফ আসার পর আপলিনের কবিতাটিকে বইয়ে স্থান দেন । বই বের হওয়ার আগে ‘লে সোয়ারে দ পারি’ (Les soirées de Paris) পত্রিকার ডিসেম্বর সংখ্যায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কাগজের একটা প্রুফকপি বইয়ের প্রথম প্রুফে যোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এই কপিতে দেখা যায়, কবি কবিতাটির প্রথম দেওয়া নাম ‘চিত্কার’ (Cri) পাল্টে ‘এলাকা’ (Zone) করে দিয়েছেন। বইয়ের প্রুফে কবিতাটির মধ্যে আরো কিছু পরিবর্তন করা হয়।
এই কবিতাটি নিয়ে যে আলোচনা ও তর্ক–বিতর্ক হয়েছে তার পরিমাণ সত্যি বিপুল। এ কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন হল কবিতাটি কি ব্লেজ সঁদ্রার–এর (Blaise Cendrars) ‘নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ (পাক আ ন্যু ইয়র্ক /Pâques à New York) দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত, নিদেনপক্ষে অনুপ্রাণিত? সঁদ্রার–এর কবিতাটি ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল, আর একথা সত্যি যে দুটি কবিতার মধ্যে সাদৃশ্য খুবই স্পষ্ট। যাঁরা মনে করেন আপলিনের–এর কবিতাটি সঁদ্রার–এর পূর্বোক্ত কবিতার দ্বারা প্রভাবিত, তাঁরা বলেন, সঁদ্রার নিউ ইয়র্কে ১৯১২–র এপ্রিল মাসে কবিতাটি লেখেন, তারপর আমেরিকা থেকে ফিরে তিনি নাকি আপলিনেরকে কবিতাটি পড়ে শোনান। আপলিনের বুঝতে পারেন, সঁদ্রার যা লিখেছেন তার তুলনীয় কিছুই তিনি লিথে উঠতে পারেন নি আর তখনই তিনি ‘এলাকা’ কবিতাটি লেথেন। অন্য দিকে আপলিনের–এর এক বন্ধুর সাক্ষ্য অনুসারে, সঁদ্রার–এর কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর আপলিনের তাঁকে কবিতাটি দেখান, কেননা তাঁর নিজের কবিতার সঙ্গে সঁদ্রার–এর কবিতার সাদৃশ্য তাঁকে বিস্মিত করেছিল। এসব কাহিনি থেকে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় নি; স্ঁদ্রার ১৯১২ সালে আমেরিকা থেকে ফিরলেও ঠিক কোন সময়ে ফিরেছিলেন জানা যায় নি। আর তাছাড়া এসব বিতর্কের সময় বেঁচে থাকলেও সঁদ্রার কখনো এ নিয়ে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেন নি।
আবার ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ব্লেজ সঁদ্রার–এর জীবনীতে গ্রন্থের লেখিকা সঁদ্রার–এর কন্যা মিরিয়াম (Miriam Cendrars) জানিয়েছেন যে সঁদ্রাম ১৯১২ সালের ৬ থেকে ৮ই এপ্রিল লেখা ‘নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ কবিতাটি আমেরিকা থেকে আপলিনার–কে পাঠান। সঁদ্রার চেয়েছিলেন আপলিনের কবিতাটি ‘মের্ক্যুর দ ফ্রঁস’ (Mercure de France) পত্রিকায় ছাপতে দিন। আপলিনের সঁদ্রারকে কোনো উত্তর দেন নি। প্যারিসে এসে ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সঁদ্রার একটি বইয়ের দোকান থেকে আপলিনের–এর সদ্য–প্রকাশিত ‘লেরেজিয়ার্ক’ (l’Hérésiarque) বইটি চুরি করে হাজতে যান। ১৭ই সেপ্টেম্বর হাজত থেকে তিনি বইটি পড়ে মুগ্ধ হওয়ার কথা আপলিনেরকে চিঠি লিখে জানান। এই চিঠিতেও তিনি ‘নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করেন। এর পর সঁদ্রার ও তাঁর দুই বন্ধু পরিচালিত একটা বইয়ের সিরিজে প্রথম পুস্তিকা হিসেবে যখন কবিতাটি প্রকাশিত হয় তখনও সেই পুস্তিকা আপলিনের–কে পাঠানো হয়েছিল। শিল্পী–দম্পতি সবের এবং সোনিয়া দলোনের–র বাড়িতে সঁদ্রার যেদিন কবিতাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন সেখানেও আপনিনের উপস্থিত ছিলেন।
এ সম্পর্কে আমরা বলতে পারি, আপলিনের–এর কবিতাটির সঙ্গে সঁদ্রার–এর উল্লিখিত কবিতাটির সাদৃশ্য রয়েছে, তাছাড়া আপলিনের–বিশেষজ্ঞ মিশেল দেকোদ্যাঁ (Michel Décaudin) তাঁর ‘সুরাসার–এর দলিল’ (ল দোসিয়ে দালকল/Le dossier d’Alcools) গ্রন্থে ‘এলাকা’ কবিতাটির যে আদি খসড়া উপস্থাপিত করেছেন তাতে এই সাদৃশ্য আরো স্পস্ট, কবিতাটির পরিমার্জনা সেই সাদৃশ্য অনেকটা মুছে দিয়েছে। আবার আপলিনের–এর কবিতার বিবর্তনের ইতিহাসে ‘এলাকা’ কবিতাটি সত্যি আকস্মিক — তার প্রস্ত্ততি এর আগে তাঁর কবিতায় চোখে পড়ে না। তবু সঁদ্রার–এর কবিতার সঙ্গে সাদুশ্য সত্ত্বেও বর্তমান কবিতাটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বস্ত্তত দুটি কবিতাই ফরাসি সাহিত্যে অনন্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বোঝা যায়, আপলিনের সঁদ্রার–এর কবিতা শুনেছিলেন বা পড়েছিলেন আর তা তাঁর মনের মধ্যে ধীরে ধীরে জমতে থাকা বারুদে প্রেরণার অগ্নিসংযোগ করে — তারই বিস্ফোরণ ‘এলাকা’ কবিতাটি । বলা যায়, যে কোনো যথার্থ নতুন কাব্যসৃস্টিই সাধারণত বিবর্তনের পথ ধরে পরিণতি বা কখনো কখনো কয়েকটি পর্যায় পার হওয়া বিস্ফোরণ। ‘নিউইয়র্কে ইস্টার’ আর ‘এলাকা’ কবিতার বিস্ফোরণের পেছনে তত্কালীন ফরাসি কবিতার কিছু প্রবণতা কাজ করেছে। বস্ত্তত এ সময়ে ফরাসি কবিতায় প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনের আবির্ভাব, গদ্যময়তা, মুক্তছন্দ ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। আবার বিদেশি কবিকৃতির অনুবাদ, বিশেষ করে হুইটম্যান–এর অনুবাদ কবিতায় নতুন উচ্চারণ সম্পর্কে সচেতনতার প্রেরণা যোগায়। এই সমস্ত উপাদানের পরিণতি সঁদ্রার এবং আপলিনের–এর কবিতা। হয়তবা সঁদ্রার–এর রচনা আপলিনেরকে নতুন উচ্চারণের অন্বেষণে পথের নির্দেশ দিয়েছিল — তারপর আপলিনের এগিয়ে গেছেন নিজের পথে, সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব কবিতা। তবে অনস্বীকার্যভাবে আপলিনের–এর ‘এলাকা’ আন্তঃরাচনিক সূত্রে সঁদ্রার–এর ‘নিউ ইয়র্কে ইস্টার’ কবিতাটির সঙ্গে সম্পর্কিত।
আলোচনার অন্য এক স্তরে বলা যায় যে আপলিনের ও সঁদ্রার–এর কবিতা দুটির সাদৃশ্য তাদের আপাত–সংস্থানে। নিহিত সংস্থানে রচনা দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, অনন্য। সঁদ্রার–এর কবিতার ভ্রমণপথের স্থানব্যাপ্তি নিউ ইয়র্কে সীমাবদ্ধ আর কালব্যাপ্তি বর্তমান কালে সীমিত; আপলিনের–এর কবিতার স্থানব্যাপ্তি প্যারিসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানান্তরে গতিশীল, আর কালব্যাপ্তি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে অবাধ গতিময়। আবার আপলিনের–এর কোলাজ–ধর্মিতাও তাঁর নিজস্ব। এদিক থেকে সঁদ্রার–এর কবিতায় রয়েছে একটা প্রবহমানতা, আর আপলিনের–এর কবিতায় উল্লম্ফনধর্মিতা।
‘এলাকা’ কবিতাটিকে ‘সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা হিসেবে উপস্থাপনার মধ্যে আপলিনের কবিতাটিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন তা বোঝা যায়। আমরা বলতে পারি এই রচনাটি আপলিনের–এর ১৮৯৪ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত কাব্যসৃস্টির পরিণতির স্বাক্ষর আর একই সঙ্গে নতুন কবিতা সম্পর্কে তাঁর ঘোষণাপত্র।
কবিতাটির নাম Zone, আমরা বাংলা অনুবাদে নাম দিয়েছি ‘এলাকা’। কিন্ত্ত এই Zone নামের তাত্পর্য কী? স্মরণীয়, প্রথম প্রকাশের সময় কবিতাটির নাম ছিল ‘চিত্কার’ (ক্রি/Cri )। সেই নাম পাল্টে অনির্দিষ্ট Zone নাম রাখার কারণ কী? সঁদ্রার–কন্যা মিরিয়াম–এর আভিমতে Zones (বহুবচনে) সঁদ্রার ও আপলিনের–এর পরিকল্পিত পত্রিকার নাম; পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় নি, কিন্ত্ত আপলিনের zone শব্দটি একবচনে তাঁর বর্তমান ‘সঁদ্রার–প্রভাবিত’ কবিতাটির শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেন। তাছাড়া জানা যায়, শ্রীমতী গাব্রিয়েল ব্যুফে (Gabrielle Buffet) ও তাঁর স্বামী ফ্রঁসিস পিকাবিয়া (Francis Picabia) ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে জ্যুরাতে (Jura) এতিভাল গ্রামে গাব্রিয়েল–এর মা–বাবার গাঁয়ের বাড়িতে আপলিনেরকে আমন্ত্রণ করেন। সেখানে তিনি অসমাপ্ত ‘এলাকা’ কবিতাটি পড়ে শোনান। গাব্রিয়েল–এর মা কবিতাটির নাম জানতে চাইলে আপলিনের জবাব দেন, Zone।জোন অনেকের ধারণা ফরাসি–সুইস সীমান্তের ‘মুক্ত এলাকা’ বা Zone franche–এর কাছাকাছি এতিভাল গ্রামের অবস্থান থেকে এই নামের কথাটি আপলিনের–এর মনে আসে। আবার প্যারিস শহরের চারদিকে শহরতলির বসতি শুরু হওয়ার আগে কিছুটা থালি জায়গা রাখা ছিল। সেখানে ধীরে গরিব, গৃহহীন আর ভবঘুরেদের বসতি গড়ে ওঠে; এই অঞ্চলকেও বলা হত Zone, আবার Zone (গ্রিক ζόνη, লাতিন zona, ফরাসি zone) বলতে বোঝায় বেল্ট বা বলয়। বৃত্তাকারভাবে ঘুরে এসে আরম্ভের জায়গায় শেষ হওয়া কবিতাটি তাই zone বা বলয়ের মতোই।
আমাদের মনে হয়েছে, এই কবিতায় কবি প্রাচীন বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশিয়ে খণ্ড, ছিন্ন, প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনকে স্থান দিতে চেয়েছেন — কবিতার প্রথানির্দিষ্ট নগর–পরিখার বাইরের এক এলাকায় এই মিলন সন্ভব। একই সঙ্গে এই কবিতায় একাকার হয়ে গেছে কাব্য আর অকাব্য, বাস্তব আর কল্পনা, অতীত আর বর্তমান — কবি কবিতার রাজ্যের আইনকানুনের সীমান্ত পেরিয়ে কবিতার এক ‘মুক্ত এলাকা’ তৈরি করতে চেয়েছেন। এই কবিতা তাই দুঃখের, যন্ত্রণার বা প্রতিবাদের ‘চিত্কার’ নয়, কবিতার নতুন ‘এলাকা’–র সৃস্টি।
ঐ কবিতার ছন্দের প্রসঙ্গে দু–একটি কথা বলা দরকার। ফরাসি কবিতায় অক্ষর বা দলমাত্রিক ছন্দের প্রথাকে ভাঙার চেষ্টা হয় টানা গদ্যে কবিতা লেখার মাধ্যমে। পরিণতির পথ ধরে তা বিশ শতকের প্রথমে ক্লোদেল এবং পের্স–এর গদ্য–কবিতায় বিশিস্ট একটা রূপ লাভ করে। অন্যদিকে উনিশ শতকের শেষ থেকে মুক্তছন্দ (vers libres) নিয়ে পরীক্ষা শুরু হল। মুক্তছন্দ মানে মোটামুটিভাবে অসম পর্বের বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের পঙক্তির সমাবেশ — বাংলায় যে ধরনের রচনাকে আমরা গদ্যছন্দে বা (সিঁড়ি) ভাঙা গদ্যে লেখা কবিতা বলি। ফরাসি মুক্তছন্দ সমিল বা অমিল দুই হতে পারে। প্রাথমিক প্রচেস্টায় আমরা তাতে গদ্যের চাল লক্ষ করলেও তা কাব্যময়, সুক্ষ্ম ছন্দোস্পন্দনময়। সঁদ্রার আর আপলিনের এই মুক্তছন্দের ব্যবহারেও বিপ্লব ঘটালেন। তাঁরা কোনো ছক মানলেন না, একই কবিতায় কখনো মিলওয়ালা, কখনো অমিল পঙক্তি ব্যবহার করলেন, মিলের পাশাপাশি ব্যবহার করলেন মিলাভাস বা স্বরসাম্য (assonance) যা ফরাসি–কবিতায় মধ্যযুগে ব্যবহৃত হত। মুক্তছন্দের এ সমস্ত চরিত্র–বৈশিস্ট্য আমরা ‘এলাকা’ কবিতায় লক্ষ করি।
এ কবিতা এবং আপলিনের–এর আরো কিছু কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কবিতা–অনুবাদের সাধারণ সমস্যাগুলি ছাড়াও আমরা যে বিশেষ সমস্যার সম্মুথীন হয়েছি তা হল:
১. বাচনের গদ্যধর্মিতার সঙ্গে মিল আর স্বরসাম্য রক্ষা করা। স্বরসাম্য ব্যাপারটা বাংলা কবিতার ঐতিহ্যস্বীকৃত নয়, বাংলা কবিতার প্রথাগত বিচারে চরণান্ত স্বরসাম্য দুর্বল বা অক্ষম মিল হেসেবে বিবেচিত হতে পারে।
২. খিস্টধর্মীয় তথা জুডো–হেলেনিক অনুষঙ্গময় শব্দ আর তার পাশাপাশি নাগরিক তথা যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দগুলির অনুবাদ ও সামঞ্জস্য রাখা সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
৩. আপলিনের বিভিন্ন স্তরের শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, বাংলা সাহিত্য–ভাষার প্রথানির্দিস্ট ছাঁচের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শব্দের মিশ্রণ দুঃসাধ্য।
কবিতার প্রথম পঙক্তির ‘তোমাকে’ (তুমি) আসলে কবির নিজেকে উদ্দেশ করে বলা। কবিতাটিতে নিজেকে নির্দেশ করতে কবি ‘আমি’ আর ‘তুমি’ দুই ব্যবহার করেছেন। বস্ত্তত উত্তম ও মধ্যম পুরুষের মধ্যে অবাধ সঞ্চরণের ফলে কবিতায় একই সঙ্গে মন্ময় ও তন্ময় ভঙ্গিতে নিজেকে দেখা আর নিজের সম্পর্কে কথা বলার রীতিতে একটা নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে।
মেষপলক হে আইফেল টাওয়ার : মুলে রয়েছে ‘মেষপালিকা’, কেননা ব্যাকরণগত বিচারে টাওয়ার–এর ফরাসি প্রতিশব্দ ‘তুর’ (tour = মিনার) স্ত্রীলিঙ্গ। তাই ফরাসিতে আইফেল টাওয়ার হল ‘লা তুর এফেল’ (la tour Eiffel)৷ ১৮৮৯ সালের ‘বিশ্বমেলা’ (Exposition universelle) উপলক্ষে ফরাসি প্রযুক্তিবিদ্ গুস্তাভ এফেল (Gustave Eiffel) ধাতু–নির্মিত এই মিনার তৈরি করেন (১৮৮৭–১৮৮৯)। কালক্রমে এই মিনার প্যারিস নগরীর অনুষঙ্গময় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বর্তমান এই টাওয়ার ভ্রমণকারীদের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া দীর্ঘকাল ধরে মিনারটিকে রিডিও এবং টেলিভিশনের সম্প্রচার–টাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পূর্বতন পঙক্তির সেকেলে জগৎ আর বিশ শতকের প্রথম পর্বের শিল্পীদের প্রিয় ব্যবহারিক কারিগরি–স্থাপত্যের নিদর্শন আইফেল টাওয়ার–এর মধ্যে প্রাথমিক সম্পর্কে বিরোধ আর বৈপরীত্যের। অন্যদিকে আইফেল টাওয়ারকে মেষপালক এবং সেন নদীর ওপরের সেতুগুলিকে ভেড়ার পাল বলে কল্পনা করে — আর তারই অনুষঙ্গে সেতুর পালের ভেড়ার ডাকের কল্পনা (হয়ত সেতুর তলা দিয়ে যাওয়া গাধাবোটের ভোঁ) অবাধে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা থেকে শ্রুতিগ্রাহ্যতায় সঞ্চলনের নিদর্শন। বস্তুত এই অবাধ গতি আর এক পঙক্তি থেকে পরবর্তী পঙক্তির চিন্তার উল্লম্ফনের দ্বারা যে আপাত যুক্তিবিরোধী সংস্থান গড়ে উঠেছে তাই হল (বিশ শতকের) আধুনিক শিল্প আর কবিতার ভিত্তি । অন্যদিকে মেষপালক আর ভেড়ার পালের কল্পনার মধ্যে খ্রিস্টধর্মীয় অনুষঙ্গও বর্তমান। খ্রিস্টীয় মেষপালক (= জিশু→পোপ) এবং নতুন যন্ত্রযুগের প্রতীক আইফেল টাওয়ার কবির উপলব্ধিতে এক হয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে তা কবিতায় খ্রিস্টধর্ম তথা পোপের প্রসঙ্গের অবতারণার ভূমিকা রচনা পরেছে।
মোটর গাড়িগুলোর চেহারা … সেকেলে : ঘোড়ার গাড়ির আকারের অনুকরণে কিছু কিছু মোটরগাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। আপলিনের হয়ত বিশেষ করে সেই গাড়িগুলির কথা স্মরণ করছেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি, আধুনিক পৃথিবীর তাবৎ আবিষ্কার আপলিনেরকে মুগ্ধ করত। বিমান–পোত ও বিমান–ভ্রমণ সম্পর্কে তাঁর উত্সাহ ছিল সীমাহীন। তাঁর মনে হত পুরাকাহিনি ও লোকবৃত্তের কল্পনার মধ্যে প্রকাশিত মানুষের ওড়ার স্বপ্নের সার্থক বাস্তব রূপায়ণ বিমানের আবিষ্কার। বিমান–ভ্রমণকে খ্রিস্টের উত্থানপর্বের সঙ্গে তুলনা করে আপলিনের বর্তমান কবিতায় মানুষের বৈমানিক প্রয়াসকে আধ্যাত্মিক তাত্পর্য দিতে চেয়েছেন। খ্রিস্টধর্ম আপলিনের–এর ধারণায় চিরন্তন এবং বর্তমান — তাই তা প্রাচীন হয়ে যায় নি। অন্যদিকে আপলিনের পোপ দশম পাইয়াস–কে ‘সবচেয়ে আধুনিক ইয়োরোপীয়’ বলে অভিহিত করেছেন। পোপ দশম পাইয়াস ছিলেন অতান্ত রক্ষণশীল চরিত্রের আর সমস্ত রকমের ‘আধুনিকতার’ বিরোধী। তিনি ট্যাঙ্গো নাচকে কামুক নৃত্য বলে নিযিদ্ধ করে ফর্মান জারি করেছিলেন। পরবর্তীকালে মাদলেনকে লেখা আপলিনের–এর একটা চিঠি থেকে বোঝা যায় যে আপলিনের সবই জানতেন। তবু ঐ পোপকে তিনি কেন আধুনিক বলে অভিহিত করলেন? এর কারণ বোধ হয়, পোপ দশম পাইয়াস একবার খ্রিস্টধর্মকে আধুনিক মানসিকতার উপযোগী হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। এছাড়া ১৯১১ সালের মে মাসে প্যারিস–রোম–তুরিন বিমান চালনার প্রতিযোগিতা হয়। পোপ তাঁর ভ্যাটিকানের প্রাসাদের ঝুল–বারান্দা থেকে ঐ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী বৈমানিক বোমোঁ–কে (Beaumont) আশীর্বাদ করেন। আশীর্বচনে পোপ বিমান–চালনার প্রসঙ্গে খ্রিস্টের উত্থান–পর্বের (Ascension) কথা উল্লেখ করেন। মনে হয় পোপের এই উক্তি আপলিনের–কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে ভবিষ্যদবাদী ইতালীয় কবি মারিনেত্তি ‘পোপের মনোপ্লেন’ নামক একটি কবিতা লিখেছিলেন। ভবিষ্যদবাদ সম্পর্কে উত্সাহী আপলিনের নিশ্চয় ঐ রচনাটির কথা জানতেন। প্যারিস–রোম বিমান–অভিযান প্রতিযোগিতা নিয়ে এদমঁ রস্তঁ (Edmond Rostand), জঁ একার (Jean Aicard) এবং আরো অনেক কবি কবিতা লেখেন। বিমান–ভ্রমণ কবিদের মধ্যে এমন উত্সাহ জাগায় যে ১৯১০ থেকে আকাদেমি ফ্রঁসেজ ‘আকাশ–বিজয়’ নামে এক কবিতা–প্রতিযোগিতা শুরু করে।
প্রসপেকটাস ক্যাটালগ আর পোস্টার : ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসের ‘লে সোয়ারে দ পারি’ পত্রিকায় প্রকাশিত অঁদ্রে বিলি–র (André Billy) লেখা ‘আমি কী করে কবি হলাম’ (Comment je suis devenu poète) রচনা খেকে জানা যায় যে ক্যাটালগ, পোস্টার আর নানান ধরনের বিজ্ঞাপনের মধ্যেই নতুন যুগের কবিতা রয়েছে বলে আপলিনের মনে করতেন।
গোয়েন্দা –গল্পে ঠাসা : এর মধ্যে কোন কটাক্ষ বা বিদ্রূপ নেই, কেননা জনপ্রিয় গোয়েন্দা–গল্পে আপলিনের–এর বিশেষ অনুরাগ ছিন।
রনে দালিজ (René Dalize) : আপলিনের–এর স্কুলের বন্ধু। তাঁর আসল নাম রনে দ্যুপ্যুই (René Dupuis) । মোনাকো–র স্যাঁ–শার্লে ১৮৯২ সালে আপলিনের–এর সঙ্গে রনে দ্যুপ্যুই–এর পরিচয় হয়। তাঁরা একই ক্লাসে পড়তেন। পরে প্যারিসে এসে ১৯০৩ সালে আবার তাঁদের দেখা হয়। দুজনেই সাহিত্যজগতে পরিচিত হয় ওঠেন। দ্যুপ্যুই–এর বাবার একটা খবরের কাগজ ছিল। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জগতে রনে দ্যুপ্যুই রনে দালিজ ছদ্মনামে পরিচিত হন। ‘লে সোয়ারে দ পারি’ পত্রিকার তিনি ছিলেন অন্যতম সহযোগী। ১৯১৭ সালে তিনি যুদ্ধে মারা যান। আপলিনের তাঁর ‘কালিগ্রাম’ (Calligrammes) বইটি রনে দালিজ–কে উত্সর্গ করেন।
খ্রিস্টের দীপ্ত মহিমা … : খ্রিস্টের যে রূপ এখানে বর্ণিত হয়েছে তা দেখা যায় নৎর্–দাম (Notre-Dame) ও অন্যান্য প্রাচীন গির্জের স্ফটিক–চিত্রে। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, কবির মার সাক্ষ্য অনুসারে শৈশবে আপলিনের খুবই ধার্মিক ছিলেন।
এই সেই স্থলপদ্ম … : এখানে জিশুর বর্ণনায় প্রাচীন ও প্রথাগত বাইবেল–অনুপ্রাণিত শব্দব্যবহারে একটি স্তোত্রের অনুষঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। ‘যন্ত্রণাকাতর মায়ের সিঁদুরে রঙ ছেলে’ একদিকে মধ্যযুগীয় চিত্রে জিশুর ছবির রঙের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যদিকে তা ক্যাথলিক গির্জেয় উচ্চারিত ল্যাটিন স্তব Stabat Mater dolorosa… মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপলিনের ধর্মীয় স্তোত্র লিখতে চান নি; ‘এই সেই খ্রিস্ট যিনি বিমানচালকদের চেয়েও…’ ইত্যাদি দুই পঙক্তি নাটকীয়ভাবে সমস্ত রচনাকে অন্য এক তাত্পর্যের অভিমুখী করেছে। তাছাড়া কবিতার পরের অংশে খ্রিস্টের উত্থান আধুনিক মানুষের বৈমানিক প্রয়াসের উপমেয় হিসেবে তার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে।
জুডিয়ার সাইমন গুণিন : সাইমন ছিলেন সামারিয়ার বাসিন্দা, জুডিয়ার নয়। জিশু–শিষ্য সন্ত পিটারের কাছ থেকে জাদুকর সাইমন অলৌকিক ঘটনা–সংঘটনের ক্ষমতা কিনতে চেয়েছিলেন। সাইমন গুণিনের কাহিনি আপলিনের–কে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি ‘সাইমন গুণিন’ (সিমোঁ মাজ/Simon mage) নামে একটি গল্পও লিখেছিলেন।
চোর : ফরাসিতে যে শব্দশ্লেষ রয়েছে বাংলায় তা রাখা যায় নি। ফরাসি voler ক্রিয়ার অর্থ হল : ক. ওড়া, খ. চুরি করা — তার থেকে আসা voleur শব্দের স্বভাবত দুটি অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে : ক. চোর, খ. উড়ন্ত (ব্যক্তি)। বাংলা অনুবাদে প্রথম অর্থ গ্রহণ করে মূলের অর্থপরিধিকে খণ্ডিত করা হয়েছে।
জিশুর উত্থান–পর্বের প্রসঙ্গে আপলিনের–এর বর্ণনা কোলনের ম্যুজিয়ামে রাখা প্রাচীন জার্মান ছবির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সে ছবি আপলিনের দেখেছিলেন। ছবিতে আছে ডানাওয়ালা ক্রুশে ভর করে যিশু আকাশে উড়ছেন — চারদিকে ঘিরে আছে বিমানকে।
ইকারুস … : পৌরাণিক যুগ থেকে মানুষের ওড়ার স্বপ্ন আর চেষ্টার কথা আপলিনের–এর বারবার মনে পড়ে যায়। গ্রিক পুরাণের চরিত্র ইকারুস (Icarus, গ্রি. ইকারস/ Ίκαρος, ফ. ইকার/Icare) পিতা দিদালুসের সঙ্গে মিনস কর্তৃক গোলকধাঁধায় বন্দী হন। মিনস–এর স্ত্রী তাঁদের মুক্ত করে দেন। তখন পালানোর জন্য ইকারুস পিতার সঙ্গে মোম দিয়ে লাগানো ডানার সাহায্যে আকাশে উঠে যান —পিতার উপদেশ ভুলে গিয়ে, ওড়ার আনন্দে তিনি সূর্যের দিকে এগিয়ে গেলেন। তখন উত্তাপে মোম গলে গিয়ে ডানা খসে পড়ল আর ইকারুস সমুদ্রে পড়ে গেলেন।
ইহুদি–পুরাণ অনুসারে ইনক (Enoch) হলেন কাইন–এর পুত্র। আর ইহুদি সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষদের একজন ছিলেন ইলাইজা (Elijah, ফ. এলি/Elie)। ইহুদি পুরাণের মতে, ঈশ্বর ইনক আর ইলাইজাকে আগুনের রথে করে আকাশে (স্বর্গে) তুলে নিয়েছিলেন।
আপলোনিয়স দ তিয়ান (Apollonios de Thyane, ই. Apollonius of Tyana) : খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের পিথাগোরাস–অনুগামী গ্রিক দার্শনিক। এই প্রাজ্ঞ দার্শনিককে জাদুকর বলে ভাবা হত আর খ্রিস্টের প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করা হত।
অর্ফিয়ুস, ইকারুস, মার্লিন–এর মতো আপলোনিয়স দ তিয়ানও তাঁর অলৌকিক, মায়াবী ‘ক্ষমতা–র’ জন্য আপলিনের–এর কাছে কবির প্রতীক বলে গণ্য হতেন।
রক (Roc): ‘আরব্য–রজনী’র কাল্পনিক পাখি।
মারাবু (Marabout): আফ্রিকার দীর্ঘচঞ্চু পাখি। মারাবু শব্দের অন্য অর্থ ভবিষ্যৎ–দ্রস্টা আফ্রিকান দৈবজ্ঞ বা পির। মারাবু পাখিকে ইংরেজিতে বলা হয় ibis।আইবিস।
পিহি : আপলিনের–বিশেষজ্ঞ দেকোদ্যাঁর মতে এই চৈনিক পাথির কল্পনার সূত্র হল ১৮৯৬ সালের জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি মাসের ‘এশিয়াবিষয়ক পত্রিকা’য় (Journal asiatique) প্রকাশিত প্রাচীন চিন সম্পর্কে একটি রচনা। সে রচনায় জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ানো এক চোখওয়ালা পি–মু মাছ আর একটি ডানাওয়ালা পি–ই পাখির কথা দেখা যায়। এই পাখির উল্লেখ আপলিনের–এর ‘জানলা’ (Les fenêtres) কবিতাটিতেও লক্ষ্য করা যায়। পি–মু মাছের উল্লেখ রয়েছে ‘দরজা’ (La porte, অনুবাদে নেই) কবিতায়। চিন সম্পর্কিত রচনাটিতে ঐ কাল্পনিক পাখিটির নামের ফরাসি বানান ছিল pi-i, আপলিনের তাকে একটু পাল্টে নিয়ে লিখেছেন pihi, বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে হওয়া উচিত ছিল পি–ই, কিন্তু আমরা উচ্চারণের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেছি পিহি।
ভালোবাসার যন্ত্রণা : ১৯১২ সালের গ্রীষ্মে মারি লোরস্যাঁ–র সঙ্গে কবির সম্পর্কের ছেদ হয়। ‘এলাকা’ কবিতা বস্তুতপক্ষে একদিকে আপলিনের–এর সেই প্রণয়াবসানের কবিতা আর অন্যদিকে তার মধ্যে রয়েছে বেদনাময় স্মৃতির যন্ত্রণা। প্রসঙ্গত পরবর্তী ‘মিরাবো সেতু’ কবিতাটির টীকা দ্রষ্টব্য।
শার্ত্র্–এর মেরি মাতা : প্যারিস থেকে ৯৬ কিলোমিটার দূরে শার্ত্র্ (Chartes) শহর তার ক্যাথিড্রালের জন্য বিখ্যাত। দ্বাদশ–ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত এই গির্জে প্যারিসের নৎর্ দাম–এর মতো খ্রিস্টের কুমারী মাতাকে নিবেদিত। মধ্যযুগ থেকে এই গির্জে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মীদের বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র।
মোঁমার্ত্র্ (Montmartre) : প্যারিস শহরের উত্তর অংশে একটি ছোট পাহাড় বা টিলা। উনিশ শতকের শেষ দিকে এই টিলার চূড়ায় একটি বড় গির্জে বানানোর পরিকল্পনা হয় (১৮৭৩)। ১৯১০ সালে গিজেটির নির্মণ শেষ হয়। এই বিপুলাকার গির্জে বা বাজিলিকটির নাম ‘পবিত্র হৃদয়’ বা সাক্রে ক্যর (Sacré-cœur) ৷ মোঁমার্ত্র্–এর টিলার গায়ে যে পুরনো পাড়া রয়েছে তার নাম মোঁমার্ত্র্ পাড়া। এই পাড়া ছিল এককালে, বিশেষ করে বিশ শতকের প্রথম দিকে, শিল্পীদের পাড়া। শিল্পীদের বন্ধু আপলিনের, সঁদ্রার প্রভৃতি কবি–সাহিত্যিকরা এখানা নিত্য যাতায়াত করতেন।
চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ শহরে রয়েছে সন্ত ভিৎ (Saint Vit) ক্যাথিড্রাল আর হ্রাদচিন (Hredchin = Hradschin) রাজপ্রসাদ।
কোব্লঁস (Coblence, জর্মন, কোব্লেনত্স/Koblenz) জার্মানির, লেইদ (Leyde) বেলজিয়ামের আর গুডা (Gouda) হল্যান্ডের শহর।
প্যারিসে তুমি দায়রা জজের আদালতে : ১৯১১ সালে লুভ্র্ ম্যুজিয়াম থেকে মূর্তি চুরির ব্যাপারে গ্রেপ্তার হওয়ার স্মৃতি।
বিশ আর তিরিশ বছরে : কবি যখন এ কবিতা লিখেছেন তখন তাঁর বয়স বত্রিশ — বিশ আর তিরিশ বছর বয়সের যে ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি তাঁর মনে পড়ছে তী হল আনি প্লেডেন (Annie Playden) ও মারি লোরঁস্যাঁ–র (Marie Laurencin) কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ইতিহাস।
স্যাঁ–লাজার স্টেশন : আপলিনের কিছুদিন তাঁর মার সঙ্গে প্যারিসের শহরতলিতে থাকতেন। প্যারিসের অন্যতম রেলস্টেশন স্যাঁ–লাজার দিয়ে তাঁকে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হত।
বাইবেলের জ্ঞানী রাজা : নক্ষত্রের অবস্থান লক্ষ করে প্রাচ্যের জ্ঞানী রাজারা ত্রাণকর্তা জিশুর জন্মসংবাদ অবগত হন এবং নবজাত ঈশ্বরপুত্রকে দেখার জন্য নক্ষত্রকে অনুসরণ ফরে সুদীর্য পথ–পরিক্রমান্তে বেখলেহেম–এ পৌঁছান।
লাল একটা লেপ : পোলাণ্ডের লোকদের কাছে লাল লেপ করিবারের প্রতীক। আপলিনের–এর মা ছেলেকে পরিবারের প্রতীক একটা লাল লেপ দিয়েছিলেন।
ওত্যই : ১৯০৯ থেকে আপলিনের ওত্যই পাড়ায় থাকতেন ।
ওসেয়ানা আর গিনির দেবদেবী : বিশ শতকের প্রথম দিকে ইয়োরোপীয় শিল্পীরা কালো মানুষদের আদিম শিল্পকলাকে আবিষ্কার করেন। শিল্পীদের বন্ধু তথা শিল্পরসিক আপলিনেরও এই আদিম শিল্পকলা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
নিকৃষ্ট খ্রিস্ট : আজকের পাঠকের কাছে ‘নিকৃষ্ট’ বিশেযণটি বর্ণবিদ্বেষের পরিচায়ক বলে মনে হবে — কিন্তু আপলিনের এ ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই সচেতন ছিলেন না। বিশেষণটি তত্কালীন ইয়োরোপীয় মানসিকতার প্রকাশ।
মিরাবো সেতু ( Le Pont Mirabeau)
কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘লে সোয়ারে দ পারি’ (Les Soirées de Paris) পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় অর্থাৎ ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই প্রথম প্রকাশের খুব বেশিদিন আগে কবিতাটি লেখা হয়েছিল বলে মনে হয় না । ১৯১১ সালে লেখা একটি অপ্রকাশিত কবিতার খসড়ার মধ্যে বর্তমান কবিতার ধ্রুবপদ দুটি পাওয়া যায়।
১৯১৫ সালে একটি চিঠিতে আপলিনের তাঁর বান্ধবী মাদলেনকে জানিয়েছিলেন যে ‘মিরাবো সেতু’ কবিতাটি ‘সেই নারীর সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কের অবসানের বিষন্ন সঙ্গীত ‘এলাকা’ (Zone) কবিতাকে অনুপ্রাণীত করেছিলেন আর পরে ঐ কবিতার জার্মান অনুবাদের প্রচ্ছদের জন্য ঘোড়ার পিঠে আমার ছবি এঁকে দিয়েছিলেন’। এই নারী মারি লোরঁস্যাঁ (Marie Laurencin, ১৮৮৫–১৯৫৬)। ১৯০৭ সালে পিকাসো–র মাধ্যমে এই মহিলা–শিল্পীর সঙ্গে আপলিনের–এর পরিচয় হয়। আপলিনের–এর বয়স তখন ২৭, মারি–র ২২। ১৯১২ সাল পর্যন্ত নানা ঘাত–প্রতিঘাত সত্ত্বেও তাঁদের সম্পর্কে বজায় ছিল। কিন্তু ক্রমশ তা চিড় থেতে শুরু করল, বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। ১৯১২ সালে লেখা ‘মিরাবো সেতু,’ ‘মারি’ (Marie) এবং ‘এলাকা’ কবিতার মধ্যে এই বিচ্ছোদের অনুভূতি কবিতার বিষয়গত উপাদানে মিশে রয়েছে। পরবর্তীকালে আপলিনের এই বিচ্ছেদের স্মৃতিকে ‘সবচেয়ে হৃদয়–বিদারক স্মৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন।
১৯১৪ সালে আপলিনের–এর নিজের কণ্ঠে পড়া তিনটি কবিতা রেকর্ড করা হয়। এই তিনটি কবিতার একটি ছিল ‘মিরাবো সেতু’।
‘এলাকা’ যেরকম ‘সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে আলোচিত কবিতা, ‘মিরাবো সেতু’ ও ‘মারি’ তেমনি এই বইয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা । এই কবিতায় গীতিময় ধ্বনি, ছন্দোম্পন্দন, ঐতিহ্যানুসারী রোমান্টিক কাব্যভাষা সব ধরনের পাঠকেরই প্রিয়। ফরাসি গীতিকবিতার চিরায়ত ঐতিহ্যের আধারে রচিত এ কবিতার ছন্দের সঙ্গে সমালোচক মারিও রক (Mario Roques) ত্রয়োদশ শতকের ফরাসি গীতিকবিতা একটি ‘শঁসোঁ দ তোয়াল’–এর (Chanson de Toile) ছন্দের সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। আবার বিখ্যাত আপলিনের–বিশেষজ্ঞ মিশেল দেকোদ্যাঁ (Michel Décaudin) কবিতাটির ধ্রুবপদের দ্বিতীয় চরণের সঙ্গে চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত কবি ফ্রঁসোয়া ভিইয়োঁ–র (François Villon) ‘শেষ ইচ্ছা’ (Testament) কবিতার একটি পঙক্তির মিল খুঁজে পেয়েছেন। বলা যায়, মধ্যযুগীয় ‘শঁসোঁ দ তোয়াল’ বা ফ্রঁসোয়া ভিইয়োঁ থেকে ভের্লেন পর্যন্ত ফরাসি গীতিকবিতার ঐতিহ্যের ধারা আপলিনের–এর কবিতায় এসে মিশেছে আর তারপর সেই ধারা তাঁরই কবিতার মধ্যে বিশ শতকের আধুনিকতার নৈচিত্র্যের অন্তরালে অন্তঃসালিলা হয়েছে ।
‘লে সোয়ারে দ পারি’ পত্রিকায় যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন কবিতাটিতে ছেদচিহ্ন এবং প্রতিটি স্তবকে তিনটে সমান (দশ) অক্ষরের পঙক্তি ছিল। পরে বইয়ের প্রথম প্রুফে কবি ছেদচিহ্ন তুলে দেন এবং প্রতিটি স্তবকের দ্বিতীয় পঙক্তিকে দুভাগে ভাগ করে সাজান। এতে ছন্দের একটা নাটকীয় দোলা আর সুরবৈচিত্র্য স়ৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া, ছেদচিহ্নের লোপ কবিতাটিতে এক ধরনের প্রবহমান গতিময়তার সৃষ্টি করেছে।
বর্তমান কবিতাটির আরো চারটি বাংলা অনুবাদ আমরা পড়েছি। প্রথম অনুবাদটি বিষ্ণ দে–র, যা তাঁর বিদেশি কবিতার অনুবাদ–সংকলনে রয়েছে। অনুবাদটি সুপরিচিত। দ্বিতীয় অনুবাদটি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের, এটি একটি সাহিত্য–পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান অনুবাদের (সম্ভবত) পরে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত একটি সাহিত্য–পত্রিকায় আর বাংলাদেশে শিশির ভট্টাচার্য তাঁর ‘আপলিন্যাখ্’ গ্রন্থে বর্তমান কবিতাটির অনুবাদ করেন। পাঠক বিষ্ণু দে, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, শিশির ভট্টাচার্য আর আমাদের অনুবাদ পড়ে মূলের সাংগীতিক ধ্বনিমূর্ছনাকে পরোক্ষভাবে কিছুটা অনুভব করতে পারবেন। বিষয় বা প্রকাশের দিক থেকে বর্তমান কবিতাটি কোনো অর্থেই নতুন নয়। একটা প্রবহমান বিধুরতার বোধ আর ব্যঞ্জক ধ্বনিময়তাই কবিতাটিকে অনন্য করে তুলেছে । কবিতার ধ্বনিময় সংস্থান অনুবাদে রূপান্তরিত করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমরা তার কিছুটা আভাস দিতে চেষ্টা করেছি।
‘মিরাবো সেতু’ প্যারিস শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সেন নদীর ওপরের অনেকগুলি সেতুর একটি। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৭ সালে এই সেতুটি তৈরি হয় । ফরাসি বিপ্নবের অন্যতম নেতা মিরাবো–র (Honoré Gabriel Riqueti, comte de Mirabeau, ১৭৪৯–১৭৯১) নামে এই সেতুর নামকরণ করা হয় । আপলিনের ১৯০৯ সালের শেষ দিক থেকে ১৯১২–র অক্টোবর পর্য়ন্ত প্যারিসের ওত্যই (Auteuil) পাড়ায় থাকতেন। যাতায়াতের পথে তাঁকে ‘মিরাবো সেতু’ পার হতে হত।
‘সুখ’ ও ‘দুঃখের জ্বালা’ –র চেয়ে ‘আনন্দ’ (la joie) আর ‘বেদনা’ (la peine) হয়ত মূলের নিকটতর শব্দার্থবহ বা প্রাতিশাব্দিক হত। মূল পঙক্তির শব্দার্থ: ‘আনন্দ আসত চিরকাল বেদনার পরে’।
সেন নদীকে অবলম্বন করে এই কবিতার সমধর্মী অনুভব পাওয়া যায় ‘মারি’ (Marie) কবিতার একটি পঙক্তিতে। সেখানেও কবির মনে হয়েছে: le fleuve est pareil à ma peine।নদী আমার বেদনার অনুরূপ।
প্রহরের ঘণ্টা বাজুক (sonne l’heure): এর ইয়োরোপীয় অনুষঙ্গ ‘প্রহর গড়াক’ তর্জমায় কিছুটা রূপান্তরিত হয়েছে।
ধ্রুবপদের দ্বিতীয় পঙক্তির ‘দিন [গুলি] (les jours)’–কে প্রথম পঙক্তিতে নিয়ে আসা হয়েছে।
‘গতিহীন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কিছুটা অন্ত্যমিলের খাতিরে, কিছুটা কালের বহমান গতির বৈপরীত্য নির্দেশের জন্য ।
অবসিত জড়িমায় : মূলের শব্দার্থ হল ‘এমন অবসন্ন’ (si lasse) ৷
দুরাশার মায়া : বাংলা কবিতার প্রথাগত ভাষায় মূলের ‘আশা’ (L’espérance) শব্দটিকে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
যেন কিরকম তীব্র ভয়ংকর : মূলে রয়েছে comme… violente।কিযে… ভয়ংকর।
বন্ধন ( Liens)
কবিতাটি ‘মোঁজোয়া’ (Montjoie) পত্রিকায় ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
‘বন্ধন’ ‘কালিগ্রাম’ বইয়ের ‘ঢেউ’ অংশের তথা ‘কালিগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা। কবিতাটি আলাদা হরফে (ইটালিক্স্ টাইপে) ছাপা হয়েছিল। মনে হয়, কবি রচনাটিকে ‘ঢেউ’ অংশ তখা ‘কালিগ্রাম’ বইয়ের মুখবন্ধ–কবিতা হিসেবে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন।
‘বন্ধন’ কবিতার মধ্যে আপলিনের যেন এক নতুন কাব্যতত্ত্বের প্রস্তাবনা রচনা করেছেন। এখন থেকে ইন্দ্রিয়ানুভূতি অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বর্তমানের মধ্যে বেঁচে থাকাটাই হবে তাঁর কবিতার অবলম্বন, সেই কবিতায় প্রতিবেশ রচনা করবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনে ভরা আধুনিক পৃথিবী। আর এই বর্তমান অতীতের প্রতিপক্ষ — ইন্দ্রিয়ানুভূতি হল স্মৃতি, কামনা, অনুতাপ আর চোখের জলের শত্রু ।
কিন্তু কবিতার শেষ পঙক্তিতে আপলিনের অতীতের আবেগময় অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেন নি। তাই ‘বন্ধন’ কবিতাটি শেষ পর্যন্ত একই সঙ্গে বিচ্ছেদ ও যোগসূত্রের কবিতা। অতীতের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা বলেও কবি ‘এখানে যা কিছু ভালোবাসেন’ তার কথা বলেছেন। ‘এখনো ভালোবাসা’র কথা বলার অর্থ হল অতীতের সঙ্গে যোগসূত্রের স্বীকৃতি। বলা যায়, ‘সবরকমের বাঁধনছাড়া’ মানুষ হওয়া শেষ পর্যন্ত কবির সম্ভব হয় নি।
আমরা বাংলায় ‘বন্ধন’ কবিতাটির ইটালিক্স্ হরফে ছাপা রূপ রাখি নি, কেননা ইটালিক্স্ হরফ বাংলায় আমাদের দৃষ্টিকে কিছুটা পীড়িত করে।
জানলা (Les Fenêtres)
এ কবিতাটি শিল্পী রবের দলোনে–র (Robert Delaunay, ১৮৮৫–১৯৪১) জার্মানিতে চিত্রপ্রদর্শনীর আলব্যাম–ক্যাটালগে প্রথম প্রকাশিত হয়, তারপর প্রকাশিত হয় ‘পোএম এ দ্রাম’ (Poème et Drame) পত্রিকার দ্ধিতীয় সংকলনে (জানুয়ারি ১৯১৩)।
আপলিনের–এর বন্ধু অঁদ্রে বিলি–র (André Billy) স্মৃতি অনুসারে, আপলিনের, দ্যুপুই (রনে দালিজ) আর বিলি একদিন ক্রুসিফিক্স্ (Crucifix) কাফেতে বসে ছিলেন। হঠাৎ আপলিনের হো হো করে হেসে উঠে বললেন যে শিল্পী দলোনে–র প্রদর্শনীতে ক্যাটালগের মুখবন্ধ হিসেবে তাঁর একটা কবিতা লেখার কথা, কিন্তু ব্যাপারটা তিনি একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। তত্ক্ষণাৎ তিনি বেয়ারার কাছ থেকে কাগজ–কলম চেয়ে নেন আর তিনজনে মিলে একটি কবিতা লিখবেন স্থির করেন। তাঁরা প্রত্যেকে এক একটি করে পঙক্তি বলতে থাকেন, এবং এভাবে কবিতাটি রচিত হয়। বিলি–র এই স্মৃতিচারণার পর দলোনে জানান, আপলিনের তাঁর স্টুডিয়োতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী সোনিয়া–র সামনে বসে কবিতাটি লিখেছিলেন। কবিতায় ব্যবহৃত উপাদান জানলা, জানলার সামনে হলুদ জুতো ইত্যাদি স্টুডিওতেই ছিল। বিতর্কে বিলি আবার প্রমাণ হিসেবে জানান যে ইতালিয়ান বারে বসে তাঁরা তুরিন–এর (Turin) মদ খাচ্ছিলেন, তাই তুরিনিজ তরুণীর প্রসঙ্গ এসেছে ; এছাড়া তাঁরা ‘সময়’ (Le Temps) আর ‘স্বধীনতা’ (La Liberté) নামে দুটি সান্ধ্য পত্রিকা কিনেছিলেন, তারই অনুযঙ্গে রচিত হয়েছে ‘যখন সময় থাকে স্বাধীনতা থাকে’।
বোঝা যাচ্ছে কবিতাটির রচনা সম্পর্কে বিতর্কের মূল প্রশ্ন হল, কবিতাটি একটি ‘সংলাপ–কবিতা’ না দলোনে–র স্টুডিয়োতে ‘লেখা’ কবিতা। বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে কাফেতে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আপলিনের একটা ‘সংলাপ–কবিতা’ রচনা করেন, তারপর দলোনে–র বাড়িতে ঐ ‘সংলাপ–কবিতাটিকে’ খসড়া হিসেবে ব্যবহার করে তাকে একটা সুনির্দিস্ট রূপ দেন। এছাড়া এই ইতিহাসের মধ্যে আমরা আরো দুটি জিনিস লক্ষ করি। প্রথমত, আপলিনের নতুন রচনারীতির সন্ধান করছিলেন, তাতে তিনি সংলাপ, তাৎক্ষণিক দেখা বস্তু (জানলা, জুতো ইত্যাদি) ব্যবহারকে পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া কবিতার রচনা সম্পর্কে এক ধরনের ‘ইতিহাস’ তৈরি করতে তিনি ভালোবাসতেন। তাই বন্ধুদের কারো কাছেই তিনি কবিতা রচনার পুরো ইতিবৃত্ত জানান নি, ‘অঁদ্রে সালমোঁ–র বিয়েতে পড়া কবিতা’র ক্ষেত্রেও আমরা এই কবিতা রচনার ‘ইতিহাস’ তৈরির প্রবণতা লক্ষ করি।
পিহি : ‘এলাকা’ কবিতার টীকা দ্রস্টব্য ।
সমুদ্র–সজারু : মূলে আছে oursin (উর্স্যাঁ) যাকে ইংরেজিতে বলে sea-urchin বা sea-hedgehog.
কাপ্রেস : আমরা মূলের Capresse শব্দটিই ব্যবহার করেছি। কাপ্রেস বলা হয় ফরাসি পশ্চিম ভারতীয় দ্ধীপপুঞ্জে আফ্রিকান ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত দো–আঁশলা মেয়েদের।
শাব্যাঁ (পুং.), শাবিন (স্ত্রী.) (Chabin, Chabine): এক ধরনের লম্বা, কর্কশ লোমওয়ালা ভেড়া। এদের ছাগল আর ভেড়ার সংকর বলে ভাবা হত।
ভোঁদর–শিকারি : মূলে রয়েছে আমেরিকার এক ধরনের লোমশ প্রাণীর নাম যাকে ফরাসিতে বলে raton (রাতোঁ ই. Racoon)৷
ভ্যাংকুভার (Vancouver) : ক্যানাডার বন্দর–নগর। ইয়ের (Hyères) ও ম্যাঁৎনোঁ (Maintenon) ফ্রান্সের দুটি ছোট শহর।
স্যাঁ–মেরি–র বাঁশিবাজিয়ে (Le musicien de Saint-Merry)
কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ‘লে সোয়ারে দ পারি’ (Les soirées de Paris) পত্রিকায় । অঁদ্রে সালমোঁ (André Salmon) তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
১৯০৯ সালের ১৩ই জুলাই, … গিয়োম প্রথমবার স্যাঁ–মেরি গির্জেয় প্রবেশ করল। গির্জেটি তার খুব ভালো লাগল আর পুরনো ঐ পাড়ার অনন্য চরিত্রটাও তাকে মুগ্ধ করল। একদিন গিয়োম আপলিনের একা একা স্যাঁ–মেরি–তে ফিরে এল, গির্জের ভেতর ঢুকে দেখল আর পাড়ার পুরনো অলিগলিতে ঘুড়ে বেড়াল, আর এই অভিজ্ঞতা থেকেই তার মনে রচিত হল ‘স্যাঁ–মেরি–র বাঁশিবাজিয়ে’। …কিছুই কখনো চূড়ান্তভাবে স্পষ্ট হয় নি… মহাফেজ–খানার সর্বভূক পোকা, বিস্ময়বিহ্বল প্রত্ন–বিশারদ, এক ধরনের মজাদার পাণ্ডিত্যের অধিকারী গিয়োম আপলিনের কি কোথাও পড়েছিল যে কোনো এক দুষ্ট পাদ্রি, অনেকদিন আগে, স্যাঁ–মেরি গির্জেটাকে শয়তানের কাছে নিবেদন করতে চেয়েছিল ?
অন্যদিকে জঁ মোলে (Jean Mollet) ১৯৪৮ সালের ১১ই নভেম্বর ‘লে লেৎর্ ফ্রঁসেজ’ (Les Lettres françaises) পত্রিকায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কাহিনি উপস্থাপিত করেন। আপলিনের–এর সঙ্গে একবার প্যারিস–এর পুরনো ‘মারে’ (Marais) অঞ্চলে ভ্রমণের স্মৃতিতে তিনি লেখেন :
রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা, কাকপক্ষী নেই, গাড়িঘোড়ার চিহৃ নেই। ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য আমরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছিলাম, রেলিঙের সৌন্দর্য দেখার উদ্দেশ্যে বাড়ির বিভিন্ন তলায় উঠছিলাম। ঐ বাড়িগুলোর কোনো একটার ভেতরে সিঁড়ি ধরে নামার পথে, আমাদের চোখে পড়ল বাড়ির উঠোনে একজন বাজিয়ে আর একজন গায়ককে ঘিরে এক দঙ্গল লোক, ওরা গলা মিলিয়ে বারবার একটা গানের ধুয়ো ধরছিল। কারো মনে হতে পারত যেন সবগুলো রাস্তা এই উঠোনে এসে লোকজন সব উজাড় করে ঢেলে দিয়ে গেছে। ব্যাপারটা দেখে আমরা দুজনেই খুব অবাক হয়ে গেলাম। কয়েক দিন পর আপলিনের আমায় একটা কবিতা পড়ে শোনাল। কবিতার নাম বলল : ‘স্যাঁ–মেরি–র বাঁশিবাজিয়ে’।
১৯১৬ সালে, এই কবিতার বিষয় অবলম্বন করে আপলিনের একটি ব্যালের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ‘চোখ, নাক, কান ছাড়া মানুষটি’ (লম সঁজিয়ো, সঁ নে, সঁজরেই/ L’homme sans yeux, sans nez, sans oreilles)৷
মেঘের এক ছায়ামূর্তি (Un Fantôme de nuées)
কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘লেজেক্রি ফ্রঁসে’ (Les Ecrits français) পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (ডিসেম্ভর, ১৯১৩) । এ কবিতাটি লেখার ইতিহাস সম্পর্কে কবির বন্ধু অঁদ্রে বিলি (André Billy) লিখেছেন, আপলিনের একটা গল্প লিখবেন বলে লেখাটি শুরু করেন, দশ লাইন লেখার পর কী লিখবেন তাঁর আর মাথায় আসে না, তখন তিনি ঐ দশ লাইনকে প্রথম দশ পঙক্তি (তিনটি স্তবক) হিসেবে রেখে একটি কবিতা লিখে ফেলেন।
এই কবিতাটি আপলিনের–এর কাব্যচিন্তা, কাব্যভাষা আর চিত্রকলার সঙ্গে কবিতার যোগাযোগ রচনার প্রয়াস হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন স্তরে কবিতাটির পাঠ সন্ভব। কবিতাটির নামের পেছনে হয়ত পুরাণপ্রিয় আপলিনের–এর চিন্তায় একটি পুরাণ–কাহিনির অনুষঙ্গ কাজ করেছে : রাজা ইক্সিয়নকে মায়াগ্রস্ত করার জন্য জিউস তাঁর স্ত্রীর চেহারার এক মেঘের মূর্তি তৈরি করেন। অন্যদিকে বাস্তব জগতের সৃষ্টিশীল শৈল্পিক রূপান্তর ঐ মেঘের ছায়ামূর্তি। অতান্ত বাস্তব দিনক্ষণ, রাস্তার নাম, মূর্তির নাম থেকে অবাস্তবে পৌছে গেছে কবির যাত্রা — সহজে, অনায়াসে। আবার কবির ঐ সময়কার কবিতা ‘জানলা’ (Les Fenêtres) যেমন শিল্পী দলোনে–র (Delaunay) ছবির সঙ্গে সম্পর্কেত তেমনি বর্তমান কবিতার সমান্তরালে রয়েছে পিকাসো–র (Picasso) ছবি — বিশেষ করে ১৯০৪ সালে আঁকা ‘বল নিয়ে বাজিকর’ (আক্রোবাৎ আ লা বুল/Acrobate à la boule) ছবিটি। আপলিনের কিউবিস্ট চিত্রকরদের সম্পর্কে তাঁর আলোচনায় পিকাসো–র ছবির প্রসঙ্গে যেসব কাব্যিক বর্ণনাত্মক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় কবিতাটির মধ্যে।
১৪ই জুলাই : ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাতে ১৪ই জুলাই বিদ্রাহী জনতা রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারের প্রতীক বাস্তিই (Bastille) দুর্গ অধিকার করে। এই দিনটি তাই ফরাসি সাধারণতন্ত্রে ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে পরিগণিত ও পালিত হয়।
স্যাঁ–জের্ম্যাঁ–দে–প্রে (Saint-Germain-des-Prés) : প্যারিস শহরের সেন নদীর বাম তীরবর্তী অংশে ৬ষ্ঠ শতকে প্রতিষ্ঠিত একটি মঠ যার মধ্যে যুক্ত হয়েছিল দশম–একাদশ শতকে নির্মিত একটি গির্জে। ধর্মবিরোধী বিপ্লবীদের হাতে মঠটি ধ্বংস হলেও গির্জেটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রক্ষা পায়। উনিশ শতকে গির্জেটির সংস্কার করা হয়। বর্তমান স্যাঁ–জের্ম্যাঁ–দে–প্রে বললে বুলভার স্যাঁ–জের্ম্যাঁ–র ওপর এ গির্জেটিকেই বোঝায়। ১৯১২ সালের অক্টাবর মাসে আপলিনের ২০২, বুলভার স্যাঁ–জের্ম্যাতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। ১৯১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এখানেই তিনি থাকতেন। তাঁর এই বাসাটি ছিল স্যাঁ–জের্ম্যাঁ–দে–প্রে গির্জের কাছেই।
দঁতোঁ (জর্জ–জাক দঁতোঁ/ Georges-Jacques Danton, ১৭৫৯–১৭৯৪): ফরাসি বিপ্লবের এই নেতার মূর্তি রয়েছে স্যাঁ–জার্ম্যাঁ–দে–প্রে গির্জে থেকে বুলভার স্যাঁ–জের্ম্যাঁ ধরে বুলভার স্যাঁ–মিশেলের দিকে এগিয়ে গেলে একটু পরেই ডানদিকে, মেট্রো স্টেশন ‘ওদেঁও’–র (Odéon) প্রবেশ পথে।
প্রথম দশ পঙক্তির বাস্তব পরিবেশের পটভূমিতে কবি পিকাসো–র ছবির জগতের সহধর্মী এক জগৎ রচনা করতে শুরু করেন, যেখানে বাস্তব ধীরে রূপান্তরিত হয়। তখন বাস্তব বর্ণনার অংশও অন্য এক অর্থ লাভ করে ; ১৪ই জুলাইয়ের আগের দিন — বিপ্লবের আগের মুহূর্ত, দঁতো–র মূর্তি — বিপ্লবের প্রতীক, — কালের সাক্ষী স্যাঁ–জের্ম্যাঁ–দে–প্রে–র গির্জে — এসব অনুষঙ্গের মধ্যে যেন কবিতা তথা শিল্পের বিপ্লব ঘোষিত হচ্ছে। তখন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখা বুড়ো মাদারি এক ঐতিহ্যানুসারী কবি হয়ে গিয়ে ব্যারেল–অর্গানের যান্ত্রিক সঙ্গীত শোনায় আর তার অর্গানের তলা দিয়ে বেরিয়ে আসে নতুন করিতার স্রষ্টা — সমস্ত মানবিক ব্যাপার যে পেরিয়ে যায় — বাস্তব থেকে অনায়াসে, অকৃত্রিমভাবে অবাস্তবে, অলৌকিকে পৌছে যায়।
প্রসঙ্গত স্মরণীয়, রিল্কে–র (Rilke) ‘ডুইনো এলিজি’–র (Duino Elegy) পঞ্চম এলিজি–র অবলম্বনও প্যারিসের রাস্তার মাদারি। ১৯২২ সালে এই কবিতা লেখার আগে রিল্কে আপলিনের–এর কবিতাটি পড়েছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। মনে হয়, আপলিনের–এর কবিতাটির মতোই রিল্কে–র কবিতারও প্রাথমিক সূত্র ছিল তাঁর প্যারিসের জীবন ও পিকাসো–র ছবি।
হৃদয় রাজমুকুট আর আয়না (Cœur couronne et miroir)
এই চিত্র–কবিতাটি আরো দুটি চিত্র–কবিতার সঙ্গে ১৯১৪ সালের জুলাই–অগাস্ট মাসের ‘লে সোয়ারে দ পারি’ (Les soirées de Paris) পত্রিকার যুগ্ম ২৬/২৭ সংথ্যায় প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালের ‘লে সোয়ারে দ পারি’ (Les soirées de Paris) পত্রিকার ২৪ সংখ্যায় (জুন) ‘সমুদ্র–পত্র’ (Lettre-Océan) নামে আপলিনের–এর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি মেক্সিকোতে পাড়ি দেওয়া কবির ছোট ভাই আলবেরকে (Albert) উদ্দেশ করে লেখা। কবিতাটির শব্দগুলি প্রথমে কয়েকটি পঙক্তির আকারে থাকলেও তার পরেই জ্যামিত্যিক বিন্যাসে চারদিকে ছড়ানো আর একটা বিশেষ আকারে সাজানো — যেন শব্দ দিয়ে একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য ছবি তৈরি করা হয়েছে। এ কি কবিতা ? আপলিনের এর নাম দিলেন ‘ইদেওগ্রাম লিরিক’ (Idéogramme lyrique)। চারদিকে আলোড়ন উঠল। ‘লে সোয়ারে দ পারি’ পত্রিকার পরের সংখ্যায় গাব্রিয়েল আর্বুয়্যাঁ (Gabriel Arbouin) আপলিনের–এর প্রয়াসকে সমর্থন করে এক প্রবন্ধ লিখলেন। পত্রিকার ২৬/২৭ যুগ্ন সংখ্যায় আপলিনের–এর আরো তিনটি চিত্র–কবিতা প্রকাশিত হল। ঘোষণা করা হল, আপলিনের–এর এই চিত্র–কবিতাগুলি বর্ণময় মুদ্রণে একটি এক ফর্মার পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হবে। তার যে ডামি তৈরি করা হয় তাতে আপলিনের নিজের নামের নিচে লিখেছিলেন ‘আর আমিও চিত্রকর’ (এ মোয়া ওসি জ স্যুই প্যাঁৎর্ /Et moi aussi je suis peintre) ৷ ঠিক ছিল কবির একটা ছবির নিচে তাঁর নামের তলায় ব্যক্যটি ছাপা হবে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এই পরিকল্পনা আর বাস্তবে রূপায়িত হতে পারল না। পরে আপলিনের এ জাতীয় চিত্র–কবিতাকে ‘ইদেওগ্রাম’–এর পরিবর্তে ‘কালিগ্রাম’ (Caligramme) নামে অভিহিত করলেন। Idéogramme শব্দের ব্যুত্পত্তিগত অর্থ ‘দৃশ্য–লিপি’। ভাষাতাত্ত্বিক অর্থে idéogramme বলতে বোঝায় সেই লিপি যাতে ধারণাকে ন্যূনতম রেখাচিত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, এই লিপিতে ন্যূনতম রেখাচিত্র ধ্বনিমূল (ফোনিম) বা ধ্বনির পরিবর্তে শব্দমূল (মর্ফিম) বা শব্দকে সংকেতিত করে। চিনা ভাষার লিপির মৌলিক রূপ এই চিত্রিলিপি। আর আপলিনের calligramme শব্দটি উদ্ভাবন করেনcalligraphie (ই. Calligraphy) শব্দ থেকে। শব্দটির মূল হল গ্রিক শব্দ ‘কালিগ্রাফিয়া’। গ্রিক ‘কালোস’ শব্দের অর্থ: সুন্দর, সু, ভালো, আর ‘গ্রাফিয়া’ মানে হল: লিখন, অক্ষর, হস্তক্ষর। এভাবে ‘কালিগ্রাফি’ বা ‘কালিগ্রাম’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় সুলিখন বা সুন্দর হস্তাক্ষর। আপলিনের calligramme শব্দটির যে অর্থ দিলেন তা হল: চিত্র–লিখন। তাঁর চিত্র–কবিতাগুলি ‘কালিগ্রাম’ (Calligrammes) কাব্যগ্রন্থে স্থান পেল। এই চিত্র–কবিতা কবির কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা কাব্যগ্রন্থটির নাম থেকে বোঝা যায়। ‘কালিগ্রাম’ বইয়ের প্রথম অংশ ‘ঢেউ’–এ (Ondes) আপলিনের–এর যুদ্ধের আগে লেখা পাঁচটি চিত্র–কবিতা স্থান পেয়েছে। এখানে ‘ঢেউ’ অংশের ‘হৃদয় রাজমুকুট আর আয়না’ (Cœur couronne et miroir) চিত্র–কবিতাটির অনুবাদ আমরা উপস্থাপিত করছি।
শিল্পের জগতে নতুন নতুন প্রবণতার সমর্থক ও ব্যাখ্যাতা আপলিনের কবিতার প্রকাশ–প্রকরণের ক্ষেত্রে নতুনতর পথের সন্ধানে, শব্দ দিয়ে চিত্রকল্প তৈরির প্রথা পার হয়ে শব্দকে চিত্র–বিন্যাসে সাজিয়ে কবিতায় দৃস্টিগ্রাহ্যতার এক নতুন মাত্রা যোগ করতে চেয়েছিলেন। ‘চিত্রকর’ আপলিনের–এর এই কালিগ্রাম নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক মাথা ঘামানো হয়েছে। প্রথমে কালিগ্রামকে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা যায়। প্রাচীন গ্রিক, লাতিন, মধ্য যুগ ও তার পরবর্তীকালের ইয়োরোপীয় সাহিত্যে কাব্যিক বাচনের চিত্ররূপায়িত উপস্থাপনার নিদর্শন রয়েছে। ল্যাটিনে একে বলা হত carmina figurataফরাসিতে একে বলা হত ‘মুদ্গর পদ্য’ (ভের রোপালিক/ Vers rhopaliques) বা vers figurésঅর্থাৎ আকৃতিপ্রাপ্ত পদ্য। আমরা তার কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করছি :
পরশুর (মাথার) আকারের প্রাচীন গ্রিক চিত্রকবিতা ।
মন্দিরের বেদীর আকারের প্রাচীন ল্যটিন চিত্রকবিতা ।
O Bouteille
Pleine toute
De mistères
D’une aureille
Je t’escoute :
Ne diffères,
Et le mot profères
Auquel pend mon cœur.
En la tant divine liqueur,
Baccus, qui fut d’Inde vainqueur
T i e n t t o u te v é r i t é e n c l o s e.
Vin tant divin, loin de toy est forclose
T o u t e m e n s o n g e et t o u t e t r o m p e r i e.
En joye soit l’aire de Noach close,
Lequel de toy nous fist la tempérie
Sonne le beau mot, je t’en prie,
Qui me doibt oster de misères.
Ainsi ne se perde une goutte.
De toy, soit blanche, ou soit vermeille.
O Bouteille
Pleine toute
De mistères,
D’une aureille
Je t’escoute :
Ne diffères.
ফ্রঁসোয়া রাবলে–র (François Rabelais, ১৪৮৩–১৫৫৩) রচনায় মদের বোতলের আকারে এই চিত্র–কবিতাটি রয়েছে।
Nous ne pouvons rien trouver sur la terre
Qui soit si bon, ni si beau que le verre.
Du tendre amour, berceau charmant,
C’est toi, champêtre fougère,
C’est toi qui sers à faire
L’heureux instrument
Où souvent pétille
Mousse et brille
Le jus qui rend
Gai, riant,
Content
Quelle Douceur
Il porte au cœur !
Tôt
Tôt
Tôt
Qu’on m’en donne !
Qu’on l’entonne !
Tôt
Tôt
Tôt
Qu’on m’en donne
Vite et comme il faut.
L’on y voit sur ses flots chéris
Nager l’allégresse et les ris.
অষ্টাদশ শতকের শার্ল ফ্রঁসোয়া পানার–এর (Charles François Panard, ১৬৯৪–১৭৬৫) পানপাত্রের আকারে বিন্যস্ত একটি চিত্রকবিতা।
লুইস ক্যারল– এর (Lewis Carroll, ১৮৩২–১৮৯৮) ‘আশ্চর্যের দেশে অ্যালিস–এর অভিজ্ঞতা’ (Alice’s Adventures in Wonderland, ১৮৬৫) বইয়ের একটি চিত্রকবিতা
ভারতীয় ঐতিহ্যে, সংস্কৃত কাব্যালংকার–বিধি অনুসারে কবিতার শব্দসমবায়ের বর্ণগুলির পদ্ম, খড়্গ , চক্র, গোমূত্রিকা প্রভৃতি আকারে বিন্যাসকে চিত্রালংকার বলে। (পদ্মাদ্যাকারহেতুত্বে ব্ণানাং চিত্রমুচ্যতে। — সাহিত্যদর্পণঃ। দশমঃ পরিচ্ছদঃ।)। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ তাঁর সম্পাদিত ‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থের টীকায় চিত্রালংকোরের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আমরা এখানে তার থেকে দুটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করেছি:
লালমোহন বিদ্যানিধি তাঁর ‘কাব্যনির্ণয়’ (প্রথম সংস্করণ, ১৮৬২) গ্রন্থে শব্দালংকার বিভাগে চিত্রালংকারের যে সংজ্ঞার্থ দিয়েছিলেন তা হল: ‘শব্দ দ্বারা কোনরূপ চিত্র অঙ্কিত করার নাম নাম চিত্রালংকার’। চিত্রালংকারের দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি একটি পদ্মবন্ধ উপস্তাপিত করেছেন :
হায়!
হায়!
বসন্ত ফুরায়!
মুগ্ধ মধু মাধবের গান।
ফল্গু সম লুপ্ত আজি মুহ্যমান প্রাণ।
অশোক নির্মাল্য–শেষ, চম্পা আজি পাণ্ডু হাসি হাসে,
ক্লান্ত কণ্ঠে কোকিলের যেন মুহুর্মুহু কুহুধ্বনি নিবে নিবে আসে!
দিবসের হৈমজ্বালা দীপ্ত দিকে দিকে, উজ্জ্বল–জাজ্জ্বল–অনিমিখ্ ,
নিঃশ্বসিছে নিঃস্ব হাওয়া, হুতাশে মূর্ছিত দশদিক্!
রৌদ্র আজ রুদ্র ছবি আকাশ পিঙ্গল,
ফুকারিছে চাতক বিহ্বল —
খিন্ন পিপাসায়;
হায়!
বসন্ত ফুরায়!
মুগ্ধ মধু মাধবের গান।
ফল্গু সম লুপ্ত আজি মুহ্যমান প্রাণ।
অশোক নির্মাল্য–শেষ, চম্পা আজি পাণ্ডু হাসি হাসে,
ক্লান্ত কণ্ঠে কোকিলের যেন মুহুর্মুহু কুহুধ্বনি নিবে নিবে আসে!
দিবসের হৈমজ্বালা দীপ্ত দিকে দিকে, উজ্জ্বল–জাজ্জ্বল–অনিমিখ্,
নিঃশ্বসিছে নিঃস্ব হাওয়া, হুতাশে মূর্ছিত দশদিক্!
রৌদ্র আজ রুদ্র ছবি আকাশ পিঙ্গল,
ফুকারিছে চাতক বিহ্বল —
খিন্ন পিপাসায়;
হায়!
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কুহু ও কেকা (১৯১২) কাব্যগ্রন্থের গ্রীষ্মের সুর কবিতার প্রথম স্তবক। এই কবিতাটির স্তবক–সংগঠনে এক ধরনের দৃষ্টিগ্রাহ্যতা তৈরির প্রয়াস রয়েছে।
উনিশ শতক থেকে আধুনিক কবিতার মুদ্রণ–বিন্যাস সম্পর্কে অনেকদিন ধরে চিন্তা করা হচ্ছল; মালার্মে (Mallarmé) তাঁর ‘পাশার চাল…’ (Un coup de dés...) কবিতার মুদ্রণ–বিন্যাসে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপকে ব্যঞ্জনাময় করে তুলতে চেয়েছিলেন। আবার আপলিনের অল্পবয়স থেকে (প্রধানত চিনা) লিখনরীতির চিত্রধর্মিতা সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের ইতালীয় ভবিয্যদবাদী বা ফিউচারিস্টদের কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তাঁরা তাঁদের ঘোষিত ‘মুক্ত শব্দের’ (Parole in liberta) মধ্যে একদিকে যেমন অন্বয় থেকে শব্দকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনি শব্দের মুদ্রিত বিন্যাসকে প্রথামুক্ত করেতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। বিশেষ করে ইতালীয় ফিউচারিস্ট কবি ফ্রান্চেসকো কানজ্যুল্লো (Francesco Cangiullo) ১৯১৩ সালে বেশ কিছু চিত্র–কবিতা সমন্বিত এক দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কবিতাটি যদিও ১৯১৬ সালে মুদ্রিত হয় তবু তা ১৯১৩ থেকে ইতালি আর প্যারিসের বিভিন্ন ভবিয্যদবাদী কবিতাসন্ধ্যায় প্রদর্শিত ও পঠিত হয়ে আলোড়ন তুলেছিল। এছাড়া আপলিনের–এর ‘সমুদ্র–পত্র’ প্রকাশিত হওয়ার সাড়ে পাঁচ মাস আগে ১৯১৪ সালের ১লা জানুয়ারি ‘লাচের্বা’ (Lacerba) পত্রিকায় কানজুল্লোর Fumatori II নামক একটি (প্রায়) চিত্র–কবিতা প্রকাশিত হয়। মারিনেত্তি (Marinetti) এই জাতীয় কবিতার নামকরণ করেন ‘মুক্তশব্দচ্ছবি’ (Tavole parolibere) ৷ এর পর মারিনেত্তি ও অন্যান্য ইতালীয় ভবিষ্যদবাদীরা ‘লাচের্বা’ পত্রিকায় মুদ্রণ–বিন্যাসের বৈচিত্র্যময় ‘মুক্ত শব্দ’ প্রকাশ করতে থাকেন।
ভবিষ্যদবাদী পাপিনি (Papini) ১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভবিষ্যদবাদীদের মুখপত্র এই ‘লাচের্বা’ (Lacerba) পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকা প্রকাশে তাঁর সহযোগী ছিলেন সোফিচি (Soffici) ৷ সোফিচি ১৯০৩ থেকে ১৯০৭ সাল অব্দি প্যারিসে ছিলেন এবং পিকাসো, আপলিনের ও মাক্ম জাকব–এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। স্বভাবতই মনে হয়, প্রথম সংখ্যা থেকেই ‘লাচের্বা’ আপলিনের সহ ফরাসি তরুণ শিল্পী–সাহিত্যিকদের হাতে আসে। তাছাড়া ‘লাচের্বা’ যখন প্রকাশিত হয় তখন ভবিষ্যদবাদী শিল্পী বোচ্চোনি (Boccioni) তাঁর ভাস্কর্যের প্রদর্শনীর আয়োজন করার জন্য প্যারিসে ছিলেন। তাঁর সঙ্গেও ফরাসি শিল্পী ও লেখকদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তিনি নিশ্চয় ভবিষ্যদবাদীদের মুখপত্র ‘লাচের্বা’ সবাইকে সবাইকে দেখিয়েছিলেন। পরে ‘লাচের্বা’ পত্রিকায় আপলিনের লিখেও ছিলেন।
এছাড়া ১৯১৩ সালে আপলিনের ‘ভবিষ্যদবাদী ঐতিহ্য–বিরোধিতা’ (L’Antitradition futuriste) নামে একটি ভবিষ্যদবাদী ইস্তাহার রচনা করেন। এই ইস্তাহার মিলান থেকে মারিনেত্তি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এই ইস্তাহারে আপলিনের ‘মুক্তি পাওয়া শব্দ’–এর (Mots en liberté) কথা ঘোষণা করেন, ঘোষণা করেন অনেক কিছুর সঙ্গে ‘টাইপোগ্রাফি বা হরফ বিন্যাসের সঙ্গতির বিলোপ’–এর (Supression de l’harmonie typographique) কথা। ‘কালিগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় এই ভবিষ্যদবাদী প্রবণতার স্বাক্ষর দেখা যায়। এসব সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে অনুমান করা যায় ভবিষ্যদবাদী ‘মুক্তি পাওয়া শব্দ’–এর ভাবনা এবং কানজ্যুল্লো–র চিত্র–কবিতা আপলিনের–কে ‘কালিগ্রাম’ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। তাছাড়া পিয়ের আলবের–বিরো–র (Pierre Albert-Birot) সম্পাদিত SIC পত্রিকায় ‘বৃষ্টি পড়ে’ কবিতাটি ছাপা হয়। এই পত্রিকাটি ছিল ইতালীয় ও ফরাসি ভবিষ্যদবাদীদের মিলনক্ষেত্র।
সঙ্গে সঙ্গে একথা মনে রাখা দরকার, আপলিনের–এর ভবিষ্যদবাদী ইস্তাহারের শিরোনামের তলায় যে কথাটি লেখা ছিল তা হল ‘ইস্তাহার = সমন্বয়’। (Manifeste = Synthèse)। তাই ভবিষ্যদবাদীদের বিধ্বংসী উগ্রপন্থা তাঁর কবিতায় অনুপস্থিত। তাঁর কবিতায় যা রয়েছে তা হল বিবর্তিত আধুনিকতার সমন্বয়। আপলিনের–এর চিত্র–কবিতার কাব্যগুণ এই সমন্বয়ের নিদর্শন।
অনেক সমালোচক আপলিনের–এর ‘কালিগ্রাম’–কে বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেন নি। তাঁদের বিচারে এই চিত্র–কবিতাগুলি একধরনের তাত্ক্ষণিক খেয়ালি কল্পনার ফসল, কবিতা হিসেবে সে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘কালিগ্রাম’ গ্রন্থ প্রকাশের পর কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম অঁদ্রে বিলি (André Billy) এই গ্রন্থের একটি সমালোচনা লেখেন। বিলি চিত্র–কবিতার উদ্ভাবনকে সমর্থন করতে পারেন নি। সমালোচনা পড়ে আপলিনের বিলিকে একটি চিঠি লেখেন, ‘কালিগ্রাম’ সম্পর্কে তিনি জানান :
কালিগ্রাম–এর কথায় বলতে হয় এগুলো হল মুক্তছন্দ–নির্ভর কবিতার আদর্শ রূপায়ণ, আর চলচ্চিত্র আর গ্রামোফোনের মতো উপস্থাপনার নতুন মাধ্যমের আবির্ভাবের ঊষায়, মুদ্রণলিপির উজ্জ্বল জীবনসায়াহ্নে এই কবিতাগুলি মুদ্রণের এক ধরনের সূক্ষ্ম ব্যবহার।
এ চিঠিতে আপলিনের তাঁর চিত্র–কবিতাকে উদ্ভাবন বা সৃষ্টি বলেন নি, বলেছেন ‘সন্ধান’ (recherches) । আমাদের কাছে আপলিনের–এর এই সন্ধানী মানসিকতাই সবচেয়ে গুরুত্বপর্ণ বলে মনে হয়েছে। অন্যদিকে কালিগ্রামের সন্ধান আমাদের কাছে একাধিক কারণে তাত্পর্যময় বলে বোধ হয়েছে। প্রথমত, এ কবিতা প্রথাগত উপস্থাপনাকে ভেঙে কবিতা–পাঠকের অভ্যস্ত চিন্তাহীন পঠনরীতিকে আঘাত করে, তাঁকে চিন্তিত আর সচেতন করে তোলে। দ্বিতীয়ত, এ জাতীয় মুদ্রণ–বিন্যাস কবিতায় শ্রুতিগ্রাহ্যতার সঙ্গে অন্য একটি মাত্রা যোগ করে (অন্ততপক্ষে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়) আর তা হল দৃষ্টিগ্রাহ্যতা। এছাড়া লিখন বা মুদ্রণের এতাবৎ প্রচলিত দু দিকের সাদা সীমানায় আবদ্ধ অনুভূমিক শৃঙ্খলিত পঠনরীতিকে ভেঙে পঠনের অন্যতর সম্ভাবনাকে আবিষ্কার ও ব্যবহার করা মুদ্রিত সাহিত্যের লিখনের/পঠনের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে আমাদের মনে হয় — কেননা তা রচনার বাগর্থের সীমানাকে প্রসারিত করতে পারে। আপলিনের–পরবর্তী বিশ শতকের সৃষ্টিশীল গদ্য আর কবিতায় মুদ্রণ–বিন্যাসের সম্ভাবনার ব্যবহার আপলিনের–এর প্রয়াসের গুরুত্ব এবং সার্থকতার নির্দেশক।
বৃষ্টি পড়ে ( Il pleut)
‘বৃষ্টি পড়ে’ চিত্রকবিতাটি ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু কবিতাটি অনেক আগের লেখা। ১৯১৪ সালের ২৯–এ জুলাই সের্জ ফেরাকে ( Serge Férat) লেখা একটি চিঠিতে আপলিনের লিখেছিলেন, তার আগের দিন বৃষ্টি পড়ছিল আর তিনি শোন বৃষ্টিপড়ছে কিনা নামে একটা কবিতা লিখেছেন, চিঠিতে রেখার সাহায্যে তিনি কবিতাটির একটা ছক এঁকে দিয়েছিলেন।
‘বৃষ্টি পড়ে’ কবিতাটিতে বৃষ্টির ধারার অনুকরণে সাজানো। পঙক্তিগুলির দৃষ্টিগ্রাহ্য আর ব্যঞ্জনাময় বিন্যাস–সৌন্দর্য বাদ দিলেও কবিতাটির মুদ্রণ্য–বিন্যাস অন্য একটি কারণেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, ফরাসি (ইয়োরোপীয় ইন্দো– ইয়োরোপীয় বেশির ভাগ) ভাষার লিখন–মুদ্রণ হচ্ছে অনুভূমিক , তার গতি বাম থেকে দক্ষিণ অভিমুখী। বর্তমান কবিতায় চিরাচরিত ঐ রীতি সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, এখানে পঙক্তিগুলির গতি বৃষ্টিধারার অনুকরণে নিম্নাভিমুখী, কিছুটা তির্যক, উল্লম্বক। আপাতদৃষ্টিতে তা চিনে বা জাপানি লিখনরীতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিজয় (La Victoire)
এ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ‘নর–স্যুদ’ (Nord-Sud) পত্রিকায়। কবিতাটির যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় তাতে রচনাকাল রয়েছে ১১ আর ১২ই মার্চ, ১৯১৭। ‘কালিগ্রাম’ বইয়ের ষষ্ঠ অংশে কবিতাটি স্থান পেয়েছে। এ বইয়ের শেষ কবিতা ‘লালচুল সু্ন্দরী’ (La jolie Rousse) ৷
রচনাকালের দিক থেকে ‘সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থের প্রথমে উপস্থাপিত কিন্তু কালানুক্রমিকভাবে শেষ কবিতা ‘এলাকা’–র সময় থেকে আপলিনের উত্কণ্ঠ সচেতনতা নিয়ে আধুনিক পৃথিবীতে কবিতার স্থান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেছেন, — ‘আধুনিক’ পৃথিবীর উপযুক্ত ‘আধুনিক’ কবিতার নতুন ভাষা, নতুন প্রকাশ–প্রকরণ সন্ধান করেছেন। যুদ্ধের উত্তেজনার তীব্র অভিজ্ঞতার মধ্যেও আপলিনের–এর উপলব্ধির জগৎ অধিকার করে ছিল কাব্যচিন্তা ; তাই ‘কালিগ্রাম’ গ্রন্থের কবিতায় যে বিষয় ফিরে ফিরে এসেছে তা হল কবিতা, কাব্যসৃষ্টি, কবিতার লক্ষ্য, কবিতার ভাষা — এক কথায় কাব্যতত্ত্ব। আর কাব্যগ্রন্থের শেষে এই উপলব্ধির চূড়ান্ত, বিস্ফোরিত, স্বতোত্সার প্রকাশ ঘটেছে ‘বিজয়’ কবিতাটিতে । এর পাশাপাশি এই বইয়ের পুনরাবৃত্ত আরেক উপলব্ধি হল প্রেম। অবশেষে কবি প্রেমের শান্তস্নিগ্ধ পরিণতি থুঁজে পেলেন ‘লালচুল’ এক সুন্দরীর মধ্যে — সে হয়ে উঠল তাঁর জীবনের আশ্রয় । আর এই পরিণতির গভীর উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘লালচুল সুন্দরী’ কবিতায়। সে দিক থেকে ‘কালিগ্রাম’ গ্রন্থের দুই স্রোতের পরিণাম যেন তার শেষ দুটি কবিতা।
‘বিজয়’ কবিতাটি পড়ে আজকের পাঠকের মনে হতে পারে, এ যেন কবিতার ভাষার মুক্তি সম্পর্কে এক অনন্য ঘোষণা ; স্মরণ হতে পারে, ফিউচারিস্টদের সঙ্গে আপলিনের–এর সম্পর্কের ইতিহাস তথা ধ্বন্যাত্মক মুক্ত শব্দের প্রতি ফিউচারিস্টদের আগ্রহের কথা ; মনে পড়তে পারে, কবিতার ভাষা নিয়ে দাদাবদীদের ধ্বংসাত্মক প্রয়াস আর দাদাবাদীদের সঙ্গে আপলিনের–এর যোগাযোগের প্রসঙ্গ, এমন কি পরবর্তী স্যুররিয়ালিস্টদের কাব্যভাবনার কথাও মাথায় আসতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর সমকালীন আর পরবর্তী কাব্যচিন্তার অনেক বীজই আপলিনের–এর উপলব্ধি ও কাব্যকৃতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, আপলিনের–এর ‘নিহত কবি’–র (পোত্রৎ আসাসিনে/Poète assassiné : যুদ্ধের আগে রচিত ও ১৯১৬ সালে প্রকাশিত) উক্তি: ‘সমস্ত বাঁধন থেকে, এমন কি ভাষার বাঁধন থেকেও মুক্ত এক কবিতা আমি লিখব’ । বস্তুত ‘এলাকা’ কবিতার পরবর্তী কাব্যসৃষ্টিতে আপলিনের–এর ‘মুক্ত কবিতা’র সন্ধান অব্যাহত। এই ‘মুক্ত কবিতা’র জন্য — যন্ত্র আর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের এই নতুন যুগের কবিতার জন্য প্রয়োজন নতুন ভাষার সন্ধান।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে আপলিনের–এর ব্যক্তিগত গ্রন্থসংগ্রহে ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন বইয়ের প্রাচুর্য থেকে অনুমান করা যায়, কবি কবিতার ভাষার সূত্রেই ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে কৌতূহলী ছিলেন।
ভাষা (লঁগ্ /langue) বচন (পারোল/parole) : আপলিনের–এর এই কবিতায় ‘ভাষা’ ও ‘বচন’–এর উল্লেখে আজকের ভাষাবিজ্ঞান–মনস্ক আধুনিক পাঠক চমকে উঠে ভাবতে পারেন, আপলিনের হয়ত ভাষাবিজ্ঞানের জগতে ফের্দিনঁ দ সোস্যুর–এর (Ferdinand de Saussure, ১৮৫৭–১৯১৩) যুগান্তকারী চিন্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু মনোযোগ দিলে বোঝা যায় যে, আপলিনের সাধারণ অর্থে শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন — তার সঙ্গে সোস্যুরীয় চিন্তার কোন সম্পর্কে নেই।
লের্ন–এর হায়ড্রা : হায়ড্রা (ই. Hydra, ফ. ইদ্র্ /Hydre) বলতে জলের সাপকে বোঝায়। লের্ন–এর হায়ড্রা গ্রিক পুরাণ–অনুসারে লের্ন–এর জলাভূমিতে বসবাসকারী এক ভয়ষ্কর বহুমুণ্ডধারী সর্পাকৃতি দানব। তার নিঃশ্বাস ছিল কালান্তক। য়োরিস্থিউস কর্তৃক প্রেরিত হয়ে হেরাক্লেস শেষে তার ভাগনের সাহায্য নিয়ে এই দানবকে হত্যা করেন।