পুষ্কর দাশগুপ্ত: আমার ভাট বকা , দ্বিতীয় পর্ব

পুষ্কর দাশগুপ্ত

আমার ভাট বকা

দ্বিতীয় পর্ব

AMAR BHAT BAKA 3

. আবার কলকাতায় (১৯১৩)

ঘুরে ফিরে আবার কলকাতায় !

দুকোটি পঞ্চান্ন লক্ষ সাঁইত্রিশ হাজার ছশ বাহাত্তরটি জাতীয় পাখি কাক, বিভিন্ন মাপের পঁচিশ কোটি সাতচল্লিশ লক্ষ ষোলো হাজার নশ বত্রিশটি সর্বংসহ পোকা আরশোলা, ঋতুভেদে কমবেশি হলেও ঠিক এই মুহূর্তে অ্যানোফিলিস, কিঊলেক্স্ ইত্যাদি প্রজাতিতে বিভক্ত সতেরো কোটি আটান্ন লক্ষ বারো হাজার তিনশ ছাপান্নটি মশা, ধেড়ে আর নেংটি মিলিয়ে সাঁইত্রিশ লক্ষ সত্তর হাজার তিনশ সাতটা লম্বোদর গজানলের বাহন ইঁদুর, মাত্র নব্বই হাজার ছশ সাতাশটা বিশ্বকর্মার বহু যত্নের সন্তান ছুঁচো, গৃহপালিত বাদ দিয়ে বাহাত্তর হাজার পঁয়তাল্লিশটি দেবকুক্কুরী সরমার বংশধর অনাথ সারমেয় বা ঘেয়ো নেড়ি কুত্তা, হাজার পঞ্চাশেক মা ষষ্ঠীর অনুচর বেড়াল, বিরামহীন ইলেক্ট্রিক হর্নের আওয়াজে কানে তালা লাগানো আর চোখমুখ জ্বলা করা ধোঁয়াওগরানো নতুন, পুরনো, মান্ধাতার ঠাকুর্দা, বাবা আর তার নিজের আমলের এবং গ্লোবালাইজড্ একুশ শতকের ক্যাটকেটে, ম্যাটমেটে, চকচকে, রঙচটা, ঝকঝকে হরেক কিসিমেব দুচাকা (স্কুটার ও বাইক সহ), তিনচাকা, চারচাকা তিরিশ লক্ষ গাড়ি, হাতে টানা আর পায়ে (সাইকেলে) চালানো দুলক্ষ রিক্সা ও সাইকেল ভ্যানের শহর কলকাতা। হাজার হাজার হকারের ঝুপড়ি আর পসরায় উধাও ফুটপাথ কলকাতা, গাদাগাদি ঠাসাঠাসি ধাক্কাধাক্কি কামড়াকামড়ি করা এক কোটি চল্লিশ লক্ষ মনুর অপোগণ্ড বংশধরের শহর কলকাতা। কালী কলকাত্তাওয়ালির শহর সনাতন কলকাতা।

সিটি, মেগাসিটি, নগরী, মহানগরী যে নামেই ডাক না কেন কলকাতা কলকাতা। কলকাতা পাল্টায় না, পাল্টাতে পারে না। কয়েক পরত ধুলো, কাদা আর ধোঁয়ায় আস্তরণে ধূসর রাস্তার পাশে অসংখ্য বিবর্ণ পুরনো বা পড়োপড়ো বাড়ি, বস্তি বা ঝুপড়ির মাঝখানে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু চকচকে বহুতল বাড়ি আর বিতিকিচ্ছিরি উড়ালপুলের কনট্র্যাস্ট কলকাতার দাদা‘ (Dada) চেহারাটকে আরো খোলসা করে দিয়েছে । খোলা ভ্যাট, চারদিকে ছড়ানো ডাঁই করা আবর্জনার মধ্যে মানুষ, কুকুর আর কাক পঞ্চশীলের মটো মেনে সহাবস্থান মেনে নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় জীবন ধারণের রসদ খুঁজছে দেখাচ্ছে আশাবাদী জীবনযুদ্ধের উজ্জ্বল উদাহরণ। নাড়িভূঁড়িতে মোচড় লাগানো বর্জ্য পদার্থের সৌরভ আর মূত্রস্রোতের মধ্যে মাথা তুলছে ঝিংচ্যাকচ্যাক মল, বাংলা মল নয়, খোদ ইয়াংকি মল । চমৎকার! আর কী চাই ? কলকাতায় পিৎসাহাট, দোমিঙ্গো, জোভান্নি, কেন্টাকি চিকেন, ম্যাকডোনাল্ড, মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা আরো কত কী এসে গেছে , আরো কত কী আসছে । ক্যা বাৎ! রাসবিহারী এভেন্যুতে রেস্টোরেন্টের নাম রিস্তোরান্তে পুঞ্জাবইতালিয়া — পঞ্চনদীর তীরের সঙ্গে টাইবারআডিজেইপৌএর রন্ধন সংস্কৃতির পরিণয়! ক্রেডিট কার্ডের তাড়ায় পেটমোটা ওয়ালেট নিয়ে শহরের বাবুদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা লেটেস্ট মডেলের কার থেকে নেমে লাইন লাগাচ্ছে কোকে সিপ করতে করতে খাচ্ছে বিগ ম্যাক, চিকেন নাগেট, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফ্রাইড চিকেন, পিৎসা, স্পাগেত্তি, রিজতো ; পরস্পরকে হাই, হাই (হায় হায় নয়) শব্দে সম্ভাষণ করছে , নাইটক্লাব, ডিস্কোতে নাচানাচি করছে — গ্লোবালাইজেশন, ‘মেরিকান ড্রিমস্(নিওকলোনিয়ালিজম্ , নিওকম্প্রাদর, বিশ্বায়নের ভুয়ো লেবেলে কর্পোরেট কলোনাইজেশন, ইয়াংকি নাইটমেয়ার — যত সব ফালতু কথা ! — বুলশিট!)

চৈত্র মাস । তারকশ্বরে মানত দিতে যাবে বলে মেয়েমদ্দরা গলির মোড়ে ভিক্ষে করছে, মানত দিতে যাওয়ার পথে রাস্তায় বাংলা মাল, কিচাইন, বাওয়াল, রথ দেখা আর কলা বেচা— বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগি, বাবা ম — হা — দে — ব, ভোলে বাবা পার করেগা ।

চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক কলকাতায় এই পাঁচটা ইন্দ্রিয়কে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়, তা না হলে প্রাণ রাখতে প্রাণান্ত হয়। মরা ইঁদুর, গাড়িতে চাপা পড়া কুকুর, রাস্তায় যেখানে সেখানে , বিশেষত যেখানে লেখা আছে প্রস্রাব করা নিষেধ’ বা প্রস্রাব করিবেন না ’ সেখানে পেচ্ছাবের বন্যা, জঞ্জালের পাহাড়, গন্ধে নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে আসার উপায়। নোংরা, নোংরা বলে কিছু হয় না, হতে পারে না হতে পারে শুচি বা অশুচি, ব্যাপারটা ছোঁয়াছুঁয়ির, চোখ বা নাকের ব্যাপার নয়, ব্যাপারটা স্পর্শের। পাশের মাড়ওয়ারিদের বাড়িতে সকাল পাঁচটা থেকে করতাল আর মৃদঙ্গ সহ রামনাম, গলির ভেতর রাম ঠাকুরের আশ্রমে অষ্টপ্রহর অবিরাম নামসংকীর্তন, কলিতে নামই ভরসা, রাস্তায় অবিরত ইলেক্ট্রিক হর্ন, চায়ের দোকান, সিডির দোকানে ফিল্মি গান, বারমাসে বারোয়ারি তের পর্বণে মাইকে সঙ্গীতবিতরণ, গলির মধ্যে পাড়ার শচীনদের ক্রিকেটের হুল্লোড়! কান ঝালাপালা ! জীবন মানেই হৈ চৈ, গন্ডগোল, নীরবতা মানে নাকি মৃত্যু, চুপ করে ভাবার কী আছে? বাসেট্রামে, রাস্তায়, দোকানবাজারে গাদাগাদি, ঠেলাঠেলি। চামড়াকে সহনশীল করতে হবে !

শুনলাম বাঙালিদের প্রিয় দিদি নাকি বলেছেন কলকাতাকে লন্ডন বানিয়ে দেবেন। বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা বাপের নাম খগেন করে দেওয়ার মতো কিছু কিনা। তবে কলকাতাকে কেউ সুন্দর, পরিষ্কার, দূষণমুক্ত, শব্দদূষণহীন কলকাতা করার কথা বলে নি বা বলে না কেন? এক পশলা বৃষ্টির পর রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেল, নোংরা জল ভেঙে এগোতে গিয়ে চোখে পড়ল নানা বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে দুটো মরা ইঁদুর ভাসছে। পেছন থেকে ছিটিয়াল মন্টুদার গলা শুনলাম, দেশের হালচাল কিছুই আর তোমার মাথায় ঢুকছে না। হ্যাঁ, কলকাতা এখনো লন্ডন হয়নি, তবে টেমস্এর জল ঢুকে পড়েছে।

যতবার কলকাতায় আসি তার আগে থেকেই মনের মধ্যে সুবর্ণরেখা ছবিতে বিজন ভট্টাচার্যের অভিনীত চরিত্রের উক্তির প্রতিধ্বনি অবসেশনের মতো পাক খেতে থাকে, চলো পুষ্কর কোইলকাতায় যাই, কোইলকাতায় বীভৎস আনন্দ!

. শম্ভুর চায়ের ঠেকে

প্রতিদিন অন্তত একবার শম্ভুর চায়ের ঠেকে গিয়ে রঙচটা বেঞ্চিতে কিছুক্ষণ পোঁদ না ঘষলে ঠিক কলকাতায় এসেছি বলে বোধ হয় না। তাই ভোরে উঠে আটটা নাগাদ শম্ভুর ঠেকে হাজির হলাম। শম্ভু   বলল, কবে এলেন? অমলদা, পার্থদা সবাই জিজ্ঞেস করে । খেয়াল করিনি শম্ভুর পেছনের বেঞ্চে ঝন্টু বসে ছিল। উঠে এসে বলল , বস এসে গেছ ? শম্ভুর ঝামেলি না করে বসকে আগে বসতে দে। শম্ভুর ঠেকে আর জায়গা নেই, কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। ঝন্টু পেছনের বেঞ্চে নিজের জায়গায় আমাকে বসিয়ে শম্ভুর টুলটা এনে নিজে গ্যাঁট হয়ে বসে শম্ভুকে অর্ডার দিল, জম্পেশ করে বড় গেলাসে দুটো ডবল লেবু চা, দুটো জোড়া মাখম টোস্ট আর ডবল ডিমের দুটো ঝিং চ্যাক চ্যাক মামলেট ।

ঝন্টু জানাল মাইরি বলছি বস সকালে তোমাকে নিয়ে শান্তিতে বসে চা খেতে খেতে সুখদুঃখের কথা বলব তার আর উপায় নেই। পুরনো চায়ের ঠেকগুলো সব এক এক করে ভোগে গেছে । বিনোদবাবু আর মুন্নার দোকান বিক্রমপুর হয়ে ঝকমকে চাইনিজের দোকান বনে গেছে, বাবুয়া গোবরা থেকে একটা মুসলমান ছোকরাকে ধরে এনে চাফা বন্ধ করে রোল আর টিকিয়া বিক্রি করছে, মন্টুদার দোকান গেছে , বাড়ি ভেঙে ওখানে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে, নিচের তলায় নাকি বাবুদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য একদিকে ফাস্ট ফুড আর অন্যদিকে সাহেবি রেস্টোরেন্ট হবে, কী যেন বলে শালা, পেটে আসছে ত মুখে আসছে না। হ্যাঁ, মনে পড়ছে, ফিউশন রান্নার রেস্টোরেন্টগুষ্টির পিন্ডিমালটা কী হবে জানিনা। ফুটের কিছুটা জুড়ে শম্ভুর চায়ের ঠেকই আমাদের শেষ সম্বল। তবে শম্ভুর ঠেকে সক্কাল বেলা হাড়হাভাতে বুড়োগুলো পাড়ার লোকের হাঁড়ির খবর নিয়ে চটকায়, অমুক আর তমুকের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে। ওরা ঢেউ তুললেই আমাদের কেউ না কেউ থাকে অর্থা আমি, হিরু, পটলা কি খোকন । বুড়োগুলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ কানের পোকা বের করে দেয়। তের নম্বর বাড়ির নতুন ভাড়াটের মেয়ে উনিশ নম্বরের বিধবা বাড়িউলির ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে, তাতে বাঞ্চো তোর কী?

ঝন্টু বলল, বস আমি কাটছি , একটা ধান্ধা আছে। তুমিত এখন আছ? কাল দেখা হবে।

আমি শম্ভুর দোকানে বসে চারদিকের আজব শহর কলকাতার লোকজন, জীবনযাপন দেখতে থাকলাম। বেঞ্চে চারটে ছোকরা বসে ছিল। এদের আমি চিনি না। তবে বুঝতে পারলাম এরা শম্ভুর ঠেকের নিয়মিত খদ্দের, কাজকম্ম নেই, পকেট ফাঁকা। দুটো চা আর দুটো ফল্স, তার সঙ্গে দুটো লেড়ে বিস্কুট নিয়ে চারজনের হেভি ঘ্যানর ঘ্যানর । নেই কাজ তো খই ভাজ! এদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এরা বাংলাভাষায় লেখালেখি করে। দুজন কবিয়াল আর দুজন গপ্পো বানিয়ে। কেউ তাদের পাত্তা দেয় না, তবু ওরা সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে ঘোট পাকাচ্ছে। পয়লা নম্বর কবিয়াল বলছে: কবিতা? সুবোধদা দারুণ লিখেছে আন্ন্দবাজারে: কবিতা হাতে নিলে হাত পুড়ে যাবে!

মাথায় গোবর ডেলিপাষণ্ড উটকো একটা লোক এক কোণায় বসে ছিল, হাতে নিলে হাত পুড়ে যাবে শুনে বলে উঠল গরম তেলেভাজার কথা বলছেন? দোকান কাছাকাছি? বাঞ্চতের ট্রেন সোনারপুরে আটকে আছে, আধঘন্টা বন্ধ, শুনশান। গরম তেলেভাজা খেলে কিছুটা সময় কাটবে।

মহাগেঁড়ে ঐ ফালতু লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে কবতে আর গপ্পো নিয়ে চারজনের বকরবকর চলতে থাকল। দুনম্বর কবি একনম্বর গপ্পোওয়ালাকে বলল, তোর গপ্পটা পড়লাম, দারুন লিখেছিস, গপ্পের শেষটাও খুব ভাবায়।

এক নম্বর কবিওয়ালা বলল, আঁতেলদের আঁতলামির কথা আর বলিস না। শনিবার কফি হাউসে বোদলেয়ার বোদলেয়ার করে এক আঁতেল আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। পাপবোধ আর দ্রষ্টা, মাথা আর মু্ন্ডু! গত কাল আবার আরেক ম্যাস্টার পাকড়াও করেছিল। রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করে কানে তালা লগিয়ে দিল। রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথের কবিতা অপাঠ্য। গান? হ্যাঁ, গান অসাধারণ, তার কোনো তুলনা নেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তাই বলতেন।

আমি শালা গবেট। রবি ঠাকুরের কবিতা অপাঠ্য, গানের কোনো তুলনা হয়না! আমার কাছে ব্যাপারটা উদ্ভট। রবি ঠাকুরের কবিতা রোমান্টিক গীতিকবিতা, তাঁর গানও তাই, সে গান কথায় ভর্তি কবিতা, সুর কিছুটা একঘেঁয়ে । গানের বাণী রোমান্টিক কখনোকখনো ছদ্মমরমিয়া। রবি ঠাকুরের পদ্য যদি ভালো না লাগে গান কি করে অতটা প্রিয় হতে আমার মাথায় ঢুকল না।

ইতিমধ্যে কর্পোরেশনের জঞ্জালের গাড়ি খোলা ভ্যাট নিয়ে চারদিকে হরিলুটের বাতাসার মতো জঞ্জাল আর নাড়িভুঁড়ি বের করা দুর্গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে চলেছে। শুনলাম রবীন্দ্রসঙ্গীত-প্রিয় কবি গুনগুন করে গাইছে ‘জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে…’