আমার ভাট বকা
পুষ্কর দাশগুপ্ত
১. হায় রে বং কবি রবীন্দ্রনাথ!
কলকাতা এখান থেকে প্রায় চার হাজার মাইল দূরে। ওই কলির শহর কলকাতায় তখন বাত্সরিক বই মেলা চলছে (২০১৫ সাধারণ অব্দ)। এর মধ্যে এক দিন একটা বৈদ্যুতিন চিঠি পেলাম:
Dear Sir/Madam,
You will be glad to know that Visva-Bharati Granthana Vibhaga is going to organize a symposium on ‘Rabindra Sristite Nari’ in collaboration with Publishers and Book Sellers Guild at SBI auditorium in Kolkata Book Fair on 30 January 2015 at 3.15 p.m. We shall be obliged if you kindly attend the programme.
With kind regards
Yours sincerely,
Dr Ramkumar Mukhopadhyay
Director
বিশ্বভারতী ‘গ্রন্থন বিভাগ’ আয়োজিত আলোচনা–সভায় উপস্থিতির আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন বিশ্বভারতীর উক্ত বিভাগের পরিচালক ডক্টর রামকুমার মুখোপাধ্যায়। আলোচনার বিষয় ‘রবীন্দ্রসৃষ্টিতে নারী’। বাংলা ভাযার একজন লেখকের রচনার একটা দিক নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা, তাতে একজন বাঙালিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন বাংলা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিদগ্ধ (ডক্টর) বাঙালি অধিকর্তা । অথচ চিঠিটা ইংরেজিতে (যা ঔপনিবেশিক যুগের আমলাতান্ত্রিক চিঠির আদলকে স্মরণ করিয়ে দেয়)। তার ওপর sir/madam-এর কোনোটাই কাটা না থাকার আমলাতান্ত্রিক উত্তরাদিকারের চিহ্নে আরো অবাক হলাম। মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ধরে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহারের অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তার কথা পুনরবৃত্তি করেছেন :
আমরাই বারংবার বলিতেছি, এ দেশে ধান জন্মে আর বিলাতে জন্মায় ওক। এখানকার দেশী ভাষা বাংলা, ইংরেজি নহে। যদি কর্ষণ করিয়া সম্যক্ ফললাভ করিবার ইচ্ছা হয় তবে বাংলায় করিতে হইবে, নতুবা ঠিক ‘কালচার’ হইবে না। (১৮৯৩)
বিদ্যাবিস্তারের কথাটা যখন ঠিকমতো মন দিয়া দেখি তখন তার সর্বপ্রধান বাধাটা এই দেখিতে পাই যে , তার বাহনটা ইংরেজি । বিদেশী মাল জাহাজে করিয়া শহরের ঘাট পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছিতে পারে কিন্তু সেই জাহাজটাতে করিয়াই দেশের হাটে হাটে আমদানি রপ্তানি করাইবার দুরাশা মিথ্যা । (১৯১৫)
জীবনের শেষ পর্যায়েও ১৯৩৭ সালে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ শরীরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম বাংলাভাষায় সমাবর্তন অভিভাষণ দেন। তাঁর মনে হয় তাঁর দীর্ঘকালের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে।
ভাষণের শুরুতে তিনি বলেন:
আজ বাংলাদেশের প্রথমতম বিশ্ববিদ্যালয় আপন ছাত্রদের মাঙ্গল্য–বিধানের শুভকর্মে বাংলার বাণীকে বিদ্যমন্দিরের উচ্চ বেদীতে বরণ করেছেন। বহুদিনের শূন্য আসনের অকল্যাণ আজ দূর হল।
তাই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোনো একটি বিভাগ থেকে ইংরেজিতে চিঠিটা পেয়ে ভাবলাম, বেচারা রবীন্দ্রনাথ ! তিনি তো স্কুল কলেজে গিয়ে ডিগ্রিমাল্যে শোভিত ‘শিক্ষিত ’ বাঙালি/ভারতীয় ঔপনিবেশিত প্রজাতির হোমো কোলোনিকুস (Homo colonicus) হতে পারেন নি, বুঝতে পারেন নি যে বাংলাভাষা বাংলাভাষা বলে সারা জীবন তিনি যে হৈচৈ করেছেন তা ‘ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত ’ বাংলা দৈনিক পত্রিকা ইংরেজিখোর আনন্দবাজার–এর কেয়ামতে ‘বাংলাবাজি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। হায়রে বাংলাবাজ রবীন্দ্রনাথ ! সুকুমার সেন, নীহাররঞ্জন রায়, প্রমথনাথ বিশী, সুনন্দ সান্যাল, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি দৈত্যদানবের মতো (থুড়ি হারকিউলিসের মতো!) বিরাট বিরাট শিক্ষিত লোকদের পাশে, বিশেষভাবে অজ্ঞান তিমিরে অন্ধ জাতির চোখ খুলে দেওয়া জ্ঞান–কাজলের লাঠি ,আনন্দের হাট আনন্দবাজার পত্রিকার বিচারে অপোগণ্ড বং রবি ঠাকুর প্রাংশুলভ্যে ফলে লোভাদুদ্বাহুরিব বামনঃ ছাড়া কিছুই নন । জ্ঞান–বিজ্ঞানের চর্চা, তথ্যপ্রযুক্তি, সরকারি কাজকর্ম, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসা–বাণিজ্য, সবকিছুই এক এবং অদ্বিতীয় ইংরেজি ভাষায় হতে পারে, হওয়া উচিৎ, হওয়া সম্ভব, না হয়ে পারে না; বাংলা ভাষায় তা হওয়া সম্ভব নয়, উচিৎ নয়, হতে পারে না, হলে সমস্ত মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়ের সম্ভাব্য সাবধান–বাণী অনুসারে, বঙ্গভাষার ব্যবহার বাইবেলোক্ত এপোকালিপ্স্–এর ঘোষণা, খ্রিস্টবৈরির আবির্ভাবের সংকেত। অভুবনায়িত দেশজদের বুঝাইতে হইলে বলিতে হয়, কলির সায়াহ্নের সূচনা, প্রলয়পয়োধিজলের আগমনের সংকেত,সপ্তম মনু বৈবস্বতের শাসনকালের সমাপ্তিতে অরাজক মন্বন্তরের আবির্ভাব–বার্তা! জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ, রাজ দুর্লভ, মির জাফর–এর উত্তরাধিকারী বঙ্গসন্তানরা এই ঘটনা কোনোক্রমেই ঘটিতে দিবেনা: বঙ্গভাষার ব্যবহার নৈব নৈব চ!
২. সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র বলে কথা!
যারা সাদ্দাম হুসেন আর কাদাফিকে গণতন্ত্রের পূজায় বলি দিল আর সৌদি আরব আর কাতারকে গণতন্ত্রের (?) পরিপোষক হিসেবে পরম বন্ধুর মর্যাদা দিয়ে মাথায় তুলে নাচে সেই গণতন্ত্র–পূজারী সাদা চামড়ার গোরারা দেশের বড়বাবুদের পিঠ চাপড়ে বলে, ভারত হল নাকি সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। সায়েবে কইছে…ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই। দিশি বড়বাবুরা লেজ নাড়ায়। তবে পশ্চিমবঙ্গের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লোক ইংরেজি বা হিন্দি বলতে, লিখতে বা পড়তে পারে না। তাদের সব কিছু থেকে আলাদা করে, বাদ দিয়ে সবকিছুর বাইরে রাখা হয়েছে। নাগরিক হিসেবে তাদের একমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে মাঝেমধ্যে মাথামুণ্ড কিছুই না বুঝে, ভয়ে বা ভক্তিতে এক–আধটা কাগজ ভোটের বাক্সে গুঁজে দেওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুই নেই । তথ্য, আইন–কানুন, সরকারি বা ব্যবসা–বাণিজ্যের (ব্যংক, শুল্ক, হিসেব, ওষুধের নাম…) কাগজপত্র বোঝার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। চিরকাল এই হয়ে এসেছে, হচ্ছে, হবে !
তিন বছর আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম, এখানে ওখানে কথায় কথায় দুচারজনের কাছে বাঙালি আর বাংলাভাষার বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে তাঁদের মতামত জানতে চাইলাম। সুধীরবাবু পাড়ার গণ্যমান্য লোক, দুই ছেলে কম্প্যুটার ইঞ্জিনিয়ার, স্টেটস্–এ কাজ করে, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আরব দেশে কাজ করা ডাক্তারের সঙ্গে। উনি আমায় ধমক দিয়ে বললেন, ওসব বাংলা ফাংলা এযুগে চলেনা, বাংলা ভাষা হল ওই মাছওয়ালা, ডাবওয়ালা, ফেরিওয়ালা, বাড়ির ঠিকে ঝি ইত্যাদি ছোটলোকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। পাড়ার মাঝবয়সী আরও কয়েকজন ছিলেন। তাদের সবাই যে খুব বিদ্বান তা নয়, দারুণ ইংরেজি জানেন তাও নয়। তবে সবারই এক কথা , বাংলা ভাষায় কিছু হবে না, হতে পারে না। দু–একজনের মতে আমি যে একটা নির্বোধ (ওঁদের ভাষায় ইডিয়ট, মোরন…) তাতে কোনো সন্দহ নেই।
৩. অধমের ঘ্যানর ঘ্যানর
আমি বলতে চেষ্টা করলাম (বাঙালি বাবুরা অবশ্য একমাত্র সাদা চামড়া ছাড়া আর কারো মতামত কান পেতে শোনার প্রয়োজন বোধ করেন না) , ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা শেখার বিরোধী আমি নয়, তবে বিদেশি ভাষায় শিক্ষা, জ্ঞান–বিজ্ঞানের চর্চা, তথ্যপ্রযুক্তি, সরকারি কাজকর্ম, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসা–বাণিজ্য সব কিছু এভাবে চলতে থাকলে যা যা ঘটেছে, ঘটে , ঘটছে, ঘটবে বলে আমার মনে হয় তা হল:
ক. এই ব্যবস্থা যে–ধরনের বিরাট সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিভেদ আর বৈষম্য সৃষ্টি করে তার মধ্যে দেশের সর্বব্যাপ্ত বা সর্বাঙ্গীন উন্নতি অসম্ভব। এই ব্যবস্থায় দেশের বেশির ভাগ মানুষ পেছনে পড়ে আছে, পড়ে থাকে, পড়ে থাকবে। এর মাধ্যমে যে নতুন জাতিভেদ তৈরি হয় তা আমাদের দেশের পুরনো জাতিভেদের থেকেও জোরালো, মানবাধিকারের বিরোধী, ন্যায়নীতি লঙ্ঘন করে সমাজিক–অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার। এর বিপরীত দৃষ্টান্ত নেই। দেশের সামাজিক–সাংস্কৃতিক ইতিহাস–ভূগোলের সঙ্গে সম্পর্কহীন, শতকরা পঁচানব্বই জন দেশবাসীর অবোধ্য বিদেশি ভাষায় শিক্ষা, জ্ঞান–বিজ্ঞানের চর্চা, তথ্যপ্রযুক্তি, সরকারি কাজকর্ম, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসা–বাণিজ্য সব কিছু চলছে অথচ দেশ সব দিক থেকে অগ্রসর, এরকম দেশের দৃষ্টান্ত আছে কী? জানি ভ্যাটে সাত দিন ধরে পড়ে থাকা বর্জ্য আর পেচ্ছাবের গন্ধে আমোদিত, হাইরাইজ আর খুপড়ি, মলমূত্র আর শপিং মলের সহাবস্থানে অপরূপ, কাক, কুকুর, ভিখিরি আর মানুষের পঙ্গপালের জীবনযুদ্ধের রঙ্গভূমি, পৃথিবীর শেষ ‘দাদা’ (Dada) শহর কলকাতায় হেভি হেভি হিজ হাইনেস, হার হাইনেসরা ছোটলোকদের ভাষা বাংলা পড়তে পারেন না, তাই আমার মতো উদগান্ডু কী লিখেছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। তবু কেউ যদি আমার কথাবার্তা তাঁদের বুঝিয়ে বলতে যায় , তবে তাকে তারা ‘ষাঁড়ের গোবর’ বলে তৎক্ষণাৎ নগদ বিদায় করে দেবেন।
খ. যে ভাষায় জ্ঞান–বিজ্ঞানের চর্চা হয় না, যে ভাষা উচ্চশিক্ষার ভাষা নয়, যে ভাষা নতুন চিন্তা আর উদ্ভাবনের ভাষা নয়, যে ভাষা বিভিন্ন বিদ্যা আর মননের শব্দসম্ভারে, বাচনে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধি, বিস্তার আর গভীরতা লাভ করে না, সে ভাষার বদ্ধ জলায় সাহিত্য নামে যা জন্মায় তা অপুষ্ট আগাছার সঙ্গে তুলনীয়। আজকের বাংলা ভাষার সাহিত্যের অবস্থাও তাই। এ ভাষায় উৎপাদিত হচ্ছে একগাদা গল্প–কবিতা, যার বেশির ভাগ অপাঠ্য। বাংলা ভাষায় প্রকৃতি–বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মানব–বিজ্ঞান, এমন কী সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ রচনা বা বই দেখা যায় না, বাংলা বইয়ের প্রকাশনার ব্যবস্থাও খুবই নিম্নমানের । না, এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, এমনকী বাংলা ভাষার (গল্প–কবিতার) লেখকরাও নন। আর এই গল্প–কবিতার লেখকদের বেশির ভাগ নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে বই বার করে, বই বিক্রি হয় না, বিলি করা হয়। প্রকাশক যদি বই বার করেন তা ছাপা হয় বড় জোর তিনশ কপি। বই নিয়ে সমালোচনা বা সাহিত্যতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সাহিত্যের কাগজেও দেখা যায় না। খবর কাগজের বই নিয়ে আলোচনা আলোচিত বইয়ের তথাকথিত বিষয় (?), ছাপাবাঁধাই ইত্যাদি তথ্য থাকলেও তার বেশি কিছু পাওয়া যায় না।
ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজি পড়া বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম ছিল বাংলা ভাষায় আত্মপ্রকাশ। ভাষা–সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়া–ঔপনিবেশিকতার প্রাথমিক লক্ষ্য হল নয়া–ঔপনিবেশিতের আত্মপরিচয় ধ্বংস করা (The empires of the future are the empires of the mind.—Winston S. Churchill, September 6, 1943. Harvard.)।
গ. ভাষার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভূগোল আর ইতিহাস। বিদেশি ভাষা–মাধ্যম ঔপনিবেশিক শিক্ষা জ্ঞানবিজ্ঞানকে বিদেশি বাইরের জিনিশ করে রাখে, শিক্ষার্থীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভূগোল আর ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ঘরের জিনিশ হয়না। বস্তুত বিদেশি ভাষা–মাধ্যম অধীত বিদ্যা পড়া, বোঝা আর সামান্য কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক আত্তীকরণ আর তারপ্রাথমিক প্রয়োগেই শেষ হয়। তবে এখানেও আত্তীকরণ ঘটে পরিগ্রাহকের অন্তর্জগতের আপাত স্তরে আর তার প্রয়োগ যান্ত্রিক প্রতিবর্তী ক্রিয়াতেই শেষ হয়। এক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞানের আত্তীকরণ পরিগ্রাহকের অন্তর্জগতের নিহিত স্তরে গিয়ে তার মানসিকতার সংগঠক উপাদানে পরিণত হয়েছে আর তার প্রয়োগ সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছে এমন ঘটনা প্রায় দেখাই যায় না। যেসব ডিগ্রির মনিহার পরা বাঙালিরা সামাজিক– অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টিকারী বিদেশি ভাষা–মাধ্যম ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে বহাল রাখতে চান, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, গত দুশ বছরের ঔপনিবেশিক ইংরেজি –মাধ্যম শিক্ষার ফলাফলটা কী? জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক অবদানটা কী আর কতটা? তা এই বিরাট দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অতি সামান্য বললে খুব ভুল বলা হয়? আমাদের ঘর আর বাইরের, কাজ আর কথার ফারাকের কারণটা কী?
প্রসঙ্গত একটা প্রশ্ন: ভারত নাকি ইংরেজি–শিক্ষার কারণে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিরাট স্থান দখল করে আছে। আমার বিদ্যেবুদ্ধি নেই বললেই হয়, তবু আমার জানতে ইচ্ছে করে তথ্যপ্রযুক্তিতে ভারতীয়দের মৌলিক অবদানটা কী? দেশি–বিদেশি তথ্যপ্রযুক্তির বাণিজ্য–সংস্থায় আপেক্ষিকভাবে কমপয়সায় ইনফোকুলি ও সর্দার হিসেবে কাজ করাটাই কি শেষ কথা? পরিচর্যা পেরিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির মৌল উৎপাদন আর উন্নতিতে আমাদের অবদান কী এবং কতখানি? এ ছাড়া ভাষাভাষীর পরিসংখ্যান অনুসারে পৃথিবীর ষষ্ঠ বা সপ্তম ভাষা বাংলা সাইবার স্পেস–এর একটা টুকরোও দখল করতে পারেনি। বাংলা ভাষা পুরো কম্প্যুটারায়িত হয় নি, কখনো হবে কিনা বলা মুস্কিল। শিক্ষিত (কয়েকটা পাশ দেওয়া) বাঙালি এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। “আমাদের” ইংরেজি তো রয়েছে, আবার বাংলা বাংলা বলে চেঁচামিচি কেন? বাঙালির লেখা ই–মেল (পুষ্কর দাশগুপ্তের মতো অপদার্থরা বলে বৈ–চিঠি/বৈদ্যুতিন চিঠি। রিডিক্যুলাস !) বেশির ভাগ রোমান হরফে লেখা (আমার মতো নির্বোধের পক্ষে পাঠোদ্ধার কঠিন।), সমান্য কিছু বাংলা হরফে, ভাষা বাংরেজি। দুটো দৃষ্টান্ত দিচ্ছি:
priyabareshu…,
asha kori tumi ar tomar barir sabai sarbangin kushale acha . Bahukal pare amra, arthat ami, amar stri ar amader chele, amader gramer barite elam. Katakal amra anek bangali khaoar khai ni, jeman dhara amrar ambal, amer catni, sarshe die sajne danta. Gatakal kakima kumro phul bhajha, pataler dolma, kuchomacher jhal ar barir gorur dhudher payes khaoalen. Ki je tar swad! Samay thakle duchar diner jannye haleo chale eso. Amra kichudin thakbo.
ডিয়ার …,
আমি ইয়েস্টারডে ইভনিঙ–ফ্লাইটে ক্যালকাটা থেকে ব্যাঙালোরে এসে অ্যারাইভ করেছি । ইফ এভ্রি থিং গৌউজ ওয়েল এখানে থ্রি অর ফৌর ডেজ থেকে এগেন দ্যাট হেল অব আ সিটি ক্যালকাটায় ব্যক করব, নেক্সট্ সানডে , আয়ুল সি ইয়ু! তোমার সঙ্গে , অ্যাজ ইট হ্যাজ বিন অলরেডি ফিক্সড্, মেন ল্যান্ড চাইনায় ডিনার করব। ডিনারে আমরা আমাদের বিজনেস স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে ডিসকাস করব।
সি ইয়ু সানডে!
পণ্ডিত মশায়রা বলছেন বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়। কেন? জাপানি, চিনে, কোরিয়ান, থাই, (ইন্দোনেশীয়) ভাষা, আরবি, রুশ, পোলিশ, আলবেনীয়, তুর্কি গ্রিক ইত্যাদি সব ভাযায় সম্ভব কিন্তু বাংলায় নয়। পণ্ডিতমশায়রা ফতোয়া জারি করে দিয়েছেন। আনন্দবাজারে বড় বড় হরফে ছাপা হয়েছে। ফতোয়ার ওপর কথা! তুমি কোন হরিদাস পাল হে?
৪. জগন্নাথ দত্তের সমীক্ষা !
এসব আলাপ–আলোচনার সময় চায়ের দোকানের দোকানদারের সহ্য করা তিনশপঁয়ষট্টি দিনের খদ্দের , (খদ্দের না বলে বলতে হয় The Last of the Mohicans দোকানের আড্ডাধারীদের দলের শেষ ব্যক্তি) জগন্নাথ দত্ত, ওরনফে জগা, জগু, জগাদা, জগুকাকা,জগুজ্যাঠা ,ইদানীংকালে জগু –আংকল্ দোকানের শেষের সারিতে তার জন্য নির্দিষ্ট করা ভাঙা চেয়ারে যথারীতি উপস্থিত থাকলেও কখনো মুখ খোলে না। একদিন সবাই চলে গেলে বলল, শোন্, তুই তো শালা দেশ ছেড়েছিস সেই কবে, কুড়ি বছরের বেশি হয়ে গেছে। দেশে তোর চাল চুলোও নেই, কোনো ধান্ধাও নেই। মাঝেমধ্যে দুচার বছর পরে আসিস। বাংলা ফাংলা নিয়ে রগড়ে তোর হবেটা কী? খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে কাল হল এঁড়ে গোরু কিনে ! ছাড় ওসব, বোস, চাফা বল। সেদিন, তুই বেরিয়ে যাওয়ার পর, ভবতোষদা তোর সম্মন্ধে ফুট কাটছিল, বুকনি কচলে কচলে বুড়ো ভাম হয়ে গেল, আর কিছুই হল না। চা আর কাটলেট বলার পর, জগা বলল। সুধীরবাবু মাস তিনেকের জন্য আমেরিকায় ছেলের ওখানে গেছিলেন। ফিরে এসে গপ্পো আর গপ্পো, একদিনতো শুধু বাথরুম আর কমোডের ডেসকৃপসনে দুঘন্টা কেটে গেল। গতবার তুই মজা করে জিজ্ঞেস করেছিলি, এর ইংরিজি কী হবে:
আমার মামাতো দাদার পিসশ্বশুর তার ভাইরাভাইকে নিয়ে গয়ায় পিন্ডি দিতে যাচ্ছেন, সঙ্গে যাচ্ছে আমার মামাতো দাদা আর তার শালা। আমি শালা ওসব ধম্মকম্মের মধ্যে নেই।
কাক ভোরে উঠে নিমকাঠি দিয়ে দাঁত মেজে আর উচ্ছেভাজা দিয়ে একটা পরোটা আর দুটো ডালপুরি খেয়েছি। দুপুরে খাব কলমি শাক, সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি, মোচার ঘন্ট, ইলিশ মাছের পাতুরি আর মোরলা মাছের টক।
আমি টুকে রেখেছিলাম। ভবতোষদাকে জিজ্ঞেস করলাম। ভবতোষদা ‘যত সব ফালতু কথা’ বলে উড়িয়ে দিলেন। সুধীরবাবু শুনে রেগে কাঁই, বললেন ওসব ভেতো বাঙালির ব্যাপার, ওসবের ইংরেজি হয়না সাহেবদের জীবনটাই আলাদা।
৫. ইন্ডিয়ান ইংলিশ লিটরেচার বা সোনার পাথরবাটি (গুহ্যপক্ক বখাগুলো বলে লেঙ্গুঠির বুক–পকেট)
উইকিপেডিয়ায় ভারতীয় লেখকদের বর্ণানুক্রমিক একটা তালিকা চোখে পড়ল: List of Indian writers, Wikipedia, the free encyclopedia, This is a list of notable writers who come from India or have Indian nationality। তার থেকে বাঙালি নামগুলো আলাদা করে তাকে দুভাগে ভাগ করলাম—
ক. যাঁরা বাংলায় লিখেছেন : Jagadish Chandra Bose, Mahasweta Devi, Nirupama Devi, Rabindranath Tagore, Sarat Chandra Chattopadhyay, Sukumar Ray, Sunil Gangopadhyay.
খ. যাঁরা ইংরেজিতে লেখেন বা লিখেছেন (যার মধ্যে অনেকের নাম বা /এবং লেখা আমার অপরিচিত ): Abhijit Bhaduri, Amit Chaudhuri, Amitav Ghosh, Barun Roy, Bishwanath Ghosh, Chitra Banerjee Divakaruni, Durjoy Datta, Kunal Basu, Jhumpa Lahiri, Raj Chowdhury, Rajat Chaudhuri, Samit Basu, Upamanyu Chatterjee।
ক. বাংলাভাষার লেখকের সংখ্যা ৭ (সাত), একজন মাত্র জীবিত (মহাশ্বেতা দেবী)। জগদীশচন্দ্র বসু কিছু বাংলা নিবন্ধের লেখক হলেও (প্রবন্ধ–সংকলন ‘অব্যক্ত’ ১৯২১) প্রধানত বিজ্ঞানী। তবে বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে সাতজন ছাড়া আর কেউ নেই। মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়,, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার… না, কেউ না!
খ. তালিকায় ১৩ জন বাঙালি লেখকের নাম রয়েছে। যেসব পরলোকগত বাঙালি লেখক ইংরেজিতে লিখেছেন তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে (তরু দত্ত থেকে সরোজিনী নাইডু, নীরদ চৌধুরি)। তালিকাভুক্ত লেখকরা সবাই জীবিত আর ইংরেজি ভাষায় লেখেন, এঁরা সবাই Wikipedia–র বিচারে notable writers। এঁদের মধ্যে একমাত্র অমিতাভ ঘোষ ছাড়া আর কারও লেখা আমি সে অর্থে পড়িনি। দু–এক জনের লেখা দু–এক পাতা পড়ে আর এগুতে পারিনি, আমারই বুদ্ধির দোষ। তাছাড়া একই ভাবে আমারই বুদ্ধির দোষে এসব লেখা পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে পোস্ট–কলোনিয়াল বিশেষণটি আসলে নিও–কলোনিয়াল–এর প্রতিশব্দ মাত্র। বুঝলাম, পুষ্কর দাশগুপ্ত না হয় একটা গাধা, কিন্তু বাঙালি বড়বাবুরা কী বলেন?
কিছু ভারতীয় লেখক ইংরেজিতে লেখেন, তাঁদের উৎপাদনকে ব্রিটিশ আমলে বলা হত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান লিটরেচার (Anglo Indian literature)। স্বাধীনতার পর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শব্দের অমর্যাদা–সূচক অনুষঙ্গের কারণে ইংরেজিতে লেখেন এমন কিছু ভারতীয় লেখক (কলকাতার রাইটার্স ওয়ার্কশপ–এর প্রতিষ্ঠাতা পুরুষোত্তম লাল আর অন্যান্যেরা) তাঁদের রচনাকে ইন্দো–অ্যাংলিয়ান লিটরেচার(Indo-Anglian literature) বলে অভিহিত করেন। তারপর নয়া–ঔপনিবেশিকতার সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠাকে দৃঢ় করার অন্য তম উপায় হিসেবে ভারতীয়দের ইংরেজি লেখাকে সামনে এনে আলোকায়িত করার প্রয়োজনে এর নতুন নাম হল ইন্ডিয়ান লিটরেচার ইন ইংলিশ (Indian literature in English ) বা ইন্ডিয়ান ইংলিশ লিটরেচার (Indian English literature (IEL)। ওপরে উইকিপেডিয়ার বাঙালি লেখকের তালিকা থেকে অথবা ‘ভারতীয়’ আত্মপরিচয়ে পরিচিত পাকিস্তানি জনাব আহমেদ সালমন রুশদি–র (Ahmed Salman Rushdie )–র বহু–প্রচারিত ফতোয়া থেকে বোঝা যায় অবস্থাট কী:
… the prose writing both fiction and nonfiction created in this period by Indian writers working in English, is proving to be a stronger and more important body of work than most of what has been produced in the 16 “official languages” of India, the so-called “vernacular languages”, during the same time; and, indeed, this new, and still burgeoning, “Indo-Anglian” literature represents perhaps the most valuable contribution India has yet made to the world of books.
ভারতীয় কোনো ভাষা রুশদি সাহেবের জানা নেই, উর্দু তাঁর মাতৃভাষা বলে দাবি করলেও উর্দুর যে ভাষাতত্ত্ব তিনি উপস্থাপিত করেছেন তাতেও তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া গেলেও ভাষাতত্ত্বে তাঁর অধিকারের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। তবু হজরত রুশদি–র ফতোয়া শিরোধার্য!
জোজেফ কনরাড ছিলেন পোলিশ, ভ্লাদিমির নভোকফ ছিলেন রুশ, এঁরা দুজনেই লিখেছেন ইংরেজিতে। ত্রিস্তঁ জারা, য়্যোজেন ইয়োনেস্কো,ইজিদর ইজু, আনা দ নোয়াই, মির্চা এলিয়াদ , এঁরা সবাই রুমানিয়ান লিখেছেন ফরাসিতে , আইরিশ স্যামুয়েল বেকেট, স্প্যানিশ ফের্নান্দো আরাবাল, চেক মিলান কুন্দেরা, লেখেন ফরাসিতে। কিন্তু পোলিশ ইংরেজি সাহিত্য, রুশ ইংরেজি সাহিত্য, রোমানিয়ান ফরাসি সাহিত্য, আইরিশ ফরাসি সাহিত্য, স্প্যানিশ ফরাসি সাহিত্য, চেক ফরাসি সাহিত্য কেউ বলেনা । বলা হয় এসব বিদেশিরা ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় লিখেছেন আর তাঁদের রচনা ইংরেজি বা ফরাসি সাহিত্যের অন্তর্গত, পোলিশ,রুশ, রোমানিয়ান ইত্যাদি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত নয়।
৬. Homo colonicus
জগা বলল, দেখ্, মাঝেমধ্যে দু–একটা শব্দের ভুঁই–পটকা ফাটিয়ে চমকে কী রগড়ে দিতে না পারলে বাঙালি আঁতেলদের কথা বাদ দে, আতাকেলানে ছেলে–ছোকড়াদের কাছেও কলকে পাবি না। জগার উপদেশ মানতেই হয়, ছাড়লাম “হোমো কলোনিক্যুস ” । সকালে শম্ভুর চায়ের ঠেকের, সন্ধ্যেবেলায় চায়ের বিজয় কাফের তরুণ কবি–লেখকদের পালের গোদা কবিয়াল দেবজ্যোতি বলল, ওরকম কোনো শব্দ হয়না, ডিক্সেনারিতে এরকম কোনো শব্দ নেই। আমি বললাম, শব্দ দুটি ইংরেজি নয়, ল্যাটিন, homo মানে হচ্ছে মানুষ (পুরুষ বা নারী), যেমন বলা হয়, homo economicus, homo erectus, homo Hierarchicus ইত্যাদি । আমি বলি homo colonicus, colonicus শব্দের প্রাথমিক অর্থ, কলোনি বা উপনিবশে যে বড় হয়েছে, কিন্তু আমি তাকে ঔপনিবেশিতের মানসিকতা সম্পন্ন (সাংস্কৃতিক হীনমন্যতায় ভোগা, নির্ভরতা, অনুকরণ, এক কথায় কালো চামড়া, সাদা মুখোস পরা ) দ্বিপদ জন্তু (মানুষ) অর্থে ব্যবহার করেছি। পেছনে জগা বসেছিল, বলল, সংস্কৃত ফংস্কৃত মারিয়ে ফাটিয়ে দিলি গুরু! আমি বললাম সংস্কৃত নয় ল্যাটিন। জগা বলল, সে যাই হোক না বস, ওই সংস্কৃত কি ল্যাটিন ফ্যাটিন আমার সয় না, আমার শালা আবার পেট গরমের ধাত। দোস্ত, এখন শুধু তুই আর আমি, আমাদের জন্য দুটো মামলেট আর দুটো টোস্ট বল! পেটে কিছু না পড়লে ল্যাটিন বল কি অংবংচং সংস্কৃত বল কোনোটাই ঠিক আসে না, এমনকী শালা, মায়ের ভাষা দিশি বাংলাটাও পেটে আসে তো মুখে আসতে চায় না। দেবজ্যোতি যেতে যেতে বলে গেল, জগাদা, মামলেট নয়, ওমলেট । জগা খেপে গিয়ে বলল, এদিকে পেটে ছুঁচোর কেত্তন, ওদিকে যত শালা জ্ঞানচো…! আমি জগার জন্য একটা ডবল ডিমের ‘মামলেট’ আর দুটো টোস্ট বললাম। জগা বলল, তোর কি আজ একাদশী নাকি? আমি বললাম, নারে, আমি সকালেই খেয়েছি।
৭.বাংলা ভাযায় কারা লেখে? কী লেখে? কেন লেখে?
আজ (একুশ শতকে) বাংলা ভাষায় কারা লেখে? কী লেখে? কেন লেখে?
যথারীতি প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম জগাকে । জগা বলল, ওসব লেখালেখির খবর রেখে আমার হবেটা কী? তোরওবা মাথাব্যথাটা কোথায়? তবে ছোটবেলায় দেখতাম কলকাতায় কাক আর কবির ছড়াছড়ি ? কমলদাকে মনে পড়ে ? কমলদা বলত, বাঞ্চৎ! কলকাতায় মানুষ খোঁজ, খুঁজে পেতে —খুঁজতে খুঁজতে জিব বেরিয়ে যাবে! তবে কাক আর কবি চারদিকে গিজগিজ করছে — রক, চায়ের ঠেক, পার্কের বেঞ্চি, খালাসিটোলা, বারদুয়ারি , ময়দানের ঘাস সব জায়গায় গিজগিজ করছে, পিলপিল করছে। (একটু গলা নামিয়ে কমলদা বলত) ময়দানের ঘাসে বসে কবি–কবিনীরা বসে প্রেমের পদ্য পড়ে, কী করে যে পড়ে জানিনা, ময়দানের ঘাসে শালা হাজারে হাজারে ডেঁয়ো পিঁপড়ে। তার ওপর সারা জীবন খাবারে ভেজাল দিয়ে আর নকলি ওষুধ বেচে লাখলাখ মানুষকে খতম করে যে জৈন মাওয়াড়িরা কালো টাকার পর্বত বানিয়েছে বুড়ো বয়সে ওরা হেভি ধার্মিক হয়ে যায়। নাকমুখ কাপড়ে ঢেকে খাটমল সেবন, ইঁদুর সেবনের পাশাপাশি তারা ময়দানের ঘাসে চিনি ছিটিয়ে ডেঁয়ো পিঁপড়ে সেবন করায়। চিনি খেয়ে খেয়ে হারামি পিঁপড়েগুলো তুমি বসে বেদ–মহাভারত কি ন্যাকা ন্যাকা আকাশের বোকা বোকা চাঁদ নিয়ে যেই একটা মেয়ে পটানোর একটা পদ্য পড়তে শুরু করবে অমনি শ খানেক পিঁপড়ে শালা কাপড় চোপড়ের ফাঁক খুঁজে যেখানে সেখানে ঢুকে মোক্ষম কামড় বসাবে। তোর হয়ত কমলদার এসব কথা মনে নেই।
জগা বলল, তুইওতো শুনেছি তখন কবতে–ফবতে লিখতিস। সুবীর বলত তোর কবতে পড়তে গিয়ে ওর মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়, উলটো পালটা কী সব লেখা! তবে এখন আর সেদিন নেই। পাগলামির ভূত তোকে ছেড়েছে।
তবে এখনকার নতুন ছেলেমেয়েরা আপনা ধান্ধা দেখার মন্তর শিখে গেছে। তাদের আড্ডা দেওয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। দেখছিস না, আড্ডার ঠেকগুলো একে একে সব উঠে গিয়ে হয় ভাতের হোটেল কি চাইনিজ–এর দোকান হয়ে গেছে বা যাচ্ছে।
পরের দিন দেবজ্যোতির দলকে প্রশ্ন করলাম। সেদিন ওরা চারজন ছিল, তিনজন কবিতা লেখে আর একজন গল্প। কারা লেখে? তাদের উত্তর অনেকেই লেখে। অনেকে বলতে? অনেকে মানে অনেকে। কী লেখে ? উত্তর , কবিতা, গল্প, মাঝেমধ্যে দুয়েকটা প্রবন্ধ। কেন লেখে ? রেগে যাওয়া উত্তর, ইচ্ছে হয়, ভালো লাগে। কবিতা–লেখক বিমলের উত্তর, ভেতরের তাগিদ, না লিখে পারা যায় না। কে বা কারা পড়ে ? অনেকেই পড়ে। এবার একসঙ্গে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম, তারা কারা? অর্থাৎ তারা শহরের না গ্রামের লোক? তারা কোন বয়সের লোক? কোন সামাজিক স্তরের, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত, গরিব? তাদের শিক্ষা, ইংরেজি–মাধ্যম, বাংলা–মাধ্যম, দুই–ই? তারা কী বই কেনে? প্রশ্ন শুনে ওরা কিছুটা বিরক্ত হল।
রিটায়ার করে গুরুর কাছে মন্ত্র নেওয়া এক বন্ধু বলল, দেখ সমাজটা পালটে যাচ্ছে। কলকাতার বা শহরের যেসব বাড়িতে পড়াশোনার চল ছিল, বাড়িতে একাধিক অভিধান, শেকসপিয়ার, মধুসূদন, বঙ্কিম, ডিকেন্স, বার্নাড শ, শরৎচন্দ্র, তারাশংকর, বিভুতিভূষণের বই ছিল। সেসব বাড়ির ছেলেমেয়েরা সত্তরের দশক থেকে রাজনৈতিক তথা সামাজিক–অর্থনৈতিক কারণে সাংস্কৃতিক শেকড়হীন ইংরেজি–মাধ্যম ইস্কুলে গেল বা যেতে বাধ্য হল। এসব বাড়িতে এখন আর কেউ বাংলা বই পড়ে না, বাংলা বই ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। নতুন জেনারেশন ইংরিজি বেস্টসেলার পড়ে। বাংলা ভাষায় যারা লেখালেখি করে বা বইপত্তর পড়ে তারা হল গ্রামের প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত ছেলেমেয়ে। ওরা গ্রামে বা গ্রাম থেকে মফস্বল শহরে বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কলকাতায় এসেছে। ওরা বাংলা ভাষার স্বপক্ষে রা কাড়তে সাহস পায় না, পাছে লোকে ইংরেজি জানেনা বলে দুয়ো দেয়। ইংরেজি জানেনা! ফটাফট ইংরেজি বলতে পারে না! কী লজ্জা! কী লজ্জা! আজকাল ফ্যাশনেবল বড় দোকানে ইংরিজি (তুমি যাকে বল হিংরেজি বা বাংরেজি) না বললে পাত্তা পাওয়া যায় না।…
বাঙালি
জনমজেয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে, কলিযুগে এতদ্দেশে বাঙালি নামে মনুষ্যস্বভাব এক প্রকার দ্বিপদ জীব আবির্ভূত হইবে। আপনি বলিয়াছেন তাহারা কী প্রকার এবং কী প্রকৃতির প্রাণী হইবে তাহা শুনিতে সবিশেষ কৌতূহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া বিশদ বর্ণনার মাধ্যমে আমার কৌতূহল নিবারণ করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর, আমি সেই কর্মবিমুখ, বাক্যবাগীশ, মর্কট হইতেও অধিকতর অনুকরণপ্রিয়, বক হইতেও অধিকতর ধার্মিক, বিড়াল হইতেও বিখ্যাত তপস্বী, কৃকলাস হইতেও অধিকতর নিপুন বহুরূপী বাঙালিদিগের চরিত্র কীর্ত্তিত করিতেছি , আপনি শ্রবণ করুন।
প্রকৃতপ্রস্তাবে মনুষ্যজাতির এক অদ্ভুত প্রজাতি বাঙালি নামে পরিচিত এই জীবগুলি পরভাষাপ্রিয়, মাতৃভাষাবিরোধী হইবেন । ইহাদের মধ্যে এমন কিছু বাঙালি জন্মিবেন যাহাঁরা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে বা পিতৃপুরুষের নাম উচ্চারণে অসমর্থ হইবেন। এই অসামর্থ্য তাঁহাদিগের সবিশেষ আত্মগরিমার কারণ হইবে। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত অথচ বাংলা ভাষার পরশুরাম দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা গীতবাদ্যসহ এই সকল বাঙালীর বিরামহীন জয়ধ্বনিতে দশ দিক মুখরিত করিবে।…