মহাত্মার মুখোসের আড়ালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি পুস্কর দাশগুপ্ত Mohandas Karamchand Gandhi Under the mask of Mahatma Pushkar DASGUPTA

 

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি : মুখ আর মুখোস

পুষ্কর দাশগুপ্ত

GANDHI 3

গান্ধি ভারতের স্বাধীনতার স্থপতি? ভারতীয় জাতির জনক ?

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি নাকি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করেছেন। আবার তিনি নাকি ভারতীয় জাতির জনক, সরকারিভাবে এটা স্বীকৃত তথা প্রচারিত। এছাড়া তাঁর অবদান হল অহিংসা, অসহযোগ, সত্যাগ্রহ। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ব্যক্তি গান্ধির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেছেন। গান্ধি আন্তর্জাতিকভাবে ভারতীয় ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা এক কথায় ভারতীয়ত্বের প্রতিভূপ্রতীক। তাঁর জন্মদিন সারা ভারতে ছুটির দিন, সরকারিভাবে উদযাপিত গান্ধিজয়ন্তী, সারা পৃথিবীতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক অহিংসাদিবস। গ্রাম, আড়ম্বরহীন আর কুটিরশিল্পভিত্তিক (চরকা, খাদি) অর্থনীতি আর অন্যদিকে অহিংসা, সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, আত্মশুদ্ধি (অনশন, ব্রহ্মচর্য, মৌনব্রত, নিরামিষ) ইত্যাদি ধারণার ভিত্তিতে ধর্ম (সত্য, ঈশ্বর) ও রাজনীতির মিশ্রণ — এসব উপাদানে গড়ে উঠেছে গান্ধির ভারতীয়ত্বের কল্পরূপ বা ভাবমূর্তি । জাতির বহুপ্রচারিত এই ‘বাপুজী’ সম্বন্ধে আমি বা তুমি কী ভাবলাম বা বললাম তাতে কার কী এসে যায়।

গান্ধিকে নিয়ে দেশে বিদেশে প্রচারের অন্ত নেই। সরকার আর কায়েমি স্বার্থ তা অবিরত প্রচার করে, পাশ্চাত্যও ঐ প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। গান্ধির রচনাবলি, গান্ধির ওপর দেশি বিদেশি বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য বই, চলচ্চিত্র (ইংরেজিতে Gandhi, The Making of the Mahatma), নাটক (ফরাসিতে L’Indiade), দেশে বিদেশে গান্ধির মূর্তি, সারা পৃথিবীতে ব্রিটেন সহ নানা দেশ থেকে বের হওয়া প্রায় আড়াইশ ডাকটিকিট । দেশময় চারদিকে গান্ধির ছবি, বাণীর ছড়াছড়ি— সরকারি নথিপত্রে, দপ্তরে, এক থেকে এক হাজার অব্দি কাগুজে টাকার নোটে । নির্বাচনী সভা কি সরকারি অনুষ্ঠানে নেতাদের মাথায় গান্ধিটুপি।

দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধি 

 

আজকের ভারতে গান্ধির প্রাসঙ্গিকতা

এখন প্রথম প্রশ্ন হল আজকের ভারতে বহুপ্রচারিত ‘জাতির জনক’ গান্ধির প্রাসঙ্গিকতাটা কী বা কতটা? গান্ধির মৃত্যুর পর তেষট্টি বছর কেটে গেছে, স্বাধীন ভারতের বয়সও চৌষট্টি পেরিয়ে গেল। কিন্তু আজকের স্বাধীন ভারতে তথাকথিত ‘বাপুজী’ গান্ধির ১৯৩৮ সালের প্রস্তাব মেনে সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয় নি, বরং বাজেটের সিংহভাগ খরচ করা হচ্ছে সামরিক খাতে । শিক্ষা, সরকারি কাজ তথা ব্যবসাবাণিজ্য, যোগাযোগ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই হিন্দি বা/এবং মাতৃভাষার বদলে বিদেশি ইংরেজি ভাষা আরো জাঁকিয়ে বসেছে। গান্ধির প্রিয় শিষ্য আর সাকরেদদের (নেহরু, বিড়লা, বাজাজ, ইত্যাদি) বংশধররা সবাই ইংরেজিতে ইংল্যান্ডে বা মার্কিন মুল্লুকে পড়াশুনা করেছে, কেউ কখনো খাদি ছুঁয়েও দেখেনি। মদ নিষিদ্ধ বা মাদকসেবন বন্ধ হয় নি, বরং মদ্যপান ও মাদকসেবনের হার শহরে আর গ্রামেগঞ্জে জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। গান্ধির আশা তথা অভিপ্রায় অনুযায়ী বর্ণহিন্দু আর গান্ধির মার্কা দেওয়া ‘হরিজনদের’ মধ্যে, হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে সৌভ্রাত্বের বদলে বিভেদ ও বিদ্বেষ দৃঢ়মূল হয়েছে, মাঝে মধ্যেই তা রক্তক্ষয়ী হিংসার আকার নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে । জাতিভেদ ভারতের রাজনীতির একটা প্রধান উপাদানে পরিণত হয়েছে। ‘চরকার ঘর্ঘর পড়শির ঘর ঘর’ ছড়িয়ে পড়ে পড়া দূরে থাকুক চরকা নিয়ে কেউ আর বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না, কুটির শিল্পের পরিবর্তে ভারি শিল্প অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, স্বদেশির তুলনায় সর্বস্তরে ‘বিলিতি’ আরও বেশি কদর পাচ্ছে। দারিদ্র্যের মহিমা কেউ বরণ করে নিচ্ছে না, পক্ষান্তরে দরিদ্র হয়ে উঠেছে আরও বেশি অপমান আর লাঞ্ছনার শিকার, ধনী আরও বেশি মান্য, ক্ষমতা ও প্রভুত্বের অধিকারী, তা তার ধন সৎঅসৎ যে উপায়েই আহৃত হোক না কেন। আর কৌতুহলের ব্যাপার, গান্ধিবিরোধী হিন্দু মহাসভার ভাবগত উত্তরাধিকারীরাই আজ জনতাকে ভজানোর জন্য গান্ধির উক্ত ‘স্বদেশি’ ‘রামরাজত্ব’ ইত্যাদি আউড়াচ্ছে। অনাদিকে যারা নিজেদের গান্ধির ভক্ত ও অনুসারী বলে দাবি করে, ‘জাতির জনকের’ সেই প্রথম সারির সুবিধাভোগী ক্ষমতাসীন অপত্যরা অবাস্তব ভেবেই গান্ধির ধ্যানধারণার বাস্তব রূপায়ণের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে নি, তবে আমজনতাকে ধোঁকা দেওয়ার প্রয়োজনে তারা এতকাল গান্ধির বাণী আউড়ে এসেছে আর আজও আউড়ে যাচ্ছে, তবে তারা কেউ ক্ষমতা ও সম্পদের লোভে দুর্নীতি, শটতা, কপটতা বা হিংসার আশ্রয় নিতে একটুকু দ্বিধা করে না। এদেশে যেমন কালিভক্ত মার্ক্সবাদীর অভাব নেই তেমনি চারদিকে বোমাবাজ ‘অহিংস’ গান্ধবাদীও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘স্বাধীন’ ভারতে বস্তুত গান্ধিবাদী কংগ্রেস সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলের অপরিহার্য অংশ হচ্ছে গুন্ডাবাহিনী। এর থেকে বোঝা যায় ভারতীয় গণজীবনে তথা রাজনীতিতে গান্ধির প্রাসঙ্গিকতাটা পোযাকি ছাড়া আর কিছুই নয়।

গান্ধির কল্পরূপ বা ভাবমূর্তি: কী, কেন, কীভাবে তা গড়ে তোলা হয়েছে

বর্তমান ভারতে গান্ধির কোনো প্রাসঙ্গিকতা না থাকলেও দেশেবিদেশে গান্ধি হলেন ভারতীয়ত্বের তথা ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার প্রতীক, মূর্ত রূপ । তাই আমাদের প্রথম প্রশ্ন হল

গান্ধি কি সত্যি ভারতীয় সংস্কৃতি, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা অরথাৎ ভারতীয়ত্বের প্রতিভূপ্রতীক? যদি তা হয় তাহলে কোনো প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে দেখতে হবে এই ভাবমূর্তি কীভাবে, কী উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে বা/এবং গড়ে তোলা হয়েছে; কারা এই ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে; বাস্তবের অর্থাৎ গান্ধির কর্মকাণ্ড আর ঐতিহাসিক ভূমিকার যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণে ঐ ভাবমূর্তির কতটা অক্ষত থাকে।

একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে গান্ধি একবার বলেছিলেন, তাঁর জীবনই তাঁর বাণী। তারপর থেকে তাঁকে, তাঁর ধ্যানধারণা, তাঁর আদর্শ বোঝার চাবিকাঠি হিসেবে এই উক্তি পুনরাবৃত্ত হয়। আমরাও তাঁর কর্মময় জীবনকে অনুসরণ করতে পারি।

রক্ষণশীল গুজরাটি বানিয়া পরিবারে গান্ধির জন্ম (১৮৬৯)। স্কুলের শিক্ষা শেষ হওয়ার আগে চোদ্দ বছর বয়সে কিশোর গান্ধির বিয়ে হয়। গান্ধির বয়স যখন ষোল তখন তাঁর বাবা মারা যান (১৮৮৫) আর ঐ বছর তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়, কয়েক দিনের মধ্যে নবজাত শিশুটি মারা যায়। ছাত্র হিসেবে খুবই সাধারণ গান্ধি স্কুলের শিক্ষা করে ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান। ইংল্যান্ডে (১৮৮৮১৮৯১) ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে তিনি ভারতে ফিরে বোম্বাইতে আইনব্যবসা শুরু করে সাফল্য লাভ করতে পারেন না। ১৮৯৩ সালে গান্ধি একটা ভারতীয় কোম্পানির আইনজীবির হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। গান্ধি একুশ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটান। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসনকর্তৃপক্ষের ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়, গড়ে ওঠে তাঁর নৈতিক তথা রাজনৈতিক ধ্যানধারণা আর আদর্শ। ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ড হয়ে গান্ধি ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে গান্ধি অবিলম্বে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতায় পরিণত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ   করে। পরের বছর গান্ধি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এই হল সংক্ষেপে গান্ধির   জীবন ।

তাঁর আত্মজীবনীতে নিজের শৈশব আর কৈশোরের কথা বলতে গিয়ে গান্ধি তাঁর পরবর্তী জীবনের ধ্যানধারণার সূত্র উপস্থাপিত করেছেন :

আমার বাবারবিশেষ কোনো শিক্ষা ছিল নাতাঁর ধর্মীয় শিক্ষাও ছিল না বললেই হয়, তবে মন্দিরে গিয়ে ধর্মালোচনা শোনার ফলে অসংখ্য হিন্দুর যে ধরনের সহজ ধর্মজ্ঞান হয় তাই তাঁর ছিল।আমার স্মৃতিতে আমার মা যে অসামান্য ছাপ রেখে গিয়েছেন হল তাঁর ধর্মনিষ্ঠার। তিনি ছিলেন খুবই ধর্মপরায়ণ, পুজোপাঠ শেষ না করে তিনি কখনোই কিছু খেতেন না । প্রায়ই তিনি হাভেলিতে (বৈষ্ণব মন্দিরে ) যেতেন। চাতুর্মাস্য ব্রত একবারও তিনি ভেঙেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। চাতুর্মাস্যের সময় সারা দিনে একবার খাওয়াটা ছিল তাঁর কাছে খুবই সামান্য ব্যাপার । এতে সন্তুষ্ট না থেকে একবার চাতুর্মাস্যে তিনি একদিন পর একদিন উপোসকরেছিলেন । পরপর দুই বা তিন দিন উপোস করাটা তাঁর কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না।

আমার বাবামা ছিলেন বিশেযভাবে গোঁড়াবৈষ্ণবগুজরাটে জৈনধর্ম ছিল দৃ়ঢ়মূল আর সর্বত্র আর সমস্ত কাজেই তার প্রভাব অনুভূত হত। গুজরাটে জৈন ও বৈষ্ণবদের মধ্যে আমিষখাওয়ার বিরোধিতা ও তার সম্পর্কে যে নিন্দা যতটা জোরালো ছিল তা ভারতে বা সারা পৃথিবীতে কোথাও দেখা যায় না। এই ছিল আমার সংস্কার

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে আমার জন্ম হয়েছিল, তাই আমার হাভেলিতে যাওয়ার প্রসঙ্গ বারবার এসেছে।হাভেলিতে আমি যা পাইনি তাই আমি পেলাম আমার ধাই রম্ভার কাছ থেকে। রম্ভা ছিল আমাদের বাড়ির পুরনো চাকরানি। রামনাম জপআজরামনামআমার কাছে অমোঘ শক্তি, আমি মেনে নিচ্ছি ওর মূলে রয়েছে রম্ভাবাইয়ের বপন করা বীজ।

একবার অসুখের সময় আমরা কিছুদিন পোরব্ন্দরে ছিলাম। সেখানে রামমন্দিরেপ্রতিদিন সন্ধেবেলা রামায়ণ পাঠশুনতাম। শোনাতেন লাধা মহারাজ নামে একজন পণ্ডিত ৷তিনি ছিলেন রামচন্দ্রের পরম ভক্তওঁর সম্পর্কে বলা হত যে ওঁর কুষ্ঠরোগ ছিল তার চিকিৎসার বদলে উনি বিলেশ্বর শিবের পূজার পর ফেলে দেওয়া বেলপত্র কুষ্ঠরোগগ্রস্ত গায়ে বেঁধে শুধু রামনাম জপ শুরু করেন শেষে ওঁর বিশ্বাস কুষ্ঠরোগকে ধ্বংস করে দিলএকথা সত্যি যে আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন উনি সম্পূর্ণ নীরোগ।রামাযণের প্রতি আমার যে একান্ত ভালোবাসা তার ভিত্তি হল এই রামায়ণপাঠ শোনা।আজ আমার ধারণা তুলসিদাসের রামায়ণ হল ভক্তি মার্গের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।

আমার বাবামা যেমন হাভেলিতে যেতেন তেমনি যেতেন শিবমন্দির আর রামমন্দিরেজৈনসাধুরাও প্রায় আমার বাবার কাছে আসতেন

বেচারজি স্বামী আগে ছিলেন মোধ বানিয়া, তবে তিনি এখন একজন জৈন সন্ন্যাসী । তিনি ছিলেন পারিবারিক উপদেষ্টাতিনি আমাকে শপথ করালেন আর আমি কখনো মদ, মেয়েছেলে আর মাংস ছোব না বলে প্রতিজ্ঞা করলামএর পর আমার মা আমায় (ইংল্যান্ডে যাওয়ার) অনুমতি দিলেন।[নিম্নরেখা আমাদের]

ওপরেউদ্ধৃত গান্ধির আত্মজীবনীর শুরুর কয়েকটি টুকরোর মধ্যে আমরা দেখতে পাই

পরবর্তী কালে গড়ে ওঠা গান্ধির তথাকথিত ভারতীয়ত্বের ভাবমূর্তির প্রাথমিক উপাদান

(হিন্দু) ধর্ম, উপোস (অনসন/উপোস), নিরামিষ, রামনাম, রামায়ণ (রামরাজত্ব, রামধুন),

রামনামে কুষ্ঠরোগমুক্তি (একদিকে আত্মশুদ্ধি, অন্য দিকে বিজ্ঞানবিরোধিতা) ইত্যাদি

শব্দ তথা ধারণার সূত্র হল গান্ধির রক্ষণশীল, সংস্কাররাচ্ছন্ন গুজরাতি বৈষ্ণব পরিবারের প্রাত্যহিক বিচারহীন (হিন্দু) আচার আর তার সঙ্গে গুজরাটের জৈন ঐতিহ্য। গান্ধির জীবনকাহিনির পরের পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই এই ধারণার বীজগুলি পরিণতি লাভ করেছে ভিক্টোরীয় ইংরেজি শিক্ষা ও বাইবেল পাঠ থেকে আসা খৃস্টীয় পাপবোধ, থিয়োজফিস্টদের ধর্মসমন্বয়বাদী মরমি চিন্তা, পরবর্তীকালে রাসকিনএর (John Ruskin) কাছ থেকে পাওয়া সরল ও সমবেত জীবনের আদর্শ, থরো(Henry David Thoreau) অসহযোগ (civil disobedience) আর বৃদ্ধবয়সে ‘সাধু’ বনে যাওয়া টলস্টয়এর (Leo Tolstoy) অর্থোডক্স খৃষ্টীয় ‘অহিংসা’ ও ‘দারিদ্র্যব্রতের’ চিন্তা। এসমস্ত মিলে নিরামিষ (বিপ. আমিষ= পাপ), ব্রহ্মচর্যআত্মসংযম (বিপ. যৌনতা= পাপ), উপোস (= অনসন = পুণ্য = শুদ্ধি), মৌন (= শুদ্ধি), রাজা রাম (→ রামরাজত্ব) ইত্যাদি ধারণার সমীকরণ তৈরি হয়েছে। হিন্দু দর্শন, হিন্দু শাস্ত্র এমন কী অঞ্চল ও সম্প্রদায়ভেদে ‘হিন্দু’ বিশ্বাস ও আচারের ভিন্নতা সম্পর্কে গান্ধির বিশেষ কোনো ধারণা বা কৌতূহল ছিল না। আবার যেকোনো বিশ্বাসী সাধারণ ভারতীয়ের মতো নিজের পরিবার, জাত আর অঞ্চল থেকে সংস্কার ও প্রথার মাধ্যমে পাওয়া আচার আর ধ্যানধারণাকেই তিনি চরম এবং পরম বলে ধরে নিয়েছেন। আর এই সমস্ত ধারণাই বিশেষ একটা আকার ও মাত্রা পেয়েছে গান্ধির বিশেষ ধরনের পাপবোধের ভিত্তিভূমিতে। ভারসাম্য না পাওয়া, অবদমিত যৌনকামনার অপরাধবোধ গান্ধিকে সারা জীবন যন্ত্রনার্ত করেছে। এই অপরাধবোধ থেকে জন্মেছে পাপ করার সন্তাবনার আতঙ্ক, পাপবোধ। কৈশোরে পারিবারিক আচারের সীমারেখা লঙ্ঘন করে মাংস খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে একবার বেশ্যাবাড়ি যাওয়া, পিতার মৃত্যুর রাতে স্ত্রীসহবাস সম্পর্কে অপরাধবোধপূর্ণ খৃস্টীয় পাপস্খালনমূলক কনফেশন থেকে শুরু করে সাতষট্টি বছর বয়সে স্বপ্নদোষের ঘটনা নিয়ে অকারণ উদ্বেগ, সংষমের পরীক্ষা করার জন্য যুবতী মেয়েদের সঙ্গে এক বিছানায় শোয়ার বিকারপ্রস্ত চিন্তা অথবা (তাঁর চেলাদের) ভারতীয় মন্দিরগাত্রে ঈশ্বরের লীলার প্রকাশক শূঙ্গাররসাত্মক ভাস্কর্য ঢেকে দেওয়ার চিন্তা, কলিদাসের রচনা সম্পর্কে আপত্তিতে — এই উদ্বেগ ও আতঙ্কের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই পাপবোধের আতঙ্কেই একদিকে তাঁর বাচন ও কর্মকে ‘শুদ্ধির’ ভাবনায় আচ্ছন্ন করেছে, অন্যদিকে এই শুদ্ধির বোধ থেকে জন্ম নিয়েছে মধ্যযুগীর খৃস্টীয় সন্ন্যাসীদের চাবুক খাওয়ার মতো মর্ষকাম আত্মপীড়নের মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্তের বাসনা। মৌন, আমৃত্যু অনশন, ব্রহ্মচর্য, নিরামিষ, হিংসার সম্ভাবনায আন্দোলন প্রত্যহার ইত্যাদির মধ্যে হিন্দুত্ব বা ভারতীয়ত্বের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একদিকে ব্যক্তিগত অবচেতন স্তরে গান্ধির পাপ ও শুদ্ধির মনোবিকারগ্রস্থ বদ্ধমূল বোধ, অন্যদিকে সচেতন সামাজিকরাজনৈতিক স্তরে ছদ্ম ধর্মাচারের মিশ্রণে নিজের সাধু (গান্ধিমহারাজ) ভাবমূর্তির প্রতিষ্ঠা তথা কার্যসিদ্ধির উপায় হিসেবে তার ব্যবহার । প্রসঙ্গত বলা দরকার ভারতীয় চিন্তায় পাপের ধারণা আপেক্ষিক, যৌনতাকে পাপ বলে ভাবলে হিন্দুরা কখনো দেবদেবীর সম্ভোগ বর্ণনা করত না, বৃহদ্আরণ্যাকে উপনিষদে ব্রহ্মপ্রাপ্তির আনন্দকে নরনারীর যৌন মিলনের চরম মুহূর্তের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাছাড়া ঈশ্বরের লীলার হিন্দু ধারণার মধ্যে এই হিডোনিজম স্পষ্ট। গান্ধির মতে:

যদি তুমি বিরক্ত না হও তাহলে আমি আরো এগিয়ে গিয়ে বলব যে শৃঙ্গার হল সমস্ত রসের মধ্যে সবচেয়ে নিচুস্তরের রস

অথচ ভরতের নাট্যশাস্ত্র, ধ্রুপদী ভারতীয় নৃত্যশাস্ত্র অনুসারে শৃঙ্গার হল রসের রাজা, ভারতীয় রসবাদী নন্দনতত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্থান অনুসারে শৃঙ্গাররস আদিরস, নবরসের প্রধান, আনন্দবর্ধনের ভাষায় ‘সুকুমারতম’ রস, আবার গৌড়ীয় বৈষ্ণব মত অনুসারে সাধনমার্গের শ্রেষ্ট (রাগাত্মিকা তথা রাগানুগা ভক্তির) অবলম্বন হল মধুর রস (শৃঙ্গার রসের আধ্যাত্মিক রূপান্তর)। আর বদ্ধমূল বিকারগ্রস্ত পাপবোধ থেকে গান্ধি সর্বত্রই পাপ দেখতে পেয়েছেন, পাপ পাপ বলে চেঁচিয়েছেন:

একমাত্র ঈশ্বরই জানেন এই বন্যা আমাদের কোনো পাপের শাস্তি কিনাআমরা একে আমাদের পাপের শাস্তি বলে বিবেচনা করলে ভাল করব।

প্রচণ্ড ভূমিকম্পসুন্দর বিহারকে ছারখার করে দিয়েছে।ইচ্ছে হলে আপনারা আমাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলতে পারেন কিন্তু আমার মতো মানুষের পক্ষে একথা বিশ্বাস না করে উপায় নেই যে এই ভূমিকম্প ভগবানের দেওয়া আমাদের পাপের কঠোর শাস্তি।

একজন অসুস্থ মানুষ ঈশ্বরের কাছে এভাবে প্রার্থনা করবে: ভগবান এই অসুস্থতা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে করা আমার পাপের ফল, আমার পাপ থেকে আমাকে মুক্ত কর

এভাবেই আমরা পাপ গোপন করা থামাব। মহাভারতের অন্যতম সৌন্দর্য হল ব্যাস পাপ গোপন করার কোনো চেষ্টা করেন নি।

জিশুজগতের অনন্ত কল্যাণের জন্যতার পাপ ধুয়ে দেওয়ার জন্যতাঁর নিজের জীবন বলি দিয়েছিলেন১০

গুজরাটে বন্যা, বিহারের ভূমিকম্প, মানুষের অসুস্থতা সবই আমাদের পাপের শাস্তি: গান্ধির বক্তৃতা, চিঠি , বিভিন্ন রচনায় পাপের প্রসঙ্গ ছড়িয়ে রয়েছে। ওপরের উদ্ধৃতিগুলির একটিতে রয়েছে মহাভারতে ব্যাসের পাপ গোপন না করার কথা, কিন্তু মহাভারতে কোথাও পাপ প্রকাশ করা বা গোপন করার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয় নি। আসলে ব্যাসের নিজের বা পঞ্চপাণ্ডবের জন্মবৃত্তান্তে পাপ খোঁজা ভারতীয় নয়, খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যভিত্তিক ঔপনিবেশিক তথা ভিক্টোরীয় ইংরেজি শিক্ষার ফল। শেষের উদ্ধৃতিতে জগতের পাপ ধুয়ে দেওয়ার জন্য জিশুর আত্মবলির প্রসঙ্গ গান্ধির পাপবোধে বাইবেল, টলস্টয় আর ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

বুয়রযুদ্ধে ব্রিটিশদের বশংবদ স্বেচ্ছাসেবক সার্জেন্টমেজর র্গন্ধি ১৮৯৯

গান্ধির তথাকথিত ‘ভারতীয়ত্বের’ আরেক উপাদান হল ‘নিরামিষ’। গান্ধি বলেন:

হিন্দুরা আবার চারটি প্রধান জাতে বিভক্ত , যথা, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র। এদের মধ্যে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ আর বৈশ্যেরা তাত্ত্বিক ভাবে শুদ্ধ নিরামিষাসী। কিন্তু বাস্তবে ভারতীয়রা প্রায় সবাই নিরামিষাসী, একদল স্বেচ্ছায় , অন্যেরা বাধ্য হয়ে।১১

হিন্দুরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র এই চারটি প্রধান জাতে বিভক্ত এই উক্তিতে বোঝা যায় গান্ধি তাত্ত্বিক বর্ণাশ্রমের কাঠামোর সঙ্গে বাস্তব জাতিবিভাগকে গুলিয়ে ফেলেছেন। বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ণবিভাগ অস্পষ্ট অথচ জাতের সংখ্যা অসংখ্য, যেমন বাঙালি হিন্দুরা তাত্ত্বিক ভাবে (স্মৃতি ও পুরাণ অনুসারে) ব্রাহ্মণ আর শুদ্র এই দুটি বর্ণে বিভক্ত,অথচ বাঙালি হিন্দুদের জাতের সংখ্যা বহু । আমরা বুঝতে পারি নিজের অঞ্চল আর পরিচিতির বাইরে ভারতীয় সমাজের কোনো খবরই গান্ধি রাখতেন না বা রাখার প্রয়োজন বোধ করতেন না।এছাড়া গান্ধির বহুপ্রচারিত ‘নিরামিষ’ হিন্দুত্বের অপরিহার্য পরিচয় নয়। তাই যদি হত তাহলে হিন্দু শৈব বা শাক্ত আচারে আমিষ প্রহণের বিধান থাকত না। অথর্ব বেদের অন্তর্গত আয়ুর্বেদের ‘দ্রব্যগুণ সংহিতায়’ গোরু আর ষাঁড়ের মাংসেরও খাদ্য হিসেবে গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে। ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের (আসাম, বাংলা, উড়িষ্যার) বৈষ্ণব বাদ দিয়ে (তথাকথিত উচ্চবর্ণ সহ) তাবৎ হিন্দুরা মাছমংস খায়। তারা কি ভারতীয় নয়, নাকি হিন্দু সমাজের বহির্ভূত? রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ তো নিরামিষাসী ছিলেন না। তাঁরাও কি তবে হিন্দু ছিলেন না? অবশ্য জাতিবিভাগ অর্থে বর্ণাশ্রমের কাঠামো আর ‘নিরামিষ’ এ দুটো পাশ্চাত্যের কল্পনায় হিন্দু ভারতীয়ত্বের অপরিহার্য উপাদান।

গান্ধি জীবনে প্রথম ভগবদগীতা পড়েছিলেন ইংল্যান্ডে, এডউইন আর্নল্ডএর ‘দিব্য সঙ্গীত’ (The Song Celestial) নামক ইংরেজি অনুবাদে । পরবর্তীকালে তিনি গীতাকে অহিংসার প্রচারক ধরে নিয়ে যে গীতাভাষ্য লেখেন তার ভিত্তি ছিল একদিকে গুজরাটি মোধ বানিয়া পরিবারের গ্রাম্য বৈষ্ণবহিন্দু আচার নির্ভর সংস্কার, অন্য দিকে থিয়োজফিস্টদের গীতাব্যখ্যা আর ইংরেজি শিক্ষা তথা ইংরেজি অনুবাদ থেকে পাওয়া ধ্যানধারণা।

আমি লোকমান্যতিলক আর শংকরাচার্যের (গীতার) ভাষ্য পড়েছি আর যথাসাধ্য তা বোঝার চেষ্টা করেছি। তাঁদের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে মতামত দেওয়ার যোগ্য আমি নই।গীতা বেদ আর উপনিযদের সঙ্গে সম্পর্কিত কেননা গীতা ঐ দুইয়ের নির্যাস দেয়।

যে অর্থে রয়েছে আলো আর অন্ধকার, সুখ আর অসুখ, সত্য আর অসত্য ঠিক একই অর্থে রয়েছে পুণ্য আর পাপ। অবশ্য যেমন জ্ঞানাতীত আর অবর্ণনীয় অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের সীমা অতিক্রম করা একটা বাস্তবতা রয়েছে তেমনি পাপ আর পুণ্য পেরিয়ে এমন কিছু একটা বর্তমান যা এই দেহের অভিজ্ঞতার বাইরে। বৌদ্ধ অথবা ন্যায় আর সাংখ্য প্রস্থানের দার্শনিক রচনাগুলিতে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা অপরিবর্তণীয় নয় আর তাও নিজের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা বা গ্রহণ করা যায়।

শংকর (শংকরাচার্য) আমার প্রিয়, তেমনি রামানুজ, মাধব, বল্লভ আর অন্যান্যেরা আমি তাঁদের সবার কাছ থেকেইউপাদেয় সব খাদ্য উপভোগ করেছি, কিন্তু তাঁদের কারো কাছেই এমন কিছুই পাই নি যাতে আমি ক্ষুধা মেটাতে পারি। একান্ত বিনীতভাবে আমি বলতে চাই যে আমার উপবাস আর অন্যান্য পরীক্ষা মুখোমুখি ঈশ্বরকে দেখার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত…[নিম্নরেখা আমাদের ]১২

তাঁর এসব উক্তির মধ্যে একধরণের আত্মম্ভরিতা স্পষ্ট হলেও এতে কিছু নাম উচ্চারণ করা ছাড়া সে অর্থে ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে গভীর পরিচয়ের কোনো চিহ্ন নেই আর ঈশ্বরকে মুখোমুখি দেখার প্রসঙ্গ গান্ধির ‘মহারাজ’ অভিধার সঙ্গে খাপ খাওয়া হিন্দু জনতার আকাঙ্ক্ষিত ভেক তথা সাধুগিরির পরিপোষক। আর গান্ধির পূর্বোক্ত গীতাভাষ্যে আমরা আদি শংকরের অদ্বৈতবাদী, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী, নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদী, মধ্বের দ্বৈতবাদী, অভিনবগুপ্তের শৈব তান্ত্রিক, বল্লভের শুদ্ধাদ্বৈতবাদী ভাষ্য থেকে শুরু করে মধুসূদন সরস্বতী, রাঘবেন্দ্র তীর্থ বা তারও পরে লোকমান্য তিলকের গীতাভাষ্যের অর্থাৎ ভারতীয় দর্শনভিত্তিক গীতাভাষ্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনো আন্তঃরাচনিক সম্পর্কের পরিচয় খুঁজে পাই না। মনে হয় গীতাভাষ্য না লিখলে এদেশে বড় রকমের ‘মহারাজ’ হওয়া যায় না তাই গান্ধিমহারাজ আম জনতাকে টুপি (গান্ধিটুপি) পরানোর জন্য তাঁর গীতাভাষ্য উৎপাদন করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য হল যিনি পৃথিবীময় ভারতীয়ত্ব তথা হিন্দু আধ্যাত্মিকতার মূর্ত প্রতীক বলে পরিগণিত হয়েছেন সেই গান্ধি বেদউপনিষদ, ভারতীয় দর্শন, বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মের নাম অহরহ আউড়ালেও তাঁর রচনায় ঐ বেদউপনিষদ, বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মের কি ভারতীয় দর্শনের কোনো আকর গ্রন্থের চিন্তাশীল পাঠের অভিজ্ঞতার কথা কোথাও পাওয়া যায়না। ওপরের উদ্ধৃতিতে পাপপুণ্য সম্পর্কে সাংখ্য আর ন্যায়ের অপ্রাসঙ্গিক উল্লেখ, শংকরাচার্য, রামানুজ, মধ্ব, বল্লভাচার্যের দার্শনিক চিন্তার প্রসঙ্গে ‘উপাদেয়’ ‘উপভোগ করা’ ইত্যাদি শব্দ আর তারপর মুখোমুখি ঈশ্বরকে দেখার প্রসঙ্গ ভারতীয় দর্শনচিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে গভীরতাহীন বাচন, সাধরণ মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য ফাঁপা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। গীতা বাদ দিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে একটি বই পড়ার উল্লেখ রয়েছে সেটি সুত্তপীটক বা বিনয়পিটক বা অভিধম্মপীটক নয়, ধম্মপদ কি মিলিন্দ পন্হও নয় তা হল ইংরেজিতে আর্নল্ডএর ‘এশিয়ার আলো’ (The Light of Asia) ৷ গান্ধির ধর্মীয় উপদেশ বিশেষ করে গীতার ব্যাখ্যা বাজারে বাবাদের ধর্মোপদেশকে স্মরণ করিযে দেয়।

গান্ধি বারবার ‘সত্যের’ কথা বলেছেন। ‘সত্যই ভগবান। সত্যের পথ গেছে অহিংসার মধ্য দিয়ে’— গান্ধির এই বহুপ্রচারিত উক্তি কোনো অর্থেই ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এই উক্তি স্মরণ করিয়ে দেয় বাইবেলের সুসমাচার:জিশু তাকে বললেন, আমিই পথ, আমিই সত্য, আমিই জীবন১৩অথবা তখন জিশু বললেনআর তোমরা সত্যকে জানতে পারবে, আর সত্যই তোমাদের মুক্ত করবে১৪আর গান্ধির এই ‘সত্য’ ইতিহাস, সমাজচিন্তা, মানবিকতাবাদী যুক্তির সঙ্গে সম্পর্কীন বিমূর্ত ‘ভেতরের কণ্ঠের’ নির্দেশ। স্বভাবতই এই সত্য সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একদিকে ইতিহাসচেতনার বিরোধী হতে পারে, অন্যদিকে স্বৈরাচারের অভিমুখী হতে পারে — কেননা, এই সত্য অন্যের সঙ্গে, বাইরের সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবের সঙ্গে যোগাযোগহীন। গান্ধির ‘সত্য’বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। ইহুদিদের ওপর নাৎসি অধিকার ও অত্যাচারের খবরে গান্ধি ইহুদি, চেক্ ও আবিসিনিয়ানদের প্রতি অহিংস অসহযোগের পরামর্শ দেন। আবার নোয়াখালিতে দাঙ্গার প্রসঙ্গে ইজ্জত বজায় রাখার জন্য গান্ধি হিন্দু নারীদের আত্মহত্যার উপদেশ দেন। নাৎসি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইহুদি, চেক্ ও আবিসিনিয়ানদের প্রতি অহিংস অসহযোগের উপদেশের মতো হিন্দু নারীদের আত্মহত্যার উপদেশও গান্ধির আত্মম্ভরী হৃদয়হীন অহিংস নিষ্ঠুরতার নিদর্শন, তাঁর অবাস্তব, মানবিকতার বোধহীন ‘সত্যের’ স্বৈরাচারী ধারণার প্রকাশক।

১৯১৮ সালে ভেক পালটানোর পথে গান্ধি

আবার গান্ধির ভাবমূর্তির সর্বপ্রধান উপাদান বহুপ্রচারিত ‘অহিংসার’ আদর্শ বা ধারণাও হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন এক কথায় ভারতীয় ‘অহিংসা’ নয়, এই ‘অহিংসার’ সূত্র বাইবেলের জিশুর ‘পাহাড়ের ওপর উপদেশ’ (ম্যাথু অনুসারী সুসমাচার: অধ্যায় ৫) আর টলস্টয়এর ‘ঈশ্বরের রাজ্য তোমার মধ্যে’ বইয়ের চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত তথা সংগঠিত। গান্ধির আত্মজীবনীতে ঐ উপদেশ আর টলস্টয়ের বই পড়ে গান্ধির অভিভূত হওয়ার অনুভব উচ্ছ্বসিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া গান্ধির সর্বোদয়ের চিন্তার সূত্র হল রাস্কিনএর রচনা ‘শেষ অব্দি’ (Unto the Last), গান্ধি ‘সর্বোদয়’ শিরোনামে গুজরাটিতে তার একটা ভাবানুবাদ করেছিলেন।

রাজনীতি, সমাজনীতির সঙ্গে ধর্মের নামে গ্রাম্য কুসংস্কারের (যেমন রামনামের ‘শক্তি’) জগাখিচুড়ি মিশ্রণ গান্ধির ‘ধার্মিক’ ভাবমূর্তির আরেকটা উপাদান হয়ে উঠেছে।

শিশুরা যদি আমার কাছে শিক্ষা পায় তাহলে তারা একটা জিনিষ পাবে, তা হল রামনাম যা হল সব ধর্মের সারাৎসার।১৫

গতকালই আমি এক বন্ধুকে চিঠিতে বলেছি যে সে ভগন্দরে নয় অন্য কিছুতে ভুগছে আমি তাকে রামনাম জপ করে যেতে পরামর্শ দিয়েছি।১৬

প্রত্যেকেই আজ এই ভাবনা ভাবুক যে রামনাম আমাদের রক্ষা করবে আমরা যদি সারা জগৎকে রামনামের শক্তিতে পূর্ণ করতে চায় তাহলে শুধুমাত্র সারাক্ষণ রা আর ধ্বনি জপ করেই আমরা সাফল্য অর্জন করতে পারি না, আমাদের অবশ্যই অবিরত ভগবানের কথা ভাবতে হবে।১৭

সহজ আর শতকরা একশ ভাগ সত্য হল আমরা যদি শুধুমাত্র রামনাম নিয়ে ভাবি তাহলে আমাদের তাবৎ চিন্তা আর কাজ আপনা থেকেই ঠিক হয়ে যাবে।১৮

গান্ধির অসংখ্য রচনা আর চিঠিতে ওপরের দৃষ্টান্তের মতো রামনামের মহিমাকীর্তনের মধ্যে গ্রাম্য সংস্কারাচ্ছন্নতার পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে।

আসলে সাধারণ ইয়োরোপীয়দের মানসিকতায় ভারতের কল্পরূপ বা ভাবমূর্তির অপরিহার্য উপাদান আনুষ্ঠানিকতাকীর্ণ ছদ্মমরমিয়া হিন্দু ধর্মাচারের মিথের সঙ্গে খৃষ্টীয় দারিদ্র্যব্রত, সেবাব্রতের ধারণা এবং সর্বোপারি খৃষ্টীয় আদি পাপের আতঙ্ক মেশানো গান্ধির ধ্যানধারণা খ্রিস্টধর্মের ঐতিহ্যে লালিত সাধারণ ইয়োরোপীয়দের কাছে সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় বলে বোধ হয়েছে। এছাড়া গান্ধিকে পাশ্চাত্যের ক্ষমতাসীনরা যে গুরুত্ব দিয়েছে তার কারণ গান্ধি ছিলেন তাদের রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক স্বার্থ আর শাসন বজায় রাখার সহায়ক। আর ইয়োরোপ যে স্বদেশীয়কে কদর করে আমরা ঔপনিবেশিতরা তাকে আরও বেশি কদর করব এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। এভাবে গান্ধির ভারতে আগমনের মতোই দেশেবিদেশে ভারতীয়ত্ব তথা হিন্দু আধ্যাত্মিকতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গান্ধির অলীক, মিথিক্যাল ভাবমূর্তি বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গড়ে তোলা। আজও গান্ধির ভাবমূর্তির অনুসরণ কায়েমি স্বার্থ রক্ষার সহায়ক আর ঐ ভাবমূর্তির গান্ধির অনুসারকরা সচেতন বা অচেতনভাবে কায়েমি স্বার্থকে রক্ষা করে চলেছে। তাই গান্ধির ভারত যেমন কায়েমি স্বার্থকে রক্ষা করার ফলস্বরূ চরম বৈষম্য আর শোষণের দেশে পরিণত হয়েছে, তেমনি গান্ধির অনুসারী বলে চিহ্নিত মার্টিন লুথার কিংএর আমেরিকায় কালোদের বেশির ভাগের অবস্থা আজও শোচনীয়, নেলসন ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকায় অ্যাপারটাইড অব্যাহত। আর গান্ধি আর তাঁর তথাকথিত ভাবশিষ্যেরা দেশি বা এবং বিদেশি কায়েমি স্বার্থকে রক্ষা করে বৈষম্য আর শোষণকে অব্যাহত রেখেছেন।

দেশি গান্ধির স্বরূপ

বলা হয় গান্ধি নাকি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করেছেন।এই উক্তির যথার্থতা বিচার করতে গেলে প্রথমেই এদেশে গান্ধির নেতৃত্ব পাওয়ার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করতে হয়। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিককতার দেশীয় সহযোগী তথা তাঁবেদার তৈরি করা। কিন্তু ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ভারতীয় বুর্জোয়াদের একটা শ্রেণীর মধ্যে ঐ শিক্ষার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা পরোক্ষ ফল হিসেবে যে আত্মসচেতনতার জাগরণ ও আত্মপরিচয় খোঁজার তাগিদ দেখা দেয়, তারই প্রকাশ ঘটে জাতীয়তাবোধের উদ্বোধনে। এই জাতীয়তাবোধ দু ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে — এক দিকে সমাজ ও ধর্মসংস্কারের আন্দোলন আর আরেক দিকে রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা। ঔপনিবেশিকতার পক্ষে অস্বস্তিকর জাতীয়তাবোধের দ্বিতীয় প্রবণতাকে নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ ১৮৮১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সৃষ্টি করে। নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেও জাতীয়তাবোধ বিবর্তনের পথে ক্রমশ শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করে বিশ শতকের প্রথম দিকে থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের চেহারা নেয়। মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণীর ভারতবাসীদের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাদের বাচন ছিল জাতীয়তার ইয়োরোপীয় ধারণার অনুসরণ; জাতীয়তাবোধের ঐতিহ্যহীন, রাজনৈতিক চেতনাহীন সংখ্যাগুরু সাধারণ ভারতবাসীর কাছে তার কোনো আবেদন ছিল না। এর পাশাপাশি, গীতার কর্মযোগ এবং আনন্দমঠের হিন্দুধর্মীয় ধারণার ভিত্তিতে সশস্ত্র স্বাধীনতাআন্দোলনের চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করে। এই আন্দোলনের বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী বা ব্যাক্তির আত্মত্যাগ, ‘ভারতীয়ত্ব’ সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট এবং আলোড়িত করে । ১৯০৮ সালে বাংলা দেশে গ্রামের ছেলে ক্ষুদিরামের নির্ভয়ে ইংরেজের ফাঁসির মঞ্চে জীবনদান আর তার সহবিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীর ইংরেজের হাতে বন্দী হওয়ার আগেই আত্মাহত্যা তাদের সাধারণ মানুষের কাছে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয় । ইতিপূর্বে অজ্ঞাতনামা চারণ কবি মুকুন্দ দাসের গান শুনে সাধারণ গ্রামের মানুযের উদ্দীপনা এই চেতনার বিস্তৃতির উদাহরণ। এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আর উদ্দীপনা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । পাঞ্জাবি তরুণ মদনলাল ধিংড়ার ফাঁসিতে (১৯০৯) আত্মাহুতি সারা দেশকে আলোড়িত করে। শহর বা মফস্বলের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান কিশোর আর যুবকরা এই আন্দোলনে সামিল হতে থাকে। এই আন্দোলনের সে অর্থে কোনো প্রতিষ্ঠিত সর্বভারতীয় নেতা ছিল না আর তখন পর্যন্ত তার পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি ছিল আবেগনির্ভর, বিক্ষিপ্ত আর অসংগঠিত। তবু ইংরেজের কঠোর দমননীতি এই আন্দোলন সম্পর্কে ঔপনিবেশিক শাসনের আতঙ্ককে প্রাকাশ করে। তারপর আবার বাইরের অস্ত্রসাহায্য সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনার কথাও কর্তৃপক্ষের অজানা ছিল না আর তাতে তাদের আতঙ্ক ঘনীভূত হয়ে উঠছিল । যে বছর গান্ধি ভারতে পৌঁছান সে বছরই জার্মানি থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টায় বাঘা যতীনের (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ) আত্মবলি ঔপনিবেশক কর্তৃপক্ষকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশেষভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে।

ঠিক এই সময়ে ‘অহিংসা’, ‘অসহযোগ’, ‘সত্যাগ্রহ’ ইত্যাদির ধারণা নিয়ে ভারতীয় জাতায়তাবাদী আন্দোলনের মঞ্চে হঠাৎ গান্ধির আবির্ভাব রহস্যময়। প্রসঙ্গত দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধির ‘আন্দোলন’ ও ভূমিকা সম্পর্কে চিন্তা করা দরকার। সেখানে তিনি ভারতীয়দের অধিকার নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ঔপনিবেশিত বিভিন্ন স্তরের ভারতীয়রা দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছিল ঔপনিবেশক ইংরেজদের সহায়ক হিসেবে ঔপনিবেশিত আফ্রিকানদের শোষণে অংশগ্রহণ করে সাধ্যমতো ঔপনিবেশকদের উচ্ছিষ্ট কুড়োতে । দক্ষিণ আফ্রিকা আফ্রিকানদের দেশ ইংরেজ তথা ইয়োপীয়রা সেখানে জবরদখলকারি ঔপনিবেশক — একথা ব্রিটিশ ‘সাম্রাজ্যের’ বশংবদ প্রজা ‘সত্যাগ্রহী’ গান্ধির কখনো মনে হয় নি। আফ্রিকানদের অধিকার সম্পর্কে তথা ঔপনিবেশিকতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে গান্ধির কোনো চিন্তা ছিল না। আফ্রিকানদের সম্পর্কে তাঁর বিভিন্ন উক্তি তাঁর বর্ণবিদ্বেষী মনোভাবের পরিচয় দেয়। ১৮৯৬ সালে মুম্বাইএ এসে গান্ধি বলেন:

ইয়োরোপীয়রাআমাদের নামিয়ে দিতে চায় বর্বর ঐ কাফ্রির স্তরে যার পেশা হল শিকার আর যার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা হল একটা স্ত্রী কেনার জন্য কিছু গবাদি পশু সংগ্রহ করা আর তারপর আলস্য আর নগ্নতার মধ্যে জীবন কাটানো১৯

১৮৯৯১৯০২ সালে ইংরেজবুয়র যুদ্ধে আর তারপর ১৯০৫ সালে বাম্বাত্তা বিদ্রোহেজুলুদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যুদ্ধে ইংরেজের বিশ্বস্ত প্রজা গান্ধি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদান করে সার্জেন্ট মেজর পদ ও সরকারি সম্মান (পদক) লাভ করেন। গান্ধির আত্মজীবনীর স্বীকৃতি অনুসারে, ‘

খবরের কাগজ জুলু বিদ্রোহ শুরু হওয়ার খবর নিয়ে এল। জুলুদের ওপর আমার কোনো রাগ ছিল নাকিন্তু আমি তখন বিশ্বাস করতাম যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রয়েছে জগতের মঙ্গলের জন্য ৷ অকৃত্রিম একটা আনুগত্যের বোধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অমঙ্গলের কথা ভাবার থেকেও আমাকে নিবৃত্ত করে রেখেছিল। অতএব বিদ্রোহের যথার্থতা বা অযথার্থতা আমার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা ছিল না।২০

এই ঘটনা থেকেও ঔপনিবেশিকতার প্রতি তাঁর সমর্থন এবং কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের প্রতি বর্ণবিদ্বেষী সহানুভূতিহীনতা অনুমান করা যায়। ঔপনিবেশিত ভারতীয় আর আফ্রিকানদের মিলিত ও সংঘবদ্ধ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনের কথা তাঁর একবারও মনে হয়নি। ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি গান্ধির আনুগত্যের আরো একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। ১৯১৩ সালে গান্ধি ভারতীয়দের দাবিদাওয়া নিয়ে ভারতীয়দের একটা মিছিল করার কথা ঘোষণা করেন কিন্তু ঐ সময়ে রেলকর্মীরা তাদের বিভিন্ন দাবির স্বপক্ষে ধর্মঘট শুরু করে। সত্যাগ্রহীরা সরকারের অসুবিধার সুযোগ নিতে পারে না একথা ঘোষণাকরে গান্ধি মিছিল বাতিল করলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধির ভূমিকা আর পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে ইংরেজের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নানাভাবে প্রতিরোধ করার ইতিহাস গান্ধির বহুপ্রচারিত ঔপনিবেশিকতাবিরোধী ভাবমূর্তির বিরোধী নয় কী ? স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বিদ্রোহের প্রতিরোধকারী শক্তি হিসেবে গান্ধির ভারতে আগমন এদেশে সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের চিন্তার ধ্বংসের প্রয়োজনে ঘটেছিল কি না ? এর পেছনে কি কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঔপনিবেশিক মদত কাজ করেছিল ? প্রথম মহাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের পক্ষ থেকে ইংরেজদের সাহায্য করার প্রস্তাব নিয়ে গান্ধি ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। সস্ত্রীক গান্ধি নিঃসর্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (গান্ধির ভাষায় Empire) প্রয়োজনে কাজ করার সিদ্ধান্তে সই করেন। গান্ধি ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বাহিনী গঠন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর পর গান্ধি অসুস্থতার ‘কারণে’ দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে না গিয়ে স্থায়ীভাবে ভারতে চলে এলেন।

১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে গান্ধি ভারতে পৌঁছান। গোখলের পরামর্শে তিনি অবিলম্বে ভারতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। সারা ভারতে পরিচিতি তথা জনজীবনে প্রবেশ করার কৌশল তথা পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে কিছুদিনের মধ্যেই মার্চ মাসের প্রথমে চতুর কূটনীতিবিদ্ গান্ধি শান্তিনিকেতনে গিয়ে আগের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। গান্ধির চেয়ারের বদলে মাটিতে (গালিচায়) বসা, নিজের হাতে শৌচাগার পরিস্কার ইত্যাদি বিনয়ের নানা ভড়ঙে রবীন্দ্রনাথ মোহিত হয়ে গান্ধিকে ‘মহাত্মা’ আখ্যায় ভূষিত করলেন। গোপালকৃষ্ণ গোখেলে আর রবীন্দ্রনাথের ছাড়পত্র পাওয়া গান্ধি ভারতীয় রাজনীতি তথা জনজীবনে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে নানা কৌশলে ভারতের অবিসংবাদী জননেতা হয়ে উঠলেন। আমরা আগেই বলেছি গান্ধির আগের মধ্যবিত্ত ইংরেজিশিক্ষিত শহুরেজাতীয়তাবাদী নেতাদের বাচন, পোশাকপরিচ্ছদ, জীবনযাপন ছিল তাঁদের শ্রেণীচরিত্রের প্রকাশক। বস্তুত গান্ধির আগে এদেশের জাতীয়তাবাদী নেতাদের লক্ষ্য ছিল জাতীয় ইতিহাসের চেতনার ভিত্তিতে পাশ্চাত্য আদর্শে আধুনিক জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা। সাধারণ মানুষ তাঁদের সঙ্গে অলঙ্ঘ্য দূরত্ব অনুভব করত, ইয়োরোপীয় জাতীয়তাবাদী বাচনের অনুসরণে তৈরি তাঁদের বাচন শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষকে স্পর্শ করতনা, একথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। প্রথাবদ্ধ ভারতীয় সমাজের আধুনিক অর্থে বিদেশি শাসনের বিরোধী কোনো জাতীয়তাবাদী বোধ ছিল না, যা ছিল তা হল চাপা একটা ‘ধর্মনাশের’ ভয়। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে সিপাহি তথা সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও এই ভয়ের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মফস্বল শহরের অর্ধশিক্ষিত, রক্ষণশীল, সংস্কার ও আচারসর্বস্ব হিন্দু, মোধ বানিয়া পরিবারের চতুর সন্তান গান্ধি সহজাত বোধ থেকে উপলব্ধি করেছিলেন যে আচারনির্ভর ধর্মীয় সংস্কার হচ্ছে সাধারণ ভারতবাসীর মানসিকতার সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ। তাই গণমানসে প্রবেশ করার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল একদিকে বাচনের মাধ্যমে জনতার সংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, বাইরের জগৎ সম্পর্কে ভীতি, ধর্মনাশের আতঙ্ককে পোষণ করা, অন্য দিকে ‘আগে দর্শনধারি’ হওয়া। গান্ধির এই কৌশল আমাদের সপ্তদশ শতকে দক্ষিণ ভারতে খিস্টধর্মপ্রচারক ইতালীয় জেজুইট পাদ্রি রবের্তো দে নোবিলির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।এই পাদ্রি উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের খিস্টধর্মান্তরিত করার ব্যাপারে অসাফল্যের কথা ভেবে সংস্কৃত, তামিল ও তেলেগু শিখে গৈরিক আলখাল্লা ও খড়ম পরে কমণ্ডলু আর দণ্ড হাতে হিন্দু সন্ন্যাসীর ভেক গ্রহণ করেন। ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গান্ধির আগের নেতারা ভেক বা ভড়ঙে খুব একটা পোক্ত ছিলেন না। বালগঙ্গাধর তিলক ‘লোকমান্য’ আখ্যা পেয়েছিলেন, ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাস কোটপ্যান্ট ছেড়ে ধুতিপাঞ্জাবি পড়ে শহুরে বাঙালি/ভারতীয় বাবু হয়ে ‘দেশবন্ধু’ (দেশের বন্ধু) অব্দি হতে পেরেছিলেন, ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত হয়েছিলেন ‘দেশপ্রিয়’, আর গান্ধি কোটপ্যান্ট ছেড়ে নেংটির মাপের খাটো ধুতি পরে লাঠি হাতে দণ্ডী সাধুর ভেক নিয়ে অবিলম্বে মহাত্মা থেকে বাপু আর তার সঙ্গে ‘জী’ যুক্ত মহাত্মাজী/বাপুজী আর তারপর আম জনতার কাছে ‘গান্ধিমহারাজে’ পরিণত হয়ে অবিলম্বে দেশের অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। ধর্মীয় সংস্কারের শব্দসম্ভার মেশানো তাঁর বাচন রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয়তাবোধহীন, সাধারণ ভারতীয় জনতার চিরলালিত ‘ধর্মনাশের’ আতঙ্কের কাছে আবেদন জানায়। বস্তুত গান্ধির সংস্কারাচ্ছন্ন আচারসর্বস্ব ধর্ম আর রাজনীতির খিচুরি, যন্ত্র, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যুক্তিবাদী মুক্ত চিন্তা এককথায় আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরোধিতা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের মানসিকতাকে স্পর্শ করে বললে কম বলা হবে, বলতে হয় অভিভূত করে। গান্ধির আশ্রম, চরকা, খাটো ধুতি, অনশন, নিরামিষভোজন ইত্যাদি আচারের সঙ্গে সত্য, অহিংসা, স্বদেশি, আত্মশুদ্ধি, মৌনব্রত, ব্রহ্মচর্য, সত্যাগ্রহ, অসহযোগের ধারণার মিশ্রণ তাঁর ভাবমূর্তিকে জনসাধারণের মনে জোরদার করে তোলে। ‘গান্ধিমহারাজে’ পরিণত এই চতুর দেশনেতাকে জনতা সন্ত বা অবতারের তখতে বসিয়ে দিল । এই আসনে বসে ‘বাপুজী’ ‘গান্ধিমহারাজ’ ভারতের রাজনীতিতে একনায়ক জগদ্গুরু হয়ে ওঠেন।

১৯২৫ সালে গান্ধি লিখছেন:

দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইংল্যান্ডে অ্যাম্বুলেন্সে কাজ করার জন্য কর্মি আর ভারতে যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য সৈনিক তালিকাভুক্ত করে আমি যুদ্ধের উদ্দেশ্যকে সাহায্য করিনি, আমি সাহায্য করেছি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নামে একটা প্রতিষ্ঠানকে যার মঙ্গলময় চূড়ান্ত মঙ্গলময় চরিত্রে আমি তখন বিশ্বাস করতাম।২১

বার ১৯৩১ সালে তিনি প্রশ্নের উত্তরে জানাচ্ছেন:

আমি তখন আনুগত্যবাদী, কেননা আমি অবিতর্কিতভাবে বিশ্বাস করতাম যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ভারত তথা মানবজাতির কল্যাণকর।২২

১৯৩২ সালের এক ইন্টারভিউতে গান্ধি ভারতের ভবিয সম্পর্কে বলেন:

সাম্রাজ্যের’ ধারণাকে অবশ্যই পুরোপুরি অদৃশ্য হতে হবে। কিন্তু তার সঙ্গে রাজপদও বিলুপ্ত হবে কিনা তা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। গ্রেট ব্রিটেনের রাজা আর ভারতের রাজা থাকবেন না এখন আমার একথা বলা সম্ভব নয়।২৩

আবার ১৯৪০ সালে ‘হরিজন’ পত্রিকায় ‘বিরুদ্ধ মতালম্বীরা’ নামক রচনায় গান্ধি জানান:

আমি লড়াইয়ের জন্য উন্মুখ নই। আমি লড়াই এড়াতে চেষ্টা করছি। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের ক্ষেত্রে যাই সত্য হোক না কেন, আমি সুভাষবাবুর অভিযোগ পুরোপুরি অনুমোদন করছি, হ্যাঁ, ব্রিটেনের সঙ্গে আমি একটা সমঝোতায় আসতে চাই তা যদি সম্মানের সঙ্গে আসা যায় সত্যাগ্রহ সত্যি তা চায়ব্রিটেনের ওপর আমি বিশ্বাস হারাই নি২৪(নিম্নরেখা আমাদের)

বোঝা যায় ব্রিটেনের প্রতি গান্ধির এক ধরনের আনুগত্যভিত্তিক সমঝোতার মনোভাব কখনোই দূর হয়নি । স্বভাবতই আরো একবার প্রশ্ন জাগে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে গান্ধির সত্যিকারের ভূমিকাটা কী ছিল?

বস্তুত যে অহিংস গান্ধি তাঁর নিজের ভাষায় দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৮৯৯১৯০২ আর ১৯০৫ সালে, ইংল্যান্ডে১৯১৪, ভারতে এসে ১৯১৮ সালেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মঙ্গলময় চরিত্রে বিশ্বাস থেকে তার প্রতি বশংবদ বোধ করেছেন, সহিংস যুদ্ধে ব্রিটিশকে সহায়তা করা কর্তব্য বলে উপলব্ধি করেছেন, ১৯৪০ সালেও ব্রিটেনের ওপর বিশ্বাস হারান নি, তিনি কী ১৯১৫ সালে ঐ সাম্রাজ্যের প্রতি একই কর্তব্যবোধ থেকে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে চলে এসে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দিলেন? তাহলে কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে পথভ্রান্ত করাটাই ছিল তাঁর ভারতে ফেরার কারণ? এতে ভারতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতা, ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতার পক্ষপাতী, সরাসরি স্বাধীনতার দাবি করা চরমপন্থী ভারতীয় জাতীয়বাদী নেতা লালবালপালের (পাঞ্জাবি লালা লাজপত রায়, মারাঠি বাল গঙ্গাধর তিলক, বাঙালি বিপিন চন্দ্র পাল) বিরোধী গোপাল কৃষ্ণ গোখলের কি কোনো ভূমিকা ছিল? ১৯২২ সালের ব্রিটানিকা বিশ্বকোষের দ্বাদশ সংস্করণে গোপাল কৃষ্ণ সম্পর্কে প্রসস্তি এই সন্দেহকে আরো গভীর করে তোলে:

লর্ড কার্জন সি.আই.. খেতাবের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করে তাঁর ঐকান্তিক দেশপ্রেমকে স্বীকৃতি দিয়েছেন (১৯০৪)। লর্ড মর্লে প্রায়শ তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেতাঁর কথা গভর্নর জেনারেলকে লিখেছিলেন (স্মৃতিকথা, . , পৃ.১৮১)তিনি চরমপন্থী গোষ্ঠীর দ্বারা প্রচণ্ডভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যারা তাঁর জীবৎকালে কখনো কংগ্রেস প্রশাসনকে দখলে সফল হতে পারে নি। ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ, ১৯২২।২৫

গান্ধি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন:

মুম্বাইয়ে পৌঁছেই আমি গোখলের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। ,তিনি জানিয়েছেন যে গভর্নর আমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক আর পুনায় রওনা হওয়ার আগে আমার পক্ষে তা করাটা উচিত হবে। তদনুসারে আমি মহামহিমের (His Excellency) সঙ্গে দেখা করলাম নিয়ম মাফিক খবরাখবর জিজ্ঞাসার পর, তিনি বললেন, ‘আমি আপনার কাছে একটা জিনিস চাই যখনই আপনি সরকার সম্পর্কিত ব্যাপারে কোনো কিছু করতে যাওয়ার প্রস্তাব করবেন আপনি এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন এটাই আমার কাম্য।’২৬

এখানেও গান্ধির তথা গান্ধিগোখলেরভূমিকা সম্পর্কে সন্দেহ জাগায় । প্রসঙ্গত স্মরণীয় গান্ধির বোম্বাইয়ে পৌঁছানোর পর অসুস্থ গোখলে গান্ধির এক অভ্যর্থনা সভার আয়োজন করেন।

ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধির ঐতিহাসিক ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে আমরা উপলব্ধি করি, তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক জীবন ধরে গান্ধি সুচতুর কৌশলে ঔপনিবেশক শক্তির স্বার্থ রক্ষা করে গেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু বিদ্রোহ আর প্রথম মহাযুদ্ধের আরম্ভে তাঁর ভূমিকার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। ভারতে আসার পর প্রথম মহাযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ গভর্নরজেনারেল জাতীয় আন্দোলনের নেতা বনে যাওয়া গন্ধিকে দিল্লিতে তাঁর আয়োজিত যুদ্ধসভায় আমন্ত্রণ করেন। ‘অহিংস’ গান্ধি ব্রিটিশ সরকারকে যুদ্ধে সক্রিয় সহায়তায় সম্মতি জানিয়ে ভারতীয়দের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদনপত্র প্রকাশ করেন, জিন্নাকেও তিনি ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করতে অনুরোধ জানান। ১৯১৯ সালে ঔপনিবেশক সরকার রোঔলাট আইন জারি করে। এই আইনে বলা হয়, সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে যে কোনো ভারতীয়কে বিনাবিচারে দুবছরের জন্য বন্দী করা যাবে। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন সমাবেশ হয়। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি সমাবেশে ডায়ার নামে এক ইংরেজ অফিসার নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এক হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে, আর কয়েক হাজার মানুষকে আহত করে। এই নৃশংস হত্যকান্ডের প্রতিক্রিয়ায় স্বতস্ফুর্তভাবে কিছু দাঙ্গা হয়। তখন ঐ একই ‘অহিংস’ গান্ধি রোঔলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রত্যাহার করেন আর হত্যকান্ডকে ধিক্কার না জানিয়ে শাসক ও শাসিত উভয়ের হিংসাত্মক কাজের নিন্দা করেন, তারপর তাঁর নির্বন্ধাতিশয্যে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দাঙ্গার নিন্দা করে নিহত অসামরিক ইংরেজদের জন্য শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। গান্ধি ধর্মের মোড়কে ঢাকা অহিংসা, অনসন আর সত্যাগ্রহের কূটনীতিতে ঔপনিবেশক শাসকদের প্রধান আতঙ্ক সশস্ত্র স্বাধীনতাআন্দোলনের বিরোধিতার নিরন্তর প্রচারে গান্ধি তার বিস্তার, সম্ভাবনা ও সমর্থনকে অনেকটাই স্তিমিত করে দেন।স্বাধীনতাসংগ্রামী যতীন দাসের কারাগারে ৬৩ দিন অনশনে মৃত্যুবরণ, ভগৎ সিং, উধম সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি, বিনয় বসু ও বাদল গুপ্তের আত্মবলি, দীনেশ গুপ্তের ফাঁসি, চন্দ্রশেখর আজাদের আত্মহত্যা, সূর্য সেন সহ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের শহীদদের বীরত্ব, সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ তাঁর বিন্দুমাত্র মনোযোগ বা সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পারে নি, নীরব থেকেছেন বা বিপথগামী বলে অভিহিত করেছেন।

গান্ধি ক্রমশ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধের শক্তি ও আবেগকে নিপুণভাবে নিয়ন্ত্রিত, নিষ্কাসিত বা/এবং পথভ্রান্ত করে নিষ্ক্রিয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন।নিয়মতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা বনে যাওয়া গান্ধি উদ্দেশ্যমূলকভাবে আন্দোলনকে এক বিশৃঙ্খল চেহারা দেন, তার ক্রমপর্যায়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রকহল যুক্তি নয়, ইতিহাস চেতনা নয়, বিচার বিশ্লেষণ নয় — তাঁর তথাকথিত ‘ভেতরের কন্ঠের নির্দেশের’ ভনিতা। ‘গান্ধিমহারাজ’ হিসেবে তাঁর জনমানস স্পর্শ করার ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কয়েক বছর পর পর ভারতীয়দের অন্তরে ক্রমশ জমে ওঠা জাতীয় অধিকারবোধ ও স্বাধীনতাস্পৃহাকে নিষ্ক্রিয় তথা নিষ্কাষণ করার জন্য গান্ধি বারবার অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করতেন, এগিয়ে নিয়ে যেতেন — আন্দোলন যখন আবেগ ও উদ্দীপনার চরমে উপস্থিত হত তখন তিনি কোনো না কোনো (সাধারণত হিংসার) ছুতোয় তা প্রত্যাহার করে নিতেন। এভাবে চূড়ায় ওঠা জনতার মানসিক আবেগ ও উদ্দীপনাকে চরম প্রকাশের মুহূর্তে হঠাৎ রোধ করে দেওয়ার ফলে সংগ্রামের মানসিকতা বিধ্বস্ত হত, মানুষের মনে দেখা দিত চূড়ান্ত হতাশা — সমাজবিরোধী স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিকতা। এই হতাশা থেকেই জন্মাত ‘কিছুতেই কিছু হওয়ার নেই, ওসব ঝুট ঝামেলায় না গিয়ে নিজের ধান্ধা দেখাটাই আসল ব্যাপার’ — এই জাতীয় মূল্যবোধহীন সিনিক সুবিধাবাদ। ১৯২২ সালে চৌরিচোরায় হিংসার অজুহাতে গান্ধির গণআন্দোলন প্রত্যাহার এরকম বহু ঘটনার একটি। এই ঘটনা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসুর মনে হয়েছিল,

জনসাধারণের উৎসাহ যখন টগবগ করে ফুটে উঠতে চলেছে ঠিক তখনই পেছনে ফেরার আদেশের ঘোষণা করাটা জাতীয় বিপর্যয়ের চেয়ে কম কিছু নয়, মহাত্মার প্রধান সহকারী সংগ্রামী, দেশবন্ধু দাস, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, লালা লাজপত রায় এ সময়ে জেলে ছিলেন, এঁরা সবাই ছিলেন জনসাধারণের ক্ষোভের অংশীদার, আমি এ সময়ে দেশবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম আর আমি দেখতে পেয়েছিলাম তিনি রাগে দুঃখে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন।২৭

ফলত ইংরেজ সরকারের কাছে বিদ্রোহ প্রতিরোধক গান্ধির ভূমিকা ছিল আদরণীয় । গান্ধিকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অবিরত প্রচারের মাধ্যমে তাঁর ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিল। ধার্মিক ‘বাপুজী’ ভারতীয় রাজনীতিতে স্বৈরাচারী মহান্তের ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন,

আমি বানিয়ার মনোভাব পছন্দ করি না। ঐ জাতে জন্ম হওয়ায় তার হালচাল আমার জানা ছিল আর আমি তা আমি ত্যাগ করেছি। কাথিয়াবারে বড় হওয়ায় তাবৎ চক্রান্তের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম আর ওগুলোকেও আমি ত্যাগ করেছি…. ’২৮

একথা বললেও বাস্তবে দেখা যায় যে সহজাত বানিয়াবুদ্ধিতে নানা চক্রান্তের মাধ্যমে দলাদলির কলকাঠি নাড়িয়ে বিভিন্ন কৌশলে গান্ধি বিরোধী মত ও মতবাদীদের প্রতিহত বা অপসারিত করেছেন। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জাতীয় কংগ্রেস থেকে চিত্তরঞ্জন দাস, বিটলভাই প্যাটেল, সুভাষচন্দ্র বসুর বিদায়। সুভাষচ্ন্দ্র তাঁর মতের বিরোধিতা করেও যখন কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন তখন গান্ধি বল্লভভাই প্যাটেলকে যে চিরকুট পাঠান তাতে ‘সত্য’ ‘রামনাম’ এসব ভনিতা উবে গেছে, প্রকাশিত হয়েছে গদলাদলির বানিয়াবুদ্ধি আর চক্রান্ত:

আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে তোমরা (সবাই) যদি পদত্যাগ কর তবে সেটাই সবচেয়ে ভালো হয় ।আমি লক্ষ্য করেছি সুভাষ মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়।প্রত্যেকে যদি নিজের স্বার্থ না দেখে তাহলে কিছুই হবে না আর পুরো খেলাটাই মাটি হবে।২৯

সুভাষচন্দ্রের বিরোধিতা আর নিজের একচ্ছত্র নেতৃত্ব হারানোর আতঙ্কে গান্ধির মুখোস খুলে যায়। ‘আভ্যন্তরীন ক্ষয়’ শিরোনামে তিনি তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে দলীয় রাজনীতির প্রথাসিদ্ধ অস্ত্র ভোটে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনা করে গান্ধি মন্তব্য করেছিলেন :

কংগ্রেসের নির্বাচনে দলীয় দ্বন্দ্ব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কংগ্রেসসদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ভাঙাটা সর্বত্র বেড়ে যাচ্ছে।তাদের অনেকে দায়িত্বজ্ঞানহীন , এমনকী হিংসাত্মক বক্তৃতা দিচ্ছে।কংগ্রেসের বর্তমান অবস্থা থেকে আমি দেশের সামনে শুধুমাত্র নৈরাজ্য আর লাল ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ত্রিপুরিতে আমরা কি এই কঠোর সত্যের মুখোমুখি হব?৩০(নিম্নরেখা আমাদের)

সুভাষচন্দ্রের ওপর ধার্মিক গান্ধিমহারাজের বিদ্বেষ কখনোই দূর হয়নি । এমনকী সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অমৃতা কাউরকে লেখা চিঠিতে তাঁর দু বাক্যের মৃতের প্রতি ন্যূনতম সম্মানহীন মন্তব্যেও তাঁর এই মনোভাব স্পষ্ট

‘….সুভাষ বোস সত্যি মারা গেছে। ভুল পথে গেলেও সে ছিল নিঃসন্দেহে একজন দেশপ্রেমিক। দাঁতের মাড়ি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে… (নিম্নরেখা আমাদের)’৩১

সুভাষচন্দ্রের ভুল পথে যাওয়ার কথার পরই এসেছে অমৃতা কাউরের দাঁতের ব্যথার প্রসঙ্গ । পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার প্রস্তুতি হিসেবে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা গান্ধিবাদী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ছায়ামন্ত্রিসভা গঠন করেন। ইতিমধ্যে যিনি রাজনীতি, কংগ্রেস, শাসনযন্ত্র ইত্যাদি সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার কথা বার বার ঘোষণা করেছিলেন সেই ‘জাতির জনক’ প্রফুল্ল চন্দ্রকে একটি চিঠিতে জানান:

প্রিয় প্রফুল্ল, সর্দার (বল্লভভাই প্যাটেল) জানিয়েছে যে তোমার মন্ত্রিসভায় একজন মাড়ওয়ারি থাকা দরকার, বদ্রিদাস গোয়েঙ্কা বা খৈতান। আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটা করা তোমার উচিত, না করাটা অনুচিত হবে। আশীর্বাদ সহ বাপু ।৩২

সেই নির্দেশ না মানায় কয়েক মাস পরে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

গান্ধির অহিংস আন্দোলনের ফলে ভারত স্বাধীন হয়েছে — এই বক্তব্য ইতিহাসের বিশ্লেষণে টেকে না। তিরিশের যুগের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় ইয়োরোপের পুরনো ঔপনিবেশক শক্তিগুলির (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদির) সঙ্কট শুরু হয়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই শক্তিগুলিকে প্রায় দেউলিয়া করে দেয়। উপনিবেশগুলিতে ক্রমহ্রাসমান লাভের অঙ্কের তুলনায় শাসন ও সামরিক ব্যয়ের অঙ্ক ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক শাসন পরিচালনার ব্যাপারটাও ক্রমশ জটিল সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠতে থাকে। অন্যদিকে ঔপনিবেশক দেশগুলির সাধারণ মানুষ উপনিবেশ রক্ষার ইজ্জতের চেয়ে নিজেদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দাবিকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। সব দিক থেকেই পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশক শক্তিগুলির পক্ষে সাবেকি পদ্ধতিতে উপনিবেশ রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। পাশাপাশি নয়াঔপনিবেশিকতার নীতি নিয়ে বিশ শতকের প্রথম থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আমেরিকায় তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়োরোপের রক্ষক তথা মিত্রশক্তির নেতার ভূমিকা নেয়। যুদ্ধের পর পুরনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দলপতি মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের আদর্শে তাদের নীতি পালটাতে বাধ্য হয়। কুড়ি বছরের কম সময়ের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় সমস্ত পুরনো উপনিবেশগুলিকে আপাত স্বাধীনতা দেওয়া হয়, যেমন কম্বোজ (১৯৫৩), ভিয়েতনাম (১৯৫৪), মালেশিয়া (১৯৫৩), মিয়ানমার (১৯৪৮), সিংহল (১৯৪৮), কুয়েত (১৯৬১), উগান্ডা (১৯৬২). নাইজেরিয়া (১৯৬০), কেনিয়া (১৯৬৩), সেনেগাল (১৯৬০), মালি (১৯৬০), বেলজিয়ান কঙ্গো (১৯৬০) ইত্যাদি।এসব দেশে কোনো গান্ধি ছিল না, তবু এই উপনিবেশগুলি ‘স্বাধীন’ হল। আসলে এসব দেশে ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের নতুন দলপতির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নয়াউপনিবেশ কায়েম হল। গান্ধির ভাবমূর্তির প্রচারক হয়ে উঠল একদিকে তথাকথিত স্বাধীন দেশের তখতে বসা ঔপনিবেশিকতার উৎপাদন সুবিধাভোগী শ্রেণী আর অন্যদিকে নয়াঔপনিবেশক পাশ্চাত্য। কেন না বিদ্রোহের প্রতিরোধকারী গান্ধি ছিলেন নয়াঔপনিবেশিক তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের সহায়ক। ঔপনিবেশক তথা দেশীয় কায়েমি স্বার্থকে অটুট রাখার প্রয়োজনে স্থিতাবস্থাকে মাঝে মাঝে আন্দোলনের ভ্যাকসিনের সাহায্যে সইয়ে দেওয়া, সব ধরনের অত্যাচার আর শোষণকে মেনে নেওয়া আর মেনে নেওয়ানোর মাধ্যমে গান্ধি নিঝর্ঞ্ঝাটে ঔপনিবেশিকতার পটপরিবর্তনে সাহায্য করেছেন। আমরা আগেই বলেছি পৃথিবীর রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক অবস্থা পালটানোর ফলে ঔপনিবেশিক শাক্তির পক্ষে পুরনো ধরনের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

তার ওপর ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ রক্ষা করা আরেকটি কারণে বিশেষভাবে সংকটজনক হয়ে উঠছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম আর বীরত্বের ইতিহাস ক্রমশ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। দিল্লির লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর জেনারেল শাহ নওয়াজ খান, কর্নেল প্রেম সাহগল ও কর্নেল গুরুবক্স্ সিং ধিলনএর জনসমক্ষে বিচার (নভেম্বর ১৯৪৫ – মে ১৯৪৬) হিন্দুমুসলমানশিখ নির্বিশেষে ভারতবাসীকে আলোড়িত করছিল। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুম্বইয়ে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর হিন্দুমুসলমানশিখ নির্বিশেষে ভারতীয় কর্মচারীরা সর্বাত্মক ধর্মঘট শুরু করল। এই ধর্মঘট বিদ্রোহের আকারে কলকাতা, করাচি, কোচিন, বিশাখাপত্তন ও মাদ্রাজে ছড়িয়ে পড়ল। মুম্বইয়ে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর ভারতীয়রাও ধর্মঘট করল। করাচিতে গুর্খা সৈন্যেরা ধর্মঘটীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করল। মুম্বইয়ে সাধারণ মানুষ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে সমবেত হওয়ায় পুলিশ তাদের এওপর গুলি চালায়, ফলে দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়। বিদ্রোহীদের মুখে ‘জয় হিন্দ্’ ধ্বনি, নেতাজির ছবিওয়ালা পতাকা, ‘আজাদ হিন্দ বাহিনীর ১১০০০ বন্দীকে মুক্তি দাও’ স্লোগান নির্দেশ করছিল যে আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম তাদের অনুপ্রেরণা আর সাম্প্রদায়িক হিন্দুমুসলমান পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে ভারতীয় হিসেব ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। তাঁর নেতৃত্ব না মেনে, কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় না এসে সহিংস আন্দোলন গান্ধির রামধুনি মুখোস খুলে দিল, তিনি বিবৃতি দিলেন :

হিংসার এই বিবেচনাহীন উন্মাদনার জ্ঞাত আর অজ্ঞাত নেতারা তারা কী করছে তা জেনে রেখে তাদের পথ অনুসরণ করে। একথা যেন বলা না হয় যে কংগ্রেসের ভারত পৃথিবীকে অহিংস কর্মোদ্যোগে স্বরাজ লাভের কথা বলেছিল আর তার জীবনের সঙ্কটপূর্ণ অধ্যায়ে নিজের কথা রাখতে পারেনি।চাকরি যদি তাদের বা ভারতের পক্ষে অসম্মানজনক হয় তাহলে তারা কেন চাকরি করবে?…৩৩

ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিভাগের দাবির ওপর যাদের অস্তিত্ত্ব গড়ে উঠেছিল সেই মুসলিম লিগও হিন্দুমুসলমানের মিলিত এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করল। এই বিদ্রোহ কংগ্রেস আর মুসলিম লিগ এই দুই দলেরই অস্তিত্ত্বের ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছিল। দুই দলের চেষ্টায় জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এই বিদ্রোহ উপযুক্ত নেতৃত্ব তথা পরিকল্পনার অভাবে ব্যর্থ হল্, কিন্তু তা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে আতঙ্কিত করল, তারা উপলব্ধি করল যে সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ততা আর শক্তির ওপর ভারতে এতদিন তাদের ঔপনিবেশিক অস্তিত্ত্ব নির্ভর করে ছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর দৃষ্টান্ত আর অনুপ্রেরণা তাতে স্থায়ী ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে, আর বেশি দিন তাদের সাম্রাজ্য অটুট রাখা যাবে না। এখন এদেশে ব্রিটিশ স্বার্থ বজায় রাখার একমাত্র পথ হল নয়াঔপনিবেশিক কাঠামো তৈরি করে নয়াকম্প্রাদর শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে আড়ালে আশ্রয় নেওয়া।

কংগ্রেসের বিদ্রোহী মহিলাসদস্য অরুণা আশফআলি হিন্দুমুসলমানের মিলন ঘটানো এই বিদ্রোহকে সমর্থন করায় গান্ধি আরেকটি ক্রুদ্ধ বিবৃতিতে তাঁকে ভর্ৎসনা করেন।

এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণভাবে ব্রিটিশদের বিভিন্ন ঘোষণায় অবিশ্বাস করার ভবিষ্যদ্দৃছ্টির অভাব পরিস্ফুট হয়। সরকারি প্রতিনিধিদল একটা মহান জাতিকে প্রতারণা করতে আসছেন একথা ভাবটা পুরুষোচিত বা নারীর উচিত নয়। জাতি বিশ্বাস করে লাভবান হবে। যে প্রতিনিধিদল আসছে তারা ব্ন্ধুত্বপূর্ণ বলে দাবী করা হয়েছে।৩৪

গান্ধির এই উক্তিতেও সার্জেন্টমেজর গান্ধির ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি অব্যাহত বিশ্বস্ততাকে প্রকাশ করে আর একই সঙ্গে উপনিবেশকে নয়াউপনিবেশে পরিণত করার পথ নিষ্কণ্টক করার পর্বে গান্ধির ভূমিকা স্পষ্ট করে। বস্তুত এই পর্বে গান্ধি নেওকম্প্রাদর শ্রেণীর প্রতিভূর ভূমিকা গ্রহণ করেন।

ভারত যদি সশস্ত্র বিদ্রোহের পথে এগিয়ে যেত তাহলেও ঔপনিবেশিকতার থেকে মুক্তি ঘটত। সেক্ষেত্রে প্রতিটি ভারতবাসী স্বাধীনতা এবং নিজের অধিকার আর কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হত, নয়াঔপনিবেশিকতা ও তার পক্ষাশ্রয়ী দেশীয় কায়েমি স্বার্থের শোষণের পথ এত মসৃণ হত না। সশস্ত্র বিপ্লবে যে রক্তক্ষয় ও ক্ষতি হত নয়াঔপনিবেশিক বিভেদনীতির প্রয়োগে দেশভাগের প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ও বিদ্বেষে ইন্ধন যুগিয়ে যে দাঙ্গা ঘটানো হয়েছিল তাতে তার চেয়ে কম রক্তপাত বা ক্ষতি হয় নি। অন্যদিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও গান্ধি আর তাঁর চিন্তার দায়ভার নিয়ে বিচার করা উচিত। আধুনিক গণতন্ত্র ইওরোপীয় চিন্তার ফসল। এর ভিত্তি মানবকেন্দ্রিক যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বান্ত্র্যবাদী রাজনৈতিক চেতনা। কিন্তু ভারতে গান্ধি যুক্তিবাদকে বিদায় দিয়ে গ্রাম্য হিন্দুসংস্কারের ভিত্তিতে জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে রক্তের মূল্যে ভারতীয়রা যে অধিকারবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতা লাভ করতে পারত, গন্ধির নেতৃত্ব তাকেও প্রতিরোধ করেছে। ফলে, ভারতীয় গণতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাসীন শ্রেণীর দ্বারা সংস্কারাচ্ছন্ন, অসচেতন বিপুল জনতাকে ছলেবলেকৌশলে শাসক ও শোষণের যন্ত্র। আসলে গান্ধি কখনো স্বাধীন গণতন্ত্রের কথা বলেন নি, তার বদলে সাধারণ মানুষকে রামরাজত্বের প্রগতিবিরোধী মধ্যযুগীয় সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছেন :

আমি স্বরাজের কথা বলি না বলি রামরাজ্যের কথাইতিহাস বলে সীতা খদ্দর পরতেনআর ঐ শুদ্ধতার জন্য রাবণ সীতাকে স্পর্শও করতে পারে নি সীতা আগুনে প্রবেশ করলেন, কিন্তু তাঁর কিছুই হয় নি। চেষ্টা করলে হিন্দু মহিলারা এমনই নিষ্পাপ হতে পারেন।৩৫

হিন্দ স্বরাজ’ বলতে কী বোঝায়? এর মানে ধর্মের শাসন বা রামরাজ্য । মেয়েদের সভায় আমি চিরকাল স্বরাজ শব্দের বদলে রামরাজ্য শব্দটি ব্যবহার করেছি।৩৬

রামরাজত্ব বলতে আমি হিন্দু রাজত্ব বোঝাতে চাই না। আমি রামরাজত্ব বলতে বোঝাতে চাই স্বর্গীয় রাজ্য, ঈশ্বরের রাজত্ব ।৩৭

সতীত্ব প্রমাণের জন্য স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করা, জনরবের ভয়ে নিরপরাধ সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নির্বাসিত করা, শুদ্র শম্বুকের তপস্যার কারণে অনাবৃষ্টি হচ্ছে — পুরোহিত ব্রাহ্মণদের এই অভিযোগ মেনে শম্বুকের শিরশ্ছেদ রামরাজত্বের ন্যায়পরায়ণতা ও গৌরবের নিদর্শন! বস্তুত রামায়ণের সাক্ষ্য অনুসারে গান্ধির স্বপ্নের পৌরাণিক রামরাজত্ব ছিল পিতৃতান্ত্রিক পুরুষশাসিত আর জাতিভেদ ও বৈষম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত পুরোহিতনিয়ন্ত্রিত সামন্ততান্ত্রিক রাজ্য। ‘সীতা খদ্দর পরতেন’ এই জাতীয় কালপ্রমাদযুক্ত উদ্দেশ্যমূলক উক্তি, (রামের নয় অর্থাৎ পুরুষের নয়) সীতার (নারীর) ‘শুদ্ধতা’ বা ‘নিষ্পাপ’ হওয়ার প্রসঙ্গ গান্ধির নারীপুরুষের সমান অধিকারের বিরোধী পিতৃতান্ত্রিক পুরুষশাসিত সমাজচিন্তার নির্দেশক। আবার নোয়াখালিতে দাঙ্গার প্রসঙ্গে এই ‘শুদ্ধতা’ বজায় রাখার জন্য গান্ধি হিন্দু নারীদের আত্মহত্যার উপদেশ দেন। গান্ধি ছিলেন পুরুষের প্রাধান্য মানা গ্রামীণ আচারসর্বস্ব হিন্দু সমাজের প্রতিভূ। তাঁর চিন্তার মধ্যে কি জীবনচর্যায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং নারীকে ভোগের এবং তার ফলে পাপের উপকরণ হিসেবে ভাবনার প্রকাশ রয়েছে। নারীকে তিনি পুরুষের ভোগ্যা, বড়জোর সেবিকার বেশী কিছু ভাবতে পারেন নি। নিজের সংযমের পরীক্ষার উপাদান হিসেবে ভক্ত এবং অনুগত নারীকে শয্যায় স্থান দেওয়া নারীত্বের প্রতি অপমান একথাও গান্ধিমহারাজের কখনো মনে হয় নি।

আধুনিক সভ্যতা অশুভ আর অন্ধকারের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে প্রাচীন সভ্যতা অর্থাৎ কিনা ভারতীয় সভ্যতা দিব্য শক্তির সারাৎসারের প্রতিনিধিত্ব করে।৩৮

আমি হলাম, আর আমি ছিলাম আধুনিক সভ্যতার দৃ়ঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিপক্ষ পরিপন্থী।৩৯

ওপরের উদ্ধৃতি গান্ধির আধুনিক সভ্যতার বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের পরিচয় দেয়। প্রথম উদ্ধৃতিতে ভারতীয় সভ্যতার কথা বলা হলেও ‘অশুভ আর অন্ধকারের সেনাবাহিনী’ পাশ্চাত্য খ্রিস্টধর্মীয় প্রভাব (‘অশুভ আর অন্ধকারের’ =শয়তানের ) নির্দেশ করে।

১৯৩৪ সালে বিহারের বিরাট ভূমিকম্পের পর গান্ধি বলেছিলেন যে ভারতীয়দের অস্পৃশ্যতার পাপের ঈশ্বরপ্রদত্ত শাস্তি এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অস্পৃশ্যতা বিভেদ ও বৈষম্যভিত্তিক অন্যায়, মানবিকতাবিরোধী, যুক্তিবিরোধী সামাজিক অপরাধ, তাকে দূর করার উপায় যুক্তিবাদী ও মানবিকতাবাদী শিক্ষা ও চিন্তার প্রসার; ধর্মীয় কুসংস্কার ছড়ানোর ফল হল তালগোল পাকিয়ে আসল সমস্যা থেকে সরে যাওয়া। এর প্রমাণ হিসেবে বলা যায় বিহার ভূমিকম্পের পর, গান্ধির আপ্তবাক্য উচ্চারণের পর আটাত্তর বছর কেটে গেছে অথচ বিহার তথা ভারত থেকে আজও বৈষম্যভিত্তিক জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা দূর হয় নি, বরঞ্চ জাতিভেদ এখন ভারতের রাজনীতিতেও শিকড় বিস্তার করেছে। অন্য দিকে ভূমিকম্প সম্পর্কে সারাদেশে কোনো সচেনতা তৈরি হয় নি, মানুষ বাড়িঘর তৈরি করার সময় আজও ভূমিকম্পের সম্ভাবনার কথা ভেবে কোনো রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনা। গান্ধির জন্মভূমি ভূমিকম্পপ্রবণ গুজরাট রাজ্যের পরপর ভূমিকম্প (২০০১, ২০০৬, ২০১১) তার প্রমাণ দেয়। আশ্রম, মন্দির, চরকা রামধুন, ‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম’পন্থী চিন্তায় ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে ধর্ম ও সম্প্রদায়কে গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে। গান্ধির বাণীপ্রকাশক তাঁর জীবনচর্যা এই ধর্মসাপেক্ষতারই উদাহরণ। গান্ধি মানবাধিকারের মাপকাঠিতে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে অগ্রাধিকারের পরিবর্তে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিভেদনীতিপ্রসূত (Divide and rule/বিভক্ত করে শাসন কর) তফশীলি শ্রেণীবিভাজনকে বিন্দুমাত্র বিরোধিতা না করে তা মেনে নেন। তথাকথিত অস্পৃশ্যদের তিনি ‘হরিজন’ নামে অভিহিত করেন। সামাজিকভাবে যাদের অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হয় তাদের ‘হরিজন’ বা অন্য যে কোনো নতুন নামেই চিহ্নিত করা হোক না কেন সারা দেশে যুক্তিবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামাজিক মানসিকতা না পালটানো পর্যন্ত তাদের অস্পৃশ্যতা তথা বৈষম্য দূর হয় না। গান্ধি ‘হরিজন’ মার্কা মেরে যুগ যুগ ধরে মানবাধিকারবঞ্চিত অসংখ্য শোষিত মানুষকে অসম্মানিত করুণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত ও সমাজ থেকে আলাদা করে রেখেছেন, তাদের বিভেদহীন সমাজে মানুষের বা ব্যক্তির অধিকার দেওয়ার কথা এতটুকু ভাবেন নি । আসলে গান্ধি কখনো জাতিভেদ প্রথাকে যুক্তিবাদী পদ্ধতিতে আক্রমণ করেন নি, জাতিভেদ আর অস্পৃশ্যতার বিরোধিতার নামে তাকে আরো শক্তি জুগিয়েছেন।

বিদেশি ঔপনিবেশিক স্বার্থের সঙ্গে দেশীয় কায়েমি স্বার্থ অক্ষত রাখার জন্য গান্ধি তাবৎ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। আফিঙ তথা তাবৎ মাদকের বিরোধী গান্ধি ছিলেন সুদের কারবার আর চিনে আফিঙের (চোরাই) চালানের ফাটকাবাজি থেকে সঞ্চিত পারিবারিক অর্থে শিল্পপতি হওয়া ঘনশ্যামদাস বিড়লার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঘনশ্যামদাস বিড়লা, যমনালাল বাজাজ, বদ্রিদাস গোয়েঙ্কা ইত্যাদি ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক গান্ধি ধর্মের ভড়ং নিয়ে বলতেন ধনীরা জাতির সম্পদের ঈশ্বর নির্দিষ্ট অছি। অবশ্য এই অছির ধারণাও গান্ধির নিজের বা ভারতীয় নয়, মার্কিন ধনী কার্নেগির (Andrew Carnegie, ১৮৩৫১৯১৯) সমাজবাদী চিন্তার বিরোধী ‘সম্পদ সম্পর্কে সুসমাচার’ (Gospel of Wealth, ১৮৮৯) নামে পরিচিত রচনা থেকে পাওয়া। গান্ধির ভারতে আসার পর ঘনশ্যামদাস কলকাতায় জমকালো ভাবে গান্ধির অভ্যর্থনা সভার আয়োজন করেন। গান্ধি তথা কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের ফল স্বরূপ বিড়লা পরিবার কতটা লাভবান হয় তা একটা সরল হিসেব থেকে বোঝা যায় ১৯১০ সালে ১৬ বছরের ঘনশ্যামদাস রাজস্থান থেকে কলকাতায় আসেন। ১৯১৪ সালে পারিবারিক অর্থে শুরু করা তাঁর ব্যবসার পরিসম্পদের ( assets ) পরিমাণ ছিল ২০ লক্ষ টাকা , ১৯১৮ সালে তা চারগুণ বেড়ে হয় ৮০ লক্ষ টাকা, ১৯৩৯ সালে ছগুণ বেড়ে ৪ কোটি ৮৫ লক্ষ, ১৯৬৯ সালে ৯৩১০ গুণ বেড়ে ৪৫৬ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা(৬১ লক্ষ ডলার)। বর্তমানে বিড়লা পরিবারের শুধুমাত্র একটি অংশ, ঘনশ্যামদাসের প্রপৌত্র কুমারমঙ্গলম বিড়লা পরিচালিত কোম্পানিগুলির পরিসম্পদের (assets) পরিমাণ নশ কুড়ি কোটি ডলার(২০১১)রামরাজ্য আর অহিংসার নামে চূড়ান্ত বৈষম্য আর শোষণকে মদত দেওয়া গান্ধিরভারতে আজ যেখানে ৮০ ভাগ ভারতবাসীর আয় দিনে দু ডলারের কম, সেখানে যাদের পরিসম্পদের মূল্য একশ কোটি থেকে দু হাজার দুশ কোটি ডলার এ রকম ৪৮ জন অছি তৈরি হয়েছে (২০১২)। গান্ধির সরল জীবনের প্রশস্তি এক দিকে ধনীদের রক্ষা করার কৌশল আর অন্য দিকে ভন্ডামি ছাড়া আর কিছুই ছিল না, গান্ধি ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীতে যাতায়ত করতেন, ফলে তাঁর জন্য কংগ্রেস পার্টি ও ইংরেজ সরকারের উদ্যোগে তৃতীয় শ্রেণী লেখা ট্রেনের একটি পুরো একটা কামরা আলাদা করে রাখা হয়েছিল, তার বাহ্যিক চেহারা বাদ দিয়ে ভেতরে ব্যবস্থা প্রথম শ্রেণীর কামরাকে ছাড়িয়ে যেত, গান্ধির গন্থব্যস্থলের ট্রেনে তা জুড়ে দেওয়া হত।সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, ‘গান্ধিজীকে দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন যাপন করানোর জন্য প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়।গান্ধির স্বপ্নের স্বাধীন ভারতের রামরাজত্বে তাই অপরিমিত ধনসম্পদের অধিকারী অল্প কিছু ভারতবাসীর পাশে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত নিঃস্ব ভারতবাসী চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে করুণভাবে বেঁচে আছে।গান্ধির নাম আউড়ে যাদের গর্বে বুক ফুলে ওঠে তারা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে আসার তিনমাস পর মাদ্রাজে আইনজীবিদের সমাবেশে গান্ধি একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি:

আমাকেপ্রায়শ প্রশ্ন করা হয়েছে আধুনিক সভ্যতার একান্ত বিরোধী আর অঙ্গীকৃত দেশপ্রেমিক আমি কী করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্যকে স্বীকার করে নিতে পেরেছিকী করে আমি উপলব্ধি করলাম যে ভারত আর ইংল্যান্ড পারস্পরিক মঙ্গলের উদ্দেশ্যে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।আরো একবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি আমার আনুগত্য ঘোষণা করতে গিয়েআমার খুবই আনন্দ হচ্ছে।আমার মনে হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কিছু আদর্শ রয়েছে, আমি যার প্রেমে পড়ে গিয়েছি, আর এই আদর্শগুলির একটা হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিটি প্রজার নিজস্ব কর্মক্ষমতার জন্য আর নিজের বিবেকবুদ্ধি অনুসারে যাই চিন্তা করুক তার সবচেয়ে স্বাধীন সুযোগ রয়েছে আমি মনে করি এটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্পর্কে সত্য, আমাদের চোখে পড়ে এরকম আর কোনো সরকার সম্পর্কেই একথা সত্য নয়। বসে পড়ার আগে আমি আপনাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি কামনা করে পান করতে অনুরোধ করব।৪০

বক্তৃতার ওপরের উদ্ধৃত অংশ ভারতে গান্ধির উপস্থিতি ও ভূমিকা স্পষ্ঠ করে।

তাহলে গান্ধিকে নিয়ে স্বদেশ আর বিদেশে কেন এত মাতামাতি? এর কারণ একাধিক। পাশ্চাত্যে ক্ষমতাসীনরা গান্ধির অলীক ভাবমূর্তির প্রচার করে। কারণ তা তাদের রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপোষক, তাদের নয়াঔপনিবেশিক প্রকল্পের সহায়ক । আফ্রিকা, এশিয়া আর দক্ষিণ আমেরিকায় তাদের স্বার্থ তথা ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন আমূল পরিবর্তনের বদলে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে তাদের নয়াকম্প্রাদর শ্রেণীর শাসন ও স্বার্থ অটুট রাখা। এর জন্য দরকার বিদ্রোহ ও বিপ্লবের প্রবণতার প্রশমক গান্ধি, মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যন্ডেলা, আন সান সুচি। এই প্রয়োজনেই গান্ধির ভাবমূর্তি বা তথাকথিত গান্ধিবাদের প্রচার।

অন্য এক স্তরে গান্ধির অলীক ভাবমূর্তির পরিগ্রহণে পাশ্চাত্যের সাধারণ মানুষের বেশির ভাগ প্রথমত পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের কায়মি স্বার্থের প্রচার দ্বারা প্রভাবিত হয়; দ্বিতীয়ত গান্ধির সাধুর ভেক আর গ্রাম্য আচারসর্বস্ব হিন্দুত্বের অনুশীলন (উপোস, রামনাম, নিরামিষ, মৌন, প্রায়শ্চিত্ত/শুদ্ধি ইত্যাদি মিলে ভারতের পশ্চিমি ইমেজ বা কল্পরূপ) আর তার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মীয় অভ্যাস (প্রার্থনা সভা, প্রার্থনা সভায় বক্তৃতা = সার্মন/ sermon) আর টলস্টয় থেকে পাওয়া অর্থোডক্স খ্রিস্টীয় মরমিয়া ধারণা, থরো আর রাস্কিনএর সামাজিক চিন্তার মিশ্রণে তৈরি অহিংসা, আধুনিক সভ্যতার বিরোধিতা, অসহযোগিতা, সর্বোদয় তাদের কাছে সহজবোধ্য আর হিন্দু ভারতীয়ত্বের মূর্ত রূপ বলে মনে হয়; তৃতীয়ত নিজেদের শ্রেয়ত্বে বিশ্বাসী পাশ্চাত্যকে অস্বীকার, বিদ্রোহ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে আপোষপন্থী গান্ধিবাদ তাদের আশ্বস্ত করে।

স্বদেশে অর্থাৎ ভারতেও গান্ধির অলীক ভাবমূর্তি সুবিধাভোগী কায়েমি স্বার্থ আর ক্ষমতাসীন শ্রেণীর রক্ষাকবচ আর শোষণ ও বঞ্চনার সহায়ক। তাই দেশের স্বাধীনতার জন্য নিঃস্বার্থ আত্মবলি দেওয়া বহু ভারতীয়ের অবদান এমন কী নাম পর্যন্ত মুছে দিয়ে গান্ধির ভাবমূর্তির উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচার অব্যাহত । এই ভাবমূর্তি দুদিক থেকে অলীক। প্রথমত বাস্তব গান্ধির সঙ্গে সম্পর্কহীন ,গান্ধি দ্বিতীয়ত যারা এর প্রচারক তারা গান্ধির ধ্যানধারণাকে কোনো অর্থেই বিন্দুমাত্র অনুসরণ করে না।

উপসংহারে সিদ্ধান্ত হিসেবে আমরা বলতে পারি ব্যক্তিগত জীবনে গান্ধি ছিলেন পারিবারিক উত্তরাধিকারে পাওয়া আচারবিশ্বাসী (উপোস, নিরামিষ, মৌন, প্রায়শ্চিত্ত/শুদ্ধি) কুসংস্কারাচ্ছন্ন (রামনামের শক্তিতে বিশ্বাস, রামরাজত্বের ধারণা) হিন্দু । আর গ্রাম্য হিন্দুর চরিত্র অনুসারে সবদিক থেকেই গান্ধি ছিলেন প্রগতিবিরোধী, পিতৃতান্ত্রিক পুরুষপ্রাধান্যে বিশ্বাসী, প্রতিক্রিয়াশীল। এর সঙ্গে মিশেছিল পাপবোধের আতঙ্ক। সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে তিনি তাঁর সংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মাচারের সঙ্গে এক দিকে ইংরেজি শিক্ষা থেকে পাওয়া ধারণা (অহিংসা, অসহযোগিতা, সর্বোদয়) আর গীতা, বেদউপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারতের দোহাই মিশিয়েছেন, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চরকা, আশ্রম, ব্রহ্মচর্য, সাধুর ভেক। গান্ধি ধূর্ত বানিয়াবুদ্ধিতে এসব ভড়ংকে চড়া দরে দেশেবিদেশে বেচেছেন। গান্ধির কাছ থেকে ভারত যে শিক্ষা পেয়েছে তা হল ভড়ং, ভেক আর ভণ্ডামির। গান্ধি ধর্মের গঙ্গাজল মেশানো রাজনীতির (ককটেল) মাদক বিলিয়ে জনসাধারণের সচেতনতা ও বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে মোহগ্রস্ত এবং পথভ্রান্ত করেছেন আর নয়াঔপনিবেশিকতা ও তার কম্প্রাদরদের শোষণের পথ প্রশস্ত করে রেখে গেছেন । দেশবিদেশের কায়েমি স্বার্থ গান্ধিকে ভারতীয়ত্ব তথা মরমিয়া হিন্দুত্বের প্রতীক বলে অবিরাম প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গান্ধি কোনক্রমেই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিভূ ছিলেন না। গান্ধির ‘হিন্দুধর্ম’ ছিল খ্রীস্টীয় পাপবোধ, খ্রীস্টীয় অহিংসার সঙ্গে (বুদ্ধ, মহাবীর বা অশোকের অহিংসার সঙ্গে নয়) ভারতীয় গ্রাম্য কুসংস্কারের সমবায়। গান্ধির (বাল্মিকীর রামায়ণ পড়া নয়. তুলসিদাসের রামচরিত মানস শোনা) ‘রামরাজত্বের’ ধোঁয়া, ‘ঈশ্বরআল্লানিয়ে কচলানো, ধর্ম থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার পরিবর্তে ক্রমশ অধিক থেকে অধিকতর রাজনীতি ও ধর্মের জগাখিচুরি মিশ্রণ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্ররোচনা দিয়েছে, উত্সাহিত করেছে — এর ফল দেশভাগ এবং দেশভাগের পরও সাম্প্রদায়িকতার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও সংঘাত।বর্তমান ভারতে সর্বস্তরে মিথ্যাচার, কপটতা, দুর্নীতি আর ভণ্ডামির সর্বব্যাপ্ত উপস্থিতি জাতির এই উত্তরাধিকারকে স্মরণ করিয়ে দেয়, হয়ত এদিক থেকে গান্ধিকে জাতির বাপুজি বা জনক’ না বলে কোনো উপায় নেই।

টীকা

.আত্মজীবনী বা সত্যের প্রয়োগ: প্রথম খণ্ড, পরিচ্ছেদ ১, জন্ম ও বাবামা।

.: প্রথম খণ্ড, পরিচ্ছেদ ৬. দুঃখজনক ঘটনা।

. : প্রথম খণ্ড, পরিচ্ছেদ ১০. ধর্মের সঙ্গে পরিচয়।

. :প্রথম খণ্ড, পরিচ্ছেদ ১১., ইংল্যান্ডের জন্য প্রস্তুতি।

. অখিল ভারতীয় সাহিত্য পরিষদে ব্ক্তৃতা, নাগপুর, এপ্রিল ২৪, ১৯৩৬. গা..,

.৬৮, পৃ.৩৮২।

. প্রকৃতির ক্রোধ, নবজীবন, ১৯২৭, গা.., . ৩৯,পৃ. ৩২।

.তিনেভেল্লির জনসভায় বক্তৃতা, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৩৪, গা.., . ৬৩,পৃ. ৩৮।

. বেহরামজি খামভট্টকে লেখা চিঠি, ১৯ নভেম্বর, ১৯২৬, গা.., . ৩৭, পৃ. ৫০।

. কুসুম দেশাইকে লেখা চিঠি, এপ্রিল ৯, ১৯২৯, গা.., . ৪৫,পৃ. ৩১৯।

১০.গীতা সম্মন্ধে সন্দর্ভ, এপ্রিল ১১, ১৯২৬, গা.., . ৩৭,পৃ. ১৩২।

১১. ভারতীয় নিরামিষাসীরা ১, নিরামিষাসী, ১৮৯১, গা.., .,পৃ. ১৯।

১২. সন্তোজি মহারাজকে লেখা চিঠি, বাঙ্গালোর, ৬ই জুলাই, ১৯২৭, গা.., . ৩৯, পৃ.

১৪২১৪৭ ।

১৩.. জন অনুসারী সুসমাচার ১৪:৬।

১৪. জন অনুসারী সুসমাচার ৮:৩১৩২ ।

১৫. যুগল কিশোর বিড়লাকে লেখা চিঠি, অগাস্ট ৭, ১৯২৬, গা.., . ৩৬, পৃ. ১৭৭।

১৬. গীতা সম্মন্ধে সন্দর্ভ, এপ্রিল ১১, ১৯২৬, গা.., . ৩৭,পৃ.৯৯।

১৭. গীতা সম্মন্ধে সন্দর্ভ, গা.., . ৩৭,পৃ.১৫০।

১৮. দিনের চিন্তা, অক্টোবর ১, ১৯৪৬, গা.., . ৯২, পৃ.৩৭৪।

১৯. মুম্বইয়ে জনসভায় বক্তৃতা, সেপ্টেম্বর ২৬, ১৮৯৬, গা.., . , পৃ.৩৭৪।

২০. আত্মজীবনী বা সত্যের প্রয়োগ: চতুর্থ খণ্ড, পরিচ্ছেদ ২৪, জুলু বিদ্রোহ ।

২১. প্রশ্নের জগাখিচুরি, তরুণ ভারত (ইয়ং ইন্ডিয়া), নভেম্বর ৫, ১৯২৫. গা.., . ৩৩,

পৃ.২০৫।

২২. প্রশ্নোত্তর, অক্সফোর্ড, অক্টোবর ২৪, ১৯৩১, তরুণ ভারত (ইয়ং ইন্ডিয়া), নভেম্বর

, ১৯৩১. গা.., . ৫৪, পৃ.৮৯।

২৩. চার্লস পেট্রাশ গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎকার , লেবার মান্থলি, .১৪, এপ্রিল ১৯৩২,

সংখ্যা ৪, পৃ. ২১৭২২৪।

২৪.বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরা, জানুয়ারি ১৬, হরিজন, ২০১৯৪০, গা.., . ৭৭ পৃ. ২২৭।

২৫. ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ, ১৯২২।

২৬.আত্মজীবনী বা সত্যের প্রয়োগ: পঞ্চম খণ্ড.পরিচ্ছেদ ২ , গোখলের সঙ্গে পুনায়।

২৭. সুভাষচন্দ্র বসু: ভারতীয় সংগ্রাম, পৃ. ৯০।

২৮. মুন্দ্রায় বক্তৃতা, নভেম্বর ১, ১৯২৫, গা.., . ৮৭, পৃ. ৩৯৮৩৯৯।

২৯,বল্লভভাই প্যাটেলকে লেখা চিরকুট,নভেম্বর ১, ১৯৩৭, গা.., . ৭২, পৃ. ৩৮০।

৩০. আভ্যন্তরীন ক্ষয়, বর্দোলি, জানুয়ারি ২৩, ১৯৩৯, হরিজন, ২৮১০৩৯, গা..,

.৭৪, পৃ. ৪৩৮।

৩১.অমৃতা কাউরকে চিঠি, পুনা, অগাস্ট ২৪, ১৯৪৫, গা.., . ৩৩, পৃ. ১৮০।

৩২.প্রফুল্ল ঘোষকে চিঠি, নয়া দিল্লি,৩০ জুন ১৯৪৭।

৩৩. প্রেসে বিবৃতি, পুনা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ১৯৪৬. হরিজন, ১৯৪৬, গা.., .৮৯,

পৃ. ৪৪২।

৩৪. প্রেসে বিবৃতি, পুনা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৪৬. হরিজন, ১৯৪৬, গা.., .৯০,

পৃ. ৫।

৩৫. নন্দীগ্রামে বক্তৃতা, এপ্রিল ৯, ১৯২৯, দি হিন্দু, ১০১৯২৯, গা.., .৪৫, পৃ.

৩২০।

৩৬. আশ্রমের মহিলাদের সঙ্গে কথা ২, ১৯২৬, গা.., . ৩৭, পৃ. ৪৭১।

৩৭. ভূপালে জনসভায় বক্তৃতা, সেপ্টেম্বর ১০, ইয়ং ইন্ডিয়া, ১৯১৯২৯, গা..,

.৪৭, পৃ. ৪১।

৩৮. ছাত্রদের প্রতি উপদেশ, মাদ্রাজের ওয়াই.এম.সিএ., ২৭ এপ্রিল, ১৯১৫, মহাত্মা

গান্ধি তাঁর জীবন , রচনা আর বক্তৃতা, গণেশ এন্ড কোং, ১৯১৭, মাদ্রাজ, পৃ. ৫৫।

৩৯. গুরুকুল, বক্তৃতা, মাদ্রাজের ওয়াই.এম.সি. ., এম. কে.গান্ধি: রচনা আর বক্তৃতা, জি. . নাটসেন এন্ড কোং, মাদ্রাজ, ১৯২২, পৃ. ২৬৮।

৪০.. মাদ্রাজ ল ডিনার(Madras Law Dinner) গান্ধির বক্তৃতা, এপ্রিল ২৪১৯১৫, গা.., .১৪, পৃ.৪১৭৪১৮।