Pushkar Dasgupta: Scattered Thoughts on the Bengali Language ( 2) পুষ্কর দাশগুপ্ত বাংলা ভাষা নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবনা (দ্বিতীয় কিস্তি)

Pushkar Dasgupta: Scattered Thoughts on the Bengali Language 

(Part II)

পুষ্কর দাশগুপ্ত

 বাংলা ভাষা নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবনা

(দ্বিতীয় কিস্তি)

. বাংলায় বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ

আমার হাতের কাছে রয়েছে ‘আকাদেমি বানান অভিধান’ (পঞ্চম সংস্করণ, আগস্ট ২০০৫)।  পাতা ওলটাতে ওলটাতে চোখে পড়ল ‘প্যারি [রী নয়](পৃষ্ঠা ২৮৪)।  অনুমান করলাম এই শব্দটি ফ্রান্সের রাজধানীর নাম Parisএর প্রতিবর্ণীকরণ । মনে পড়ল বেশ কিছু বিদগ্ধ বাঙালি ফ্রান্সের রাজধানীর নাম লেখেন ‘পারী’। অতৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈকার বর্জনীয় — এই বিধি মেনে বানানঅভিধানে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে নির্দেশ করা হয়েছে ‘রী’ নয়। প্রসঙ্গত একাধিক কথা বলার থাকে। ফ্রান্সের রাজধানী উনিশ শতক থেকে ইংরেজি উচ্চারণের অনুসরণে বাঙালিদের কাছে বাংলা ভাষায় ‘প্যারিস’ নামে পরিচিত। তাকে পালটানোর প্রয়োজন বা/এবং যুক্তিটা কী ? যদি বলা হয় ‘প্যারি’ বা ‘পারী’ ‘মূল’ ভাষার ‘শুদ্ধ’ বা ‘সঠিক’ উচ্চারণ তাহলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রথমত এক ভাষার কিছু কিছু ধ্বনিমূল (ফোনিম/phoneme) অন্য একটি ভাষায় অনুপস্থিত থাকতে পারে আর তখন উক্ত অনুপস্থিত ধ্বনিমূলকে লিখিতভাবে প্রকাশ করার জন্য কোনো বর্ণপ্রতীক ও (বর্ণমূল = গ্রাফিম/grapheme) ঐ দ্বিতীয় ভাষায় থাকে না ৷ বানান অভিধানের ‘প্যারি’র অ্যা/æ (বাংলায় দেখা, ইংরেজি cat) ফরাসি ভাষায় নেই। Paris নামের ɑআ’ (ɑ :) অ্যা’ নয়। আবার প্যারিসীয় ফরাসি rএর উচ্চারণ বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতিতে নেই। তাই বাংলা বর্ণ ‘র’ দিয়ে তার যথাযথ প্রকাশ সম্ভব নয়, যেমন বাংলা ‘ড়’, ‘ঢ়’ বা ‘ঢ’ দ্বারা প্রকাশিত ধ্বনিমূলকে ইয়োরোপীয় (গ্রিক, ল্যাটিন) বর্ণমালার কোনো বর্ণমূল দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। ফরাসি iএর দীর্ঘত্ব প্রকাশ করার জন্য যদি দীর্ঘ ঈকার ব্যবহার করা হয় তাহলেও বাঙালির উচ্চারণে তা হ্রস্ব রূপ লাভ করবে। কেননা বাংলা উচ্চারণপদ্ধতিতে ‘ই’ আর ‘ঈ’এর কোনো তফাত নেই — একাক্ষর শব্দে (যেমন চি, ধী) দুটোই দীর্ঘ, অন্যত্র দুটোই হ্রস্ব (যেমন প্রতিবাদী, টীকাটিপ্পনী। দ্বিতীয়ত ‘প্যারিস’ জাতীয় বিভিন্ন বিদেশি ভৌগোলিক বা ব্যক্তির নামের তথাকথিত ‘মূলানুগ’, ‘শুদ্ধ’ বা ‘সঠিক’ উচ্চারণের প্রতিবর্ণীকরণের শুদ্ধিয়জ্ঞ যদি একবার শুরু হয় তাহলে আমরা যে গোলকধাঁধায় প্রবেশ করব তার মধ্যে পথ হারিয়ে ঘোরা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। ইতালি, রোম, মিলান, লিসবন, গ্রিস, অ্যাথেন্স, ইজিপ্ট/মিশর, কাইরো, মেক্সিকো ইত্যাদি আর বলা বা লেখা যাবে না, বলতে বা/এবং লিখতে হবে ইতালিয়া, রমা (ইতালীয়r-এর উচ্চারণ বাংলা ভাষার ‘র’এর উচ্চারণ এক নয়), মিলানো, লিসবোআ, এলাস বা এলাদা, আথিনা (গ্রিক θ থিতা বাংলা ‘থ’ দিয়ে প্রতিবর্ণীকরণ করা যায় না), কেমেৎ/মিস্র্ বা গুমহুরিয়াৎ মিস্র্ আল আরাবিয়া, আলকাহিরা, মেহিকো (আরবি ‘হ’ আর ইস্পানি x ঠিক বাংলা হ’ নয়, আবার তা মহাপ্রাণ ‘খ’ ও নয়)

আকাদেমি বানান অভিধানের ৪৫৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘শ্যাম্পেন’। ‘শ্যাম্পেন’ ফ্রান্সের উক্ত নামের প্রদেশে উৎপাদিত ফেনাওঠা সাদা মদবিশেষ। champagneএর ইংরেজি উচ্চারণের অনুসরণে বাংলা ভাষায় বহু কাল ধরে উক্ত বিশেষ ধরনের মদের নাম হিসেবে ‘শ্যাম্পেন’ শব্দটি প্রচলিত আর এই প্রচলিত রূপটি রক্ষা করাই আমাদের মতে যুক্তিযুক্ত। তবে প্রশ্ন হল ‘শঁপাইন’ (ফরাসিতে gn-এর তরল ‘ɲধ্বনি বাংলায় নেই) যদি তার প্রচলিত রূপ ‘শ্যাম্পেন’ নামে স্বীকৃত হয় তাহলে ‘প্যারিস’এর বদলে বাংলায় ‘প্যারি’ বা ‘পারী’ বলা বা/এবং লেখার লেখার যুক্তিটা কী ?

বানান অভিধানের ২৮৪ পৃষ্ঠায় দেখলাম ‘প্যাস্কাল’। এতদিন শুনে আসা সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞানীদার্শনিক ‘পাস্কাল’এর নাম অভিধানকর্তাদের ইচ্ছায় ‘প্যাস্কাল’এ পরিণত হল কেন তা বোঝা গেল না।

পূর্বোক্ত প্রসঙ্গের জের টেনে বলা যায় যে বেশ কিছুকাল ধরে বাংলা ভাষায় বিদেশি আখ্যাবাচক বিশেষ্যের, বিশেষ ভৌগোলিক ও ব্যাক্তিনামের প্রতিবর্ণীকরণে একটা নৈরাজ্য লক্ষ করা যায়। এখানে ঐ অরাজকতা সম্বন্ধে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। আমার মনে হয়েছে উক্ত নৈরাজ্যের মূলে রয়েছে দু ধরনের অপ্রকৃস্থ মানসিক প্রবণতা। প্রথমত এক ধরনের প্রদর্শক (একজিবিশনিস্ট), পণ্ডিতম্মন্যআত্মস্ভরিতা (ওরা/অন্যেরা যা বলে বা লেখে তা ভুল, আমিই হলাম জ্ঞানের জিম্মাদার আমি যা বলব/লিখব তাই ধ্রুবসতা, তাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য)। দ্বিতীয়ত ঔপনিবেশিতের উপসর্গে (কলোনাইজড সিনড্রমস/ colonized syndromes) ভোগা বাঙালি/ভারতীয় বুদ্ধিজীবিশ্রেণীর পাশ্চাত্যের মুখোমুখি হীনমন্যতা; তাই জাপানি, চিনে, থাই, ভিয়েতনামীয়, ইন্দোনেশীয়, আরবি ইত্যাদি ভাষার নাম সম্পর্কে বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু পশ্চিমি নামের ‘মূল’, ‘সঠিক’ উচ্চারণ দিতে না পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ! —এই প্যারানোইয়ায় তারা মুহ্যমান। কী কাণ্ড ! লোকে ভাববে ও জানে না !

ঘটনাচক্রে বেশ কিছু বছর ধরে আমি ইয়োরোপপ্রবাসী । তাছাড়া অন্নসংস্থানের জন্য তার বহু আগে থেকেই আমাকে অইংরেজি একটি ইয়োরোপীয় ভাষা পড়াতে হত, ঐ ভাষার সূত্রে বারবার ইয়োরোপেও আসতে হত। ফলে কলকাতায় দেখা হলে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, অমুক নামের সঠিক উচ্চারণটা কী হবে? নামটা বাংলায় কীভাবে লেখা যাবে?আমি জবাব দিই, সাহেবরা আমাদের নামধাম ওদের উচ্চারণপদ্ধতিতে, ওদের মতো করে উচ্চারণ করে। আমাদেরও উচিত বাংলা ভাষায় ওদের নামধামের প্রচলিত উচ্চারণ আর বানানগুলি রাখা আর নতুন নামধামের ক্ষেত্রে তথাকথিত শুদ্ধ বা আসল উচ্চারণ নিয়ে মাথা খারাপ না করে বাঙালির উচ্চারণঅভ্যাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, বাঙালির ধাতে সয় এরকম বানানে প্রতিবর্ণীকরণ করা।’ প্রশ্নকর্তা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন — আমার জ্ঞানের বহর সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে বলে বোধ হয়।

ইয়োরোপ আমেরিকার নাম করলে এ দেশের বুদ্ধিজীবিরা কিছুটা নড়েচড়ে বসেন, বেশ খানিকটা স্বস্তি পান। তাই ইয়োরোপীয় পরিপ্রেক্ষিতে যাওয়া যাক, ঐ পশ্চিমি পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে আমাদের হীনমন্যতা আর মানসিক দৈন্যের ছবিটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের রাজধানীর নামের বাংলা ভাষায় উচ্চারণপ্রতিবণীকরণ নিয়ে প্যারিসপ্যারিপারীর টানাহ্যাঁচড়ার কথা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। ঐ নগরীকে ফরাসি বাদ দিয়ে অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষায় বলা বা/এবং লেখা হয়ে থেকে প্যারিস, পারিস, পারিয়িস, পারিসি, ইত্যাদি। ঐ সব ভাষা বলা বা লেখার সময় কেউ উক্ত নগরীর নামের তথাকথিত ‘শুদ্ধ’, ‘মূলানুগ’ উচ্চারণ — প্রতিবর্ণীকরণের চেষ্টা করে না। বস্তুত এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তথাকথিত শুদ্ধ করার চেষ্টা করলে ভাষাব্যবহারের উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হবে অর্থাৎ তখন ভাষা আর তার উদ্দিষ্ট পরিগ্রাহকের (রিসিভারের) কাছে বক্তব্যের সংজ্ঞাপন (কম্যুনিকেশন) করতে পারবে না। ইয়োরোপে সরু এক চিলতে ইংলিশ চ্যানেলের দুপাশে রয়েছে দুটি দেশ — গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স — ভাষা ইংরেজি আর ফরাসি। ফরাসিতে গ্রেট ব্রিটেনকে বলা হয় গ্রঁদ ব্রতাইন, ইংল্যান্ডকে অঁগলতের, ওয়েলসকে গাল, শেকসপিয়ারকে শেকসপির, লন্ডনকে লোঁদর্। আর ইংরেজিতে ফ্রঁসকে বলা হয় ফ্রান্স, পারিকে প্যারিস, ব্রতাইনকে ব্রিট্যানি, মঁশকে ইংলিশ চ্যানেল, তুর এফেলকে আইফেল টাওয়ার, জান দার্ককে জোয়ান অব আর্ক ৷ ফরাসি বলতে পারে এরকম একজন ইংরেজকে ফরাসিতে সংজ্ঞাপন করতে গিয়ে বলতে হয় গ্রঁদ ব্রতাইন, অঁগলতের, গাল, শেকসপির, লোঁদর্ আর ঠিক একই ভাবে একজন ফরাসিকে ইংরেজিতে বলতে হয় ফ্রান্স, প্যারিস, ব্রিটানি, ইংলিশ চ্যানেল, আইফেল টাওয়ার, জান দার্ক ৷ অথচ বাংলায় বহুকাল ধরে প্রচলিত জার্মান মহাকবি গেটের নাম ‘শুদ্ধভাবে’ উপস্থাপিত করতে গিয়ে গ্যেটে, গয়টে, গ্যোয়টে, গ্যোটে, ইত্যাদি কত কিছুই না বলা বা/এবং লেখা হয়। ‘ইডিপাস’ নামে পরিচিত গ্রিক ধ্রুপদী নাটক তথা তার নায়কের নাম ইডিপাস, ঈডিপাস, অয়দিপুস, অয়দিপাউস, ইত্যাদির মধ্যে কোনটা ‘সাঠিক’ তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ তর্ক হয়। উনিশ শতকের এক বিখ্যাত ফরাসি কবির নাম ব়্যাঁবো, হ্র্যাম্বো, হ্র্যাঁবো, খ্যাম্বো ইত্যাদির মধ্যে কোনটা ‘মূলানুগ’ তা নিয়ে লড়াই বেধে যায়। অথচ ফরাসিতে সংজ্ঞাপন করতে গেলে তথাকথিতসঠিক’, ‘মূলানাগ’ উচ্চারণ ভুলে গিয়ে একজন জার্মান, একজন গ্রিক, একজন ইতালিয়ান, এমন কী একজন বাঙালিকেও বলতে হয় ‘গ্যোৎ ’ (গেটে), ‘য়্যদিপ’ (ইডিপাস), দঁত (দান্তে)

ইদানীং কালের বাংলা ভাষার তাবৎ লিখিত উৎপাদনে (সংবাদপত্র, সামায়িক পত্র, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনায়) পশ্চিমি আখ্যাবাচক নামপদের উচ্চারণপ্রতিবর্ণীকরণের অরাজকতার অজস্র দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। আমার সামনে রয়েছে সুবল সামন্ত সম্পাদিত সাম্প্রতিক কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যপত্রিকা ‘এবং মুশেয়ারা’র একটি সংখ্যা। এই বিশেষ সংখ্যাটির বিষয়বস্তু হল ষোড়শ শতকের বিখ্যাত ইস্পানি উপন্যাস Don Quixote। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং সাহিত্যস্রষ্টা উপন্যাসটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন ৷ এসব আলোচনার বিচার বা মূল্যায়ন এখানে আমার আলোচ্য নয় আর তা আমার ক্ষমতারও বাইরে। তবে পাত্রিকাটিতে প্রকাশিত বিভিন্ন রচনায় উক্ত উপন্যাসের শিরোনাম তথা প্রধান চরিত্র, প্রধান চরিত্রের সঙ্গী ও উপন্যাসের রচয়িতার নামের যে উচ্চারণপ্রতিবর্ণীকরণগুলি চোখে পড়ল তা হতবুদ্ধি করার মতো:

. উপন্যাস ও তার প্রধান চরিত্রের নাম Don Quixote : ডন কুইকসোট, ডন কুইক্ সোট, ডন কুইকজোট, ডন কুইক্ জোট, ডন কিহ্বোতে (বাংলায় ‘হ্বো’র উচ্চারণটা কী ?), ডন কিহোতে, দন কিহোতে, দোন কিখোতে, ডন কিওটি, ডন কুইক্সোট, দোন কিহোতি, ডন কুইজোট, ডন কিহোটে, দন কিশোটে, দন কিহোটে।

. প্রধান চরিত্রের পদবির অংশ de la Mancha: দি লা মাঞ্চা, দ্য লা মাংকা, দ্য লা মাঞ্চা, ডি লা মাঞ্চা, দে লা মানচা, দে লা মাঞ্চা।

. প্রধান চরিত্রের সঙ্গীর নাম Sancho Panza : সাঙ্কো, স্যাঙ্কো, সাঙ্কো পাঞ্জা, সাংকো পাঞ্জা, সানচো পানসা, সাঞ্চো পাঞ্জা, সাঙ্কো পানসা, সাঁকো পাঁজা।

. উপন্যাসের রচয়িতার নাম Miguel de Cervantes Saavedra: মিগুয়েল দি থেরভান্তেস, সার্ভান্টিস, সের্ভান্তেস, সার্ভেন্তেজ, সেরভান্তেস, সের্ভান্তেস, মিগেল দে সেরভানতেস সাভেদ্রা, সারভেন্তিস, সারভেন্তেস, সারভ্যানটিস, মিগুয়েল সারভানতিস, দোন মিহুয়েল দে সের্ভান্তেস সাভেদ্রা, সেরভেন্তেস, সার্ভান্তিস, মিগেল দে সেরভান্তেস সাবেদ্রা, মিগেল দ থেরভান্টে সাআভেদ্রা, মিগেল দ্য সেরবানতেস, মিখুয়েল দে সেরভানতেস সাভেদ্রা।

ওপরের তালিকা থেকে সাধারণভাবে বাংলা ভাষার অস্থির নৈরাজ্যের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই অস্থিরতা তার পরিপুষ্টি ও পরিণতির অভাবকে সূচিত করে। আমি ‘ভারতীয়’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘গান্ধি’র দেশের লোক, ‘কলকাতা’ থেকে এসেছি। একথা বোঝানোর জন্য আমাকে ইংরেজিতে বলতে হয়, আমি ‘ইন্ডিয়া’ থেকে আসা ‘ইন্ডিয়ান’ (আমেরিকার ‘ইন্ডিয়ান’ নই), ‘টেগোর’ আর ‘গ্যান্ডি’র দেশের লোক, ‘ক্যালকাটা’ (‘কোলক্যাটা’এখনো পরিচিত নয়) থেকে এসেছি ; ফরাসিতে পরিচয় দিতে হয়, আমি ‘অ্যাঁদ’ (ল্যাঁদ) থেকে আসা ‘অ্যাঁদিয়্যাঁ’, ‘তাগোর’ আর ‘গঁদি’র দেশের লোক, ‘কালক্যুতা’ খেকে এসেছি ; গ্রিকে বলতে হয়, আমি ‘ইন্দিয়া’ থেকে আসা ‘ইন্দস’ (আমেরিকার ‘ইন্দিয়ানস’ নই), ‘তাগোর’ আর ‘গান্দি’র দেশের লোক, ‘কালকুতা’ (‘কলকাতা’ এখানো কেউ জানে না) থেকে এসেছি। আমাকে ব্রিটিশ ইংরেজিতে বলতে হয় ডন কুইকজোট, (টেক্সমেক্সএর দেশ আমেরিকার) মার্কিন ইংরেজিতে ডন (বা দন) কিহোতে। অর্থাৎ সংজ্ঞাপনের সর্বস্তরে ব্যবহৃত যেকোনো পরিণত ভাষায় আখ্যাবাচক বিদেশি নামপদের (ভৌগোলিক বা ব্যত্তির নামের) অনন্য একটি সর্বজনগ্রাহ্য মান উচ্চারণপ্রতিবর্ণীকরণের রূপ রয়েছে। ঐ রূপ উক্ত ভাষার ধ্বনিউৎপাদনপদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে উঠেছে। সেখানে ঔপনিবেশিতের উপসর্গের প্রকাশক হীনমন্যতা থেকে ‘আসল’, ‘সঠিক’, ‘মূলানুগ’ উচ্চারণের অর্থহীন অনুকরণের প্রয়াস দেখা যায় না। বহু ভাষায় সংজ্ঞাপনে সক্ষম বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা তাঁরা কি এ জাতীয় প্রয়াস কোনো পরিণত ভাষায় লক্ষ করেছেন?

এমনকী বাঙালির হীনমন্যতার প্রকাশ ভারতীয় ভাষার আখ্যাবাচক নামপদের প্রতিবর্ণীকরণেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। হিন্দিতে বংগাল, কলকাত্তা, হাবড়া ইত্যাদি বলা বা লেখা হত এবং এখানো হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় সম্প্রতি গাঁধি, পটনা, গ্বার্লিয়র (শব্দের আদি অক্ষরে বাংলায় বযুক্ত ব্যঞ্জনে ‘ব’ বা ‘বফলার’ কোনো উচ্চারণ নেই যেমন ‘স্বাধীনতা’, তাহলে ‘গ্বা’এর উচ্চারণ কী ?) ইত্যাদি লেখা শুরু হয়েছে।

 প্রসঙ্গত আরেকটি প্রশ্ন : আখ্যাবাচক নামপদের উচ্চারণ—প্রতিবর্ণীকরণের মান, সর্বজনগ্রাহ্য রূপ স্থির করা — যা চলে আসছে (প্যারিস, অ্যাথেন্স, ইডিপাস, গেটে, ডন কুইকজোট ইত্যাদি) তাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া আর বাংলা ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক সংস্থান (স্ট্রাকচার) মেনে নতুন বিদেশি নামের উচ্চারণ — প্রতিবর্ণীকরণের একটা নিয়মপ্রণালী তৈরি করা কি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আর ঢাকার বাংলা একাডেমির যৌথ কর্তব্য হয়ে উঠতে পারে না ? তবে এ প্রয়াসেও বিদেশি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বে জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে যা দরকার তা হল বাংলা ভাষার উচ্চারণরীতির কাঠামোয় বিদেশি শব্দ তথা ধ্বনিকে (প্রয়োজন অনুসারে রূপান্তরিত করে) স্থান দেওয়া — বাঙালির ধ্বনিউৎপাদন স্বভাবের সঙ্গে তাকে খাপ খাওয়ানো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানসংস্কার সমিতি ১৯৩৬ সালে তাঁদের প্রস্তাবে Z-র প্রতিবর্ণীকরণের নিম্নরেখাযুক্ত অথবা দুটি বিন্দু বা ফুটকিযুক্ত জ* ব্যবহারের কথা বলেছিলেন, তারপর বুদ্ধদেব বসু pleasure-এর S বা ফরাসিj আর g(+e/ i)এর জন্য একটা বিন্দু বা ফুটকিওয়ালা ‘জ’*-এর প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু বিদেশি ভাষার উচ্চারণে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত নয় এরকম বাঙালির উচ্চারণে ফুটকি ছাড়া ‘জ’ বা/এবং নিম্নরেখাযুক্ত তথা দুটি বা একটি ফুটকিওয়ালা *এক আর অনন্য বাংলা ‘জ’* পরিণত হতে বাধ্য ৷

আমার শেষ জিজ্ঞাসা : বাংলা ভাষা কি কখনো সাবালক হবে না ? আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিগ্রহণের সহজাত নিয়ম মেনে বিদেশি শব্দকে নিজস্ব ধ্বনিসংস্থানের মধ্যে রূশান্তরিত তথা আত্মীকৃত করে নিতে পারবে না ? বাংলা ভাষা কি চিরকাল শৈশবের অস্ফুট, অপটু অনুকরণে সাহেবদের নামধাম আউড়াতে থাকবে ? বাংলা ভাষার চিরশৈশব কি কাটবে না ?


 

. বাংলা ভাষা নিয়ে ভ্যানতাড়া

সাদা চামড়ার সায়েবরা যদ্দিন এদেশের মাথায় বসেছিল তদ্দিন বাপ বলে ইংরিজি বুলিটা রপ্ত করতে হত ৷ নইলে লোকজনের ভিড়ে ভদ্দরলোক বলে কল্কে মিলত না, বাপের ঠাকুর লালমুখোদের তোয়াজ করে নানান ধান্দা করার উপায় থাকত না, আঙুলে থুতু লাগিয়ে নোট গোণা যেত না ৷হেয়ার কলিন পামরশ্চ কেরী মার্শমেনস্তথা ৷ পঞ্চগোরা স্মরেনিত্যং মহাপাতকনাশনম্ ৷৷ — তার মানে ঘুম থেকে ধরমর করে উঠে চোদ্দপুরুষের আউড়ানো পঞ্চকন্যার নাম খেয়ে ফেলে তার বদলে পঞ্চগোরার নাম আউড়েও দিনভর গোরাদের হাতে কেলানি খাওয়ার ভয়ে চিমসে মেরে থাকতে হত ৷ অবশ্যি ওরই ফাঁকফোকরে, ঝোপ বুঝে কোপ মেরে, হরেক কিসিমের ফন্দিফিকির করে ফায়দা লোটার চেষ্টাচরিত্তির চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো রাস্তা ছিল না ৷ আর ইংরিজিতে বুকনি ঝাড়তে পারলে হেভি সুবিদে হত — সায়েব ফাদার সায়েব মাদার বলে লালমুখোদের এঁড়ে তেল মাখানো যেত, মজাসে দিশি ছোটলোকদের চমকানো কি টুপি পরানো যেত ৷ তবু ইংরেজিওয়ালা টপ্ টপ্ ভদ্দরলোকদের মনটা চুপসে থাকত৷ চব্বিশ ঘন্টা গটমট ইংরিজি বলেও গোরা সায়েবগুলোর মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা দায়, দিনে পাঁচশবার ঝাড় খেতে হয়, বিলিতি খিস্তিখাস্তা মুক বুজে হজম করতে হয়, মায় চুনোগলির বেজম্মা ফিরিঙ্গিগুলো অব্দি ব্লাডি নিগার বলে মামাসি তোলে ৷ তাই মানইজ্জতে পয়জার খাওয়া ইংরিজিতে এগ্গাদা পাশ দেওয়া ভদ্দরলোকদের অনেকে মায়ের মুকের ভাষায় গপ্পোকবতে কি বইপত্তর লিখে বা পড়ে একটুখানি সোয়াস্তি পেতেন ৷ ঐ বাঙালিপনাটা ছিল বাবুদের বুকের বেথার মলম, ওটা ছিল সায়েবদের হুকুমদারির বাইরে ৷ খিদিরপুরের মদুসুদন দত্ত থেকে হাটখোলার সুদিন দত্ত পজ্জন্ত কোটপ্যান্টুলুন পরা বহুত তাবড় তাবড় দিশি ইংরিজিোয়ালাদের বাংলা বাজারটাই ছিল মাতা গোঁজার ঠেক ৷

তারপর বাপঠাকুদ্দার আমলের সেসব সখের প্রাণ গড়ের মাঠের দিন ভোগে গেল ৷ দুদুটো লড়াইয়ের হেভি কিচাইন, তিরিশের টাইমে দুনিয়া জুড়ে মালগন্ডার মন্দা — সায়েবদের জান কয়লা — বলা যায়, ও দুটো রগে উঠে গেল! দেখা গেল শেষমেশ সায়েবের বাচ্চারা  ফুটল ৷ তবে ওটা শুধু চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য, আসলে গোরারা রামু শামুর মতো ভোট পবলিককে ঢপের চপ গেলাল ৷ ব্রিটিশ লালমুখোগুলো নামকা ওয়াস্তে সটকে পড়ল, আসল ব্যাপারটা হল, একা শুধু ব্রিটিশ গোরারা নয় তাবৎ লালমুখোরা যেসব দেশ জবরদখল করে তার মাথায় গেঁড়ে বসেছিল সেগুলো একটার পর একটা লোক দেখানো কায়দায় ছেড়ে দিয়ে সবাই মিলেঝুলে একাট্টা হয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াবে বলে ঠিক করল ৷ মারদাঙ্গা করে, তার ওপর আবার বন্দে মাতাগরম বন্দে পেটগরমের ঝক্কি সামলে সায়েবদের আর পোষাচ্ছিল না, লাভের গুড় মাছিতে খাচ্ছিল ৷ ওদের মাথায় বাওয়া জিলিবির প্যাঁচ — ওরা দেশটাকে ভেঙে দুটুকরো করে রামওয়ালা আর আল্লাহোআকবরওয়ালাদের মধ্যে বেঁটে দিল, যাতে দুদলের কামড়াকামড়ি লেগে থাকে, তাঅলে ঘোলা জলে নির্ঝঞ্ঝাটে মাছ ধরা যাবে, হরবকত পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানোর সুবিদে  হবে ৷ বলতে কী সব সায়েবে মিলেঝুলে পেছন থেকে সুতো টানতে পারলে আর কোনো ঝক্কি পোয়াতে হবে না, মস্তিসে রস নিঙড়ে চুক চুক করে খাওয়া যাবে — হারামির বাচ্চা দিশি কেলে ভূতগুলো জাতির বাপের মতো নেংটি পরে আঁটি চুষবে ৷ এদ্দিন যারা সায়েবদের কাগজে পোছা হেগো পোঁদ চেটে এসেছে, গোরারা সেই দিশি ইংরিজিওয়ালাদের অত্থাৎ কিনা মেকলে সায়েবের বেজম্মা নাতিপুতিদের তখতে বসিয়ে দিয়ে গেল ৷ ঐ কেলে ইংরিজিওয়ালারা সায়েবদের ফেলে যাওয়া চেয়ারে সব গ্যাঁট হয়ে বসল, হয়ে উঠল গোরাদের নতুন ফিকিরের আড়কাঠি ৷ লালমুখোদের সুতো টানার মন্তর হয়ে থাকল ইংরিজি বুলি ৷ আর মেকলে সায়েবের ঐ বেজম্মা নাতিপুতিদের ছকে ইংরিজি বুলিটা দেশে আরো জবরদস্তভাবে মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসল ৷ নয়া জমানায় ঐ কেলে ইংরিজিওয়ালাদের আর মাতা গোঁজার ঠেকের দরকার রইল না, ওরাই হয়ে উঠল দেশের মাতা — কথায় বলে, ছাতুবাবু লাটুবাবু হয়ে গেল গায়েব ৷ এবার সায়েব তো সায়েব কেলে সায়েব ৷৷ কিম্বা, রাধাকান্ত নবকেস্ট একে একে গেল সবাই অক্কা ৷ এখন শুধু কেলে সায়েবরা মেরে যাচ্ছে দানে দানে ছক্কা ৷৷ ওদের সবাই — মেজ সায়েব, সেজ সায়েব, ছোট সায়েব আর ন সায়েবরা সবাই সুটবুট চাপিয়ে ভাসন দিতে লাগল — ইংরিজি হল আমাদের দিশি ভাষা নিজের ভাযা ৷ ও ভাষা ছাড়লে চলবে না ৷ আর বিলিতি ধলা সায়েবরা হল গিয়ে আমাদের দাদা ৷ (না না, মায়ের পেটের ভাই নয়, তুতো দাদা ৷ কোন তুতো? খুড়তুতো? মাসতুতো? পিসতুতো? নারে বাঞ্চোত না, ওসব দিশি তুতো নয়, খাঁটি বিলিতি সম্পক্ক — গাঁড়তুতো)

সায়েবি জমানায় মদুসুদন দত্ত থেকে ভবানী ভটচায্, সরোজিনী নাইডু অব্দি নেটিভদের বেশ দুচারজন ইংরিজিতে বই ছাপাত ৷ সায়েবদেরতো কথা বাদই দাও, এমন কী দিশি ভদ্দরলোকরাও তাদের বড় একটা পাত্তা দিত না ৷ লোকজন বলাবলি করত, ওসব হল গিয়ে ফিরিঙ্গি লেখা — অ্যাংলোইণ্ডিয়ান রাইটিং । এবার লালমুখোরা দেখল, ইংরিজি বুলিটা দেশের ঘাড়ে যত চেপে বসছে ওদের আঁখ মাড়াইয়ের কল গরগর ঘরঘর করে ততই বেড়ে চলছে, তেল দিতে হচ্ছে না। তাই ফায়দা তোলার আঁক কষে সায়েবরা কেলোদের মাথায় হাত বোলানোর জন্যে ফতোয়া দিল, কেলে সায়েবদের ইংরিজি মালগুলো মন্দ নয়। গোরা সায়েবের থুতু গেলা কেলো সায়েবদের বিশ ইঞ্চি ছাতি ফুলে ফেঁপে ছত্তিশ ইঞ্চি হয়ে উঠল। ওরা বুকনি ঝাড়তে লাগল, আমাদের ইংরিজি মাল আর অ্যাংলোইণ্ডিয়ান নয়, ইন্দোঅ্যাংগ্লিকান । গোরারা এসব কেলেদের দুচারবার কালাপানি পার করে বিলেতআমেরিকা মুল্লুকে চক্কর দিইয়ে আনল। কেলেরা হেভি লেজ নাড়াতে লাগল। আনকোরা বিলিতি কোটপ্যান্টুলুনে ঘেমে নেয়ে ওরা লেকচারে লেকচারে অন্ধকার করে দিল। যোদো মোধোরও হুঁশ হল। ইংরিজি বুলি রপ্ত না থাকলে টু পাইস কামানো যাবে না, পাড়ায় ইজ্জত থাকবে না, মায় মেয়েকে কোনো একটা মন্দের ভালো পাওরের গলায়ও ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে না। ফটাফট ইংরিজি বকতে না পারলে ছেলেপিলেকে লাফাঙ্গা হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হবে, বাপের হোটেলে খেয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করতে হবে। যোদো তার ছেলেকে বাপের ইংরিজি বকা লালু ছেলে বানাবার জন্যে ঘটিবাটি বন্দক দিয়ে ইংরিজি গোয়ালে ঢুকিয়ে দিল। মোধো পেটে গামছা বেঁদে এগ্গাদা নোট খসিয়ে মেয়েটাকে ধুমসো কেলে মেমসায়েব আন্টিদের জিম্মায় পৌঁছে দিয়ে এল। এবার বাড়ির মধ্যে ইঞ্জিরি বকা শুরু হয়ে গেল। আন্ডাবাচ্চা আর বাড়ির কুত্তার সঙ্গে ইয়েসনোকামগো সিটইট বলে ইঞ্জিরি না ফাটালে আর চলে না। যোদোর লেড়েকুত্তা ভুলোর নতুন নাম দেয়া হল টমি। মোধোর বাড়ির মেনি বেড়ালটা হয়ে গেল পুসি। পাড়ার কাকা, জেঠা আর কাকা, জেঠা রইল না, হয়ে গেল আংকল ; জেঠিমা, খুড়িমা, মাসিমা, পিসিমা, গুষ্টিশুদ্দু সব ঝেঁটিয়ে আন্টি।

বাপঠাকুদ্দার আমলে দেশে জাতফাত নিয়ে হরবকত হেভি ঝামেলা লেগে থাকত: বামুন, বোদ্যি, কায়েত, শুদ্দুর, নম শুদ্দুর, বড়জাত, ছোটজাত, জলচল. জলঅচল, নবশাখ, হেলে কৈবত্ত, জেলে কৈবত্ত আরো কতো যে ঘোট! ওসব ভোগে গেছে, নম শুদ্দুরের হোটেলে কুলীন রাঢ়ী বামুনের ছেলে বাসন মাজছে, বারিন্দির বামুনের মেয়ে জাতে জেলে কৈবত্ত ছেলেকে লভ মেরেজ করে দিব্যি ঘর করছে ৷ দিনকাল পালটে গ্যাছে, আজকাল কেউ ওসব নিয়ে মাতা ঘামায় না, ধোপা নাপিত বন্দ করে একঘরে করার দিন চলে গ্যাছে, ৷ এখন জাতপাতের নতুন ছক ৷ এই নতুন ছকের মাপকাঠি হল গিয়ে কে কতটা ইংরিজিতে সরগর তার ওপর ৷ তুমি গুরু গটমট করে ইংরিজি বল আর ঘ্যাচঘ্যাচ করে ইংরিজি লেখ ৷ তুমি হলে বামুন, তাতে যদি আবার সায়েবি ইস্কুল থেকে বেরুনো হও, ইংরিজি বলার সময় কথার আদ্দেকটা চিবিয়ে খেয়ে ফেল, বাড়িতে চাকরবাকর আর ডেরাইভার ছাড়া সবার সঙ্গে ইংরিজি বল তাহলে তুমি হলে গিয়ে নৈকষ্য কুলীন ৷ এর পর যারা দিশি কায়দায় কোনোরকমে ইংরেজি বলে আর লেখে তারা হল যজমেনে বামুন ৷ আর যারা কানার মধ্যে ঝাপসা দ্যাখে অত্থাৎ ইংরেজি বলতে গেলে ঘন ঘন ঢোক গেলে, আর লিখতে গেলে মাথা চুলকিয়ে মাথায় প্রায় টাক ফেলে দেয় তারা হল গিয়ে বোদ্দি কি কায়েত, তারপর রয়েছে যারা কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ইংরেজি দুচার লাইন পড়তে পারে তবে বলতে গেলে সব গুলিয়ে যায়, বুকের ভেতর ধপাস ধপাস করে এরা জলচল — বলা যায় নবশাখ ৷ এর পরের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লোক হল জলঅচল আর অচ্ছুৎ ৷

লোকে বলে, গোরারা নাকি কেটে পডেছে ৷ তার মানে দেশ নাকি স্বাধীন হয়ে গেছে ৷ এখন সবার নাকি সমান অধিকার ৷ কী বললে? ঢপ? ঢপ হতে যাবে কেন? তোমার কি চোখ বলতে কিছুই নেই? দেখতে পাচ্ছনা সবাই স্বাধীন দেশের নাগরিক, মাথাপিছু সবার একটা করে ভোট ৷ তবে একথাটাও মিথ্যে নয় যে ঐ ভোটেই শুরু আর ঐ ভোটেই শেষ ৷ তোমরা হলে গিয়ে ছোটলোক পবলিক, তোমরা যে ভোট দিতে পারছ ওটাই তোমাদের চোদ্দপুরুযের ভাগ্যি, ভোটের কাগজটা বাক্সে গুঁজে দিয়েমুখ বুজে শুনসান ফুটে যাও ৷ দেশের আইনকানুন, সরকারি চিঠিপত্তর, দলিলদস্তাবেজ, কাজকম্ম সবই ইংরিজিতে, তোমার হুদ্দোর বাইরে ৷ তুমি ইংরিজিতে পোক্ত নও, তুমি শালা জলঅচল ছোটজাত! ইংরিজির শাসন যুগ যুগ জিয়ো! মেকলে সায়েবের বেজম্মা নাতিপুতিদের রাজত্ব চলছে চলবে!

ঐ যা বলছিলাম, সায়েবরা দুঁদে মাল, ওরা বুঝতে পারল ওদের ছক দুয়ে দুয়ে চার হতে শুরু করেছে। রস চাখতে চাখতে লালমুখোদের মালুম হল, খেলটা হেভি জমে উঠেছে, আর গোটাকয়েক দানেই কিস্তি মাৎ । তারা দিশি ইংরিজিয়ালাদের বেশ করে পিঠ চাপড়ে দিল, কেলেদের ইংরিজি বইপত্তরের তারিফ করতে লাগল মায় দুচারটে প্রাইজ ফাইজও ঠেকিয়ে দিল। তোল্লাই খেয়ে ফুলে ওঠা দিশি কেলে সায়েবরা বাওয়াল শুরু করে দিল। বুঝলে, আমাদের মাল হচ্ছে দিশি ইংরিজি। বিলিতি ইংরিজিতে বেশ কিছু খাদ ঢুকে পড়েছে — আমাদের মালটা যোল আনার ওপর বত্তিশ আনা খাঁটি ; আমাদের হল গিয়ে ইন্ডিয়ান ইংলিশ। (মা শেৎলার নামে কিরে খেয়ে বলছি, পেছন থেকে হারামির গাছ কেউ একটা ফুট কাটল, জাঙিয়ার বুকপকেট আর কি !) বাজারে বাংলা কাগজগুলোর বাঙালি বাবুরা ঐ সায়েবি ইংরেজি বুলিতে খুব একটা রপ্ত নয়। ওদের মধ্যে দুচাজ্জন — যারা কানার মধ্যে ঝাপসা দেখে — ওদেরও বুলিটা পেটে আসে তো মুখে আসে না। ওরা তো তুলকালাম ধুমধাড়াক্কা লাগিয়ে দিল। অমুক দিশি সায়ের আর তমুক কেলে মেমসায়েব ইংরিজিতে বই ছাপিয়েছে। সে বই বেরিয়েছে খোদ বিলেত মুল্লুক থেকে। তার ওপর তিন তিনটে বিলিতি কাগজে কেলে মেমসায়েবের বগলকাটা মেনা দেখানো ফোটো উঠেছে। যাই বলো বস্, কেলি আছে ! আর শালা, কথায় বলে, মাগির মাগি লেউইনস্কি, নেশার নেশা হুইস্কি ; পেশার পেশা দালালগিরি, বুলির বুলি ইঞ্জিরি। ওর সঙ্গে বাংলা বুলির কোনো কমপারিজন চলে ? — কোথায় গালের তিল আর কোথায় হাইড্রোসিল ! চাঁদে আর পোঁদে ? বাংলা কাগজয়ালাদের বুকের ভেতরটা সারাক্ষণ ঢিপ ঢিপ করে, পাছে পাবলিক ওদের পট্টিটা ধরে ফেলে — বুঝে ফেলে ওদের ইংরিজি বুলির দখলদারি তেমন পাকাপোক্ত নয়। তাই ঐ বাংলা কাগজয়ালারাই সারাক্ষণ ইংরিজির ঢাক পিটিয়ে কানে তালা লাগিয়ে দেয়।

তাঅলে বল এখন বাংলা বুলির হালটা কী ? বাংলা মাল আর বাংলা বুলি চলছে চলবে। তবে বস্, চাদ্দিকের ইংরিজির ধামাকায় বাংলাটা আর গিয়ার খাচ্ছে না। ওদিকে হিন্দিয়ালারাও তড়পাচ্ছে, আরে রাষ্ট্রভাষা বোল। তা যা বলছিলাম, বাংলা বুলির হাল। বাংলা এখন পুরোপুরি গরিবগুর্বো, ছোটলোকদের বুলি। ফেকলু চাকরবাকর, বাজারের মাছয়ালা, আনাজয়ালা, আর গাঁয়ের চাষাভুষোর বুলি হল গিয়ে বাংলা। পাত্তি বানাতে চাও, জ্ঞানফ্যানের বেওসায় নাক গলাতে চাও, মানইজ্জত পেতে চাও, পাঁজ্জন ঘ্যাম লোকের পাশে কি সামনে চেয়ারে বসে পা নাচাতে চাও, বিলিতি মালে চুমুক দিতে দিতে ঝিং চাকচাক ডিস্কো মিউজিক শুনতে চাও, মায় ঠোঁটে গালে রঙ লাগানো জিন পরা ফ্রেশ ডবকা মাল কি জম্পেশ মেয়েছেলে তুলতে চাও — তোমার মুখ থেকে বাওয়া ইংরিজির পপকর্ন ফোটাতে হবে। (তুইত শালা আচ্ছা টিউবলাইট! ওসব খৈমুড়ির দিন কবে চলে গেছে ! দেখিস না ভদ্দরলোকেরা আর ঝলমু়ড়ি খায় না। গলির মোড়ে সবে চুলকুনি জাগা বাবুদের বাড়ির নেকি মেয়েগুলো ইংরিজিতে খুক খুক হাসতে হাসতে হলিউড থেকে আসা পপকর্ন আর বলিউড থেকে আসা ভেলপুরি খায়।)। হ্যাঁ, যা বলছিলাম ননেস্টপ ইঞ্জিরি বকে যেতে হবে আর সঙ্গে সঙ্গে খচাখচ ইঞ্জিরি লিকতে হবে। (পেছন থেকে আরেক বাঞ্চোতের বাচ্চা অ্যাড করল, সকালে দাঁতন দিয়ে দাঁত মেজে রুটিমুটি খেয়ে হাগতে যাওয়া চলবে না, দুপুরে আর রাতে পাত পেতে গাণ্ডে পিণ্ডে গেলা যাবে না। টুথব্রাস করে ব্রেকফাস্ট সেরে টয়লেটে যেতে হবে, ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ আর ডিনার করতে হবে। — মাইরি বলছি, এই ছোটলোকদের কথায় কিছু মাইণ্ড করো না, বস্। বাপের ক্যাপফাটা এসব ছেলেপিলেদের আর মানুষ করা গেলনা!)

কী বলছিলে ? বাংলা বলতে চাও ? বাংলায় লেকালিকি করতে চাও ? মাতাফাতা সব ঠিক আছে ত ? মায়ের ভাষা বাংলা — তাই ত ? চাঁদ আমার মানেওটা। তবে দেখ বাওয়া, ঐ মায়ের ভাষার টানে পোঁদের কাপড় যেন মাতায় উঠে না যায় ! (ঐ যে দেসাওবোদক গান আছে, ঐ যে সেই রজনী সেনের গান — মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই — ছেলের মাঅন্ত প্রাণ, মাতাটা তাই পুরো গেছে, একটা ইসকুরুও আর টাহট নেই। বোঝ ঠ্যালা ! মায়ের দেওয়া কাপড়ে পোঁদ না ঢেকে ওটা মাথায় বেঁধে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে যাচ্ছে !) হ্যাঁ, এতক্ষণে মালটা ক্যাচ করেছি। তার মানে ইংরিজি বুলিটা তোমার ঠিকঠাক আসে না। তুমি শালা ভদ্দরলোকদের দলে পাত পাও না। কী আর করবে, কপালের নাম গোপাল। এখন ছোটজাতদের বাংলার দলে ঢুকে পড়। ছোটলোকদের সঙ্গে গা ঘসাঘসি কর,ও দুটো চুলকোতে চুলকোতে বাংলা বুলিতে গ্যাঁজাও। যত খুশি হ্যাজাতে চাও হ্যাজাতে পার তবে জ্ঞান মারিও না — তাঅলে চারপাশের বুড়ো হাবড়া থেকে ক্যাওড়া ছোঁড়ারা সব্বাই মিলে প্যাঁক দিয়ে গুষ্টির তুস্টি করে ছাড়বে। আর বাংলায় লেকলিকি করবে ? কর — কেউতো তোমায় বারণ কচ্ছে না। তবে কিনা লেকালিকির কথা বলতে গেলে পড়াপড়ির কথাটাও তুলতে হয়। ভদ্দরলোকের বাচ্চারা, বলতে গেলে যেসব মালপয়মালরা একআদটু ক্যাটম্যাটস্যাট ইংরিজি বুলি রপ্ত করেছে তারা কেউ বাংলা লেকালিকি শুঁকেও দেখে না, বাংলায় ছাপা বইয়ের লেজ উল্টেও দেকতে চায় না মালটা কী, গোরু না বকনা। অবশ্যি যে হোঁচট খেতে খেতে নাকানিচোবানি খেয়েও ইংরিজি বই পড়তে পারে সে বাংলা পড়তে যাবে কোন দুঃখে, তুমিই বল। এক ছোটলোক ছাড়া কেউ আর বাংলা বইয়ের পাতা ওলটায় না। ছোটলোক, ছোটজাত — তার মানে ইংরিজিতে যাদের ক অক্ষর গোমাংস, আর যারা বাপমায়ের খুচরো পাপে কখনো ইংরিজি ইস্কুলের মুখ দেখতে পায় নি, আর গরিবগুর্বোর ঘরের যত অগামারা অপোগণ্ডের দল — চোদ্দবার ফেল মেরে শেষ অব্দি কেঁদে ককিয়ে দুএকখানা পাসের চোতা জুটিয়েছে, ইংরিজি পড়তে গেলে চোখে সর্ষেফুল দেখে এরাই হল গিয়ে বাংলা বইয়ের খদ্দের ৷ এছাড়া ধ্যাদ্দেরে গোবিন্দপুরের কিছু আতাক্যালানো দেহাতি — পাড়াগাঁয়ের বাংলা ইস্কুলে যারা হালে পড়াশোনা শেষ করেছে, যাদের চোদ্দগুষ্টি কখনো ইস্কুলের পত মাড়ায় নি, আর কিছু কেরানি কি দোকানদারের বউ — পাঁচপাঁচবার বিয়োনোর পর এখন মুটিয়ে আলুর বস্তা বনে গেছে, দুপুরবেলা পান চিবুতে চিবুতে টিভি দেখার পর কিছুক্ষণ বাংলা বহটই ঘাঁটাঘাঁটি করে, ইংরিজি অক্ষর দেখলেই ওদের বুকের ভেতরটা কাটা ছাগলের মত ধপাস ধপাস করতে থাকে। এই সব এলেবেলে লোকজন, এদের তো আর ভদ্দরলোক বলা যায় না। বাংলায় লেকালিকি করবে ? লেক শালা এদের জন্যে। তার বেওস্থাও আছে। বাংলা বইয়ের হাট। উত্তর থেকে গেলে ঠনঠনেতে মায়ের পায়ে পেন্নাম ঠুকে আর দক্ষিণ থেকে এলে হাড়কাটার মাগিদের বারকয়েক কানকি মেরে কলেজইষ্ট্রিট পাড়ায় ঢুকে পড়। ওটা হল গিয়ে বইপাড়া। চাদ্দিকে গলিঘুঁজি জুড়ে মায় পেচ্ছাবখানার দেয়াল ঘেঁসে বইয়ের হাটের হাটুরেদের সার সার দোকান। বইয়ের পসরা সাজিয়ে অনেকে রাস্তার ওপর বসে পড়েছে। এরা সব বাংলা বই ছাপায়। ঐ যে আমাদের হুগলি জেলার জকপুকুর গ্রামের হারান ঘোষের দুনম্বর বৌযের চারনম্বর ছেলে ঘোঁৎনা গন্ডায় গন্ডায় উজবুককে জক দিয়ে আর উদগান্ডুর মাথায় কাঠাল ভেঙে বেশ মালকড়ি হাতিয়ে আর ঘোঁৎনা রইল না নিবারণবাবু বনে গেল ৷ ঘোঁৎনা ওরফে নিবারণবাবু কলকাতার বইপাড়ায় এসে পেল্লাই একটা দোকান হাঁকিয়ে বসল — ইংরিজিতে তার সাইনবোর্ড — শ্রী শ্রী নিউ কালিমাতা ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং এন্টারপ্রাইজ। নিবারণবাবু ওরফে ঘোঁৎনা এখন শয়ে শয়ে মেয়েছেলে নিয়ে টানাটানি লটকালটকি লদকালদকির রগরগে গপ্পের গাবদা গাবদা বাংলা বই ছাপিয়ে বাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে ফেলেছে, দলবাজি করে প্রকাশক সমিতির সম্পাদক বনে গেছে ৷ সারাক্ষণ সে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে যে বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির জন্যই সে তার জীবন দিচ্ছে। তা যা বলছিলাম, বাংলা লেকালিকির কথা। তা যা বলছিলাম, বাংলা লেকালিকির কথা। এগ্গাদা কাগজ, এতগুলো ঢাউস পুজোসংখ্যা আর বইয়ের হাট — এই নিয়ে লেকালিকির বাংলা বাজার। খেলসা করে বলতে গেলে, দিশি আর চুল্লুর ঠেক আর ঘুপচি ঘাপচি মেরে এখানে ওথানে কিছু তাড়ির ঘড়া। বাংলায় যাঁরা লেকালিকি করেন তাঁরা হরবকত মাল বানিয়ে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছেন — নানান রসের গাদাগুচ্ছের গপ্পোউপন্যাস। হাটুরেরা সেগুলো বেচছেন —খাঁটি বাংলা মাল, দুনম্বর আর তিননম্বর সি এল, ব্লাডারের চুল্লু, আর মাটির ঘড়ার তাড়ি। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু পাগলাচো…  এরা বানাচ্ছে গ্যাঁজলা ওঠা কবতে। এরা নিজেরাই তা বাজারে ছাড়ছে। ঐ মাল দুয়েকজন পবলিক একআদ ঢোক গিলতে ট্রাই করে কুলকুচি করে ফেলে দেয়।

আবার ইংরিজিওয়ালা বাঙালি জ্ঞানের কারবারিদের মধ্যে দুচাজ্জনের দয়ার শরীর। কালেভদ্রে ওঁরা বাংলা বাজারে দর্শন দেন। ছোটলোকদের কথা ভেবে ওঁদের পাঁজরায় ব্যথা হয়। হাজার হলেও দেশতুতো সম্পক্ক ! তাছাড়া এসব জ্ঞানের বেওসায়িরা আগে সবাই ছাত্তর ঠ্যাঙাতেন। তাই জ্ঞান দেওয়ার স্বভাবটাও পুরোদমে রয়ে গেছে। ওঁরা হাটুরেদের ঝুলোঝুলিতে ঢেঁকি গেলেন — দু একটা বাংলা মাল নাবিয়ে দেন। সবাই যুগ যুগ জিয়ো বলে চেল্লায়। তবে কিনা বাংলাপড়া ছোটলোকগুলো সব মাতামোটা, ধুর — তার ওপর ওদের বাংলা বুলিটাও জ্ঞানের শক্ত শক্ত বুকনি ঝাড়ার জন্য সেরকম পোক্ত নয়। তাই জ্ঞানবাবুরা ইংরিজি মালের রঙটা ফিকে করতে করতে উড়িয়ে দেন — একটুখানি এসেনস দিয়ে খুব পাৎলা করে একটা বাংলা পাঁচন ছাড়েন। ইংরিজিতে যা দেওয়া হয় তা বাংলায় দিলে সেটা ছোটলোক পাবলিকের পেটগরম করবে, বুকে কষ্ট দেবে, মাতায় ঘোট পাকাবে। ছোটলোকদের দিতে হলে দুয়েক ফোঁটা বিলিতি মাল এক গেলাস টিপ্ কলের দিশি জল মিশিয়ে দিতে হয়, যা ওদের পেটে সয়।

এ সমস্ত বাদ দিয়ে বাংলা বাজারে আরেক কিসিমের কিম্ভুতকিমাকার মাল বিক্রি হয়। এ মালগুলো যাঁরা বানান তাঁরা হলেন গিয়ে ম্যাস্টর, বিশেষ করে বাংলার ম্যাস্টর। বেচারারা ছোটলোকদের বুলির ম্যাস্টর বলে এমনিতেই পোঁদের ফাঁকে লেজ গুঁজে সিঁটিয়ে থাকেন। না ছাত্তর না চারপাশের পবলিক, কেউ ওঁদের মানুষ বলে গন্যি করে না। সেই খার থেকে ওঁরা ঘরের কোণে বসে গাবদা গাবদা বই বানিয়ে বাজারে ছাড়েন। ঐ মালগুলোর আদ্ধেক হেন্ সায়েব আর তেন্ সায়েবের ইংরিজি বুকনিতে ঠাসা থাকে, আর বাকি আদ্ধেকে থাকে বাংলায় ওসব সায়েবি বুকনি নিয়ে ভুলভাল মানে করে আলটুফালটু কপচানি, ভাট বকা আর হ্যাজানো। তার মধ্যেই আবার এগগাদা সায়েবের প্যান্টুলুন আর মেমসায়েবের গাউন ধরে জাতীয়তাবাদী টানাটানি। আসলে বেচারা ম্যাস্টররা শো করেত চান, বাংলার ম্যাস্টর হলে কী হবে, ওঁরা ফেলনা নন, ইংরিজি পড়ে ওঁরা নিজের পছন্দমাফিক একটা মানে আন্দাজ করে নিতে পারেন। আর ইতিমদ্ধে নামজাদা সব সায়েবের এন্তার বিগ বিগ বই নিয়ে সব ফিনিস করে দিয়েছেন। তবে কিনা স্রিফ দেসওয়ালি আম জন্তার কথা ভেবে দিল দিওয়ানা হয়ে যায় বলে বাংলা বুলির জন্যে জান লড়িয়ে দিচ্চেন, জিন্দিগি বরবাদ কচ্চেন ; তা নইলে কবে শালা বিলেতে গিয়ে সাদা চামড়ার আঁতেলদের জিগরি দোস্ত বনে যেতেন। আর অসুবিদেটাই বা কী ছিল ? ওসব বার্তফার্ত, বাখতিনটাকতিন, স্ট্রাকচারমাকচার, পাওয়ারফাওয়ার, ঘনাদা, টেনিদা, দেরিদামেরিদা — সবই তো ওঁদের কবে জলভাত হয়ে গেছে!

কী বলছ? এসবের পরও তুমি বাংলা বুলিতে লেকালেকি করতে চাও ! তা কী লিকবে বলো ৷ গপ্পো না কবতে? বাংলায় গপ্পো, কবতে ছাড়া আর কীইবা লেখা যায়? মাতাটা যখন গেছে, ইংরিজি বুলিটাও তেমন আসে বলে মনে হয় না তখন আর কী করা ৷ যাও — বাংলা বাজারে ঢুকে পড়, যত মাল পয়মালদের সঙ্গে বার দোয়ারি কী খালাসিটোলায় বেঞ্চিতে পোঁদ ঠেকিয়ে বাংলা টেনে আতাক্যালানো দেহাতি আর ছোটলোকদের জন্যে বাংলা বুলিতে লেকালেকি শুরু করে দাও ৷ জিন্দিগি চোরপোরেশনের ভ্যাটে ফেলে দিতে চাও, দাও ৷ আমার কী এসে যায় ? গরিব কায়েতের ছেলে নেইকো কোনো কতাতে ৷ কেলোর পোঁদ ভুলোয় মারে দাঁড়িয়ে দেকি তপাতে ৷৷ — সব বুঝে শুনে আমি এখন বাপঠাকুদ্দার মুখে শোনা এই নীতিই মেনে চলেছি ৷

এতটা লিখে চোতাটা একজন জানপয়চান বড়বাবুকে দেখালাম ৷ বললাম, বস্ উলটোপালটা বকেছি,মালটায় একটু চোখ বুলিয়ে   দাও ৷ বাবু সেদিন ইংরিজিতে মার্কিন মুল্লুকের আজকালকার লিখিয়েদের লেখায় সেলেং (বাংলা বুলির ম্যাস্টররা বলে অপভাষা অত্থাৎ কিনা তোমার আমার মতো রামা শ্যামা যোদো মোধোর বুলি) বেবহারের ফরে বক্তিমা দিয়ে এসেছেন ৷ দুচার লাইন দেখেই তিনি লেখাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, বললেন, ন্যাস্টি, একে বাংলা, তার ওপর গুন্ডা বদমাসদের অবসিন ভাষা, কোনো ভদ্দরলোক এসব পড়তে পারে ?

ঠিক! একশ পঞ্চাশ ভাগ রাইট! ঐ যে বাগবাজারের অম্রেতবাজারি জয়গৌর মার্কা ঘোষবাড়ির নামকেত্তন করা বোস্টম জামাইয়ের বানানো আর এখন তার আমেরিকাভজা নাতিপুতিদের চালানো সুতারকিন গলির আনন্দবাজার পত্রিকা হরবকত বাংলা ভাষার গুষ্টির তুষ্টি করে ৷ ভদ্দরলোকদের বুলিতে বলতে হয়, সাধু ভাষায় তিরস্কার করত চতুর্দশ পুরুষকে উদ্ধার করে ৷ কেউ বাংলা ভাষার হয়ে রা কাড়তে গেলেই আনন্দবাজার তাকে বাংলাবাজ বলে হেভি খিস্তিখাস্তা করে — সাধু ভাষায় বলতে গেলে সুকঠিন ভাষায় ভর্ৎসনা করে (সাধু ভাষা বোঝ না যাদু? বুঝবেটা কী করে! চব্বিশ ঘন্টা গলির মোড়ে ছোটলোকদের সঙ্গে গুলতানি করছ, শোন , সাধু ভাযা হল গিয়ে তোমাদের চোর ভাষার উলটো) ৷ ভদ্দরলোক বাঙালির প্রাণের বাংলা কাগজ আনন্দবাজারের কেত্তন হল হল ‘এস হে মার্কিনি চন্দ্র সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে করি, এস হে’, মনপছন্দ্ হল ইংরিজিখোররা৷ বল গুরু, ওয়ার্ল্ডে কোথায় এমন আরেকটা কাগজ রযেছে যা যে বুলিতে বেরয় তারই খাল খিচে দেয়ার জন্য সারাক্ষণ রেডি থাকে! সত্যিই তো ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ ৷

এই হল গিয়ে বাংলা বুলির হাল! ইস্কুলে যা পড়েছিলে তা তো কবে খেয়ে হজম করে ফেলেছ, হক কথা বলা একটা লাইন মনে পড়ছে ? তবে শোন: আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্চোত ভূমি বঙ্গে!


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান