স্যাঁ–জন পের্স –এর (Saint-John Perse) :
“আনাবাজ” (Anabase, ১৯২৪) ও “নির্বাসন” (Exil , ১৯৪১) কবিতার কয়েকটি অংশ
উপস্থাপনা ও অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত
স্যাঁ–জন পের্স –এর (Saint-John Perse, ১৮৮৭–১৯৭৫) আসল নাম মারি– রনে আলেক্সি স্যাঁ–লেজে লেজে ( Marie-René Alexis Saint-Leger Leger)। বয়সে ব্লেজ সঁদ্রার–এর চেয়ে তিন মাসের ছোট এই কবি বিশ শতকের ফরাসি কবিতায় এক অনন্য রচনা–রীতির স্রষ্টা। আধুনিক ফরাসি কবিতার আলোচনায় প্রতিকীবাদ, ভবিয্যৎবাদ, দাদা, পরাবাস্তবতাবাদ ইত্যাদি যেসব আন্দোলন আর প্রবণতার কথা বলা হয় পের্স–এর কবিতা তার কোনোটার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ছন্দ–স্পন্দিত গদ্যে লেখা পের্স–এর কবিতায় ধ্রুপদী আর আধুনিকের, মহাকাব্য আর গীতিকবিতার কোনো বিরোধ নেই, বিরোধ নেই কবিতা আর গদ্যের। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, অতীত আর বর্তমান সেই কবিতার উচ্চারণে, ভাষাশরীরে মিশে গেছে। পের্স–এর কবিতা তথাকথিত অর্থে দুর্বোধ্য অর্থাৎ তার বহু–পঠন সম্ভব এবং স্বাভাবিক। ব্যঞ্জক ধ্বনি–সংগঠন, শব্দালংকার আর অর্থালংকারের ব্যবহার, ছন্দস্পন্দন আর বহু–পঠনের সম্ভাবনা এই কবিতাকে অননুবাদ্য করে তুলেছে। আমাদের অনুবাদের পঠন–লিখনে এই কবিতার সামান্যতম অনুরণন যদি ধরা পড়ে থাকে তাহলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল বলে আমরা মনে করব।
এখানে কবির “আনাবাজ” (ফ. Anabase/ইং. এনাবেসিসAnabasis, ১৯২৪) ও “নির্বাসন” (Exil /Exile, ১৯৪১) কবিতার কয়েকটি অংশ অনূদিত হয়েছে। দূর–প্রাচ্যে, চিনে ফরাসি দূতাবাসে সচিবের পদে কাজ করার সময় পিকিং (বেইজিং) থেকে বেশ কিছু দূরে একটি পরিত্যক্ত তাও মন্দিরে পের্স প্রথম কবিতাটি লেখেন। কবিতাটির নাম ধ্রুপদী গ্রিক সাহিত্যের একটি বিখ্যাত রচনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, রচনাটি হল জেনোফন–এর (Xenophon /ক্সেনোফন, Ξενοφῶν , সা.পূ. পঞ্চম শতক) “আনাবাসিস” (Ανάβασις বা কিরু আনাবাসিস Κύρου Ανάβασις), ক্সেনোফোন–এর রচনাটির অনুপ্রেরণায় আরিয়ান (Arrian/ আরিয়ানস Ἀρριανός, সাধারণ অব্দের দ্বিতীয় শতক) আলেকজান্ডার–এর অভিযানের বিষয় নিয়ে “আলেকজান্ডার–এর আনাবাসিস” (Anabasis of Alexander/আনাবাসিস আলেক্সান্দ্রু Ανάβασις Αλεξάνδρου) রচনা করেন। দীর্ঘ কবিতাটির শিরোনাম উপরচনা Anabase কবিতাটিকে জেনোফন আর আরিয়ান–এর ঐতিহাসিক রচনার আন্তঃরাচনিক পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে যেখানে অতীত আর বর্তমান, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য, পুরাণ আর ইতিহাস, একাকার হয়ে যায় আর যেখান থেকে শুরু হয় উপলব্ধির অভিযান বা “আনাবাজ”। ব্যক্তিগত জীবনে আলেক্সি স্যাঁ–লেজে লেজে ছিলেন ফরাসি সরকারের বিদেশ দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। যুদ্ধের শুরুতে আলেক্সি লেজে ইংল্যান্ড হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে আশ্রয় নেন। হিটলারের নাৎসি বাহিনি যখন প্যারিসে ঢোকে তখন তারা তদন্তের নামে আলেক্সি স্যাঁ–লেজে লেজে অর্থাৎ স্যাঁ–জন পের্স–এর বাসস্থানে ঢুকে তাঁর লেখা সহ বহু কাগজপত্র পুড়িয়ে ধ্বংস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা–নির্বাসনের সময় নিউ জার্সির লঙ বিচ আইল্যান্ডে তিনি লেখেন তাঁর কবিতা “নির্বাসন” (ফ. এগজিলExil / ইং.Exile)। কবিতাটি শিকাগোর “পোএট্রি” (Poetry) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (মার্চ ১৯৪২)।
প্রসঙ্গত স্মরণীয় ১৯১২ সালে ২৫ বছরের স্যাঁ–জন পের্স ছ মাস লন্ডনে ছিলেন, ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর নিজের করা কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ, যা বই আকারে প্রকাশিত হয়। (ওই বই পরের বছর নোবেল পুরস্কার পায়)। পুরস্কার পাওয়ার আগে পের্স রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। তিনিই একটি বই পাঠিয়ে অঁদ্রে জিদকে রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্পর্কে অবহিত করান আর তাঁরই উৎসাহ আর চেষ্টায় জিদ রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলির অনুমোদিত ফরাসি অনুবাদ করেন। জানা যায় ফরাসি সাহিত্যজগতে সম্পূর্ণ অপরিচিত তিনজন ফরাসি ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলির ফরাসি অনুবাদে আগ্রহ দেখান আর তার মধ্যে একজন ( অজানা কোনো এক জঁ দ রোজেন/Jean de Rosen) পুরো অনুবাদের পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্রনাথ আর তার ইংরেজ বন্ধুবান্ধবদের দেখার জন্য জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পের্স–এর প্রয়াসে অঁদ্রে জিদের (André Gide, ১৮৬৯– ১৯৫১) অনুবাদের প্রস্তাব গ্রাহ্য হয়। “নীতিবিরোধী” ( L’immoraliste, ১৯০২), “অমিতব্যয়ী পুত্রের ফিরে আসা” ( Le retour de l’enfant prodigue, ১৯০৭), “সরু দরজা” (La porte étroite, ১৯০৯), ইত্যাদি উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবে খ্যাত, ১৯০৮ থেকে বিখ্যাত “নুভেল রভ্যু ফ্রঁসেজ”–এর পরিচালক–সম্পাদক (Nouvelle Revue Française ) ফরাসি সাহিত্যজগতে খুবই পরিচিত ছিলেন। জিদ–এর ফরাসি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথকে অইংরেজিভাষী পাশ্চাত্যে পরিচিত করে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম–শতবার্ষিকী উপলক্ষে ফরাসি সরকারের আহ্বানে স্যাঁ–জন পের্স “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ” (Hommage à la mémoire de Rabindranath Tagore) নামে একটা রচনা পাঠান।
“আনাবাজ”–এর একাধিক বাংলা অনুবাদ আমাদের চোখে পড়েছে: বই হিসেবে প্রকাশিত ১. বার্নিক রায়–এর অনুবাদ , ২. শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ও অসীমকুমার রায়–এর অনুবাদ (১৯৯৫); একাধিক সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত ৩. পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আর ৪.সুকুমার ঘোষের অনুবাদ। এর মধ্যে দ্বিতীয় অনুবাদটির শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকার কয়েকটি বাক্য সম্পর্কে কিছু বলা দরকার বলে আমাদের মনে হয়েছে। শরৎকুমার লিখেছেন, “রাজনীতিঘেঁষা চাকরি করার পাশাপাশি স্যাঁ–জন প্যার্স কবিতা অনিয়মিতভাবে লিখে গেছেন।… আনাবাজ… কাব্যের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। প্রথম ইংরেজি অনুবাদ টি. এস. এলিয়টের করা । বেরিয়েছে ১৯৩১ সালে, তারপর তিনবার সংশোধিত হয়ে তার তিনটি নতুন সংস্করণ বেরয়… ফরাসি ভাষাভাষীদের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে প্যার্সের দুরূহ রচনা এলিয়টের মধ্যস্থতায় মুক্তি পেয়েছিল, কিন্তু তাতে এলিয়টের মৌলিক অবদান মিশেল ছিল। সে কাব্য সুশ্রাব্য কিন্তু অনুগত নয়। আমরা এখন ফরাসির সঙ্গে এলিয়ট–কৃত ইংরেজির যে ভাষাগত অসংগতি দেখতে পাই , তাতে মনে হয় মূল রচয়িতার যোগসাজস ছিল। এমনও হতে পারে, বৃহত্তর জগতের সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন এলিয়টের মতো একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, এতে স্যাঁ–জন প্যার্স খানিকটা কৃতজ্ঞতা ও সৌজন্যবশত বিশেষ বাধা সৃষ্টি করেন নি।” এর আগে তাঁর অনুবাদের আদর্শ বোঝাতে গিয়ে শরৎকুমার বলেছেন, “এলিয়ট নিজে একজন বড় মাপের কবি হওয়ায় মূল রচয়িতার কলাকৌশল উপেক্ষা করে স্থানে স্বাধীনতা নিয়েছেন। — হয়তো বৃহত্তর স্বার্থে। আমরা তা পারি না। আমরা মনে করতে চাই, অনুবাদকের দ্বারা কোনো মৌলিক অনুদান নিষিদ্ধ, এলেয়ট তার তোয়াক্কা করেন নি।” ওপরের বাক্যগুলিতে এমন কিছু বাক্য রয়েছে যা আমাদের মনকে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি করে। যুদ্ধের আরম্ভের কিছু আগে পের্স ফরাসি সরকারের বৈদেশিক দপ্তরের সাধারণ বা প্রধান সচিব ছিলেন, অতএব তিনি ফরাসি বৈদেশিক নীতির সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁর হিটলার বিরোধিতার কথা হিটলারও জানতেন। তাই তিনি “রাজনীতিঘেঁষা চাকরি” করতেন বলাটা সমস্ত ব্যাপারটাকে লঘু করে দেখা, তাছাড়া “প্যার্স অনিয়মিতভাবে কবিতা লিখে গেছেন।” বলতে কী বোঝানো হয়েছে, প্লেইয়াদ সংস্করণের রচনা–সমগ্রে তাঁর কবিতার বিস্তার শ চারেক পৃষ্ঠা। বোদলের, ব়্যাঁবো, মালার্মে, লোত্রেয়ামোঁ–র কবিতা তো এর চেয়ে কম। “ফরাসি ভাষাভাষীদের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে প্যার্সের দুরূহ রচনা এলিয়টের মধ্যস্থতায় মুক্তি পেয়েছিল”—পের্স–এর সমসাময়িক ফরাসি ভাষার লেখক হলেন ভালেরি, ক্লোদেল, অঁতোন্যাঁ আর্তো, প্রুস্ত, আপলিনের, সঁদ্রার, ব্রতোঁ, এল্যুয়ার, আরাগোঁ, সার্ত্র্, কাম্যু এবং আরো অনেকে। এঁরাও বুঝি ইংরেজিতে অনুবাদের মাধ্যমেই পরিচিত হয়েছেন? “ফরাসি ভাষাভাষীদের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্তি” এই বাচনের মধ্যে লেখকের ইয়োরোপীয় সাহিত্য সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণার সঙ্গে নিজের ঔপনিবেশিত মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায়। লেখক “ফরাসির সঙ্গে এলিয়ট–কৃত ইংরেজির যে ভাষাগত অসংগতির” কথা বলেছেন তা প্রায় সমস্ত কবিতার অনুবাদে স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় কেননা কবিতার অনুবাদ পঠন–লিখন (Reading-Writing), অনুবাদকের নিজস্ব পঠন নির্ভর নিজস্ব লিখন প্ররচনা আর অনুরচনার মধ্যে স্বাভাবিক দূরত্ব তৈরি করে । অঁদ্রে জিদের করা রবীন্দ্রনাথের ফরাসি অনুবাদের কথা বলতে গিয়ে পের্স বোদলের–এর করা এডগার অ্যালেন পো–র ফরাসি অনুবাদের কথা বলেছিলেন। সে অনুবাদও স্বাভাবিকভাবে অনেকটা সরে গেছে, যেমন সরে গেছে বুদ্ধদেব বসুর করা বোদলের–এর বাংলা অনুবাদ । “আমরা মনে করতে চাই, অনুবাদকের দ্বারা কোনো মৌলিক অনুদান নিষিদ্ধ,” একথা বহু বিখ্যাত অনুবাদ সম্পর্কেই বলা যায় না। তাছাড়া ১৯৩০ সালে এলিয়ট পের্স–এর চেয়ে অধিক পরিচিত “বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব” হন নি।
এলিয়টের অনুবাদের আগে ১৯২৬ সালে আদামোবিচ ও ইভানফ–এর করা “আনাবাজ”–এর রুশ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ইতালিয়ান কবি জুসেপ্পে উনগারেত্তি ইতালিয়ানে রচনাটির অনুবাদ শুরু করেন ১৯২৬ সালে, তাঁর অনূদিত রচনাটি প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। ইতিপূর্বে রাইনের মারিয়া রিলকে পের্স–এর “প্রশস্তি” কাব্যের একটি অংশ জার্মানে অনুবাদ করেছিলেন, তিনি “আনাবাজ” অনুবাদের কথা ভাবলেও শেষ পর্যন্ত ভাল্তের বেঞ্জামিন আর বের্নার গ্রুতইজেন–এর অনুবাদ দেখে নিজের অনুবাদের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। ১৯২৯ সালে ওই অনুবাদের ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬১ সালে অনুবাদটি প্রকাশিত হয়।
“আনাবাজ” (Anabase) থেকে
গান
ব্রোঞ্জের পাতার তলায় জন্ম নিচ্ছিল একটা ঘোড়ার বাচ্চা। একটি লোক আমাদের হাতে দিল তেতো জাম। ভিনদেশি। সে পথ চলছিল। আর এই তো আমার পছন্দসই অন্যসব দেশগাঁয়ের শোরগোল।… “কন্যা আমার, বছরের সবচেয়ে বড় গাছের তলায় তোমাকে আমি অভিবাদন জানাই ।”
*
কেননা সূর্য প্রবেশ করছে সিংহরাশিতে আর ভিনদেশিটি তার আঙুল পুরে দিয়েছে মৃতদের মুখের ভেতর । ভিনদেশি। সে হাসছিল। আর আমাদের একটা গুল্মের কথা বলে। আহ্ ! দেশগাঁয়ে এত হাওয়া। আমাদের যাত্রাপথে কী যে আরাম। তূর্যধ্বনি আমার কাছে কী যে মন ভোলানো আর ডানার কেলেঙ্কারির মধ্যে জ্ঞানী পালকটি !… “আমার অন্তরাত্মা , দীর্ঘকায় কন্যা, তোমার যেসব নিজ্বস্ব রীতিনীতি ছিল তা আমাদের নয়।‘‘
*
ব্রোঞ্জের পাতার তলায় জন্ম নিল একটা ঘোড়ার বাচ্চা। একটি লোক আমাদের হাতে দিয়ে গেল এই তিক্ত জামগুলো। ভিনদেশি। সে পথ চলছিল। আর এই ব্রোঞ্জের একটা গাছের ভেতর বিরাট একটা শোরগোল। অ্যাসফ্যাল্ট্ আর গোলাপ, গানের অবদান। ঘরগুলোর ভেতর বজ্র আর বাঁশি। আহা ! আমাদের পথে পথে এমন আরাম, আহ্, বছর ধরে এত সব গল্প, আর ভিনদেশি তার রীতি অনুযায়ী সারা পৃথিবীর পথে পথে ! … “বছরের সবচেয়ে সুন্দর বসনে ঢাকা, কন্যা আমার, আমি তোমাকে অভিবাদন জানাই ।”
|| ১. ||
তিনটি মহান ঋতুর বুকে নিজেকে সসম্মানে স্থাপন করে যেখানে আমি আমার বিধি–বিধান প্রতিষ্ঠা করেছি সেই ভূমিতে ভবিষ্যতের মঙ্গলচিহ্নগুলি লক্ষ করছি ।
ভোরে অস্ত্রসস্ত্র সুন্দর আর সমুদ্র। আমাদের ঘোড়াগুলোর জন্য উন্মুক্ত নির্বীজ পৃথিবীর
দাম আমাদের কাছে ওই অপাপবিদ্ধ আকাশের সমান। এবং সূর্যের নাম করা না হলেও আর তার শক্তি আমাদের মাঝখানে
আর সকালে সমুদ্র অন্তরের একটি অনুমানের মত।
শক্তি, তুমি আমাদের রাতের যাত্রাপথে গান গাইছিলে।
…সকালবেলার শুদ্ধ উত্সবে, আমাদের চেয়ে বয়সে বড়, স্বপ্ন সম্পর্কে কিইবা আমরা জানি?
আরো একটি বছরের জন্য তোমাদের মাঝখানে ! শষ্যের প্রভু, লবণের প্রভু, আর সার্বজনীন বস্তু সঠিক দাঁড়িপাল্লাগুলোর ওপর !
অন্য এক তীরের লোকদের আমি ডাকাডাকি করব না। প্রবালের শর্করা দিয়ে
আমি মোটেই শহরের উৎরায়ের বিরাট পাড়াগুলোর রেখাচিত্র আঁকব না । অথচ তোমাদের মধ্যে বাস করার ইচ্ছে আমার রয়েছে।
তাঁবুগুলোর দোরগোড়ায় তাবৎ জয়গৌরব! আমার ক্ষমতা তোমাদের মধ্যে ! আর নুনের একটা কণার মতো বিশুদ্ধ ধারণা তার আসর শুরু করে।
… আর আমি তোমাদের স্বপ্নের শহরে বারবার হানা দিচ্ছিলাম এবং জনশূন্য হাটে থামিয়ে দিচ্ছলাম আমার অন্তরাত্মার এই বিশুদ্ধ বাণিজ্য , তোমাদের মাঝখানে
অদৃশ্য আর পুনরাবৃত্ত খোলা হাওয়ায় যেরকম কাঁটার আগুন।
শক্তি, তুমি আমাদের আশ্চর্য যাত্রাপথে গান গাইছিলে !…
”…লবণের মধুর স্বাদে মনের সবকটি বল্লম…
…কামনার মৃত মুখগুলিকে আমি লবণ দিয়ে সজীব করে তুলব !
তৃষ্ণার প্রশস্তি করে, শিরস্ত্রাণে করে কে না পান করেছে বালির জল।
আত্মার লেনদেনে আমি তাকে সামান্যই দাম দিই।
(সূর্যের কোনো নাম করা হয় নি, তবু তার শক্তি আমাদের মাঝখানে রয়েছে।)
মানুষেরা, ধুলোর আর সব ধরনের জনতা, সওদাগর আর ব্যস্ততাহীন জনতা, সীমান্তের আর অন্য কোথাকার জনতা, এসব জায়গার স্মৃতিতে যাদের ভার খুবই সামান্য তোমরা সেই সব জনতা, উপত্যকা আর মালভূমি আর আমাদের নদীগুলোর সীমানা পেরিয়ে এই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ঢালুতে, চিহ্নগুলোর, বীর্যের গন্ধশোঁকা, প্রাচ্যের হাওয়ার পাপের স্বীকারোক্তি শোনা গুরুদেবরা: পথের চিহ্ন আর ঋতুগুলোর অনুসরণকারী, ভোরের মৃদু হাওয়ার মধ্যে শিবির গোটানো জনতা, পৃথিবীর খোসায় ওগো জলের সন্ধানীরা, ওগো সন্ধানীরা, অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য কারণের ওগো আবিস্কারকরা, তোমরা আরো জোরালো একটা লবণের চোরা কারবার কর না যখন সকালবেলায় সাম্রাজ্যগুলোর আর নিষ্প্রাণ জলরাশির একটা পূর্বাভাস পৃথিবীর রাশি রাশি ধোঁয়ার ওপরে অনেকটা উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যখন নির্বাসনের মাদলগুলো সীমান্তে বালুকার বুকে হাই তোলা অনন্ত কালকে জাগিয়ে দেয়,
শুদ্ধ বস্ত্রে তোমাদের মাঝখানে, আরো একটা বছর তোমাদের মাঝখানে। “আমার গরিমা সমুদ্রের বুকে আমার ক্ষমতা তোমাদের মধ্যে!
আমাদের অদৃষ্টে রয়েছে অন্য সব তীরভূমির এই হাওয়ার প্রতিশ্রুতি আর সময়ের বীজ বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় তুলাদণ্ডের শাস্তির চরমে একটা শতাব্দীর দীপ্তি…”
নুনের ভাসমান স্তরে ঝোলানো গণিত । মৃত্যুহীন জাহাজের খোলগুলোকে জাহাজঘাটায় টেনে নিয়ে এসে যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় কবিতা আমার কপালের সেই স্পর্শকাতর বিন্দুতে, আমি লিপিবদ্ধ করি সব চেয়ে মাতাল
পুরো একটা জনগোষ্ঠীর এই গীত !
|| ২ ||
যেসব দেশে বহু লোকের সমাগম সেখানেই বারবার সবচেয়ে বিরাট সব স্তব্ধতা, যেসব দেশে দুপুরে ঝিঁঝিদের সমাগম।
আমি হাঁটছি , তোমরা হাঁটছ নেবুঘাস ওয়ালা উঁচু উঁচু উৎরায়ের একটা দেশে, যেখানে বড়লোকদের ধোয়া জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া হয়।
আমরা পুরোটা জরির কাজ করা আর দুটো উজ্ঝ্বল রঙের পাড় বসানো রানির পোশাক টপকে যাই ( আহা ! নারীর কটু শরীর একটা পোশাকের বগলের জায়গায় কেমন দাগ লাগিয়ে দিতে জানে!)
আমরা পুরোটা জরির কাজ করা আর দুটো উজ্ঝ্বল রঙের পাড় বসানো তাঁর মেয়ের পোশাক টপকে যাই ( আহা ! টিকটিকির জিভ বগলের জায়গা থাকে কেমন পিঁপড়ে চয়ন করতে জানে!)
আর হয়ত দিন মোটেই গড়িয়ে যায় নি যখন না একই পুরুষ একটি নারী আর তার মেয়ের জন্য পুড়ে মরে নি ।
মৃতদের বিজ্ঞ হাসি, খোসা ছাড়িয়ে ওই ফলগুলো আমাদের দেওয়া হোক!…কী কাণ্ড! জগতসংসারে বুনো গেলাপের তলায় আর কোনো ক্ষমা নেই ?
জগতের এপাশ থেকে জলের ওপর বিরাট একটা বেগুনি অসুখ আসছে । বাতাস বইতে শুরু করেছে। সমুদ্রের বাতাস। আর ধোয়া কাপড়–চোপড়
বিদায় নিচ্ছে ! যেন টুকরো টুকরো করা একজন পুরোহিত…
“নির্বাসন” (Exil) থেকে
॥ ১ ॥
দরজাগুলো খোলা বালির বুকে , দরজাগুলো খোলা নির্বাসনের বুকে ,
চাবি বাতিঘরের লোকদের কাছে, আর চৌকাঠের পাথরের চক্রে
সূর্য জীবন্ত বন্দী
গৃহকর্তা, বালির ওপর আপনার কাচের বাড়িটা আমায় ছেড়ে দিন…
খড়িমাটির গ্রীষ্ম আমাদের ক্ষতস্থানে তার বর্শাফলকগুলো শান দেয়,
ঋতুগুলোর অস্থিভাণ্ডের মতো জাজ্বল্যমান আর শূন্য একটা জায়গা আমি বেছে নিচ্ছি,
আর পৃথিবীর সমস্ত তীরভূমিতে, ধূমায়িত দেবতার আত্মা তার অ্যাস্বেস্টসের শয্যা ত্যাগ করে।
বিদ্যুৎ–চমকগুলি তোরিদ–এ রাজকুমারদের বিনোদনের জন্য।
॥ ২ ॥
কোনো তীরভূমিতে উৎসর্গিত নয়, কোনো পৃষ্ঠায় উপস্থাপিত নয় এই গানের শুদ্ধ মুখ…
অন্যেরা মন্দিরের বেদীর রঙীন শিঙা তুলে নেয়:
আমার জয়গৌরব বালিতে ! আমার জয়গৌরব বালিতে !… আর ব্যাপারটা মোটেই ঘুরে বেড়ানো নয় হে যাযাবর,
নির্বাসনের অপচয় দিয়ে নাস্তি থেকে জন্ম নেওয়া একটা মহৎ কবিতা, নাস্তি থেকে তৈরি করা একটা মহৎ কবিতা সমাহার করার জন্য সবচেয়ে শূন্য পটভূমি চাওয়াটা একটুও ভ্রান্তি নয়…
শিস্ দাও, হে পৃথিবীর চারদিকের ফিঙেগুলো, গান কর, জলের বুকে হে শঙ্খেরা !
অতল গহ্বর, তরঙ্গোৎক্ষিপ্ত শীকর আর বালির ধোঁয়ার ওপর আমি ভিত্তি স্থাপন করেছি। আমি শুয়ে পড়বো জলাধার আর ফাঁপা জাহাজে,
তাবৎ অব্যবহার্য আর বিবর্ণ জায়গায় যেখানে সমাহিত রয়েছে মহত্বের আস্বাদ।
“… কমই বাতাস জুলদের বংশের প্রশস্তি করেছিল, কমই কুটুম্ব বিপুল পুরোহিতগোষ্ঠীকে সহায়তা করেছিল।
যেখানে রাশি রাশি বালি তাদের গান গাইতে যায় সেখানেই বিদায় নেয় নির্বাসনের রাজকুমারেরা,
যেখানে ছিল উঁচু খাটানো পালগুলো সেখানেই বীণকরের স্বপ্নের চেয়েও রেশমি–কোমল ধ্বংসাবশেষের গতি,
যেখানে ছিল বিরাট সব সামরিক কর্মকাণ্ড সেখানে ইতিমধ্যেই সাদা হয়ে ওঠে গাধার চোয়ালের হাড়।
আর চারপাশে ঘোরার সময় সমুদ্র তীরভূমিগুলিতে তার করোটিনিনাদ ধ্বনিত করে,
আর পৃথিবীর তাবৎ ব্যাপার তার কাছে অর্থহীন হয়ে উঠুক, এ কথাটাই কোনো এক সন্ধ্যায়, পৃথিবীর তীরপ্রান্তে, নির্বাসনের বালুকায়,
বাতাসের রক্ষীবাহিনী আমাদের শোনায়…”
ফেনার প্রজ্ঞা, নুনের চিড়্ চিড়্ শব্দে আর বাখারিচুনের দুধে হে হৃদয়ের মড়কসমূহ !
অন্তরাত্মার অত্যাচার হিসেবে আমার ভাগে পড়ে একটা বিজ্ঞান… বাতাস আমাদের শোনায় তার তাবৎ বোন্বেটে–গিরির গল্প, বাতাস আমাদের শোনায় তার যত ভুলভ্রান্তির গল্প !
মরুভূমির প্রবেশপথে, দড়ির পাশ হাতে, অশ্বারোহীর মতো,
রঙ্গভূমিতে আমি সবচেয়ে মঙ্গলসূচক চিহৃগুলির সবচেয়ে বিরাট ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করি।
আর প্রভাত আমাদের জন্য তার ভবিয্যৎ–জ্ঞাপক আঙুল পবিত্র রচনাবলীর মধ্যে বুলিয়ে যায়।
নির্বাসন কখনোই গতকালের নয় ! নির্বাসন কখনোই গতকালের নয় ! “ হে পদচিহ্নগুলি ! হে উপলক্ষগুলি !”
বালির মধ্যে ভিনদেশি বলে, “জগতে প্রত্যেকটি জিনিসই আমার কাছে নতুন !…” আর তার গানের জন্ন তার কাছে কম অদ্ভুত নয়।
॥ ৩ ॥
“…সব সময় ছিল এই কলকোলাহল, সব সময় ছিল এই জাঁকজমক।
আর পৃথিবী জুড়ে অভিযানে বার হওয়া বীরত্বের ঘনঘটার মতো, নিষ্ক্রমণের মুহূর্তে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকগণনার মতো, সেনাপতিদের গর্জনের মধ্যে সাম্রাজ্যগুলির ভিত্তিস্থাপনের মতো, আহা ! মহৎ গ্রন্থগুলির জন্মক্ষণে ওষ্ঠাধরের স্ফীত হয়ে ওঠার মতো।
পৃথিবী জুড়ে বিপুল এই বধির বস্তুটি আর সহসা তা একটা মাদকতার মতো বেড়ে ওঠে।
…সব সময় ছিল এই কলকোলাহল, সব সময় ছিল এই মহিমা।
পৃথিবী জুড়ে এই ভ্রাম্যমান বস্তুটি, পৃথিবী জুড়ে এই ভাবাবেশ, আর এই পৃথিবীর তাবৎ বেলাভূমিতে, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত, একই তরঙ্গ উচ্চারণ করে
চিরকাল অবোধ্য দীর্ঘ যতিবিহীন অনন্য একটি বাক্য…
…সব সময় ছিল এই কলকোলাহল, সব সময় ছিল ক্রোধের এই উন্মাদনা।
আর প্রবেশপথের চূড়া অব্দি আছাড় খাওয়া ঢেউ, সব সময়, কামনার চূড়া অব্দি, ডানায় ভর করা একই গাংচিল, নিজের বাসায় একই গাংচিল, প্রচণ্ড গতিতে উড়তে উড়তে নির্বাসনের কবিতাগুলির সমাবেশ ঘটায়, এই পৃথিবীর তাবৎ বেলাভূমিতে, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত, ছন্দহীন একই বিলাপ,
বালির বুকে, আমার নুমিডিয় অন্তরাত্মার অনুসরণে…
আমি তোমায় চিনি, ওগো দানব! এইতো আবার আমরা মুখোমুখি। যেখানে আমরা থেমে গিয়েছিলাম ঠিক সেখান থেকেই আবার ওই দীর্ঘ বিতর্ক শুরু করা যাক।
আর তুমি তোমার যুক্তিগুলোকে জলের ওপর মাথা নিচু করা পশুতুণ্ডের মতো এগিয়ে দিতে পার: আমি তোমাকে এতটুকু অবসর বা বিরতি দেব না।
দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই ইতিমধ্যে দেখা অনেক বেলাভূমিতে আমার পায়ের ছাপ ধুয়ে মুছে গেছে, অনেক পরিত্যক্ত শয্যায় আমার অন্তরাত্মা নীরবতার কর্কট–ব্যাধির কাছে নিবেদিত হয়েছে।
হে আদি নিঃশ্বাস–বায়ু, আমার কাছ থেকে আরো কী তুমি চাও? আর আমার জীবন্ত ঠোঁট থেকে আরো কী তোমরা টেনে বার করে আনতে পারবে বলে ভাবছ?
আমার ঘরের চৌকাঠের ওপর হে ভ্রাম্যমান শক্তি, আমাদের চলার পথে হে ভিখারিনী, অমিতব্যয়ীর পদচিহ্ন ধরে
বাতাস আমাদের শোনায় তার বার্ধক্যের গল্প , বাতাস আমাদের শোনায় তার যৌবনের গল্প… হে রাজকুমার তোমার নির্বাসনকে সম্মান কর!
…আরো আরো উঁচুতে, প্রতি রাতে, আমার চৌকাঠে এই মূক কলকোলাহল, আরো আরো উঁচুতে, প্রতি রাতে, খোলসের ভেতরে শতাব্দীগুলির এই জাগরণ.
পৃথিবীর তাবৎ বেলভূমিতে, অমার অস্তিত্বের খাদ্যে পরিপুষ্ট হওয়ার জন্য আরো ভয়ানক একটা শ্লোক!…
এতখানি উচ্চতা তোমার চৌকাঠের খাড়া তীরভূমিকে ফুরিয়ে দিতে পারবে না, হে ঊষার পরশুধারী,
তোমরা যারা নিজেদের কঠোর স্বভাবে যারা ঈগলকে পোষ মানাও তোমরা যারা লোহার কলমের তলায় সবচেয়ে কটু মেয়েদের পরিপুষ্ট কর
জন্ম নিতে চলেছে এরকম প্রতিটি বস্তু পৃথিবীর প্রাচীতে অধৈর্য হয়ে ওঠে, জন্ম নিচ্ছে এরকম প্রতিটি শরীর দিনের প্রথম আগুনে জয়োল্লাস করে
আর এইতো পৃথিবী জুড়ে অন্তরাত্মার বিদ্রোহের মতো বিশাল একটা কলরব জেগে ওঠে,
কলকোলাহল, তুমি তো কখনো নীরব হবে না! হতে পারে বালির ওপর তাবৎ মানবিক বিশ্বস্ততাকে পুরোটা আমি উজার করতে পারি নি। (আমার জন্মস্থান কোথায় কেই বা এখনো তা জানে?)