কবিতার অন্তিক ও দূরান্তিক অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত TRANSLATING POETRY: PROXIMAL AND DISTAL TRANSLATION / TRADUIRE LA POESIE: TRADUCTION PROXIMALE ET DISTALE: PUSHKAR DASGUPTA

অনুবাদ

কবিতার অনুবাদ

সামাজিকসাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত:অন্তিক ও দূরান্তিক অনুবাদ

পুষ্কর দাশগুপ্ত

কবিতার দূরান্তিক অনুবাদ PDF

পরাসাংস্কৃতিকতা(transculturality)প্রতিটি জীবন্ত সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত চরিত্রের অন্যতম মৌল উপাদান। সংস্কৃতির চারিত্রিক ধর্ম এই পরাসাংস্কৃতিকতা বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগের, বিভিন্ন স্তরে আদানপ্রদানের প্রণালী বা গতিপথ তৈরি করে। এই পথ ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক উপাদানের সঞ্চালন (circulation)অর্থা সম্প্রেষণ (emission)ও পরিগ্রহণ (reception) সম্পাদিত হয়, যার পরিণাম হল প্রতিটি সংস্কৃতির মধ্যে সাংস্কৃতিক বহুস্বরের (polyphony)অস্তিত্ব। এই বহুস্বর সংস্কৃতির জীবনের লক্ষণ, একস্বর (monophony) বা তার প্রবণতা সংস্কৃতির বিবর্তনহীন জড়তার, আসন্ন মৃত্যুর ঘোষণা। অন্যদিকে এই পরাসাংস্কৃতিক সংজ্ঞাপনের Communication)ফলশ্রুতিতে প্রতিটি সংস্কৃতি আন্তঃসাংস্কৃতিকতার(interculturality) দ্বারা চিহ্নিত হয়। বিদেশি সাহিত্য অন্যতম সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে সম্প্রেষণ ও পরিগ্রহণের মাধ্যমে কোনো ভাষার সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক (intercultural) আন্তঃরাচনিক (intertextual) উপাদান হয়ে ওঠে। বিদেশি সাহিত্য পঠনলিখন (উদ্বিহিতি/decodingউপলব্ধি+নিজের ভাষায় পুনর্সংবিহিতি/re-encoding + পুনর্নির্মাণ) আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্প্রেষণ ও পরিগ্রহণের একটা রূপ। তাই আমরা বলতে পারি বিদেশি কবিতার পঠন (reading)নির্ভর লিখন (writing) অর্থা অনুবাদ প্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে, আর মানুষের সংস্কৃতির বর্তমান রূপ যদি কখনো একেবারে পালটে না যায় তাহলে সাহিত্যের/কবিতার অনুবাদ ভবিষ্যতেও হবে আর পাঠকও অজানা বিদেশি ভাষার কবিতার অনুবাদ পড়বে।

কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে তীর্থরেণু’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন: : ‘এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি — আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে — ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টিকার্য।’ কান্তিচন্দ্র ঘোষের ওমর খৈয়ামের অনুবাদ পড়ে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘ভাল কবিতা মাত্রকেই তর্জ্জমায় নূতন করে সৃষ্টি করা দরকার। … মূল কাব্যের এই রসলীলা যে তুমি বাংলা ছন্দে এমন সহজে বহমান করতে পেরেচ এতে তোমার বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েচে। কবিতা লাজুক বধুর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙেচ,তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে’ সুধীন্দ্রনাথ তাঁর অনূদিত কবিতার সংকলন প্রতিধ্বনির ভূমিকায় লিখেছেন: আমার মতে কাব্য যেহেতু উক্তি ও উপলব্ধির অদ্বৈত, তাই আমি এও মানতে বাধ্য যে তার রূপান্তর অসম্ভব;…।’বিষ্ণু দে তাঁর অনূদিত কবিতার সংকলন হে বিদেশি ফুলএর মুখবন্ধে জানিয়েছেন:যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি মূল কবিতার বিন্যাস, ছন্দ বা নিদেনপক্ষে মেজাজ অনুবাদের আভাসে রক্ষা করাসুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘অন্য দেশের কবিতা’ নামে তাঁর অনূদিত বিদেশি কবিতার সংকলনের ভূমিকায় লিখেছেন: ‘এ বইতে যাঁরা বিশুদ্ধ কবিতাররস খুঁজতে যাবেন, তাঁদের নিরাশ হওয়ার সম্ভাবনাই খুব বেশি। এই বইতে কবিতা নেই আছে অনুবাদ কবিতাআমি এতগুলি কবিতার অনুবাদক তবু আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, অনুবাদ কবিতার পক্ষে কিছুতেই বিশুদ্ধ কবিতা হওয়া সম্ভব নয়, কখনো হয়নি। কবিতার সংজ্ঞা, ব্রহ্মেরই মতন, অনুচ্ছিষ্ট… ’ ‘বহুল দেবতা বহু স্বর’ শঙ্খ ঘোষের অনূদিত কবিতার এই সংকলনে কবিঅনুবাদক জানিয়েছেন, ‘অনেকের মতো আমিও একথা জানি যে কবিতার ঠিক ঠিক অনুবাদ হয় নাএসব লেখাকে অনুবাদ না বলে অনুসর্জন বলাই কি তাই সংগত ?’ শরকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ব়্যাবোঁ , ভের্লেন ও নিজস্ব বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন:‘অনুবাদকর্মে আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল যতদূর সম্ভব মূলের বিন্যাস ছন্দ রক্ষা করে কবির অনুভবটি বাংলায় সঞ্চারিত করা। তারপর সুনীলবাবু কেন (ইংরেজি) অনুবাদ থেকে (অইংরেজি) কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন তা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কবিতার অনুবাদ গুণ সম্পর্কে ঘোরতর অবিশ্বাসী’ হয়েও কেন বিদেশি কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন। শেষ পর্যন্ত অনুবাদক বলেছেন, যে তিনি ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের নির্দেশে ওই অনুবাদ করেছেন।(সর্বত্র নিম্নরেখা আমাদের),

এই উক্তিগুলির মধ্যে আমরা বাংলাভাযায় কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ এবং কয়েকজন পরিচিত কবিঅনুবাদকের চিন্তা বা ধারণার পরিচয় পাই। এই ধারণাগুলি হল কবিতার অনুবাদ :

. সৃষ্টিকার্য,নূতন করে সৃষ্টি করা (রবীন্দ্রনাথ), অনুসর্জন( শঙ্খ ঘোষ);

. অসম্ভব(সুধীন্দ্রনাথ), কবিতার অনুবাদ গুণ সম্পর্কে ঘোরতর অবিশ্বাসী(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়), কবিতার ঠিক ঠিক অনুবাদ হয় না ( শঙ্খ ঘোষ);

. অনুবাদের পদ্ধতি:মূল কবিতার বিন্যাস, ছন্দ বা নিদেনপক্ষে মেজাজ অনুবাদের আভাসে রক্ষা করা (বিষ্ণু দে), মূলের ছন্দ রক্ষা করে কবির অনুভবটি বাংলায় সঞ্চারিত করা(শরকুমার মুখোপাধ্যায় )

উদ্ধৃতিগুলিতে প্রথমত দেখতে পাই কবিতার যথার্থ অনুবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ধারণা ও উচ্চারণ :জন্মান্তর প্রাপ্তি — আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিতইহা সৃষ্টিকার্য।’ তর্জ্জমায় নূতন করে সৃষ্টি করা দরকার। … মূল কাব্যের রসলীলাতুমি বাংলা ছন্দে বহমান করতে পেরেচ । কবিতা লাজুক বধুর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙেচ,তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে।শঙ্খ ঘোষের অনুসর্জন । কবিতার অনুবাদ করলেও অনুবাদে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হলেন সুধীন্দ্রনাথ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আর শঙ্খ ঘোষ না তবে হ্যাঁ অর্থা মধ্যপন্থী। তবে সুনীলের ‘বিশুদ্ধ কবিতা’, কবিতার সংজ্ঞা ব্রহ্মেরই মতন, অনুচ্ছিষ্ট, বিশুদ্ধ কবিতার রস’ ইত্যাদি শব্দব্যবহারে আধুনিকসুধীন্দ্রনাথ আর রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের মিশ্রণ অনুভব করা যায় । বিষ্ণু দে আর শরকুমার মুখোপাধ্যায় মূলের ছন্দ রক্ষা করার কথা বলেছেন। কিন্তু প্রতিটি ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক সংস্থানের সঙ্গে ওই ভাষার ছন্দসংস্থানের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। অতএব ভাষান্তরে কীভাবে মূলের ছন্দ রক্ষা করা যায় তা আমরা বুঝতে পারি নি । ইংরেজি আইয়াম্বিক পেন্টামিটার (Iambic pentameter), কোরিয়াম (choriamb), বা ফরাসি পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ মিলের পরম্পরা (alternance) ইত্যাদি কিভাবে বাংলা অনুবাদে ‘রক্ষা করা ’ যায় তা আমরা জানি না। বেশির ভাগ অনুবাদ কবিতার সংকলনে মোটামুটি এ ধরনের বাচনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

আর সংকলনগুলির আলোচনা বা সমালোচনায় প্রশংসা করে বলা হয় ‘স্বচ্ছন্দ অনুবাদ’, ‘অনুবাদকের নিজস্ব কবিতা’ বলে মনে হয়, ‘মূলের ছন্দ’ (?) অক্ষুণ্ণ রয়েছে। নিন্দা করে বলা হয় ‘আড়ষ্ট’, ‘আক্ষরিকভাবে মূলানুগ রাখতে যাওয়ায় অনুবাদ বাংলায় কবিতা বলে বোধ হয় না’ ইত্যাদি। প্রমথ চৌধুরী কান্তিচন্দ্র ঘোষের ওমর খৈয়ামের অনুবাদগ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন:ওমর খৈয়ামের এত স্বচ্ছন্দ সলীল অনুবাদ আমি বাঙলা ভাষায় ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি।

কিন্তু এসব আলোচনায় অনুবাদের ভাষাতাত্ত্বিক সমস্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশ্রিত সামাজিকসাংস্কৃতিক সমস্যার কথা কেউ বলেন না। মনে হয় সেরকম কোনো সমস্যাই যেন নেই। এর বাইরে বাংলা ভাষায় সাহিত্যের/ কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে কোনো তাত্ত্বিক আলোচনা দেখা যায় না, অর্থাৎ বাংলা ভাষায় সাহিত্যের/ কবিতার অনুবাদতত্ত্বের কোনো অস্তিত্ব নেই। ইংরেজিতে যাঁরা সাহিত্যের/ কবিতার অনুবাদ নিয়ে গবেষণা (Translation Studies) করেন তাঁরা সাহেবদের আকর বইপত্রের বাইরে যান না। সাহেবদের আলোচনায় ইয়োরোপের বিভিন্ন ভাষায় পারস্পরিক অনুবাদের সমস্যার আলোচনা থাকে, অন্য সমাজ, অন্য সংস্কৃতি, অন্য আবহের কোনো ভাষা থেকে বা ভাষায় সাহিত্যের/ কবিতার সৃজনশীল বাচনের অনুবাদের সামাজিকসাংস্কৃতিক সমস্যা তাদের আলোচনার বাইরে। সাহিত্যের/ কবিতার ভাষিক সংগঠনের মধ্যে ইতিহাস, ভূগোল, পরিবেশ, সামাজ আর সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে রয়েছে আর তা বাচনের ব্যঙ্গার্থের উপাদান হিসেবে ক্রিয়াশীল। এ নিয়ে অনুবাদক বা তথাকথিত আলোচকরা আলোচনা করেন না। নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের, ইয়োরোপীয় গ্রেকোরোমান, জুডিওখ্রিস্টান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী, ফ্রান্সের ল্যাটিন ফরাসি ভাষা, অ্যাংগ্লোস্যাক্সন ইংরেজিভাষা আর পূর্বভারতীয়, উষ্ণ মৌসুমী অঞ্চলের, ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুবৌদ্ধলৌকিকঐস্লামিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ইন্দোইরানীয় বাংলা ভাষার সামাজিকসাংস্কৃতিক দূরত্ব বিরাট। এই দূরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার তথা শব্দসম্ভারের পার্থক্য (ইতিহাস, পশু,পাখি, গাছপালা, আচার, রীতিনীতি , খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ইত্যাদি) আর তার বাচক, লক্ষক অথবা ব্যঞ্জক অর্থপরিধির পার্থক্যের পরিমাপে ইংরেজি বা ফরাসি থেকে বাংলা বা হিন্দিতে সাহিত্যের/ কবিতার অনুবাদের সমস্যা ইংরেজি থেকে ফরাসি বা হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদের সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দূরত্বের ভিত্তিতে পূর্বোল্লিখিত প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণীর অনুবাদকে আমরা যথাক্রমে দূরান্তিক ও অন্তিক অনুবাদ বলে অভিহিত করছি। পারিভাষিক শব্দ বাংলায় হলে যিনি বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষাই জানেন না, তিনিও খুব একটা স্বস্তি পান না, সন্দেহের দৃষ্টিতে আড়চোখে তাকান। তাই বন্ধনীতে ঝট করে দুটো ল্যাটিনমূল শব্দ বসিয়েদিলাম: অন্তিক (Proximal), দূরান্তিক(Distal) । এই মুখবন্ধটি

.) রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের করা দুটি বাংলা অনুবাদে ভিক্তর য়ুগোQuia pulvis esকবিতার শিরোনামের পরিবর্তন.)টি. এস. এলিয়টএর Ash Wednesdayকবিতার বিষ্ণু দের করা বাংলা অনুবাদের প্রথম ন পংক্তি .) William Radiceর করা রবীন্দ্রনাথের নববর্ষা’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদের একটি স্তবক.) স্তেফান মালার্মের Brise marine কবিতার সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে আর তুষার চৌধুরির করা বাংলা অনুবাদের প্রথম চার পংক্তি;.) বুদ্ধদেব বসুর করা বোদলেরএর Les Litanies de Satan বাংলা অনুবাদের ছ পংক্তি

এইপাঁচটি দৃষ্টান্তের বিশ্লেষণের মাধ্যমে কবিতার দূরান্তিক অনুবাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার উপস্থাপনা।

আসলে বহু বছর আগে কবিতার অনুবাদ ও আরো দুটি প্রবন্ধ নামে আমার একটি বই বেরিয়েছিল। বইটাতে প্রকাশক হিসেবে রক্তকরবীর নাম থাকলেও বইটা বেরিয়েছিল আমার নিজের খরচে। বইটা কেউ পড়েছিল কিনা, বইয়ের দু চার কপি বিক্রি হয়েছিল কিনা জানি না। সে বইটা আর কোথাও পাওয়া যায় না, তবু আর কখনো বেরুবে না জেনেও পুরো বইটা নতুন করে লিখেছি। যে বই কখনো আর প্রকাশিত হবেনা তারই নতুন শেষ অধ্যায় হল কবিতার দূরান্তিক অনুবাদ। 

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত: নির্বাচিত ফরাসি কবিতার বাংলা অনুবাদ//SATYENDRANATH DATTA : Choix de poèmes français traduits en bengali// SATYENDRANATH DATTA : Selected French Poems translated into Bengali.

 সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নির্বাচিত ফরাসি কবিতার বাংলা অনুবাদ

PDF

Choix de poèmes français traduits en bengali.// সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নির্বাচিত ফরাসি কবিতার বাংলা অনুবাদ

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২১৯২২)

ফরাসি কবিতার অনুবাদ

বাংলা কবিতার ইতিহাসে যে সময়টাকে রবীন্দ্রযুগ বলে চিহ্নিত করা হয় সে সময়ের বেশির ভাগ বাংলাভাষার কবি রবীন্দ্রনাথের লিখনের মাধ্যমে গড়ে তোলা, নির্ধারিত আর প্রতিষ্ঠিত রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার সীমার মধ্যে আবদ্ধ থেকেছেন। রবীন্দ্রানুসারী কবি বলে পরিচিত এই কবিগোষ্ঠী মহীরূহ রবীন্দ্রনাথের ছায়ার আশ্রয়ে থেকে আশ্বস্ত হয়েছেন, কবিতার ভাব ও ভাষাব্যবহারে রাবীন্দ্রিক জগতের বাইরে পা বাড়ানোর সাহস অর্জন করেন নি। কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচি, মোহিতলাল মজুমদার, গোলাম মোস্তাফা রবীন্দ্রানুসারী এই কবিরা তাঁদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু ভালো কবিতা যে লেখেন নি এমন নয়। কিন্তু ইতিহাসবিরোধী বাঙালি তাঁদের ভুলে গেছে। এঁদের পাশাপাশি যে বাঙালি কবিরা নিজস্ব লিখনের সন্ধানের মাধ্যমে রবীন্দ্রানুসারী মণ্ডলের বাইরে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তাঁরা হলেন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়। খেয়ালি কল্পনা, ভাষার তথা শব্দের (সংকেতকের) সঙ্গে অর্থ বা সংকেতিতের সম্পর্কের স্বেচ্ছাচারকে দেখানো আর ভাষাব্যবহারে তথাকথিত যুক্তি ভাঙার মাধ্যমে সুকুমার রায়ের রচনা বাংলা ভাষায় অনন্য, তা আমাদের আন্তঃরাচনিক সূত্রে তাঁর রচনা লুইস ক্যরলএর ( Lewis Carroll,আসল নাম:Charles Lutwidge Dodgsonunder, ১৮৩৮১৮৯৮)জাদুর দেশে অ্যালিসএর অভিজ্ঞতা(Alice in Wonderlandনামে পরিচিত Alice’s Adventures in Wonderland, ১৮৬৫), এডওয়ার্ড লিয়ার এর (Edward Lear, ১৮১২১৮৮৮) কবিতার কথা একআধটু স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে তাঁর ভাষাব্যবহারে আমরা তাঁর বহু পরবর্তী বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের তেআর্ত দ লাবস্যুর্দ আন্দোলনে স্যামুয়েল বেকেট (Samuel Beckett,১৯০৬১৯৮৯), য়্যোজেন ইয়োনেস্কো(Eugène Ionesco, ১৯০৯১৯৯৪), আর্ত্যুর আদামভ (Arthur Adamov, ১৯০৮১৯৭০), ইত্যাদির নাটকের ভাষাচিন্তার পূর্বাভাষ দেখতে পাই। তাঁর এই ভাষাব্যবহার অসচেতন নয় তা তাঁর প্রবন্ধ ভাষার অত্যাচার (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২২, মেজুন ১৯১৫)পড়লেই বোঝা যায়। সুকুমার রায়ের সৃষ্টিকর্মের প্রতি অবিচারের কথা স্মরণ করে আমরা আমরা আমাদের আলোচনার সীমা লঙ্ঘন করে সুকুমার রায়ের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি:

কতকগুলা কৃত্রিম অযৌক্তিক ধ্বনির সংযোগে কেমন করিয়া আমার মনের নাড়ীনক্ষত্র সমস্ত দশজনের কাছে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, তাহার সূত্রান্বেষণ করিতে গেলে মনে হইতে পারে যে এত বড় আজগুবি কাণ্ড বুঝি আর কিছ্ নাই।নামের সঙ্গে নামীর সাদৃশ্য বা সম্পর্ক যে কোথায় তাহা আজ পর্যন্ত কেহ নির্দেশ করিতে পারে নাই।সুতরাং বলিতে হয়, ভাষা জিনিসটা গোড়া হইতে একটা কৃত্রিমতার কারবার ।

বাংলা কবিতার ওই রবীন্দ্রযুগে সুকুমার রায় সম্পূ্র্ণ আলাদা, তাঁর লিখনে রবীন্দ্রনাথ কোথাও নেই। কিন্তু রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতায় লালিত কাব্যচিন্তায় বাঙালি অধ্যাপক সমালোচকরা সুকুমার রায়কে শিশুসাহিত্যিক মার্কা মেরে আলাদা করে রেখেছেন। আর যাঁরা নিজস্ব লিখন খুঁজছিলেন তাঁদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কবি কিন্তু কবিতার ইঞ্জিনিয়ার নন, নজরুল আবেগের উচ্ছ্বাস আর দেশপ্রেমে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও নিজস্ব শিল্পিত লিখনের গুরুত্বপূর্ণ আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ যে সূচকের শব্দব্যবহার, ব্রাহ্মভিক্টোরীয় মানসিকতা থেকে তত্সম শব্দব্যবহারের যে ভাষিক সীমাবদ্ধতা তৈরি করেন তা আজও বাংলা কবিতার আদর্শ। রবীন্দ্রপরিমণ্ডলে থেকেও কোনোরকম বিদ্রোহের ভণিতা না করেই সত্যেন্দ্রনাথ সেই সীমা অতিক্রম করে অরাবীন্দ্রিক নিজস্ব কাব্যিক লিখনের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তদ্ভব, দেশি ও ধ্বন্যাত্মক শব্দে সমৃদ্ধ ভাষাব্যবহারে আর লৌকিকপ্রাকৃতিক চিত্র রচনার মাধ্যমে (যেমন, মেঘের সীমায় রোদ জেগেছে আলতাপাটি সিম, চুপ চুপ ওই ডুব দেয় পানকৌটি দেয় ডুব টুপ টুপ ঘোমটার বৌটি, হাড় বেরুনো খেজুরগুলো ডাইনি যেন ঝামর চুলো,) তাঁর কিছু কবিতাকে ধ্বনিময়তা, ছন্দস্পন্দনে, তুলির লিখনে’ পরিণত করেছেনআমরা কবিতার পাঠককে বিদ্যায়তনিক সমালোকদের সমালোচনা ভুলে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথের যক্ষের নিবেদন, পালকির গান, দূরের পাল্লা, চরকার গান, গ্রীষ্মের সুর, ইলশে গুঁড়ি, পড়তে বলব। রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতায় লালিত ভাববাদী সমালোচকরা সত্যেন্দ্রনাথকে ছন্দের জাদুকর’ অভিধা দিয়ে তাঁর গুরুত্ব লাঘব করতে চেষ্টা করেছেন। ছন্দ কবিতার ভাষাশিল্পের অবিচ্ছেদ্য উপাদান, কবিতার তথাকথিত বিষয় বা বক্তব্যকে তার প্রকাশপদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। উনিশ শতকের ইংরেজি ভাববাদী সাহিত্যসমালোচনায় লালিত বাঙালি সমালোচক আর কবিতাপাঠক সুকুমার রায়ের অনন্য সৃজনশীল প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেন নি আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি অবিচার করেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস হল অনুবাদ বা আনুরাচনিক পরিগ্রহণের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য তথা কবিতাকে সমৃদ্ধ করা এবং তার আন্তঃরাচনিক দিগ্বলয়কে প্রসারিত করা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পাঁচ শ চল্লিশটি বিভিন্ন ভারতীয় ও বিদেশি ভাষার কবিতা বা কবিতাংশের অনুবাদ করেছিলেন। এই রচনাগুলি রয়েছে তাঁর তীর্থসলিল, ‘তীর্থরেণুমণিমঞ্জুষানামক তিনটি অনূদিত কবিতার সংকলনে৷ সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদের একটা বড় অংশ হল ফরাসি কবিতার অনুবাদ ৷ তিনি মোট আটষট্টিটি ফরাসি কবিতার বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।

প্রসঙ্গত এই অনুবাদের পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার। সত্যেন্দ্রনাথের আগে বাংলাভাষায় ফরাসি কবিতার অনুবাদ খুব একটা দেখা যায় না। মধুসূদনের নীতিগর্ভ কবিতাগুলির মধ্যে আটটি লা ফোঁতেনএর আটটি নীতিকবিতার অবলম্বনে লেখা। রসময় দত্তের খ্রিস্টধর্মান্তরিত ছেলেদের (অর্থাৎ তরু দত্তের বাবা গোবিন্দচন্দ্র দত্ত আর তাঁর ভাইদের) ইংরেজি রচনাসংগ্রহ The Dutt Family Album (London, Longman Green & Co, 1870) বইয়ে তাঁদের নিজেদের কবিতার সঙ্গে কয়েকটি জার্মান ও ছটি ফরাসি কবিতা ও কাব্যাংশের ইংরেজি অনুবাদ ছিল। এর পর বাঙালির ফরাসি সাহিত্যের পরিগ্রহণের ইতিহাসে যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নামটি মনে পড়ে তা হল তরু দত্তের(১৮৫৬১৮৭৭)A Sheaf Gleaned from the French Fields ( Calcutta, 1st edition, 1776, 2nd edition, 1778, London, 3rd edition, 1880) তরুর এই বইয়ে ৭৩জন ফরাসি কবির (প্রধানত উনিশ শতকের ) ১৯৪ টি ফরাসি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে, তার মধ্যে আটটি কবিতার অনুবাদ তরুর দিদি অরুর, একটি অনুবাদ তরুর বাবা গোবিন্দ চন্দ্র দত্তের। বইয়ের শেষে ছিল সংক্ষিপ্ত টীকা। বিশ শতকের প্রথমে রবি দত্তের (১৮৮৩১৯১৭) Echoes from East and West (Cambridge, Gallway and Porter, 1909) ইংরেজিতে এই অনুবাদ কবিতা ও নিজের কবিতার সংকলনে সতেরোটি ফরাসি কবিতা এবং কাব্যাংশের অনুবাদ রয়েছে।বাঙালি তরু দত্ত এবং তার পরিবার, রবি দত্ত এঁদের সবারই ফরাসি কবিতার পরিগ্রহণের প্রকাশ ছিল ইংরেজি ভাষায় আনুরাচনিক সৃষ্টি। তা বাঙালির সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিকতার পরিধি প্রসারিত করলেও বাংলা ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে তার কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না।

এর পর বাঙালির ফরাসি কবিতার পরিগ্রহণের ইতিহাসে যাঁদের নাম করতে হয় তাঁরা  হলেন , জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯১৯২৫) প্রিয়নাথ সেন (১৮৫৪ ১৯১৬) , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১১৯৪১)ফরাসি কবিতার পরিগ্রহণের ফলশ্রুতি বাংলা ভাষায় আনুরাচনিক সৃষ্টি বাঙালির সংস্কৃতির আন্তঃসাংস্কৃতিকতার পরিধি প্রসারিত করে আর তারই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে বাংলা ভাষার সাহিত্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতায় আত্তীকৃত হয়তবে একথা মনে রাখা দরকার ইংরেজি রোমান্টিক কবিতা পড়া আর রবীন্দ্রযুগের শুরুর বাঙালিদের ফরাসি কবিতার অনুবাদ ও আলোচনায় প্রাধান্য লাভ করেছিলেন ভিক্তর য়ুগো(Victor Hugo, ১৮০২১৮৮৫)বা তাঁর সমসামায়িক দুএক জন রোমান্টিক কবি। রবীন্দ্রনাথ নিজে ভিক্তর য়ুগোর ছটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহী বন্ধু প্রিয়নাথ সেন রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় তাকে বারবার য়ুগোর ‘অনুধ্যান’(Les Contemplations) কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রিয়নাথ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় য়ুগোর কিছু কবিতারও অনুবাদও করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফরাসি থেকে অনুবাদের পরিমাণ বিপুল হলেও কবিতার অনুবাদ খুবই কম।জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বেশির ভাগ অনুবাদ অসংকলিত অবস্থায় ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁর যেসব কবিতার অনুবাদ আমাদের চোখে পড়েছে তা হল ভিক্তর য়ুগোর নটি কবিতা, ফ্রঁসোয়া কোপে(François Coppée,১৮৪২১৯০৮) দশটি কবিতা, স্যুলি প্র্যুদমএর (René-François SULLY PRUDHOMME,১৮৩৯১৯০৭) একটি কবিতা।

এর পাশাপাশি সত্যেন্দ্রনাথের ফরাসি কবিতার অনুবাদের পরিসর অনেক বিস্তৃত। তাঁর অনূদিত আটষট্টি ফরাসি কবিতার কবিদের মধ্যে চব্বিশ জন ফরাসি, সাত জন বেলজিয়ান। এছাড়া রয়েছে অজ্ঞাতনামা কবির চারটি আর দক্ষিণ ফ্রান্সের উপভাষায় লেখা পাঁচটি কবিতা।

সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদ কবিতার দ্বিতীয় সংকলন তীর্থরেণু’ পড়ে একটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন: ‘এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি — আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে — ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টিকার্য। ’ সাহিত্যিক রচনা বা তার অনুবাদ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হল তা শুধুমাত্র শিল্পকার্য বা শুধুমাত্র সৃষ্টিকার্য এর কোনোটাই নয়, সাহিত্যিক রচনা বা তার অনুরচনা অবিভাজ্যভাবে শিল্পকার্যময় সৃষ্টিকর্ম। সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদ , বর্তমান ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথের ফরাসি কবিতার অনুবাদের মূল্যায়নে আমরা বিভিন্ন মানের অনুবাদের সাক্ষা পাই।

১৯১০ সালে সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদকবিতার দ্বিতীয় সংকলন তীর্থরেণু’ বইয়ে আমরা আধুনিক ইয়োরোপীয় কবিতার উদ্গাতা বোদলেরএর দুটো সম্পূর্ণ কবিতা (Abel etCaïn/সুয়ো আর দুয়ো, Harmonie du soir/সন্ধ্যার সুর) আর দুটো কবিতার (?/জ্ঞানপাপী, Le Voyage/কা বার্ত্তা) আংশিক অনুবাদ দেখতে পাই। ইহুদি তথা খিস্টীয় ধর্মগ্রন্থ বাইবেলএর সৃষ্টি’ খণ্ডের আদম ও হাওয়ার দুই পুত্র এইবেল ও কেনএর কাহিনির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত Abel etCaïn (এইবেল ও কেন) কবিতাটি । বোদলেরএর অমঙ্গলের ফুল কাব্যের ‘বিদ্রোহ’ অংশের তিনটি কবিতার দ্বিতীয় কবিতা ।এই কবিতায় স্বৈরাচারী ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বোদলেরএর বিদ্রোহের প্রতীক হল কেন। স্মরণীয় উক্ত কাব্যের ‘বিদ্রোহ’ অংশের তৃতীয় কবিতা হল ঈশ্বরবিরোধী শয়তানের স্তব’। সামাজিকসাংস্কৃতিক স্থানীয় করণ তার ব্যঙ্গার্থকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করেছে , আংশিক অনুবাদ প্ররচনার প্রসঙ্গ বা ব্যঞ্জনা কোনোটাই প্রকাশ করে না। একমাত্র ‘সন্ধ্যার সুর’ অনুরচনাটি প্ররচনার রোমান্টিক ধ্বনিময়তার সার্থক প্রতিরূপ নির্মাণ করতে পেরেছে, কিন্তু সবগুলি অনুরচনা বোদলেরএর আধুনিকতা সম্পর্কে কোনো ধারণা দেয় না, বরঞ্চ তার একটা রোমান্টিক রূপান্তর উপস্থাপিত করে। বইয়ের শেষে টীকায় সত্যেন্দ্রনাথ বোদলেরএর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন “ফরাসি কবি; ইনি ‘সুন্দরকে মন্দ’ দেখিতেন না, কিন্তু ‘মন্দকে সুন্দর’ দেখিতেন। ইঁহাকে বীভত্স রসের কবি বলা যাইতে পারে।” এই মন্তব্য তাঁর ভাববাদী অনৈতিহাসিক পঠনের নির্দেশক। তবু ভিক্তর য়ুগো, আলফ্রেদ দ ম্যুসে, লকোঁ দ লিল, জোজেমারি এরেদিয়ার একাধিক কবিতা আর পল ভের্লেনএর ‘শিশিরের গান’এর অনুবাদগুলি অনূদিত কবিতা হিসেবে কমবেশি সার্থক বলে আমাদের মনে হয়েছে

এখন শেষ একটা প্রশ্ন:সত্যেন্দ্রনাথ কি ফরাসি জানতেন?অর্থা তিনি কি ফরাসি কবিতাগুলি ফরাসি থেকে অনুবাদ করেছেন, না ওগুলি ইংরেজি অনুবাদের অনুবাদ ? সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংবাদিক অমল হোম,অমর অনুবাদক সত্যেন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের মতে সত্যেন্দ্রনাথ ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন। অনুবাদগুলি পড়তে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে ১. য়ুগোর ‘জিন’ আর পল ভের্লেনএর ‘শিশিরের গান’ এই অনুরচনাদুটিতে অনুরচয়িতা যেভাবে উত্সকবিতার ধ্বনিসংস্থানের সার্থক প্রতিরূপ গড়ে তুলেছেন তা উত্সকবিতার পঠন ছাড়া সম্ভব নয়। ২. সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্কেতগীতিকা নামে অনুরচনা প্রসঙ্গে সুধাকর চট্টোপাধ্যায় বলেছেন উক্ত রচনাটি য়ুগোAutre Chanson কবিতার তরু দত্ত কৃত ইংরেজি অনুবাদ Mornimg Serenade-এর অনুবাদ। আমরা ব্যাপারটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম সুধাকর চট্টোপাধ্যায় যে ইংরেজি অনুবাদটি উদ্ধৃত করেছেন তার অনুবাদিকা তরু নন, তাঁর দিদি অরু। তবে অরু যেখানে মূলানুগ সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ অনেকটা সরে গেছেন, আবার তবে অরু যেখানে অনেকটা সরে গেছেন সত্যেন্দ্রনাথ সেখানে মূলানুগ। এই ব্যাপারটাও সত্যেন্দ্রনাথের অনুরচনার সঙ্গে উত্সকবিতার প্রত্যক্ষ সংযোগ স্পষ্ট করে ৩. অনুবাদে দুএকটা বিশেষ ভাষিক সংগঠন বোঝার ভুল (পরিবর্তন নয় ভুল) অনুরচনার সঙ্গে উত্সকবিতার প্রত্যক্ষ সংযোগ স্পষ্ট করে। ৪. আবার প্রতিবর্ণীকরণ আর টীকা থেকে যা বোঝা যায় তার ভিত্তিতে আমাদের অনুমাননির্ভর ধারণা হল সত্যেন্দ্রনাথ ফরাসি পড়তে পারতেন তবে তিনি বিদ্যায়তনিক শৃঙ্খলা মেনে তা শেখেন নি ।

বর্তমান সংকলনে আমরা পূর্বোক্ত তিনটি সংকলনে ছডিয়ে থাকা ফরাসি কবিতার অনুবাদগুলিকে একসঙ্গে উপস্থাপিত করছি। এই কবিতাগুলি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পূর্বোক্ত তিনটি অনূদিত কবিতার সংকলন তীর্থসলিল, ‘তীর্থরেণুমণিমঞ্জুষাথেকে নেওয়া ৷ কবিতাগুলির নিচে সংকলনের নাম দিয়ে সূত্র নির্দেশ করা হয়েছে ৷ মূল কবিতার কবির ফরাসি নাম যেখানে বাংলা থেকে বোঝা যায় সেখানে তা দেওয়া হয়েছেকিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা খুঁজে পাওয়া বা অনুমান করা সম্ভব হয় নি ৷ অনুবাদের আগে কিছু মূল ফরাসি কবিতাও দেওয়া হয়েছে । প্রথম দুটি জাতীয় সঙ্গীত বাদ দিয়ে বাকি কবিতাগুলি ফরাসি সাহিত্যের কালানুক্রমে উপস্থাপিত করা হয়েছে ৷ কৌতুহলী পাঠকদের জন্য কয়েকটি কবিতার অন্য কোনো বাঙালির করা এক বা একাধিক ইংরেজি অথবা বাংলা অনুবাদও উপস্থাপিত হয়েছে। তেয়োফিল গোতিয়ের একটি কবিতার(Barcarolle) ইংরেজ কবি সুইনবার্নএর (Algernon Charles Swinburne, ১৮৩৭১৯০৯ )ইংরেজি অনুবাদ যোগ করা হয়েছে, কেননা আমদের মনে হয়েছে গোতিয়ের কবিতাটির সত্যেন্দ্রনাথের করা অনুবাদ আন্তঃরাচনিক সূত্রে পূর্বোক্ত ইংরেজি অনুবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত।

বর্তমান সংকলন এই ব্লগেই প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত হল ৷ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনূদিত ফরাসি কবিতার অনুবাদের আলাদা কোনো সংকলন কখনো মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।এই সংকলন এই ব্লগেই প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত হল, এর কোনো মুদ্রিত সংস্করণ নেই ৷

পুষ্কর দাশগুপ্ত

বাংলাবুলি নিয়ে ভ্যানতাড়া: পুষ্কর দাশগুপ্ত

বাংলাবুলি নিয়ে ভ্যানতাড়া

পুষ্কর দাশগুপ্ত

সাদা চামড়ার সায়েবরা যদ্দিন এদেশের মাথায় বসেছিল তদ্দিন বাপ বলে ইংরিজি বুলিটা রপ্ত করতে হত ৷ নইলে লোকজনের ভিড়ে ভদ্দরলোক বলে কল্কে মিলত না, বাপের ঠাকুর লালমুখোদের তোয়াজ করে নানান ধান্দা করার উপায় থাকত না, আঙুলে থুতু লাগিয়ে নোট গোণা যেত না ৷

হেয়ার কলিন পামরশ্চ কেরী মার্শমেনস্তথা ৷

পঞ্চগোরাঃ স্মরেনিত্যং মহাপাতকনাশনম্ ৷৷

তার মানে ঘুম থেকে ধরমর করে উঠে চোদ্দপুরুষের আউড়ানো পঞ্চকন্যার নাম খেয়ে ফেলে তার বদলে পঞ্চগোরার নাম আউড়েও দিনভর গোরাদের হাতে কেলানি খাওয়ার ভয়ে চিমসে মেরে থাকতে হত ৷ অবশ্যি ওরই ফাঁকফোকরে, ঝোপ বুঝে কোপ মেরে, হরেক কিসিমের ফন্দিফিকির করে ফায়দা লোটার চেষ্টাচরিত্তির চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো রাস্তা ছিল না ৷ আর ইংরিজিতে বুকনি ঝাড়তে পারলে হেভি সুবিদে হত — সায়েব ফাদার সায়েব মাদার বলে লালমুখোদের এঁড়ে তেল মাখানো যেত, মজাসে দিশি ছোটলোকদের চমকানো কি টুপি পরানো যেত ৷ তবু ইংরেজিওয়ালা টপ্ টপ্ ভদ্দরলোকদের মনটা চুপসে থাকত ৷ চব্বিশ ঘন্টা গটমট ইংরিজি বলেও গোরা সায়েবগুলোর মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা দায়, দিনে পাঁচশবার ঝাড় খেতে হয়, বিলিতি খিস্তিখাস্তা মুক বুজে হজম করতে হয়, মায় চুনোগলির বেজম্মা ফিরিঙ্গিগুলো অব্দি ব্লাডি নিগার বলে মামাসি তোলে ৷ তাই মানইজ্জতে পয়জার খাওয়া ইংরিজিতে এগ্গাদা পাশ দেওয়া ভদ্দরলোকদের অনেকে মায়ের মুকের ভাসায় গপ্পোকবতে কি বইপত্তর লিখে বা পড়ে একটুখানি সোয়াস্তি পেতেন ৷ ঐ বাঙালিপনাটা ছিল বাবুদের বুকের বেথার মলম, ওটা ছিল সায়েবদের হুকুমদারির বাইরে ৷ খিদিরপুরের মদুসুদন দত্ত থেকে হাটখোলার সুদিন দত্ত পজ্জন্ত কোটপ্যান্টুলুন পরা বহুত তাবড় তাবড় দিশি ইংরিজিোয়ালাদের বাংলা বাজারটাই ছিল মাতা গোঁজার ঠেক ৷

তারপর বাপঠাকুদ্দার আমলের সেসব সখের প্রাণ গড়ের মাঠের দিন ভোগে গেল ৷ দুদুটো লড়াইয়ের হেভি কিচাইন, তিরিশের টাইমে দুনিয়া জুড়ে মালগন্ডার মন্দা — সায়েবদের জান কয়লা — বলা যায়, ও দুটো রগে উঠে গেল! দেখা গেল শেষমেশ সায়েবের বাচ্চারা ফুটল ৷ তবে ওটা শুধু চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য, আসলে গোরারা রামু শামুর মতো ভোট পবলিককে ঢপের চপ গেলাল ৷ ব্রিটিশ লালমুখোগুলো নামকা ওয়াস্তে সটকে পড়ল, আসল ব্যাপারটা হল, একা শুধু ব্রিটিশ গোরারা নয় তাবৎ লালমুখোরা যেসব দেশ জবরদখল করে তার মাথায় গেঁড়ে বসেছিল সেগুলো একটার পর একটা লোক দেখানো কায়দায় ছেড়ে দিয়ে সবাই মিলেঝুলে একাট্টা হয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াবে বলে ঠিক করল ৷ মারদাঙ্গা করে, তার ওপর আবার বন্দে মাতাগরম বন্দে পেটগরমের ঝক্কি সামলে সায়েবদের আর পোষাচ্ছিল না, লাভের গুড় মাছিতে খাচ্ছিল ৷ ওদের মাথায় বাওয়া জিলিবির প্যাঁচ — ওরা দেশটাকে ভেঙে দুটুকরো করে রামওয়ালা আর আল্লাহোআকবরওয়ালাদের মধ্যে বেঁটে দিল, যাতে দুদলের কামড়াকামড়ি লেগে থাকে, তাঅলে ঘোলা জলে নির্ঝঞ্ঝাটে মাছ ধরা যাবে, হরবকত পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানোর সুবিদে হবে ৷ বলতে কী সব সায়েবে মিলেঝুলে পেছন থেকে সুতো টানতে পারলে আর কোনো ঝক্কি পোয়াতে হবে না, মস্তিসে রস নিঙড়ে চুক চুক করে খাওয়া যাবে — হারামির বাচ্চা দিশি কেলে ভূতগুলো জাতির বাপের মতো নেংটি পরে আঁটি চুষবে ৷ এদ্দিন যারা সায়েবদের কাগজে পোছা হেগো পোঁদ চেটে এসেছে, গোরারা সেই দিশি ইংরিজিওয়ালাদের অত্থাৎ কিনা মেকলে সায়েবের বেজম্মা নাতিপুতিদের তখতে বসিয়ে দিয়ে গেল ৷ ঐ কেলে ইংরিজিওয়ালারা সায়েবদের ফেলে যাওয়া চেয়ারে সব গ্যাঁট হয়ে বসল, হয়ে উঠল গোরাদের নতুন ফিকিরের আড়কাঠি ৷ লালমুখোদের সুতো টানার মন্তর হয়ে থাকল ইংরিজি বুলি ৷ আর মেকলে সায়েবের ঐ বেজম্মা নাতিপুতিদের ছকে ইংরিজি বুলিটা দেশে আরো জবরদস্তভাবে মৌ রসি পাট্টা গেড়ে বসল ৷ নয়া জমানায় ঐ কেলে ইংরিজিওয়ালাদের আর মাতা গোঁজার ঠেকের দরকার রইল না, ওরাই হয়ে উঠল দেশের মাতা — শোনোনি,

কলির শহর কলির বসত কলির নামে কলিকাতা ৷

এই নরকেই দেখবে তুমি সারা দেশের হালখাতা ৷৷

পুরনো গান বন্ধ করো,ছাতুবাবু লাটুবাবু হয়ে গেছে গায়েব ৷

ঘোর কলিকাল হোল আড়াল লালমুখো সব সায়েব ৷৷

জাল তো ওদের পাতাই আছে হাতের মুঠোয় কলকাঠি

ঝুট ঝামেলি রইল না আর বেওসা হচ্ছে ফাটাফাটি ৷৷

লালমুখোদের পোঁদের ঘষায় রঙচটা সব কুর্শিতে

ওদের দালাল কেলে সায়েবরা বসল মহা ফুর্তিসে ৷৷

রাধাকান্ত নবকেস্ট পুরনো সব আড়কাঠিরা পেয়ে গেল অক্কা৷

এখন শুধু কেলে সায়েবরা মেরে যাচ্ছে দানে দানে ছক্কা ৷৷

ওদের সবাই — মেজ সায়েব, সেজ সায়েব, ছোট সায়েব আর ন সায়েবরা সবাই সুটবুট চাপিয়ে ভাসন দিতে লাগল — ইংরিজি হল আমাদের দিশি ভাসা নিজের ভাসা ৷ ও ভাসা ছাড়লে চলবে না ৷ আর বিলিতি ধলা সায়েবরা হল গিয়ে আমাদের দাদা ৷ (না না, মায়ের পেটের ভাই নয়, তুতো দাদা ৷ কোন তুতো? খুড়তুতো? মাসতুতো? পিসতুতো? নারে বাঞ্চোত না, ওসব দিশি তুতো নয়, খাঁটি বিলিতি সম্পক্ক — গাঁড়তুতো)

সায়েবি জমানায় মদুসুদন দত্ত থেকে ভবানী ভটচায্, সরোজিনী নাইডু অব্দি নেটিভদের বেশ দুচারজন ইংরিজিতে বই ছাপাত ৷ সায়েবদেরতো কথা বাদই দাও, এমন কী দিশি ভদ্দরলোকরাও তাদের বড় একটা পাত্তা দিত না ৷ লোকজন বলাবলি করত, ওসব হল গিয়ে ফিরিঙ্গি লেখা — অ্যাংলোইণ্ডিয়ান রাইটিং । এবার লালমুখোরা দেখল, ইংরিজি বুলিটা দেশের ঘাড়ে যত চেপে বসছে ওদের আঁখ মাড়াইয়ের কল গরগর ঘরঘর করে ততই বেড়ে চলছে, তেল দিতে হচ্ছে না। তাই ফায়দা তোলার আঁক কষে সায়েবরা কেলোদের মাথায় হাত বোলানোর জন্যে ফতোয়া দিল, কেলে সায়েবদের ইংরিজি মালগুলো মন্দ নয়। গোরা সায়েবের থুতু গেলা কেলো সায়েবদের বিশ ইঞ্চি ছাতি ফুলে ফেঁপে ছত্তিশ ইঞ্চি হয়ে উঠল। ওরা বুকনি ঝাড়তে লাগল, আমাদের ইংরিজি মাল আর অ্যাংলোইণ্ডিয়ান নয়, ইন্দোঅ্যাংগ্লিকান । গোরারা এসব কেলেদের দুচারবার কালাপানি পার করে বিলেতআমেরিকা মুল্লুকে চক্কর দিইয়ে আনল। কেলেরা হেভি লেজ নাড়াতে লাগল। আনকোরা বিলিতি কোটপ্যান্টুলুনে ঘেমে নেয়ে ওরা লেকচারে লেকচারে অন্ধকার করে দিল। যোদো মোধোরও হুঁশ হল। ইংরিজি বুলি রপ্ত না থাকলে টু পাইস কামানো যাবে না, পাড়ায় ইজ্জত থাকবে না, মায় মেয়েকে কোনো একটা মন্দের ভালো পাওরের গলায়ও ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে না। ফটাফট ইংরিজি বকতে না পারলে ছেলেপিলেকে লাফাঙ্গা হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হবে, বাপের হোটেলে খেয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করতে হবে। যোদো তার ছেলেকে বাপের ইংরিজি বকা লালু ছেলে বানাবার জন্যে ঘটিবাটি বন্দক দিয়ে ইংরিজি গোয়ালে ঢুকিয়ে দিল। মোধো পেটে গামছা বেঁদে এগ্গাদা নোট খসিয়ে মেয়েটাকে ধুমসো কেলে মেমসায়েব আন্টিদের জিম্মায় পৌঁছে দিয়ে এল। এবার বাড়ির মধ্যে ইঞ্জিরি বকা শুরু হয়ে গেল। আন্ডাবাচ্চা আর বাড়ির কুত্তার সঙ্গে ইয়েসনোকামগো সিটইট বলে ইঞ্জিরি না ফাটালে আর চলে না। যোদোর লেড়েকুত্তা ভুলোর নতুন নাম দেয়া হল টমি। মোধোর বাড়ির মেনি বেড়ালটা হয়ে গেল পুসি। পাড়ার কাকা, জেঠা আর কাকা, জেঠা রইল না, হয়ে গেল আংকল ; জেঠিমা, খুড়িমা, মাসিমা, পিসিমা, গুষ্টিশুদ্দু সব ঝেঁটিয়ে আন্টি।

বাপঠাকুদ্দার আমলে দেশে জাতফাত নিয়ে হরবকত হেভি ঝামেলা লেগে থাকত: বামুন, বোদ্যি, কায়েত, শুদ্দুর, নম শুদ্দুর, বড়জাত, ছোটজাত, জলচল. জলঅচল, নবশাখ, হেলে কৈবত্ত, জেলে কৈবত্ত আরো কতো যে ঘোট! ওসব ভোগে গেছে, নম শুদ্দুরের হোটেলে কুলীন রাঢ়ী বামুনের ছেলে বাসন মাজছে, বারিন্দির বামুনের মেয়ে জাতে জেলে কৈবত্ত ছেলেকে লভ মেরেজ করে দিব্যি ঘর করছে ৷ দিনকাল পালটে গ্যাছে, আজকাল কেউ ওসব নিয়ে মাতা ঘামায় না, ধোপা নাপিত বন্দ করে একঘরে করার দিন চলে গ্যাছে, ৷ এখন জাতপাতের নতুন ছক ৷ এই নতুন ছকের মাপকাঠি হল গিয়ে কে কতটা ইংরিজিতে সরগর তার ওপর ৷ তুমি গুরু গটমট করে ইংরিজি বল আর ঘ্যাচঘ্যাচ করে ইংরিজি লেখ ৷ তুমি হলে বামুন, তাতে যদি আবার সায়েবি ইস্কুল থেকে বেরুনো হও, ইংরিজি বলার সময় কথার আদ্দেকটা চিবিয়ে খেয়ে ফেল, বাড়িতে চাকরবাকর আর ডেরাইভার ছাড়া সবার সঙ্গে ইংরিজি বল তাহলে তুমি হলে গিয়ে নৈকষ্য কুলীন ৷ এর পর যারা দিশি কায়দায় কোনোরকমে ইংরেজি বলে আর লেখে তারা হল যজমেনে বামুন ৷ আর যারা কানার মধ্যে ঝাপসা দ্যাখে অত্থাৎ ইংরেজি বলতে গেলে ঘন ঘন ঢোক গেলে, আর লিখতে গেলে মাথা চুলকিয়ে মাথায় প্রায় টাক ফেলে দেয় তারা হল গিয়ে বোদ্দি কি কায়েত, তারপর রয়েছে যারা কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ইংরেজি দুচার লাইন পড়তে পারে গুলিয়ে যায় এরা জলচল — বলা যায় নবশাখ ৷ এর পরের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লোক হল জলঅচল আর অচ্ছুৎ হাঁড়িডোম

লোকে বলে, গোরারা নাকি কেটে পডেছে ৷ তার মানে দেশ নাকি স্বাধীন হয়ে গেছে ৷ এখন সবার নাকি সমান   অধিকার ৷ কী বললে? ঢপ? ঢপ হতে যাবে কেন? তোমার কি চোখ বলতে কিছুই নেই? দেখতে পাচ্ছনা সবাই স্বাধীন দেশের নাগরিক, মাথাপিছু সবার একটা করে ভোট ৷ তবে একথাটাও মিথ্যে নয় যে ঐ ভোটেই শুরু আর ঐ ভোটেই শেষ ৷ তোমরা হলে গিয়ে ছোটলোক পবলিক, তোমরা যে ভোট দিতে পারছ ওটাই তোমাদের চোদ্দপুরুযের ভাগ্যি, ভোটের কাগজটা বাক্সে গুঁজে দিয়ে মুখ বুজে শুনসান ফুটে যাও ৷ দেশের আইনকানুন, সরকারি চিঠিপত্তর, দলিলদস্তাবেজ, কাজকম্ম সবই ইংরিজিতে, তোমার হুদ্দোর বাইরে ৷ তুমি ইংরিজিতে পোক্ত নও, তুমি শালা জলঅচল ছোটজাত! ইংরিজির শাসন যুগ যুগ জিয়ো! মেকলে সায়েবের বেজম্মা নাতিপুতিদের রাজত্ব চলছে চলবে!

ঐ যা বলছিলাম, সায়েবরা দুঁদে মাল, ওরা বুঝতে পারল ওদের ছক দুয়ে দুয়ে চার হতে শুরু করেছে। রস চাখতে চাখতে লালমুখোদের মালুম হল, খেলটা হেভি জমে উঠেছে, আর গোটাকয়েক দানেই কিস্তি মাৎ । তারা দিশি ইংরিজিয়ালাদের বেশ করে পিঠ চাপড়ে দিল, কেলেদের ইংরিজি বইপত্তরের তারিফ করতে লাগল মায় দুচারটে প্রাইজ ফাইজও ঠেকিয়ে দিল। তোল্লাই খেয়ে ফুলে ওঠা দিশি কেলে সায়েবরা বাওয়াল শুরু করে দিল। বুঝলে, আমাদের মাল হচ্ছে দিশি ইংরিজি। বিলিতি ইংরিজিতে বেশ কিছু খাদ ঢুকে পড়েছে — আমাদের মালটা যোল আনার ওপর বত্তিশ আনা খাঁটি ; আমাদের হল গিয়ে ইন্ডিয়ান ইংলিশ। (মা শেৎলার নামে কিরে খেয়ে বলছি, পেছন থেকে হারামির গাছ কেউ একটা ফুট কাটল, জাঙিয়ার বুকপকেট আর কি !) বাজারে বাংলা কাগজগুলোর বাঙালি বাবুরা ঐ সায়েবি ইংরেজি বুলিতে খুব একটা রপ্ত নয়। ওদের মধ্যে দুচাজ্জন — যারা কানার মধ্যে ঝাপসা দেখে — ওদেরও বুলিটা পেটে আসে তো মুখে আসে না। ওরা তো তুলকালাম ধুমধাড়াক্কা লাগিয়ে দিল। অমুক দিশি সায়ের আর তমুক কেলে মেমসায়েব ইংরিজিতে বই ছাপিয়েছে। সে বই বেরিয়েছে খোদ বিলেত মুল্লুক থেকে। তার ওপর তিন তিনটে বিলিতি কাগজে কেলে মেমসায়েবের বগলকাটা মেনা দেখানো ফোটো উঠেছে। যাই বলো বস্, কেলি আছে ! আর শালা, কথায় বলে,

মাগির মাগি লেউইনস্কি,

মালেরমাল হুইস্কি ;

পেশার পেশা দালালগিরি,

বুলির বুলি ইঞ্জিরি।

ওর সঙ্গে বাংলা বুলির কোনো কমপারিজন চলে ? — কোথায় গালের তিল আর কোথায় হাইড্রোসিল ! চাঁদে আর পোঁদে ? বাংলা কাগজয়ালাদের বুকের ভেতরটা সারাক্ষণ ঢিপ ঢিপ করে, পাছে পাবলিক ওদের পট্টিটা ধরে ফেলে — বুঝে ফেলে ওদের ইংরিজি বুলির দখলদারি তেমন পাকাপোক্ত নয়। তাই ঐ বাংলা কাগজয়ালারাই সারাক্ষণ ইংরিজির ঢাক পিটিয়ে কানে তালা লাগিয়ে দেয়।

তাঅলে বল এখন বাংলা বুলির হালটা কী ? বাংলা মাল আর বাংলা বুলি চলছে চলবে। তবে বস্, চাদ্দিকের ইংরিজির ধামাকায় বাংলাটা আর গিয়ার খাচ্ছে না। ওদিকে হিন্দিয়ালারাও তড়পাচ্ছে, আরে রাষ্ট্রভাসা বোল। তা যা বলছিলাম, বাংলা বুলির হাল। বাংলা এখন পুরোপুরি গরিবগুর্বো, ছোটলোকদের বুলি। ফেকলু চাকরবাকর, বাজারের মাছয়ালা, আনাজয়ালা, আর গাঁয়ের চাষাভুষোর বুলি হল গিয়ে বাংলা। পাত্তি বানাতে চাও, জ্ঞানফ্যানের বেওসায় নাক গলাতে চাও, মানইজ্জত পেতে চাও, পাঁজ্জন ঘ্যাম লোকের পাশে কি সামনে চেয়ারে বসে পা নাচাতে চাও, বিলিতি মালে চুমুক দিতে দিতে ঝিং চাকচাক ডিস্কো মিউজিক শুনতে চাও, মায় ঠোঁটে গালে রঙ লাগানো জিন পরা ফ্রেশ ডবকা মাল কি জম্পেশ মেয়েছেলে তুলতে চাও — তোমার মুখ থেকে বাওয়া ইংরিজির পপকর্ন ফোটাতে হবে। (তুইত শালা আচ্ছা টিউবলাইট! ওসব খৈমুড়ির দিন কবে চলে গেছে ! দেখিস না ভদ্দরলোকেরা আর ঝলমুড়ি খায় না। গলির মোড়ে সবে চুলকুনি জাগা বাবুদের বাড়ির নেকি মেয়েগুলো ইংরিজিতে খুক খুক হাসতে হাসতে হলিউড থেকে আসা পপকর্ন আর বলিউড থেকে আসা ভেলপুরি খায়।)। হ্যাঁ, যা বলছিলাম ননেস্টপ ইঞ্জিরি বকে যেতে হবে আর সঙ্গে সঙ্গে খচাখচ ইঞ্জিরি লিকতে হবে। (পেছন থেকে আরেক বাঞ্চোতের বাচ্চা অ্যাড করল, সকালে দাঁতন দিয়ে দাঁত মেজে রুটিমুটি খেয়ে হাগতে যাওয়া চলবে না, দুপুরে আর রাতে পাত পেতে গাণ্ডে পিণ্ডে গেলা যাবে না। টুথব্রাস করে ব্রেকফাস্ট সেরে টয়লেটে যেতে হবে, ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ আর ডিনার করতে হবে। — মাইরি বলছি, এই ছোটলোকদের কথায় কিছু মাইণ্ড করো না, বস্। বাপের ক্যাপফাটা এসব ছেলেপিলেদের আর মানুষ করা গেল না!)

কী বলছিলে ? বাংলা বলতে চাও ? বাংলায় লেকালিকি করতে চাও ? মাতাফাতা সব ঠিক আছে ত ? মায়ের ভাসা বাংলা — তাই ত ? চাঁদ আমার মানেওটা। তবে দেখ বাওয়া, ঐ মায়ের ভাসার টানে পোঁদের কাপড় যেন মাতায় উঠে না যায় ! (ঐ যে দেসাত্তবোদক গান আছে, ঐ যে সেই রজনী সেনের গান — মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই — ছেলের মাঅন্ত প্রাণ, মাতাটা তাই পুরো গেছে, একটা ইসকুরুও আর টাহট নেই। বোঝ ঠ্যালা ! মায়ের দেওয়া কাপড়ে পোঁদ না ঢেকে ওটা মাথায় বেঁধে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে যাচ্ছে !) হ্যাঁ, এতক্ষণে মালটা ক্যাচ করেছি। তার মানে ইংরিজি বুলিটা তোমার ঠিকঠাক আসে না। তুমি শালা ভদ্দরলোকদের দলে পাত পাও না। কী আর করবে, কপালের নাম গোপাল। এখন ছোটজাতদের বাংলার দলে ঢুকে পড়। ছোটলোকদের সঙ্গে গা ঘসাঘসি কর,ও দুটো চুলকোতে চুলকোতে বাংলা বুলিতে গ্যাঁজাও। যত খুশি হ্যাজাতে চাও হ্যাজাতে পার তবে জ্ঞান মারিও না — তাঅলে চারপাশের বুড়ো হাবড়া থেকে ক্যাওড়া ছোঁড়ারা সব্বাই মিলে প্যাঁক দিয়ে গুষ্টির তুস্টি করে ছাড়বে। আর বাংলায় লেকলিকি করবে ? কর — কেউতো তোমায় বারণ কচ্ছে না। তবে কিনা লেকালিকির কথা বলতে গেলে পড়াপড়ির কথাটাও তুলতে হয়। ভদ্দরলোকের বাচ্চারা, বলতে গেলে যেসব মালপয়মালরা একআদটু ক্যাটম্যাটস্যাট ইংরিজি বুলি রপ্ত করেছে তারা কেউ বাংলা লেকালিকি শুঁকেও দেখে না, বাংলায় ছাপা বইয়ের লেজ উল্টেও দেকতে চায় না মালটা কী, গোরু না বকনা। অবশ্যি যে হোঁচট খেতে খেতে নাকানিচোবানি খেয়েও ইংরিজি বই পড়তে পারে সে বাংলা পড়তে যাবে কোন দুঃখে, তুমিই বল। এক ছোটলোক ছাড়া কেউ আর বাংলা বইয়ের পাতা ওলটায় না। ছোটলোক, ছোটজাত — তার মানে ইংরিজিতে যাদের ক অক্ষর গোমাংস, আর যারা বাপমায়ের খুচরো পাপে কখনো ইংরিজি ইস্কুলের মুখ দেখতে পায় নি, আর গরিবগুর্বোর ঘরের যত অগামারা অপোগণ্ডের দল — চোদ্দবার ফেল মেরে শেষ অব্দি কেঁদে ককিয়ে দুএকখানা পাসের চোতা জুটিয়েছে, ইংরিজি পড়তে গেলে চোখে সর্ষেফুল দেখে এরাই হল গিয়ে বাংলা বইয়ের খদ্দের ৷ এছাড়া ধ্যাদ্দেরে গোবিন্দপুরের কিছু আতাক্যালানো দেহাতি — পাড়াগাঁয়ের বাংলা ইস্কুলে যারা হালে পড়াশোনা শেষ করেছে, যাদের চোদ্দগুষ্টি কখনো ইস্কুলের পত মাড়ায় নি, আর কিছু কেরানি কি দোকানদারের বউ — পাঁচপাঁচবার বিয়োনোর পর এখন মুটিয়ে আলুর বস্তা বনে গেছে, দুপুরবেলা পান চিবুতে চিবুতে টিভি দেখার পর কিছুক্ষণ বাংলা বহটই ঘাঁটাঘাঁটি করে, ইংরিজি অক্ষর দেখলেই ওদের বুকের ভেতরটা কাটা ছাগলের মত ধপাস ধপাস করতে থাকে। এই সব এলেবেলে লোকজন, এদের তো আর ভদ্দরলোক বলা যায় না। বাংলায় লেকালিকি করবে ? লেক শালা এদের জন্যে। তার বেওস্থাও আছে। বাংলা বইয়ের হাট। উত্তর থেকে গেলে ঠনঠনেতে মায়ের পায়ে পেন্নাম ঠুকে আর দক্ষিণ থেকে এলে হাড়কাটার মাগিদের বারকয়েক কানকি মেরে কলেজইষ্ট্রিট পাড়ায় ঢুকে পড়। ওটা হল গিয়ে বইপাড়া। চাদ্দিকে গলিঘুঁজি জুড়ে মায় পেচ্ছাবখানার দেয়াল ঘেঁসে বইয়ের হাটের হাটুরেদের সার সার দোকান। বইয়ের পসরা সাজিয়ে অনেকে রাস্তার ওপর বসে পড়েছে। এরা সব বাংলা বই ছাপায়। ঐ যে আমাদের হুগলি জেলার জকপুকুর গ্রামের হারান ঘোষের দুনম্বর বৌযের চারনম্বর ছেলে ঘোঁৎনা গন্ডায় গন্ডায় উজবুককে জক দিয়ে আর উদগান্ডুর মাথায় কাঠাল ভেঙে বেশ মালকড়ি বানিয়ে আর ঘোঁৎনা রইল না বনে গেল নিবারণবাবু ৷ ঘোঁৎনা ওরফে নিবারণবাবু কলকাতার বইপাড়ায় এসে পেল্লাই একটা দোকান হাঁকিয়ে বসল — ইংরিজিতে তার সাইনবোর্ড — শ্রী শ্রী নিউ কালিমাতা ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং এন্টারপ্রাইজ। নিবারণবাবু ওরফে ঘোঁৎনা এখন শয়ে শয়ে মেয়েছেলে নিয়ে টানাটানি লটকালটকি লদকালদকির রগরগে গপ্পের গাবদা গাবদা বাংলা বই ছাপিয়ে বাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে ফেলেছে, দলবাজি করে প্রকাশক সমিতির সম্পাদক বনে গেছে ৷ সারাক্ষণ সে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে যে বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির জন্যই সে তার জীবন দিচ্ছে। তা যা বলছিলাম, বাংলা লেকালিকির কথা। তা যা বলছিলাম, বাংলা লেকালিকির কথা। এগ্গাদা কাগজ, এতগুলো ঢাউস পুজোসংখ্যা আর বইয়ের হাট — এই নিয়ে লেকালিকির বাংলা বাজার। খেলসা করে বলতে গেলে, দিশি আর চুল্লুর ঠেক আর ঘুপচি ঘাপচি মেরে এখানে ওথানে কিছু তাড়ির ঘড়া। বাংলায় যাঁরা লেকালিকি করেন তাঁরা হরবকত মাল বানিয়ে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছেন — নানান রসের গাদাগুচ্ছের গপ্পোউপন্যাস। হাটুরেরা সেগুলো বেচছেন —খাঁটি বাংলা মাল, দুনম্বর আর তিননম্বর সি এল, ব্লাডারের চুল্লু, আর মাটির ঘড়ার তাড়ি। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু পাগলাচো। এরা বানাচ্ছে গ্যাঁজলা ওঠা কবতে। এরা নিজেরাই তা বাজারে ছাড়ছে। ঐ মাল দুয়েকজন পবলিক একআদ ঢোক ট্রাই করে কুলকুচি করে ফেলে দেয়।

আবার ইংরিজিওয়ালা বাঙালি জ্ঞানের কারবারিদের মধ্যে দুচাজ্জনের দয়ার শরীর । কালেভদ্রে ওঁরা বাংলা বাজারে দর্শন দেন। ছোটলোকদের কথা ভেবে ওঁদের পাঁজরায় ব্যথা হয়। হাজার হলেও দেশতুতো সম্পক্ক ! তাছাড়া এসব জ্ঞানের বেওসায়িরা আগে সবাই ছাত্তর ঠ্যাঙাতেন। তাই জ্ঞান দেওয়ার স্বভাবটাও পুরোদমে রয়ে গেছে। ওঁরা হাটুরেদের ঝুলোঝুলিতে ঢেঁকি গেলেন — দু একটা বাংলা মাল নাবিয়ে দেন। সবাই যুগ যুগ জিয়ো বলে চেল্লায়। তবে কিনা বাংলাপড়া ছোটলোকগুলো সব মাতামোটা, ধুর — তার ওপর ওদের বাংলা বুলিটাও জ্ঞানের শক্ত শক্ত বুকনি ঝাড়ার জন্য সেরকম পোক্ত নয়। তাই জ্ঞানবাবুরা ইংরিজি মালের রঙটা ফিকে করতে করতে উড়িয়ে দেন — একটুখানি এসেনস দিয়ে খুব পাৎলা করে একটা বাংলা পাঁচন ছাড়েন। ইংরিজিতে যা দেওয়া হয় তা বাংলায় দিলে সেটা ছোটলোক পাবলিকের পেটগরম করবে, বুকে কষ্ট দেবে, মাতায় ঘোট পাকাবে। ছোটলোকদের দিতে হলে দুয়েক ফোঁটা বিলিতি মাল এক গেলাস টিপ্ কলের দিশি জল মিশিয়ে দিতে হয়, যা ওদের পেটে সয়।

এ সমস্ত বাদ দিয়ে বাংলা বাজারে আরেক কিসিমের কিম্ভুতকিমাকার মাল বিক্রি হয়। এ মালগুলো যাঁরা বানান তাঁরা হলেন গিয়ে ম্যাস্টর, বিশেষ করে বাংলার ম্যাস্টর। বেচারারা ছোটলোকদের বুলির ম্যাস্টর বলে এমনিতেই পোঁদের ফাঁকে লেজ গুঁজে সিঁটিয়ে থাকেন। না ছাত্তর না চারপাশের পবলিক, কেউ ওঁদের মানুষ বলে গন্যি করে না। সেই খার থেকে ওঁরা ঘরের কোণে বসে গাবদা গাবদা বই বানিয়ে বাজারে ছাড়েন। ঐ মালগুলোর আদ্ধেক হেন্ সায়েব আর তেন্ সায়েবের ইংরিজি বুকনিতে ঠাসা থাকে, আর বাকি আদ্ধেকে থাকে বাংলায় ওসব সায়েবি বুকনি নিয়ে ভুলভাল মানে করে আলটুফালটু কপচানি, ভাট বকা আর হ্যাজানো। তার মধ্যেই আবার এগগাদা সায়েবের প্যান্টুলুন আর মেমসায়েবের গাউন ধরে জাতীয়তাবাদী টানাটানি। আসলে বেচারা ম্যাস্টররা শো করেত চান, বাংলার ম্যাস্টর হলে কী হবে, ওঁরা ফেলনা নন, ইংরিজি পড়ে ওঁরা নিজের পছন্দমাফিক একটা মানে আন্দাজ করে নিতে পারেন। আর ইতিমদ্ধে নামজাদা সব সায়েবের এন্তার বিগ বিগ বই নিয়ে সব ফিনিস করে দিয়েছেন। তবে কিনা স্রিফ দেসওয়ালি আম জন্তার কথা ভেবে দিল দিওয়ানা হয়ে যায় বলে বাংলা বুলির জন্যে জান লড়িয়ে দিচ্চেন, জিন্দিগি বরবাদ কচ্চেন ; তা নইলে কবে শালা বিলেতে গিয়ে সাদা চামড়ার আঁতেলদের জিগরি দোস্ত বনে যেতেন। আর অসুবিদেটাই বা কী ছিল ? ওসব বার্তফার্ত, বাখতিনটাকতিন, স্ট্রাকচারমাকচার, পাওয়ারফাওয়ার, ঘনাদা, টেনিদা, দেরিদামেরিদা — সবই তো ওঁদের কবে জলভাত হয়ে গেছে!

কী বলছ? এসবের পরও তুমি বাংলা বুলিতে লেকালেকি করতে চাও ! তা কী লিকবে বলো ৷ গপ্পো না কবতে? বাংলায় গপ্পো, কবতে ছাড়া আর কীইবা লেখা যায়? মাতাটা যখন গেছে, ইংরিজি বুলিটাও তেমন আসে বলে মনে হয় না তখন আর কী করা ৷ যাও — বাংলা বাজারে ঢুকে পড়, যত মাল পয়মালদের সঙ্গে বার দোয়ারি কী খালাসিটোলায় বেঞ্চিতে পোঁদ ঠেকিয়ে বাংলা টেনে আতাক্যালানো দেহাতি আর ছোটলোকদের জন্যে বাংলা বুলিতে লেকালেকি শুরু করে দাও ৷ জিন্দিগি চোরপোরেশনের ভ্যাটে ফেলে দিতে চাও, দাও ৷ আমার কী এসে যায় ?

গরিব কায়েতের ছেলে নেইকো কোনো কতাতে।

 কেলোর পোঁদ ভুলোয় মারে দাঁড়িয়ে দেকি তপাতে ৷৷

সব বুঝে শুনে আমি এখন বাপঠাকুদ্দার মুখে শোনা এই নীতিই মেনে চলেছি ৷

এতটা লিখে চোতাটা একজন জানপয়চান বড়বাবুকে দেখালাম ৷ বললাম, বস্ উলটোপালটা বকেছি, মালটায় একটু চোখ বুলিয়ে দাও ৷ বাবু সেদিন ইংরিজিতে মার্কিন মুল্লুকের আজকালকার লিখিয়েদের লেখায় সেলেং (বাংলা বুলির ম্যাস্টররা বলে অপভাসা অত্থাৎ কিনা তোমার আমার মতো রামা শ্যামা যোদো মোধোর বুলি) বেবহারের ফরে বক্তিমা দিয়ে এসেছেন ৷ দুচার লাইন দেখেই তিনি লেখাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, বললেন, ন্যাস্টি, একে বাংলা, তার ওপর গুন্ডা বদমাসদের অবসিন ভাসা, কোনো ভদ্দরলোক এসব পড়তে পারে ?

ঠিক! একশ পঞ্চাশ ভাগ রাইট! ঐ যে বাগবাজারের অম্রেতবাজারি জয়গৌর মার্কা ঘোষবাড়ির নামকেত্তন করা বোস্টম জামাইয়ের বানানো আর এখন তার আমেরিকাভজা নাতিপুতিদের চালানো সুতারকিন গলির আনন্দবাজার পত্রিকা হরবকত বাংলা ভাসার গুষ্টির তুষ্টি করে ৷ ভদ্দরলোকদের বুলিতে বলতে হয়, সাধু ভাসায় তিরস্কার করত চতুর্দশ পুরুষকে উদ্ধার করিয়া দেয় ৷ কেউ বাংলা ভাসার হয়ে রা কাড়তে গেলেই আনন্দবাজার তাকে বাংলাবাজ বলে হেভি খিস্তিখাস্তা করে — সাধু ভাসায় বলতে গেলে সুকঠিন ভাসায় ভর্ৎসনা করে (সাধু ভাসা বোঝ না যাদু? বুঝবেটা কী করে! চব্বিশ ঘন্টা গলির মোড়ে পাতাখোর আর সিএলখোর ছোটলোকদের সঙ্গে গুলতানি করছ, শোন, সাধু ভাসা হল গিয়ে তোমাদের চোরচোট্টা ভাসার উলটো) ৷ ভদ্দরলোক বাঙালির প্রাণের বাংলা কাগজ আনন্দবাজারের কেত্তন হল ‘এস হে মার্কিনি চন্দ্র সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে করি, এস হে’, মনপছন্দ্ হল ইংরিজিখোররা ৷ বল গুরু, ওয়ার্ল্ডে কোথায় এমন আরেকটা কাগজ রযেছে যা যে বুলিতে বেরয় তারই খাল খিচে দেয়ার জন্য সারাক্ষণ রেডি থাকে! সত্যিই তো ‘এমন দেসটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ ৷

এই হল গিয়ে বাংলা বুলির হাল! ইস্কুলে যা পড়েছিলে তা তো কবে খেয়ে হজম করে ফেলেছ, সত্যেন দত্তোর হক কথা বলা একটা লাইন মনে পড়ছে ? পড়ছে না? তবে শোন: আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্চোৎ ভূমি বঙ্গে!