Ahmadou Kourouma: Les soleils des indépedances আহমাদু কুরুমা ( ১৯২৭-২০০৩) ‘ স্বাধীনতার সূর্যগুলি’ (= স্বাধীনতার দিনগুলি)

KOUROUMA

Ahmadou Kourouma :

Les soleils des indépedances

Première partie

(Chapitre I)

স্বাধীনতার সূর্যগুলি ;

প্রথম পর্ব

(প্রথম অধ্যায় )

Traduction en bengali:Pushkar Dasgupta

অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত

আহমাদু কুরুমা (Ahmadou Kourouma, ১৯২৭২০০৩) উত্তরপশ্চিম আফ্রিকার পূর্বতন ফরাসি উপনিবেশ আইভরি কোস্টএর (La Côte d’Ivoire/কোৎ দিভোয়ার এর) ফরাসি ভাষার লেখক। মালির রাজধানী বামাকোতে পড়াশোনা করার সময় ১৯৫০ সালে তিনি ফরাসি সেনাবাহিনিতে যোগ দিয়ে ইন্দোচিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন (১৯৫৪), যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি ফ্রান্সের লিয়োঁ শহরে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ সালে আইভরি কোস্ট স্বাধীনতা পেলে অনেক আশা নিয়ে আহমাদু কুরুমা দেশে ফিরে যান। সেখানে দক্ষিণপন্থী সরকারের সন্দেহের শিকার হয়ে কিছুদিন জেলে কাটানোর পর ১৯৬৪ থেকে ১৯৯৪ সাল অব্দি তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান।

এর পর দেশে ফিরে তিনি আইভরি কোস্টে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করে ফের সরকারের সন্দেহভাজন হন। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আহমাদু কুরুমা মারা যান। ‘ স্বাধীনতার সূর্যগুলি’ (Les soleils des indépedances = স্বাধীনতার দিনগুলি) আহমাদু কুরুমার প্রথম উপন্যাস, ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রকাশক পাণ্ডুলিপি পড়ে ফেরৎ দেওয়ার পর ১৯৬৮ সালে তা কানাডার মন্ট্রিল (মোঁরেআল/ Montréal ) শহরের একটি সাহিত্যপত্রিকা বইটি প্রকাশ করে যা বুদ্ধিজীবি পাঠকদের আকৃষ্ট করে। ইতিপূর্বে যারা পাণ্ডুলিপি ফেরৎ দিয়েছিল তার মধ্যে ছিল প্যারিসের বিখ্যাত প্রকাশনসংস্থা এদিসিয়োঁ দ্যু স্যই (Editions du Seuil)। এবার তারা বইটি সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হয়ে ১৯৭০ সালে বইটি প্রকাশ করে। এই উপন্যাস অবিলম্বে আফ্রিকান লেখকেরফরাসি ভাষায় লেখা ধ্রুপদী উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করে। ২০০০ সালে কুরুমার শেষ বিখ্যাত উপন্যাস ‘আল্লা বাধ্য নন ’ প্রকাশিত হয়। ‘স্বাধীনতার সূর্যগুলি’ সহ আহমাদু কুরুমার বিভিন্ন উপন্যাসের ভালো ইংরেজি অনুবাদ না থাকায় কুরুমা ইংরেজিভাষী জগতে খুব একটা পরিচিত নন।

ডালকুত্তা আর তার বসার বেহায়া ধরন

এক সপ্তাহ হল, রাজধানীতে মাল্যাঁকে জাতের কোনে ইরাহিমা ইন্তেকাল করেছে কিম্বা মাল্যাঁকে ভাষায় বলা যায়: সামান্য একটু সর্দির বোঝা ও আর বইতে পারে নি

যেকোনো মাল্যাঁকের মতোই ওকে ছেড়ে প্রাণটা যখন বেরিয়ে গেল তখন ওর ছায়াটা উঠে দাঁড়াল, খক খক কেশে কফ ফেলল, পোশাকআশাক পরে অনেক দূরের জন্মভূমি মাল্যাঁকেদের দেশের দীর্ঘ পথে ও বেরিয়ে পড়ল। ওখানে ওকে দাফনের দুঃখের খবরটা এত্তেলা করতে হবে। লোকবসতিহীন ধু ধু বাদাড়ের মাঝখানে নির্জন কাঁচা রাস্তার ওপর দুজন মাল্যাঁকে ফিরিওয়ালা ছায়াটাকে দেখে চিনে ফেলল। ছায়াটা জোর কদমে হাঁটছিল আর ওদের কোনো আদাব জানাল না। হাটুরে ব্যাপারিরা চিনতে ভুল করে নি: তারা বলাবলি করতে লাগল, ‘ইব্রাহিমা ইন্তেকাল করেছে। বাড়ি এসে ছায়াটা নিজের যাবতীয় সম্পত্তি এদিকওদিক করে গুছিয়ে রাখল। ঘরের পেছন থেকে লোকজন বাক্সপেটরা বন্ধ করার আর লাউয়ের খোলের ঘসাঘসির আওয়াজ শুনতে পেল। এমন কী ওর ছাগলভেড়াগুলোও কেমন অদ্ভুতভাবে ছটফট করতে করতে ডাকতে লাগল। বুঝতে কারো ভুল হল না, লোকে বলাবলি করতে লাগল – ‘ইব্রাহিমা কোনে ইন্তেকাল করেছে,ওটা ওর ছায়া। ছায়াটা রাজধানীতে দাফনে হাজির থাকার জন্যে ওর মরদেহের কাছে ফিরে গেল:পঁচিশ ক্রোশ পথে যাওয়াআসা। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে ব্যাপারটা ঘটে গেল।

মনে হচ্ছে, আপনারা যেন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাহলে আমার কথাটা শুনুন, আমি আপনাদের কাছে কসম খেয়ে বলছি যে ব্যাপারটা সত্যি। আমি আরো বলছি : মারা যাওয়া লোকটি যদি জাতে কামার হত আর আমাদের সময়টা যদি স্বাধীনতার যুগ না হত (মাল্যাঁকেরা বলে, স্বাধীনতার সূর্যগুলো) তাহলে, আমি আপনাদের কাছে কসম খেয়ে বলছি,লোকে কখনোই ওকে অনেক দূরের বিদেশবিভুঁইয়ে গোর দিতে সাহস পেত না। কামার জাতের বুড়ো কোনো এক মাতব্বর ছোট্ট একটা ছড়ি হাতে দেশ থেকে এসে হাজির হত, ধড়টাতে ছড়ির ঘা লাগাত, ছায়াটা ফের ধড়টার সঙ্গে এক হয়ে যেত, মরা লোকটি উঠে দাঁড়াত। ছড়িটা মৃতের হাতে দেওয়া হত, লোকটি বুড়ো মাতব্বরের পেছন পেছন চলতে থাকত, আর দুজনে একসঙ্গে ওরা কয়েকটা দিন আর কয়েকটা রাত হাঁটত । তবে খবরদার! মরা লোকটা যেন ফের বেঁচে না ওঠে! প্রাণ হল একমাত্র আল্লার হাতে! আর মুখে কিছু না দিয়ে, জল অব্দি না খেয়ে, এতটুকু রা না কেড়ে, এমনকী না ঘুমিয়ে মরা লোকটি বুড়োর পেছন পেছন যেত, হাঁটতে হাঁটতে গাঁয়ে এসে পৌঁছাত। গাঁয়ে পৌঁছে বুড়ো কামার ছড়িটা কেড়ে নিয়ে আরেকবার ঘা লাগাত, ছায়া আর ধড়টা ফের আলাদা আলাদা হয়ে যেত। আর জন্মগাঁয়েই একজন কামার জাতের মাল্যাঁকের হরেক দফার জট পাকানো দাফন সম্পন্ন হত।

অতএব ব্যাপারটা সম্ভব, বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করে বলা যায় যে ছায়াটা সত্যি ওর জন্মগাঁ অব্দি হেঁটে গেল, তেমনি আবার দাফনের দেখভাল করার জন্যে তড়িঘড়ি করে রাজধানীতে ফিরে এল। শবযাত্রীদের মধ্যের এক গুনিন ওকে মনমরা হয়ে কফিনের ওপর বসে থাকতে দেখেছিল। দাফনের পর সপ্তম দিন অব্দি কটা দিন কেটে গেল আর ছায়ার সামনে সপ্তম দিনের পারলৌকিক ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হল। তারপর কয়েকটা সপ্তাহ কাটিয়ে চল্লিশ দিনের দিন হাজির হল আর উবু হয়ে বসে থাকা ছায়ার পায়ের কাছে চল্লিশ দিনের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হল। হেঁজিপেঁজি মাল্যাঁকেদের চোখে ছায়াটা অবশ্য সারাক্ষণ অদৃশ্য থেকে গেল। তারপর ছায়াটা চিরতরে বিদায় নিল। হাঁটতে হাঁটতে সে মাল্যাঁকেদের দেশে এসে হাজির হল। সেখানে কোনো একটা মাল্যাঁকে বাচ্চার মধ্যে ও নতুন করে জন্ম নেবে, হয়ে উঠবে একজন মায়ের সুখের আধার।

ছায়াটা যেহেতু নিজে হাজির থেকে সবকিছুর ওপর নজর রেখেছিল, গোনাগুনতি করছিল,শোকরগোজারি করছিল গোর দেওয়াটা তাই ইমানদারভাবে সম্পন্ন হল, পারলৌকিক ক্রিয়া পবিত্রভাবে অনুষ্ঠিত হল। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এমন কী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া সাধারণ লোকজনও দানখয়রাত করল খয়রাতির মালগুলো অতিথি আর রাজধানীর তাবৎ বড় মাল্যাঁকে পরিবারের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হল। প্রতিটি পারলৌকিক অনুষ্ঠানে বেশ কিছুটা রোজগারপাতি হয় বলে এটা খুবই স্বাভাবিক যে মাল্যাঁকে গ্রিয়োরা, স্বাধীনতায় সর্বস্ব খুইয়ে বেচার মতো আর কিছুই যাদের অবশিষ্ঠ নেই সেই বুড়ো মাল্যাঁকেরা (আর রাজধানীতে কত বুড়ো ব্যাপারি যে সর্বস্বাস্ত হয়েছে তার হিসেব একমাত্র আল্লারই জানা রয়েছে) সবাই দাফন আর পারলৌকিক অনুষ্ঠানে কাজ করে। সত্যিকারের পেশাদার ! সকাল সন্ধ্যে ওরা এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাবতীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্যে হাঁটাহাঁটি করে। মাল্যাঁকেরা নিজেদের মধ্যে বদমাইসি করে ওদের নাম দেয়েছে শকুনবা হায়নার পাল

হোরোদুগুর দুম্বুইয়া রাজবাহাদুরদের শেষতম জায়েজ বংশধর, চিতাবাঘ গোত্র, দুম্বুইয়া বাবা,দুম্বুইয়া মা, খাঁটি দুম্বুইয়া, ফামা দুম্বুইয়া হল একজন শকুন‘ ! একজন দুম্বুইয়া রাজবাহাদুর । হায়নার পালে চিতাবাঘ গোত্র ! হায়রে! স্বাধীনতার সূর্যগুলো।

মরহুম কোনে ইব্রাহিমার সপ্তম দিনের পারলৌকিক ক্রিয়ায় যেতে ফামার দেরি হয়ে যাচ্ছিল। সে আরো তাড়াহুড়ো করতে থাকল। অতিসার রুগীর মতো দুগুণ কদমে সে পা ফেলছিল। দ্বিতীয় নামাজের সময় সে তখনো সাহেবদের মহল্লা আর নিগ্রো পাড়ার মাঝখানের পুলের ওপর: অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।

ফামা মনে মনে গজরাতে লাগল: হারামের হারামি ! বেজম্মা! আর সব কিছুই যেন তার মাথা খারাপ করে দেওয়ার জন্যে ঘোট পাকাচ্ছে । সূর্য ! সূর্য ! অলক্ষুণে স্বাধীনতার সূর্য আকাশের পুরো একটা কোণ ভরে ফেলছে , বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সেঁকছে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে দিচ্ছে — যাতে করে মনে হয় বিকেল বেলার অস্বাস্থ্যকর ঝড়বৃষ্টিটা স্বাভাবিক । আর তার ওপর ওই নিষ্কর্মা বাউন্ডুলের গুষ্টি ! হারামজাদা নিষ্কর্মা বাউন্ডুলের পাল ফুটপাতের মাঝখানে আস্তানা গেড়েছে,ফুটপাতটা যেন ওদের বাপের ভিটেমাটি। হাঁটতে গেলে ধাক্কাধাক্কি করতে হয়, ধমকাতে হয়,গালিগালাজ করতে হয়। সব কিছু মিলে কানে তালা লাগানো হট্টগোল: হর্ন, ইঞ্জিনের ভটভট,চাকার ঘরঘর, ড্রাইভার আর পথ চলতি লোকজনের চিত্কার আর ডাকাডাকি। পুলের বাঁদিকের রেলিং থেকে লেগুনটা অসংখ্য আরশিতে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। আরশিগুলো টুকরো টুকরো হয়ে অনেক দূরের পাড়ে গিয়ে ফের জোড়া লেগে যাচ্ছিল। সেখানে ছোট ছোট দ্বীপ আর জঙ্গলের সীমারেখা ছাইরঙ দিগ্বলয়ের খোপের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। পুলটা আসাযাওয়া করা রঙবেরঙের গাড়িঘোড়ায় পিলপিল করছে ; আর ডানদিকের রেলিঙের ওপারে লেগুনটা কোথাও কোথাও সারাক্ষণ ঝকঝক করছে , কোথাও বা রাঙামাটির রঙ; বন্দরটা জাহাজ আর গুদামঘরে ঠাসা; আর আরো কিছুটা দূরে লেগুনটা এবার রাঙামাটির রঙ, জঙ্গলের সীমারেখা আর অবশেষে ছোট্ট এক টুকরো নীল: দিগন্তের নীলে সমুদ্রের শুরু। ভাগ্যি ভাল ! বিসমিল্লা হি রহমান ! ফামাকে আর বেশি দূর হাঁটতে হবে না, বন্দরের শেষ সীমা দেখা যাচ্ছে, ঐ যে, ওখানে পথটা একটা ঢালুর মধ্যে,একটা খাদের ভেতর নেমে হারিয়ে গেছে। ঐ খাদের মধ্যে গিজগিজ করছে আরো গুদামঘরের চকচকে কি ম্যাটম্যাটে টিনের চাল, তালগাছ, পাতার ঝাড় আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে জানলায় খড়খড়ি লাগানো দুতিনটে কোঠাবাড়ি। পারলৌকিক অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার জন্যে ফামা এভাবে ছুটে চলেছে বুঝতে পারাটা মন্ত এক অধঃপতন আর লজ্জার ব্যাপার, মরা জানোয়ার নিয়ে হায়নার পালের সঙ্গে বুড়ো একটা চিতাবাঘের কামড়াকামড়ি করতে দেখে ফেলার মতই মস্ত ঘটনা।

ফামা — সোনাদানা, চর্ব্যচোষ্য, শরিফৎ আর মেয়েছেলের মধ্যে ওর জন্ম। ও তালিম পেয়েছে এক সোনা ছেড়ে অন্য সোনা পছন্দ করার , হরেক চর্ব্যচোষ্যের মধ্যে বেছে নিয়ে খাওয়ার, আর একশ স্ত্রীর মধ্যে থেকে মনের মতন একজনকে নিয়ে শোয়ার। আজ ওর কী হাল ?ও আজ একটা মড়াখেকো শকুন

ছুটতে থাকা একটা হায়না। আকাশটা অনেক ওপরে নিথর, শুধুমাত্র সমুদ্রের দিকটায় ছন্নছাড়া আর বেহায়া মেঘের দল হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে আর একটা ঝড়ঝাপ্টার মতলবে একে অন্যের পেছনে ছুটছে। রোদ আর বৃষ্টির খিচুড়ি পাকানো এদেশের হারামজাদা, বেতাল,বিদঘুটে ঋতুপরিবর্তনের কাল।

একটা বাগান পার হয়ে মোড় ঘুরে ও সরকারি চাকুরেদের পাড়ার রাস্তা ধরল। বিসমিল্লা হি রহমান। হ্যাঁ, এখানেই। তবে ফামার পৌঁছুতে দেরি হয়ে গেল। ব্যাপারটা বিরক্তিকর, কেননা এর ফলস্বরুপ ওকে লোকজনের মাঝখানে একেবারে মুখের ওপর সইতে হবে সেই লাঞ্ছনা আর আক্রোশ যা পাৎলুনের ঢোলা পায়ে যেন সাপ ছুঁড়ে দেয়: অসম্ভব হয়ে ওঠে বসা, দাঁড়িয়ে থাকা,হাঁটা কি শোয়া।

শেষ অব্দি ও এসে পৌঁছল। থামের ওপর তৈরি বাড়িটার তলার অংশটা দিউলাতে ভরে গিয়েছিল। সাদা, নীল, সবুজ, হলদে, — বলা যায় তাবৎ রঙের বুবু গিজগিজ করছিল, হাতগুলো ওঠানামা করছিল আর গালগল্পের খই ফুটছিল। গোরে যাওয়া ইব্রাহিমার সপ্তম দিনের অনুষ্ঠানের ভীড়। শুধু এক ঝলকে দেখে নিলেই হল। সব কটা মহল্লার সব কটা পেশার নাককান গুণে নেওয়া যায় — চেনা যায়। ফামা সালাম জানিয়ে আকর্ণ হাসল, প্রকান্ড শরীরটা থামের ফাঁকে একটা জায়গায় রাখল, বুবুটা গুটিয়ে নিয়ে গুটিসুটি মেরে চাটাইয়ের এক কোনায় বসে পড়ল। রোগাপটকা থুণ্থুরে বুড়ো একটা গ্রিয়ো গলা ফাটিয়ে টিপ্পনী কেটে যাচ্ছিল, সে উতোর ধরল:

হোরোদুগুর রাজবাহাদুর, শেষ জায়েজ দুম্বুইয়া আমাদের মধ্যে সামিল হলেনতবে কিনা একটু দেরি করে।

বিদ্রুপের ভ্রুকুটি আর মুচকি হাসি দেখা দিল। কী আর করা যায়: বলতে গেলে ভিখিরি এক রাজবাহাদুর, যে কোনো সূর্যের তলায় তা বিকট। তবে এ সমস্ত হাসিমস্করা করা কুত্তার বাচ্চাদের গালাগালি করে ফামা অযথা তার রাগ খরচ করল না। গ্রিয়োটা বলে চলেছে, আর তা আরো বেশি বিরক্তিকর:

এই বিলম্বে অবশ্য কোনো ঝামেলা হয় নি ; বড় ঘরের তাবৎ আচার আর হকিকৎ মানা হয়েছে। দুম্বুইয়াদের কথা ভুলে যাওয়া হয় নি। কেতাদের সঙ্গে হোরোদুগুর রাজবাহাদুরদের সম্বন্ধ দেখানো হয়েছে।

ফামা গ্রিয়োকে কথাটা আরেক বার বলতে বলল। সে আমতা আমতা করতে লাগল। যে মাল্যাঁকে নয় তার কাছে ব্যাপারটা অজানা থাকতে পারে: বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা একটা বেইজ্জতি, চোখের মণি গলিয়ে দেওয়ার মতো বেইজ্জতি। কেইবা এভাবে কেতাদের সঙ্গে দুম্বুইয়াদের একাকার করেছে? কেতারা ছিল ওয়াসুলুদের রাজা আর ওদের গোত্র ছিল জলহস্তী,চিতাবাঘ নয়।

রূঢ়, তিরিক্ষি আর ঘৃণা মেশানো গলায় ফামা ফের গ্রিয়োকে কথাটা আরেকবার আউরাতে বলল। সে লোকটি অনর্গল সাফাই গাইতে শুরু করল ; প্রতীকী — আচারঅনুষ্ঠানে সবই তো প্রতীকী, আর এতেই লোকের তুষ্ট থাকা উচিত। একটা গলদ, ধর্ম আর আচারঅনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিরাট একটা গলদ হল, এই শহরের কিছু বুড়োর পেট চালানোর একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে পালাপার্বণের খয়রাতিশেষমেশ একগাদা ন্যক্কারজনক অবান্তর কথা — ওর কাছে যা জানতে চাওয়া হয়নি। হারামজাদা গ্রিয়ো। সাচ্চা গ্রিয়ো বলতে আর কেউই নেই, খাঁটি গ্রিয়োরা সবাই গোরাদের বিজয়ের আগের যুদ্ধের বীর নায়কদের সঙ্গে গত হয়েছে। ফামাকে ওখানেই সাবুদ করতে হবে যে এখনো এমন মানুষ রয়েছে যারা হারামিপনা সইতে পারে না। বেল্লিকের পাদের গন্ধ শুঁকে ভদ্রতাবশত মুখ বুজে থাকলে, ওরা তোমাদের নাক নেই বলে সাব্যস্ত করে নেবে।

ফামা উঠে দাঁড়িয়ে তর্জনগর্জনে বাড়িটা কাঁপিয়ে তুলল। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া রোগাপটকা গ্রিয়োটা কোন নৌকোয় পা রাখবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। জমায়েৎ হওয়া লোকজনকে সে দুম্বুইয়া বংশের ক্ষুব্ধ আর অপমানিত বংশধরের বক্তব্য শুনতে বলল। চিতাবাঘ গোত্র, দুম্বুইয়া বংশের বংশধর নিজেই একটা চিতাবাঘ — ক্ষোভ আর রাগ ও চেপে রাখতে জানে না । গলা চড়িয়ে সে ফামাকে বলল:

বীরের রক্ত, যা সত্যি যা বজ্রের মতো কঠিন তাই জানিয়ে দাও, যা তোমাকে দুঃখ দিয়েছে তাই বল। উগরে দাও, চোখের সামনে বিছিয়ে দাও তোমার ফরিয়াদ।

গ্রিয়োর বিড়ম্বনায় উত্সাহ পেয়ে ফামার নিজেকে বাধাবন্ধহীন বলে বোধ হল। এবার তার মুখ খোলার পালা, তার হক রয়েছে, রয়েছে এক মেঝে শ্রোতা। তাহলে বলুন খাঁটি মাল্যাঁকে হিসেবে আর কী তার চাওয়ার থাকতে পারে। চিতাবাঘের গর্জনে খাঁকারি দিয়ে সে গলাটা পরিষ্কার করে নিল। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ফেজটা ঠিক করে নিল, বুবুর হাতটা নামিয়ে দিল, বুক ফুলিয়ে এমন ভাবে পায়চারি করতে লাগল যেন সবাই তাকে দেখতে পায়, আর এরপর সে মুখ খুলল। গ্রিয়োটা তার কথার পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছিল, ফামা হুংকার ছাড়ছিল আর আরো জোরে হুংকার ছাড়তে যাচ্ছিল কিন্তুহতভাগা গ্রিয়ো, হতচ্ছাড়া কাসি ! প্রচন্ড একটা বিশ্রী কাসি গ্রিয়োর গলাটাকে এমনই উত্যক্ত করে তুলল যে সে বাধ্য হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে কফের সঙ্গে তার কলজে দুটো প্রায় বের করে দিচ্ছিল। ঘটনাটা ফামাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল। গ্রিয়োর জন্যে শেষতম দুম্বুইয়ার এতটুকু সমবেদনা হল না, ঘটনাটায় সে বিন্দুমাত্র দমেও গেল না। বরঞ্চ একটুখানি ভেবে নিয়ে কিংবদন্তীগুলো ফের শুরু করার জন্য সে মাথাটা নিচু করে রইল আর এই পরিস্থিতিতে চারপাশে ভ্রুক্ষেপ করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে তার বোধ হচ্ছিল না,অথচ ব্যাপারটাকে সে কি করে আমল না দিয়ে পারে ? লোকজন হয়রান হয়ে পড়েছিল, ফামার এসব রঙচটা ভ্যানতারা আর নিজের ঢোল পেটানোর তাবৎ কায়দাকানুন উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মুখস্ত হয়ে গেছে । জমায়েতে বুবু আর চাটাইয়ের খসখস শোনা যাচ্ছিল, লোকে নাকমুখ কোঁচকাচ্ছিল আর প্রবল হাতপা ছুঁড়ে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছিল। চিরকাল ফামা,চিরকাল ভাগের কমতি, চিরকাল একটা না একটা কিছু। লোকের আর সইছিল না। ওকে এবার বসিয়ে দেওয়া দরকার।

গ্রিয়ো কাসিটা সামলে উঠল, তবে একটু দেরিতে। চারপাশে একটা তিতিবিরক্তির ভাব ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অবশ্য ফামার চোখে কিছুই পড়ছিল না, কিছুই ওর কানে ঢুকছিল না। ও বকে যাচ্ছিল, ঠোঁট বাঁকিয়ে কিংবদন্তীগুলো কড়মড় করে চিবোতে অশত্থের ডালের মতন হাত দুটোকে আন্দোলিত করে ও অনর্গল বকে যাচ্ছিল। উত্তেজিত, ক্ষিপ্ত অবস্থায় তার নজরে পড়ছিল না যে বিরক্তিতে ওদের মুখের আদল পাল্টে যাচ্ছে, বিকৃত হয়ে উঠছে, তার নজরে পড়ছিল না, উহ্। বেলা বাড়ন্ত, হারামিপনা আর সহ্য হয় না, জাতীয় মন্তব্য মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে । সে ভ্যানতারা করে যাচ্ছিল।

ঠিক সেই মুহুর্তে জমায়েতের মধ্যে থেকে একটা ফতোয়া ফেটে পড়ল:

মুখে কুলুপ এঁটে কোথাও একটা পাছা ঠেকিয়ে বসে পড়। তোর কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান পচে গেছে ।

গাছের গুঁড়ির মতো গোল গেঁটেগাট্টা একটা লোক, পালোয়ানের মত গর্দান, হাত, পাঞ্জা আর ঘাড় নিরেট পাথরের মুখ। ওই লোকটাই চেঁচিয়ে উঠেছিল, ক্ষিপ্ত একটা ঝিঁঝিঁপোকার মত উত্তেজিত হয়ে ফামার সমান লম্বা হওয়ার জন্যে পায়ের ডগার ওপর দাঁড়িয়েছিল।

নিঃশ্বাস টানতে টানতে লোকটা আরো বলে উঠল:

তোর কোনো লজ্জাশরম নেই, সব কিছুর আগে হল লজ্জাশরম।

চারদিকে একটা রৈরৈ কাণ্ড। জঙ্গলের ভেতর একপাল মোষের ঢুকে পড়ার হৈচৈ। রোগাপটকা গ্রিয়োটা অনর্থক ফামার তোলা ঝড়টাকে বাগে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।

সে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে উঠল:

বাম্বা (যে লোকটি আস্ফালন করে উঠেছিল তার নাম ছিল এই ), বাম্বা, দিলটা ঠান্ডা করো।

মেঝের ওপর ঘাপ্টি মেরে থাকা, হিংস্র জানোয়ারের মত চোয়াল নাড়ানো, কনুই, ঘাড় আর মাথা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে বসা বাম্বা কি গ্রিয়োর বকের ডাক শুনতে পাচ্ছিল ? ফামার কানেও কিছুই ঢুকছিল না। ও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছিল, মেঝের ওপর লাথি মারছিল, বাপান্ত করছিল; কুত্তার বাচ্চা বাম্বার খুব বাড় বেড়েছে, তার মাথা মাটিতে নুইয়ে দিতে হবে, তাকে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরতে হবে, দাঁত বসাতে হবে। ওকে যে অপমান করেছে ফামা তার দিকে এগিয়ে গেল। আর দু পা হবে কিনা সন্দেহ ! ফামা তখনো সেই দু পা এগিয়ে যায় নি, এরই মধ্যে গেঁটেগাঁট্টা বাম্বা নাচিয়ের ভঙ্গিতে এক লাফে ওর পায়ের কাছে মাটির ওপর এসে হাজির হল। ওরা দুজনে একে অন্যের বুবুর ঝুল ধরে টানাটানি করতে লাগল । গ্রিয়োটা সরে পড়ল, হট্টগোল আরো তীব্র হয়ে উঠল, চারপাশে সবাই উঠে দাঁড়াল, দুজনকে জাপটে ধরে টানাহেঁচড়া করতে লাগল। বুবুর ঝুল পটাপট্ করে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গেল। ফামা ওর বুবুটা গুটিয়ে ধপাস করে চাটাইয়য়ের ওপর বসে পড়ল। বাম্বাকে তার নিজের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে দুদুজন ষন্ডামার্কা জোয়ানের দরকার হল। দুই প্রতিপক্ষের আসন নেওয়ার পর প্রত্যেকে নিজের নিজের জায়গায় চাটাইয়ের ওপর বসে পড়ল।

ফামা মার্জনা চাইল। অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বর্ষীয়ান সমস্ত মুসলমানদের হয়ে ফামার কাছে ক্ষমা চাইলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, ফামা ভুল করে নি, যা সত্যি তা বলতেই হয়, যতই তা কঠোর হোক না কেন, যা সত্যি তা চোখের মণি রগড়ে দেয় তবে তাকে গলিয়ে দেয় না। শেষমেশ বর্ষীয়ান লোকটি ফামাকে ওর পাওনার চেয়ে বেশি কয়েকটা নোট আর কোলাবাদাম দিয়ে ওর ক্ষতিপূরণ করে দিলেন। স্বভাবতই ফামা তা ছুঁড়ে ফেলে দিল: ও কেবল শরিফতের জন্যে লড়াই করেছে। লোকে ওর কথায় কান দিল না : বর্ষীয়ান লোকটি জোরাজুরি করতে লাগলেন। ফামা টাকা আর বাদাম ট্যাঁকে গুঁজে বেশ কিছুক্ষণ মাল্যাঁকেদের জাতখোয়ানো আর আচারবিচারের অধঃপতন নিয়ে চিন্তা করতে থাকল, গোরে যাওয়া লোকটির ছায়া পিতৃলোকে পূর্বপুরুষদের জানিয়ে দিতে চলেছে যে স্বাধীনতার সূর্যের তলায় মাল্যাঁকেরা তাদের রাজবাহাদুরকে বেইজ্জত করছে এমনকী তার গালে চড় কষাচ্ছে। পিতৃলোকের হে পূর্বপুরুষেরা,রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পিতৃলোকপ্রাপ্ত হে মারিবা, শেষতম খাঁটি দুম্বুইয়ার কপাল নিয়ে তোমাদের দুঃখ করার মুহূর্ত যথার্থ মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে।

অনুষ্ঠান চলতে লাগল। একদল খয়রাত করছে, অন্যেরা হাত পেতে নিচ্ছে। সকলেই বারবার করে মৃতের গুণগান করছে: মানুষকে ভালোবাসা, ধর্মবিশ্বাস, অতিথি সেবা; এমনকি একজন প্রতিবেশী স্মরণ করিয়ে দিল, একদিন রাতে মৃত লোকটি তাকে একটা কাপড় আর জাঙিয়া এনে দিয়েছিল। ঐ কাপড় আর জাঙিয়া ছিল তার মেয়েছেলের (যথার্থভাবে বলতে গেলে ঐ প্রতিবেশীর ধর্মপত্নীর), হাওয়ায় ওগুলো মৃত লোকটির খাটের তলায় উড়ে গিয়েছিল। তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিল: চারপাশের মুখগুলো আর শক্ত হয়ে থাকল না, গালগল্পের ফাঁকে ফাঁকে হাসির উড়নতুবড়ি ফাটতে থাকল। একমাত্র ফামা ওতে হাসল না। পকেটে টাকার নোট আর অন্তরে সত্যি কথা বলার হক নিয়েও তার রাগ পড়ে নি ও মনে মনে গজরাচ্ছিল।

হারামের হারামি। ও ফামা, দুম্বুইয়াদের বংশধর, ওকে নিয়ে মস্করা করছে, ওকে তাতাচ্ছে,গালিগালাজ করছে, কে ? না এক বান্দার বাচ্চা, ও ঘুরে তাকাল। বাম্বা ঠোঁটদুটো কোঁচকাচ্ছে কামড়াচ্ছে, ড্যাবা ড্যাবা চোখদুটো ঘুরিয়ে যাচ্ছে, ওর ছুটে আসা ঘোড়ার নাকের ফুটোদুটো ফোঁসফোঁস করছে, টানটান শরীর, হাতপাগুলো গোলগাল, গাঁটওয়ালা, ঢেঁকির খিলের মত। আর ফামার মনে প্রশ্ন জাগল যে বাম্বাকে লড়াইয়ে আহ্বান করার পক্ষে ওর বয়েসটা কি যথেষ্ট বেশি হয়ে যায় নি। তবে ফামা তার সৎ অভ্যেসগুলো ছাড়ে নি, মরদ আর তার হাতিয়ার কখনো আলাদা হয় না। ও পকেট হাতড়ে দেখে নিল চাকুটা যথাস্থানেই রয়েছে ; কুত্তার বাচ্চার নাড়িভুঁড়ি ফাঁসিয়ে চারদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে দেওয়ার পক্ষে ওটা যাথেষ্টই লম্বা। এবার তাহলে বাম্বা ফিরে আসুক, ফের শুরু করুক, ও টের পাবে দাঁত পড়ে গেলেও হায়নার মুখটা কখনো ছাগলছানার যাতায়াতের সড়ক হয়ে উঠতে পারে না।

হাসির ফোয়ারা, ফামা কান পাতে। একটুও রাগ না পড়া, এতটুকু ক্ষমা না করাটা ওর পক্ষে সমীচীন, গাধার বাচ্চা গ্রিয়োটা মৃতের গুণকীর্তনের মধ্যে বিষাক্ত সব শ্লেষ মিশিয়ে দিচ্ছিল:কাঙালিপনা, খেয়োখেয়ি আর বেইজ্জতির মধ্যে যারা বেশ্যাবৃত্তি করছে সেই মহান বীরের বংশের বংশধরদের সঙ্গে গোরে যাওয়া লোকটির সম্পর্কটা কি ? বেজাত কুত্তার বাচ্চা ! খাঁটি গ্রিয়োদের,শেষতম জাত গ্রিয়োদের সামোরির মহান সেনাপতিদের সঙ্গে গোর দেওয়া হয়েছে। সামনের ঐ প্যাঁকপ্যাঁক করিয়েটা না জানে গান গাইতে , না কথা বলতে, না কারো কথা শুনতে। গ্রিয়োটা বকে যাচ্ছিল, এমনকি জায়গা পাল্টে সে একটা থামের আড়ালে ঠাঁই নিয়েছিল। তার মতো বেহায়ার কাছে একটা থাম নদী কি পর্বতের মতোই পাঁচিল বলে গণ্য হতে পারে। আর এরপর সে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে তাবৎ গন্ডি পার হয়ে গেল: মহান বীরদের বংশধরেরা (ফামা !) মিথ্যের বেসাতি আর কাঙালিপনা করে পেট চালায় (আবার ফামা !) মহান নায়কদের সাচ্চা বংশধরেরা(সারাক্ষণ ফামা !) মানইজ্জতের বদলে শকুনের পালক পরে নেয়েছে। ওরা খোঁজ করতে থাকে যে কোনো একটা উপলক্ষে রান্নার গন্ধ: জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে ; অনুষ্ঠান থেকে অনুষ্ঠানে লাফিয়ে যেতে চায় । জবাব দেবার জন্যে ফামা বুবুটা গুটিয়ে নিল। ও একটুখানি ইতস্তত করছিল। তড়িৎ প্রতিক্রিয়ার অভাবটা হতচ্ছাড়া গ্রিয়োর কাছে একটা আমন্ত্রণ বলে গণ্য হল। সে যার পর নেই অভব্য ইতরামি শুরু করল, বাম্বা মনের আনন্দে ঢোলের দলে সামিল হল।

না, তাহলেও। ফামা উঠে দাঁড়াল, বাধা দিল:

মুসলমানরা, ক্ষমা কর, মুসলমানরা শোন।

একটিমাত্র শব্দ যোগ করাও অসম্ভব। গরম খাওয়া কুত্তার পাল। নিজেদের যারা মুসলমান বলে পরিচয় দেয় সেই বসে থাকা হতচ্ছাড়া মাল্যাঁকেরা খেঁকিয়ে উঠল, দাঁত আর গালিগালাজ খিঁচিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। গন্ডিটা পেরিয়ে গেছে।

লজ্জা আর অপমানে চুপসে যাওয়া ফামা কী করে আর সেখানে থাকতে পারে ? তাছাড়া ওর কোনো অনুতাপ হচ্ছিল না। অনুষ্ঠান নিচে নামতে নামতে বাঁদরনাচে পরিণত হয়েছে। অতএব বাঁদরগুলোকে কামড়াকামড়ি আর লেজ টানাটানি করতে দাও। ও বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল। দুজন লোক ওকে ধরে রাখতে ছুটে এল। ও ধ্বস্তাধ্বস্তি করে লোক দুটোকে হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা বলে বেরিয়ে গেল।

মজা পাওয়ার হাসি। উহ্ ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ! এমন একটা হৈ হৈ করা চুড়ান্ত প্রস্থানের শুধু এতটুকুই প্রতিক্রিয়া । রাজধানীর তাবৎ মাল্যাঁকে অনুষ্ঠানের মতো এর পরের অনুষ্ঠানগুলোতেও ফামার দেখা পাওয়া যাবে; এটাতো জানা কথা ; কেননা কে কোথায় দেখেছে যে হায়না গোরস্থানের আশপাশ ছেড়ে কি শকুন কুঁড়েঘরের পেছন ছেড়ে চলে গেছে । এটাও সবার জানা যে ফামা ঝামেলা করবে আর আরো লজ্জা দেবে। কেননা কোনো জমায়েতে ডালকুত্তা কি তার বেহায়া বসার ধরন ছেড়ে দিতে পারে ?

প্রসঙ্গত

মাল্যাঁকে (Malinké বা Mandingue,বা Mandinka, বা Mandingo, বা Mandé, বা Maninka ) উপজাতি হল পশ্চিম আফ্রিকার একটি জনগোষ্ঠী যারা আজ ছড়িয়ে রয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে । এরা রয়েছে প্রধানত মালি আর গিনিতে, এছাড়া সেনেগাল, বুর্কিনাফাসো, আইভরি কোস্ট আর গিনেবিসোতে।

উপন্যাসের উপস্থাপিত অংশে যে শহরের কথা বলা হয়েছে তা আবিদজঁ (Abidjan)। আইভরি কোস্টএর এই বন্দরশহরটি ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে ১৯৩৪থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আর স্বাধীনতার পর (১৯৬০) ১৯৮৩ অব্দি আইভরি কোস্টএর রাজধানী ছিল। এর পর থেকে ইয়ামুসুক্রো (Yamoussoukro) আইভরি কোস্টএর প্রশাসনিক রাজধানী হলেও অর্থনৈতিকরাজনৈতিক গুরুত্বে আবিদজঁ এখনও আইভরি কোস্টএর প্রধান শহর। কুরুমার বর্তমান উপন্যাস যখন লেখা হয় বা প্রকাশিত হয় তখন আবিদজঁ আইভরি কোস্টএর অদ্বিতীয় রাজধানী।

এই উপন্যাসে কুরুমার অন্যান্য রচনার মতো মাল্যাঁকে শব্দ বা বাগধারাকে ফরাসির সঙ্গে মিশিয়ে এক ধরনের ভাষাসংকরের সৃষ্টি করেছেন যা তাঁর কাহিনিকথনকে অন্যতর চরিত্র দিয়েছে । রচনার প্রান্তিক ঔপরাচনিক উপাদান শিরোনামে Les soleils des indépendances = স্বাধীনতার সূর্যগুলি soleil(সূর্য) আর indépendance (স্বাধীনতা) শব্দের বহুবচন এই ভাষাসাংকর্ষ সম্পর্কে পাঠককে সচেতন করে দেয়। সন্ধানী পাঠকের সক্রিয় পঠন আবিষ্কার করে শিরোনাম বা রচনার ভাষাশরীরে মাল্যাঁকেভাষার ফরাসি শব্দানুবাদ যেমন শিরোনাম বা আরম্ভের প্রথম বাক্যের অংশ (Koné Ibrahima avait fini কোনে ইব্রাহিমা শেষ করে ফেলেছিল) পাঠককে অন্য এক জগতে প্রবেশে উদ্বুদ্ধ করে। কুরুমার উপন্যাসগুলিতে মাল্যাঁকেদের মৌখিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যে মৌখিক কাহিনিকথনের আদল অনুভব করা যায়, ভাষাসাংকর্ষ এই অনুভবকে উদ্বোধন করে।

মাল্যাঁকে সমাজ শ্রেণীবিভক্ত সবার ওপরে অভিজাত শ্রেণী এঁদের পদবির আগে হোরো (শ্রদ্ধেয়) ব্যবহৃত হয়।এর পর রয়েছে একাধিক জাত: গ্রিয়ো, কামার, মুচি এর পর জাতহীন মাল্যাঁকে সমাজে গৃহীত অমাল্যাঁকেরা। মৌখিক সংস্কৃতির জগতের মানুষ মাল্যাঁকেদের ইতিহাস: ঐতিহ্য, রীতিনীতি, পুরাণের প্রতিকী রূপান্তরে অতীতের কথা গেয়ে শোনায় কথকগায়ক গ্রিয়োরা, সে ইতিহাস অবশ্য সনতারিখের তালিকাওয়ালা পাশ্চাত্য ছাদের ইতিহাস নয়। মাল্যাঁকেদের মধ্যে অতীতে গড়ে ওঠা ব্যবসায়ী শ্রেণীকে বলা হয় দিউলা।